সাবিহা মেয়েটা কেমন যেন অদ্ভুত, বোরকা,নিকাব,হাত মোজা,পা মোজা পরে ক্লাসে আসে আবার ক্লাসের পুরো সময়টাতেও এসব পরে থাকে!
কিভাবে পারে মেয়েটা! গরম ও লাগেনা নাকি! আর একবারও কি আয়নায় নিজেকে দেখেছে আগাগোড়া মোড়া কালো পোশাকে ওকে কেমন লাগে?
আর এটা তো গার্লস কলেজ,এখানে এত বাড়াবাড়ির কি এমন দরকার মনে মনে ভাবে শায়লা…
কলেজের প্রথম দিন থেকেই সাবিহা কে দেখে আসছে শায়লা কিন্তু কখনো কথা হয়নি। তবে সাবিহা কথা/বার্তায় আচরনে খুব অমায়িক অন্য ফ্রেন্ডদের থেকে শুনেছে শায়লা।
:
সেদিন সেমিনার রুমে একাকী বসে শায়লা আতিকের কথা ভাবছে। সম্পর্ক টা ভাল যাচ্ছেনা ইদানিং আতিকের সাথে।
এই আতিকের সাথে সেই আতিকের কোনই মিল নেই।কোচিংয়ে গিয়ে পরিচয় হয় আতিকের সাথে। শায়লাদের ক্লাস নিতে আসে ঢাবি তে পড়ুয়া আতিকুর রহমান। প্রথম দেখাতেই ভাল লেগে যায় শায়লার। শায়লা একদিন আতিকের ফোন নাম্বার সংগ্রহ করে ফোন দেয় অংক বুঝার বাহানায়।
সেই থেকে কথায় কথায় আতিকের সাথে সম্পর্ক গড়ে উঠে শায়লার, শায়লার জন্য আতিক পাগল ছিল তখন।
শায়লা একটু অভিমান করলেই আতিক অস্থির হয়ে ফোনের পর ফোন দিত। আতিকের এমন অস্থিরতা দেখে ভালোই লাগত শায়লার।
কিন্তু এখন আতিক অনেক বদলে গেছে।
আজকাল কেমন যেন অল্পতেই রেগে যায়। সম্পর্ক রাখবেনা বলেও শাসায়! অথচ এই আতিকের জন্য কি না করেছে শায়লা?
আতিক কে কতটা ভালবাসে এটা প্রমাণ করার জন্য নিজেকে সঁপে দিয়েছিল আতিকের কাছে।
সেদিন আতিক বলেছিল খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে করে ফেলবে তারা..
অথচ আতিক এখন সম্পর্ক রাখবেনা বলে হুমকি দেয়! ভাবতে ভাবতে দুচোখ ঝাপসা হয়ে আসে শায়লার।
কাঁধে কারও স্পর্শ পেয়ে চমকে ঘুরে তাকায় শায়লা।
– সাবিহা!
– কি হয়েছে তোমার, শায়লা? কাঁদছ কেন?
– না কিছু না।
– আমাকে বিশ্বাস করতে পারো। আমি তোমাকে অনেকক্ষন ধরেই খেয়াল করছি তুমি এখানে বসে কান্না করছো। কেউ কিছু বলেছে?
– জানো আমার বয়ফ্রেন্ড এখন আর আমাকে চায়না, অথচ আমি কি না করেছি ওর জন্য! এটুকু বলেই শায়লা কেঁদে উঠল।
– একটা ব্যাপার কি জানো শায়লা! দুনিয়ার কেউ তোমাকে বুঝবেনা, তোমার অন্তরের চাপা কষ্ট গুলো অনুভব করবেনা, তোমার কষ্টের ভাগ কেউ নিবেনা, একজন ছাড়া!
.
একজন আছেন যিনি তোমার সকল দুঃখের ভাগ নিবেন, তোমার প্রতিটি অশ্রুর ফোঁটা যাঁর কাছে দামী, তুমি যে প্রবলেম ফেস করছো তা দূর করে দেয়ার ক্ষমতা তিনিই রাখেন শুধু!
আমাদের রব।
তুমি আল্লাহর কাছে চাও, যা তোমার জন্য কল্যানকর তা তুমি চেয়ে নাও, কেবল তিনিই পারবেন তোমার সমস্ত দুঃখ কষ্ট দূর করে দিতে। তবে তুমি হয়ত জানোনা তুমি একটা হারাম সম্পর্কে আছ, প্রেম কত বড় গুনাহের কাজ তা তুমি উপলব্ধি করতে পারছোনা, মেয়েদের জন্য কন্ঠের পর্দার কথাও কোরআনে বলা হয়েছে আর সেখানে দিনের পর দিন একজন গায়রে মাহরাম পুরুষের সাথে প্রেমালাপ, ঘুরাঘুরি অবলিলায় স্পর্শ করে যিনার দিকে এগিয়ে যাওয়া কত জঘন্য গুনাহ তা কি বুঝতে পারছো?
একটা হারাম সম্পর্ক নিয়ে প্রতিনিয়ত যিনার দিকে অগ্রসর হয়ে তুমি ভাল থাকবে বলে আশা করছো?
– সাবিহা, প্রেম গুনাহ তা তো জানতাম না!
আর আমি যদি ভালবেসে কাউকে বিয়ে করি তবে তা গুনাহ হবে কেন?
– প্রথমত একজন মুসলিম হিসেবে আমাদের তাকদীরের উপর বিশ্বাস রাখতে হবে। আমার সঙ্গী কে হবে তা আমার তাকদীরে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে।
সুতরাং আমি কাউকে ভালবাসলেই যে তার সাথে আমার বিয়ে হবে এমন টা ধারনা করা ভুল। আমি একজন কে ভালবেসে বসে আছি অথচ আমার তাকদীরে আছে অন্য কেউ! তখন স্বভাবতই আমি প্রেমিকের সাথে যাই করি না করি রেজাল্ট হবে জিরো!
এই জিরো রেজাল্টের ফাইনাল রেজাল্ট কিন্তু ভয়াবহ!
একে তো যার সাথে বিয়ে তাকদীরে লিপিবদ্ধ আছে সেই বেচারার হক্ব নষ্টের গুনাহ এবং নিজের আমলনামায় যুক্ত হওয়া প্রেমিকের সাথে কাটানো প্রতিটি মুহুর্তের গুনাহের ফলাফল হল জাহান্নাম!
দ্বিতীয়ত মুসলিম নারীর জন্য পর্দা ফরজ, তুমি পর্দার আয়াতের গুরুত্ব অনুধাবন করলে চোখ বন্ধ করে বলতে বাধ্য হবে প্রেম বলে জগতে কিছু নেই, এটি শুধুমাত্র শয়তানের ধোঁকা।
আর তোমার জন্যও পর্দা এখন ফরজ শায়লা, তুমি বেপর্দায় আছ বলেই শয়তান তোমাকে দিয়ে একটা হারাম কাজ করাতে পেরেছে, এবং এখন যিনার দিকে নিয়ে যাবে সম্পর্কটাকে…
– কিন্তু পর্দা তো বিয়ের পর করলেও চলে। এখন আমি পর্দা করে চললে আমি দেখতে কেমন যেটা লোকে বুঝবে কি করে? আর এই বয়সে যদি একটু সাজগোজ না করি তবে কখন করব?
– এটা ঠিক পর্দা করে চললে লোকে দেখতে পাবেনা তুমি দেখতে কেমন। আর পর্দারও উদ্দেশ্য লোকে যাতে দেখতে না পায় তুমি দেখতে কেমন। আল্লাহর হুকুম ও হল নারীর সৌন্দর্য প্রদর্শন করবেনা স্বামী ব্যতীত অন্য কারও সামনে।
– বুঝলাম, কিন্তু সাবিহা! আমার পর্দা ব্যাপার টা মোটেও ভাল লাগেনা।
আমাকে যদি আড়ালেই থাকতে বলা হয় তবে কেন আমাকে সৌন্দর্য দেয়া হল?
– সৌন্দর্য টা তোমার স্বামীর জন্য। আর তোমার পর্দা দুনিয়ার সব পুরুষের জন্য।
শায়লা আল্লাহর কাছে চাও এই হারাম সম্পর্ক থেকে তোমাকে উদ্ধার করতে, আর পর্দা টা করো বোন, নিশ্চয়ই জাহান্নাম অনেক ভয়ানক জায়গা! জাহান্নামের আগুন সহ্য করার ক্ষমতা আমাদের কারও নেই। পর্দা একটি ফরজ বিধান। প্রদর্শনের মোহে তুমি হয়ত দুনিয়ার জীবন বেপর্দায় কাটিয়ে দিলে কিন্তু এরপর?
এরপর তোমাকে অবশ্যই আল্লাহর সামনে দাঁড়াতে হবে দুনিয়ার জীবনের কৃতকর্ম হাতে নিয়ে।
:
সাবিহা চলে গেল। শায়লা কেমন যেন একটা ধাক্কা খেল।
কি বলে গেল সাবিহা! আল্লাহর কাছে চাইতে যেন আতিকের সাথে সম্পর্ক ব্রেকআপ করে দেন? প্রেম গুনাহ? প্রেম যিনার দিকে নিয়ে যায়?
কিন্তু সে তো এসব বহু আগেই করে ফেলেছে আতিক কে ভালবেসে! তার কাছে তো এটা গুনাহ মনে হয়নি!
পর্দার কথা বলল সাবিহা!
শায়লা কত সেজেগুজে কলেজে আসে। ছেলে থেকে শুরু করে বুড়ো পর্যন্ত দ্বিতীয়বার ফিরে তাকাতে বাধ্য। আর শায়লা কিনা বোরকা পরবে! নিকাব করবে!
বাসায় ফিরেও শায়লা সাবিহার কথা ভুলতে পারলোনা কিন্তু কোনভাবেই নিজেকে সে রবের সামনে দাঁড় করাতে পারলোনা! কিসের যেন জড়তা এসে অবস করে দেয় ওকে!
আর কিই বা চাইবে?
আতিক কে ভালবাসে সে। তাকে ভুলে যেতে সে আল্লাহর কাছে চাইবে?
সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে শায়লা। আতিক কে ছাড়া সে বাঁচবেনা, তার সমস্ত সুখের ঠিকানা যে আতিকের কাছে। আর আগামীকাল থেকে সাবিহা নামের মেয়েটার থেকে সে নিরাপদ দূরত্বে থাকবে।
প্রেম নাকি গুনাহ!! এখনই নাকি পর্দা করা ফরজ!!
শায়লা তার মার কাছে শুনেছ তার বাবা মা ও নাকি প্রেম করে বিয়ে করেছে। প্রেম যদি গুনাহ হত তবে কি তার বাবা-মা প্রেম করে বিয়ে করত?
আর তার মা তো বিয়ের আগে বোরকা পরতোনা, এখনো পরেনা। তাতে কি এমন হয়েছে!
নাহহ.. সাবিহার সাথে আর কোন কথা না কাল থেকে… মাথা খারাপ করে দিয়েছে মেয়েটা!
…..
…
..
১৫বছর পর।
..
….
…..
শায়লার বিয়ে হয়েছে আজ ১৩বছর হল। একটা মেয়েও হয়েছে শায়লার, নাম রেখেছে শায়ন্তি। শায়ন্তির ১১ বছর পূর্ণ হল। মেয়ে কে স্কুলে দিয়ে এসে শায়লা দোতলার বারান্দায় গিয়ে বসল। আজ কোন কাজেই মন বসছেনা শায়লার। হঠাৎ চোখ গেল নীচে বাসার গেইটে। নতুন ভাড়াটিয়া উঠছে মনেহয় পাশের ফ্ল্যাটে।
নিজের অতীতে ফিরে গেল শায়লা। ১৩বছর আগে দুচোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে আতিকের হাত ধরে উঠেছিল এই বাসায়।
আতিককেই বিয়ে করেছিল শায়লা। আতিক বিয়ে করতে রাজি হয়নি শুরুতে কিন্তু শায়লা সাফ জানিয়ে দিল বিয়ে না করলে আত্মহত্যা করে বসবে শায়লা আর দোষ সব আতিকের। বাধ্য হয়ে বিয়েতে রাজি হয় আতিক।
শায়লা ভেবেছিল বিয়ে হলে সব ঠিক হয়ে যাবে কিন্তু নাহ! আজ ১৩বছরেও কিছুই ঠিক হয়নি। আতিক এখন ওকে সহ্যই করতে পারেনা। আতিক আর শায়লার মাঝে সেতুবন্ধন শুধুমাত্র শায়ন্তি। শায়লা বুঝে গেছে একজন ভুল মানুষ কে সে বেছে নিয়েছে জীবনে আর দীর্ঘ ১৩ বছর ধরে সে ভুলের গ্লানি টেনে যাচ্ছে। ১৩বছরের বিবাহিত জীবন কে আর যাই হোক সংসার বলেনা। একটা সময় আতিকের এমন রূঢ় আচরনের প্রতিবাদ করত শায়লা। প্রতিদিনই ঝগড়া হত। কখনো আতিক গায়েও হাত তুলত। প্রতিবাদ করে কপালে কয়েক ডজন চড়/থাপ্পড় জুটেছে আর কিছুই পরিবর্তন হয়নি!
আতিক কি জানে ভালবাসার মানুষটির বদলে যাওয়া কতটা পুড়ায়?
কিন্তু মেয়েটা হওয়ার পর এখন ঝগড়াঝাটি একটু কমেছে।
আতিক তার অফিস, কলিগ, বন্ধু-বান্ধবী নিয়ে পড়ে থাকে আর শায়লা বাস্তবতার কাছে হার মেনে ঘরের কাজ আর মেয়েটাকে নিয়ে আছে। সত্যি বলতে একজনের প্রতি আরেকজনের অভিযোগ করার সময় ই হয়না এখন।
হঠাৎ মনে হল সাবিহার কথা!
সাবিহা ঠিক ১৫বছর আগে শায়লা কে বলেছিল যা তার জন্য কল্যানকর তা আল্লাহর কাছে চেয়ে নিতে! সেদিন চাইতে পারেনি শায়লা। অন্ধ ছিল আতিকের মিথ্যা প্রেমে। কেন সেদিন সাবিহার কথা কে গুরুত্ব দেয়নি সে!
সাবিহা! না জানি কোথায় আছে এখন! সেদিনের পর আর কথা বলেনি ওর সাথে শায়লা। নিশ্চয় সাবিহা আমার চেয়ে অনেক ভাল আছে। সাবিহা তো তাঁর রবের কাছে চাইতে জানে যা আমি জানিনা। জীবনে আর কি কখনো দেখা হবে সাবিহার সাথে!
…
..
পরদিন সকালে কলিংবেলের শব্দ শুনে দরজার দিকে এগিয়ে গেল শায়লা। দরজা খুলে দেখল পূর্ণ পর্দাশীল একজন মহিলা, সাথে ছোট দুইটা মেয়ে। অদ্ভুত ব্যাপার এতটুকু মেয়ে দুইটাও বোরকা/নিকাব পড়ে আছে!
শায়লা কাকে চান জানতে চাওয়ার আগেই মহিলা টি বলে উঠল ‘আসসালামু আলাইকুম’
কণ্ঠ টা কি একটু পরিচিত মনে হল শায়লার!
সাবিহা নয়ত?
কিন্তু এত বছর পর.. এখানে!
নাহ.. কিভাবে সম্ভব!
সাবিহার সাথে তো কোন যোগাযোগ ই নেই। সাবিহা তার বাসার ঠিকানা জানবে কেমন করে?
সালামের উত্তর দিয়ে শায়লা বলল কে আপনি?
-আমি সাবিহা। একসাথে কলেজে পড়তাম, মনে আছে শায়লা?
-সাবিহা!! হুট করেই সাবিহা কে জড়িয়ে ধরল শায়লা। ঘটনার আকস্মিকতায় সাবিহা একটু থমকে গেল।
-আমি স্বপ্নেও ভাবিনি তোমার সাথে আবার দেখা হবে! আমি যে কি খুশি হয়েছি! এসো ভেতরে এসো… কিন্তু তুমি আমার ঠিকানা জানলে কি করে?
-আমরা তোমার পাশের ফ্ল্যাটেই উঠেছি গতকাল। বাসায় ঢুকার সময় তোমাকে বারান্দায় দেখেছি। সত্যি বলতে আমিও খুশি হয়েছি তোমাকে এতদিন পর দেখে। আর এটা আমার বড় মেয়ে মারঈয়াম, এটা ছোট মেয়ে আয়িশাহ।
– এত ছোট মেয়ে কেও বোরকা/নিকাব পরিয়েছ? এদের তো এখন খেলাধূলার বয়স। বাচ্চা মেয়ে।
– বাচ্চা কোথায়! বড়টার বয়স ১২,ছোটটার ৮। ওদের কে তো আরও ছোট থেকেই বোরকা পরিয়েছি আমি।
– আশ্চর্য! তোমার মেয়েরা পরতে রাজি হল? আমার শায়ন্তি তো চিৎকার করে মাথা খারাপ করে ফেলবে ও যা পরতে চায় তা পরতে না দিলে।
শায়ন্তি কে ডেকে এনে পরিচয় করিয়ে দিল শায়লা। শায়ন্তির চেহারা দেখেই বুঝা যাচ্ছে বোরকা পরা এই মানুষ গুলো কে তার পছন্দ হয়নি মোটেও।
– শায়লা, বাচ্চাদের মানসিকতা, আচরন, আদব এসব তৈরি হয় সে কেমন পরিবেশে বড় হচ্ছে তার উপর। আমার মা ছোট থেকেই পর্দা করতেন কারন আমার নানী পর্দাশীল ছিলেন। আমি ছোট থেকেই আমার মা কে দেখেছি পর্দা করতে। আমিও কোন অভিযোগ ছাড়াই পর্দা শুরু করেছিলাম। আমার মেয়েরা আমাকে দেখেছে। তারাও কোন অভিযোগ ছাড়াই পর্দা শুরু করেছে। আমি জোর করে কখনোই আমার মেয়ে কে পর্দা করাতে পারতাম না। হয়ত তাকে সাময়িক বাধ্য করতে পারতাম কিন্তু এটা তার জীবনে প্রতিফলিত হত না।
শায়লার ভেতর তোলপার শুরু হয়ে গেল। শায়লা তার নানী কে কখনো দেখেনি পর্দা করতে, শায়লার মা ও কখনো করেনি, শায়লা ও করছেনা। তাহলে শায়ন্তি! সেও করবেনা…
শায়লার বাবা-মা প্রেম করে বিয়ে করেছে, তবু বাবা-মার মধ্যে ঝগড়া লেগেই থাকত। শায়লা নিজেই কি সুখি হতে পেরেছে?
নিজের জীবনে যা হওয়ার হয়েছে, শায়ন্তির জীবন টা নষ্ট হতে দিবে না শায়লা। সে নিজে যে ভুল গুলো করেছে শায়ন্তি যেন সেগুলো না করে তার জন্য এখনই শায়লা কে ব্যবস্থা নিতে হবে।
শায়লা চায়না তার মেয়ের জীবনটাও ভুলের উপর কাটুক। আজ সাবিহা কে দেখে কেমন যেন হাহাকার শুরু হয়েছে শায়লার বুকের ভেতর। কি পেয়েছে শায়লা তার জীবনে? মিথ্যে ভালবাসার মোহে সব হারিয়েছে সে।
অথচ সাবিহা! মিথ্যে মোহের পেছনে নিজেকে উৎসর্গ করেনি সে। সাবিহা কে দেখেই বুঝা যায় সুখী সংসার তার।
– শায়লা! কি চিন্তা করছো?
– একটা কথার উত্তর দিবে,সাবিহা?
– হ্যাঁ বলো..
– আমি সত্যিই এতদিন ভুল পথে ছিলাম, যে ভালবাসার জন্য নিজের সব হারিয়েছি সেই ভালবাসাই আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে। আমি কেমন ছিলাম এতটা বছর আমার জানা নেই। কোন রকম বেঁচে ছিলাম তবে এই বেঁচে থাকা কে জীবন বলেনা। ১৫বছর আগে তুমি বলেছিলে আমার রবের কাছে আমার কল্যানের জন্য চাইতে। সেদিন আমি পারিনি রবের সামনে দাঁড়াতে। আজ আমি রবের সামনে দাঁড়াতে চাই। যে রবের ভয়ে তুমি এতটা বছর ধরে কালো পোশাকে নিজেকে আড়াল করেছ, যে রবের ভয়ে তুমি প্রেম থেকে দূরে ছিলে, যে রবের কাছে তুমি তোমার কল্যানের জন্য চাইতে, যে রব তোমাকে এমন সুখের জীবন দিয়েছেন সে রবের কাছে আজ আমি আত্মসমর্পণ করতে চাই।
কিন্তু সাবিহা, এতটা বছরে তো রব নামের মহান সত্তার সাথে আমার কখনো কথা হয়নি, আজ হঠাৎ তাঁর কাছে চাইতে গেলে তিনি কেন আমাকে দিবেন? কেন আমাকে ক্ষমা করবেন?
সাবিহা শায়লা কে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিল। শায়লার জন্য কত দোয়া করেছে সে! যেদিন থেকে শায়লা কোন কারন ছাড়াই ওর সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিল খুব কষ্ট পেয়েছিল সাবিহা। সে তো শায়লা কে ভাল পরামর্শ দিয়েছিল কিন্তু শায়লা তাকে ভুল বুঝল।
অবশ্য শায়লারও দোষ ছিলনা। শয়তান তার সামনে ভুল পথ টাকে সঠিক হিসেবে উপস্থাপন করেছিল। সাবিহা শায়লার জন্য তাহাজ্জুদে খুব করে দোয়া করত। আলহামদুলিল্লাহ! আল্লাহ এতদিন পর শায়লা কে সঠিক পথের সন্ধান দিয়েছেন।
:
শায়লা নিজেও কাঁদছে। চোখ মুছে দিয়ে শায়লার সামনে বসল সাবিহা।
তোমার ফিরতে হয়ত একটু দেরি হয়েছে কিন্তু সময় এখনো ফুরিয়ে যায়নি। তুমি এখনো তওবা করে গুনাহ থেকে ফিরে আসলে আল্লাহ অবশ্যই তোমাকে ক্ষমা করবেন। বান্দা গুনাহ করে অনুতপ্ত হয়ে ফিরে আসলে আল্লাহ তো ক্ষমার ওয়াদা দিয়েছেন। আর আল্লাহর ওয়াদা নিঃসন্দেহে সত্য।
সেদিন শায়লা নামাযের নিয়ম শিখে নিল সাবিহার কাছ থেকে। প্রতি সন্ধ্যায় সাবিহার কাছে গিয়ে সে আর শায়ন্তি কোরআন ও শিখবে। সাবিহা রাতেই একটা কোরআন আর বোরকা-নিকাব এনে হাদিয়া দিল শায়লা কে। কোরআন টা হাতে নেয়ার পর শায়লার ভেতরটা কেঁপে উঠল। কোরআনের স্পর্শে শায়লার মনেহল বহু বছরের অশান্ত/অতৃপ্ত আত্মা আজ নিমেষেই শান্ত হয়ে গেল। বুকের বাম পাশে যে শক্ত বড় পাথর টা এতদিন চেপে বসে ছিল আজ হঠাৎই সেটা কোথায় যেন মিলিয়ে গেল।
…
..
৬মাস পর।
.
মাঝ রাতে চাপা কান্নার শব্দে আতিকের ঘুম ভেঙে গেল। এত রাতে কে কান্না করছে বাসায়! একবার ভাবল যা ইচ্ছা হোক তাতে তার কি! সকালে অফিস আছে, ঘুমাতে হবে তাকে। কিন্তু কিসের যেন একটা টান ওকে ঘুমাতে দিল না। উঠে পাশের ঘরে উঁকি দিল যেখান থেকে শব্দ টা আসছিল। আবছা আলো-আঁধারি ঘরেও শায়লা কে চিনতে কষ্ট হল না আতিকের।
শায়লা!
ও এভাবে ফ্লোরে পড়ে কাঁদছে কেন! আবার অস্পষ্ট স্বরে কি যেন বলেও যাচ্ছে। ইদানিং কিছু একটা হয়েছে শায়লার। নামাযের ওয়াক্তে আতিক কে মসজিদে যেতে বলে, অফিসে থাকলেও ফোনে বলে নামায আদায় করে নিতে, যেন কত গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজের ভার সে নিয়েছে যা আতিক মিস করলে সমস্ত দায়ভার শায়লা উপর বর্তাবে! আতিক তার কথা শুনে কখনো মসজিদে যায়নি তবু শায়লা হাল ছাড়েনি!
শায়লা এখন পর্দা করে বাইরে যায়, নামায আদায় করে, পাশের ফ্ল্যাটে কার কাছে গিয়ে নাকি আরবী ও শেখে! শায়ন্তিকে পরিবর্তনের চেষ্টা ও চালিয়ে যাচ্ছে। সেদিন এসে বলল শায়ন্তি কে মহিলা মাদ্রাসায় পড়াতে চায় সে। এক বাক্যে ‘না’ বলে দেয়ার পরও তার অভিব্যক্তির কোন পরিবর্তন হলনা। বলল শায়ন্তি মাদ্রাসাতেই পড়বে ইন শা আল্লাহ। আমার রব সব ব্যবস্থা করে দিবেন। কতটা দৃঢ়তার সাথে বলল শায়লা!
আজকাল রাগ বলতেই নেই যেন শায়লার। অফিস থেকে ফিরে ঘরে ঢুকতেই হাসিমুখে সালাম দেয়। কেমন যেন অপ্রস্তুত হয়ে যায় আতিক। শায়লা তো এমন কখনো করেনি আগে! ৬মাস ধরে আতিকের কাপড় গুলো নিজেই গুছিয়ে রাখে, অফিসে যাওয়ার আগে শার্ট টা এগিয়ে দেয়, ঘড়ি টা হাতে তুলে দেয়! এমন কখনো করতনা শায়লা। প্রতিদিন রাতে একসাথে খাওয়ার জন্য ওয়েট করে এখন! সেদিন খাওয়ার টেবিলে বলে বসল আমাকে একটু তুলে খাইয়ে দেবে?
বলে কি মেয়েটা! আরেকটু হলেই হো হো করে হেসে উঠত আতিক। কিন্তু তা না করে মুখে গাম্ভির্য এনে বলে দিল এসব আবার কি ঢঙ শুরু করেছ?
শায়লা তবু রেগে গেলনা! একটু হেসে বলল আচ্ছা তাহলে আমি খাইয়ে দেই?
আতিক কি বলবে ভেবে পেল না!
শায়ন্তি যখন বলল মা আদর করে খাইয়ে দিতে চাচ্ছে, তুমি এমন করছো কেন বাবা?
আতিকের কিছু বলার ছিলনা আর। কিন্তু শায়লা খাইয়ে দেয়ার পর আতিকের অদ্ভুত এক অনুভূতি হল। কেমন যেন ভাল লাগতে শুরু করল শায়লার এমন আচরন! এই মেয়েটাই তো আতিকের স্ত্রী। অথচ কত অন্যায় আচরন করেছে এতটা বছর ওর সাথে! ১৩বছর পর আতিকের হঠাৎই মনেহল মেয়েটাকে আমি ভালবাসি!
:
শায়লা তখনো কেঁদেই যাচ্ছে। আতিকের খুব মায়া হতে লাগল। আজ সে শুনবেই শায়লা কেন সিজদায় এমন কান্নাকাটি করছে। মনের ভেতর উসখুস করতে শুরু করল আতিকের। শায়লা কে এত বছরেও কাঁদতে দেখেনি। কত গায়েও হাত তুলেছে আতিক, শায়লা রাগে ফুসেছে তবু কান্না করেনি। আর আজ কি এমন শায়লার হৃদয়টা কে এত নরম করে এতক্ষন ধরে কাঁদাচ্ছে?
শায়ন্তির কাছে শুনেছে পাশের বাসার সাবিহা নাকি শায়লার কলেজ ফ্রেন্ড ছিল। যেদিন প্রথম সে বাসায় এল সেদিন থেকেই শায়লার পরিবর্তন শুরু হয়েছে!
সাবিহা কি এমন করলো যা শায়লা কে পুরোপুরি চেঞ্জ করে দিল?
আজ সে সব শুনবে শায়লা কাছে।
…
..
শায়লা সিজদা থেকে উঠে দরজায় আতিক কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চমকে গেল। আতিক কখন এসে দাঁড়িয়েছে টের পায়নি শায়লা।
আতিক শায়লার কাছে এসে বসল। কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ কেটে গেল। কারও মুখে কথা নেই। আতিক সন্তর্পনে শায়লার হাতটা ধরল। কি বলবে ভেবে না পেয়ে আতিক বলল আমাকে ক্ষমা করে দাও। এত গুলো বছর তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। তোমাকে এভাবে কাঁদতে দেখে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে।
শায়লা হাসিমুখে বলল, আমি কোন কষ্টে কাঁদিনি। আমি সুখে কেঁদেছি। আল্লাহর জন্য একটা সিজদায় এত প্রশান্তি থাকতে পারে আগে জানলে আমি কখনোই ভুল পথে পা বাড়াতাম না। আতিক, তোমার হেদায়াতের জন্য আমি আল্লাহর কাছে চেয়ে যাচ্ছি, কারন আমি তোমাকে ভালবাসি।
আমরা অনেক গুনাহ করেছি জীবনে, প্রেম ইসলামে হারাম অথচ আমরা দিব্যি প্রেম করে গেছি, প্রেমের নামে আমরা ভয়ংকর সব গুনাহে লিপ্ত ছিলাম। রব্বুল আলামীন আমার চোখ খুলে দিয়েছেন। আমি আমার কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত। সাবিহা বলেছে, বান্দা গুনাহের পর অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চাইলে আল্লাহ ক্ষমার ওয়াদা করেছেন। আতিক, সাবিহা আমাকে কোরআনে পড়ে শুনিয়েছে জাহান্নাম কত ভয়াবহ আযাবের স্থান।
একটাই আশা এখন জাহান্নাম থেকে বাঁচার! আল্লাহ যদি ক্ষমা করেন। তা না হলে কোন রক্ষা নেই আতিক।
অতীতে আমরা যাই করেছি আসো এখন তওবা করি, যে কয়দিন বেঁচে আছি আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী জীবন টা পরিচালিত করি, আমরা যে ভুল করেছি আমাদের শায়ন্তি যেন তা না করে সেজন্য আমাদেরই সচেতন হতে হবে। আমি নিয়াত করেছি শায়ন্তি কে মাদ্রাসায় পড়াব। তুমি আর না করোনা। আমার মেয়ের জীবন টা সাবিহার মারঈয়াম, আয়িশাহর মত হোক আমার এখন এটাই স্বপ্ন।
শায়লা কে মমতায় জড়িয়ে ধরে আতিক। পরম আশ্রয়ে শায়লা ও কেঁদে উঠে। বহু বছরের পাথর চাপা ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া অনুভূতি গুলো আজ আবার সজীব হয়ে উঠেছে।
চুপ করে আছে আতিক। কি বলবে ভেবে পাচ্ছেনা। শায়লার পরিবর্তন দেখে ইদানিং আতিকেরও ধর্মের প্রতি দূর্বলতা বাড়ছে। কারন ধর্মের প্রতি শায়লা যখন থেকে আকৃষ্ট হয়েছে ওর আচরনে অদ্ভুত পরিবর্তন এসেছে। আগের চেয়ে শান্ত, ধৈর্যশীল, ধীরস্থির হয়েছে। আতিকের প্রতি যত্নশীল হয়েছে। স্বামীর হক্ব কি জিনিস তা আতিক জানেনা তবে শায়লার কাছে প্রত্যাশিত আচরন গুলো এখন না চাইতেই পেয়ে যায় আতিক, শায়লা বলে এসবই নাকি স্বামীর হক্ব।
আযান হচ্ছে মসজিদে, ফজরের আযান। আজ মসজিদের দিকে আতিকের মন এত টানছে কেন?
আযানের অর্থ আতিক জানেনা তবু আযানের প্রতিটা কথা আতিকের হৃদয়ে গিয়ে যেন আঘাত করছে। শায়লার প্রার্থনা কি তবে আল্লাহ কবুল করে নিলেন? চোখের কোণা টা কি ভিজে উঠল আতিকের!
(সংগৃহিত)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন