Mohiuddin Kasemi
স্বীকৃতি নিয়ে আলোচনা এখন তুঙ্গে। অনেকে প্রবন্ধ নিবন্ধ লিখছেন। মোটামুটি সবগুলোই পড়েছি। যৌক্তিক পরামর্শ এসেছে। মুরুব্বিরাও বিষয়গুলো চিন্তাভাবনা করছেন। একটা চূড়ান্ত ফলাফল আসবে ইনশাল্লাহ।
এ প্রসঙ্গে দেওবন্দের মূলনীতির কথা আলোচিত হচ্ছে। দেওবন্দ আমাদের চেতনা। আমরা তাদের অনুসারী। আসলেই কি আমরা দেওবন্দের অনুসরণ করি?
---
দারুল উলুম দেওবন্দ কেবল একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়; বরং একটি মাকতাবায়ে ফিকর-- চিন্তাগোষ্ঠী, চেতনার বাতিঘর, স্কুল অব থট। ইংরেজদের সাথে সম্মুখসমরে পরাজিত হয়ে ইসলামের মূল চেতনাগুলো ধরে রাখা এবং আজাদির সংগ্রাম যুগযুগান্তরে জিইয়ে রাখার মহান উদ্দেশ্যে দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠিত হয়। তৎকালীন প্রেক্ষাপট বিবেচনা করেই কিছু মূলনীতি তৈরি করা হয়, যার ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হবে। এরকম প্রসিদ্ধ আটটি মূলনীতিরর কথা জানা যায় :
১। অত্যাচারী শাসকের সাহায্য ব্যতীত শুধু জনসাধারণের সাহায্যে এই প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হবে। এভাবে জনসাধারণের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা এবং স্বাধীনতাকামী মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে জনমত গঠন করা।
২। ব্যাপকহারে ছাত্র ভর্তি করে তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে আধিপত্যবাদী (তৎকালীন শাসক) ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ পরিচালনার জন্য সুশিক্ষিত এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বাহিনী গঠন করা।
৩। শুরাতাত্ত্বিক অর্থাৎ পরামর্শের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হবে।
৪। যে কোনো ন্যায্য সংগ্রামকে সফলতায় নিয়ে যেতে হলে সমমনাদের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন, তাই এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক এবং কর্মচারীবৃন্দ সমমনা হতে হবে।
৫। প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে শিক্ষাকোর্স সম্পন্ন করে সঠিক দায়িত্ব পালনের উপযোগী হতে হবে।
৬। সম্মানজনক পদ্ধতিতে চাঁদা সংগ্রহের মাধ্যমে গরিবদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে এবং পুঁজিবাদী, ধনী এবং জমিদারদের সাথে সম্পর্ক বিছিন্ন করতে হবে।
৭। অত্যাচারী শাসকের কোনো সাহায্য গ্রহণ করা যাবে না।
৮। মুখলিস/নির্মোহ লোকদের চাঁদাকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।
(মূলনীতিগুলো একজনের কাছ থেকে নিয়েছি। সবগুলো হুবহু ঠিক আছে কিনা, এ মুহূর্তে বলতে পারছি না)
-
এগুলো ছাড়াও দেওবন্দের আরও কিছু কর্মপদ্ধতি, নিয়মকানুন ও বৈশিষ্ট্য ছিল। যুগের পরিবর্তনে সেগুলোতে ঈষৎ; ক্ষেত্রবিশেষে আমূল পরিবর্তনও হয়েছে।
প্রতিষ্ঠালগ্ন ও আজকের দেওবন্দের মাঝে সিলেবাস, নিয়মকানুন ও অন্যান্য বিষয়ে কি একটুও পরিবর্তন হয়নি?
২০০৭ সনে দেওবন্দে আদব পড়ি আমি। বিশ্বখ্যাত আরবি সাহিত্যক উস্তাদে মুহতারাম মাওলানা নুর আলম খলীল আমিনী প্রায়ই ক্লাসে বলতেন, কতগুলো বুড়া বসে আছে, ওদের কারণে এই এই কাজ হচ্ছে না। বারবার পরামর্শ দিচ্ছি দুনিয়ার কোথাও ৫০ নম্বরে পরীক্ষা হয় না, ১০০ নম্বরে আমাদের পরীক্ষা নেওয়া দরকার। তারা আকাবিরদের অনুসরণ করে!
এখন দেওবন্দে ১০০ নম্বরে পরীক্ষা হয়।
--
দেওবন্দে দুই বছরে দুই টাকা লেগেছে আমার। হা, ভর্তিপরীক্ষার জন্য দুই রুপি দিয়ে একটি ফরম কিনতে হয়। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ভর্তিফরম নিয়ে ভর্তি হলাম। রুম পেলাম। খানা পেলাম। প্রতি মাসে মাসে টাকা পেতাম। পরীক্ষার বিশেষ টাকা পেতাম। পরীক্ষার কোনো ফি নাই। শীতে লেপতোশক পেতাম। দুই টাকার টিকেট দিয়ে ফ্রি চিকিৎসা পেতাম...! বউ ছাড়া সবই পেয়েছি।
দাওরা ও আদব দুবছরে মাত্র দুই রুপি খরচ হয়েছে। হা, ব্যক্তিগত খরচের কথা ভিন্ন।
বাংলাদেশের কোনো একটি মাদরাসায় কি এমন সুযোগ রয়েছে?
দেওবন্দের ছাত্ররা কনসেশন কার্ড দিয়ে কমমূল্যে ভ্রমণ করতে পারে।
জামিয়া মিল্লিয়া, আলীগড় এবং আরব বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পায়, বাংলাদেশের কওমি মাদরাসাগুলো এ চিন্তা করেই না।
আমরা কেবল পাচকল্লির মেহনত করি! ইলম ও আমলের তেমন গুরুত্ব দিই না।
বাংলাদেশের অধিকাংশ মাদরাসা পরিচালিত হয় স্থানীয় রাজনীতিবিদ, প্রভাবশালী ও বিত্তবানদের তত্ত্বাবধানে। তাদের মর্জির বাইরে যাওয়ার তেমন সুযোগ থাকে না। হেফাজতের আন্দোলনের পরে বিষয়টি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি আমরা।
-
প্রথম দেওবন্দে গেলাম তখন শীতকাল ছিল। বড় বড় হুজুররা দেখি মোটা মোটা টুপি পরে। গোলাম আজম সাহেবের টুপিও অনেকের মাথায় দেখলাম! সবাই কি গোমরাহ...?
সবাই খাটো জামা ও চিপা পায়জামা পরে। পাচকল্লি তো খুজেও পেলাম না। জুব্বা নাই বললেই চলে। এসব দেখে কেমন কেমন জানি লাগত! বাংলাদেশি মাদরাসার সাথে মিল পেতাম না। কিছুটা আহত ও মর্মাহত হলাম।
আস্তে আস্তে দেওবন্দের উদারতা ও আমাদের সঙ্কীর্ণতা পরিষ্কার হতে লাগল।
---
আট মূলনীতি কুরআন ও হাদিস নয় যে পরিবর্তন করা যাবে না। সঠিক ইসলাম জিইয়ে রাখা, ইমান আমল বাকি রাখা, ইলমের চর্চা, কুরআন হাদিসের অনুসরণ, সাহাবিদের পদাঙ্কননুসরণ এবং এ উপমহাদেশে যুগযুগ ধরে চলে আসা হানাফি মাযহাব মেনে চলা দেওবন্দের মূল স্পিরিট।
নস ছাড়া সবকিছুই পরিবর্তনশীল। স্থান কাল পাত্র ভেদে সংযোজন ও বিয়োজন করলে গোনাহ হবে না। -
ভারতের প্রেক্ষাপট বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট কি এক? বাংলাদেশের পরিবেশ, সামাজিক অবস্থা, আলেমসমাজের শক্তি-সামর্থ্য, সরকারের নীতিমালা, রাষ্ট্রীয় আইনকানুন সবকিছু মিলিয়ে এদেশের আলেমদেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে জরুরি বিষয় হচ্ছে ঐক্য। আমি বিশ্বাস করি, কওমির সব ঘরানা মৌলিক কিছু বিষয়ে একমত হয়ে দাবি পেশ করলে সরকার অগ্রাহ্য করতে পারবে না। সরকারের দরকার ক্ষমতা। ক্ষমতাকে নিষ্কণ্টক করতে ট্রাকের পর ট্রাক লাশ ফেলতেও কুণ্ঠিত নয় তারা।
দেশের সরকারের সাথে লিয়াজো করা ছাড়া কোনোকিছুই করা সম্ভব নয়। ইতিহাসের বৃহৎ গণজমায়েতকে কয়েক ঘণ্টায় নাস্তানাবুদ করার কীর্তি শাপলাচত্বরে এ সরকার দেখিয়েছে।
বিএনপি ও আওয়ামীলীগ ছাড়া আর কোনো দল ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। স্বাধীনতার পর থেকে সব ইসলামী দলই বড় রাজনৈতিক দলের আশ্রয় বা আশির্বাদপ্রাপ্ত হয়েছে।
--
সুতরাং সব কওমি ঘরানা স্বীকৃতির নীতিমালা বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করে সরকারের কাছে ওই মোতাবেক স্বীকৃতির দাবি জানানোই প্রধান কাজ। কিন্তু বৃহৎ ঐক্য নিয়েই যত ঝামেলা।
আমরা আশা করি, আলেমসমাজ ঐক্যবদ্ধ হলে স্বীকৃতি কেউ ঠেকাতে পারবে না। আর স্বীকৃতি না নেওয়ার বিষয়ে একমত হলে সেটাকেও সাধুবাদ জানাবো।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন