এক. ইমামু আহলিল বসরা সাইয়েদুনা হাসান বসরী র.। শীর্ষস্থানীয় তাবেয়ীদের একজন। সাহাবীদের হাতে বড় হয়েছেন। তাঁর ব্যাপারে সমকালীন উলামায়ে কিরামের বক্তব্য হচ্ছে: তার চেয়ে সাহাবাদের অধিক সদৃশ আর কেউ আমাদের চোখে পড়েনি।
দুই. ইসলামে যতগুলো ফিরক্বা ও দল-উপদল রয়েছে। হক হোক কিংবা বাতিল হোক- প্রত্যেকেই হক হওয়ার প্রমাণ স্বরূপ নবীজী সা. ও সাহাবায়ে কিরামের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করে। এএটা একটা প্রশংসাপত্রের মতো। একারণে দেখা যায়, খাওয়ারেজ-কাদেরিয়া থেকে শুরু করে শিয়া ও (ভণ্ড) সুফিরাও সাহাবায়ে কিরাম কিংবা বড় কোনো ইমাম বা ব্যক্তিত্বের সঙ্গে নিজের নিসবত আবিষ্কার করে। উদাহরণত শিয়ারা নিজেদের আলী রা. এর অনুসারী বলে দাবি করে। কিন্তু আলী কি শিয়া ছিলেন? তথাকথিত ইসলামী কমিউনিজমের দাবিদাররা আবু যর গিফারীর সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ততা দাবি করে। আবু যর গিফারী কি কমিউনিস্ট ছিলেন? ক্বাদেরিয়া সম্প্রদায় হাসান বসরীর সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ততা দাবি করতো এবং এ ব্যাপারে তার নামে কিতাবও লিখেছে। হাসান বসরী কি তকদীর অস্বিকারকারী ভ্রান্ত ক্বাদরিয়া সম্প্রদায়ের জনক ছিলেন? মাইজভাণ্ডারীরা তাদের গ্রন্থে আব্দুল হক্ব দেহলভী, ইমাম গাযালীসহ অনেকের নাম তাদের সালাফ হিসেবে উল্লেখ করে। এর মানে দেহলভী কিংবা গাযালী মাইজভাণ্ডারী? প্রত্যেকটির উত্তর না।
তিন. ইমাম আবু নুআইম ইস্পাহানী 'হিলয়াতুল আউলিয়া' গ্রন্থে তাসাউফের ইমামদের আলোচনা করেছেন। সেখানে তিনি আবু বকর, উমর, উসমান ও আলী রা. এর মতো বড় বড় সাহাবায়ে কিরামের জীবনীও এনেছেন। এর অর্থ তারাও সুফি ছিলেন! কেউ বলতে পারেন, যুহদ ও ইবাদতের ভিত্তি করে তাদের আলোচনা আনতে পারেন। ইবনুল জাওযী এর জবাবে বলেছেন, তাসাউফ একটি মতাদর্শ এবং কেবল যুহদ নয়; বরং আরও অনেক কিছু এর ভেতরে রয়েছে। বরং যাদের জীবনী তাতে এনেছেন, উদহারণত ইমাম শাফেয়ী, কথিত তাসাউফের বিরুদ্ধে তার বক্তব্য রয়েছে'।
চার. বর্তমান অনেক (হক এবং বাতিল) সুফী তরীকা হাসান বসরী র. এর দিকে নিজেদের নিসবত করে। হাসান বসরী- আলী- রাসূলুল্লাহ সা.। অথবা হাসান বসরী-আনাস বিন মালিক-রাসূল সা.। কোনো তরীকাতে আবু বকরও রা. রয়েছেন। এর অর্থ কী? দু'টি অর্থ করা যেতে পারে। এক. তারা বুযুর্গ ছিলেন অন্য আরও দশজনের মতোই। কিন্তু তাদের কোনো ছাত্র তাসাউফের সঙ্গে জড়িয়ে গেছেন এবং পরবর্তীতে পরম্পরায় তরীকার আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। দুই. তাদের কাছে আলাদা কোনো ইলম ছিল, ইবাদতের আলাদা তরীকা ছিল, আলাদা দুআ-দরূদ ও অজীফা ছিল, বাইয়াত ও খিরকা ছিল। দ্বিতীয়টি অসম্ভব। আবু বকর কিংবা আলী রা. এর আলাদা কোনো ইলম ছিল না। আলাদা ইবাদত-পদ্ধতি কিংবা দুআ-অজীফা ছিল না। তবে প্রথমটি সম্ভব। কিন্তু কথা হলো- কোনো ছাত্র কিংবা ছাত্রের ছাত্র যদি নিজস্ব কোনো পদ্ধতি আবিষ্কার করে তার জন্য উস্তাদ দায়ী হন কীভাবে?
পাঁচ. হাসান বসরী র. এর আমলে ইবাদত-বন্দেগীর ওপর জোর দিতেন এমন একশ্রেণীর মানুষের সমাজে উদ্ভব ঘটেছিল। এরা খুব কান্নাকাটি, ইবাদত ও দুনিয়াবিমুখ ছিলেন। যিকির ও ইবাদত করতে গিয়ে কখনও বেহুঁশ হয়ে যেতেন। আসমা বিনতে আবু বকর, আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর ও মুহাম্মাদ ইবনে সীরীনের মতো সাহাবী ও তাবেয়ীরা এদের সমালোচনা করতেন। সে যাই হোক, হাসান বসরী র. অত্যন্ত পরহেযগার ও বুযুর্গ তাবেয়ী ছিলেন। প্রচুর ইবাদত-বন্দেগী ও মুজাহাদ করতেন। তার কয়েকজন শিষ্য ছিলেন ইবাদতের ক্ষেত্রে আরও অগ্রগণ্য। ইবাদত করতে করতে হাদীস ও ইলমের প্রতিও দুর্বলতা এসে গিয়েছিল। হাসান বসরী র. তাদের সঙ্গে নিজ ঘরে আলাদা বৈঠক করতেন। সেখানে তাসাউফ-যুহদ ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা হতো। পরবর্তীতে এসব ছাত্ররা যেমন আব্দুল ওয়াহেদ বিন যায়দ ও আমর বিন উবায়েদের মতো বুযুর্গ মানুষ বিভিন্ন ত্বরীকা ও খানকা প্রতিষ্ঠা করেন। আর হাসান বসরী হয়ে যান ত্বরীকার ইমাম!
ছাত্ররা খানকা প্রতিষ্ঠা করে সুফি ও ত্বরীকার প্রতিষ্ঠাতা হলে হাসান বসরীও ত্বরীকার প্রতিষ্ঠাতা হয়ে যান? তাহলে আলী রা. কেন শিয়া হবেন না? হাসানী বসরী কেন ক্বাদরী (তকদীর অস্বিকারকারী) হবেন না? আবু যর রা. কেন কমিউনিস্ট হবেন না? ত্বরীকা বলতে যা কিছু বোঝায়, সুফিবাদ বলতে যা কিছু বোঝায়- হাসান বসরী র. এর যুগে এসব কিছু ছিল না। তিনি ইবাদত করতেন, যাহেদ ছিলেন। তাকওয়া, যুহদ, ইলম, নুসুক ইত্যাদি নিয়ে ছাত্রদের সঙ্গে আলোচনা-পর্যালোচনা করতেন। তাঁর ছাত্র সুফি হলে তিনি সুফিদের ইমাম হতে যাবেন কেন? আবুদল ওয়াহিদ বিন যায়েদ আর হাসানের ইলম, চিন্তাগত মানহাজ, রাজনৈতিক মানহাজ কোনোকিছুই মিল ছিল না।
ছয়. সাহাবায়ে কিরাম, তাবেঈন, চার ইমাম, সিহাহ সিত্তার আইম্মায়ে কিরাম, মুহাদ্দিসীন হাতে গনা দুয়েকজন ব্যতীত কেউ ত্বরীকাপন্থী ছিলেন না। হুম সকলে ছিলেন যাহেদ, মুত্তাকী, বুযুর্গ, আল্লাহর অলী। আজও পৃথিবীতে ত্বরীকাপন্থী উলামােয়ে কিরামের চেয়ে ত্বরীকার বাইরের উলামায়ে কিরামের সংখ্যা বেশি। তাযকিয়া ও ইসলাহ ফরজ। তাই অঞ্চল কিংবা প্রেক্ষাপট ভেদে যদি ব্যক্তিবিশেষ কারও কাছ থেকে ইসলাহী ফায়েদা নিতে হয় সেটা নিতে সমস্যা নয়; বরং জরুরী। এটার বিরোধিতা করা হচ্ছে না। গুরত্বও অস্বীকার করা হচ্ছে না। অস্বীকার করা হচ্ছে জগতের বড়বড় আয়িম্মায়ে কিরাম যারা এগুলো চিনতেনও না তাদের নামের 'তাযকিয়া' নেয়াটাকে। আজ যদি হাসান বসরী কিংবা আব্দুল কাদের জিলানী র. দুনিয়াতে আসতেন, চিশতিয়া কিংবা ক্বাদেরিয়া ত্বরীকা দেখে তারা আবার মনোকষ্টে মরে যেতেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন