শুক্রবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৬

ফরয সালাতের পর ইজতেমায়ি দোয়া সম্পর্কে ওলামায়ে দেওবন্দের মত


এ ব্যাপারে ওলামায়ে দেওবন্দের মত আলোচনা করার আগে সকলকে একটা বিষয় স্পষ্ট করে দেওয়া দরকার যে আহলে হাদীস শায়খগণ এ ব্যাপারে ওলামায়ে দেওবন্দের নামে খেয়ানতের সাথে মিথ্যাচার করে আসছে। ওলামায়ে দেওবন্দের বিভিন্ন কিতাব থেকে এক অংশ প্রকাশ করে আলোচনার ফলাফলকে চেপে রাখে। এটা তাদের নতুন কোন পদ্ধতি না। সাধারণ মানুষ যেহেতু বড় বড় আরবী কিতাব মুতালায়া করে তাদের মত যাচাই করতে পারে না তাই দলিলের চিপায় ফেলে সাধারণ মানুষদের আই ওয়াশ করে আসছে। তারা যে অংশটুকু গোপন করে আসল বিষয় সে অংশের মধ্যেই বিদ্যমান থাকে। আলোচনা করতে গিয়ে আমি সে গোপন করা অংশটুকুই প্রকাশ করবো ইনশাল্লাহ।
হযরত মাওলানা মুফতী রশীদ আহমাদ গাঙ্গুহী রহ.
"""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""
ফকীহুন্নফস হযরত মাওলানা মুফতী রশীদ আহমাদ গাঙ্গুহী রহ.ও মুনাজাত অস্বীকারকারীদের সমালোচনা করেছেন। (আল কাওকাবুদ্দুররী: ২/২৯১)
হাকীমুল উম্মাত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী রহ.
"""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""
নামাযের পরে ইমামের দুআ’ করা এবং উপস্থিত লোকদের আমীন বলার বিষয়ে অনেক আলোচনা-পর্যালোচনা করা হয়েছে। ইমাম ইবনে আরাফা এবং অন্যান্যদের বক্তব্যের সার কথা এই যে, যদি নামাযের পরের দুআ’ এই বিশ্বাসে করা হয় যে, এটা নামাযের ছুন্নাত-মুস্তাহাবসমূহের একটি ছুন্নাত বা মুস্তাহাব আমল। তাহলে এটা বৈধ নয়। তবে এ ধরণের বিশ্বাস পোষণ করা ব্যতীত যদি এ জন্য দুআ’ করে যে, এটা স্বতন্ত্র একটা মুস্তাহাব ইবাদাত। তাহলে দুআ’র মূল হুকুমের উপর ভিত্তি করে এটাও মুস্তাহাব হবে যেহেতু দুআ’র ফজিলত কুরআন হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। (ইমদাদুল ফতোয়া-১ম খন্ড, ৮০৪ পৃষ্ঠা)
মুফতী কিফায়াতুল্লাহ রহ.
"""""""""""""""""""""""""
মুফতী কিফায়াতুল্লাহ রহ. বলেন: ফরয নামাযের পরে ইমাম সাহেব কর্তৃক উচ্চ আওয়াজে দুআ করা এবং মুক্তাদী কর্তৃক আমীন আমীন বলার পদ্ধতিকে জরুরী মনে না করলে বৈধ। (কিফায়াতুল মুফতী: ৩য় খন্ড, ৩৩০ পৃষ্ঠা)
আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী রহ.
"""""""""""""""""""""""""""""""""""" 
আজানের পরে হাত উঠিয়ে দুআ করার বিষয়ে হযরত মাওলানা আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী রহ. বলেন: জেনে রাখ যে, অনুরূপ পদ্ধতিতে দুআ করা রসূলুল্লাহ স. থেকে প্রমাণিত নয়। আর নামাযের পরে হাত তুলে দুআ করার আমলও রসূলুল্লাহ স. থেকে খুব কমই পাওয়া যায়। এতদসত্ত্বেও এ ব্যাপারে মৌখিক উৎসাহ প্রমাণিত। এ জাতীয় বিষয়কে বিদআত বলা যায় না। আমাদের যুগের এ দুআ রসূলুল্লাহ স. থেকে প্রমাণিত সুন্নাত নয়। আবার দ্বীনের মধ্যে ভিত্তিহীন বিদআতও নয়।
আরও কিছু পরে গিয়ে তিনি বলেন: .
যদি এ বিষয়গুলো তুমি অনুধাবন করে থাক তাহলে তোমার মনের সংকীর্ণতা ঝেড়ে ফেলে দাও। (দুআর সময়) হাত তোলা বিদআত নয়। রসূলুল্লাহ-এর অনেক কথা এবং নামাযের পরে কিছু কাজ সেদিকে পথ দেখিয়েছে। আর এমনই অবস্থা জিকির ও অজীফার। রসূলুল্লাহ স. নিজের জন্য তাই বেছে নিয়েছেন আল্লাহ তাআলা তাঁর জন্য যা পছন্দ করেছেন। আর কিছু বিষয় তিনি উম্মাতকে উৎসাহিত করেছেন। আমাদের কেউ যদি নামাযের পরে হাত উঠিয়ে দুআ করার আমল করতে থাকে তাহলে সে এমন আমল করলো যে কাজে রসূলুল্লাহ স. উৎসাহ দিয়েছেন; যদিও তিনি নিজে এ কাজ বেশী করেননি। (ফাইজুল বারী: ‘মুয়াজ্জিনের আজান শুনে কী বলবে’ অধ্যায়)
আনোয়ার শাহ কাশ্মরিী রাহঃ আরো বলনে – 
“নামাযরে পর মুনাজাত প্রসঙ্গে হাদীস সমূহ ব্যাপকতা সম্পন্ন। এ হাদীস সমূহে মুনাজাতরে কোন ক্ষত্রে উল্লখে নইে। অতএব হাদীস সমূহরে ব্যাপকতার ভত্তিতিে নামাযরে পর র্সবক্ষত্রেরে/ধরনরে মুনাযাতই মুস্তাহাব বলে ববিচেতি হব।ে মূলভত্তিি সহীহ হাদীসে বদ্যিমান থাকার পর বদোয়াতরে প্রশ্নয় উঠে না।” (ফাইযুল বারী ২/ ৪৩১)।
আল্লামা ইউসুফ বিন্নুরী রহ.
"""""""""""""""""""""""""""
فهذه وما شاكلها تكاد تكفى حجة لما اعتاده الناس فى البلاد من الدعات الإجتماعية دبر الصلوات ولذا ذكره فقهاؤنا أيضا كما فى نور الإيضاح و شرحه مراقى الفلاح للشرنبلالى ويقول النووى فى شرح المهذب الدعاء للإمام و المأموم والمنفرد مستحب عقب كل الصلوات بلا خلاف ويستحب ان يقبل على الناس قلت وثبت الدعاء مستقبل القبلة أيضا كما تقدم فى حديث ابى هريرة عند ابى حاتم فثبتت الصورتان جميعا فلينبه-(معارف السنن,(৩/১২৩) باب ما يقول إذا سلم)
হযরত মাওলানা ইউসুফ বিন্নুরী রহ. বেশ কিছু হাদীস পেশ করার পরে বলেন: এগুলো এবং এর অনুরূপ যা আছে তা দ্বারা আমাদের দেশে প্রচলিত নামাযের পরে সম্মিলিত দুআর প্রমাণের জন্য প্রায় যথেষ্ট হয়ে যায়। এ কারণে নামাযের পরে সম্মিলিত দুআর কথা আমাদের ফকীহগণ বলেছেন। যেমনটি উল্লেখ রয়েছে আবুল হাসান শারান্বুলালীর লিখিত ‘নুরুল ঈযাহ’ এবং উক্ত কিতাবের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘মারাকিল ফালাহ’ কিতাবে। ইমাম নববী ‘শরহুল মুহাজ্জাব’ কিতাবের ৩য় খন্ড, ৪৮৮ পৃষ্ঠায় বলেন: ইমাম, মুক্তাদী ও একাকী নামাযী সকলের জন্য প্রত্যেক নামাযের পরে দুআ করা সর্বসম্মতিক্রমে মুস্তাহাব। আর ইমামের জন্য মুস্তাহাব হলো (দুআর সময়) মুসল্লীদের দিকে ফেরা। আল্লামা বিন্নুরী রহ. বলেন: কিবলার দিকে ফিরে দুআ করাও প্রমাণিত, যেভাবে হযরত আবু হুরাইরা রা. থেকে তাফসীরে আবু হাতিমে বর্ণিত হয়েছে। সুতরাং (মুসল্লীদের দিকে ফিরে এবং কিবলামুখী হয়ে) উভয় পদ্ধতিই প্রমাণিত হলো। সুতরাং বিষয়টি ভেবে দেখুন। (মাআরিফুস সুনান: ৩/১২৩, ‘সালামের পরে কী বলবে’ অধ্যায়)
আল্লামা জাফর আহমাদ উসমানী রহ. 
"""""""""""""""""""""""""""""""""""""
প্রখ্যাত হাদীস সংকলক হযরত মাওলানা জাফর আহমাদ উসমানী রহ. বলেন: “আমাদের দেশে যে রীতি প্রচলিত রয়েছে যে, ইমাম সাহেব কোন কোন নামযের পরে কিবলামুখী হয়ে দুআ করেন, তা বিদআত নয়। বরং হাদীসে উক্ত দুআর ভিত্তি রয়েছে। যদিও ইমামের জন্য প্রত্যেক নামাযের পর ডানে বা বামে ফেরা উত্তম”। (ই’লাউস সুনান: ৩/১৯৯)
তিনি আরও বলেন: “আমাদের দেশে যে সম্মিলিত মুনাজাতের প্রথা চালু আছে যে, ইমাম সাহেব নামাযের পরে কিবলামুখী বসে দুআ করে থাকেন, এটা কোন বিদআত কাজ নয়। বরং হাদীসে এর প্রমাণ রয়েছে। তবে ইমামের জন্য উত্তম হলো ডানদিক বা বামদিকে ফিরে মুনাজাত করা”। (ই’লাউস সুনান: ৩/১৬৩, ৩/১৯৯)
তিনি আরও বলেন: “হাদীসসমূহ দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, প্রত্যেক ফরজ নামাযের পর হাত উঠিয়ে মুনাজাত করা মুস্তাহাব। যেমন আমাদের দেশে এবং অন্যান্য মুসলিম দেশে প্রচলিত আছে”। (ই’লাউস সুনান: ৩/১৬৭, ৩/২০৪) এরপর তিনি নামাযের পরে মুনাজাত অস্বীকারকারীদের কঠোর সমালোচনা করেছেন। (ই’লাউস সুনান: ৩/২০৩)
আল্লামা ত্বাকী উসমানী দা,বা 
"""""""""""""""""""""""""""""
আল্লামা ত্বাকী উসমানী দা,বা 
শাইখুল ইসলাম আল্লামা ত্বাকী উসমানি দা,বা বলেন- “ উভয় দিক বিবেচনার পর সঠিক অবস্থান এটা যে – (ফরয সালাতের পর) ইজতেমায়ি দোয়া সুন্নতও নয় এবং নিষেধ করার মতো বিষয়ও নয়। বরং এটা এবাদাতের বিভিন্ন বৈধ পদ্ধতি হতে একটি (several permissible ways of perforoming supplication)। ” (Contemprary fatwah - 32)
বাংলাদেশের অন্যতম বিদ্যাপিঠ ‘জামিয়া রহমানিয়া আরাবিয়া’ এর দারুল ইফতা থেকে প্রকাশিত একটি প্রশ্নের উত্তরে মুফতী মনসূরুল হক সাহেব দা,বা হুজ্জত ও উসূলের উপর ভিত্তি করে প্রমান করেছেন ফরয সালাতের পর ইজতেমায়ি দোয়া করা মুস্তাহাব। এরপর তিনি বলেন -
“এ সকল বর্ণনা দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত যে, নামাযের পর ইমাম, মুক্তাদী সকলের জন্য সম্মিলিতভাবে মুনাযাত করা মুস্তাহাব। এ মুনাজাতকে বেদায়াত বলার কোন যুক্তিই নেই। কারণ-বিদায়াত বলা হয় সে আমলকে শরীয়তে যার কোন অস্তিত্বই নেই। মুনাজাত সেই ধরনের মূল্যহীন কোন আমল নয়। তবে যেহেতু মুনাজাত ‘মুস্তাহাব আমল’ তাই এ নিয়ে বাড়াবাড়ি করা অনুচিত। মুস্তাহাব নিয়ে বাড়াবাড়ি করা নিষিদ্ধ।
অতএব, কেউ মুনাজাতের ব্যাপারে যদি এমন জোর দেয়, মুনাজাত তরককারীকে কটাক্ষ বা সমালোচনা করতে থাকে, বা মুনাজাত না করলে তার সাথে ঝগড়া ফাসাদ করতে থাকে তাদের জন্য বা সেরূপ পরিবেশের জন্য মুনাজাত করা নিঃসন্দেহে মাকরুহ ও বিদআত হবে। মুনাজাত বিদায়াত হওয়ার এই একটি মাত্র দিক আছে। আর এটা কেবল মুনাজাতের বেলায় নয় বরং সমস্ত মস্তাহাবের বেলায় এ হুকুম। অতএব মুনাজাতও পালন করতে পারবে এবং বেদায়াত থেকেও বাঁচতে পারবে। আর এ জন্য সুষ্ঠ নিয়ম আমাদের জন্য এই যে , মসজিদের ইমাম সাহেবান মুনাজাতের আমল জারী রেখে মুনাজাতের দর্জা সম্পর্কে মুসল্লীগণকে ওয়াজ নসিহতের মাধ্যমে বুঝাবেন এবং ফরয-ওয়াজিব ও সুন্নত মুস্তাহাবের দর্জা-ব্যাবধান বুঝিয়ে দিয়ে বলবেন যে ফরয নামাযের পর মুনাজাত করা যেহেতু মুস্তাহাব সুতরাং যার সুযোগ আছে সে মুস্তাহাবের উপর আমল করে নিবে। আর যার সুযোগ নেই তার জন্য মুস্তাহাব তরক করার অবকাশ আছে। এমনকি কেউ যদি ইমামের সাথে মুনাজাত শুরু করে, তাহলে ইমামের সাথে শেষ করাও জরূরী নয়। কারণ, সালাম ফিরানোর পর ইকতিদা শেষ হয়ে যায়। সুতরাং কেউ চাইলে ইমামের আগেই মুনাজাত শেষ করে দিতে পারে। আবার কেউ চাইলে ইমামের মুনাজাত শেষ হওয়ার পরও দীর্ঘক্ষণ একা একা মুনাজাত করতে পারে। কিন্তু এ ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করা শরীয়তে নিষেধ। এভাবে বুঝিয়ে দেওয়ার পর ইমাম সাহেবান প্রত্যেক ফরয সালাতের পর দায়িমীভাবে মুনাজাত করলেও তাতে কোন ক্ষতি নেই।” (ফাতওয়ায়ে রাহমানিয়া ১/ ৩২৬- ৩২৭)
বাংলাদেশের অন্যতম একটি প্রধান বিদ্যাপীঠ আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়া এর প্রধান মুফতী ও মুহাদ্দিস আল্লামা মুফতি হাফেয আহমাদুল্লাহ দোয়ার উপর একটি সতন্ত্র কিতাব লিখেছেন। কিতাবটির নাম “ বিশুদ্ধ হাদীস শরীফ ও ইজমার আলোকে ফরজ নামাযের পর দোয়া ও মুনাজাত...” কিতাবটির ২৩ পৃষ্ঠায় তিনি লেখেন 
– “ সে জন্য আমাদের দেওবন্দের ওলামায়া কেরামের মুরুব্বি হাকিমুল উম্মত মুজাদ্দাদে মিল্লাত আশরাফ আলী থানভী রাহঃ এই মাসয়ালা সম্পর্কে অর্থাৎ ফরজ সালাতের পর সম্মিলিতভাবে, হাত উঠিয়ে দোয়া করা সুন্নত ও মুস্তাহাব হওয়া সম্পর্কে আমাদের চার মাযহাবের ইমামদের ইজমা নকল করত কোরআন হাদীস এবং নির্ভরযোগ্য ফিকাহ ফতোয়ার কিতাবাদি থেকে অনেক দালায়িল একত্রিত করে একটি কিতাব লিখেছেন যার নাম ‘استحباب الدعوات عقيب الصلوات ’ । কিতাবটি কয়েক জায়গায় মুদ্রিত হয়ে ইন্ডিয়া, পাকিস্তান, বাংলাদেশ সবজায়গায় প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানে তা থানভী রাহঃ এর প্রসিদ্ধ ফতোয়া গ্রন্থ ‘উমদাদুল ফাতওয়া’র প্রথম খন্ডের শেষে যুক্ত করে ছাপানো হয়েছে। এরকম তদানিন্তন অখন্ড ভারতের ফতোয়া বিষারদ মুফতিয়ে আজম হযরত মাওলানা কেফায়াতুল্লাহ সাহেব রাহ” ও ফরয সালাতের পর সম্মিলিত দোয়া ও মুনাজাত মুস্তাহাব হওয়া সম্পর্কে পৃথকভাবে একটি কিতাব লিখেছেন যার নাম ‘النفاءس المرغوبت في مسءلة الدعاء بعد المتو بة’। সে কিতাবটিও অনেকবার মুদ্রিত হয়ে প্রকাশিত হয়েছে। এরকম আরো বহু দেওবন্দি ওলামায়ে কেরাম এ বিষয়ে উর্দু ও বাংলা ভাষায় অনেক কিতাব লিখেছেন। ” (পৃ-২৩)
আমাদের আহলে হাদীস ভায়েরা দেওবন্দের আলেমদের যে সকল কওল দিয়ে বুঝাতে চায় যে দেওবন্দের আলেমগণ ফরয সালাতের পর ইজতেমায়ি দোয়া করতে নিষেধ করেছেন সে সকল কওল সমূহের মূল কথা হল – 
“রসূলুল্লাহ স. বা সাহাবায়ে কিরাম এ আমলটি স্থায়ীভাবে করেছেন মর্মে কোন পরিষ্কার বর্ণনা আমরা হাদীসে খুঁজে পাইনি। তাই হাদীসের মর্মানুসারে ফরয নামাযের পরে হাত উত্তোলন করে ইজতিমাঈ দুআ মাঝে-মধ্যে ছেড়ে দেয়া উত্তম। যাতে সাধারণ মানুয়ের মধ্যেও এ বুঝ সৃষ্টি হয় যে, এটা নফল পর্যায়ের আমল; সুতরাং করা উত্তম হলেও না করাতে কোন দোষ নেই।”
আল্লাহ তায়ালা আমাদের বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির থেকে হেফাযত করুন।–আমিন।

বৃহস্পতিবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৬

মুসলিম সেনাপতি আমর এর ন্যায়পরায়ণতা!

একদিন আলেকজান্দ্রিয়ার খ্রীষ্টান পল্লীতে হৈ চৈ পড়ে গেল। কেউ একজন গত রাতে যীশুখ্রীষ্টের প্রস্তর নির্মিত প্রতিমূর্তির নাক ভেঙ্গে দিয়েছে।
খ্রীষ্টান উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। তারা ধরে নিল যে, এটা একমাত্র মুসলমানেরই কাজ। খ্রীষ্টান নেতারা মুসলিম সেনাপতি আমরের কাছে এলো বিচার ও অন্যায় কাজের প্রতিশোধ দাবী করতে। আমর সব শুনলেন। শুনে অত্যন্ত দুঃখিত হলেন। ক্ষতিপূরণ স্বরূপ তিনি প্রতিমূর্তিটি সম্পূর্ণ নতুন করে তৈরী করে দিতে চাইলেন।
কিন্তু খ্রীষ্টান নেতাদের প্রতিশোধ নেবার বাসনা ছিল অন্যরূপ। তাদের সংকল্প প্রকাশ করে একজন খ্রীষ্টান নেতা বললো, “যীশুখ্রীষ্টকে আমরা আল্লাহর পুত্র মনে করি। তাঁর প্রতিমূর্তি এরূপ অপমান হওয়াতে আমরা অত্যন্ত আঘাত পেয়েছি। অর্থ এর যথেষ্ঠ ক্ষতিপূরণ নয়। আমরা চাই আপনাদের নবী মুহাম্মদের (সাঃ) প্রতিমূর্তি তৈরী করে ঠিক অমনি ভাবে অসম্মান করি।” এ কথা শুনে বারুদের মত জ্বলে উঠলেন আমর (রা), ভীষণ ক্রোধে মুখমণ্ডল উদ্দীপ্ত হয়ে উঠলো। কিছুক্ষণ নীরব থেকে নিজেকে সংযত করে নিয়ে তিনি খ্রীষ্টান বিশপকে লক্ষ্য করে বললেন, “আমার অনুরোধ, এ প্রস্তাব ছাড়া অন্য যে কোন প্রস্তাব করুন আমি তাতে রাজি আছি। আমাদের যে কোন একজনের নাক কেটে আমি আপনাদের দিতে প্রস্তুত, যার নাক আপনারা চান।”
খ্রীষ্টান নেতারাও সকলেই এ প্রস্তাবে সম্মত হলো।
পরদিন খ্রীষ্টান ও মুসলমান বিরাট এক ময়দানে জমায়েত হলো। মিসরের শাসক সেনাপতি আমর (রা) সবার সামনে হাজির হয়ে বিশপকে বললেন,
“এদেশ শাসনের দায়িত্ব আমার। যে অপমান আপনাদের তাতে আমার শাসন দুর্বলতাই প্রকাশ পেয়েছে। তাই তরবারি গ্রহন করুন এবং আপনিই আমার নাসিকা ছেদন করুন।”
এ কথা বলেই তিনি বিশপকে একখানি তীক্ষ্ণধার তরবারি হাতে দিলেন। জনতা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, খ্রীষ্টানরা স্তম্ভিত। চারদিকে থমথমে ভাব। সে নীরবতায় নিঃশ্বাসের শব্দ করতেও যেন ভয় হয়। সাহসা সেই নীরবতা ভংগ করে একজন মুসলিম সৈন্য এলো।
চিৎকার করে বলল,

“আমিই দোষী, সিপাহসালারের কোন দোষ নেই। আমিই মূর্তির নাসিকা কর্তন করেছি, এই তা আমার হাতেই আছে!”
সৈন্যটি এগিয়ে এসে বিশপের তরবারির নীচে নিজের নাসিকা পেতে দিল। স্তম্ভিত বিশপ। নির্বাক সকলে।
বিশপের আন্তরাত্মা রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল। তরবারি ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বিশপ বললেন,“ধন্য সেনাপতি, ধন্য এই বীর সৈনিক, আর ধন্য আপনাদের সেই মুহাম্মদ যাঁর মহান আদর্শে আপনাদের মত মহৎ, উদার, নির্ভীক ও শক্তিমান ব্যক্তি গড়ে উঠেছে। যীশু খ্রীষ্টের প্রতিমূর্তির অসম্মান করা অন্যায় হয়েছে সন্দেহ নেই, কিন্তু তার চাইতে অন্যায় হবে যদি আজ আমি এই সুন্দর ও জীবন্ত দেহের অঙ্গহানি করি। সেই মহান আদর্শ নবীকেও আমার সালাম জানাই।”

হযরত ইমাম বুখারী (রহঃ)-এর জীবনের একটা ঘটনা!


একবার ইমাম বুখারী (রহঃ) জাহাজে উঠেছেন। দীর্ঘ সফরে একজন মানুষের সাথে আলাপ এবং হৃদ্যতা। কথাপ্রসঙ্গে তিনি বলে ফেললেন তাঁর কাছে ১০০০ দিনার আছে।
পরদিনই লোকটার ভোল পাল্টে গেল। সে জাহাজের মাঝে মরাকান্না জুড়ে দিল – “আমার ১০০০ সোনার দিনার কোথায় গেল? আমার সারা জীবনের জমানো সম্পদ কে চুরি করে নিল? এখন আমার কী হবে”…?
জাহাজের কর্তৃপক্ষ ভারী বিপদে পড়ল। কিন্তু কর্তব্যের খাতিরে সবার সামান তল্লাশি করা হলো। ইমাম বুখারীর সামান-ও। নাহ, কোথাও নেই। লোকটাকে সবাই আচ্ছামত গালাগালি করল। কত সম্মানী মানুষের সম্মানহানী। ছিঃ ছিঃ, সবাই কী মনে করল? লোকটার দুনিয়া তখন ছোট্ট হয়ে এতটুকু।
সে জাহাজ থেকে নেমে ইমাম বুখারীকে বললো,
আপনি এত বড় মুহাদ্দিস, মিথ্যা কথা বলেন না,
অথচ আমাকে মিথ্যা বললেন?”
ইমাম বুখারী (রহঃ)বললেন, “আমি মিথ্যা বলিনি। তুমি যখনই আমাকে চোরের অপবাদ দেওয়ার পরিকল্পনা শুরু করেছ তখনই আমি দিনারের থলি সাগরে ফেলে দিই। কত দূর-দূরান্ত থেকে আমি হাদিস সংগ্রহ করেছি। সারা দুনিয়ার মানুষ আমার বিশ্বস্ততায় আস্থা রাখে। হাদীসের প্রচারের প্রয়োজনীয় এই বিশ্বস্ততার দাম দিনার দিয়ে মাপা যাবে না।”
“সুবহানআল্লাহ!

প্রিয় ভাই ও বোনেরা আমার! আজ যে পৃথিবীর ঘরে ঘরে আল্লাহ তাঁর কিতাবের পাশাপাশি ইমাম বুখারীর হাদিস সংকলনকে কবুল করে নিয়েছেন তার পিছনে পরীক্ষা আছে, ত্যাগ আছে, বিচক্ষণতা আছে। এই ঘটনা থেকে আমাদের জন্য বেশ কিছু শেখার জিনিসও আছে। আল্লাহ্ তাঁর কবরকে নুরে পরিপূর্ণ করে দিন আমিন।
লিখেছেনঃ আবু আনাছ!

পিতা মাতার নাফরমানীর পরিনতি!!

এক সাহাবীর মৃত্যু কালে মুখ দিয়ে কালেমা বের হচ্ছে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বিষয়টি জানানো হলো!!!
সংবাদ পেয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাশরিপ আনলেন। সাহাবীর চোখের দিকে তাকিয়ে প্রথম দৃষ্টিতেই ধরে ফেললেন, এ কোন পাপের অভিশাপ। কোন পাপ তার মুখকে বন্ধ করে দিয়েছে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাথে সাথে তার মাকে ডেকে পাঠালেন।
তার মা আসলে বললেন-আপনি আপনার ছেলেকে ক্ষমা করে দেন।
মা বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমি তাকে ক্ষমা করবনা। কারন সে আমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তাহলে আমি একে আগুনে পোড়াব।
মা বললেন, এটা আমি বরদাশত করতে পারব না।
নদী কারীম (সাঃ) বললেন, আপনি যদি তাকে ক্ষমা না করেন, তাহলে সে সোজা জাহান্নামে যাবে।
মা বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! তাহলে আমি তাকে ক্ষমা করে দিচ্ছি। মায়ের মুখ থেকে এ কথা বের হবার সাথে সাথেই দেখা গেল ছেলের মুখে কালেমা জারি হয়ে গেছে এবং সাথে সাথেই সাহাবী শেষ নিঃষ্বাস ত্যাগ করলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার জানাযা পড়ালেন।
প্রিয় ভাই ও বোনেরা আমার! আপনি পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়েছেন। নামায পড়ে কপালে কালো দাগ পরে গেছে। রোজা রেখেছেন, যাকাত আদায় করেছেন, বায়তুল্লাহ হজ্ব করেছেন, কিন্তু আপনি মা ও বাবার সাথে নাফরমানি করেছেন-ওয়াল্লাহি আপনি জান্নাত তো দূরের কথা জান্নাতের গ্রান ও আপনি পাবেন না। সারা জীবন ইবাদত বন্দীগি করেও আপনি জাহান্নামী। ভাইও বেহনো মা আর বাবা হলো জান্নাতের আটটি দরজা আপনি ইচ্ছা হলে যে কোন একটি দরজা দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবেন শুধুমাএ মা বাবার ক্ষেদমত করে। তাই আসুন আজ থেকে সকলেই প্রতিজ্ঞা করি আর কখোনো মা ও বাবাকে কষ্ট দিব না। তাদের সাথে ওহ শব্দটি উচ্চারন করব না।
আল্লাহ সুবহানা ওয়া ত’আলা আমাদের সকলকে, মা ও বাবার, বেশি বেশি করে ক্ষেদমত করার তৌফিক দান করুক-আমীন!!!!

মারআহ সালিহা! নেককার মহিলা কারা?

Atik Ullah

নেককার মহিলা কারা? যিয়াদ বিন আবি সুফিয়ান। উমাইয়া খিলাফাহর একজন জাঁদরেল প্রশাসক। তার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ আছে। দুর্ণাম আছে। সেগুলোর সব মিথ্যেও নয়। তবে তিনি যে একজন সুদক্ষ বাগ্মী আর পন্ডিত আর ধূর্তব্যক্তি, এ-ব্যাপারে কারো দিমত নেই। একদিন কী মনে করে, দরবারীদের কাছে প্রশ্ন রাখলেন:
-সবচেয়ে সুখী মানুষ কে?
-আমাদের আমীরুল মুমিনীন!
-উঁহু! ঠিক বলো নি। 
-খলীফাতুল মুসলিমীনের চেয়েও সুখী আর কে হতে পারে?
-আছে আছে। 
-কে সে?
-একজন মুসলিম:
ক. যার একজন মুসলিম স্ত্রী আছে। 
খ. যার প্রয়োজন পরিমাণ জীবিকা আছে। 
গ: যার স্ত্রী তার প্রতি সন্তুষ্ট। 
ঘ: যে তার স্ত্রীর প্রতি সন্তুষ্ট।
ঙ. আমাদের মতো প্রশাসনিক লোকদেরকে সে চেনে না। 
চ. আমরাও তাকে চিনি না। 
= এমন ব্যক্তিই সবচেয়ে সুখী। কোনও প্রকারের ঝুট-ঝামেলামুক্ত। নিশ্চিন্ত নিরুপদ্রব জীবন যাপন করে। নির্ঝঞ্ঝাট। 
.
যিয়াদ বিন আবি সুফিয়ানের মতে সবচেয়ে সুখী মহিলা কে? 
= পূত-পবিত্র চরিত্রের অধিকারিনী। মহৎ গুণাবলী সম্পন্না। চেহারা থেকে পবিত্রতার দ্যুতি ছড়াবে। হৃদয় থাকবে আনুগত্যে ভরপুর। অবয়ব থেকে ঠিকরে বের হবে, সম্ভ্রম আর সমীহ জাগানিয়া অভিব্যক্তি। স্বামীকে হৃদয়-মন সঁপে দিবে নির্দি¦ধায়। চিন্তা-বিশ্বাস ও কর্মে হবে স্বামীর প্রতি পুরোপুরি বিশ্বস্ত। তার পুরো অস্তিত্ব জুড়ে থাকবে স্বামীর উপস্থিতি। এমন নারীর কিছু সার্বজনীন বৈশিষ্ট্য আছে:
(এক) প্রয়োজনের সময় সঠিক পরামর্শ দিবে। নির্ভুল চিন্তা তুলে ধরবে:
= সাফফানাহ। বিখ্যাত আরব দানবীর হাতেম তাইয়ের কন্যা। বন্দী হয়েই এসেছেন মদীনায়। নবীজির কাছে সুন্দর করে মাফ চাইলেন। হৃদয়স্পর্শী ভাষায় বাবার কথা বললেন। নবীজি তাকে মাফ করে দিলেন। তাইতনয়া নিজ গোত্রে ফিরে গেলেন। বড়ভাই আদি তাইকে সব খুলে বললেন। নবীজির কাছে চলে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। অল্প সময়ের মাঝেই তিনি নবীজিকে চিনে ফেললেন। তার তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণে, নবীজির অনেক গুণ ধরা পড়লো। এক এক করে ভাইয়াকে সব খুলে বললেন। বোনের পরামর্শ ও সুচিন্তিত মতামত ভাই ফেলে দিতে পারলেন না। 
.
(দুই) দ্বীনের স্বার্থে, উম্মাহর পরিবার-পরিজনকে উৎসর্গ করতে দ্বিধা করবে না। আপনজনদেরকে ত্যাগ করতে একপায়ে প্রস্তুত থাকবে। 
= উম্মে কুলসুম বিনতে উকবা রা.। নবীজি মদীনায় হিজরত করেছেন। মক্কায় তখনো কিছু মুসলিম নারী ও পুরুষ রয়ে গেছেন। উম্মে কুলসুমের তখনো বিয়ে হয়নি। বাপ-ভাই ইসলাম গ্রহণ করেনি। কিন্তু নিজের বিবেক বুদ্ধিতে তিনি বুঝতে পারলেন, ইসলাম সত্য। মুহাম্মাদ সা. সত্য নবী। তিনি ইসলাম গ্রহণ করলেন। দুঃসাহসিক সিদ্ধান্ত নিলেন। একা একা মদীনায় চলে এলেন। সবকিছু ছেড়ে। তার পিছু নিয়ে দু’ভাই মদীনায় এলো। বোনকে নিয়ে যেতে। উম্মে কুলসুম ফুঁসে উঠলেন। নবীজিকে বললেন:
-আপনি আমাকে ফেরত পাঠাবেন ইয়া রাসুলাল্লাহ? তারা আমাকে আমার দ্বীন থেকে বিচ্যুত করে ছাড়বে যে! সেখানে নারীদের অবস্থা আপনি জানেন। তাদের নির্যাতনে আমি সবর করে থাকতে পারবো না! তবুও আপনি আমাকে ফিরিয়ে দেবেন?
.
নিজের বিশ্বাসের জন্যে সবকিছু ছেড়েছেন। দূরের পথ পাড়ি দিতে দ্বিধা করেন নি। কোন ডরভয়ের পরোয়া করেন নি। সিদ্ধান্ত নিতে দেরী করেন নি। 
.
(তিন) সৎকাজে অত্যন্ত তৎপর থাকবেন। অভিনব পন্থায় নেককাজ করবেন। নিজের সুখকে বিসর্জন দিয়ে হলেও। 
= নবীজি সা. বললেন; কে এই লোকের মেহমানদারি করবে? এক সাহাবী সাড়া দিলেন, আমি করবো! মেহমান নিয়ে ঘরে ফিরলেন:
-ওগো! আল্লাহর রাসূলের মেহমান নিয়ে এসেছি। দেখো কী করতে পারো!
-ইয়া আল্লাহ! ঘরে যে শুধু বাচ্চাদের খাবারই আছে! আর কিছু নেই!
-কোনও সমস্যা নেই! খাবার যা আছে প্রস্তুত করো। বাতিটা ঠিক করে রাখো। বাচ্চাদেরকে ঘুম পাড়িয়ে দাও। খাবার প্রস্তুত হলো। বাকী কাজও ঠিকঠাক মতো সম্পন্ন হলো। খানা খেতে বসলো সবাই। স্ত্রী অত্যন্ত বুদ্ধিমতি। তিনি ঠিক করার ছলে বাতিটা নিভিয়ে দিলেন। অন্ধকারেই খানাপিনা চলতে থাকলো। মেজবান দুজন ভাব দেখাতে লাগলো, তারাও সমানতালে খাবার গ্রহণ করছে। 
.
সকাল হলো। আনসারীকে দেখেই নবীজি মুচকি হেসে বললেন:
-বী ব্যাপার! আল্লাহ তা‘আলা গতরাতে তোমাকে আচরণ দেখে হেসেছেন! নাযিল করেছন:
“ তারা দারিদ্র্য সত্ত্বেও অন্যদেরকে নিজেদের উপর প্রাদান্য দেয়। যাকে অন্তরের কৃপণতা থেকে বাঁচানো হয়েছে, তারাই সফলকাম (হাশর:৯)। 
.
(চার) চারিত্রিক নিষ্কলুষতার কারণে, গভীর বোধের অধিকারী হবেন। শুদ্ধাচারসম্পন্ন চিন্তার অধিকারী হবেন। ব্যতিক্রমী কিছু হলে, তার সুরুচি সেটা গ্রহণ করতে বাধা দিবে। 
= মাইসুন বিনতে বাহদল রহ.। একজন তাবেয়ী। তার আরও পরিচয় আছে। তিনি দ্বিতীয় উমাইয়া খলীফা ইয়াযীদের মা। মুয়াবিয়া রা.-এর স্ত্রী। স্বামী থেকে বেশ কয়েকটা হাদীসও বর্ণনা করেছেন। রূপে-গুণে অতুলনীয় ছিলেন। চমৎকার কবিতা রচনা করতেন। খাঁটি বেদুইনকন্যা ছিলেন। একদিন মুয়াবিয়া রা. তার কাছে এলেন। সাথে ছিল একজন খোজা খাদেম। তাকে দেখেই মাইসুন বলে উঠলেন:
-এ কে? এখানে কেন?
-সমস্যা নেই! সে ‘খোজা’!
-আল্লাহর কসম! খোজা হলেই, আল্লাহ যা হারাম করেছেন তা হালাল হয়ে যায় না! (বিদায়া
.
কী অনন্য চিন্তা! কী অপূর্ব আত্মসম্মানবোধ! কী বেনজীর সচেতনতা আর রুচিবোধ! বেগানা পুরুষ যেই, যেমনই হোক, তার সামনে যেতে একজন মুসলিম নারীর বিবেকে লাগবেই! তার রুচিতে বাধবেই!
.
(পাঁচ) আল্লাহর শা‘আয়ের বা নিদর্শনের সম্মানবোধ থাকবে। সেটা নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী প্রকাশও করবেন। 
= জামীলা বিনতে হাসান (৯৮১)। হামদানী গোত্রের মহিলা। অত্যন্ত স্বাধীনচেতা। অতিরিক্ত আত্মসম্মানবোধের কারণে জীবনে কারো কাছে বিয়ে বসেন নি। অন্য কোনও পুরুষ তার ওপর আধিপত্য করবে এটা তার পক্ষে মেনে নেয়া অসম্ভব ছিল। পর্দার আড়ালে থেকে বাবা ও ভাইয়ের সাথে রাজকার্যে অংশ নিতেন। ৩৬৬ হিজরীতে হজ করেছেন। আব্বাসী খলীফা হারুনুর রশীদের স্ত্রী যুবায়দার মতোই তিনি মক্কার উন্নয়নে অনেক টাকা ব্যয় করেছেন। হজের সফরে তার সাথে ছিল চারশ দাসী। মালসামানা বহন করার জন্যে ছিল অসংখ্য উট। অনেকগুলো উটের পিঠে হাওদা লাগানো ছিল, যাতে লোকজন বুঝতে না পারে, কোনটাতে জামীলা আছেন। কা‘বার সম্মানে ব্যক্তিগত কোষাগার থেকে দান করেছেন দশ হাজার স্বর্ণমুদ্রা। পঞ্চাশ হাজার জোড়া কাপড় দান করেছেন। দান-দাক্ষিণা ও পরহেজগারিতে অতুলনীয় হলেও, এই হামদানীরা ছিল শী‘আ। একজন নারীও মক্কা ও মদীনার প্রতি সম্মান রাখতে পারে, তার নমুনা হিশেবেই জামীলার কথা আনতে হলো। এমন আরো বহু নারী আছেন, যারা মক্কার জন্যে উদার হস্তে ব্যয় করেছেন। অতুলনীয় সম্মান দেখিয়েছেন। কিন্তু সবার মাঝে জামীলার মতো গুণ ছিল না। 
.
(ছয়) হক ও সত্য প্রকাশের ক্ষেত্রে কোনও কিছুর পরোয়া করবে না। নিন্দুকের নিন্দার ভয় করবে না। 
আহলে বাইতের এক বিদূষী কন্যা। ফাতিমা তার নাম। এক লোক এসে, আড়াল থেকে তার পিতার প্রশংসা করতে শুরু করলো। উদ্দেশ্য, বাবার কথা বলে মেয়েকে খুশি করা। সরাসরি মেয়ের প্রশংসা করা যায় না। ফাতিমা লোকটার দুরভিসন্ধি ধরে ফেললেন। চুপচাপ উঠে গিয়ে, চুলা থেকে ছাই এনে লোকটার মুখের উপর ছুঁড়ে মারলেন। (তাবাকাতে ইবনে সা‘দ)। 
.
(সাত) ইবাদত বন্দেগীর প্রতি প্রবল আগ্রহ থাকবে। শুধু নিয়ে নয়, অন্যদেরকেও উদ্বুদ্ধ করবে। 
= হায়সাম বিন জাম্মায বলেছেন: আমার স্ত্রী রাতে খুব কম ঘুমুতেন। আমি তার মতো অত জেগে থাকতে পারতাম না। শেষরাতে আমি ঘুম থেকে না জাগলে, আমার মুখে পানি ছিটিয়ে দিয়ে বলতেন:
-আর কতো নাক ডাকাবেন! আল্লাহর কথা ভেবে লজ্জিত হোন!
.
(আট) সব ধরনের দুনিয়াবি লোভ-লালসাকে জয় করতে পারবে। নিজেকে নিরাসক্ত রাখতে পারবে। শত প্রলোভনেও টলে যাবে না।
= ঈদের রাত। খরচ করার মতো কোনও টাকা নেই। স্বামী তার এক বন্ধুর কাছ থেকে কিছু টাকা করয আনল। এমন সময় একজন আওলাদে রাসূল এলো। করযের আশায়। স্ত্রীকে বললো: তুমি কী বলো? নবীজি সা.-এর আওলাদকে খালি হাতে ফিরিয়ে দেবো? অর্ধেক দিয়ে দিই?
-কী বলছেন আপনি! আপনার সামনে আবু বকর ও উমার রা.-উভয়ের আদর্শই আছে। আপনি প্রথম খলীফার আদর্শকে কেন গ্রহণ করছেন না? উমার রা. নিজেই তো প্রথম হতে না পেরে আফসোস করেছেন? 
-ঠিক আছে, যা হওয়ার হবে, হাওলাত করে আনা পুরো টাকাই দিয়ে দিচ্ছি। হাদিয়া হিশেবে!
.
(নয়) দ্বীনের জন্যে কষ্ট সহ্য করা। নিজের বিশ্বাসে অটল অবিচল থাকা। বিচ্যুত না হওয়া। পরিবার বা স্বামীর পাপ দ্বারা প্রভাবিত না হওয়া। 
= হাওয়া বিনতে আসাদ রা.। আনসারী মহিলা। তার স্বামী ছিল কায়েস বিন খাতীম। স্বামীর অগোচরে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। মুসআব বিন উমায়ের রা.-এর দাওয়াতে। এটা নিয়ে স্বামী হাওয়াকে কষ্ট দিতো। মহীয়সী হাওয়া স্বামীর নির্যাতনকে পরোয়া করেন নি। মুখ বুজে সয়েছেন। ইসলাম ত্যাগ করেন নি। স্বামী দ্বারা প্রভাবিতও হন নি। অথচ মদীনাতে তখনো ইসলাম অতটা প্রচারিত হয়নি। 
.
(দশ) বিপদে ধৈর্যের প্রতিমূর্তি হবেন। দ্বীনের জন্যে স্বামী-সন্তানকে উৎসর্গ করতে পিছপা হবেন না। 
= বিশিষ্ট তাবেয়ী সিলাহ বিন আশয়াম রহ.। যুদ্ধে গিয়েছেন। সাথে আছে তার আদরের পুত্র। পুত্রকে বললেন: বৎস আগে বাড়ো। তুমি শহীদ হলে আমি আজর পাবো। পুত্র শহীদ হয়ে গেলো। এবার বাবাও আগে বাড়লেন। তিনিও শহীদ হয়ে গেলেন। বাড়িতে খবর এলো স্ত্রী মু‘আযার কাছে। খবর শুনে প্রতিবেশিনী মহিলারাও এলেন। তাদের দেখে মু‘আযাহ বললেন:
-তোমরা যদি আমাকে সম্ভাষণ জানাতে এসে থাকো, তাহলে স্বাগতম! আর যদি অন্য কিছুর জন্যে এসে থাকো, তাহলে ফিরে যাও!
.
(এগার) সন্তানদের প্রতি যত্নবান হবেন। তাদের ঈমান-আমনের প্রতি লক্ষ্য রাখবেন। সন্তানকে দ্বীন শিক্ষাদানের ব্যাপারে ব্রতী হবেন। শত বাধাতেও টলবেন না। আত্মীয় স্বজনের চোখ রাঙানিকে ভয় পাবেন না। 
= উম্মে সুলাইম রা.। ঈমান এনেছেন। স্বামী আবু আনাস বাইরে ছিলেন। ঘরে ফিরে দেখলেন পরিস্থিতি ভিন্ন! রেগে গিয়ে স্ত্রীকে বললেন
-ধর্মত্যাগী হয়ে গেছো?
-উঁহু! আমি মুহাম্মাদের প্রতি ঈমান এনেছি!
উম্মে সুলাইম ছেলেকে কালিমা পড়াতে শুরু করলেন। এটা দেখে ছেলের বাবা বললো:
-তুমি ছেলেকে নষ্ট করছো! 
-না, আমি নষ্ট করছি না!
.
(বারো) স্বামীকে যথাযথ সম্মান করে। তার সাথে আদব-লেহায বজায় রেখে চলে। 
= সায়ীদ ইবনুল মুসাইয়াব রহ. এর স্ত্রী বলেছেন:
-আমরা স্বামীগনের সাথে এমন ভঙ্গিতে কথা বলতাম যেমনটা তোমরা রাজা-বাদশার সাথে কথা বলো!
.
(তেরো) স্বামীর খেদমতের প্রতি তৎপর থাকবে। স্বামীর বাড়ির কাজও সোৎসাহে করবে।
 = আসমা বিনতে আবি বকর রা.। বিয়ে হয়েছে হযরত যোবায়ের রা.-এর সাথে। তিনি বলেছেন:
-আমাকে বিয়ে করেছেন যোবায়ের। তার কোনও ধন-সম্পদ ছিল না। আমি নিজ হাতে তার ঘোড়ার ঘাস কাটতাম। পানি খাওয়াতাম। নিজ হাতে রুটি বানাতাম। যোবায়েরের জমি থেকে খেজুর আঁটি কুড়িয়ে আনতাম। মাথায় করে। একমাইল দূর থেকে। 
.
(চৌদ্দ) স্বামীর আবেগ-অনুভূতির সাথে একাত্ম হবে। স্বামী সুখে হাসবে। স্বামীর দুঃখে কাঁদবে। তার ব্যথায় ব্যথিত হবে। 
= আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা রা. একদিন ঘরে বসে কাঁদতে শুরু করলেন। তার দেখাদেখি স্ত্রীও কাঁদতে শুরু করলেন। আবদুল্লাহ স্ত্রীকে প্রশ্ন করলেন:
-তুমি কেন কাঁদছ?
-আপনাকে কাঁদতে দেখে আমারও কান্না পেয়ে গেছে!
-আমি কাঁদছি, জাহান্নামের ভয়ে!
.
(পনের) স্বামীর মৃত্যুর পরও কেউ কেউ বিশ্বস্ত থাকে। স্বামীর ভালোবাসা ভুলতে পারে না। স্বামী মারা গেলে স্ত্রী আবার বিয়ে করলে সেটা দোষণীয় কিছু নয়। তবে স্বামীর প্রতি ভালোবাসাবশত বাকি দিনগুলো একাকীও কাটিয়ে দেয় অনেকে!
= উম্মে দারদা রা.তার স্বামী আবু দারদাকে বললেন:
-আপনি আমার বাবা-মায়ের কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন। তারা আপনার কাছে আমাকে বিয়ে দিয়েছেন। আর আমি এখন আপনার কাছে আমার নিজের বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছি! আখেরাতের জন্যে!
-ঠিক আছে, তুমি আমার মৃত্যুর পর আর বিয়ে বসো না!
আবু দারদা রা. মারা গেলেন। তখন মুয়াবিয়া রা. বিধবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠালেন। উম্মে দারদা প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন। 
.
(ষোল) শরীয়তের ইলম শেখার প্রতি নিবিষ্ট হবেন। ঘরের কাজের পাশাপাশি। সুযোগ থাকলে ব্যুৎপত্তি অর্জন করবেন। 
= শায়খ আলাউদ্দীন সামারকন্দী রহ.। তার মেয়ে ফাতিমা। বাবা তার মেয়েকে উপযুক্ত শিক্ষা দিয়েছেন। সাধ্যানুযায়ী নিজের সবটুকু ইলম মেয়েকে শেখানোর চেষ্টা করেছেন। মেয়েও মা-শা-আল্লাহ বাবার মেহনতকে কাজে লাগাতে কসুর করেনি। বাবার লিখিত বিখ্যাত কিতাব ‘তুহফাতুল ফুকাহা’ আগাগোড়া মুখস্থ করে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। এমন বিদূষী কন্যার খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো। রাজপুত্ররাও বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে ভীড় জমাতে শুরু করলো। ইলমসাধক বাবা এমন প্রস্তাবে রাজি হলেন না। শায়খের একজন ছাত্র, কাসানী! তিনি এক অভিনব কাজ করলেন। শায়খের কিতাব ‘তুহফাতুল ফুকাহা’-এর একটা বিশাল ব্যখ্যাগ্রন্থ রচনা করে নিয়ে এলন। ছাত্রের এমন কীর্তিতে শিক্ষক রীতিমতো মুগ্ধ। মেয়ের উপযুক্ত পাত্র পেয়ে গেলেন। এমন মেয়ের মোহরানা কী হবে? এক অভিনব মোহরানা ধার্য্য করা হলো,উভয়পক্ষের সম্মতিতে;
= ছাত্রের লিখিত কিতাব ‘বাদায়ে সানায়ে’-ই হলো বিয়ের মোহরানা। 
সংসার শুরু হলো। সংসার তো নয় যেন ‘মাদরাসা’। স্বামী পড়ালেখায় একটু পিঠটান দিলেই স্ত্রীর খরবদারি! স্বামীর ভুল হবার জো নেই, স্ত্রী হেঁশেল থেকেই বলে পড়া বলে দিচ্ছেন! মুখস্থ। আগে বাবার কাছে বিভিন্ন মানুষ ফতোয়ার জন্যে আসতো! লিখিত ফতোয়ার স্বাক্ষর থাকতো দু’জনের: বাবা ও মেয়ের। বিয়ের পর অবস্থার হেরফের হলো না। শুধু ফতোয়ার কাগজে জামাইয়ের স্বাক্ষর বৃদ্ধি পেলো। 
.
(সতের) হালাল তরীকার উপর চলবে। হারাম বর্জন করবে। অত্যন্ত সচেতনভাবে হালাল-হারামের প্রতি লক্ষ্য রাখবে। 
= মায়মুনাহ বিনতে আকরা রহ.। ইবাদতগুজার ও মুত্তাকী মহিলা ছিলেন। ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল রহ.-এর কাছ থেকে হাদীস শিখেছেন। সুতা কেটে জীবিকা নির্বাহ করতেন। বেশ কিছু সুতা বোনা হয়েছে। বিক্রি করার জন্যে সুতা ব্যবসায়ীকে ডেকে পাঠালেন। তার হাতে সুতা তুলে দিয়ে বললেন:
-আপনি সুতাগুলো বিক্রির সময় ক্রেতাকে বলে দিবেন, আমি এগুলো বোনার সময়, রোজা রেখেছিলাম। তাই কাজে একটু শিথিলতা এসেছিল। বুনন অতটা মযবুত হয়নি হয়তো!
-আচ্ছা ঠিক আছে, আমি বলে দেবো!
ব্যবসায়ী চলে গেলো। একটু পর কী মনে করে মায়মুনা আবার ব্যবসায়ীকে ডেকে পাঠালেন:
-আমার সুতাগুলো ফেরত দিয়ে দিন। আমি বিক্রি করবো না!
-কেন কী হলো?
-আমার ভয় হচ্ছে, আপনি ক্রেতাদের কাছে সুতার দুর্বলতাটা খুলে বলবেন না। তাহলে ক্রেতা ঠকানোর কারনে আমার গুনাহ হবে! 
.
(আঠার) আল্লাহর দিকে সাধ্যানুযায়ী মানুষকে দাওয়াত দিবে। নিজের সীমার মধ্যে থাকা মানুষকে। আত্মীয়কে। 
= উম্মে শুরাইক রা.। ইসলাম তার কাছে ভালো লেগে গেলো। ঈমান আনতে দেরী করলেন না। এবার শুরু করলেন দাওয়াতের কাজ। তিনি গোপনে কুরাইশ মহিলাদের কাছে যেতেন। তাদেরকে ইসলাম সম্পর্কে বোঝাতেন। ইসলাম গ্রহণের প্রতি উদ্বুদ্ধ করতেন। ব্যাপারটা বেশিদিন গোপন থাকলো না। ফাঁস হয়ে গেলো। মক্কার পুরুষরা ক্ষেপে গেলো। তারা উম্মে শুরাইককে হুমকি দিয়ে বলল:
-তোমার কওম যদি না থাকতো, তাহলে আমরা এর একটা বিহিত করেই ছাড়তাম!
.
একজন নেককার মহিলার গুণের কোনও শেষ নেই। একজনের মধ্যে সবগুণই বিদ্যমান থাকবে এমন নয়। কমবেশ হতে পারে। কিন্তু আগের যুগের মহীয়সীগনের আদর্শ সামনে থাকলে, নিজেকে আরো ভাল করার প্রেরণা পাওয়া যায়।

আসহাবে উখদুদ!

Atik Ullah


জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রকে কুরআন কারীমের আওতায় আনা মুমিনের দায়িত্ব। নিজের চিন্তার লাগামের নিয়ন্ত্রণ কুরআন কারীমের হাতে ছেড়ে দেয়া, একজন শিক্ষিত মানুষের কর্তব্য। চিন্তা ও কর্ম জুড়ে কুরআন কারীম থাকা, মানবজীবনের শ্রেষ্ঠতম প্রাপ্তি! কিন্তু এই দুর্লভ অর্জন অধরাই থেকে গেলো! কুরআন কারীমকে ধারন করতে না পারার একটা অতৃপ্তি সারাক্ষণ ভেতরটাকে কুরে কুরে খায়। 
.
হালাব ও ইরাক-সিরিয়ার বিভিন্ন শহরের অবস্থা দেখে, সূরা বুরূজের কথা মনে পড়লো। হাদীস শরীফে এ-বিষয়ে একটা ঘটনার কথা বলা হয়েছে! সেটা একটু পড়ে দেখা যাক! উখদূদ অর্থ গর্ত। শিরোনামের অর্থ দাঁড়ায়: গর্তজীবিরা। 
.
যু-নাওয়াস। নাজরানের বাদশা। নাজরান প্রাচীন আরবের বিখ্যাত শহর। এখানে জাদুবিদ্যার বেশ প্রচলন। এখনকার সরকারী আলেমদের মতো, তখনো রাজদরাবারে থাকতো জাদুকর। রাজার পক্ষে জাদুকরী ফলাতো। এখন যেমন ফতোয়াগিরি করে। জাদুকরের বয়েস হয়ে গেছে। এখনো যোগ্য কোনও উত্তরসূরী তৈরী হলো না। এ-নিয়ে তার আক্ষেপের শেষ নেই। কী হবে তার মৃত্যুর পর? সারা জীবনের সঞ্চিত ‘জাদুবিদ্যা’ কি তবে বৃথা যাবে? নাহ একটা বিহিত করতেই হবে:
-জাহাঁপনা! আমি বৃদ্ধ হয়ে গেছি। কখন মনে যাই তার ঠিক-ঠিকানা নেই! আমাকে একজন নবীসের ব্যবস্থা করে দিন না! তাকে গড়েপিটে নিতাম!
কথাটা রাজার মনে বেশ ধরলো। পুরো শহর চষে উপযুক্ত এক বালককে নিয়ে আসা হলো। শুরু হলো জাদুবিদ্যা শিক্ষা। বালক প্রতিদিন গুরুর কাছে আসে। জাদুর তালীম নিয়ে ঘরে ফিরে যায়। 
বালকের আসা-যাওয়ার পথেই এক রাহেব (সংসারত্যাগী আল্লাহভীরু) আবাস ছিল। ঘটনাক্রমে রাহেবকে ভালো লেগে গেলো বালকের। রাহেবের কথা শুনে মুগ্ধ হলো বালক। জাদুগুরুর কাছে যাওয়ার পথে, রাহেবের কাছেও ধর্না দিতে শুরু করলো। এজন্য মাঝেমধ্যে গুরুর আখড়ায় পৌঁছতে বিলম্ব হয়ে যেতো। বুড়ো গুরু ছিলেন রগচটা স্বভাবের। শাগরেদের দেরী দেখলে নিজেকে সামলাতে পারতেন না। ধমাধম কিলঘুষি বসিয়ে দিতেন। 
বালক পড়লো বিপদে! বুযুর্গ রাহেবের কাছে না গেলে তার ভাল লাগবে না। আবার গুরুর কাছেও যেতে হবে। রাজ-ফরমান বলে কথা! এখন উপায়? শেষমেষ বুযুর্গের কাছেই কথাটা পাড়ল:
-ও আচ্ছা, এই ব্যাপার! একদম চিন্তা করবে না। জাদুগুরুকে বললে: ঘরের লোকেরা আসতে দেয়নি! আর ঘরের লোকদের বলবে: গুরু আসতে দেননি, তাই দেরী হয়েছে!
.
আপাতত একটা সমাধান হলেও, বালকের মনে প্রশ্ন উদয় হলো: কে ভালো? জাদুগুরু না ধর্মগুরু? আল্লাহ তা‘আলা খটকা দূর করার ব্যবস্থা করলেন। শহরে এক চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটলো। লোকজন চলাচলের বড় রাস্তায় কোত্থেকে এক বিরাট অজগর এসে ঠাঁই নিল। প্রাণভয়ে লোকজন পথচলা বন্ধ করে দিল। জনজীবনে দেখা দিল অবলাবস্থা। রাস্তার দুই পাড়েই মানুষজন আটকা পড়ে রইল। 
বালকের মাথায় একটা চিন্তার উদয় হলো: এবার জানা যাবে দু’জনের কে ভালো। একটা পাথর কুড়িয়ে নিল। মনে মনে বললো: হে আল্লাহ! রাহেব যদি আপনার কাছে সাহের (জাদুকর)-এর চেয়ে বেশি প্রিয় হয়, তাহলে অজগরটাকে মেরে দেখান! 
পাথরটা ছুঁড়ে মারলো সাথে সাথে সাপটা মারা গেলো। রাহেবের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস বহুগুণ বেড়ে গেলো। পরিষ্কার হয়ে গেলো,জাদুগুরুর অসারতা। রাহেবের কাছে গিয়ে ঘটনা খুলে বললো বালক। রাহেব সবকথা শুনে বললেন:
-বাছা, তুমি আজ আমার চেয়েও আগে বেড়ে গেছো। তোমার বিষয়টা আজ বড় আকার ধারন করেছে। তুমি যদি পরীক্ষার সম্মুখীন হও, তাহলে আমার কথা কাউকে বলে দিও না!
.
পাথর ছুঁড়ে সাপ মারার কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো। সবাই ভাবলো নিশ্চয় বালক অপার্থিব শক্তির অধিকারী। দলে দলে অসুস্থ মানুষেরা বালকের কাছে আসতে শুরু করলো। জন্মান্ধ, কুষ্ঠরোগীরা ধর্না দিতে শুরু করলো। রাজার এক সভাসদও বালকের কাছে এলো। তার সভাসদের দৃষ্টিশক্তি লোপ পেয়েছিল। সাথে নিয়ে অগাধ ধনরত্ন:
-আমাকে ভালো করে দিতে পারলে, এসব হীরে-জহরত তোমার হয়ে যাবে!
-আমি সুস্থ্য করার ক্ষমতা রাখি না। সুস্থ্য করার মালিক একমাত্র আল্লাহ। আপনি যদি আল্লাহর প্রতি ঈমান আনেন, তাহলে আমি আরোগ্যের জন্যে দু‘আ করতে পারি!
-ঠিক আছে ঈমান আনলাম!
আল্লাহ সভাসদের দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিলেন। পরদিন খুশিমনে দরবারে হাজির হলেন সভাসদ। রাজা অবাক! 
-তোমার চোখ ভাল হলো কী করে?
-আমার রব ভালো করে দিয়েছেন!
-আমি ছাড়াও তোমার আর রব কে?
-তিনি আমার ও আপনার রব, আল্লাহ!
সভাসদকে গ্রেফতার করা হলো। চরম নির্যাতন চালানো হলো। সভাসদ সইতে না পেরে, শেষে বাধ্য হয়ে বালকের কথা বলে দিলেন। রাজা এবার বালকের দিকে মনোনিবেশ করলেন:
-কী ব্যাপার, খবর পেলাম তুমি নাকি সর্বরোগের আরোগ্য দানকারী?
-আমি কাউকে আরোগ্য দান করার ক্ষমতা রাখি না। আল্লাহই সবাইকে আরোগ্য দান করেন। 
রাজার হুকুমে বালককে গ্রেফতার করা হলো। কোথায় পেয়েছে এই নতুন ধর্মবিশ্বাস, সেটা বের করার জন্যে দিনরাত নির্যাতন চালানো হলো। বালক বাধ্য হয়ে রাহেবের নাম বলে দিল। গ্রেফতার করা হলো রাহেবকে। তাকে বলা হলো:
-তোমার দ্বীন থেকে ফিরে এসো!
-আমি কিছুতেই আমার দ্বীন ত্যাগ করবো না!
করাত দিয়ে রাহেবের মাথা থেকে পা পর্যন্ত দু’টুকরা করে ফেলা হলো। রাজার সভাসদও একই পরিণতির শিকার হলেন। এবার বালকের পালা:
-তুমি আগের দ্বীনে ফিরে এসো!
-আমি কিছুতেই আমার দ্বীন ত্যাগ করবো না!
রাজা হুকুম দিলেন:
-এই বালককে নিয়ে অমুক পাহাড়ে যাও। চূড়ায় ওঠার পর, তাকে আরেকবার তার ধর্মত্যাগ করতে বলবে। ফিরে এলে ভাল, নইলে পর্বতশিখর ছেড়ে ছুঁড়ে নিচে ফেলে দিবে। 
.
রাজার লোকেরা বালককে নিয়ে গন্তব্যে পৌঁছে গেলো। চূড়ায় চড়ার পর, বালক তার রবের কাছে দু‘আ করলো:
-আল্লাহুম্মাকফিনীহিম বিমা শি‘তা। ইয়া আল্লাহ! আপনার ইচ্ছা মতো, তাদের বিরুদ্ধে আমার জন্যে আপনি যথেষ্ট হয়ে যান। 
দু‘আ শেষ হতে না হতেই পাহাড়টা প্রবলভাবে কেঁপে উঠলো। রাজার লোক-লস্কর ছিটকে পড়ে বেঘোরে মারা পড়লো। মুমিন বালক বহাল তবিয়তে ফিরে এলো। রাজা সীমাহীন অবাক হয়ে জানতে চাইলেন:
-অন্যদের কী হলো?
-আল্লাহ তা‘আলাই আমার পক্ষ হয়ে তাদের ব্যবস্থা করেছেন!
.
রাজা গেলেন আরো ক্ষেপে। এবার আরো বেশি লোক দিয়ে বালককে বন্দী করে পাঠালেন। বলে দিলেন:
-তাকে নিয়ে গভীর সমূদ্রে চলে যাও! ধর্মত্যাগ করলে ভাল, অন্যথায় বন্দী অবস্থাতেই ফেলে দিবে। 
বালক আগের দু‘আটাই আবার পড়লো। সাথে সাথে নৌকা উল্টে গেলো। সবার সলিল সমাধি হলেও, বালক কুদরতি বলে বেঁচে গেলো। রাজা যারপরনাই অবাক:
-বাকীরা কোথায়?
-তাদের ব্যবস্থা আল্লাহ করেছেন! শুনুন রাজামশায়! আপনি আমাকে শত চেষ্টা করলেও হত্যা করতে পারবেন না। তবে আমাকে মারার একটা উপায় বাতলাতে পারি!
-কী উপায়?
-নগরবাসীকে এক জায়গায় জড়ো করতে হবে। তারপর আমাকে শূলে চড়িয়ে তীর ছুঁড়ে হত্যা করতে হবে। তীর ছোঁড়ার আগে একটা দু‘আ পড়তে হবে। 
-কোন দু‘আ?
-বিসমিল্লাহি রাব্বিল গুলাম!
.
নগরবাসী আগে থেকেই সাহসী বালকের প্রতি গুণমুগ্ধ ছিল। তার প্রতি রাজার এই নির্মম জুলূম দেখে, তারা বালকের প্রতি আরো বেশি অনুরক্ত হয়ে পড়লো। বালকের ধর্ম সম্পর্কে শহরবাসী কমবেশি জানতে পেরেছিল। তাকে হত্যার বিভিন্ন প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার সংবাদও জানতে পেরেছিল। এসব কারনে তাদের মনে বালকের ধর্মের প্রতি প্রবল অনুরাগ তৈরী হলো। বালক শহীদ হওয়ার সাথে সাথেই সবাই কালিমা পড়ে মুসলমান হয়ে গেলো। 
.
রাজার দরবারে সংবাদ পৌঁছতে দেরী হলো না। হিতাহিত জ্ঞানশুন হয়ে রাজা হুকুম দিলেন:
-বিরাট বড় করে লম্মালম্বি একটা গর্ত খোঁড়! গর্তের মধ্যে আগুন জ্বালাও। 
যারা বালকের ধর্ম ত্যাগ করতে অস্বীকার করলো, তাদের সবাইকে ধরে ধরে অগ্নিগর্তে ছুঁড়ে ফেলা হলো। শিশুসন্তান সহ এক মাকে ধরে আনা হলো। মা আগুনে ফেলার ভয়ে কাঁপছিলেন। তখন শিশুসন্তান মাকে সান্তনা দিয়ে বললো: আম্মু ভয় পেয়ো না, তুমি হকের ওপর আছো!
.
গল্পের মূল বক্তব্য হাদীস শরীফ থেকে নেয়া। কুরআন কারীম ও হাদীস শরীফ উভয় নসেই ঘটনাটার উল্লেখ আছে। এজন্য ঘটনাটা গুরুত্ব অনেকগুণ বেড়ে যায়। কিছু ঘটনা শুধু কুরআনে আছে, হাদীসে নেই, আবার কিছু ঘটনা হাদীসে আছে কুরআনে নেই। ঘটনাটা পড়লে কিছু ভাবনা মাথায় আসে। সেগুলো সেঁচে আনা যাক।
-
প্রথম ভাবনা
গল্পের মূল চরিত্র হলো একজন গোলাম মানে বালক। উপযুক্ত শিক্ষা পেলে, একজন কিশোরও বিরাট পরিবর্তন আনতে পারে। শিশু-কিশোরদের মধ্যে ছোটকাল থেকেই ‘দাওয়াত ও জিহাদের’ মেজাযে গড়ে তুলতে পারলে, ভবিষ্যতে তারা উম্মাহর অমূল্য রতনে পরিণত হবে। মুস্তাফা সাদেক রাফেয়ী রহ. বলেছেন:
-আজকের কাঁচারাই আগামী দিনের ‘পাকা’!
আজকের শিশুরাই আগামী কালের পুরুষ। প্রতিটি শিশুই বিপুল সম্ভাবনা নিয়ে জন্ম গ্রহণ করে। বাবা-মায়ের হাতেই তার ভবিষ্যত নির্মিত হয়। 
সন্তানের সাথে সম্পর্কটা হওয়া চাই ঘনিষ্ঠ ও নিবিড়। ভয় ও ভালবাসার মিশেলে। স্নেহ ও শ্রদ্ধার যৌথ আয়োজনে। পিতার দায়িত্ব আল্লাহ তা‘আলা একটা বাক্যেই বলে দিয়েছেন:
= তোমরা নিজেকে ও পরিবারকে আগুন থেকে রক্ষা করো (তাহরীম: ৬)। 
নবীজি সা.-ও বলে গেছেন:
= প্রতিটি শিশুই ‘ফিতরাতের’ উপর জন্মগ্রহণ করে। তার বাবা-মা তাকে ইহুদী বানায়। খ্রিস্টান বানায়। মজুসী বানায় (মুসলিম)। 
.
দ্বিতীয় ভাবনা:
শিষ্যের কথা শুনে রাহেব বললেন:
-তুমি আজ আমার চেয়ে এগিয়ে গেছো!
চমৎকার একটা দিক ফুটে উঠেছে। উস্তাদ অম্লানবদনে স্বীকার করে নিলেন: শাগরেদের শ্রেষ্ঠত্ব। তাও সরাসরি শাগরেদের সামনে। এ-দিকটাতে আমাদের সমাজ আজো পিছিয়ে আছে। শিষ্যকে স্বীকৃতি দিতে বেজায় অনীহ আমরা। অথচ হাজারো বছর আগেই এই মূল্যবোধ চর্চিত ও অর্জিত হয়েছিল। একজন বিনয়ী উস্তাদের চিত্র ফুটে উঠেছে। ছাত্ররা যদি শিক্ষকদের চেয়ে বেশি যোগ্য হয়ে না ওঠে, তাহলে সমাজ আগে বাড়বে কী করে? স্থবিরতা দেখা দেবে না সমাজে ও রাষ্ট্রে? একজন যোগ্য শিষ্যকে হতে ওস্তাদের চেয়েও যোগ্য। ওস্তাদের সমান হওয়াও চলবে না। তাহলে বড় হয়ে কী করবে? ওস্তাদের বইয়ের নোট লিখবে। অথবা ওস্তাদের লিখিত বইয়ের সারসংক্ষেপ লেখায় নিরত হবে। শিষ্যকে আগা বাড়াতে হলে ওস্তাদের প্রেরণার বিকল্প নেই। আলি তানতাবী রহ. বলেছেন:
-গত শতাব্দীতে সিরিয়ায় জ্ঞানের ক্ষেত্রে স্থবিরতা সৃষ্টি হওয়ার অন্যতম কারণ ছিল: উৎসাহদানের অনুপস্থিতি। 
শুধু শুকনো প্রশংসা নয়, পিঠ চাপড়ে উৎসাহ ও প্রেরণা যোগাতে হবে শিষ্যকে। এটা সুন্নাতও বটে। নবীজি সা. সব সময় এমনটাই করতেন। তিনি একবার বলেছিলেন:
-তোমাদের সেরা কারী হলেঅ উবাই, সেরা ফরায়েয বিশেষজ্ঞ হলো যায়েদ (তিরমিযী)।
 এছাড়া বড় বড় প্রায় সব সাহাবী সম্পর্কেই এক বা একার্ধিক প্রশংসাবাক্য-উৎসাহবাক্য উচ্চারণ করেছেন নবীজি। এটা যে সুন্নাত, সেটাই তো মাথায় থাকে না! শুধু ওস্তাদ-শাগরেদই নয়, যে কোনও গুণীর কদর ও সমাদর করা, তার গুণের স্বীকৃতি দেয়া সুন্নাত। 
.
তৃতীয় ভাবনা
বিপদের সময় একমাত্র আল্লাহর দিকে রুজু হওয়া। আল্লাহ তা‘আলার প্রতি পুর্ণ আস্থা রাখা। তাও ওপর তাওয়াক্কুল করা। বালক বয়েসে ছোট্ট হলেও, রাহেবের কাছে এই অমূল্য শিক্ষাটা পেয়ে গিয়েছিল। তাই নিঃশঙ্কচিত্তে বলতে পেরেছিল:
اللهم اكفنيهم بما شئت
আমাদের শিশুদের মধ্যেও এই বোধটা গভীরভাবে চারিয়ে দিতে হবে। 
.
চতুর্থ ভাবনা
একজন দায়ী কেমন হবে? বাধা পেয়ে থেমে যাবে? না তা হবে না। শত বাধা পেলেও দাওয়াত চালিয়ে যেতে হবে। ঘটনা পড়ে জানা যায়, বারবার হত্যাপ্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পরও, বালক রাজার কাছে ফিরে এসেছে। জান নিয়ে পালিয়ে যায় নি। ভয়ে পিছুৃও হটে নি। রাজার দরবারে ফিরে এসেছে। দমে যায় নি। হটে যায় নি। 
.
পঞ্চম ভাবনা
দায়ীর কাজ হলো দাওয়াত দানের সুযোগ তৈরী করা। দাওয়াতের সুযোগ পেলেই কাজ শুরু করা। এমনকি নিজের জীবন দিয়ে হলেও। এটা নবীওলা সুন্নাত। নবীজি সা. কী করেছেন? সাফা পাহাড়ে দাঁড়িয়ে কুরাইশদেরকে আহ্বান করেছেন। মুসা আ. কী করেছেন? সুযোগ পেয়ে বলেছেন:
-তোমাদের নির্ধারিত সময় হলো: উৎসবের দিন। পূর্বা‎েহ্ন লোকজনকে জমায়েত করা হবে (ত্বহা ৫৯)। 
.
বালক কী করলো, তার মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও, দাওয়াতের সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইল না। শুধু সম্ভান্ত শ্রেনী নয়, সাধারন জনগনের মাঝেও দাওয়াতের ফিকির করেছে সে। 
.
ষষ্ঠ ভাবনা
বিজয় বা নসর মানে কী? ব্যক্তির মুক্তি? না, প্রকৃত নসর-বিজয় মানে, চিন্তা-মতবাদ ও মূল্যবোধের বিজয়। নির্দিষ্ট কোনও ব্যক্তি বা দলের নসরকে প্রকৃত নসর বলা যায় না। বালকটি চাইলে নিজের মুক্তি ও বিজয় নিশ্চিত করতে পারতো। কিন্তু তা না করে, সবার বিজয়ের কথা ভেবেছে। 
.
এগার নাম্বার আয়াতে প্রকৃত বিজয় বা বড় সফলতা বলা হয়েছে: ঈমান আনা ও সৎকর্ম করাকে। বালকটি সবার জন্যে প্রকৃত সাফল্য নিশ্চিত করতে চেয়েছিল। 
.
সপ্তম ভাবনা
ঘটনার এক জায়গায় ছোট্ট শিশু মাকে অবিচল থাকার পরামর্শ দিয়েছে। ঈমানের ক্ষেত্রে অবিচলতা বড় বেশি জরুরী। এ-ব্যাপারে একটু শিথিলতা দেখা দিলেই সর্বনাশ। দাওয়াতের কাজ করতে গেলে, বিপদ আসবেই। তখন সবর জরুরী। নবীজি তাই বলে গেছেন:
-মানুষ সকালে মুমিন থাকবে, বিকেলে কাফের হয়ে যাবে। বিকেলে মুমিন থাকবে, সকালে কাফের হয়ে যাবে। দুনিয়ার সামান্য প্রাপ্তির বিনিময়ে সে তার দ্বীনকে বিকিয়ে দেবে (মুসলিম)। 
বিপদের মুহূর্তে অন্তরের ঈমান ঠিক রেখে, মৌখিকভাবে কুফুরিবাক্য উচ্চারণ করা জায়েয আছে। নির্যাতন থেকে বাঁচার জন্যে। তবুও হিম্মত থাকলে, নির্যাতনের মুখোমুখি হওয়া ভাল। 
.
অষ্টম ভাবনা
সূরা বুরুজ মক্কী সূরা। মক্কার মুসলমানরা চরম নির্যাতনের শিকার হচ্ছিলেন। এই সূরা নাযিল করে, আল্লাহ তা‘আলা মুমিনগনের হিম্মত বাড়াতে চাইলেন। সাহসী বালকের ঘটনার দিকে ইঙ্গিত করে, সবরের তালকীন দিলেন। বিপদে টলে না যাওয়ার সবক দিলেন। 
আমরাও বর্তমানে এই সূরা থেকে শিক্ষা নিতে পারি। রোহিঙ্গা ভাইরা পারেন। হালাবী ভাইয়েরা পারেন। কাশ্মীরি ভাইয়েরা পারেন। আল্লাহ তা‘আলার শিক্ষাদান পদ্ধতির দাবিও এটা। তিনি এভাবেই নবীজি সা. ও সাহাবায়ে কেরামকে গড়ে তুলেছেন। মক্কায় অবতীর্ণ হওয়া আয়াত ও সূরাগুলো নাযিল হওয়ার ধারাবাহিকতা খেয়াল করলে, বড় আজীব চিত্র ফুটে ওঠে! আল্লাহ তা‘আলা কিভাবে ধীরে ধীরে শিক্ষিত করে তুলেছেন। ঈমানে। আকীদায়। হিম্মতে। সবরে। সাহসিকতায়!
.
নবম ভাবনা
সতের নাম্বার আয়াতে, ফিরআওন ও সামূদ জাতির দিকে ইশারা করে বোঝানো হয়েছে, এত শক্তিশালী জাতি হয়েও তারা আজ কোথায়? হে রাশা! হে বাশার! হে আমেরিকা! সূরা বুরূজে তোমাদের কথাই বলা হয়েছে। সাবধান হয়ে যাও!
.
দশম ভাবনা
তবে হাঁ, যত কঠিন পরিস্থিতিই হোক, আত্মহত্যা করা যাবে না। নিজের সাধ্য অনুযায়ী শত্রুর মোকাবেলা করে যাবে। আল্লাহর কাছে সাহায্য কামনা করবে। হিম্মত করে শত্রু থেকে অস্ত্র ছিনিয়ে নেবে। বালকটিও আগাম মৃত্যু কামনা করেনি। 
.
এগারতম ভাবনা;
সবকিছুই ওস্তাদের কাছে শিখতে হয়। একা একা শেখা ‘ফিতরাতবিরোধী’ ব্যাপার। এমনকি মন্দ কাজ বা মন্দজ্ঞান হলেও, ওস্তাদ লাগে। বালকের জাদুবিদ্যা শেখা থেকে সেটাই পরিষ্কার হয়ে। ব্যবিলনের দুই ফিরিশতাও জাদুবিদ্যা শিখিয়েছিলেন। 
.
বারোতম ভাবনা:
ভালোমন্দ শিক্ষা একসাথে চলতে পারে। সেটা হতে পারে মন্দ সম্পর্কে জ্ঞান না থাকা অবস্থায়। জানা হয়ে যাওয়ার পর, মন্দশিক্ষা আর গ্রহণ করা যাবে না। বালকও একসাথে জাদু শিখেছিল। পাশাপাশি ঈমানও শিখেছিল। আল্লাহর কাছে কে বেশি প্রিয়,সেটা পরিষ্কার হয়ে যাওয়ার পর, বালক আস্তে আস্তে ঈমানি দাওয়াতের দিকেই ঝুঁকে পড়েছিল। নির্যাতনের মুখে দোয়া-দুরূদই পড়েছিল। মন্ত্রতন্ত্র নয়। 
.
তেরোতম ভাবনা
দাওয়াত দিতে গেলে, অনেক সময় অলৌকিক ঘটনা ঘটতে পারে। কারামাত প্রকাশ পেতে পারে। যেমনটা বালকের ক্ষেত্রে হয়েছে। তবে দায়ী এসবকে গুরুত্ব না দিয়ে আপন কাজ চালিয়ে যাবে। 
.
ষোলতম ভাবনা
যাচাই-বাছাই করেই ওস্তাদ গ্রহণ করা উচিত। বালক দুই ওস্তাদের মাঝে তুলনা করে আল্লাহর কাছে সাহায্য চেয়েছিল। কে বেশি ভাল, সেটা নিশ্চিত হতে চেয়েছিল।
.
সতেরতম ভাবনা 
একজন দায়ী একা একা কাজ করবে না। একজন অভিজ্ঞ মুরুব্বীর অধীনেক কাজ করাই ভাল। বালক তাই করেছে। নিয়মিত ওস্তাদের সাথে পরামর্শ করেছে। 
আঠারতম ভাবনা
সবকিছু আল্লাহই করেন। বান্দা কিছুই করতে পারে না। এই বিশ্বাস রাখা। অন্যদের মাঝেও এই বিশ্বাসের প্রসার ঘটানো। বালক রাজা ও জনগনকে এটাই বোঝাতে তৎপর ছিলো। 
.
উনিশতম ভাবনা
একজন দায়ী আল্লাহর রাস্তায় দাওয়াত দানের বিনিময়ে কোনও প্রতিদানের আশা করবে না। নির্লোভ থেকে কাজ করে যাবে। 
.
বিশতম ভাবনা
দায়ীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হবে: আল্লাহর প্রতি ঈমান। তারপর আল্লাহর কাছে দু‘আ। এই দুই গুণ না থাকলে, পূর্ণতা আসবে না। 
.
একুশতম ভাবনা
যালেম শাসকরা সাধারণত বেকুবই হয়ে থাকে। পাশাপাশি তারা নির্দয়ও হয়ে থাকে। রাজ ভেবেছিল, সেই রোগীকে আরোগ্য দান করে। অন্য কেউ নয়।
.
বাইশতম ভাবনা
নিজের মতে না চললে, যালেমের শেষ অস্ত্র হলো যুলুম-নির্যাতন করা। ভয় দেখানো। ত্রাসের সঞ্চার করা। চাপ প্রয়োগ করে মানুষের টুটি চেপে ধরা। গণহারে হত্যা করা। হকের আওয়াজ বুলন্দকারীর আওয়াজকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়া। 
.
তেইশতম ভাবনা
দায়ী যখন দু‘আ করেন, আল্লাহ সেটা কবুল করেই নেন। বালকের দু‘আও আল্লাহ কবুল করেছেন।