সোমবার, ৩০ নভেম্বর, ২০১৫

এটি হাদীসের পাঠ নয় : স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেশত

স্ত্রীর প্রতি স্বামীর হক বা স্বামীর আনুগত্য  বিষয়ে অনেকে উপরের কথাকে হাদীস হিসেবে পেশ করে থাকে। যার আরবী হল,الجنة تحت أقدام الأزواج । কিন্তু এ শব্দ-বাক্যে কোনো হাদীস পাওয়া যায় না। সুতরাং এটিকে হাদীস হিসেবে বলা যাবে না। তবে কিছু বর্ণনায় এর মর্মার্থ পাওয়া যায়।
মুআত্তা মালেকমুসনাদে আহমাদমুসতাদরাকে  হাকেমসহ হাদীসের আরো কিছু কিতাবে বর্ণিত হয়েছেÑ
একবার এক নারী সাহাবী রাসূলের কাছে এলেন নিজের কোনো প্রয়োজনে। যাওয়ার সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জিজ্ঞেস করলেনতোমার কি স্বামী আছেতিনি বললেনজীআছে। নবীজী বললেনতার সাথে তোমার আচরণ কেমনসে বললআমি যথাসাধ্য তার সাথে ভালো আচরণ করার চেষ্টা করি। তখন নবীজী বললেনহাঁতার সাথে তোমার আচরণের বিষয়ে সজাগ থাকোকারণ সে তোমার জান্নাত বা তোমার জাহান্নাম। Ñমুআত্তা মালেকহাদীস ৯৫২;মুসনাদে আহমাদ৪/৩৪১ হাদীস ১৯০০৩মুসতাদরাকে হাকেমহাদীস ২৭৬৯সুনানে কুবরাবায়হাকীহাদীস ১৪৭০৬
স্বামী-স্ত্রীর একের উপর অন্যের হক রয়েছে। এ বিষয়ে আল্লাহ তাআলা কুরআনে কারীমে মৌলিক নির্দেশনা দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَلَهُنَّ مِثْلُ الَّذِي عَلَيْهِنَّ بِالْمَعْرُوفِ.
আর স্বামীদের যেমন তাদের (স্ত্রীদের) উপর ন্যায়সঙ্গত হক রয়েছেতেমনি তাদেরও হক রয়েছে স্বামীদের উপর। Ñসূরা বাকারা (২) : ২২৯
আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিস্তারিতভাবে স্বামী-স্ত্রীর  হক তুলে ধরেছেন এবং স্বামীদেরকে স্ত্রীর হক আদায়ের ব্যাপারে সতর্ক  করেছেন। বিদায় হজ্বের ভাষণে নবীজী বলেছেন,
اتَّقُوا اللَّهَ فِي النِّسَاءِ.
তোমরা নারীদের  বিষয়ে আল্লাহকে ভয় কর। Ñসহীহ মুসলিমহাদীস ১২১৮
সাথে সাথে নারীদেরকে স্বামীর আনুগত্য করার প্রতি উদ্বুদ্ধ  করেছেন এবং এর ফযীলতও বর্ণনা করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেননারী যখন পাঁচ ওয়াক্ত  নামায ঠিকমত আদায় করবেরমযানের রোযা রাখবে,  আপন লজ্জাস্থানের হেফাযত করবে,  স্বামীর আনুগত্য করবেÑ তখন সে  জান্নাতের যেই দরজা দিয়ে ইচ্ছা প্রবেশ করতে পারবে।Ñসহীহ ইবনে হিব্বান,  হাদীস ৪১৬৩

সুতরাং গুনাহের কাজ নয় এমন বিষয়ে  স্বামীর আনুগত্য জরুরি। কিন্তু  স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেশত’ এটি হাদীস নয়।

পথ ও পথিকের হক

মাওলানা শিব্বীর আহমদ
সমাজবদ্ধ জীবনে পথের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। আর সেই পথটি সবসময়ের জন্যেই নিরাপদ ও ঝুঁকিমুক্ত থাকবেনির্ভয়ে নিশ্চিন্ত মনে আপন সম্মান ও সম্ভ্রম রক্ষা করে সেই পথ দিয়ে হেঁটে যাওয়া যাবেÑ এটি একজন পথিকের হক ও অধিকার। সমাজের সকল শ্রেণির মানুষকেই পথে ধরে চলতে হয়। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর কিংবা সর্বোচ্চ বিত্তবান ব্যক্তি থেকে শুরু করে খেটে খাওয়া দিনমজুর পর্যন্ত সকলকেই জীবনের তাগিদে পথে আসতে হয়। নিরাপদ পথের অধিকার তাই সকলের। আবার এ অধিকার সংরক্ষণও সমাজের মানুষকেই করতে হবে। সুন্দরতম আচরণের পূর্ণতাবিধানকারীরূপে যে নবী প্রেরিত হয়েছিলেনআমরা তো তাঁরই উম্মত। তাঁর বাণীতেই আমরা খুঁজে পাই পথ ও পথিকের হক।
পথের অধিকার সম্পর্কে এই হাদীসটি খুবই প্রসিদ্ধÑ
হযরত আবু সাঈদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিতরাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনÑ
إِيَّاكُمْ وَالْجُلُوسَ بِالطُّرُقَاتِ، فَقَالُوا يَا رَسُولَ اللهِ! مَا لَنَا مِنْ مَجَالِسِنَا بُدٌّ، نَتَحَدَّثُ فِيهَا، فَقَالَ: إِذَا أَبَيْتُمْ إِلاَّ الْمَجْلِسَ، فَأَعْطُوا الطَّرِيقَ حَقَّهُ، قَالُوا: وَمَا حَقُّ الطَّرِيقِ يَا رَسُولَ اللهِ! قَالَ: غَضُّ الْبَصَرِ، وَكَفُّ الأَذَى، وَرَدُّ السَّلاَمِ، وَالأَمْرُ بِالْمَعْرُوفِ وَالنَّهْيُ عَنِ الْمُنْكَرِ .
তোমরা পথে বসা থেকে বিরত থেকো। সাহাবীগণ বললেনইয়া রাসূলাল্লাহ! কথাবার্তা বলার জন্যে যে আমরা পথে না বসে পারি না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনযদি তোমাদের পথে বসতেই হয় তাহলে পথের হক আদায় করো। তারা বললেনইয়া রাসূলাল্লাহ! পথের হক কীতিনি বললেন, দৃষ্টি অবনত রাখাকাউকে কষ্ট না দেওয়াসালামের উত্তর দেয়াসৎ কাজের আদেশ করা এবং অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করা। Ñ সহীহ বুখারীহাদীস ৬২২৯
হযরত আবু হুরায়রা রা.ও হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। উপরোক্ত বিষয়গুলো ছাড়াও তাঁর বর্ণিত হাদীসটিতে আরও রয়েছেÑ
وَتَشْمِيتُ الْعَاطِسِ، وَإِرْشَادُ السَّبِيل ...
এবং হাঁচির জবাব দেয়া এবং (মানুষকে) পথ দেখিয়ে দেওয়া। Ñমুসনাদে আবু ইয়ালাহাদীস ৬৬০৩
হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রা. বর্ণিত হাদীসে রয়েছেÑ
وَتُغِيثُوا الْمَلْهُوفَ وَتَهْدُوا الضَّالَّ ...
এবং তোমরা নির্যাতিত ব্যক্তিকে সাহায্য করবে এবং পথ-সন্ধানীকে পথের সন্ধান দেবে। Ñসুনানে আবু দাউদহাদীস ৪৮১৯
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বর্ণনা করেছেনÑ
... وَأَعِينُوا عَلَى الْحمُولَةِ ...
এবং তোমরা বোঝা উঠিয়ে দিয়ে সহযোগিতা করো। Ñমুসনাদে বাযযারহাদীস ৫২৩২
হযরত আবু তালহা রা. বর্ণিত হাদীসে আছেÑ
... وحسن الكلام ...
এবং সুন্দর কথা বলো। Ñসহীহ মুসলিমহাদীস  ২১৬১
উপরোক্ত হাদীসগুলোতে প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পথের যে অধিকারগুলো বর্ণনা করেছেন তা আমরা এভাবে উপস্থাপন করতে পারি:
১. দৃষ্টি অবনত রাখা
দৃষ্টিকে বলা হয় শয়তানের একটি বিষাক্ত তীর। এই দৃষ্টির মাধ্যমেই সূচনা হয় নারী-পুরুষের অবৈধ সম্পর্কের। এর ফলশ্রæতিতে ধীরে ধীরে বিনষ্ট হয় পারিবারিক ও সামাজিক শান্তি। পথে চলার অধিকার নারী-পুরুষ সকলেরই রয়েছে। পথে বের হতে হলে নারীকে কীভাবে বের হতে হবেকেমন পোশাক পরতে হবে তা একটি স্বতন্ত্র বিষয়। তবে কোনো সম্ভ্রান্ত নারী যখন পথ চলে তখন কোনো পুরুষ তার দিকে তাকিয়ে থাকাকে সে নিজের জন্যে সম্ভ্রমহানিকর মনে করে। পরিচিত কিংবা অপরিচিত কোনো পুরুষ যদি তাকিয়ে থাকে তাহলে অনেক নারী পর্দাবৃত থাকা সত্তে¡ও পথ চলতে অস্বস্তি বোধ করে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এজন্যেই নির্দেশ দিয়েছেনÑ পথের ধারে বসলে দৃষ্টি অবনত রাখো। আর পবিত্র কুরআনে তো নারী-পুরুষ উভয় শ্রেণিকে ভিন্ন ভিন্নভাবে দৃষ্টি অবনত রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন,
قُلْ لِلْمُؤْمِنِينَ يَغُضُّوا مِنْ أَبْصَارِهِمْ.
হে নবীতুমি মুমিন পুরুষদের বলে দাওতারা যেন তাদের দৃষ্টি অবনত রাখে...। Ñসূরা মুমিনুন (২৩) : ৩০
وَقُلْ لِلْمُؤْمِنَاتِ يَغْضُضْنَ مِنْ أَبْصَارِهِنَّ.
আর হে নবীতুমি মুমিন নারীদের বলে দাওতারা যেন তাদের দৃষ্টি অবনত রাখে...। Ñসূরা মুমিনুন (২৩) : ৩১
২. কাউকে কষ্ট না দেওয়া
এ বিষয়টি অত্যন্ত ব্যাপক। একজন মুসলমানের প্রাণসম্পদসম্ভ্রমÑ সবকিছুই সম্মানের পাত্র। অন্যায়ভাবে কারও জান-মাল ও ইজ্জত-সম্মানের ওপর হামলা করা ইসলামে নিষিদ্ধ। অন্যায়ভাবে কাউকে কোনোরূপ কষ্ট দেয়া যাবে নাচাই সেটা শারীরিক হোক বা মানসিকধন-সম্পদের বিষয়ে হোক বা মান-সম্মানের ওপরই হোক। এক্ষেত্রে কুরআনে কারীমের সুস্পষ্ট নির্দেশনা এসেছে। আল্লাহ তাআলা বলেছেন,
وَالَّذِينَ يُؤْذُونَ الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ بِغَيْرِ مَا اكْتَسَبُوا فَقَدِ احْتَمَلُوا بُهْتَانًا وَإِثْمًا مُبِينًا.
যারা মুমিন নারী-পুরুষদের পীড়া দেয়এমন কোনো অপরাধের বিষয়ে যা তারা করেনিতারা তাহলে অপবাদ ও সুস্পষ্ট পাপের বোঝা বহন করে নিল। Ñসূরা আহযাব (৩৩) : ৫৮
মুসলমান ভাইদের কোনোরূপ কষ্ট না দেয়াÑ এ বিষয়টিকে তো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একজন মুসলমানের পরিচয় হিসেবেই উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন,
الْمُسْلِمُ مَنْ سَلِمَ الْمُسْلِمُونَ مِنْ لِسَانِهِ وَيَدِهِ.
অর্থাৎ মুসলমান তো সেইযার যবান ও হাত থেকে অন্য মুসলমানেরা নিরাপদ থাকে। Ñসহীহ বুখারীহাদীস  ১০
প্রয়োজনীয় কথা বলার জন্যে হোক কিংবা বিশ্রামের জন্যে হোকপথের পাশে যদি কেউ বসে তাহলে অবশ্যই তাকে এমন সব কাজকর্ম থেকে বিরত থাকতে হবেযাতে কোনো পথিক কষ্ট পেতে পারে। শুধু মুসলমান নাগরিকই নয়নিরাপদ পথের অধিকার অমুসলিমদেরও। এমনকি অন্য কোনো প্রাণীকেও তো অনর্থক কষ্ট দেয়া যাবে না।
৩. সালামের উত্তর দেওয়া
একজন মুসলমান যখন আরেকজন মুসলমানকে সালাম দেয় তখন সেই সালামের উত্তর দেয়া ওয়াজিব। এই উত্তর সালামপ্রদানকারীর অধিকার। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
حَقُّ الْمُسْلِمِ عَلَى الْمُسْلِمِ خَمْسٌ: رَدُّ السَّلاَمِ وَعِيَادَةُ الْمَرِيضِ، وَاتِّبَاعُ الْجَنَائِز،ِ وَإِجَابَةُ الدَّعْوَةِ، وَتَشْمِيتُ الْعَاطِسِ.
পাঁচটি বিষয় এক মুসলমানের ওপর আরেক মুসলমানের অধিকারÑ সালামের উত্তর দেওয়াঅসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে যাওয়া,জানাযায় শরিক হওয়ানিমন্ত্রণ গ্রহণ করা এবং হাঁচি দিয়ে আলহামদুলিল্লাহ বললে এর উত্তরে ইয়ারহামুকাল্লাহ বলা। Ñসহীহ বুখারীহাদীস ১২৪০
পরস্পর দেখা-সাক্ষাতে মুসলমানগণ সালামের মাধ্যমেই অভিবাদন জানায়। একে অন্যের জন্যে আল্লাহর দরবারে শান্তি ও রহমত কামনা করে। আর পারস্পরিক এই কল্যাণ কামনা তাদের মাঝে রোপন করে ভালোবাসা ও আন্তরিকতার বীজ। হাদীস শরীফেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালামকে পারস্পরিক ভালোবাসা ও ঘনিষ্ঠতাকে আরও ঘনিষ্ঠ করে তোলার মাধ্যম হিসেবে উল্লেখ করেছেন। হাদীসটি হযরত আবু হুরায়রা রা. কর্তৃক বর্ণিতÑ
لاَ تَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ حَتَّى تُؤْمِنُوا، وَلاَ تُؤْمِنُوا حَتَّى تَحَابُّوا، أَوَلاَ أَدُلُّكُمْ عَلَى شَىْءٍ إِذَا فَعَلْتُمُوهُ تَحَابَبْتُمْ أَفْشُوا السَّلاَمَ بَيْنَكُمْ.
তোমরা যতক্ষণ ঈমান না আনবে ততক্ষণ বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে নাআর যতক্ষণ পরস্পরে ভালোবাসা সৃষ্টি হবে না ততক্ষণ তোমাদের ঈমানও পূর্ণ হবে না। আমি কি তোমাদের এমন একটি আমলের কথা বলে দেব নাযা করলে তোমরা পরস্পরকে ভালোবাসবে। নিজেদের মাঝে সালামের প্রচলন ঘটাও। Ñসহীহ মুসলিমহাদীস ৫৪
সালামের উত্তর দেয়াকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পথের হক হিসেবে গণ্য করেছেন। পথের পাশে বসে থাকা ব্যক্তিকে পথিক যখন সালাম দেবেতখন যেন সে পথিকের সালামের উত্তর দেয়।
৪. সৎ কাজের আদেশ করা এবং অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করা
সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করা এই উম্মতের এক অনন্য বৈশিষ্ট্য। পথে যদি কোনো অন্যায় কাজ চোখে পড়ে তখন সাধ্যমতো বাধা দিতে হবে এবং সৎ কাজের আদেশ করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রত্যেকেই নিজ নিজ সামর্থ্যরে প্রতি লক্ষ রাখবে এবং নিজের সামর্থ্যটুকু যথাযথ ব্যবহারের প্রতিও যতœবান হবে। এটাই হাদীসের শিক্ষা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন,
مَنْ رَأَى مِنْكُمْ مُنْكَرًا فَلْيُغَيِّرْهُ بِيَدِهِ، فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِلِسَانِهِ، فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِقَلْبِهِ، وَذَلِكَ أَضْعَفُ الإِيمَانِ.
তোমাদের কেউ যখন কোনো অন্যায় কাজ দেখে তখন যেন সে নিজ হাতে তা প্রতিহত করে। যদি তা তার পক্ষে সম্ভব না হয় তাহলে মুখে বাধা দেবে। যদি তাও না পারে তাহলে অন্তরে তা ঘৃণা করবে। আর এটিই ঈমানের সর্বনি¤œ স্তর। Ñসহীহ মুসলিমহাদীস ৪৯
৫. হাঁচির জবাব দেওয়া
হাঁচির পর আলহামদুলিল্লাহ বলা সুন্নত। তখন যে আলহামদুলিল্লাহ বলা শুনবেতার কর্তব্য ইয়ারহামুকাল্লাহ বলা। এর মাধ্যমে যে হাঁচি দিল তার জন্যে কল্যাণের দোয়া করা হয়। এটিই হাঁচির জবাব। পথচলার সময় কোনো পথিক যদি হাঁচি দিয়ে আলহামদুলিল্লাহ বলে আর পথের পাশে বসে থাকা ব্যক্তি যদি তা শোনে তাহলে তার কর্তব্য ইয়ারহামুকাল্লাহ (আল্লাহ তোমার ওপর রহম করুন) বলে তার কল্যাণ কামনা করা। উপরে সালামের উত্তর দেয়া প্রসঙ্গে যে হাদীসটি উল্লেখ করা হয়েছে তাতে হাঁচির জবাবের বিষয়টিও রয়েছে। এ প্রসঙ্গে আরেকটি হাদীসরাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনএক মুসলমানের ওপর আরেক মুসলমানের ছয়টি হক ও অধিকার রয়েছে। সাহাবায়ে কেরাম জানতে চাইলেনÑ সেগুলো কী?রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,
إِذَا لَقِيتَهُ فَسَلِّمْ عَلَيْهِ، وَإِذَا دَعَاكَ فَأَجِبْهُ، وَإِذَا اسْتَنْصَحَكَ فَانْصَحْ لَهُ، وَإِذَا عَطَسَ فَحَمِدَ اللهَ فَسَمِّتْهُ، وَإِذَا مَرِضَ فَعُدْهُ وَإِذَا مَاتَ فَاتَّبِعْهُ.
তুমি যখন তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে তখন তাকে সালাম দেবেযখন সে তোমাকে নিমন্ত্রণ জানাবে তখন নিমন্ত্রণ গ্রহণ করবে,যখন সে তোমার নিকট উপদেশ চাইবে তখন তাকে উপদেশ দেবেযখন সে হাঁচি দিয়ে আলহামদুলিল্লাহ বলবে তখন (ইয়ারহামুকাল্লাহ বলে) তার জন্যে কল্যাণ প্রার্থনা করবেসে অসুস্থ হয়ে পড়লে দেখতে যাবে আর মৃত্যু বরণ করলে তার জানাযায় শরীক হবে। Ñসহীহ মুসলিমহাদীস ২১৬২
৬. সুন্দর কথা বলা এবং পথ দেখিয়ে দেওয়া
পথচলা যেমন মানবজীবনের একটি স্বাভাবিক অনুষঙ্গতেমনি চলার পথে পথ না চেনা কিংবা চলতে চলতে পথ হারিয়ে ফেলাও একটি অতি সাধারণ বিষয়। পথের সন্ধানে পথিক তখন পথে থাকা কারোর ওপরই ভরসা করে। তার কাছে সে জানতে চায় আপন গন্তব্যের ঠিকানা। যারা পথের ধারে বসে থাকে তাদের নিকট এটি পথিকের অধিকার। কেউ পথ জানতে চাইলে তাকে তার পথটি দেখিয়ে দিতে হবে। এরই পাশাপাশি তার সঙ্গে কৃত আচরণও যেন সুন্দর হয়হাদীস শরীফে এদিকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এবং একেও পথের হক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। উদ্দিষ্ট পথটি জানা থাকলে তাকে তা দেখিয়ে দিতে হবে হৃদ্যতা ও উদারতার সঙ্গেআর জানা না থাকলেও তার সঙ্গে কোমল আচরণ করতে হবে। এটাই এ হাদীসের দাবি। কর্কশ ও অসুন্দর আচরণ করা যাবে না কিছুতেই।
এক হাদীসে এ পথ দেখানোকে সদকা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেনÑ
وَإِرْشَادُكَ الرَّجُلَ فِي أَرْضِ الضَّلاَلِ لَكَ صَدَقَةٌ.
তুমি কাউকে তার অচেনা পথ দেখিয়ে দিলেএটি তোমার জন্যে একটি সদকা। Ñজামে তিরমিযীহাদীস ১৯৫৬
আরেক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
مَنْ مَنَحَ مَنِيحَةَ لَبَنٍ أَوْ وَرِقٍ أَوْ هَدَى زُقَاقًا كَانَ لَهُ مِثْلَ عِتْقِ رَقَبَةٍ.
যে ব্যক্তি কোনো দুগ্ধবতী বকরি দান করে অথবা কাউকে ঋণস্বরূপ অর্থ প্রদান করে কিংবা কাউকে পথ দেখিয়ে দেয় সে একটি গোলাম আজাদ করার সওয়াব লাভ করবে। Ñজামে তিরমিযীহাদীস ১৯৫৭
৭. নির্যাতিত ব্যক্তিকে সাহায্য করা
একজন মানুষ যখন বিপদে পড়ে তখন আরেকজন মানুষই তার সহযোগিতায় এগিয়ে আসে। এটি মানবতা ও নৈতিকতার দাবি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র বাণীতে এটি আলোচিত হয়েছে পথের অধিকার হিসেবে। কোনো পথিকের ওপর যদি অন্যায়ভাবে কেউ হামলে পড়েকোনো সন্ত্রাসী কিংবা ছিনতাইকারীর আক্রমনে কোনো পথিকের অর্থসম্পদ প্রাণ কিংবা সম্মান-সম্ভ্রম ঝুঁকির মুখে পড়েতখন পথের পাশে বসে থাকা ব্যক্তিদের এগিয়ে আসতে হবে এই নির্যাতিত পথিকের সহযোগিতায়। আক্রান্ত ব্যক্তিটির জাত-ধর্ম এক্ষেত্রে কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়সে একজন পথিক এবং নিরাপদে পথ চলার অধিকার তার রয়েছেÑ এটিই মূল কথা। অন্যায় মোকাবেলার সামর্থ্য থাকা সত্তে¡ও কাউকে নির্যাতিত হতে দেখেও না দেখা কিংবা নীরবতা অবলম্বন করা প্রকারান্তরে অন্যায়কে সমর্থন ও সহযোগিতা করারই শামিল।
হাদীস শরীফের ভাষ্যনির্যাতিত ব্যক্তির পাশে দাঁড়িয়ে অন্যায় থামিয়ে দেয়াÑ এতে জালেম-মজলুম উভয়কেই সহযোগিতা করা হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনতুমি তোমার ভাইকে সাহায্য করোসে জালেম হোক আর মজলুম হোক। সাহাবায়ে কেরাম জানতে চাইলেনইয়া রাসূলুল্লাহ! মজলুমকে তো আমরা সাহায্য করব ঠিককিন্তু জালেমকে সাহায্য করব কীভাবেরাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,
تأخذ فوق يديه.
তুমি তার হাত ধরে ফেলবে। (অর্থাৎ তাকে তার অন্যায় থেকে ফিরিয়ে রাখাটাই তার জন্যে সহযোগিতা।) Ñসহীহ বুখারী,হাদীস ২৪৪৪
৮. বোঝা উঠিয়ে দিয়ে সহযোগিতা করা
বোঝার ভারে ক্লান্ত হয়ে একজন ভারবাহী মানুষ কখনো তার বোঝাটি কিছু সময় নামিয়ে রাখে। মাথা থেকে কিংবা ভারবাহী কোনো বাহন থেকে পড়েও যেতে পারে কোনো বোঝা। ক্লান্ত শ্রান্ত সে পথিক তখন একজন মানুষের অপেক্ষায় থাকেযে তার বোঝাটি ওঠাতে সহযোগিতা করবে। পথের পাশে বসতে হলে পথিকের এ জাতীয় সহযোগিতায় এগিয়ে আসতে হবেÑ এটিও পথের অধিকারপথিকের অধিকার।

মোটকথাপথের সৃষ্টিই পথিকের জন্যে। পথিক চলাচল করবেÑ এতেই পথের স্বার্থকতা। তাই পথে বসে এমন কোনো কাজ করা যাবে নাযাতে পথিকের পথচলা বিঘিœত হতে পারে। বরং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে পথিকের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। সামর্থ্য উজার করে তার সাহায্যে এগিয়ে আসতে হবে। এও মনে রাখতে হবেপ্রথমোক্ত হাদীসটিতে পথের পাশে বসার যে বিষয়টি উল্লেখিত হয়েছে সেটি কেবলই একটি প্রাসঙ্গিক বিষয়। হাদীসটির ভাষ্য হলোযদি পথের পাশে তোমাকে বসতেই হয় তাহলে পথের এ অধিকারগুলো আদায় করো। এর অর্থ এই নয়Ñ যারা পথে পথে বসে থাকবে তারাই কেবল পথের এ অধিকারসমূহ আদায় করবে। বরং এ অধিকারসমূহ পথ ও পথিকের। যারা কথাবার্তা বলা কিংবা অন্য কোনো প্রয়োজনে পথের পাশে বসবে তারা যেমন এ অধিকারসমূহ আদায়ে সচেষ্ট হবেতেমনি যারা পথিক কিংবা পথের পাশের দোকানদারতাদেরকেও এ বিষয়গুলোর প্রতি  যতœবান হতে হবে। এটিই ইসলামের আদর্শ। নিজেকে ইসলামের সত্যিকার অনুসারী হিসেবে পরিচয় দিতে হলে এ আদর্শ আমাদের ধারণ করতেই হবে।