বৃহস্পতিবার, ১৩ অক্টোবর, ২০১৬

হাসান বিন আলি রা.

শায়খ আতীকুল্লাহ
তিনি তৃতীয় হিজরীতে জন্মগ্রহন করেন। নবিজী (সা.)এর খুবই প্রিয় ছিলেন। হযরত আলি (রা.)এর প্রথম সন্তান। নবিজী (সা.)এর প্রথম নাতি। 
নবিজী তার দুই কানে আযান দিয়েছেন। জন্মের সাতদিন পর আম্মাজান ফাতিমা তার মাথা মুন্ডিয়ে দিয়েছেন। নবিজীর আদেশে মুন্ডানো চুলের ওযন পরিমান রুপা সদকা করে দিয়েছেন। 
নবিজী নিজের পক্ষ থেকে একটা (বা দুইটা) দুম্বা যবেহ করে আকীকা দিয়েছেন। একই দিন খতনা করানোর আদেশও দিয়েছেন। 
.
নবিজী তার এ-নাতিটাকে এত ভালোবাসতেন, বলার নয়! বারা বিন আযেব (রা.) বর্ণনা করেছে:
-আমি দেখেছি হাসান নবিজীর কাঁধে চড়ে বসে আছে। নবিজী বলছেন: হে আল্লাহ! আমি একে ভালোবাসি, আপনিও তাকে ভালোবাসুন!
.
একদিন নবিজী নাতিকে কাঁধে চড়িয়ে হাঁটছিলেন, একলোক দেখে বললো:
-হে বালক! কতো উত্তম বাহনে চড়েছো!
নবিজী তাকে উত্তরে বললেন: আরে সে নিজেই তো কত উত্তম আরোহী!
.
একদিন মিম্বরে বসে খুতবা দিচ্ছিলেন। হাসান পাশে বসা ছিলেন। নবিজী একবার নাতির দিকে আরেকবার শ্রোতাদের দিকে তাকিয়ে বললেন:
-আমার এই নাতি একজন নেতা হবে। সে দু’টি মুসলিম জামাতের মধ্যে আপোষ-মীমাংসা করবে!
.
হাসান রা. প্রতিদিন ঘুমের আগে সূরা কাহফ তেলাওয়াত করতেন। 
প্রতিদিন ফজর নামায পড়ার পর মসজিদে নববীতে সূর্যোদয় পর্যন্ত বসে থাকতেন। তারপর ইশরাক পড়ে উম্মাহাতুল মুমিনীনের সাথে দেখা করতে যেতেন। 
তিনি সারা জীবনে পঁচিশ বার পায়ে হেঁটে হজ করেছেন। 
তিনি ছিলেন একজন সহনশীল, ধীরস্থির মেজাজের অধিকারী। উদার-মুক্তহস্ত। তিনি ফিতনা-ফাসাদ অপছন্দ করতেন। 
.
নবিজীর ইন্তেকালের পর, আবু বকর (রা.) একদিন আসর নামায পড়ে, আলি (রা.)এর সাথে কথা বলতে বলতে ফিরছিলেন। সামনেই দেখলেন হাসান (রা.) কয়েকটি ছেলের সাথে খেলা করছে। তিনি এগিয়ে গিয়ে হাসানকে একেবারে কাঁধে উঠিয়ে নিয়ে বললেন:
-একেবারে নবির মতো হয়েছে। আলির মতো নয়। 
হযরত আলি দৃশ্যটা দেখে হাসছিলেন। আবু বকর (রা.) হাসানকে খুবই স্নেহ করতেন। হযরত হাসানও আবু বকর (রা.)কে খুবই শ্রদ্ধা করতেন। এমনকি নিজের একটা ছেলের নামও আবু বকর রেখেছিলেন। 
.
উমার (রা.) হাসান ও হুসাইন উভয়কেই বদরী সাহাবীদের মর্যাদা দিয়ে পাঁচ হাযার দিরহাম ভাতা দিতেন। তিনি নিজের সন্তানের চেয়েও হাসান-হুসাইনকে বেশি গুরুত্ব দিতেন। 
.
উসমান রা.এর আমলে হাসান-হুসাইন আফ্রিকার এক অভিযানে অংশ নিয়েছেন। উসমান রা. যখন বিদ্রোহীদের হাতে অবরুদ্ধ হয়ে পড়লেন, তখন হাসান রা. তরবারি উঁচিয়ে দরজায় পাহারার দায়িত্বে ছিলেন। কিন্তু উসমান রা. ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লেন, তার নিরাপত্তা নিয়ে শংকিত হয়ে পড়লেন। জোর-জবরদস্তি করে হাসানকে ফেরত পাঠালেন। 
.
হযরত আলি রা. এর আমলে তিনি সব সময় বাবার পাশেই থাকতেন। প্রশাসনিক কাজকর্ম শিখতেন। বাবাও ছেলেকে নানা ভাবে দীক্ষা দিতেন। 
.
আবদুল্লাহ বিন যুবায়ের বলতেন:
-হাসান বিন আলির মতো সন্তান আর কোনও মা জন্ম দিতে পারেনি। 
.
তিনি কোথাও কোনও বাড়িতে গেলে, আশেপাশের সবাই ভেঙে পড়তো তাকে দেখার জন্যে। তার জন্যে মানুষের ভালোবাসা-শ্রদ্ধা ছিল অতুলনীয়। 
.
হযরত আলির শাহাদাতের পর, মানুষজন তার হাতে বাইয়াত হন। সর্বপ্রথম বাইআত হয কায়স বিন সা‘দ বিন উবাদা। এটা ছিল ৪০ হিজরীর ঘটনা। 
.
হাসান (রা.) এর খিলাফাহ ছিল খেলাফতে রাশেদার অন্তুর্ভুক্ত। নবিজী বলেছিলেন:
-আমার পরে ত্রিশ বছর খিলাফাহ থাকবে। তারপর আসবে রাজা। 
হযরত হাসানের খিলাফতকাল ত্রিশ বছরের মধ্যেই পড়ে। তার খিলাফতকাল ছিল সাত মাস। 
.
৪১ হিজরীতে হযরত হাসান সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন তিনি মু‘আবিয়া (রা.)-এর সাথে আপোষ করে ফেলবেন। তাই করেছিলেন। এতে করে বাস্তবায়িত হয়েছে নবিজীয় সেই ভবিষ্যদ্বাণী। 
.
এরপর হযরত হাসান কুফা থেকে মদীনায় চলে এলেন। সন্ধির কারণে কিছু লোক নারায হলেও, তিনি ছিলেন খুবই সন্তুষ্ট ও পরিতৃপ্ত। এমনকি জীবনে বাকি দিনগুলোতেও হযরত মুয়াবিয়ার সাথে তার সম্পর্ক ছিল খুবই আন্তরিক। বার্ষিক এক লাখ দিরহাম ভাতা পেতেন হযরত হাসান। 
.
সন্ধিচুক্তির দশ বছর পর, হযরত হাসান অসুস্থ হয়ে পড়লেন। এর রোগেই তিনি ইন্তেকাল করেছেন। তার মৃত্যু নিয়ে অনেক বর্ণনা আছে। তাকে বিশ খাওয়ানো হয়েছে, এ মর্মে। একটা বর্ণনায় হযরতা হাসান নিজেই বলেছেন:
= যন্ত্রণায় তার কলিজা ফেটে যাচ্ছে। তাকে বেশ কয়েকবার বিষ খাওয়ানো হয়েছে। কিন্তু এবার খুব শক্তিশালী বিষ খাওয়ানো হয়েছে। 
হুসাইন জিজ্ঞাসা করলেন:
-কে খাইয়েছে বিষ?
হযরত হাসান উত্তর দেননি। 
.
তাকে বিষ খাওয়ানো নিয়ে সবচেয়ে বেশি প্রসিদ্ধ হলো, তার স্ত্রী জা‘দা বিনতে আশ‘আস তাকে বিষ খাইয়েছেন। মুয়াবিয়া রা. এক লাখ দিরহাম দিয়েছিলেন তাকে। এবং তাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, হাসানকে মারতে পারলে, ইয়াযিদের সাথে তার বিয়ের ব্যবস্থা করবেন। হযরত হাসানের মৃত্যুর পর জা‘দা ইয়াযিদের সাথে যোগাযোগ করলে ইয়াযিদ উত্তর দিয়েছিলো:
-আমরা তোমাকে হাসানের জন্যে পছন্দ করিনি, আমাদের জন্যে পছন্দ করবো, এটা তুমি কিভাবে ভাবতে পারলে?
.
.
আমরা এবার এ বিষয়ক বর্ণনাগুলো একটু যাচাই করে দেখি:
এক: স্ত্রীর নাম কিন্তু হযরত হাসান নিজে বলেননি। অন্যরা বলেছে। আর জা‘দা বিষয়ে যে বর্ননা আছে, সেটার সনদ দুর্বল। বিশুদ্ধ নয়। 
.
দুই: ইয়াযিদ কর্তৃক জা‘দাকে বিষ দেয়ার সংবাদ সংবলিত যে বর্ণনা আছে, সেটার সনদে একজন রাবী আছে ইয়াযিদ বিন ইয়ায। এ লোকটা চরম মিথ্যাবাদী। সুতরাং তার বর্ণনা বাতিল। 
.
তিন: সে বর্ণনায় একটা কথা এমন আছে: মুয়াবিয়া রা. সরাসরি আদেশ করেছিলেন জা‘দা-এর পিতা আশ‘আস বিন কায়সকে: তুমি তোমার মেয়েকে বলো তার স্বামীকে বিষ খাওয়াতে। 
= ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন:
-আরে আশ‘আস মারা গেছে চল্লিশ হিজরীতে। হাসানের ইন্তেকালের দশ বছর আগে। তিনি এত আগে মেয়েকে বিষ খাওয়ানোর কথা বলে যাবেন, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। 
আর জা‘দা টাকা বা ইয়াযিদের বৌ হওয়ার লোভে এমন ন্যাক্কারজনক কাজ করবেন, এটাও বিশ্বাসযোগ্য নয়। কারণ তিনি নিজেই অনেক বড় নেতার মেয়ে। তার নিজের ধন-সম্পদের কমতি ছিল না। আর হাসানের চেয়ে ইয়াযিদ কোন দিক দিয়ে ভাল? এটা বুঝি একজন স্ত্রী বুঝতে পারবে না?
এ-বর্ণনাটার বক্তব্যও যুক্তিসঙ্গত নয়। আর সনদের দুর্বলতার কথা তো আগেই বলা হলো। 
.
চার: এছাড়াও হাসানের ইন্তেকাল বিষয়ক বর্ণনাগুলোতে কিছু লোক আছে যাদের পরিচয় খুবই স্পষ্ট:
ক: আহমাদ বিন আবদুল্লাহ। এ ব্যাটা একজন স্বীকৃত শী‘আ। 
খ: ঈসা বিন মারওয়ান। এ মুহাদ্দিসপ্রবর (!!!)ও একজন রাফেযী। কাযযাব। 
গ: হাইসাম বিন আদাস। এই গুণধরও একজন কাযযাব!
.
তাহলে কি হাসানকে বিষ খাওয়ানো হয়নি? তিনি নিজেই যে বললেন?
= আমরা যদি বলি বিষ খাওয়ানো হয়েছে, তাহলে কে খাইয়েছে সেটা স্পষ্ট নয়। শুধু শুধু কেন একজন সাহাবী, একজন মহিলাকে সন্দেহের ওপর ভিত্তি করে দোষারোপ করা?
= আর যদি বলি বিষ খাওয়ানো হয়নি। তাহলে হাসানের উক্তি?
সেটার সমাধান ড. আলি সাল্লাবী এভাবে দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন:
-আমি ডা. কামালুদ্দীন হুসাইন তাহেরর সাথে এ-ব্যাপারে কথা বলেছি। তিনি বলেছেন: রক্তস্বল্পতার কারণে অনেক সময় এমন অনুভূতি হতে পারে। অন্ত্রে টিউমার হলেও এমন হতে পারে। এক প্রকার ক্যান্সারের কারণে এমনটা হয়ে থাকে। 
.
পরিশেষে বলবো:
= কী ঘটেছে সেটা আজ এতদিন পরে, নিশ্চিত করে বলা কঠিন। আমরা শুধু প্রমান ও অনুমানের ভিত্তিতে কিছু কথা বলতে পারি। 
.
ও হাঁ, আরেকটা কথা রয়ে গেলো:
= হযরত হাসান সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে: তিনি অসংখ্য বিয়ে করেছিলেন। কেউ কেউ তো বলেছে তিনি কয়েকশ বিয়ে করেছেন। একদিন হযরত আলি মিম্বরে বসেই ঘোষণা দিয়েছেন:
-তোমরা আমার ছেলে হাসানের কাছে মেয়ে বিয়ে দিওনা। সে শুধু বিয়ে করে আর তালাক দেয়। 
এমনি আরও অসংখ্য বর্ণনা আছে। এগুলো যে কতোটা বানোয়াট আর ভ্রান্ত, সেটা প্রমাণের জন্যে আলাদা লেখা প্রয়োজন। 
ইনশাআল্লাহ নবিজী (সা.)এর আহলে বাইতকে শী‘আ-রাফেযীদের ভ্রান্ত ছোবল থেকে রক্ষার জন্যে, আমরা এগিয়ে আসবো। যে কোনও ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকবো।
.
পাশাপাশি মহান সাহাবী মুয়াবিয়া (রা.)-এর সম্মান রক্ষায়ও আমরা প্রস্তুত থাকবো। ইনশাআল্লাহ। 
.
ফিরাকে শী‘আ!
মুর্দাবাদ! মুর্দাবাদ!
.
সিপাহে সাহাবা
যিন্দাবাদ ! যিন্দাবাদ!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন