ফিতরা : ফাজায়েল ও মাসায়েল
ফিতরা কার ওপর ওয়াজিব?
প্রত্যেক মুসলমান নর-নারী, যার মালিকানায় মৌলিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার মূল্য সমপরিমাণ সম্পদ রয়েছে— তার ওপর ফিতরা ওয়াজিব হয়। প্রত্যেকে তার নিজের পক্ষ হতে এবং তার নাবালেগ সন্তানের পক্ষ হতে ফিতরা আদায় করবে। টাকা-পয়সা, সোনা-রূপা, অলংকার, বসবাস ও খোরাকির প্রয়োজনে আসে না এমন জমি, বসবাসের অতিরিক্ত বাড়ি, ব্যবসায়িক পণ্য, অপ্রয়োজনীয় আসবাবপত্র— এসবকিছুর মূল্য ফিতরার নেসাবের ক্ষেত্রে হিসাবযোগ্য।
উল্লেখ্য, যাকাত ফরজ হওয়ার জন্য নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হতে হয় এবং ওই সম্পদ পুরো এক বছর তার মালিকানায় থাকতে হয়। কিন্তু ফিতরার ক্ষেত্রে ওই পরিমাণ সম্পদ একবছর অতিবাহিত হওয়া আবশ্যক নয়, বরং রমজানের শেষের দিন ওই পরিমাণ সম্পদের মালিক হলেই ফিতরা ওয়াজিব হয়ে পড়ে।
.
রোযার পূর্ণতা অর্জনে ফিতরা
রোযা শেষে প্রত্যেক সচ্ছল ব্যক্তি নিজের এবং পরিবারের সবার পক্ষ থেকে ফিতরা আদায় করতে হয়। এরূপ আর্থিক অনুদানে দেশের অসহায় গরীব-মিসকিনদের জীবনে কিছুটা হলেও স্বাচ্ছন্দ্য আসে, তাদের জীবনেও বয়ে আনে ঈদের খানিকটা আনন্দ। অন্যথায় বিদ্রোহী কবির জিজ্ঞাসা :
‘জীবনে যাদের হররোজ রোযা ক্ষুধায় আসে না নিদ্,
নিদ্হারা সেই গরীবের ঘরে এসেছে কি আজ ঈদ?’
রমজানের রোযা পালন করতে গিয়ে ছোটখাট অনেক ত্রুটি-বিচ্যূতি হয়ে যাওয়া একেবারেই স্বাভাবিক। দীর্ঘ এক মাস রোযা পালনে কোনো ঘাটতি থাকলে ফিত্রার মাধ্যমে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তা পূর্ণ করে দেন।
আবু দাউদ শরিফের হাদিসে এসেছে আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত :
فَرَضَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- زَكَاةَ الْفِطْرِ طُهْرَةً لِلصَّائِمِ مِنَ اللَّغْوِ وَالرَّفَثِ وَطُعْمَةً لِلْمَسَاكِينِ.
অর্থ : রাসূল সা. সাদকায়ে ফিতর নির্ধারণ করেছেন রোযাকে অনর্থক কথা ও অশ্লীল কার্যকলাপ হতে পবিত্র করা এবং গরিবদের মুখে অন্ন দেওয়ার জন্য। [হাদিস নং- ১৬১১।]
...
ফিতরা ওয়াজিব হওয়ার দুটি যুক্তি
উপর্যুক্ত হাদিসে ফিতরা ওয়াজিব হওয়ার দুটি যুক্তি তুলে ধরা হয়েছে।
প্রথম যুক্তি : যা রমজান মাসের রোযাদারদের সাথে সম্পৃক্ত। রোযা পালনকালে তারা কোনো বেহুদা ও অনর্থক কথা বলতে পারে, কিংবা কোনো অশ্ল¬ীল ও শরিয়তনিষিদ্ধ কাজে জড়িয়ে পড়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে। কেননা, রোযা তো তাই যা মুখ ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পালন করে। কারণ রোযা থাকে পেট ও যৌনাঙ্গে। রোযার সংজ্ঞা হল :
هُوَ الِامسَاكُ عَنِ المُفَطِّرَاتِ الثَّلاَثَةِ : الأكْلِ و الشُّربِ والجِمَاعِ
‘খাওয়া, পান করা ও স্ত্রীসহবাস থেকে বিরত থাকার নাম রোযা।’
কাজেই রোযাদারের মুখ, কান ও চক্ষুদ্বয়, হাত কিংবা পা আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সা. কর্তৃক নিষিদ্ধ কথা-কাজ দ্বারা কলুষিত হলে, সে ক্ষমার অযোগ্য হয়ে যাবে। আর মানবীয় দুর্বলতার দরুন রোযাদার সাধারণত এসব থেকে রক্ষা পেতে পারে না। এ কারণে রোযা শেষ হওয়ার পর এর যাকাতের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ঠিক গোসলের মতো, শরীর দুর্গন্ধ ও নাপাক হলে। কেননা, ভালো ও উত্তম কার্যাবলি খারাপকে ধুয়ে মুছে দেয়— এতো সবার জানা।
যেমন- শরিয়তের বিধানদাতা পাঁচওয়াক্ত ফরজ নামাযের সাথে নিয়মিত সুন্নত নামায চালু করেছেন। কেননা, ফরজ নামাযে কোনো ত্রুটি বা নিয়ম পালনে ভুল হয়ে যেতে পারে। কোনো কোনো ইমাম এ ব্যবস্থাকে ‘সাহু সিজদার’ সাথে তুলনা করেছেন। ইমাম শাফেয়ির উস্তাদ ওয়াকী ইবনুল জাররাহ রহ. বলেছেন, “রমজান মাসের জন্য ফিতরের যাকাত নামাযের ‘সাহু সিজদা’র সমতুল্য। তা রোযার ত্রুটি-বিচ্যুতির ক্ষতিপূরণ করে দেয়। যেমন- সাহু সিজদা নামাযের ত্রুটির ক্ষতিপূরণ করে”।
আর দ্বিতীয় যুক্তি : যা সমাজ-সমষ্টির সাথে সম্পৃক্ত। সমাজের সর্বত্র— বিশেষ করে গরিব-মিসকিন ও অভাবগ্রস্ত লোকদের মাঝে ভালোবাসা, সম্প্রীতি ও আনন্দ ছড়িয়ে দেওয়া।
কেননা, ঈদ তো সাধারণভাবে আনন্দ-ফুর্তির দিন। কাজেই সেদিন সমাজের সমস্ত লোক যাতে সকল ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে আনন্দে যোগদান করতে পারে— এর ব্যবস্থা করা একান্ত কাম্য ও বাঞ্ছনীয়। কিন্তু মিসকিনরা কখনোই আনন্দ লাভ করতে পারে না, যদি কেবল ধনী ও সচ্ছলরা রসনাবিলাস ও পেটপূজায় মেতে উঠে। শুধু তারাই চর্ব-চূষ্য-লেহ্য-পেয় ভোগ করে। আর এ মহা আনন্দের দিনে তাদের মুখে দু’মুঠো খাবারও জুটে না, জঠরজ্বালা নিবারণের ন্যূনতম উপকরণও মিলে না ।
এ কারণে শরিয়তের যৌক্তিক দৃষ্টিকোণ এ দিনে এমন ব্যবস্থা গ্রহণের অপরিহার্যতা মনে করেছে, যার ফলে অভাবীরা অভাব ও ভিক্ষার লাঞ্ছনা থেকে মুক্ত থাকতে পারে। উপরন্তু তার মনে এ চেতনাও জাগবে যে, সমাজ তাকে ভুলে যায় নি। তাকে উপেক্ষা করে নি। বিশেষ করে এ জাতীয় আনন্দ ও উৎসবের দিনে। সে কারণেই হাদিসে বলা হয়েছেÑ أَغْنُوهُمْ فِى هذا اليَوم ‘তোমরা এ দিনে তাদের সচ্ছল করে দাও।’ [নাসবুর রায়া : খ. ২, পৃ. ৪৩২]
শরিয়তের বিধানদাতা ফিতরার ওয়াজিব পরিমাণটা হ্রাস করে দিয়েছেন এবং লোকেরা নিজেদের খাদ্যদ্রব্য থেকে যাতে সহজেই দিতে পারেন, সে ব্যবস্থাও করেছেন। এজন্য ফিতরা ওয়াজিবের ক্ষেত্রে লঘু শর্তারোপ করেছেন, যেমনটি যাকাতে করেন নি। যেন সম্ভাব্যভাবে জাতির বৃহত্তর জনগোষ্ঠী এ মহা উৎসবে অংশগ্রহণ করতে পারে। এ মহান উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই শরিয়তে তাৎক্ষণিক অবদান হিসেবে ‘সাদাকাতুল ফিত্র’ ওয়াজিব করার এ মহান ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। [ড. ইউসুফ আল-কারযাবীর ফিকহুয যাকাত]
...
কী দিয়ে ফিতরা দিতে হবে এবং পরিমাণ কতটুকু?
গম, আটা বা ময়দা, ছাতু কিংবা কিশমিস অর্ধ সা অথবা সমপরিমাণ মূল্য। আর খেজুর বা যব এক সা অথবা সমপরিমাণ মূল্য দ্বারা ফিতরা আদায় করা যাবে।
অর্ধ সা- ১ কেজি ৬৩৫ গ্রাম।
এক সা- ৩ কেজি ২৭৯ গ্রাম।
ফাতাওয়া শামিতে আছে :
نصف صاع فاعل تجب من برّ او دقيقه او سويقه او زبيب او صاع تمر او شعير.
(শামি- ৩/৩১৮,৩১৯, বাদায়ে- ২/২০৩,২০৫, আলমগিরি- ১/১৯১)
এই হুকুম নিম্ন ও মধ্যবিত্তের জন্য। আর উচ্চবিত্ত ও বিত্তশালীদের জন্য কিশমিশ বা খেজুর দ্বারা ফিতরা আদায় করা উত্তম। যাতে হাদিসে বর্ণিত সকল বস্তুর ওপর আমল হয়ে যায়। তা ছাড়া এতে গরিবরা অধিক লাভবান হবে, যা শরিয়তের কাম্য।
মূল্য নির্ধারণের সময় মধ্যম মানের বস্তু দিয়ে মূল্য নির্ধারণ করা উচিত। উৎকৃষ্ট মানের বস্তু দিয়ে হলে তো আরো উত্তম।
...
ফিতরার ক্ষেত্রে খাদ্যশস্য দেওয়া উত্তম না মূল্য?
আল্লামা ইউসুফ আল-কারজাবি বলেন, খাদ্যশস্য নাকি মূল্য দ্বারা ফিতরা আদায় করা উত্তম? ‘এতদুভয়ের মধ্যে উত্তম সাব্যস্ত করার ভিত্তি হচ্ছে গরিব ব্যক্তির পক্ষে কোন্টা দিলে অধিক সুবিধাজনক হয়, সেই জিনিসটি দেওয়া। যদি খাদ্যশস্য দিলে মূল্যের তুলনায় তার পক্ষে অধিক ভালো হয়, তবে সেটি দেওয়াই উত্তম। যেমন- দুর্ভিক্ষ ও কষ্টের সময় তা ভালো। আর নগদ টাকা পেলে তার যদি বেশি সুবিধা হয়, তাহলে তা-ই দেওয়াই উত্তম। এ হিসাবে গরিব ব্যক্তির একার সুবিধাটা না দেখে গোটা পরিবারের সুবিধাটার বেশি গুরুত্ব পাওয়া উচিত। কেননা, দেখা গেছে অনেক পারিবারিক দায়িত্বসম্পন্ন দরিদ্র ব্যক্তি নগদ পয়সা নিয়ে তা নিজের বাজে অভ্যাসে ব্যয় করে ফেলে অথচ তখন তার স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি হয়তো একবেলা খাবার থেকেও বঞ্চিত রয়েছে। এরূপ অবস্থায় খাদ্যশস্য দেওয়াই ভালো। [ড. ইউসুফ আল-কারযাবীর ফিকহুয যাকাত : খ. ২, পৃ. ৫০৫]
...
একনজরে ফিতরার মাসায়েল
ঈদুল ফিতরের দিন সুবহে সাদিকের সময় ফিতরা ওয়াজিব হয়। সুতরাং যে সন্তান ঈদুল ফিতরের দিন সুবহে সাদিকের পর জন্মগ্রহণ করবে, তার পক্ষ হতে ফিতরা আদায় করা ওয়াজিব না।
রমজান মাসের ভেতর ফিতরা আদায় করে দেওয়া যায়। তবে ঈদের দিন নামাযে যাওয়ার আগে আদায় করা উত্তম। কোনো কারণে ঈদের নামাযের আগে ফিতরা দিতে না পারলে নামাযের পরেও দেওয়া যাবে এবং ফিতরা আদায় হবে।
কেউ রমজানের রোযা রাখতে না পারলেও নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে তার ওপর ফিতরা ওয়াজিব হয়ে যায়।
পিতা-মাতা, স্ত্রী ও বালেগ সন্তানরা পৃথক পৃথকভাবে নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে তাদের ওপর ফিতরা ওয়াজিব হবে। তারা নিজেরা ফিতরা আদায় করবে। তবে কর্তা আদায় করে দিলে আদায় হয়ে যাবে।
নাবালেগ সন্তানের নেসাব পরিমাণ সম্পদ থাকলে অভিভাবক ইচ্ছে করলে নিজের সম্পদ দ্বারা ফিতরা আদায় করতে পারবে।
একজন গরিবকে পূর্ণ একটি ফিতরা দেওয়া উত্তম। যদিও এক ফিতরা কয়েকজনকে ভাগ করে দেওয়া জায়েয।
যাকাত গ্রহণের উপযুক্ত গরিব-মিসকিনদের ফিতরা দেওয়া যায়। তবে অমুসলিমদেরকে যাকাত দেওয়া না গেলেও ফিতরা দেওয়া বৈধ। [ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/১৯০, বাদায়েউস সানায়ে ২/২০৭]
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন