সোমবার, ১৯ জুন, ২০১৭

যারা মনে করেন ছেলে এখনো ছোট


ছেলের বয়স ২৩, ছেলেকে বিয়ে দিচ্ছেন না, কারন আপনার ধারনা ছেলে এখনও ছোট। আপনার কাছে ছেলে অবশ্যই ছোট । কিন্তু সে নিজে জানে, সে আসলে কতটা বড় হয়ে গেছে । সে এটা আপনাকে বিস্তারিত বলতে পারে না। বলতে গেলে আপনার চাইতে সেই লজ্জা বেশি পাবে। আপনি বলতে পারেন ছেলে বিয়ে করলে বউকে খাওয়াবে কি?? প্রশ্ন হচ্ছে, যে মেয়েটাকে সে এখন বিয়ে করার কথা ভাবছে, সে কি তাহলে এত বছর না খেয়ে ছিল?? বিয়ে যদি আরও পাচ বছর পরও হয়, মেয়ে কি না খেয়ে থাকবে?? মেয়ে যদি বিয়ে ছাড়া কোন
ভাবেই না খেয়ে না থাকে তাহলে শুধু বিয়েটা পড়ানোর পরেই কেন খাওয়ার
চিন্তা আসবে?? মেয়ে তার বাপের কাছে থাকুক, ছেলের যখন সামর্থ্য হবে মেয়েকে নিয়ে আসবে নিজের কাছে। এখন দেখা যাক এর অ্যাডভান্টেজ ডিসঅ্যাডভান্টেজ গুলা।
অ্যাডভান্টেজঃ
*************
১.ছেলের জীবনে টেনশন জাস্ট অর্ধেক হয়ে যাবে। তার বিয়ে হয়েছে মানে তার
"গার্লফ্রেণ্ডের বিয়ে হয়ে যাবে" রোজ রোজ এই দুশ্চিন্তা করতে হবে না।
২.বিয়ের পরে মানুষ গোছালো হয়। এই বয়সের ছেলেরা অত্যন্ত অগোছালো হয়ে অপেক্ষায় থাকে কেউ একজন এসে তার জীবনটাকে গুছিয়ে দিয়ে যাবে ভেবে। একজন স্ত্রী ছাড়া কোন গার্লফ্রেণ্ডের পক্ষে এটা সম্ভব না।
৩.ডেটিংয়ের পেছনে যা খরচ হত, তা দিয়ে তারা দুজন বিয়ের পর দিব্যি প্রেম করে যেতে পারবে, কারও গুনাহ হবে না।
৪.পর্ন নামক জিনিসটার বাজারদরে ভাটার টান পড়বে। মুসলিম দেশগুলাতে পর্নের এত রমরমা কাটতির কারন কি জানেন? মুসলিমদের জন্য এক্সট্রা ম্যারিটাল সেক্স নিষিদ্ধ। তরুন বয়সীরা যখন জৈবিক চাহিদা বৈধ ভাবে মেটানোর সুযোগ না পায়, তখন তারা আলটিমেটলি বিকৃত উপায়ের দিকে
আরও বেশি ঝুকতে থাকে। এই জিনিস কোনক্রমেই আপনি রুখতে পারবেন না। এগুলো হল একটা পানির স্রোতের মত, কোননা কোন দিকে তা গড়াবেই।
৫.আপনি নিজে স্ট্রেস ফ্রি থাকবেন। ছেলে কই কার সাথে কি করছে তা দেখার
ভারটা ছেলের বউই তখন নিতে পারবে।
৬.ছেলে ও মেয়ে দুজনেই তখন স্যাক্রিফাইস করা শিখবে। এই শিক্ষাটা না থাকায় এখন দিনকে দিন মানুষের জীবন কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
এবার ডিসঅ্যাডভান্টেজের হিসেবে আসি।
**********-****
১.কিছু পয়সা পাতি খরচ হতে পারে।
২.লোকে বদনাম করতে পারে।
৩.ছেলে-মেয়ে দুজনেই ৬-৮ মাস পড়াশোনাতে একটু ঢিল দিতেtপারে।
৪.আপনি যদি মোবাইল কোম্পানির মালিক হন তাহলে এটা আপনার ব্যবসার জন্য ক্ষতিকর।
৫.যদি আপনি পর্ন ইণ্ডাস্ট্রির মালিক হন তাইলে এটা আপনার জন্য ক্ষতিকর।
৬.ছেলে হয়তো পুরোপুরি আপনার কন্ট্রোলে নাও থাকতে পারে। এটা নির্ভর করে ছেলের ব্যক্তিত্বের ওপর। সারা জীবন তাকে কি শিখালেন তার
ওপর। তাকে চামচামি শিখালে সে আলটিমেটলি চামচামিই করবে, তা হোক
বউয়ের বা মায়ের চামচামি। যদি পুরুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারেন তো কিভাবে বউ-মা দুজনকে এক সাথে হ্যাণ্ডল করতে হয় সেটা সে দেখবে, যদি আপনারা ঠিক থাকতে চান। এখন আমাদের অভিভাবকদের এই মেসেজটা দেয়ার সময় হয়েছে, তারা ঠিক করুক তারা কি চায়। তারা যদি চায়
আগামী পাঁচ ছয় বছর ছেলে দিনে ডেট আর রাতে মাস্টার বেট করে কাটাক
এবংমানসিক বিকৃতির শিকার হোক, তবু সমাজের চোখে তার মুখ রক্ষা করুক, তবে তারা আগের সিদ্ধান্তেই অটল থাকতে পারেন।
যদি তা না চান, তবে একটু সাহস করে আল্লাহর ওপর ভরসা করে বিয়েটা
করিয়ে দিতে পারেন। ছেলে-মেয়ে সবাই এখন রোজগার করতে পারে। বিয়ে করার কারনে কেউ না খেয়ে মরবে না। মোস্ট ইম্পর্ট্যান্টলি, দুজন তখন প্রেমের অনিশ্চয়তা থেকে মুক্ত হয়ে ঠাণ্ডা মাথায় ক্যারিয়ারের হিসেবটা কষতে পারবে, একজন আরেকজনকে আরও বেশি সময় দিতে পারবে সবকিছু ঠিক রেখেই এবং তাতে আপনার হার্ট অ্যাটাক হবার কোন সম্ভাবনা থাকবে না কারন আপনি জানেন আপনার ছেলে/ মেয়ে তার স্ত্রী বা স্বামীর সাথেই আছে। আমার ফ্রেণ্ড লিস্টে গার্ডিয়ান লেভেলের মানুষ খুব কম। কিন্তু বড় ভাই-বোন লেভেলের মানুষ আছেন অনেক। আশা করি ফ্যামিলি লেভেলে ডিসিশন নেবার সময় কথাগুলো একবার ভেবে দেখবেন। একটু ভেবে দেখেন, এই বয়সে আপনার ডিসিশনের কারনে বিয়ে না করে যে ছেলেটা বা মেয়েটা বছরের পর
বছর ধরে গুনাহ করে যাবে, এগুলোর হিসাব আপনাকেই হাশরের ময়দানে চুকাতে হবে।
তখন কাকে কৈফিয়ত দেবেন??
লেখকঃ Prince Muhammad Sajal


বুধবার, ১৪ জুন, ২০১৭

তারাবির হাফিজ সাহেবদের হাদিয়া বিব্রতকর বিভ্রান্তির নিরসন দরকার


রশীদ জামীল

Emran Hossain Adib 

শুরুতেই বলে রাখি, ফতওয়া দেয়ার অধিকার মুফতিদের। সনদধারী মুফতি ছাড়া অন্য কারো তরফ থেকে ফতওয়া দেয়া একদিকে যেমন শরীয়তের দৃষ্টিতেও অনধিকার চর্চা, অপরদিকে আদালতের রায় অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধও। দেশের উচ্চ আদালত রায় দিয়েছেন সনদধারী মুফতি ছাড়া আর কেউ ফতওয়া দিতে পারবেন না। কিন্তু আজকাল যখন দেখি নন-মুফতি হযরতগণ বয়ানের মজমায় জোসের ঠেলায় স্পর্শকাতর হালাল-হারামের মাসআ’লায় ফতওয়া দিয়ে চলেছেন অবাধে, তখন ভাবি তারা কি জানেন, ভিকটিমদের যে কেউ হাইকোর্টে একটি রিট করে যদি বলে ‘অমুক আলেমের সনদ নেই ফতওয়া দেয়ার অথচ তিনি ফতওয়া দিয়ে আমার স্বার্থহানী ঘটিয়েছেন, পাশাপশি সমাজে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন...’ তাহলে কী হবে! 
.
‘তোমরা আমার আয়াতকে সামান্য মূল্যে বিক্রি করো না’-আল্লাহপাকের এমন শক্ত আর সরাসরি নির্দেশনার পর রমযানে তারাবীহ’র নামাজ পড়ানো হাফিজদের হাদিয়া দেয়া বা গ্রহণ করা কেমন করে জায়েজ হয়? অথচ; সারাদেশের বেশিরভাগ মসজিদে এই নাফরমানি (!) চলছে। যেহেতু উলামায়ে কেরামের দায়িত্বই হচ্ছে মানুষকে নাফরমানি থেকে বাঁচানো, সেই লক্ষে কিছু আলেম সর্বশক্তি নিয়োগ করে মানুষকে বোঝাচ্ছেন। যারা একটু টানটুন দিয়ে ওয়াজ করতে পারেন, প্রফেশনাল ওয়াইজিনে কেরামের কথা বলছি, তারা দলিল-আদিল্লা দিয়ে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে মানুষকে বোঝাতে চেষ্টা করছেন যেনো ভুলেও তারাবীহ’র হাফিজদের হাদিয়া দেয়া না হয়। এতোবড় পাপ যেনো ভুলেও কেউ না করে। এমন যারা করছেন, ‘আল্লাহপাক তাদের জবানে আরো বরকত দিন’ এই দোয়া করব কি না-ভাবছিলাম। ভাবনারা হোঁচট খেলো আপাতদৃষ্ট অর্বাচিন সহসাঙ্গিক প্রাসঙ্গিকতায়। জানি অতি উৎসাহী সংশ্লিষ্টদের ভাল লাগবে না। কিচ্ছু করার নেই! 
.
দুই 
অবাক হই আমি! গূঢ় বিষয়াদিতে কারো কারো একপাক্ষিক রূঢ়তা আমাকে বিস্মিত করে! ‘তারাবীহ’র হাদিয়া’ বিষয়টির স্পর্শকাতরতা বিবেচনায় এ নিয়ে এর আগে আর কথা বলিনি। ঠিক করেছিলাম এ প্রসঙ্গে কথা বলব না। মাসআলা-মাসাঈল সংক্রান্ত ব্যাপার-সেপারে মুফতিগণই কথা বলবেন। কোথায় কী বলতে কী বলে বসে আবার গোনাহগার হই। কী দরকার! কিন্তু লক্ষ লক্ষ হাফিজদের পেছনে গুটি কতেক আলেম যেভাবে হামলে পড়েছেন, তাতে মনে হল এ জীবনে জেনে না জেনে পাপ তো আর কম করিনি! হাফিজদের নিয়ে কথা বললে যদি পাপ হয়, হয়ে যাক। আল্লাহ গাফুরুর রাহীম। প্রতি রমযানে দেশের লক্ষ লক্ষ মসজিদে লক্ষ লক্ষ বার আল্লাহর কালাম প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পাঠ করা ও শোনার এই ধারা অব্যাহত রাখবার স্বার্থে কথা বলে সমালোচিত যদি হতে হয়, গালি যদি খেতে হয়, খেলাম না হয়। ইদানীং লেখালেখির কারণে গালমন্দটা একটু বেশিই হজম করতে হচ্ছে। 
.
জানিয়ে রাখি, লিখছি আমার বোধ থেকে। এটি একটি নিরীহ আর্টিক্যাল। কেউ যেনো এই লেখাকে ফতওয়া ভেবে বিভ্রান্ত না হন।
.
রমযান এলেই তারাবীহ’র নামাজ পড়ানো হাফিজদেরকে হাদিয়া দেওয়া ঠিক কিনা, এ নিয়ে বিতর্ক মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। সাম্প্রতিক সময়ে বিষয়টিকে নিয়ে এমনভাবে ফতওয়াবাজি শুরু হয়েছে যে, এর প্রভাবে গোঠা সমাজ মারাত্নভাবে বিভ্রান্ত। সাধারণ মুসলমানরা চরমভাবে বিব্রত। আমি জানি না হাফিজদের হাদিয়া দেয়া বন্ধ করে দেয়ার পেছনে যারা জানবাজ সংগ্রাম শুরু করে অশেষ সওয়াব হাসিলের প্রতিযোগিতায় মত্ত হয়েছেন, পাঁচ মিনিটের জন্য যদি ধরেও নিই এই হাদিয়া শরীয়ত পরিপন্থী, বাংলাদেশে কি এই একটাই খেলাফে শরীয়ত কাজ তাদের চোখে পড়ে? আর কিছু পড়ে না? আচ্ছা যারা এই বিষয়ে বড় বড় কথা বলছেন, তাদের অনেকের অনেক ব্যাপার যে অনেকেই জানে, এটা কি তারা জানেন? থাক, এখনই সেদিকে যেতে চাচ্ছি না। 
.
তিন 
তারাবীহ পড়ানো হাফিজদের হাদিয়া দেয়া না-জায়েজ।
কারণ কী?
কারণ হল, কুরআন শরীফ তেলাওয়াতের বা খতমের বিনিময় নেয়া হারাম।
দলিল কী?
আয়াত তাদের ঠোঁটেই থাকে, “লা তাশতারূ বি-আ’য়াতী সামানান ক্বালীলা” (তোমরা আমার আয়াতকে স্বল্প মূল্যে বিক্রি করো না)। 
.
-আচ্ছা পাঁচবেলা নামাজে যিনি ইমামতি করছেন, তিনি তো নামাজে কুরআন শরীফই তেলাওয়াত করছেন, নাকি? তাহলে ইমাম সাহেবকে টাকা দেয়া জায়েজ কেন? 
-জবাবঃ ওটা তেলাওয়াতের বিনিময় হিশেবে নয়, নামাজ পড়ানোর বিনিময়ে। কারণ, উনারও পেট-পীঠ আছে।
-আচ্ছা ইমাম সাহেবেরটা বৈধ হলে হাফিজ সাহেবেরটা অবৈধ হবে কেন?
এরও জবাব তৈরি আছে। বলা হবে, ফুকাহায়ে কেরাম ঐক্যমত্তের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত দিয়ে রেখেছেন ইমাম সাহেবদের বেতন-ভাতা দেয়া যাবে। জানতে চাই ফুকাহায়ে কেরাম ঐক্যমত্তের ভিত্তিতে কোথায় কখন বলেছেন তারাবীহ পড়ানো হাফিজদেরকে হাদিয়া দেয়া যাবে না! আমি চ্যালেঞ্জ করছি, হাদিয়া দেয়া বা নেয়া না-জায়েজ, এমন কথা হানাফি মাজহাবের কোনো কিতাবে একজন আলেমও বলেননি। কেনো তবে খামাখা এই বিভ্রান্তি ছড়ানো! হাদিয়া আর তারাবিহ'র বিনিময়কে গুলিয়ে ফেললে তো হবে না।
.
বলবেন, ইমামদের টাকা দেয়া না হলে পাঁচ ওয়াক্ত জামাতে নামাজ পড়া যাবে না। ইমামকে বেতন না দিলে তিনি চলবেন কেমন করে? তাঁরও তো স্ত্রী-সন্তান আছে। সংসার আছে। আচ্ছা, হাফিজদের কি বিয়ে করা নিষেধ? তাদের কি স্ত্রী-সন্তান থাকতে নেই? আজব অনুভব! 
.
জামাতে নামাজ পড়া সুন্নতে মুয়াক্কাদা। তারাবীহ্ওতো সুন্নতে মুয়াক্কাদা। তবে কেন আলাদা নিয়ম?
যুক্তির ভাণ্ডারে এরও যুতসই জবাব তৈরি করে রেখেছেন তারা। বলা হয়, তারাবীহ সুন্নতে মুয়াক্কাদা কিন্তু খতম তারাবীহ বাধ্যতামূলক নয়। কোন কারণে যদি হাফিজগণ তারাবীহ নাও পড়ান, সমস্যা নেই। ইমাম সাহেব আছেন। সুরা তারাবীহ চলবে।
মজার তথ্য হচ্ছে সুরা তারাবীহ’র বিনিময়ে হাদিয়া নেয়া তাদের দৃষ্টিতে জায়েজ। সুরা তারাবীহ’তে কী পড়া হয়? কুরআনের ছোট ছোট সুরাই তো, নাকি? ‘পুরো কুরআন শুনিয়ে হাদিয়া নেয়া নাজায়েজ কিন্তু কিছু অংশ শুনিয়ে পয়সা নেয়ায় দোষ নেই...’ আমি জানি না ঠিক এই কথাটি ত্রিশ পারা কুরআন অথবা সহী হাদিসের কোথায় লেখা আছে! আচ্ছা কিছু সময়ের জন্য মেনে নিলাম, আংশিক নয়, পুরো কুরআন তেলাওয়াত করার অপরাধ(!)করে ফেললে তাকে আর হাদিয়া দেয়া যাবে না। কিন্তু আমাদের দেশের প্রায় সকল মসজিদেই তো দু’জন হাফিজ মিলে ২০ রাকাত নামাজ পড়ান। তার মানে কেউই তো পুরো কুরআন খতম করছেন না। অর্ধেক তেলাওয়াত করেছেন। বলি সুরা তারাবীহ যে লজিক ফিট করে জায়েজ করা হল, এই লজিকখানা এখানে ফিট করতে বাধা দিল কে?
.
চার 
যা আছে কপালে। শুরু যখন আজ করেই ফেলেছি, কিছু কথা তাহলে বলেই ফেলি। সমুদ্রে পেতেছি শয্যা শিশিরে ভয় পেয়ে লাভ নেই! যারা ফতওয়া দিচ্ছেন তারাবীহ’র হাফিজদের কোনো অবস্থাতেই হাদিয়া দেয়া যাবে না, তারা কিন্তু টাকার কথা বলছেন না। বলছেন বিনিময় দেয়া-নেয়া জায়েজ নয়। অবাক হব না কাছের আগামীতে এইসব অতি উৎসাহী আলেমদের যদি বলতে শুনি, “রমযানে তারাবীহ পড়াতে আসা হাফিজকে খাওয়ানোও যাবে না, কারণ, কোন মসজিদে যদি কয়েকজন হাফিজও তারাবীহ পড়েন তাহলে তাদেরকে মহল্লাবাসী খাওয়ায় না, খাওয়ায় শুধু তারাবীর হাফিজদের। তাহলে সন্দেহাতীতভাবেই প্রমাণিত হয় এই খাবার তারাবীহ’র বিনিময়েই খাওয়ানো হচ্ছে...।”
তাহলে কী করতে হবে?
জিজ্ঞেস করলে তারা হয়ত বলবেন, নিজের গাটের পয়সায় গাড়ি ভাড়া দিয়ে হাফিজকে তারাবীহ পড়াতে আসতে হবে। হোটেলে রোম করে থাকতে হবে আর নিজের পয়সার রেস্টুরেন্টে খেতে হবে! কিছুই আর অসম্ভব মনে হচ্ছে না আমার কাছে।
.
পাঁচ 
সাম্প্রতিক কিছু বছর থেকে লক্ষ করছি রমযান এলেই তারাবীহ’র হাফিজদের হাদিয়া প্রদানের বিরুদ্ধে কিছু সংখ্যক সম্মানিত আলেম খুব শক্ত অবস্থান গ্রহণ করছেন। কোন অবস্থাতেই তারা মেনে নিতে চান না হাফিজরা কিছু পয়সা পেয়ে যাক। পরিষ্কার ভাষায় বলছি, এটা যতটা না শরীয়তের দৃষ্টিভঙ্গিজনিত তাগিদ থেকে, তারচে’ বেশি জেলাসি মনোভাবের কারণে। এদেশে শরীয়ত পরিপন্থি হাজার হাজার সমস্যা নিয়ে তাদের কোন মাথাব্যথা নেই। সমস্যা তাদের নজরে এই একটাই, তারাবীহ পড়ানো হাফিজদের হাদিয়া দেয়া। আমি জানি না দেশের দশ লক্ষ হাফিজ এই আলেমদের কোন্ বাড়া ভাতে ছাই দিল যে, এদের পিছে তাঁরা এভাবে লাগলেন! 
.
যারা ৩০ পারা কুরআন হিফজ করেছে, হাফিজ নয়-এমন যে কারো থেকে তারা সন্দেহাতীতভাবে উত্তম। পবিত্র কুরআনকে আল্লাহপাক কোনো বক্তা বা মুফতির কাছে রক্ষিত রাখেননি। রেখেছেন হাফিজে কুরআনের বুকে, ভালবাসার অক্ষরে খুদাই করে। এই অর্থে লাওহে মাহফুজ আর হাফিজে কুরআনের বুক’র মধ্যে রূহানী একটি সাদৃশ্য বিদ্যমান। উচিত তো ছিল বিজ্ঞ আলেমদের, কুরআন যারা বক্ষে নিল, সেই হাফিজদের বেশি বেশি করে হাদিয়া-তুহফা দেয়ার ফাজাইল বয়ান করা। এটা কুরআনের তা’জিমেই করা দরকার ছিল। সেটা তো তারা করছেনই না বরং কীভাবে এতোগুলো হাফিজকে আর্থিকভাবে আরো বেশি কোনঠাসা করা যায়, এই ফিকিরে মগ্ন! লক্ষ-কোটি মুসলমান ৩০ পারা কুরআন এর বিশুদ্ধ তেলাওয়াত, তাও নামাজে, তাও আবার রমযানে, এই হাফিজদের কল্যাণেই শুনে আসছে, এটা তাদের মনতশির যেহেনে স্থান পায় না!
.
কুরআনের দুশমনরা কুরআনকে নিশ্চিহ্ণ করার সবরকম চেষ্টা করেই ব্যর্থ হয়েছে। ১৮৬৪-৬৭, তিন বছরে তিন লক্ষ কপি কুরআন পুড়িয়েছে ইংরেজ। কিছুই করতে পারেনি। কুরআন স্বমহিমায় দ্বীপ্য থেকেছে। 
.
দু’টি অবস্থানকে টার্গেট করে সফল হওয়া গেলে পৃথিবীতে কুরআন আর থাকবে না।
এক. লাওহে মাহফুজ।
দুই. হাফিজে কুরআন।
যেহেতু প্রথমটিতে আঘাত হানার ক্ষমতা নেই, অতএব অপারেশন চালাতে হবে এই দ্বিতীয়টিতেই। হাফিজদের হাদিয়া প্রদান নাজায়েজ বানিয়ে দিতে পারলে আস্তে আস্তে হাফিজ তৈরির কারখানাগুলো ছোট হয়ে আসবে। হাফিজরা হবে সমাজের বোঝা। কেউ আর হাফিজ হতে চাইবে না। কোনো বাবা আর তার ছেলেকে নিয়ে হাফিজিয়া মাদরাসার দিকে যাবে না। আর এভাবেই কুরআনকে পৃথিবীর বুক থেকে...
হাফিজদের হাদিয়ার বিরুদ্ধে যারা অতি উৎসাহী, তারা অপরিনামদর্শী মনোভাবের কারণে কুরআন বিদ্বেষী দেশি-বিদেশি কোনো গোষ্টীর এজেন্ডা বাস্তবায়নের ব্যবহৃত হয়ে যাচ্ছেন কিনা অর্থাৎ তাদের এই কর্মকাণ্ড ওদের প্লানিংকে সাফল্যের দিকে নিয়ে যেতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে কিনা, ইতোমধ্যে অনেকেই সেটা সন্দেহ করতে শুরু করেছে।
.
ইসলামের নামে দু’টি পক্ষ আছে। সকল যুগেই ছিল। কিছু আছেন ইসলামের নামে ‘মার’ খানেওয়ালা আবার কিছু আছেন ইসলামের নামে ‘মাল’ খানেওয়ালা। মাল খানেওয়ালারা কথা বলেন মাইন্ডসেট থেকে। বিস্মিত হই! নিজে চালনী হয়ে যখন সূই’র ছিদ্র নিয়ে কথা বলাহয়, তখন ভাবি, বোধগুলো সব কোথায় হারিয়ে গেল! দ্বীনি কথাবার্তা বলার বিনিময়ে নিজেরা প্রতিদিন ৩০/৪০ হাজার টাকা কামালে সেটা ঠিক আছে, ঠিক নেই শুধু গরিব ঘরের এক কুরআনে হাফিজ বছরে একবার সারা মাসে ১৫/২০ হাজারটা টাকা পেয়ে গেলে! তাও তাদের মতো কন্টাক করে নয়, মানুষের ভালবাসায়, স্বেচ্ছায়... পরিষ্কার ভাষায় বলছি, হাফিজদের বিরুদ্ধাচরণকে এদেশের মুসলমান কুরআনের বিরুদ্ধাচরণের ড্রেস রিহার্সেল হিশেবেই ভাববে। আর এমনদেরকে জাতি বরদাশত করবে; ভাবা ঠিক হবে না।
.
ছয় 
বলা হবে আবেগি কথা দিয়ে শরীয়ত চলে না। আল হালালু বাইয়্যিন, ওয়াল হারামু বাইয়্যিন। সত্য-মিথ্যা সুস্পষ্ট। জানি তো। আর তাই অতি উৎসাহী যারাই হাফেজদের পেছনে লেগেছেন, তাদের উদ্দেশ্যে বিনয়ের সাথে বলছি, আপনারা যে যতবড় আল্লামাই বনে বসে থাকেন, আন্তরিকভাবে দুঃখিত, আপনাদেরকে আমরা আশরাফ আলী থানবী থেকে বড় আলেম মনে করি না। থানবী রাহ. তো হাফিজদেরকে হাদিয়া দেয়া যাবে-বলেছেন। থানবী রাহ. বলেছেন- চুক্তি করে তারাবীহ’র বিনিময় নেয়া হালাল নয় কিন্তু মানুষ যদি কুরআনের মহব্বতে হাফিজে কুরআনের সম্মানার্থে হাদিয়া-তোহফা হিসাবে কিছু দেয় তাহলে সেটা কেবল বৈধই না; বরং এমন হাদিয়া দাতারা আল্লাহর কাছে অনেক বেশি প্রতিদান পাবে।
.
তাহলে কথা পরিষ্কার। তারাবীহ’র বিনিময়ে চুক্তি করে পয়সা নেয়া যাবে না। এমনটি তো কোথাও করাও হয় না। এ কথাতেও কারো দ্বিমত নেই যে, তারাবীহ’র বিনিময় দেয়া ঠিক না। প্রকৃতপক্ষে কী ঘটে? সব মসজিদেই মুসল্লিদের পক্ষ থেকে হাফিজদেকে স্বেচ্ছায় হাদিয়া দেয়া হয়। হাফিজ সাহেবও বিনিময় চান না আর মসজিদ কমিটির পক্ষ থেকেও বলা হয়, জনাব, আমাদের তরফ থেকে এটি সামান্য হাদিয়া। এটা তারাবীহ’র বদলা নয়। দয়াকরে গ্রহণ করুন। আমি বুঝতে পারি না এখানে সমস্যাটা ঠিক কোথায়?
.
আল্লামা মুশাহিদ বায়মপুরী ছিলেন এদেশের আহলে হক্ব আলেমদের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। ছিলেন একজন চৌকষ আলেম। তিনি কিন্তু তারাবীহ’র হাফিজকে নিজে পয়সা উঠিয়ে দিয়েছেন। গহরপুরী হুজুর রাহ’কে আমরা দেখেছি তারাবীহ’র হাফিজদের হাদিয়া দিতে। বলতে শুনেছি, “হাফিজদের মন খুলে দান করো। আল্লাহ খুশি হবেন।” স্বীকৃত প্রায় সকল আলেমকেই দেখেছি হাদিয়ার পক্ষে। আজকাল যারা বাংলা-উর্দু মিলিয়ে কয়েকটি কিতাব পড়ে আল্লামা বনে গেছেন, তাদের খেদমতে আমার জিজ্ঞাসা, সাধারণ মুসলমান কাকে মানবে? থানবী, বায়মপুরি, গহরপুরিদের কথা, নাকি এ যুগের এই আপনাদের! কী মনে করেন? তারা কিতাব বুঝেননি? তারা ভুল করেছেন? তো বুকে সততার এতোই যদি সাহস থাকে, তাহলে একবার বলুন না, আশরাফ আলী থানবী’র মতো মাওলানা কিতাব বুঝেননি, আপনি/আপনারা আল্লামা হয়ে বুঝে ফেলেছেন, আপনাদের নিয়ে আমরা গর্বিত হই!
.
আর যদি বলেন, কোন আলেমের কথা বা কাজ শরীয়তের দলিল হতে পারে না, তাহলে কী করে আশা করেন আপনাদের কয়েকজনের কথাকে এদেশের মুসলমান দলিল হিশেবে গ্রহণ করে নেবে!
যাদের বুকে আল্লাহ পাক তাঁর কালাম শরীফ আমানত রেখেছেন, তারা অবশ্যই তাদের থেকে শ্রেষ্ঠ, যাদের বুকে কুরআন নেই। যথেষ্ট জেনে বুঝে এবং দায়িত্ব নিয়েই বলছি, হাদিসের সবগুলো কিতাব যদি কোনো আলেম মুখস্ত করে সত্যিকার হাফিজুল হাদিসও হয়ে যান কখনো, আল্লাহর কসম তাঁর অবস্থান একজন হাফিজে কুরআনের উপরে মনে করব না আমরা। আমরা হাদিসকে কোনো অবস্থাতেই কুরআনে কারীমের উপরে তরজীহ দিতে রাজি হব না।
.
বললে তো বড় কথা বলা হয়ে যাবে। খতমে বোখারির বিষয়ে কিছু বলা যাবে না কারণ, এটা ইমাম-মুয়াজ্জিন মার্কা খতম নয়। এই খতম মুহাদ্দিসীনে কেরামের খতম। এ বিষয়ে কথা বললে বেয়াদবি হবে। যে কারণে কুরআন খতমের হাদিয়া ১০০ টাকা আর বোখারি খতমের বেলায় আগাম কন্টাক্ট পার হেড ২ হাজার হলেও বেয়াদবি হয়ে যাবার ভয়ে আমরা চুপ থাকি। কথা বলি না। আমরা কখনো প্রশ্ন তুলি না এতে করে কি কুরআনে করীমের উপরে হাদিসকে মূল্যায়িত করা হয়ে যাচ্ছে না! ইমাম বোখারি কত হিজরিতে বোখারি শরীফ লিখেছিলেন, তখন কোনো একজন সাহাবী জীবিত থাকবার সম্ভাবনা ছিল কি না, আর নবী ও সাহাবী থেকে সাবিত নেই-এমন আমল করাকে আকাঈদের ভাষায় কী বলা যায়-এসব নিয়ে আমরা কথা বলি না। মনে মনে মনকে বলি, সম্ভবত আমার উর্ধতন কারো কর্মকাণ্ড নিয়ে কিয়ামতের মাঠে আমাকে জিজ্ঞাসিত হতে হবে না। নবী যদি জিজ্ঞেস করেন আমি আমার রক্তরাঙা বাণীগুলো তোমাদের কাছে গচ্ছিত রেখে এসেছিলাম এগুলো দিয়ে মানুষকে কুরআনের পথে নিয়ে আসবে বলে, বলো দেখি আমার হাদিসকে তোমরা কে কীভাবে কাজে লাগিয়েছো? তখন কে কী করেছেন, সে জবাব তিনিই দেবেন। কার কী!
.
সাত 
ওয়াজের মার্কেট রমরমা-এমন বক্তারাও আজকাল হাফিজদের হাদিয়ার বিরুদ্ধে ‘জিহাদ বিল মাইক উইথ হাদিয়া’ শুরু করেছেন! তাদের উদ্দেশ্যে বিনয়ের সাথে আরজ করি, বাংলাদেশে যদি বয়ানের মওজুর এতোই আকাল পড়ে যায় যে, আর কিছু না পেয়ে নিরীহ হাফিজদের পেছনে লাগতে হয়েছে, তাহলে আমাদের জানান। আমরা আপনাদেরকে বিষয় সাজেস্ট করি। দশ লক্ষ গরিব হাফিজদের রিযিকের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবেন না। সদয় অবগতির জন্য মনে করিয়ে দিই, তারাবীহ যারা পড়ান, এদের অধিকাংশই গরিব হাফিজ। এদের অনেকের ফ্যামিলিই তাদের উপর নির্ভরশীল। বিশ্বাস করুন এদের ডায়েরী ওয়াজ মাহফিলের তারিখ দিয়ে ভরা থাকে না। আগাম বায়না নিয়ে নসিহত বাণিজ্য করার ক্ষমতা নিয়েও তারা জন্মাননি। আল্লাহর ওয়াস্তে তাদের পিঁছু ছাড়েন। আল্লাহ আপনাদের মঙ্গল করবেন। 
.
একবার ভাবুন, জানতে চেষ্টা করে দেখুন তারাবীহ’র পেছেনে এক একজন হাফিজের কত মেহনত কাজ করে। সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত তেলাওয়াত করতে হয় তাদের। জোহরের নামাজের পর থেকে আসর পর্যন্ত আবার তেলাওয়াত। সঙ্গতকারণেই পেটে ক্ষিধা নিয়ে। আসরের পর মসজিদে তেলাওয়াত শোনানো। মাগরিবের পর থেকে এশার আযান পর্যন্ত নাকে-মুখে প্রস্তুতি। তারপর বিশ রাকাত নামাজ পড়ানো... একদিনের তারাবীহ’র প্রস্তুতি থেকে শুরু করে নামাজ পড়ানো পর্যন্ত তাদের শরীর থেকে যত ফোটা ঘাম ঝরে, আমার তো মনে হয় সেই ঘামে আপনারা ভালভাবেই তিনবেলা অজু সেরে ফেলতে পারবেন। এই যে পরিশ্রম, এতো যে ঘাম ঝরানো, সেই মেহনত আর ঘাম ঝরানোর পর সাধারণ সৌজন্যবোধ থেকে আমরা যদি খুশি হয়ে তাদেরকে কিছু হাদিয়া দিই, আর এতে করে যদি আপনাদের দৃষ্টিতে মহা অন্যায় কিছু হয়ে যায়, হয়ে যাক। আমরা থানবী রা.দের দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সিদ্ধান্তেই আস্থা রাখতে চাই। রমযানের এই গরমে আমাদেরকে বেশি সওয়াবের ভাগ দেবে বলে আমার হাফিজ ভাইরা যে পরিমাণ পরিশ্রম করে, তার জবাবে আমরা যদি কৃতজ্ঞতা স্বরূপ সামান্য কিছু হাদিয়া তাদের হাতে তুলে দিতে পারি, আর সে কারণে যদি কিছু আলেম নারাজও হয়ে যান, মুসলমানদের কিছুই যায় আসে না।
.
আট 
একটু আগে বলছিলাম, বয়ানের জন্য বিষয়বস্তুজনিত সংকটে ভোগলে আমরা বিষয় দিয়ে হেল্প করতে পারি। আপাতত পবিত্র কুরআনে একটি আয়াতকে সাজেস্ট করি। সুস্পষ্ট আয়াত। আল্লাহপাক নবী-রাসূলগণকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন মানুষকে নসিহত করে আল্লাহর দিকে নিয়ে যাবেন বলে। নবীগণ তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবেই পালন করে গেছেন। আর বিশুদ্ধ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত যে, আলেমগণ হলেন নায়েবে নবী বা নবীগণের ওয়ারিস। আলেমরা নবীদের রেখে যাওয়া কাজ করে যাবেন নবীগণের তরিকায়। এর ব্যত্যয় ঘটলে সেই আলেমকে সত্যিকারের নায়েবে নবী বলা যাবে কি না- এই ফতওয়া দেয়ার ভার মুফতিগণের উপর ন্যস্ত রেখেই এতদসংক্রান্ত পবিত্র কুরআনের আয়াতটি সামনে আনছি। নবীগণ আম জনতাকে নসিহত কীভাবে করতেন, সেটার বর্ণনা দিয়ে আল্লাহপাক সুরায়ে হুদ এর ৫১ নং আয়াতে বলেছেন, “ইয়া কাওমী লা আসআলুকুম আলাইহি আযরা, ইন আযরিয়া ইল্লা আলাল্লাজি ফাতারানী, আফালা তা’ক্বিলূন...”। নবীগণ তাদের জাতিকে ওয়াজ করতেন আর বলতেন, (হে আমার জাতি! এই যে তোমাদের ওয়াজ করছি, এর বিনিময়ে আমি তোমাদের কাছে তো কোনো বিনিময় চাইছি না। বিনিময় কিছু পেলে সেটা তাঁর কাছেই পাব যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন, কেন তবে বুঝতে চেষ্টা করছো না!) যেহেতু আলেমগণ নায়েবে নবী, সুতরাং ওয়াজ-নসিহতের এই সূত্রটা তাদের বেলায়ও সমানভাবে কার্যকর। টাকার বিনিময়ে নসিহত বা আরেকটু এডভান্স হয়ে দেশে হলে টাকায় আর বাইরে হলে ডলারে, আগাম বিল আদায় করে করে মাইকে সুন্দর সুন্দর কথা বলা, এটা কীভাবে কী- আশাকরি সংশ্লিষ্টরা একটু সবিস্তারে ব্যাখ্যা করবেন। 
.
এমন তথ্যও তো আমাদের হাতে আছে, এডভান্স ডলার প্রদানের শর্তে এবং এডভান্স পেমেন্টের ভিত্তিতে নসিহত পেপারে সাইন করেন কেউ কেউ। কিন্তু আগাম ডলার নিয়ে অসুস্থতার কথা বলে প্রোগ্রামেও যান না পয়সাও ফেরত দেন না। সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে যথেষ্ট দায়িত্ব নিয়েই কথাটি বললাম। সংশ্লিষ্ট কেউ চ্যালেঞ্জ করলে দাগ-খতিয়ানসহ প্রমাণ করে দেয়া যাবে।
.
নয় 
শেষ কথাটি বলে নিই। হাফিজে কুরআনগণ হলেন আল্লাহর বিশেষ মনোনিত কিছু লোক। চাইলেই কারো ক্ষমতা নেই পুরো কুরআন মুখস্ত করে ফেলতে পারে। যারা পেরেছে, সন্দেহ নেই তাদের প্রতি মহান মা’বুদের বিশেষ করুণাদৃষ্টি ছিল বলেই এটা তারা করতে পেরেছেন। আর আল্লাহপাক তার কালামকে যে বুকে আমানত রেখেছেন, আমরা যারা হাফিজ নই, আমাদের থেকে সেই বুকওয়ালারা অসংখ্য গুণ বেশি দামি। চলুন তাদেরকে সেই বুকটির খাতিরে অন্তত সম্মান করি, যে বুকে রয়েছে ৩০ পারা কুরআন। ফতওয়ার মারপ্যাঁচে ফেলে কীভাবে তাদেরকে আরো বেশি কোনঠাসা করা যায়, তার পেছনে মেহনত না করে বরং কীভাবে এই লোকগুলো সমাজে আরেকটু ভালভাবে বেঁচে থাকতে পারে, সেদিকে মনোনিবেশ করি। আর বিজ্ঞ মুফতিয়ানে কেরামের উদ্দেশ্যে বিনীতভাবে বলি, যতদূর জানি ইজমা’র দরজা তো বন্ধ হয়ে যায়নি। গুরুত্বসহকারে বসে এই বিষয়টির ব্যাপারে পজিটিভ অ্যাঙ্গেলে একটি ফায়সালায় চলে আসুন। অহেতুক এই বিতর্ককে জিইয়ে রাখলে দিন দিন এটির শাখা-প্রশাখা গজাবে। সেটি নিশ্চয় আগামীর জন্য সুখকর হবে না। 
[বন্ধুদের অনুরোধে পূণঃ প্রকাশিত]

মঙ্গলবার, ১৩ জুন, ২০১৭

দাড়ি কাটা দাড়ি ছাঁটা কিছু ভ্রান্তি কিছু বিভ্রান্তি


দাড়ি ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান। এটি সব নবীর সুন্নত। সব নবীরই দাড়ি ছিল। হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত একটি হাদীসে এসেছে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ''দশটি বিষয় ফিতরতের অন্তরর্ভুক্ত। মোচ ছোট করা, দাড়ি লম্বা করা...(সহীহ মুসলিম, হা.২৬৩)
হাদীসে উল্লেখিত এই ফিতরতের অর্থ কি? উলামায়ে কেরাম এর ব্যাখ্যায় বলেছেন ফিতরত হচ্ছে সুন্নাহ অর্থাৎ সব নবীর সুন্নাহ এবং সব শরীয়তের সর্বম্মত বিধান যা আকড়ে ধরার জন্য আমাদেরকে আদেশ করা হয়েছে। (শরহু মুসলি, নভভী: ৩/১৪৮; মাজমাউ বিহারিল আনওয়ার ৪/১৫৫)
একজন মুসলমান দাড়ি রাখার গুরুত্ব অনুধাবন করার জন্য উপরোক্ত হাদীসটিই যথেষ্ট। দাড়ি সব শরীয়তের বিধান সব নবীর সুন্নাহ, কোনো মুসলমান এটা জানার পর কি দাড়ি ছাঁটাই করতে কিংবা মুণ্ডাতে পারে! উপরন্তু নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে দাড়ি রাখার সুস্পষ্ট আদেশ বর্ণিত হয়েছে। হযরত ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত নবীজী সাল্লাল্লাহু অালাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ''তোমরা মুশরিকদের বিরোধিতা কর; দাড়ি বাড়াও এবং মোচ ছোট কর। (সহীহ বুখারী, হা.৫৮৯২; সহীহ মুসলিম, হা.২৬২)
হায়! নবীজী সাল্লাল্লাহু অালাইহি ওয়া সাল্লাম যেখানে মুশিরকদের বিরোধিতা করতে বলেছেন সেখানে আমরা তাদের কালচার এবং ফ্যাশনকেই প্রদান্য দিচ্ছি। শুধু তাই নয় আমাদের এমন গর্হিত কাজের পক্ষে সাফাই পেশ করছি যে, এটা তো সুন্নত; ফরজ ওয়াজিব তো নয়। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
তাদের কথা অনুযায়ী বাস্তবে যদি এটা শুধু সুন্নতই হতো তবুও কি একজন প্রকৃত মুসলামের পক্ষে একথা বলা সম্ভব যে, এটা তো সুন্নত তাই পালন করা জরূরী নয়! আর সমস্ত নবীদের সর্ব সম্মত সুন্নতের বিষয়টি তো আরো গুরুত্বপূর্ণ।
দাড়ি সুন্নত, এটা ঠিক। কিন্তু সুন্নত শব্দের অর্থ কি কি তা তো জানতে হবে। এক হচ্ছে ফিক্বহী সুন্নত যা ফরজ ওয়াজিবের বিপরিত আরেকটি হচ্ছে শাব্দিক অর্থে সুন্নত কিন্ত ফিক্বহী দৃষ্টিতে তা ফরজ কিংবা ওয়াজিবও হতে পারে। দাড়ি সমস্ত নবীদের সুন্নত অর্থাৎ তাদের রীতি তাদের অভ্যাস এই অর্থে সুন্নত বলা হয়েছে। কিন্তু ফিক্বহী দৃষ্টিতে তা ওয়াজিব। কেননা অসংখ্য হাদীসে দাড়ি রাখার আদেশ করা হয়েছে তাই এটা ওয়াজিব। এক্ষেত্রে উপরোক্ত হাদীসটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও বিভিন্ন হাদীসে দাড়ি লম্বা করার আদেশ দেয়া হয়েছে। যেমন হযরত ইবনে উমরের রা. এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
انْهَكُوا الشَّوَارِبَ وَأَعْفُوا اللِّحَى
(সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৫৮৯৩; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-২৬০)
সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৫৮৯২; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-২৬২০ এ ইবনে উমর রা. এর সূত্রে অপর বর্ণনায় এসেছে-
وَأَوْفُوا اللِّحَى
এসকল বর্ণনায় সুস্পষ্টভাবে দাড়ি লম্বা করার আদেশ দেয়া হয়েছে।
উপরোক্ত হাদীসগুলো থেকে দাড়ি রাখার গুরুত্ব সুস্পষ্ট। প্রশ্ন জাগে, তাহলে কি দাড়ি লম্বা হতেই থাকবে? দাড়ি বিলকুল কাটা যাবে না। তখন তো খুবই বিশ্রি দেখা যাবে!
না, বিষয়টি এমন নয়। সহীহ বুখারী শরীফে বর্ণিত হাদীস নং-৫৮৯২ এর শেষে উল্লেখ হয়েছে, ''হযরত ইবনে উমর রা. যখন হজ্জ বা উমরা করতেন, একমুষ্টির অতিরিক্ত দাড়িগুলো কেটে ফেলতেন।''
হযরত আবু হুরায়রা রা.ও এক মুষ্টির অতিরিক্ত দাড়িগুলো কাটতেন। ইমাম বুখারী ও মুসলিমের উসতায ইবনে আবী শাইবাহ রহ. এর প্রসিদ্ধ গ্রন্থ আল মুসান্নাফ’ (১৩/১১২) এ বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে এভাবে, ''হযরত অাবু হুরায়রা রা. দাড়ি মুষ্টিবদ্ধ করতেন অত:পর এক মুষ্ঠির অতিরিক্ত দাড়ি কেটে ফেলতেন।
এছাড়াও ক্বাতাদাহ, হাসান বাসারী, ইবনে সিরীন, আতা, তাউস, ক্বাসিম প্রমুখ তাবেয়ীগণ এক মুষ্টির অতিরিক্ত দাড়িগুলো কাটতেন, এ মর্মে আছার বর্ণিত হয়েছে। দেখুন, মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবাহ: ১৩/১১২-১১৩
শুরুতে উল্লেখিত বিভিন্ন হাদীসে আমরা দাড়ি লম্বা করার আদেশ পেয়েছি কিন্তু এর বিপরিত সাহাবা ও তাবেয়ীনদের আমল পেলাম, তারা এক মুষ্টির অতিরিক্ত দাড়িগুলো কেটেছেন। যেমন ইবনে উমর ও আবু হুরায়রা রা. এর আমল। সাহাবায়ে কেরাম রা. নবীজীর আদেশের বিপরিত আমল করবেন এটা কল্পনাও করা যায় না। ইবনে উপর রা. তো নবীজীর এতো বেশি অনুসরণ করতেন যে, কেউ দেখলে মনে হবে লোকটি কি মাজনুন? (সিয়ারু আ’লামিন নুবালা: ৩/২১৩)
সুতারাং নিশ্চয় তারা নবীজী থেকে এই মর্মে কোনো নির্দেশনা পেয়েছেন যে, একমুষ্টির অতিরিক্ত দাড়ি কাটা যাবে।
প্রশ্ন হলো সেই নির্দেশনাটি কোথায় বা নবীজী দাড়ি কেটেছেন এমর্মে কোনো হাদীস থাকলে সেটি কোথায়? হ্যাঁ, আছে। তিরমিযি শরীফে (হাদীস নং ২৭৬২, ২৯১২) হযরত আমর ইবনুল আস রা. এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, ''নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ধৈর্ঘ্যে-প্রস্থে দু’দিকে তাঁর দাড়ি কাটতেন।''
সনদের বিচারে হাদীসটি দুর্বল। ইমাম তিরিমিযি রহ. ‘হাযা হাদীসুন গারীবুন’ বলে এদিকে ইঙ্গিত করেছেন।

সোমবার, ১২ জুন, ২০১৭

প্রশ্ন সকল নারীরা তাদের স্বামীর পাজরের হাড় দিয়ে তৈরী?

একজন প্রশ্ন করেছে -আল্লাহ নাকি স্বামীর পাজরের হার দিয়ে স্ত্রীকে সৃষ্টি করেছেন , তাহলে যাদের ডিভোর্স হয়ে অন্য কোথাও বিয়ে হয় তাদের ব্যাপারটা কি মানে তাহলে ঐ মেয়েকে কয়জনের পাজরের হার দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে ? একটু বুঝিয়ে বলবেন কি??
উত্তর
بسم الله الرحمن الرحيم
প্রথমে এ সংক্রান্ত হাদীসটি দেখে নেইঃ
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «إِنَّ الْمَرْأَةَ خُلِقَتْ مِنْ ضِلَعٍ لَنْ تَسْتَقِيمَ لَكَ عَلَى طَرِيقَةٍ، فَإِنِ اسْتَمْتَعْتَ بِهَا اسْتَمْتَعْتَ بِهَا وَبِهَا عِوَجٌ، وَإِنْ ذَهَبْتَ تُقِيمُهَا، كَسَرْتَهَا وَكَسْرُهَا طَلَاقُهَا
হযরত আবূ হুরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, নারীকে পাঁজরের হাড় দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে। সে তোমার জন্য কখনোই সোজা হবে না। তার দ্বারা কাজ আদায় করতে হলে এই বাঁকা অবস্থায়ই আদায় করতে হবে। এটি সোজা করতে গেলে ভেঙ্গে যাবে। ভাঙ্গার অর্থ হল তালাক ঘটে যাওয়া। [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-১৪৬৮]
হাদীসে নারীদের পাজরের হাড় দ্বারা তৈরীর কথা এসেছে। কিন্তু কার পাজরের হাড় দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে? তা হাদীসে বর্ণিত হয়নি।
সুতরাং না বুঝার কারণে অনেকে মনে করেন, স্বামীর পাজরের হাড় দিয়ে স্ত্রীকে তৈরী করা হয়েছে।
একথাটি সম্পূর্ণ গলদ।
একথার কোন ভিত্তি নেই।
হ্যাঁ, হযরত হাওয়া আলাইহিস সালামকে হযরত আদম আঃ এর পাজরের হাড় দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে। একথা সত্য।
কিন্তু এর মানে সকল স্ত্রীলোককে তার স্বামীর পাজরের হাড় দিয়ে তৈরী করার দাবীটি অযৌক্তিক ও বানোয়াট।
একেতো এর পক্ষে কোন দলীল নেই। দ্বিতীয়ত এটি যুক্তিহীন কথা। কারণ, যে সকল মেয়ে বাচ্চা শিশুকালেই মারা গেছে, বা বিবাহ ছাড়াই মারা গেছে, তাদের কার হাড় দিয়ে তৈরী করা হল?
তাদেরতো স্বামীই ছিল না দুনিয়াতে। তাহলে?
সুতরাং স্বামীর পাজরের হাড় দিয়ে তৈরী করা হয়েছে স্ত্রীদের এ দাবীটিই যেহেতু ভুল। তাই আপনার উপরোক্ত প্রশ্নেরই আর কোন যৌক্তিকতা বাকি থাকে না।
হাদীসটির ব্যাখ্যা কী?
হাদীসে যে পাজরের হাড় দিয়ে তৈরীর যে কথা বলা হয়েছে। এর দ্বারা দু’টি উদ্দেশ্য হতে পারে। যথা-
এটি কেবলি একটি উপমা। সত্যিই পাজরের হাড় দ্বারা তৈরী হওয়া উদ্দেশ্য নয়। নারীদের একটি সৌন্দর্য হল, তারা সাধারণতঃ একটু কথায় আচরণে বাঁকা স্বভাবের হয়ে থাকে। এটি সর্বক্ষেত্রে তাদের দোষ নয়। অনেক ক্ষেত্রেই সৌন্দর্য।
নারীরা বাবা আদম আঃ এর পাজরের হাড় দ্বারা তৈরী। স্বামীর পাজরের হাড় দ্বারা নয়। [তাকমিলা ফাতহুল মুলহিম-১/১৩৭-১৩৮]

রবিবার, ১১ জুন, ২০১৭

কুরআনের ও হাদীসের আলোকে যাকাতের বিধান


যাকাত কি ?
যাকাত ইসলামের পাচটি ভিত্তিসমূহের তৃতীয় ভিত্তি। যাহা ইসলামের মৌলিক ইবাদতসমূহের মধ্যে অন্যতম ইবাদত। প্রত্যেক মুসলমানকে যেমন যাকাত ফরয হওয়ার বিষয় সম্পর্কে বিশ্বাস করতে হবে, ঠিক তেমনিভাবে যার উপর যাকাত ফরয তাকে তা নিয়মিত পরিশোধও করতে হবে।
যাকাত বলতে বুঝায়:
خُذْ مِنْ أَمْوَالِهِمْ صَدَقَةً تُطَهِّرُهُمْ وَتُزَكِّيهِم بِهَا وَصَلِّ عَلَيْهِمْ إِنَّ صَلاَتَكَ سَكَنٌ لَّهُمْ وَاللّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ : التوبة (103)
 হে নবী! তাদরে (ধনীদরে) ধন সম্পদ থেকে সদকা নিয়ে তাদরেকে পাক পবত্রি করো,(নেকীর পথে) তাদরেকে এগিয়ে দাও এবং তাদরে জন্য রহমতের দোয়া করো।  তোমার দোয়া তাদরে সান্তনার কারণ হবে। আল্লাহ সবকছিু শুনেন ও জানেন।
যাকাতের শাব্দিক অর্থ অর্থে: পবিত্রতা, বৃদ্ধি, পরিশুদ্ধি,বরকত। কারণ যিনি যাকাত প্রদান করবেন, তার সম্পদ বৃদ্ধি পাবে এবং সাথে সাথে উহা বালা-মুছিবত থেকে রক্ষা পাবে। ইবনে তাইমিয়া হতে বর্ণিত,“যাকাতপ্রদানকারীর মন পবিত্র হয় এবং তার সম্পদে বরকত হয় ও বৃদ্ধি পায়।
যাকাত ফরজ হওয়ার দলীল
 وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ حُنَفَاءَ وَيُقِيمُوا الصَّلاةَ وَيُؤْتُوا الزَّكَاةَ وَذَلِكَ دِينُ الْقَيِّمَةِ  (البينة(৫
‘তাদের এ মর্মে আদেশ করা হয়েছে যে,তারা নিবিষ্ট মনে একান্তভাবে শুধুমাত্র আল্লাহর এবাদত করবে,যথাযথভাবে সালাত আদায় করবে,জাকাত প্রদান করবে,আর এটাই হলো সুপ্রতিষ্ঠিত দ্বীন। (বাইয়্যিনাহ :৫)
إِنَّ الَّذِينَ آمَنُواْ وَعَمِلُواْ الصَّالِحَاتِ وَأَقَامُواْ الصَّلاَةَ وَآتَوُاْ الزَّكَاةَ لَهُمْ أَجْرُهُمْ عِندَ رَبِّهِمْ وَلاَ خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلاَ هُمْ يَحْزَنُونَ (بقرة (২৭৭
“যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে,সৎ কাজ করেছে, নামায প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং যাকাত প্রদান করেছে,তাদের জন্য পুরস্কার তাদের পালনকর্তার কাছে রয়েছে। তাদের কোন ভয় নাই এবং তারা দুঃখিত হবে না ”। (সুরা বাক্বারা, ২৭৭)
পবিত্র কুরআনের ৩৪ স্থানে নামাযের পাশাপাশি যাকাত প্রদানের হুকুম দেয়া হয়েছে।
وَأَقِيمُواْ الصَّلاَةَ وَآتُواْ الزَّكَاةَ وَارْكَعُواْ مَعَ الرَّاكِعِينَ (بقرة   (43
আল্লাহ  তায়ালা বলেন, “তোমরা নামায কায়েম কর, যাকাত প্রদান কর এবং রুকুকারীদের সাথে রুকু কর” (সূরা বাক্বারা, আয়াত- ৪৩)।
 عَنْ أَبِيْ عَبْدِ الرَّحْمَنِ عَبْدِ اللهِ بْنِ عُمَرَ بْن الخَطَّابِ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا قَالَ: سَمِعْتُ النبي صلى الله عليه وسلم يَقُوْلُ: (بُنِيَ الإِسْلامُ عَلَى خَمْسٍ: شَهَادَةِ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ الله وَأَنَّ مُحَمَّدَاً رَسُوْلُ اللهِ، وَإِقَامِ الصَّلاةِ، وَإِيْتَاءِ الزَّكَاةِ، وَحَجِّ البِيْتِ، وَصَوْمِ رَمَضَانَ (رواه البخاري ومسلم(
আবি আবদুর রহমান আবদুল্লাহ ইবনে ওমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) থেখে বর্ণিত তিনি বলেন,আমি নবী (সা:) থেকে শুনেছি যে,“ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত। এতে সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন মাবুদ নাই এবং মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহর প্রেরিত রাসুল,নামায প্রতিষ্ঠা করা, যাকাত দেয়া,শারীরিক ও আর্থিক সামর্থ্য থাকলে হজ্জ্ব করা এবং রমযান মাসে রোযা রাখা”। (বুখারী ও মুসলিম)
যাকাত পরিশোধ না করার পরিণাম
وَاَلَّذِينَ يَكْنِزُونَ الذَّهَبَ وَالْفِضَّةَ وَلَا يُنْفِقُونَهَا فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَبَشِّرْهُمْ بِعَذَابٍ أَلِيمٍ يَوْمَ يُحْمَى عَلَيْهَا فِي نَارِ جَهَنَّمَ فَتُكْوَى بِهَا جِبَاهُهُمْ وَجُنُوبُهُمْ وَظُهُورُهُمْ هَذَا مَا كَنَزْتُمْ لِأَنْفُسِكُمْ فَذُوقُوا مَا كُنْتُمْ تَكْنِزُونَ*  (التوبة (৩৪-৩৫
আল্লাহ তায়ালা বলেন,“আর যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য পূঞ্জীভূত করে এবং উহা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, তাদেরকে মর্মন্তুদ শাস্তির সংবাদ দাও। যেদিন স্বর্ণ ও রৌপ্য জাহান্নামের অগ্নিতে উহা উত্তপ্ত করা হবে এবং উহা দ্বারা তাদের ললাট, পার্শ্বদেশ ও পৃষ্ঠদেশে দাগ দেওয়া হবে। সেদিন বলা হবে, ইহাই উহা যাহা তোমরা নিজেদের জন্য পূঞ্জীভূত করতে। সূতরাং তোমরা যাহা পূঞ্জীভূত করেছিলে তাহা আস্বাদন কর ।” (সুরা তওবা-৩৪-৩৫)
আবদুল্লাহ বিন মাসউদ (রা:) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে,আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন,“কোন ব্যক্তি যদি তার ধনসম্পদের যাকাত না দেয় তবে ঐ সম্পদ কিয়ামতের দিন অজগর সাপের আকার ধারণ করে তার গলদেশ বেষ্টন করবে”।
রাসল (সা.) তারপর তিলাওয়াত করলেন,
﴿وَلَا يَحْسَبَنَّ الَّذِينَ يَبْخَلُونَ بِمَا آتَاهُمُ اللَّهُ مِن فَضْلِهِ هُوَ خَيْرًا لَّهُم ۖ بَلْ هُوَ شَرٌّ لَّهُمْ ۖ سَيُطَوَّقُونَ مَا بَخِلُوا بِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ۗ وَلِلَّهِ مِيرَاثُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ۗ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ﴾ ال عمران ১৮০
আর আল্লাহ যাদেরকে তাঁর অনুগ্রহ থেকে যা দান করেছেন তা নিয়ে যারা কৃপণতা করে তারা যেন ধারণা না করে যে, তা তাদের জন্য কল্যাণকর। বরং তা তাদের জন্য অকল্যাণকর। যা নিয়ে তারা কৃপণতা করেছিল, কিয়ামত দিবসে তা দিয়ে তাদের বেড়ি পরানো হবে। আর আসমানসমূহ ও যমীনের উত্তরাধিকার আল্লাহরই জন্য। আর তোমরা যা আমল কর সে ব্যাপারে আল্লাহ সম্যক জ্ঞাত।
 নাসায়ী ও ইবনে মাজাহ। হযরত আলী (রা:) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, আল্লাহ রাসূল (সা.) বলেন, “সুদখোর, সুদদাতা, উহার সাক্ষী ও লেখক, উল্কি অংকনকারিণী এবং যে নারী উল্কি অংকন করায়, অভিশপ্ত ঐ ব্যক্তি যে যাকাত দিতে অস্বীকার করে, হিল্লাকারী ও যার জন্য হিল্লা করানো হয়, এদের সকলের উপর আল্লাহর অভিশাপ বা লা’নত ”।(আহমাদ ও নাসায়ী)
হাদীসে বর্ণিত আছে , একদা দু’জন মহিলা রাসুলুল্লাহ (সা.) এর নিকট আসল। তাদের দু’জনের হাতে স্বর্ণের কংকণ ছিল। তখন নবী করীম (সা.) তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন,“ তোমরা তোমাদের অলংকারের যাকাত দাও কি?” তারা বললো, “না ”। তখন নবী (সা.) বললেন, “তোমরা কি পছন্দ করবে যে, আল্লাহ তায়ালা তোমাদেরকে আগুনের দু’টি বালা পরিয়ে দিবেন”? তারা দু’জন বলল, “না ” । তখন নবী (সা.) বললেন, “তাহলে তোমরা এ স্বর্ণের যাকাত প্রদান কর ”। (তিরমিযি)
যাদের উপর যাকাত ফরয
নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক সকল মুসলিম নর-নারীর উপর যাকাত প্রদান করা ফরয। কোন ব্যক্তি নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়ার পর চাঁদের হিসাবে পরিপূর্ণ এক বছর অতিবাহিত হলে তার উপর পূর্ববর্তী বছরের যাকাত প্রদান করা ফরয। অবশ্য যদি কোন ব্যক্তি যাকাতের নিসাবের মালিক হওয়ার পাশাপাশি ঋণগ্রস্ত হয়,তবে ঋণ বাদ দিয়ে নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে তার উপর যাকাত ফরয হবে। যাকাত ফরয হওয়ার পর যদি কোন ব্যক্তি যাকাত প্রদান না করে অর্থ-সম্পদ খরচ করে ফেলে তাহলেও তার পূর্বের যাকাত দিতে হবে।
যাকাতের নিসাব
রূপা ৫৯৫ গ্রাম (৫২.৫০ভরি) কিংবা স্বর্ণ ৮৫ গ্রাম (৭.৫০ ভরি) অথবা স্বর্ণ বা রূপা যে কোন একটির নিসাবের মূল্য পরিমাণ অর্থ-সম্পদ বা ব্যবসায়িক সামগ্রীকে যাকাতের নিসাব বলে।
কোন ব্যক্তির মৌলিক প্রয়োজন পূরণের পর যদি নিসাব পরিমাণ সম্পদ তার মালিকানায় থাকে এবং চন্দ্র মাসের হিসাবে এক বৎসর তার মালিকানায় স্থায়ী থাকে তাহলে তার উপর এ সম্পদ থেকে চল্লিশ ভাগের এক ভাগ যাকাত রূপে প্রদান করা ফরয। মনে রাখতে হবে বছরের শুরু ও শেষে এ নিসাব বিদ্যমান থাকা জরুরী। বছরের মাঝখানে এ নিসাব পূর্ণ না থাকলেও যাকাত প্রদান করতে হবে। সম্পদের প্রত্যেকটি অংশের উপর এক বছর অতিবাহিত হওয়া শর্ত নয় বরং শুধু নিসাব পরিমাণের উপর বছর অতিবাহিত হওয়া শর্ত। অতএব, বছরের শুরুতে শুধু নিসাব পরিমাণ অর্থ-সম্পদ থাকলেও বছরের শেষে যদি সম্পদের পরিমাণ বেশী হয় তাহলে ঐ বেশী পরিমাণের উপর যাকাত প্রদান করতে হবে। বছরের যে কোন অংশে অধিক সম্পদ যোগ হলে তা পূর্ণ এক বছর অতিবাহিত হওয়া শর্ত নয়। যাকাত ফরয হওয়ার ক্ষেত্রে মূল নিসাবের উপর বছর অতিক্রম করা শর্ত। যাকাত, যাকাতুল ফিতর, কুরবানী এবং হজ্ব এ সকল শরীয়তের বিধান সম্পদের মালিকানার সাথে সম্পৃক্ত।
যাকাত বহির্ভুত সম্পদ
জমি, বাড়ী-ঘর, দালান, দোকানঘর, কারখানা, কারখানার যন্ত্রপাতি, কলকব্জা, যন্ত্রাংশ, কাজের যন্ত্র, হাতিয়ার, অফিসের আসবাবপত্র ও সরঞ্জাম, যানবাহনের গাড়ী, নৌকা, লঞ্চ, জাহাজ, বিমান ইত্যাদি, যানবাহন বা চলাচলের অথবা চাষাবাদের পশু, ব্যবহারিক গাড়ী, ব্যবহারিক কাপড়-চোপড়, ঘরের আসবাবপত্র ও সরঞ্জামাদি, নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যবহার্য সামগ্রী, গৃহ-পালিত পাখি, হাঁস-মুরগী ইত্যাদির যাকাত হয় না। ঋণ পরিশোধের জন্য জমাকৃত অর্থের উপর যাকাত হয় না। শস্য ও গবাদি পশুর যাকাত পরিশোধ করার পর ঐ শস্য বা গবাদি পশু বিক্রিকরে নগদ অর্থ প্রাপ্ত হলে ঐ প্রাপ্ত অর্থের উপর একই বছরে যাকাত দিতে হবে না। কারণ একই সম্পদের একই বছরে দুইবার যাকাত হয় না।
যে সকল সম্পদের যাকাত ফরয
(১) স্বর্ণ-রূপা ও নগদ অর্থ (২) বানিজ্যিক পণ্য (৩) মাঠে বিচরণকারী গবাদি পশু (৪) শস্য ও ফলমূল।
স্বর্ণ ও রূপার যাকাত
যদি কারো নিকট ৮৫ গ্রাম বা ৭.৫০ ভরি (১ভরি=১১.৬৬৪ গ্রাম) স্বর্ণ অথবা ৫৯৫ গ্রাম (৫২.৫০ ভরি) রূপা থাকে তাহলে তার উপর যাকাত ফরয। স্বর্ণ-রূপা চাকা হোক বা অলংকার, ব্যবহৃত বা অব্যবহৃত, স্বর্ণ বা রৌপ্যনির্মিত যে কোন বস্তু, সর্বাবস্থায় স্বর্ণ-রূপার যাকাত ফরয।
হীরা, ডায়মন্ড, হোয়াইট গোল্ড, প্লাটিনাম প্রভৃতি মূল্যবান ধাতু যদি সম্পদ হিসাবে বা টাকা আটকানোর উদ্দেশ্যে ক্রয় করা হয়, তাহলে বাজার মূল্য হিসাবে তার যাকাত দিতে হবে। অলংকারসহ সকল প্রকার স্বর্ণ-রূপার যাকাত দিতে হবে।
নগদ অর্থের যাকাত
নগদ অর্থ, টাকা-পয়সা, ব্যাংকে জমা, পোষ্টাল সেভিংস, বৈদেশিক মূদ্রা (নগদ, এফসি একাউন্ট, টিসি, ওয়েজ আর্নার বন্ড), কোম্পানির শেয়ার, মিউচুয়াল ফান্ড, ঋণপত্র বা ডিবেঞ্চার, বন্ড, সঞ্চয়পত্র, জমাকৃত মালামাল (রাখী মাল), প্রাইজবন্ড, বীমা পলিসি (জমাকৃত কিস্তি), কো-অপারেটিভ বা সমিতির শেয়ার বা জমা, পোষ্টাল সেভিংস সার্টিফিকেট, ডিপোজিট পেনশন স্কীম কিংবা নিরাপত্তামূলক তহবিলে জমাকৃত অর্থের যাকাত প্রতি বছর যথা নিয়মে প্রযোজ্য হবে। প্রতিষ্ঠানের রীতি অনুযায়ী বাধ্যতামুলকভাবে চাকুরীজীবির বেতনের একটি অংশ নির্দ্দিষ্ট হারে কর্তণ করে ভবিষ্য তহবিলে জমা করা হলে ঐ অর্থের উপর যাকাত ধার্য হবে না, কারণ ঐ অর্থের উপর চাকুরীজীবির কোন নিয়ন্ত্রণ থাকে না। কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ভবিষ্যৎ তহবিলের অর্থ ফেরৎ পাওয়ার পর যাকাতের আওতাভুক্ত হবে। ঐচ্ছিকভাবে (অপ্শনাল) ভবিষ্যৎ তহবিলে বেতনের একটা অংশ জমা করা হলে তার উপর যাকাত প্রযোজ্য হবে অথবা বাধ্যতামূলক হারের চাইতে বেশি হারে এই তহবিলে বেতনের একটা অংশ জমা করা হলে ঐ অতিরিক্ত জমা অর্থের উপর বছরান্তে যাকাত প্রযোজ্য হবে। চাকুরীজীবির অন্যান্য সম্পদের সাথে এই অর্থ যোগ হয়ে নিসাব পূর্ণ হলে যাকাত প্রদান করতে হবে। পেনশনের টাকাও হাতে পেলে যাকাত হিসাবে আসবে। মানড়বত, কাফ্ফারা, স্ত্রীর মাহরের জমাকৃত টাকা, হজ্ব ও কুরবানীর জন্য জমাকৃত টাকার উপরেও বছরান্তে যথানিয়মে যাকাত দিতে হবে। ব্যাংক জমা বা সিকিউরিটির (ঋণপত্র বা ডিবেঞ্চার, বন্ড, সঞ্চয়পত্র ইত্যাদি) উপর অর্জিত সুদ ইসলামের দৃষ্টিতে বৈধ উপার্জন নয় বিধায় যাকাতযোগ্য সম্পদের সঙ্গে যোগ করা যাবে না। অর্জিত সুদ কোন জনহিতকর কাজে ব্যয় করতে হবে। তবে মূল জমাকৃত অর্থের বা সিকিউরিটির ক্রয় মূল্যের উপর যাকাত প্রদান করতে হবে। ব্যাংক জমার উপর বৈধ মুনাফা প্রদান করা হলে ঐ মুনাফা মূল জমার সঙ্গে যুক্ত করে যাকাতযোগ্য অন্যান্য সম্পত্তির সাথে যোগ করতে হবে।
বৈদেশিক মুদ্রার উপর যাকাত
যাকাত প্রদানের সময় উপস্থিত হলে মালিকানাধীন সকল বৈদেশিক মুদ্রার নগদ, ব্যাংকে জমা, টিসি, বন্ড, সিকিউরিটি ইত্যাদি যাকাত প্রদানকারী ব্যক্তির বসবাসের দেশের মুদ্রাবাজারে বিদ্যমান বিনিময় হারে মূল্য নির্ধারণ করে অন্যান্য যাকাতযোগ্য সম্পদের সাথে যোগ করে যাকাত প্রদান করতে হবে।
 মোহরাণার অর্থের উপর যাকাত
’মাহর’ বিধানের মাধ্যমে ইসলাম নারীদের জন্য এক অনন্য অধিকার নিশ্চিত করেছে। কনে,বরের সাথে তার বিবাহবন্ধনে স্বীকৃতির সম্মানীস্বরূপ,বরের কাছ থেকে মাহর ( মোহরাণা) পেয়ে থাকে। মাহর বাবদ প্রাপ্ত জমাকৃত অর্থের উপর যাকাত ধার্য হবে। মাহরের অর্থ নিসাব মাত্রার হলে অথবা অন্যান্য যাকাতযোগ্য সম্পদের সাথে যোগ হয়ে নিসাব পূর্ণ হলে যাকাত প্রদান করতে হবে। মোহরাণার যে অর্থ আদায় করা হয়নি তার উপর যাকাত ধার্য হবে না, কারণ এই অর্থ তার আওতাধীনে নাই। প্রচলিত মুদ্রায় (টাকায়) ধার্যকৃত ’মাহর’ বিয়ের সময় সাথে সাথে পরিশোধ না করে, বিলম্বে প্রদান করা হলে তা আর্থিক ক্ষতির কারণ হয়। বর্তমানকালে বিদ্যমান মুদ্রার ক্রমবর্ধমান মূল্যহ্রাসের ফলে এই পাওনা পরবর্তীতে যখন পরিশোধ করা হয়, তখন মাহরের বিনিময়ে প্রাপ্ত অর্থ একান্ত নগণ্য বা তুচ্ছ পরিমাণ হয়ে যায়। শরীয়াহ্ বিশারদগণ এই সমস্যার সমাধানে দৃঢ় মত পোষণ করেন যে, প্রচলিত মূদ্রার পরিবর্তে স্বর্ণ বা রৌপ্যের পরিমাণের ভিত্তিতে ’মাহর’ নির্ধারণ করা উচিত, যাতে করে বিবাহিত নারীদের এই অধিকার যথার্থভাবে সংরক্ষিত থাকে এবং পরবর্তীকালে প্রচলিত মুদ্রার মূল্যহ্রাসজনিত কারণে তাদের ক্ষতি হওয়া থেকে রক্ষা পায়।
শেয়ার
যৌথ মূলধনী কোম্পানির মোট মূলধনকে সমমূল্য বিশিষ্ট বহুসংখ্যক ক্ষুদ্রাংশে বিভক্ত করা হয়। এরূপ ক্ষুদ্রাংশগুলোকে শেয়ার বলে। শেয়ার মালিককে কোম্পানির নিট সম্পত্তির একজন অংশীদার হিসাবে গণ্য করা হয়। শেয়ার ক্রয়ের উদ্দেশ্য বৃহৎ কোম্পানির ব্যবসায় বিনিয়োগ, কোম্পানির আংশিক মালিকানা অর্জন এবং লভ্যাংশ বা মুনাফা উপার্জন করা। ইসলামের দৃষ্টিতে নিষিদ্ধ যেমন-
অসামাজিক বা অনৈতিক ব্যবসায়ে লিপ্ত, নিষিদ্ধ পণ্য উৎপাদন ও বিক্রয় বা সুদী কারবার ও দৈবনির্ভর লেনদেনে নিয়োজিত কোম্পানির শেয়ার ক্রয় বৈধ নয়। কোম্পানি নিজেই যদি শেয়ারের উপর যাকাত প্রদান করে তা হলে শেয়ারমালিককে তার মালিকানাধীন শেয়ারের উপর যাকাত   দিতে হবে না। কোম্পানি যাকাত প্রদান করতে পারবে যদি কোম্পানির উপ-বিধিতে এর উল্লেখ থাকে অথবা কোম্পানির সাধারণ সভায় এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় অথবা শেয়ারমালিকগণ কোম্পানিকে যাকাত প্রদানের ক্ষমতা প্রদান করেন।
কোম্পানি নিজে তার শেয়ারের উপর যাকাত প্রদান না করলে শেয়ার মালিককে নিম্নোক্ত উপায়ে যাকাত প্রদান করতে হবে:
১. শেয়ারমালিক যদি শেয়ারগুলো বার্ষিক লভ্যাংশ অর্জনের কাজে বিনিয়োগ করে, তা হলে যাকাতের পরিমাণ নিম্নোক্ত উপায়ে নির্ণয় করা হবে:
(ক) শেয়ারমালিক যদি কোম্পানির হিসাবপত্র যাচাই করে তার মালিকানাধীন শেয়ারের বিপরীতে যাকাতযোগ্য সম্পদের পরিমাণ জানতে পারেন, তাহলে তিনি ২.৫% হারে যাকাত প্রদান করবেন।
(খ) কোম্পানির হিসাবপত্র সম্পর্কে যদি তার কোন ধারনা না থাকে তাহলে তিনি তার মালিকানাধীন শেয়ারের উপর বার্ষিক অর্জিত মুনাফা যাকাতের জন্য বিবেচ্য অন্যান্য সম্পত্তির মূল্যের সঙ্গে যোগ করবেন এবং মোট মূল্য নিসাব পরিমাণ হলে ২.৫% হারে যাকাত প্রদান করবেন।
২. শেয়ার মালিক যদি শেয়ার বেচাকেনার ব্যবসা (মূলধনীয় মুনাফা) করার জন্য শেয়ারগুলো ব্যবহার করেন তা হলে যেদিন যাকাত প্রদানের ইচ্ছা হবে, শেয়ারের সেদিনের বাজার মূল্য ও ক্রয়-মূল্যের মধ্যে যেটি কম তারই ভিত্তিতে মূল্যায়ন করে ২.৫% হারে যাকাত প্রদান করবেন। একজন শেয়ার মালিক ইচ্ছে করলে যে কোন সময় শেয়ার বিক্রি করে দিতে পারেন। কোম্পানির শেয়ার ক্রয় ও বিক্রয়ের এই স্বাধীনতা শেয়ার বাজারকে এমন পরিণতির দিকে নিয়ে যায় যে, কিছু ব্যক্তি নিজেদের স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে শেয়ারের মূল্য বাড়িয়ে বা কমিয়ে একটি সাধারণ ব্যবসা কার্যক্রমকে প্রায় জুয়াখেলায় পরিণত করে। ইহা ইসলামী শরীয়ার দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ অবৈধ।
বানিজ্যিক সম্পদের যাকাত
ব্যবসার নিয়তে (পুনঃবিক্রয়ের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ মুনাফা অর্জনের জন্য) ক্রয়কৃত, আমদানী-রপ্তানী পণ্য,ট্র্যানজিট বা পরিবহন পণ্য, বিক্রয় প্রতিনিধির (এজেন্ট) কাছে রাখা পণ্যদ্রব্য ও মজুদ মালামালকে ব্যবসার পণ্য বলে। ব্যবসার পণ্যের উপর সর্বসম্মতভাবে যাকাত ফরয। এমনকি ব্যবসার উদ্দেশ্যে ক্রয়কৃত জমি,দালান বা যে কোন বস্তু অথবা মালামালের মূল্যের উপরও যাকাত প্রদান করতে হবে। বাকী বিক্রির পাওনা, এলসি মার্জিন ও আনুষঙ্গিক খরচ, ব্যবসার নগদ অর্থসহ অন্যান্য চলতি সম্পদ যাকাতের হিসাবে আনতে হবে। অন্যদিকে ব্যবসার দেনা যেমন বাকীতে মালামাল বা কাঁচামাল ক্রয় করলে কিংবা বেতন, মজুরী, ভাড়া, বিদ্যুৎ, টেলিফোন ও গ্যাস বিল, কর ইত্যাদি পরিশোধিত না থাকলে উক্ত পরিমাণ অর্থ যাকাত যোগ্য সম্পদ থেকে বাদ যাবে। যাকাত নির্ধারণের জন্য বিক্রেতা তার
পণ্যের ক্রয়-খরচ মূল্যকে (ক্রয়মূল্যের সাথে ভাড়া সহ ক্রয়-সংক্রান্ত অন্যান্য খরচ যোগ করে) হিসাবে ধরবেন। “আল্লাহ  তায়ালা ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে হারাম করেছেন”। (সুরা বাক্বারা,আয়াত-২৭৫)
উৎপাদিত পণ্য
তৈরি বা উৎপাদিত পণ্য, উপজাত দ্রব্য, পঙক্রিয়াধীন পণ্য, উৎপাদন পঙক্রিয়ায় ব্যবহৃত কাঁচামাল ও প্যাকিং সামগ্রী ইত্যাদি যাকাতের আওতাভুক্ত হবে। যাকাত নির্ধারণের জন্য তৈরি বা উৎপাদিত পণ্যের মূল্যায়ন উৎপাদন খরচ মূল্যের অথবা পাইকারী বাজার দরের ভিত্তিতে হবে। পপঙক্রিয়াধীন বা অসম্পূর্ণ পণ্যের মূল্যায়ন ব্যবহৃত কাঁচামাল ও অন্যান্য উপাদানের খরচের ভিত্তিতে করতে হবে। মজুদ কাঁচামাল এবং উৎপাদন পঙক্রিয়ায় কাঁচামালের সাথে ব্যবহৃত প্যাকিং সামগ্রী ক্রয়- খরচ মূল্যের ভিত্তিতে হিসাব হবে এবং যাকাতের আওতাধীন পণ্যদ্রব্যসহ ব্যবসার নগদ অর্থ ও অন্যান্য চলতি সম্পত্তির সাথে যোগ করে যাকাত নির্ধারণ করতে হবে। উৎপাদন পঙক্রিয়ায় নিয়োজিত স্থায়ী সম্পদ যেমন- জমি, দালান, যন্ত্রপাতি, আসবাবপত্র, যানবাহন ইত্যাদির উপর যাকাত প্রযোজ্য হবে না।
স্থায়ী সম্পত্তির যাকাত
স্থায়ী সম্পত্তি বলতে বুঝায় জমি, দালানকোঠা, আসবাবপত্র, যন্ত্রপাতি, যানবাহন ইত্যাদি।
(ক) বসবাস, ব্যবহার, উৎপাদন কাজে বা কার্য সম্পাদনের উদ্দেশ্যে নিয়োজিত স্থায়ী সম্পত্তির উপর যাকাত ধার্য হয় না।
(খ) আয় উপার্জনের জন্য ভাড়ায় নিয়োজিত স্থায়ী সম্পত্তি যেমন- গৃহ, দোকান, দালানকোঠা, জমি, যন্ত্রপাতি, গাড়ি, যানবাহন ইত্যাদির উপর যাকাত ধার্য হয় না। তবে এসব সম্পত্তি থেকে ভাড়া বাবদ অর্জিত নিট আয় অন্যান্য যাকাতযোগ্য সম্পত্তির সঙ্গে যোগ করে ২.৫% হারে যাকাত প্রদান করতে হবে।
(গ) বেচা-কেনার উদ্দেশ্যে নিয়োজিত স্থায়ী সম্পত্তি যেমন- জমি, গৃহ, দোকান, এপার্টমেন্ট, দালানকোঠা, আসবাবপত্র, যন্ত্রপাতি, গাড়ি, যানবাহন ইত্যাদি ব্যবসায়িক পণ্য বলে গণ্য করা হবে এবং এগুলোর মূল্যের উপর যাকাত ধার্য হবে।
ঋণদাতার উপর যাকাত
(ক) আদায়যোগ্য ঋণ আদায় হওয়ার পর অন্যান্য যাকাতযোগ্য সম্পদের সাথে যোগ করে যাকাত প্রদান করতে হবে।
১. যে ঋণ নগদে বা কোন দ্রব্যের বিনিময়ে কারো কাছে পাওনা হয়, এরূপ ঋণ আদায় হওয়ার পর যাকাত দিতে হবে, এবং বিগত বৎসরসমূহেরও যাকাত প্রদান করতে হবে।
২. যে পাওনা কোন দ্রব্য বা নগদ ঋণের বিপরীতে নয়, যেমন উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত অস্থাবর সম্পদ, দান, অছিয়ত, মোহরাণার অর্থ ইত্যাদি বাবদ প্রাপ্ত হয়। এরূপ ক্ষেত্রে আদায়ের পর যাকাত ধার্য হবে। এগুলোর উপর বিগত বৎসরসমূহের যাকাত প্রদান করতে হবে না।
(খ) আদায় অযোগ্য বা আদায় হবার ব্যাপারে সন্দেহ থাকলে সে ঋণ যাকাতের হিসাবে আসবে না। যদি কখনও উক্ত ঋণের টাকা আদায় হয়, তবে কেবলমাত্র…
১(এক) বছরের জন্য উহার যাকাত দিতে হবে।
ঋণগ্রহিতার উপর যাকাত
(ক) ঋণগ্রহিতার ঋণের টাকা মোট যাকাতযোগ্য সম্পদ থেকে বাদ যাবে। কিন্তু যদি ঋণগ্রহিতার মৌলিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত স্থায়ী সম্পত্তি (যেমন-অতিরিক্ত বাড়ী, দালান, এপার্টমেন্ট, জমি, মেশিনারী, যানবাহন, গাড়ী ও আসবাবপত্র ইত্যাদি) থাকে যাহা দ্বারা এরূপ ঋণ পরিশোধ করতে সক্ষম,তবে উক্ত ঋণ যাকাতযোগ্য সম্পদ থেকে বাদ যাবে না।
(খ) স্থাবর সম্পদের উপর কিস্তিভিত্তিক ঋণ (যেমন-হাউজিং লোন ইত্যাদি) যাকাতযোগ্য সম্পদ থেকে বাদ যাবে না। তবে বার্ষিক কিস্তির টাকা অপরিশোধিত থাকলে তা যাকাতযোগ্য সম্পদ থেকে বাদ যাবে।
(গ) ব্যবসায়ে বিনিয়োগের জন্য ঋণ নেওয়া হলে উক্ত ঋণের টাকা যাকাতযোগ্য সম্পদ থেকে বাদ যাবে। কিন্তু যদি ঋণগ্রহিতার মৌলিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত স্থায়ী সম্পত্তি থাকে তবে উক্ত ঋণ যাকাতযোগ্য সম্পদ থেকে বাদ যাবে না।
(ঘ) শিল্প-বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ঋণের টাকা যাকাতযোগ্য সম্পদ থেকে বাদ যাবে। তবে যদি ঋণগ্রহিতার মৌলিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত স্থায়ী সম্পত্তি থেকে উক্ত ঋণ পরিশোধ করা যায় তবে তা যাকাতযোগ্য সম্পদ থেকে বাদ যাবে না।
(ঙ) যদি অতিরিক্ত স্থায়ী সম্পত্তির মূল্য ঋণের পরিমাণের চেয়ে কম হয়, তবে ঋণের পরিমাণ থেকে তা বাদ দিয়ে বাকী ঋণের টাকা যাকাতযোগ্য সম্পদ থেকে বাদ যাবে। বিলম্বে প্রদেয় বা পুণ:তপসিলিকৃত ঋণের বেলায় শুধুমাত্র ঋণের বার্ষিক অপরিশোধিত কিস্তি যাকাতযোগ্য সম্পদ থেকে বাদ যাবে।
পশুর যাকাত
উটের সর্বনিম্ন নিসাব পাঁচটি, গরু-মহিষের ত্রিশটি এবং ছাগল-ভেড়ার চল্লিশটি। তবে এ ধরণের পশু বৎসরের অর্ধেকের বেশি সময় মুক্তভাবে চারণভূমিতে খাদ্য গ্রহণ করলেই এসব পশুর উপর সংখ্যা ভিত্তিক যাকাত ধার্য হবে। ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে যে কোন পশুসম্পদ প্রতিপালন করা হলে সেগুলোকে ব্যবসায়িক পণ্য বলে গণ্য করা হবে এবং এদের উপর যাকাত সংখ্যার ভিত্তিতে নয়, মূল্যের ভিত্তিতে ধার্য হবে। ব্যবসার উদ্দেশ্যে খামারে পালিত মৎস্য, হাঁস-মুরগী, গরু-ছাগল ইত্যাদি এবং খামারে উৎপাদিত দুধ, ডিম, ফুটানো বাচ্চা, মাছের রেণু, পোনা ইত্যাদি ব্যবসার সম্পদ হিসাবে যাকাত প্রদান করতে হবে। প্রিয়নবী মুহম্মদ (সা:) পানিতে বাস করা অবস্থায় মাছ ক্রয়-বিক্রয় করতে নিষেধ করেছেন। মাছ যখন বিক্রির জন্য ধরা হবে তখনই এর যাকাত পরিশোধ করতে হবে।
শস্য ও ফলের যাকাত (উশর)
শস্য ও ফলমূলের যাকাতকে উশর বলে। জমি থেকে উৎপন্ন সকল প্রকার শস্য, শাকশব্জি, তরি-তরকারি ও ফলের উপর যাকাত প্রযোজ্য। ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে বিনিয়োগ করা হলে বনজ বৃক্ষ, ঘাস, নলখাগড়া, ঔষধি বৃক্ষ, চা বাগান, রাবার চাষ, তুলা, আগর, ফুল, অর্কিড, বীজ, চারা, কলম ইত্যাদি যাকাতের আওতাভুক্ত হবে। ফসল আসার সাথে সাথে উশর পরিশোধ করতে হয়। এ ক্ষেত্রে বৎসর অতিক্রান্ত হওয়ার প্রয়োজন নাই। বৎসরে একাধিকবার ফসল আসলে একাধিকবার উশর পরিশোধ করতে হবে। অনেক ধরনের ফল, ফসল ও শাকশব্জি একই সাথে কাটা বা উত্তোলন করা যায় না। যেমন- মরিচ, বেগুন, পেঁপে, লেবু, কাঁঠাল ইত্যাদির পরিপক্কতা বুঝে কিছু কিছু করে কয়েকদিন পর পর পুরো কৃষি মৌসুমে বার বার উত্তোলন করা হয়। ফসলের মালিক যদি ফসলের আনুমানিক পরিমাণ নিরূপণ করতে সমর্থ হন এবং তা যদি নিসাব পরিমাণ হয় তবে প্রথম থেকেই প্রতি উত্তোলনের সাথে সাথে উশর (যাকাত) পরিশোধ করবেন। যদি মালিকের পক্ষে ফলফসে লর পরিমাণ নিরূপণ করা সম্ভব না হয়, তবে তিনি প্রথম উত্তোলন থেকে ফসলের হিসাব রাখবেন এবং যখনি মোট উত্তোলিত ফসলের পরিমাণ নিসাব পরিমাণে পৌঁছবে তখনি ঐ দিন পর্যন্ত মোট উত্তোলিত ফসলের যাকাত পরিশোধ করবেন এবং তৎপরবর্তী প্রতি উত্তোলনের সাথে সাথে যাকাত পরিশোধ করবেন। জ্বালানি কাঠ,আসবাবপত্র ও গৃহনির্মাণে ব্যবহার উপযোগী বৃক্ষের ক্ষেত্রে,এরূপ বৃক্ষ যখন কাটা হবে তখন এগুলোর উপর যাকাত প্রযোজ্য হবে,তা যত দীর্ঘ সময় পর কাটা হউক না কেন। যে জমিতে সেচ প্রয়োজন হয় না,প্রাকৃতিকভাবে সিক্ত হয়,তার ফসলের যাকাত হবে দশ ভাগের একভাগ (১০%) আর যে জমিতে সেচের প্রয়োজন হয়,তার ফসলের যাকাত হবে বিশ ভাগের একভাগ (৫%)। ফসল উৎপাদনের ব্যয় যেমন- চাষ,সার,কীটনাশক,বপন ও কর্তণ ইত্যাদি খরচ উৎপাদিত ফসলের পরিমাণ থেকে বাদ যাবে,তবে এ সব খরচ মোট উৎপাদিত ফসলের এক তৃতীয়াংশের বেশি বাদ যাবে না। ফসলের নিসাবের পরিমাণ ৫ ওয়াস্ক বা ৬৫৩ কিলোগ্রাম। অনেক কৃষি ফসল আছে যা মাপা বা ওজন করা হয় না। যেমন বিভিন্ন ধরনের ফল, ফসল, শাকশব্জি, ফুল, অর্কিড, চারা, বৃক্ষ ইত্যাদি। এগুলোর নিসাব নির্ধারণের ক্ষেত্রে দেশের সাধারণ ফসল চাল বা গমের ৬৫৩ কেজির মূল্য (স্থানীয় বাজারে গড় মূল্য) নিসাব হিসাবে গণ্য করা যাবে।
নিয়ত:
নিয়ত যাকাতের একটি গুরুত্ব রোকন। যাকাতের অংশ মূল সম্পদ হতে বের করার সময় নিয়ত অবশ্য করতে হবে। এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হতে হবে।
যাকাত আদায় করার সময়:
নিসাবের মালিক হওয়ার পর এক বৎসর অতিবাহিত হলেই সঙ্গে সঙ্গে যাকাত ওয়াজিব হয়। বিলম্ব করা জায়েয নাই। তবে বর্ষপূর্তির পূর্বে আদায় করা জায়েয।
যাকাত প্রদানের খাত
إِنَّمَا الصَّدَقَاتُ لِلْفُقَرَاء وَالْمَسَاكِينِ وَالْعَامِلِينَ عَلَيْهَا وَالْمُؤَلَّفَةِ قُلُوبُهُمْ وَفِي الرِّقَابِ وَالْغَارِمِينَ وَفِي سَبِيلِ اللّهِ وَابْنِ السَّبِيلِ فَرِيضَةً مِّنَ اللّهِ وَاللّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ (توبة (৬০
আল্লাহ  তায়ালা বলেন, “যাকাত তো কেবল
১. নিঃস্ব,
২. অভাবগ্রস্ত ও
৩. তৎসংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের জন্য,
৪. যাদের চিত্ত আকর্ষণ করা হয় তাদের জন্য,
৫. দাসমুক্তির জন্য,
৬. ঋণ ভারাক্রান্তদের,
৭. আল্লাহর পথে ও
৮. মুসাফিরের জন্য ” (তওবা,আয়াত-৬০)।
অসহায় এতিম, গরীব, মিসকীন, আশ্রয়হীন, গরীব বাস্তুহারা, দরিদ্র শিক্ষার্থী প্রভৃতি দুঃখী জনগোষ্ঠি যাকাতের প্রকৃত হকদার। ইহাদের মধ্যে গরীব আত্মীয় স্বজন ও প্রতিবেশী অধিক হকদার। কর্মঠ গরীবদেরকে আত্মকর্মসংস্থানে সহায়তা করে স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য যাকাতের অর্থ ব্যয় করা যায়। দ্বীনের প্রসারে ও দ্বীনী শিক্ষার বিস্তারে যাকাতের অর্থ ব্যয় করা যায়। যথার্থ কারণে ঋণগ্রস্ত এবং ঋণ পরিশোধে অক্ষম হয়ে পড়লে তাদের ঋণ মুক্তির জন্য যাকাতের অর্থ দিয়ে সাহায্য করা যায়। সফরকারী যদি আর্থিক অসুবিধায় পতিত হয়, তবে তাকে যাকাতের অর্থ দিয়ে সাহায্য করা যায়, যদিও তার বাড়ীর অবস্থা ভালো হয়। নও-মুসলিমকে পুনর্বাসনের জন্য যাকাতের অর্থ দিয়ে সাহায্য করা যায়। যাকাত এমন লোককেই দিতে হবে যারা যাকাত নিতে পারে।
যাদের যাকাত দেয়া যাবেনা
ধনী ব্যক্তির জন্য যাকাত খাওয়া বা ধনী ব্যক্তিকে যাকাত দেওয়া জায়েয নয়। আপন দরিদ্র পিতা-মাতা, দাদা-দাদী তথা ঊর্ধ্বস্থ সকল নারী-পুরুষ, অনুরূপ ভরণ- পোষণে নির্ভরশীল পুত্র-কন্যা এবং স্বামী স্ত্রীকে যাকাত প্রদান করা জায়েয নাই। যাকাত বহির্ভুত সম্পদের দ্বারা তাহাদের ভরণ-পোষণ করা ওয়াজিব।
 অনুরূপ মুহাম্মাদ (সা.) এর প্রকৃত বংশধরদের সম্মান ও মর্যাদার কারণে যাকাতের অর্থ দ্বারা সাহায্য করা জায়েয নয়। একমাত্র দানের অর্থ দ্বারাই তাদের খেদমত করা জরুরী। মসজিদ, মাদ্রাসা, রাস্তা-ঘাট ইত্যাদি নির্মাণের জন্য যাকাতের অর্থ ব্যয় করা নিষেধ। সাধারণ আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করাও জায়েয নয়। তবে আশ্রয় কেন্দ্রে দুরাবস্থা সম্পসারণ আশ্রয় প্রার্থীদের ব্যক্তি মালিকানাধীন ঘর-বাড়ী নির্মাণ করে দেয়া জায়েয। মনে রাখতে হবে যাকাত পরিশোধ হওয়ার জন্য ব্যক্তিকে মালিক বানিয়ে দেওয়া শর্ত। সুতরাং যাকাতের অর্থে মৃত ব্যক্তির দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করাও জায়েয নয়। যাকাত দেওয়া যেমন শরীয়তের বিধান, অনুরূপ যাকাত পাওয়ার যোগ্য ব্যক্তিকেই যাকাত দেওয়া শরীয়তের বিধান। সঠিক পাত্রে যাকাত প্রদান না করলে যাকাত পরিশোধ হবে না।
সামাজিক কল্যাণে যাকাত
ইসলামের ৫টি স্তম্ভের মধ্যে যাকাত অর্থনৈতিক স্তম্ভ। ইসলামে যাকাত ব্যবস্থা সমাজের দারিদ্র্য ও দুঃখ-কষ্ট দূর করা ও মানবতার কল্যাণ সাধন করা। ধনীদের সম্পদে গরীব ও বঞ্চিতের হক রয়েছে। সঠিক হিসাব করে নিয়মিত যাকাত প্রদান করার ফলে ধনীর সম্পদের উপর গরীবের হক পরিশোধ হয়। ফলে সম্পদ পরিশুদ্ধ ও হিফাযত হয়, যাকাতদাতার মনকে লোভ থেকে পবিত্র করে এবং দান ও ত্যাগ স্বীকারে অভ্যস্থ হতে সাহায্য করে। যাকাত প্রদানকারীর জন্য রয়েছে মহান আল্লাহ  তায়ালার নিকট হতে অগণিত পার্থিব ও পারলৌকিক কল্যাণ। যাকাতের উপকারভোগী সমাজের দূঃখী-দরিদ্র জনগোষ্ঠি। যাকাতের অর্থে সমাজের দরিদ্র জনগোষ্ঠির অভাব পূরণে সহায়তা করার পাশাপাশি অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস পায় এবং সমাজে ধনী- দরিদ্রের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহানুভূতির গুণাবলী বৃদ্ধি পায়।
দান-খয়রাত
সম্পদ উপার্জনের লক্ষ্য দুনিয়ার ও আখিরাতের শান্তি লাভ করা। উপার্জনকারী নিজের প্রয়োজন পূরণের পর তার নিকট যে সম্পদ অবশিষ্ট থাকে, তা সমাজের অসহায় মানুষের কল্যাণে ব্যয় করার বিধান রয়েছে। তাই যাকাত ছাড়াও সম্পদ হতে স্বীয় আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী, এতিম, মিসকিন ও সাহায্য প্রার্থীদের এবং আল্লাহর রাস্তায় দান করতে হয়। আল্লাহ  তায়ালা দানকে বৃদ্ধি ও সমৃদ্ধ করেন।
যাকাত হিসাব করার পদ্ধতি
নিসাব পরিমাণ অর্থ সম্পদের মালিক প্রত্যেক মুসলমানকে বছরান্তে যাকাত প্রদান করতে হবে। সম্পদের প্রকৃতি ও ধরণ অনুযায়ী যাকাতের হার ভিন্ন ভিন্ন হবে ।
ক) স্বর্ণ, রৌপ্য, নগদ অর্থ, ব্যবসায়িক মালামাল, আয়, লভ্যাংশ, কাজের মাধ্যমে উপার্জন, খনিজ সম্পদ ইত্যাদির উপর যাকাত ২.৫% হারে হিসাব করতে হবে।
খ) ফল ও ফসল উৎপাদনে যান্ত্রিক সেচ সুবিধা গ্রহণ করলে ৫% হারে যাকাত হিসাব করতে হবে।
গ) ফল ও ফসল উৎপাদনে জমি প্রাকৃতিকভাবে সিক্ত হলে ১০% হারে যাকাত হিসাব করতে হবে।
স্বর্ণ বা রূপার নিসাবের ভিত্তিতে প্রতি চন্দ্র বছরে (৩৫৪ দিন) নিজের পূর্ণ মালের যাকাত হিসাব করে প্রথমে সম্পদ থেকে যাকাতের অংশ অর্থাৎ পূর্ণ মালের চল্লিশ ভাগের এক ভাগ বা শতকরা আড়াই ভাগ বা ২.৫% পৃথক করে নিতে হবে। আর যদি হিসাবপত্র সৌর বছর অর্থ্যাৎ ৩৬৫ দিনের (যেমন ৩০ চৈত্র, ৩০ জুন বা ৩১ ডিসেম্বর) ভিত্তিতে হয় তাহলে যাকাত ধার্য হবে ২.৫৭৭% হারে। স্বর্ণের বাজার দর প্রতি গ্রাম ৪,০০০ টাকা হলে ৮৫ গ্রামের মূল্য ৩,৪০,০০০ টাকা যার উপর যাকাত হবে ২.৫% হারে = ৮,৫০০.০০ টাকা। আর রূপার বাজার দর প্রতি গ্রাম ১৫০ টাকা হলে ৫৯৫ গ্রামের মূল্য ৮৯,২৫০ টাকা যার উপর যাকাত হবে ২.৫% হারে = ২২৩১.২৫ টাকা। যাকাত হিসাব করার সময় এসব স্বর্ণ ও রৌপ্যের বিক্রয় মূল্যের (অর্থ্যাৎ যাকাত হিসাব করার সময় বিক্রয় করতে চাইলে যে মূল্য পাওয়া যাবে) ভিত্তিতে যাকাত হিসাব করতে হবে। যাকাতের অংশ পৃথক করার সময় বা প্রদান করার সময় অবশ্যই নিয়ত করতে হবে। নচেৎ যাকাত পরিশোধ হবে না। যৌথ মালিকানার মালের যাকাত ব্যক্তিগতভাবে নিজের অন্যান্য মালের সাথে দেয়া যায় আবার সম্মিলিতভাবেও শুধু যৌথ মালিকানার মাল থেকে যাকাত পরিশোধ করা যায়। যাকাত নগদ অর্থে প্রদান করা উচিত। গরীবের কাছে নগদ অর্থই অধিকতর কল্যাণকর। কারণ নগদ অর্থের দ্বারা যে কোন প্রয়োজন মিটানো যায়। যাকাত কোন প্রকার দয়া বা অনুগ্রহ নয়।

শনিবার, ১০ জুন, ২০১৭

ফরযে আইন ইলম শেখা ছাড়া ঈমান শেখা হয় না’

Emran Hossain Adib

ﯾٰۤﺎَﯾُّﻬَﺎ ﺍﻟَّﺬِﯾْﻦَ ﺍٰﻣَﻨُﻮﺍ ﺍﺩْﺧُﻠُﻮْﺍ ﻓِﯽ ﺍﻟﺴِّﻠْﻢِ ﻛَﺎٓﻓَّﺔً
ﯾٰۤﺎَﯾُّﻬَﺎ ﺍﻟَّﺬِﯾْﻦَ ﺍٰﻣَﻨُﻮﺍ ﺍﺗَّﻘُﻮﺍ ﺍﻟﻠﻪَ ﻭَ ﻗُﻮْﻟُﻮْﺍ ﻗَﻮْﻟًﺎ ﺳَﺪِﯾْﺪًﺍ ﯾُّﺼْﻠِﺢْ ﻟَﻜُﻢْ ﺍَﻋْﻤَﺎﻟَﻜُﻢْ ﻭَ ﯾَﻐْﻔِﺮْ ﻟَﻜُﻢْ ﺫُﻧُﻮْﺑَﻜُﻢْ ؕﻭَ ﻣَﻦْ ﯾُّﻄِﻊِ ﺍﻟﻠﻪَ ﻭَ ﺭَﺳُﻮْﻟَﻪٗ ﻓَﻘَﺪْ ﻓَﺎﺯَ ﻓَﻮْﺯًﺍ ﻋَﻈِﯿْﻤًﺎ .
একটি মাসআলা আমরা সবাই শুনেছি, দ্বীনী ইল্ম হাছিল করা ফরয। হয়ত অনেকে এভাবে শুনেছি যে, ফরযের দুটো স্তর। ফরযে আইন, ফরযে কেফায়া। কিছু পরিমাণ ইলম ফরযে আইন, কিছু পরিমাণ ইলম ফরযে কেফায়াহ। ফরযে আইন ইলম বলতে বোঝায়, যে পরিমাণ ইলম সবার জন্য শেখা ফরয। আর ফরযে কেফায়া ইলম হল সেটা দ্বীনের ইলম, যা সবার জন্য শেখা ফরয নয়, তবে কিছুসংখ্যক আলেম এমন থাকা জরুরি যারা ফিকহ ও দলীল-আদিল্লা নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন। যাতে কারো প্রয়োজন হলে তাঁদের কাছ থেকে শিখতে পারে ও জানতে পারে।

আজকে আমরা ফরযে আইন ইলম সম্পর্কে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।
প্রথমেই ঈমান, ইসলাম শিখতে হবে। এই শেখাটার প্রথম স্তর হল ফরযে আইন ইলম। আপনি যদি বলেন ঈমান শিখব, ইসলাম শিখব- এর মানেই হল যতটুকু ইলম ফরযে আইন ততটুকু শিখতে হবে। শেখার দুটি স্তর আছে। এক হচ্ছে, জ্ঞান অর্জন করা, আরেকটা হল প্রায়োগিক শিক্ষা। যা শিখবেন ওটার প্রয়োগ করার অনুশীলন করতে হবে। শুধু জ্ঞান অর্জন করলাম তাহলে এই শেখা পরিপূর্ণ হল না। ফরযে আইন যতটুকু ইলম, এর মধ্যেও দুটি স্তর আছে। একটা হল, জ্ঞান অর্জন আরেকটা হল, সেটার প্রায়োগিক শিক্ষা-অনুশীলন। তাহলে ফরয আদায় হবে। অন্যথায় ফরয আদায় হবে না। 
এই যে একটা শব্দ আমরা বলি, ‘ঈমান শেখা’ খুব দামী, কঠিন এবং গভীর একটা শব্দ। তো ঈমান শেখা বলতে গেলেই আমাকে ফরযে আইন ইলম শিখতে হবে। ফরযে আইন ইলম শেখার ব্যবস্থা না করে যতই ঈমান শেখার কথা বলি, ঈমান শেখা হবে না। এমনকি ফরযে আইনের উভয় পদ্ধতিতে; জ্ঞান অর্জন আর প্রায়োগিক অনুশীলন -এই উভয় স্তরের ফরযে আইন পরিমাণ ইলমের উপর মেহনত করলে ঈমান শেখা হবে, ইসলাম শেখা হবে।
এখন বুঝতে হবে, ফরয আইন ইলমের অধ্যায়গুলো কী কী।
ফরযে আইন ইলমের দুটো স্তর। জ্ঞান অর্জন ও প্রায়োগিক অনুশীলন। এখন বলছি ফরযে আইন ইলম দুই প্রকার। প্রথম প্রকার ইলম শুরু হয় ঈমান আনার পরেই। যে আল্লাহর মেহেরবানীতে মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছে সে শুরু থেকেই ঈমানওয়ালা, ইসলাম ওয়ালা। তো ঈমান আনার পর থেকে, ইসলাম সম্পর্কে বোধ সৃষ্টি হওয়ার পর থেকেই এই অংশের ইলম অর্জন শুরু করতে হবে। এক দিনের এক সপ্তাহের এক মাসে আমি শিখে শেষ করতে পারব না। ঠিক আছে। এক সপ্তাহে সব শিখে ফেল- শরীয়ত এটা বলে না। কিন্তু শিখতে থাকতে হবে। বাদ দেওয়া যাবে না। এমনিই তো আমরা ছুটি পাই। যেমন, আজকের দিন পুরা ইলমের জন্য আমরা ওয়াক্ফ করেছি, কিন্তু এর মধ্যেও কি ছুটি পাইনি আমরা? ছুটি দিতে হবে। ছুটি না দিলে আমরা লাগাতার কীভাবে কাজ করব? আমরা রোযা রাখি। তাতে কি ছুটি নেই? প্রথম ছুটি তো ইফতার। ইফতারের পর থেকে আবার সেহরীর শেষ পর্যন্ত ছুটি। নামায ফরযে আইন। কিন্তু ছুটি আছে। ফজরের নামাযের পর থেকে লম্বা ছুটি যোহর পর্যন্ত। যোহরের পর থেকে আছর পর্যন্ত মোটামুটি লম্বা ছুটি। আছর থেকে মাগরিব পর্যন্ত ছুটি। মাগরিবের পর থেকে ইশা পর্যন্ত। আমাদের দেশে তো ইশা আগে আগে পড়ে, এজন্য কম ছুটি। ইশা আরো দেরীতে পড়লে আরো ছুটি। আর ইশার পর থেকে একেবারে ফজর পর্যন্ত ছুটি। আল্লাহ তাআলা কত আসান করেছেন। দ্বীন বুঝার, দ্বীন শেখার এবং দ্বীনের উপর চলার যদি কারো ইচ্ছা থাকে, নিয়ত থাকে তাহলে কি কঠিন? নিয়ত না থাকলে তো সহজ থেকে সহজ বিষয়ও কঠিন। 
যাই হোক, বলছিলাম দ্বীন শিখতে থাকতে হবে। দ্বীন শেখা বাদ দেওয়া যাবে না। মানে হল, আপনি ভুলে যেতে পারবেন না। এক সপ্তাহে একটু শিখলেন, তারপর আর খবর নেই, ভুলে গেছেন। আমাদের ফরয ইলমের যে অনেক বাকি আছে, তার খবর নেই। ভুলেই গেছে। এটা কি জায়েয হবে? জায়েয হবে না। চলতে থাকতে হবে। ছুটি নিতে পারব, কিন্তু একেবারে ভুলে যেতে পারব না। এক সপ্তাহ একটু শিখলাম তারপর তিন দিনের ছুটি বা আরো এক সপ্তাহের ছুটি, ঠিক আছে, এক সপ্তাহ পর আসুন। আরেকটু শিখুন। কিন্তু একদিন একটু শিখলাম, তারপর মাসকে মাস পার হয়ে গেল, বছরকে বছর পার হয়ে গেল, আর কোনো খবর নেই, এটা কি ছুটি নেওয়া হল, না ভুলে যাওয়া হল? ভুলে যাওয়া যাবে না। ফরযে আইন ইলমের যতক্ষণ একটা অংশও বাকি আছে, যেটা আমি শিখিনি, ততক্ষণ পর্যন্ত ভুলে যাওয়া যাবে না। চালিয়ে যেতে হবে। অবহেলা করতে পারবেন না। এটা হল এক প্রকার ফরয ইলম।
আরেক প্রকার, যখন যে কাজ তখন সেটা শেখা ফরয। দেরি করা যাবে না। আগের প্রকার তো বললাম, সেটা ছুটি নিয়ে নিয়ে শিখতে থাকেন। কিন্তু অবহেলা করে ভুলে যাওয়া যাবে না। আরেক প্রকার ফরযে আইন ইলম হল, যেটা নগদ দরকার সেটা নগদ শিখতে হবে। দেরি করা যাবে না। একজন ব্যবসা শুরু করতে যাচ্ছে, ভালো কথা। কিন্তু ব্যবসার মধ্যে তো দু’প্রকার আছে, হালাল ও হারাম। আরেক প্রকার আছে হারাম ও হালালের মিশ্রণ। এখন আমাকে জানতে তো হবে যে, এটা হালাল, এটা হারাম, এটা সন্দেহযুক্ত। এমন কিছু যদি করি যাতে হালাল-হারাম মিশ্রিত- এটা করা যাবে না। কিছু ব্যবসা আছে যা আগাগোড়াই হারাম। কাজেই কোনটা হালাল, কোনটা হারাম তা জানতে হবে। আমি ব্যবসা শুরু করব এখন আর শিখব এক বছর পর, এক বছর শেখা ছাড়াই ব্যবসা চালাব, এটা হয় না।
ব্যবসার কিছু বিষয় আছে কৌশলগত। কিছু আছে ব্যবস্থাপনাগত। ব্যবস্থাপনাগত বিষয় আপনি অভিজ্ঞ ব্যবসায়ীর কাছে শেখেন বা কিছুদিন বড় ভাইয়ের দোকানে বসে তার কাছ থেকে শেখেন। কিন্তু হারাম-হালালের বিষয়গুলো আলেমের কাছ থেকে শিখতে হবে। ব্যবসা খুলে দিলেন কিন্তু ব্যবসার হারাম-হালাল জানলেন না, ফরযে আইন লংঘন হল। ব্যবসায় ঢুকেননি তাহলে ব্যবসার হালাল-হারাম সম্পর্কে আরো দেরিতে জানলেও অসুবিধা নেই। কিন্তু যখন ব্যবসা শুরু করতে যাচ্ছেন তখন আর দেরি করার সুযোগ নেই। ব্যবসা শুরু করবেন এই সপ্তাহে, ব্যবসার হালাল-হারাম জানবেন কি এক সপ্তাহ পর, একমাস পর? না এখনই। তো এটা হচ্ছে আরেক প্রকারের ফরযে আইন ইলম। মানে যা আমাকে এখনই জানতে হবে। দেরি করা যাবে না।

একজন হজ্বে যাওয়ার নিয়ত করেছে। তো হজ্বের পদ্ধতি শিখতে হবে না? এটা নগদ দরকার, দেরি করা যাবে না। হজ্বের ইহরাম বেঁধে ফেললাম, রওয়ানাও হয়ে গেলাম। কিন্তু খবর নেই যে, ইহরাম কাকে বলে। অনেকে মনে করে, সাদা দুটো কাপড় পরিধানের নামই ইহরাম। লোকে বলে ইহরাম বাঁধা। আর মনে করে কাপড় বাঁধাই হল ইহরাম বাঁধা। যেমন বলা হয় নামাযের নিয়ত বাঁধা। ওখানে কী বাঁধে? হাত বাঁধে। আসলে নিয়ত বাঁধা মানে নিয়ত করা। এই না যে, কোনো কিছু দিয়ে বেঁধে ফেলা। তো ইহরাম বাঁধার মানে হল, হজ্বের ইহরাম করা। কীভাবে তা করবে আর এর কারণে নতুন কী কী বিধান আসবে, এগুলো জানতে হবে। কিন্তু দেখা যায়, অনেকের এগুলো কিছুই জানা থাকে না।
একবার বিমানবন্দরে গেলাম একজনকে এগিয়ে দেওয়ার জন্য। হজ্বে যাচ্ছিলেন। ওখানে একজন জিজ্ঞাসা করল, এক বেচারা ইহরামের কাপড় লাগেজে দিয়ে দিয়েছে। লাগেজ চলে গেছে ভেতরে। সঙ্গে ছোট ব্যাগে ইহরামের কাপড় রাখেনি। বাড়ি থেকে ইহরাম বেঁধে যায়নি। এটা ঠিক যে ইহরাম বাড়ি থেকে বেঁধে না আসারও অবকাশ আছে। ইহরাম বাঁধার শেষ একটা জায়গা আছে। যে যে দেশ থেকেই মক্কা শরীফে আসুক। একটা শেষ সীমানা আছে। ওখানে এসে ইহরাম বাঁধতেই হবে। ইহরাম না বেঁধে ওই মীকাত অর্থাৎ ঐ জায়গা অতিক্রম করা যায় না। বিমান ঢাকা থেকে রওয়ানা হলে পাঁচ ঘণ্টা সাড়ে পাঁচ ঘণ্টার মত সময় লাগে। জিদ্দা পৌঁছার আগেই ঐ জায়গাটা এসে যায়। তো এখন কেউ বাসা থেকে ইহরাম বাঁধল না, বিমান বন্দর থেকেও করল না, কিন্তু জেদ্দায় পৌঁছার ঘণ্টা খানিক আগে তার ইহরাম বাঁধতে হবে। নতুবা তার ঐ সীমানা অতিক্রম করতে হবে ইহরাম ছাড়া; এটা নাজায়েয। এমন হয়ে গেলে কী করতে হবে সে মাসআালাও আছে। তো চাইলে এই অবস্থাতেও ইহরাম বাঁধা যায়, নিয়ত করে লব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক... বললে ইহরাম হয়ে গেল। কিন্তু সে তো সাধারণ পোষাক পরে আছে। ইহরাম অবস্থায় পুরুষ এই সাধারণ পোষাক পরে থাকতে পারে না। এখন করবে কী? এটা কি নগদ মাসআলা হল না? এটাও শিখেনি, হজ্বে রওয়ানা করেছে। এখন কে বলবে মাসআলা? তো একজন মুফতী সাহেব ছিলেন, বলে দিয়েছেন মাসআলা- যে আপনি বিমানে বসে ঘণ্টা দুয়েক পর নিয়ত করে তালবিয়া পড়বেন। আপনার ইহরাম শুরু হয়ে যাবে। কিন্তু এই ২/৩ ঘণ্টা ইহরামের পরিপন্থী হালতে থাকবেন এটা ওযর। এখন করবেন কী, ভুল হয়ে গেছে। ইস্তেগফার পড়তে থাকবেন আর ওখানে গিয়ে কাপড় হাতে পাওয়ার পরপরই ইহরামের কাপড় পরে নিবেন। আর কয়েকঘণ্টা ইহরাম পরিপন্থী হালতে ছিলেন এর জন্য যে জরিমানা আসে তা আদায় করবেন।
তো ভালো যে, মুফতী সাহেবকে পেয়েছেন। না পেলে তিনি কী করতেন? অনেকে ইহরামের জন্য কাপড়কেই মূল মনে করে। কাজেই সে ভাবত যে, কাপড়ই যেহেতু নেই আমি আর কী করব? জিদ্দায় যাই, তারপর ইহরাম বাঁধব। অথচ ওটা করলে ডবল গুনাহ হত।
তো আমি বলছিলাম, যে ইলম আপনার এখন দরকার, সেটা আপনাকে এখনই শিখতে হবে। একেক জনের একেক যরুরত। যে ব্যবসায় নামবে তার ব্যবসারটা দরকার। যে হজ্বে যাচ্ছে তার হজ্বেরটা দরকার। এরকম একেক জনের একেক বিষয়ের ইলম দরকার।
একজন চাকরি নেবে, আগে কোথাও চাকরি করেনি। এই প্রথম চাকরি; তাকে চাকরির মাসায়েল জানতে হবে। আমি একজন চাকরিজীবি হিসেবে, একজন কর্মচারী বা কর্মকর্তা হিসেবে যেই স্তরের হই না কেন- আমার উপর তো কিছু দায়-দয়িত্ব আসে। কী কী দায়িত্ব আসে? সকাল এতটায় যেতে হবে, এতটায় ফিরতে হবে। অফিস সময়গুলো বলে দিল। এ সময়টা অফিসের দেওয়া সময়। এটা পালন না করলে শুধু কর্তা নারায হবে, মালিকপক্ষ নারায হবে, এইটুকু? না, এ সময়টা অফিসে না দিলে আল্লাহও নারায হবেন? এই বিষয়টা তো আমাকে জানতে হবে। যার যে পেশা সেই পেশার সাথে সংশ্লিষ্ট বিধান জানতে হবে।

একজন সেলুন খুলছে। এটা তার পেশা। কিন্তু কেউ কি সেলুন খোলার পর মুফতী সাহেবের কাছে যায় যে, হুযুর আমি একটি সেলুন খুলেছি, এটা আমার আয়ের উৎস। আমাকে এ সংক্রান্ত মাসায়েল বলুন? কারণ হুযুরের কাছে গেলে হুযুর বলবেন যে, কারো দাড়ি কামাতে পারবে না। মানুষ এসে ভীড় করুক দাড়ি কামানোর জন্য, তুমি পারবে না। দাড়ি কামালে তো টাকা দেয়, সেটা হালাল না হারাম, কী হুকুম? এগুলি জানতে গেলে তো অসুবিধা! একজন দোকানদার কত পণ্য-সামগ্রী তার দোকানে রাখে। কোনটা দোকানে রাখা ও বিক্রি করা জায়েয, কোনটা জায়েয নয়- মাসআলা জানতে হবে। জানতে আসলেই হয়ে যায়। আমি যে আয়াত পড়লাম-
ﯾٰۤﺎَﯾُّﻬَﺎ ﺍﻟَّﺬِﯾْﻦَ ﺍٰﻣَﻨُﻮﺍ ﺍﺩْﺧُﻠُﻮْﺍ ﻓِﯽ ﺍﻟﺴِّﻠْﻢِ ﻛَﺎٓﻓَّﺔً
হে ঈমানদারগণ! (যারা ঈমান এনেছো), তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ কর। -সূরা বাকারা (২) : ২০৮
পূর্ণ ইসলামকে বিশ্বাস কর। পূর্ণ ইসলামকে গ্রহণ কর। পূর্ণ ইসলামকে মান। গ্রহণ করতে, মানতেই যদি অসুবিধা তাহলে তো ঈমান হল না। আর যদি গ্রহণ করে, মানে কিন্তু আমল করতে গেলে ভুল-ত্রুটি হয়ে যায়। শয়তানের ধোঁকায় পড়ে যায়। বিভিন্ন কারণে করতে পারে না। নিজেকে অপরাধী মনে করে, তাহলে ঈমান আছে কিন্তু আমলের ত্রুটি। আর যদি গ্রহণই না করে এবং বলে নামায রোযার কথা হুযুররা বলে, ঠিক আছে, এখন দেখি আমার একটা সেলুন আছে, হুযুররা এটার উপরও কথা বলা শুরু করেছে, এটাও নাকি আমার হুযুুরদের কাছে শিখতে হবে? এটা তো শিখব ভালো নাপিতের কাছে। হুযুরদের কাছে এটা শেখার কী?
শুনুন, ভালো নাপিতের কাছে শিখবেন, কীভাবে কাঁচি ধরবেন, কীভাবে চালাবেন- এগুলো। এটা নাপিতের কাছে যাওয়া ছাড়া শেখা যাবে না। একটা কিসসা বলি। এক নাপিত বাদশার চুল-মোঁচ ঠিকঠাক করত। একদিন বাদশা ঘুমিয়ে পড়েছেন। তো নাপিত এসে বাদশাকে ঘুমের মধ্যে রেখেই চুল কাটা শুরু করল। এবং যেভাবে করা দরকার করে দিল। ঘুম থেকে উঠে বাদশা আশ্চর্য হয়ে গেলেন, আরে! নাপিত এসেছিল? কীভাবে করল সে? আমি ঘুমিয়ে ছিলাম, টেরই পেলাম না, ঘুমও ভাঙ্গল না! এ তো নাপিতদের বাদশা। হাকীমুল উম্মত থানভী রাহ. কিসসাটা বর্ণনা করেছেন। ঘটনা তো ঘটনাই্, সম্ভবত এটা বাস্তব ঘটনা হবে। তো বাদশা যখন সনদ দিলেন যে, ‘নাপিতদের বাদশা’, তো বাদশাহর কথা নাপিতের জন্য খুব সম্মানের বিষয়। কথাটা খুব মশহুর হয়ে গেল। এখন অন্যান্য নাপিতের স্ত্রীরা এসে এ নাপিতের বউকে, মোবারকবাদ জানাচ্ছে যে, বাদশা তোমার স্বামীকে ‘নাপিতের বাদশা’ বলেছেন। তখন এই নাপিত বা তার স্ত্রী মন্তব্য করল, বাদশা তো বাদশাই। কোন্ নাপিত তার পেশাতে বড়, এটা বাদশা বুঝবেন না, এটা তার বিষয় না। এই পেশার যারা গুরু তারা কেউ এই সনদ দিলে এর মূল্য ছিল। কিন্তু এই সনদ দিয়েছেন দেশের বাদশা। এটা তো তাঁর বিষয় নয়।

বুঝতে পেরেছেন? বিষয়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। হযরত প্রফেসর হামীদুর রহমান ছাহেব দা. বা. এই ঘটনা অনেক বলেন। আমরা বলি না যে, অমুক হুযুর অনেক বড় আলেম, অমুক হুযুর অনেক বড় বুযুর্গ। আমি কী বুঝি- তিনি অনেক বড় আলেম না ছোট আলেম। এটা তো আরেক আলেমই বুঝবেন। তো আমি বলছিলাম এই যে, এত পারদর্শিতা সে অর্জন করেছে যে, ঘুমন্ত অবস্থায় একজনের চুল-মোঁচ কেটে দিয়েছে, ঘুম ভাঙেনি, এটা কি ছোটখাট কোনো পা-িত্য? এটা কোনো হুযুরের কাছে শিখতে হবে? সেলুনওয়ালাদেরকে আমরা বলি না যে, এটা হুযুরের কাছে শিখতে আস। এটা তো নাপিতের কাছেই শিখতে হবে। হুযুুরের কাছে যা শিখতে হবে, তা হল, সেলুনের জন্য যদি সে দোকান ভাড়া নিয়ে থাকে সে ভাড়া সংক্রান্ত মাসআলা জেনে নিবে। একজন মহিলা এসে তার চুল ছোট করে দিতে বলল, এটা করা তার জন্য জায়েয হবে, নাকি হবে না- হুযুরের কাছে জানতে হবে। নাপিত হলো পুরুষ, এসেছে মহিলা; তাও আবার মাথার চুল ছোট করার জন্য?!
চুলের বিভিন্ন ঢং দেখবেন সেলুনে। বিভিন্নজনের কাছে বিভিন্ন ঢং ভালো লাগে। এগুলোর অনেকগুলোই অনুত্তম। কিছু কিছু আছে, নাজায়েয। ঢালাওভাবে সবগুলোকে না জায়েয বলা যায় না। আমরা যেভাবে চুল রাখি, হয় বাবরী চুল আর না হয় ছোট করে সামনে পেছনে বরাবর করে রাখি। একেবারে স্বাভাবিক। এটা হল সুন্দর পদ্ধতি। এর ব্যতিক্রম হলে হারাম হবে- তাও বলছি না। কিন্তু ব্যতিক্রমের মধ্যে যা যা আছে, সবগুলো জায়েয ফ্যাশনে পড়ে না। কিছু না জায়েযও আছে, সেটা জানতে হবে। যে এমন ফ্যাশন করতে চায় তারও জানতে হবে আর যে এমন ফ্যাশন করে দেবে তারও জানতে হবে।

বিউটি পার্লার আছে না? ওখানে কী কী কর্মকা- হয়? কোনো পার্লারওয়ালা তো দারুল ইফতায় আসে না। ফরযে আইন লংঘন। আরে ভয় পাওয়ার কী আছে? তুমি মাসআলা জান। আমল যদি করতে নাই পার নিজেকে অপরাধী মনে কর। নিজেকে অপরাধী মনে করলেও তো গুনাহ কমল। কিন্তু না জায়েযকে জায়েয মনে করে করা? মানুষ জানতে ভয় পায়। জানতে ভয় পাওয়া ঠিক নয়। হালাল হারামের খোঁজ-খবর নেওয়া দরকার। আমলের মধ্যে যদি ত্রুটি হয়েও যায়, নিজেকে তো অন্তত অপরাধী মনে করব। এটুকু লাভ তো হল। কিন্তু যদি আমি না-ই জানি তাহলে তো হারামকে হালাল মনে করব। নাজায়েযকে জায়েয মনে করব। এটা তো আরো বড় সমস্যা। এজন্যই বললাম, যার যেটা পেশা, যার যেটা কর্মক্ষেত্র তাকে ঐ বিষয়ের ইলম অর্জন করতে হবে। তদ্রূপ যার যেই হক এখন তার উপর এসেছে- সে সম্পর্কে জানতে হবে।
বাবা হয়ে গেলাম কিন্তু কোনো মাসআলা জানারই যরুরত মনে করলাম না। একজন স্বামী হয়ে গেল, কোন মাথাব্যাথা নেই তার মাসআলা জানার ব্যাপারে। মেয়েকে যখন বিয়ে দেওয়া হল, স্ত্রী হিসেবে তার উপর কী কী মাসআলা আসছে জানার যরুরত মনে করা হল না। বাবা ইন্তেকাল করেছে, মীরাসের মাসআলা জানার যরুরত মনে করা হল না। এরকম কত ক্ষেত্র, কয়টা বলব? কয়েকটি উদাহরণ দিলাম। যে যে পেশায় থাকুক সে পেশা সংক্রান্ত শরীয়তের মাসআলা থাকবে। কেউ কৃষক; এ বিষয়ে কত মাসআলা। আবার কেউ আইনজিবী; তারা শুধু লয়ারদের কাছেই প্র্যাকটিস করতে যায় কিন্তু তাদের কম লোকই হয়ত হুযুরদের কাছে আসা জরুরি মনে করে। আমার যদি মজবুত মাধ্যম থাকত সব আইনজিবী-উকিলদের কানে এই আয়াতের পয়গাম পৌঁছে দিতাম-
ﻭَ ﻟَﺎ ﺗَﻜُﻦْ ﻟِّﻠْﺨَﺂﻯِٕﻨِﯿْﻦَ ﺧَﺼِﯿْﻤًﺎ
আর তুমি খেয়ানতকারীদের পক্ষ অবলম্বন করো না। -সূরা নিসা (৪) : ১০৫
যদি উকিলরা এই বিধানটির উপর আমল করত তাহলে যেসব ক্ষেত্রে বাদি-বিবাদির এক পক্ষ নিশ্চিত জালিম, তার কি নিজের জন্য উকিল পাওয়ার কোনো সুযোগ ছিল?
আমি একটা ইবাদত শুরু করলাম, কীভাবে করব? যে কাজ আমি করতে চাই, সে কাজের ক্ষেত্রে কী কী বিধান আছে, জীবনের কোন্ অবস্থায় কী বিধান- আরবীতে এটাকে বলে ‘ইলমুল হাল’, মানে নগদ অবস্থায় তোমার কী বিধান জানা দরকার; কী বিধান তোমার উপর আরোপিত হচ্ছে, সে বিধান সম্পর্কে জানা ফরযে আইন।

নগদ ফরয। এটা ফরযে আইন ইলমের এক প্রকার। আরেক প্রকার যা এখনের বিষয় না, তখনের বিষয় না, সব সময়ের বিষয়। সেটা আস্তে আস্তে শিখে ফেলতে হবে। সেটা হল আকীদার বিষয়। এক নম্বরে আকীদা। এটা জানা ফরযে আইন। দ্বিতীয় নম্বর হল ফরযসমূহ; ইসলাম কী কী বিষয় ফরয করেছে। ফরযের তালিকা জানা থাকতে হবে। ইসলাম কী কী জিনিস হারাম করেছে, হারামের তালিকা জানতে হবে। তাহলে এক নম্বরে হল আকীদাতুল ইসলাম, যা মক্তবে পড়ে এসেছেন; ঈমানে মুজমাল-
ﺁﻣَﻨْﺖُ ﺑِﺎﻟﻠﻪِ ﻛَﻤَﺎ ﻫُﻮَ ﺑﺄﺳﻤﺎﺋﻪ ﻭَﺻِﻔَﺎﺗِﻪ .
আমি আল্লাহর প্রতি ঈমান আনলাম, আল্লাহ তাঁর নামসমূহ ও গুণাবলীসহ যেভাবে আছেন। ﻭَﻗَﺒِﻠْﺖُ ﺟَﻤِﻴْﻊَ ﺃَﺣْﻜَﺎﻣِﻪ ﻭَﺃَﺭْﻛَﺎﻧِﻪ এবং আল্লাহর সমস্ত হুকুম আমি মেনে নিলাম। এটা হল সংক্ষিপ্ত। আরেকটু বিস্তারিত হল ঈমানে মুফাসসাল-
ﺁﻣَﻨْﺖُ ﺑِﺎﻟﻠﻪِ، ﻭﻣﻼﺋﻜﺘﻪ، ﻭَﻛُﺘُﺒِﻪ، ﻭَﺭَﺳُﻠِﻪ، ﻭَﺍﻟْﻴَﻮْﻡِ ﺍﻟْﺎﺧِﺮِ، ﻭَﺍﻟْﻘَﺪْﺭِ ﺧَﻴْﺮِﻩ ﻭَﺷَﺮِّﻩ ﻣِﻦَ ﺍﻟﻠﻪِ ﺗَﻌَﺎﻟﻰ، ﻭَﺍﻟْﺒَﻌْﺚِ ﺑَﻌْﺪَﺍﻟْﻤَﻮْﺕِ .
এগুলো ইসলামের আকীদা। আমরা চাই যে মক্তবে উস্তাদযী আমাকে যে আকীদার শুধু নামগুলো শিখিয়েছেন, ব্যস ঐটুকু নিয়েই কবরে যেতে। আল্লাহর প্রতি ঈমান, ফেরেশতার প্রতি ঈমান, কিতাবের প্রতি ঈমান এগুলো তো শুধু শিরোনাম। এগুলোর অর্থ কী? কী অর্থ আল্লাহর প্রতি ঈমানের? এই যে বললাম ﻛَﻤَﺎ ﻫُﻮَ ﺑﺄﺳﻤﺎﺋﻪ ﻭَﺻِﻔَﺎﺗِﻪ ‘যেমন আল্লাহর নাম ও গুণাবলী’ সেভাবে আমি ঈমান আনলাম। কিন্তু সেই নাম ও গুণাবলী কী? মক্তবে তো তা বলা হয়নি। আর আপনি চাচ্ছেন এভাবেই কবরে চলে যেতে। এই আকীদার প্রত্যেকটি নামের অধীনে এর বিশ্লেষণ আছে। ঈমান বিল্লাহ কী? ১-২-৩-৪-৫ এগুলো সবকটা মিলে ঈমান বিল্লাহ। কুরআনের প্রতি ঈমান মানে কী? ১,২,৩,৪,৫ এই কতগুলো বিষয় নিয়ে কুআনের উপর ঈমান। বিস্তারিত আকীদা যদি অন্তরে থাকে তাহলে আল্লাহর প্রতি ঈমান হল, কুরআনের প্রতি ঈমান হল। ভাই বলুন দেখি আল্লাহর প্রতি ঈমান মানে কী? তা তো জানি না। তো আকীদার শুধু নামগুলোই মুখস্থ করে কি কবরে যেতে চাই? কুরআন ও হাদীসে প্রতিটির যে বিশ্লেষণ আছে তা কি জানতে হবে না? এটা হল ‘আকীদাতুল ইসলাম’।

ফরযে আইন ইলমের প্রথম বিষয় হল আকীদাতুল ইসলাম। দ্বিতীয় কথা ‘ফারায়েযুল ইসলাম’। কুরআন-হাদীসে আল্লাহ আমার উপর কী কী জিনিস ফরজ করেছেন, একজন মুসলিমের উপর কী কী জিনিস ফরয এগুলো জানতে হবে। তৃতীয়ত, ইসলাম তার অনুসারীদের উপর কী কী জিনিস হারাম করেছে? সগীরা গুনাহ, কবীরা গুনাহ সবই তো গুনাহ। হারাম, মাকরূহে তাহরীমী, মাকরূহে তানযীহী সবই তো বর্জনীয়। কিন্তু বর্জনীয়ের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ কী? হারাম এবং মাকরূহে তাহরীমী। এগুলোর তালিকা আমার জানা থাকতে হবে না? তা হল- আকীদাতুল ইসলাম, ফারায়েযুল ইসলাম, মাহারিমুল ইসলাম এই বিষয়গুলো।
আরেকটি শিরোনাম হচ্ছে ‘আদাবুল ইসলাম’-ইসলামের আদব। কোন্ ক্ষেত্রে কী আদব-কায়েদা ইসলাম জানিয়েছে এগুলো শিখে ফেলতে হবে। বলে, হুযুর আদব তো আর ফরয না। কোনো কোনো আদব আছে ফরযেরও দাদা। আদব পরিপন্থী কোনো কিছু করাকে কী বলে? বেয়াদবী বলে। সব বেয়াদবী কী জায়েয? কত বেয়াদবী আছে তো হারাম, কত বেয়াদবী আছে এর কারণে ঈমানই চলে যায়। তাহলে আদব শেখা কি মামুলী কথা, না গুরুত্বপূর্ণ কথা? ইসলামের আদবগুলো শিখতে হবে। কোন ক্ষেত্রে কী আদব শিখিয়েছে ইসলাম তা জানতে হবে। প্রয়োগের ক্ষেত্রে সব আদব রক্ষা করা সব সময় জরুরি নয়। ফরয নয়। কিন্তু আদব জানা থাকা, ইসলামের আদব জানা থাকা ফরয। সব আদব এক মাপের নয়। কিছু আদব আছে ফরয, কিছু আদব আছে মুস্তাহাব। মুস্তাহাব যেটা সেটাতো আর ফরয নয়। কিন্তু আপনার জানা তো থাকতে হবে যে ঐ আদব ফরয আর এই আদব মুস্তাহাব। মুস্তাহাবটা দৈনিক আমল না করলে না করলাম। যেমন জামা গায়ে দেওয়ার সময় ডান হাত আগে ঢুকানো এটা মুস্তাহাব। ভুলে বাম হাত আগে ঢুকে গেছে এতে ফরয বা ওয়াজিব লংঘন হয়নি। কিন্তু মুস্তাহাব লংঘন হয়েছে। কিন্তু সওয়াব আছে না এতে? ইচ্ছাকৃত আদব পরিপন্থী কাজ করা কি ভালো? কিন্তু এটা মুস্তাহাব। আপনার জানা তো থাকতে হবে। আপনার জানা না থাকলে সব সময় তো উল্টা করবেন। মসজিদে ঢোকার সময় ডান পা আগে দেওয়া আদব এটা মুস্তাহাব। সুন্নত। ফরয ওয়াজিব নয় কিন্তু জানা তো থাকতে হবে। জানা না থাকলে দেখা যাবে বেশির ভাগই বাম পা আগে যায়। বের হওয়ার সময় ডান পা আগে বের হয়। এটা কি মুসলিমের জন্য ভালো, সেজন্য অনেকে ধারণা করে যে, এটা তো মুস্তাহাব, এটা তো নফল, না জানলে কী হবে? আরে মুস্তাহব ও নফলের ইলম অর্জন করাও কি শুধু মুস্তাহাবই, না একটি জরুরি কাজ?
ﻭﺁﺧﺮ ﺩﻋﻮﺍﻧﺎ ﺃﻥ ﺍﻟﺤﻤﺪ ﻟﻠﻪ ﺭﺏ ﺍﻟﻌﺎﻟﻤﻴﻦ