সোমবার, ২৭ জুন, ২০১৬

স্মৃতিমাখা গালিচা! Atik Ullah Atik

ঘটনাটা কয়েক দশক আগের। নিকোলাস ফিলিপ। একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা। থাকেন প্যারিসের অভিজাত এলাকায়। সদ্য চাকুরি থেকে অবসর নিয়েছেন। চাকুরিজীবন শেষ হওয়ার কিছুদিনের মাথায় স্ত্রী মারা গেছেন। বিপত্নীক হওয়াতে এখন তিনি ঝাড়া হাত-পা। একটি কন্যা সন্তানের জনক। মেয়ে অলিভিয়া বেশ ভাল। কাজেরও। বাবাঅন্তপ্রাণ। 
-
চাকুরির শেষ দিকে মশিয়ে ফিলিফি মাগরিব বা মরক্কো নিয়ে পড়াশোনা করা শুরু করেছিলেন। পরিবারের সদস্যদের কৌতূহলের অন্ত নেই! তিনি এতকিছু ফেলে মরক্কো নিয়ে পড়লেন? মশিয়ে ফিলিপ সবাইকে বুঝ দিয়েছেন:
-আমি তরুণ বয়েসে সেখানে ছিলাম না! আমার প্রথম পোস্টিং মরক্কোতেই ছিল, সেটা ভুলে গেলে চলবে কেন!
-
বিশ শতকের গোড়ার দিকেই মরক্কোতে ফরাসীদের আনাগোনা শুরু হয়েছিল। ১৯১২ সালে আনুষ্ঠানিক সামরিক আগ্রাসন শুরু হয়েছিল। ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত মরক্কোতে ফরাসি উপনিবেশ ছিলো। আলজেরিয়া ও মরক্কোতে ফরাসিদের একটা চোখ সব সময় ‘বারবার’ জনগোষ্ঠীর প্রতি নিবদ্ধ ছিল। আরবীতে এদেরকে ‘আমাযীগ’ বলা হয়। 
আফ্রিকা ও স্পেনে ইসলামি হুকুমত বিস্তারের ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা ছিল ‘আমাযীগ’দের। তারিক বিন যিয়াদ রহ., ইউসুফ বিন তাশাফীন রহ., বিশ্বের সর্বপ্রথম বিমানের চিন্তার উদ্ভাবক আব্বাস বিন ফিরনাস, ইবলে খালদুন, ইবনে বতুতা, ফরাসীবিরোধী মহান মুজাহিদ আবদুল করীম খাত্তাবী ও মহান মুজাহিদ আল্লামা আবদুল হামীদ বাদীস রহ. প্রমুখ ছিলেন এই জাতিগোষ্ঠীর। 
-
নিকোলাস ফিলিপ তার গবেষণা কাজে সহযোগিতার জন্যে একজন সহকারী খুঁজছিলেন। ফরাসি জানে পাশাপাশি মরক্কোর বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষাও জানে এমন! স্ত্রী মারা যাওয়ার পর বেশ নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছেন। তাই মরক্কোর নেশার প্রতি আরো বেশি ঝুঁকে পড়েছেন। 
বাবাকে দিনরাত এই একটা বিষয় নিয়ে পড়ে থাকতে দেখে অলিভিয়া বেশ অবাক হলো। বাবা একজন উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা। তার মতো লোকেরা অবসর নেয়ার পর কতো সুন্দর করে জীবন কাটায়! তিনি কি না, এক অপরিচিত দেশ নিয়ে মেতেছেন! বলি বলি করে সুযোগ মেলে না। স্বামীসন্তানসহ বাবার বাসারই উপরতলার ফ্ল্যাটেই থাকে অলিভিয়া। এক ছুটির দিনে মশিয়ে ফিলিপ মেয়েকে কল করলেন:
-বাবা কিছু বলবে?
-হ্যাঁ, একটা কিছু বলার জন্যেই তোকে ডাকা! আমি তোকে একটা চাবি দিয়েছিলাম। ব্যাংক-লকারের! কোথায় সেটা?
-আছে, আমার কাছেই! তোমার কথামতো আমি কাউকে সেটার কথা জানাইনি! এমনকি মাকেও না। 
-খুব ভালো করেছিস! চাবিটা এখন লাগবে! 
-এত গোপন করে, এমনকি মাকেও লুকিয়ে কী রেখেছিলে লকারে? আমাকে বলা যাবে? 
-তোকে না বললে আর কাকে বলবো মা! সরাসরিই বলি, তোর মা আমার বিয়ে করা প্রথম স্ত্রী নয়!
-কী বলছ আব্বু তুমি! 
-হ্যাঁরে! সত্যি বলছি! সেটা আমার জীবনের এক অন্যরকম অধ্যায়! অন্ধকারও বলতে পারিস, আলোময়ও বলতে পারিস! 
-মাকে জানিয়েছিলে?
-জানাতে চেয়েছিলাম! কিন্তু মন আগায়নি! আর তখন পরিস্থিতি এমন হয়ে গিয়েছিল, জানানোর মতো কিছু ছিল না বা জানানোর মতো পরিস্থিতি ছিল না। কারন আমি সেই ঘটনাকে ভুলে থাকার চেষ্টা করতাম প্রাণপণে। কিন্তু আজকাল মনে হয়, তোর মাকে জানালেই ভাল করতাম! মনে করেছিলাম সব ভুলে গেছি! সম্পর্ক চুকেবুকে গেছে! এখন দেখছি, কিছুই মুছে যায়নি! আমি যে অন্যায় করেছি, সেটার প্রায়শ্চিত্ত করা ছাড়া আমার মুক্তি নেই। 
-আব্বু তুমি সব শুরু থেকে খুলে বলো! 
-চাকুরিজীবনের শুরুতেই আমার পোস্টিং পড়লো আলজেরিয়াতে। সেখান থেকে কিছুদিন পর পাঠিয়ে দেয়া হয় মরক্কোতে। সেখানে স্বাধীনতা আন্দোলন তখন তুঙ্গে। দমন করার জন্যে রিজার্ভ ফোর্স প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ বুঝতে পেরেছিল, মাগরিব অঞ্চলকে আর বেশিদিন ধরে রাখা যাবে না, তাই বাইরে আন্দোলন দমনের চেষ্টা করলেও ভেতরে ভেতরে এই অঞ্চল ত্যাগ করার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছিল। এজন্য কিছু কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল:
ক: স্থানীয় শিল্পগুলোকে যথাসম্ভব পঙ্গু করে দিয়ে যাওয়া। 
খ: সমাজের বিভিন্ন স্তরে ফরাসি চিন্তাধারা গভীরভাবে প্রোথিত করে দিয়ে যাওয়া!
গ: শিক্ষাব্যবস্থা ও শিল্পসাহিত্যকে পুরোপুরি ফরাসীদের তাবে করে দিয়ে যাওয়া! 
ঘ: একটা নতজানু সরকার ও পদলেহী সেনাবাহিনী তৈরী করে দিয়ে যাওয়া!
ঙ: যেখানে যত মূলবান পুরাকীর্তি আছে, সংগ্রহ করে নিয়ে আসা। 
-
স্বাধীনতা যুদ্ধে আমরা বেশি ভয় করছিলাম বারবারদেরকে। তারা বেশ স্বাধীনচেতা ও যুদ্ধবাজ! এ-ব্যাপারে আমাদের সহযোগিতায় স্পেনিশ সেনাবাহিনীও কাজ করেছে। বারবারদের ব্যাপারে তাদের অভিজ্ঞতা আমাদের চেয়ে বেশি! 
-
আমাদের দলের দায়িত্ব পড়েছিল এক বারবার অঞ্চলে। ওই এলাকাটা ছিল ‘হাতেবোনা গালিচার’ জন্যে বিখ্যাত। পুরো অঞ্চলের মহিলারা সারাদিন বসে বসে গালিচা বুনতো। অত্যন্ত দামী আর দুর্লভ এক শিল্প সেটা। হাজার বছর ধরে আমাযীগ নারীরা এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রেখেছে। চর্চা করে এসেছে। নিপুণতার চুড়ান্তশিখরে পৌঁছে দিয়েছে। 
-
আমরা এলাকায় শিবির স্থাপন করেই কাজ শুরু করে দিলাম। পুরো গ্রাম কর্ডন করে চিরুনি অভিযান চালালাম। বিভিন্ন গ্রামে অভিযান চালানো হলো। অঞ্চলটা আপাতত বিদ্রোহের শংকামুক্ত হলো। নিয়মিত টহলে থাকলো সেনাদল। আমাদের অফিসার ছিলেন ধুরন্ধর ব্যবসায়ী বুদ্ধির অধিকারী! তিনি দেখলেন, এখানকার গালিচা বেশ সুন্দর! বাইরের ব্যবসায়ীরা গ্রামের বাজার থেকে কিনে নিয়ে যায়। অফিসার কায়দা করে বাইরের পাইকারদের আসা বন্ধ করলেন। ক্ষুদ্র কুটিরশিল্পীদের মাথায় হাত! বিক্রি করতে না পারলে খাবে কী? কিছুদিন এই অচলাবস্থা থাকলো। অবস্থা যখন সঙ্গীন আকার ধারণ করলো, তখন অফিসার তার খোলস ছেড়ে বের হলেন। তিনি প্রস্তাব দিলেন:
-নিরাপত্তাজনিত কারণে আমরা বাইরের লোককে এখানে আসতে দিতে পারি না, আবার তোমরাও বাইরে গেলে বিদ্রোহীদের সাথে যোগ দেয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়! তার চেয়ে বরং এক কাজ করা যাক, তোমাদের গালিচা আমরাই বড় পাইকারদের হাতে পৌঁছে দেবো! 
গ্রামবাসী খুশি! এতো সাধু প্রস্তাব! শুরু হলো গালিচা সংগ্রহ করা! আমরা নামমাত্র মূল্য দিয়ে গালিচা সংগ্রহ করে সব বাক্সবন্দী করে প্যারিসের বাজারগুলোতে পাঠাতে শুরু করলাম। আশাতীত মুনাফা আসতে শুরু করলো। অফিসারের লোভ শতগুণ বৃদ্ধি পেলো। আমরাও তার ছিঁটেফোঁটা ভাগ পেতে লাগলাম। 
-
নিয়মিত গালিচাসংগ্রহে যেতে যেতে গ্রামের মানুষের সাথে একধরনের সখ্যতা গড়ে উঠলো। মধ্যস্বত্বভোগীদের থেকে বাঁচার জন্যে আমি সেপাই নিয়ে নিজেই বাড়ি বাড়ি গিয়ে সংগ্রহ করে আনতাম! একটা বাড়ির গালিচার কথা সবাই বেশ প্রশংসা করতো, কিন্তু এখন পর্যন্ত ওবাড়ি থেকে একটা গালিচাও আমাদের হাতে আসেনি! খোঁজ নিয়ে জানা গেলো, তারা আমাদের কাছে গালিচা বিক্রি করতে আগ্রহী নয়। ব্যাপারটা আমাদের সামরিক মেজাযের সাথে মানানসই নয়!
-
সিদ্ধান্ত হলো তারা স্বেচ্ছায় বিক্রি করতে রাজি না হলে জোর-জবরদস্তি করে বিক্রি করাতে বাধ্য করতে হবে। বেশি তেড়িবেড়ি করলে সব গালিচা বাজেয়াপ্ত করা হবে। আমাদের একজন স্থানীয় ইনফর্মার ছিল, সে ইশারা-ইঙ্গিতে এমন করতে নিষধ করলো, সে বললো:
-ঘরে তিনজন মহিলা থাকে। ঘরে কোনও পুরুষ নেই। বৃদ্ধা দাদী, একজন মধ্যবয়স্ক মহিলা ও এক তরুনী। আমাযীগ মহিলারা কড়া পর্দানশীন না হলেও, এই পরিবার ভালভাবে পর্দা মেনে চলার চেষ্টা করে। দয়া করে তাদেরকে ছেড়ে দিন! 
-নাহ, ছেড়ে দেবো কেন? অন্যদের কাছে বিক্রি করলে, আমাদের কাছে বিক্রি করতে সমস্যা কোথায়?
-
আমি তার কোনও যুক্তি বা অনুনয়ের ধার না ধেরে একাই সে বাড়িতে উপস্থিত হলাম। সাথে আসা সেনাদেরকে অন্যদিকে পাঠিয়ে দিলাম। আগাম সংবাদ দেয়া ছাড়া, আচানক ঘরের আঙিনায় হাজির হয়ে বেশ অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। তিনবয়েসী তিনজন মহিলা একমনে কাজ করে চলছে! আমাকে দেখে তারা এতবেশি অবাক-বিহবল হয়ে পড়লো, প্রথমে ঠাহর করে উঠতে পারলো না কী করবে! পরক্ষণেই সাথে সাথে ওড়না দিয়ে ভাল করে মুখ ঢেকে জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকলো! ভাবটা এমন: তিনটা শামুক, বাধা পেয়ে খোলসের মধ্যে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে!
তাদের এই অবস্থা দেখে আমার মনে কী যে হয়ে গেলো, আজও এর রহস্য বের করতে পারিনি! শুধু মনে হয়েছে: আমার এখানে আসা ঠিক হয়নি! আমার এভাবে দাঁড়িয়ে থাকা সুরুচির পরিচায়ক নয়। দুঃখিত বলে বেরিয়ে এলাম। সরাসরি ক্যাম্পে চলে এলাম। মাথায় তখন তিনজন অসহায় নারীর করুন চাহনি ঘুরছে! যেন মিনতি করছে: আমাদের দ্বারা আপনার কোনও ক্ষতি হবে না। আমরা দুর্বল! শুধু তরুনির দৃষ্টিতেই শেষের দিকে একধরনের রাগ ফুটে উঠেই মিলিয়ে যেতে দেখেছি! এতসব ঘটে গেছে কয়েক মুহূর্তে!
-
ইনফর্মারকে একান্তে ডেকে পাঠালাম। আমার মন অবিশ্বাস্যভাবে ও-বাড়ির সাথে লেগে আছে। খবর পেয়েই সে ছুটে এল:
-তুমি ওই পরিবার সম্পর্কে কী জানো বলো তো!
-যা জানি সে তো সকালেই বলেছি! স্যার! 
-আমি ওদের সাথে সরাসরি কথা বলতে চাই! ব্যবস্থা করতে পারবে!
-জ্বি! পারবো! কিন্তু কেন স্যার! ওরা বলেছে একান্তই না মানলে, তারা গালিচা বিক্রি করে দিবে! 
-না না, গালিচা নয়, আমি ওদের কাছে একটু দুঃখ প্রকাশ করতে চাই! 
-কী বলছেন স্যার! আপনি ক’জন অসহায় মহিলার কাছে দুঃখ প্রকাশ করবেন? আপনি তো কোনও অন্যায় করেননি! অন্যবাড়িতেও এভাবে যান! 
-তা হোক, তুমি আগামীকাল তাদের কাছ থেকে একটা সময় ঠিক করে নিও!
-
পরদিন তরুন ল্যাফটেনেন্ট যথাসময়ে হাজির হলেন। তাকে জানানো হলো: মহিলারা আত্মীয় ছাড়া আর কারো সামনে আসেন না। আড়াল থেকেই ক্ষমাপর্ব সমাপ্ত হলো। বারবার রীতিতে আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা হলো। প্রতিবেশি ছোট মেয়েরা এটাসেটা এনে দিল। বিদায়ের সময় ইনফর্মার একটা সুন্দর থলে ল্যাফটেনেন্টের হাতে তুলে দিল:
-কী আছে এতে! 
-একটা গালিচা স্যার! 
-কতো দিতে হবে এটার জন্যে?
-কিছুই দিতে হবে না, আপনার ভদ্রতায় তারা খুবই খুশি হয়েছেন! আর বারবার রীতিতে বাড়িতে মেহমান এলে কিছু একটা উপহার দিতে হয়, তাদের ঘরে দেয়ার মতো কিছুই নেই। আপনারা এখানে আসার পর, এ-বাড়ির কর্তা এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন! তারা এখন কোনও রকমে দিন গুজরান করছে!
-নাহ, আমি এমনি এমনি গালিচা গ্রহণ করবো না! কিছু একটা বিনিময় গ্রহণ করতে হবে!
-দুঃখিত স্যার! তাহলে মেজবানকে অপমান করা হবে! তারা দিলে চোট পাবেন!
-
আলিভিয়া! তুই বিশ্বাস করবি না, ক্যাম্পে এসে ব্যাগ খুলে দেখি: এক অপুর্ব গালিচা! কী নকশা! কী কারুকাজ! কী নৈপুণ্য! কী নিখুঁত কাজ! এসব গালিচা বাজারে বিক্রি হয় না। বাজারেরগুলোর কাজ এত নিখুঁত আর সমৃণ হয় না। অনেকদিন ধরে গালিচার কারবার করতে করতে অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে! 
-আব্বু! তোমার লকারে কি সেই গালিচাই রেখেছ!
-জ্বি। আরো কিছু অমূল্য জিনিস আছে, খুললেই দেখতে পাবি!
-
প্রথম সাক্ষাতেই একজন ভিনদেশী শত্রুকে গালিচা উপহার দেয়া কম কথা নয়। একেকটা গালিচা বানাতে মহিলাদের কতো সময় যে লাগে! আমার মনে হলো, তারা এত সুন্দর একটা উপহার দিল, আমাকেও কিছু একটা দিতে হবে! আবার ইনফর্মারের সাহায্য নিলাম, সে জানাল:
-তারা যাতে গালিচা বিক্রি করে ন্যায্য দামটা পায়, সেটা নিশ্চিত করলেই তাদের সবচেয়ে বড় উপকার হবে! 
-তা তো করবোই! এ ছাড়া আর কী করা যেতে পারে?
-আচ্ছা আমি জেনে নিয়ে আপনাকে জানাব!
-
তারা কিছুই নিতে রাজী হলো না। কিন্তু আমার মন তা মানবে কেন! আমি একবার মেয়েটার সাথে কথা বলার অনুমতি চাইলাম। বলা হলো: এক প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে কোনও অপরিচিত পুরুষের সামনে যেতে পারে না। ইসলাম এটার অনুমতি দেয় না। ব্যাপার আমার হজম করতে কষ্ট হলো। আফ্রিকা যাওয়ার আগে অবশ্য আমাদেরকে এসব বিষয় বিস্তারিত জানানো হয়েছিল। তবুও আমরা যেভাবে বেড়ে উঠেছি, তার বিপরীত একটা প্রথা মানতে কষ্ট হয় বৈকি! আমার ধারণা ছিল: আমি একজন অফিসার! তার ওপর বিজয়ী শক্তি! আমি কোনও মেয়েকে ডেটিংয়ের প্রস্তাব দিলে, সানন্দে মেনে নিবে! এখন দেখি ভিন্নচিত্র!
-
তাদের অনাগ্রহে আমার আগ্রহ আরও তুঙ্গে উঠে গেলো। যেভাবেই হোক এই পবিরারের সাথে আমার একটা পরিচয়সূত্র কায়েম করতেই হবে। তখন থেকেই মরক্কো নিয়ে পড়াশোনার আগ্রহ তৈরী হয়। 
ইনফর্মারের মাধ্যমে আরও কয়েকবার প্রস্তাব পাঠালাম। আমি দেখা করতে চাই! আমাতে অবাক ও হতাশ করে দিয়ে, প্রতিবারই একই জবাব এল। স্বাভাবিক অবস্থায় অন্য কেউ হলে জোর খাটাত! আমিও হয়তো তাই করতাম! কিন্তু কেন যে মন সায় দিচ্ছিল না, বুঝতে পারিনি! আজো না। আমার মাথায় তখন খুন চেপে গেছে! যে করেই হোক, তার সাথে দেখা করতে হবে। কথা বলতে হবে। এভাবে কেউ কাউকে প্রত্যাখ্যান করে! 
-
ইনফর্মারকে বললাম: 
-যে করেই হোক আমাকে তার সাথে দেখা করিয়ে দাও! আমার মান-ইজ্জতের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে!
-স্যার আমি চেষ্টা করতে পারি! না হলে আপনি ক্ষমতা দেখিয়েই উদ্দেশ্য হাসিল করতে পারেন!
-আরে সেটা হলে তো কবেই হাসিল করে ফেলতাম! আমি জোরাজুরি করতে চাই না!
-তাহলে স্যার, ইহজীবনেও সেটা সম্ভব হবে না। কারন বাধাটা মেয়ের পক্ষ থেকে নয়, মেয়ের ধর্মের পক্ষ থেকে। তার ধর্মের দৃষ্টিতে আপনি বেগানা পুরুষ! আপনার সাথে দেখা দেয়া বা কথা বলা তার জন্যে হারাম! তবে এটুকু হয়তো করা যেতে পারে! আপনি তার সাথে আড়াল থেকে কথা বলবেন!
-না, আমি তার সাথে মুখোমুখি হয়ে কথা বলতে চাই!
-এমন হলে একটাই পথ খোলা থাকে!
-কী সেটা বলো! যত টাকা লাগে আমি খরচ করব! 
-টাকা নয়, বিয়ে! 
-বিয়ে?
-জ্বি স্যার! আপনার সাথে বিয়ে হলে তখন তার সাথে আপনার দেখা হওয়ার সম্ভব! 
-তাহলে সেটার ব্যবস্থা করো!
-কিন্তু আপনার সাথে বিয়েও সম্ভব নয়! কারণ আপনি অমুসলিম! 
-আচ্ছা! আমি মুসলিম হলেই সমস্যার সমাধান হবে!
-তারপরও সমস্যা থাকবে! তার পরিবার একজন ভিনদেশীর কাছে বিয়ে দেবেন কি না! আপনি আজ আছেন তো কাল নেই! আপনার কাছে বিয়ে দিলো! কিন্তু আপনি তাকে রেখে চলে গেলেন, তখন? অতীতে এমন ঘটনার নজীর আছে!
-আচ্ছা তুমি তাদের সাথে বিষয়টা নিয়ে কথা বলো! আমিও একটু ভেবে দেখি!
-
-আব্বু তুমি এতকিছু করছো, তোমার সহকর্মীদের কেউ টের পায়নি? 
-এতকিছু কোথায়? আমি তো শুধু তার সাথে কথা বলার বা দেখা করার চেষ্টা করছিলাম! এছাড়া সব কাজতো ঠিকঠাক মতো চলছিল! আমরা আমাদের এলাকায় কোনও মিটিং-মিছিল হতে দেইনি! এদিকে গালিচার রপ্তানীর ব্যবসাও বেশ রমরমা! শুধু এই ‘কেসেই’ যা একটু ফেঁসে গিয়েছিলাম! আমার পৌরূষে বেশ ঘা লেগেছিল বলতে পারিস! 
-তারপর!
-তারপর আরকি! অনেক ঝুলোঝুলির পর, মেয়ে রাজি হলো! কিন্তু মেয়ে তার বাবার অনুপস্থিতিতে বিয়ে করবে না। মেয়ের বাবা আত্মগোপনে আছে। আবার এদিকে আমার ক্যাম্পেও বিয়েটা গোপন রাখতে হবে! মেয়ের বাবা রাজি হন কি না, সেটা নিয়েও সন্দেহ! তবে আশার কথা, মেয়ের দাদীর সাথে কথা বলার সুযোগ হয়েছে। তিনি নিমরাজি! 
-
সব কথা বলতে গেলে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হবে। সবকিছু গুছিয়ে বিয়ে হলো। বিয়ের আগে আমাকে বুঝিয়ে দেয়া হলে: শুধু বিয়ের জন্যেই মুসলমান হওয়া ঠিক নয়। আমাকে মনেপ্রাণে মুসলমান হতে হবে। মেনে নিলাম। বহুল কাঙ্খিত প্রথম সাক্ষাত হলো। আমি কল্পনার চেয়েও বেশি অভিভূত হয়ে পড়লাম তাকে দেখে! তার ভদ্রতা সৌজন্যবোধ দেখে। আমার প্রতি ওর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসামাখা আচরণ দেখে। আদর-যত্ন দেখে। 
আমি অত্যন্ত সতর্কতার সাথে তার সাথে দেখা করতে যেতাম। কারণ আমি যা করেছি, তার জন্যে আমাকে চর আখ্যা দিয়ে, কোর্ট-মার্শাল হওয়াও বিচিত্র কিছু ছিল না। সবাইকে লুকিয়ে কয়েকমাস আমাদের দেখা-সাক্ষাত চললো। তবুও এসব খবর গোপন থাকে না। আমার উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ পুরোপুরি ধরতে না পারলেও আমার গতিবিধিতে সন্দেহজনক কিছু আঁচ করতে পারলেন। আমার কমান্ডিং অফিসার ডেকে নিয়ে সরাসরি সতর্ক করলেন। 
-
তবুও ‘ইয়ামনার’ আকর্ষণ ছিল দুর্নিবার! আমি ফাঁক পেলেই তার কাছে ছুটে যেতাম। এদিকে মরক্কোতে আমাদের অবস্থান দিনদিন নড়বড়ে হয়ে আসছিল! কর্তৃপক্ষের কানে বোধহয় নির্ভরযোগ্য সূত্রে কোনও তথ্য গিয়েছিল। তারা একদিন আমাকে নিয়ে বসলেন। তীব্র জেরার মুখে পড়লাম। বিয়ের কথা না বললেও একপ্রকার সম্পর্কের কথা স্বীকার না করে পারলাম না। পুরোদেশের টালমাটাল পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে, আমার বিরুদ্ধে কঠোর কোনও ব্যবস্থা নেয়া হলো না। তবে সুনির্দিষ্ট কিছু অভিযোগ ফাইলবন্দী করা হলো। আমাকে কোনও সুযোগ না দিয়ে, সেই বৈঠক থেকেই আলজেরিয়াতে পাঠিয়ে দেয়া হলো। বলে দেয়া হলো:
-যদি কখনো মরক্কোতে আসি এবং এখানকার সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করি, আমাদের উভয়ের প্রাণসংশয় দেখা দিবে! এটা ফ্রান্সের সম্মান ও নিরাপত্তার স্বার্থেই করতে হবে! 
-
আমাকে কড়া নজরদারিতে রাখা হলো। একটি মুসলিম মেয়ের সাথে সম্পর্কের ‘অপরাধে’ ব্যাজ-র‌্যাংক কেড়ে নেয়া হলেও, বিশেষ বিবেচনায় ফেরত দেয়া হলো। গোপন সূত্রে জানতে পেরেছিলাম: মরক্কোর হাইকমান্ড আরও তদন্ত চালিয়েছিল। তারা সূত্র ধরে ধরে ‘ইয়ামনা’ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। তার বাবার সাথে বিদ্রোহীদের সংযোগও আবিষ্কার হয়ে পড়েছিল। এসব ঝামেলার মুখে তারা নিজগ্রাম ত্যাগ করে অজ্ঞাত কোনও নিরাপদ স্থানে সরে পড়তে সক্ষম হয়েছিল। এর বেশি কিছু উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি! 
-
ফ্রান্সে ফিরে কোনও উপায়ান্তর না দেখে, নিজেকে পরিস্থিতির হাতে ছেড়ে দিলাম। কর্তৃপক্ষের চাপে বিয়েও করতে হলো। মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স আমার ব্যাপারটাকে সিরিয়াসভাবে নিয়েছিল। তাদের বজ্রআঁটুনি ফস্কে নিজের মতো করে বাঁচার সুযোগ ছিল না। আমি দেখলাম বিয়ে করাই সবদিক থেকে যুক্তিযুক্ত। আমাদের উভয়ের জন্যে নিরাপদ। সময়ের সাথে সাথে দগদগে ঘা শুকিয়ে এলো। তবে একেবারে মুঝে গেলো না। আমাকে দেয়া ইয়ামনার গালিচা ও কয়েকটা অপূর্ব হাতের কাজ করা শোপিস আমার কাছেই রয়ে গেলো। স্বপ্নময় অতীতের একচিলতে স্মৃতি হিশেবে!
-আব্বু! তার কথা তোমার মনে পড়তো না! 
-অবশ্যই পড়তো। কিন্তু কাউকে বলার উপায় ছিল না। তাই বলে মার্থাকে আমি বিন্দুমাত্র অবহেলা করিনি। তাকে আমি শতভাগ স্ত্রীর মর্যাদায় রাখার চেষ্টায় কোনও কমতি করিনি। আর তোর মাও ছিলো এক অসাধারণ মানুষ! তার গভীর অনুরাগ আমাকে সাময়িকভাবে পেছনের কথা ভুলে থাকতে সহযোগিতা করেছে, এটা অস্বীকার করবো না! কিন্তু প্রথম ভালোলাগাকে তো ভোলা অসম্ভব! আর সে আমার বিয়ে করা বৈধ স্ত্রী! পবিত্র। কোমল। গভীর। দৃঢ়চেতা। সাহসী। দায়িত্বশীল। কর্মঠ। গুণী। 
-
-এখন কী করবে?
-করার মতো অনেক কিছুই আছে! কিছুদিন আগে আমি গোয়েন্দাদের লুকিয়ে, প্যারিসের এক মসজিদে গিয়েছিলাম। 
-কেন?
-কনফেশন করতে! 
-তারা জানাল, ইসলাম ধর্মে মানুষের কাছে কনফেশন করার নিয়ম নেই, যা কিছু সরাসরি গডের কাছেই করতে হয়। খ্রিস্টানদের মতো ভায়া লাগে না। তবুও স্বস্তি পেলাম না। খালি মনে হতে লাগলো, আমি ‘ইয়ামনার’ সাথে প্রতারণা করেছি। কিন্তু তুই বিশ্বাস কর, আমি শুধু তার নিরাপত্তার দিকে তাকিয়ে ব্যাপারটা নিয়ে বেশি নাড়াচাড়া করিনি! আমি তার খোঁজ পেয়ে গেলে, ট্রেইল ধরে ধরে গোয়েন্দারাও যদি তাকে ট্রেস করে ফেলে? 
অলিভিয়া! ইমাম সাহেবের একটা কথা আমার কানে বেশ বাজে ! তিনি পুরো ঘটনা শুনে বলেছিলেন: 
-আপনি তো তাহলে একজন মুসলিম! 
-কিন্তু আমি তো সামাজিক পরিচয়ে একজন খ্রিস্টান! আমার দ্বিতীয় বিয়েও খ্রিস্টরীতিতে হয়েছে। কারণে-অকারণে চার্চেও যেতে হয়েছে! তাছাড়া ইসলাম সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। যা কিছু জেনেছিলাম, তার সব ভুলে গেছি! 
-তা হোক! আপনি একজন মুসলিম! আপনি পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসুন! 
-তার আগে আমি একটা কাজ করতে চাই, আমার পূর্বের স্ত্রীর হদিস বের করতে চাই! তারপর আমি বিষয়টা নিয়ে ভাববো! 
-মশিয়ে ফিলিপ! আপনি চাইলে উল্টো করেও দেখতে পারেন! 
-কিরকম?
-আপনি ইসলাম ধর্ম পালন শুরু করে দিন! আল্লাহ তাহলে আপনার কাজকে সহজ করে দিবেন! 
-আচ্ছা ভেবে দেখি!
.
-তুমি একজন লোক খুঁজছিলে, সেটা তাহলে মরক্কো-বিষয়ক গবেষণার জন্যে ছিল না!
-গবেষণাও উদ্দেশ্য ছিল, পাশাপাশি তাকে দিয়ে একটু খোঁজ-খবর করার অভিপ্রায়ও ছিল! 
-অমন কাউকে পেয়েছ?
-না। 
-আব্বু! এক কাজ করলে কেমন হয়! আমিই না হয় মরক্কো চলে যাই! একটু খোঁজ-খবর করে আসি!
-সত্যি বলছিস! তোর যদি আগ্রহ থাকে, তাহলে এটাই সবদিক থেকে নিরাপদ!
-
অলিভিয়া তার অফিস থেকে লম্বা একটা ছুটি নিল। রাবাতে নেমে সরাসরি ফেজ নগরীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিল। ফেজে পৌঁছে, আব্বুর দেয়া স্মৃতিনির্ভর ঠিকানা অনুসারে খোঁজ করা শুরু করলো: গ্রামের নাম কীকু! এটাই সম্বল। কয়েকদিনের চেষ্টা-কসরতে কীকুনামী কয়েকটা গ্রাম চিহ্নিত করা সম্ভব হলো। এবার ঝাড়াই-মাড়াইয়ের পালা। প্রতিদিন লং ডিসটেন্স কলে, বাবার সাথে কথা হয়। তিনিও তার নিজস্ব সোর্স কাজে লাগিয়ে, সে সময়কার ক্যাম্পের জায়গাটা সুনির্দিষ্টভাবে বের করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। 
-
বাপ-বেটির যৌথ প্রয়াসে ঠিক গ্রামটা বের হলো। এবার সরেজমীনে গিয়ে অনুসন্ধানের পালা। অনেক বড় গ্রাম! একজন স্থানীয় গাইডের সাহায্যে গ্রামের মুরুব্বীদের সাথে কথা বলে জানা গেল: এই গ্রামের অদূর একটা অস্থায়ী সেনাছাউনি ছিলো। গ্রামের বাজারের পুরনো গালিচা-ব্যবসায়ীরাও আবছা আবছা স্মৃতিমন্থন করতে সক্ষম হলো। কিন্তু কাঙ্খিত সূত্র পাওয়া গেলো না। হঠাৎ মাথায় ঝিলিক দিয়ে উঠলো: গ্রামের বয়স্কা কোনও মহিলার কাছে খোঁজ নিলে হয়তো একটা বিহিত হতে পারে! কয়েকজনের সাথে কথা বলেও কিছু বের হলো না। একবুড়িমা শুধু বলতে পারলো: নাম ইয়ামনা কি না বলতে পারবো না! তবে অনেক আগে এই গ্রামের একটা পরিবার উত্তর দিকের একটা গ্রামে গিয়ে নতুন করে বসতি স্থাপন করেছে, সেটা মনে আছে। গ্রামের নাম ‘আয়াত হামযা’। 
-
আবার নতুন করে পথচলা শুরু হলো। একে তো ভিনদেশী, তায় ভিনভাষী। তবে ভাগ্য বলতে হবে, বয়স্করা কিছু কিছু ফরাসী বোঝে! গ্রামটা বেশ সুন্দর আর ছিমছাম। গাইড প্রথমেই একটা স্কুলঘরের মতো লম্ব এক ভবনে নিয়ে গেলো। সেটা মূলত ক্ষুদ্রকুটিরশিল্পচর্চাকেন্দ্র। অসংখ্য মহিলা সারিবদ্ধভাবে বসে-দাঁড়িয়ে গালিচা বুনছে! একদল ভেড়ার পশম কাটছে। আরেক দল পশমকে বিশেষ চিরুনির সাহায্যে প্রক্রিয়াজাত করছে। অসংখ্য কাজের ধরন। অলিভিয়ার মনে হলো, কে তার লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। অফিসে গেলো। সেখানে এক যুবক বসে বসে ফাইল দেখছে। অনুমতি নিয়ে ভেতরে গিয়ে বসলো:
-আমি একজন মানুষের খোঁজে এসেছি! একজন মহিলা! নাম ইয়ামনা। 
-আচ্ছা! আপনি কোত্থেকে এসেছেন?
-ফ্রান্স থেকে! ইয়ামনা নামে কাউকে চেনেন? 
-জ্বি, চিনি! তার কাছে আপনার কী প্রয়োজন? তার নামই বা জানলেন কী করে? (যুবকের চেহারায় ভীষণ বিস্ময়!)
অলিভিয়া ব্যাগ্রস্বরে জানতে চাইল:
-সত্যি সত্যি তাকে চেনেন! আমাকে তার কাছে নিয়ে চলুন!
-
অলিভিয়ার বিশ্বাস হচ্ছিল না এত সহজেই মিলে যাবে। যুবক তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চললো। ঘরে প্রবেশ করে ছেলেটা জোরে আম্মু বলে ডাক দিল। অলিভিয়ার মনে ভাবান্তর সৃষ্টি হলো, তবে কি এই যুবক তার সন্তান? তার আবার বিয়ে হয়েছিল! এসব ভাবনার মাঝেই একজন মধ্যবয়স্কা মহিলা এলেন। দেখে অজান্তেই অলিভিয়া দাঁড়িয়ে গেলো। তার দু’চোখ নির্ণিমেশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, মধ্যময়েসেও মানুষ এত সুন্দর হয়! ইনিই কি তিনি? 
-আমি অলিভিয়া! ফ্রান্স থেকে এসেছি! 
-আমি বুঝতে পেরেছি! আমার অনুমান যদি ভুল না হয়, তোমাকে কেউ একজন পাঠিয়েছে, ঠিক আছে না?
-কিভাবে বুঝলেন?
-ওইযে বললাম অনুমান! ঠিক কি না বলো!
-একদম ঠিক! আমার আব্বু পাঠিয়েছেন। 
মহিলা এবার এসে গভীর আবেগে অলিভিয়াকে জড়িয়ে ধরলেন। অনেকক্ষণ ধরে থাকলেন। ঝাপসা চোখে অলিভিয়াকে পরম আদরে চুমু দিলেন। প্রায় কোলে করে নিয়ে সোপায় বসালেন। তারপর শুরু হলো কথাবার্তা। অলিভিয়া সবকিছু খুলে বললো বাবার অসহায়ত্বের কথা, সরকারী গোয়েন্দাদের নজরদারির কথা! 
-আমি তো সব বললাম, আমি এসেছি আপনাকে দেখতে। আপনার কথা শুনতে!
-আমার কথা আর কী শুনবে! বলার মতো তেমন কিছুই নেই! 
-তবুও শুনবো! বলূন!
-এখন থাক! তুমি এতদূর থেকে এসেছ! বিশ্রাম করো। খাওয়া-দাওয়া করো! রাতে বসবো! আর হাঁ, ও তোমার ভাই! মা ভিন্ন হলেও বাবা এক! 
-তাই!
অলিভিয়া বেশ আবেগাপ্লুত হয়ে পড়বো। দু’চোখ দিয়ে আনন্দাশ্রু গড়িয়ে পড়তে শুরু করলো। সে উপলব্ধি করতে পারলো, আব্বু যেভাবে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করছিলেন, সেটা বাস্তবিকই যথার্থ ছিল না। তিনি আরও অনেক বেশি মহিয়সী! 
-
রাতে খাবার শেষে ছোট্ট মেয়ের মতো আদর করে নিজের খাটে নিয়ে বসালেন। ইয়ামনা যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলেন। ফরাসি ভাষাটা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলেন। কিন্তু হৃদয় যেখানে দ্বার খুলে দেয়, ভাষা সেখানে কোনও বাধা সৃষ্টি করতে পারে না। 
-আপনার কথা বলুন! একটুও বাদ দেয়া যাবে না!
-আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম ইয়ামীন মানে তোমার বাবা কোনও কাজে ব্যস্ত আছে। মুসলমান হওয়ার পর আব্বু আমার নামের সাথে মিলিয়ে তার নাম রেখেছিল ইয়ামীন! তাকে না আসতে দেখে, আমরা কিছু মনে করলাম না। সবকিছু ঠিকঠাক মতো চলছিল। আমাদের সম্বিত ফিরল পরপর কয়েকদিন অন্য সেনা কর্মকর্তা গ্রামের টহলে আসতে দেখার পর! খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, ইয়ামীনকে কর্তৃপক্ষ জরুরীভিত্তিতে পাঠিয়ে দিয়েছে! 
তারপরও মনে মনে আশা ছিল, সবকিছু গুছিয়ে যোগাযোগ করবে। সেই আশাতেই জীবন কেটে গেলো। সে চলে গেলো, এদিকে আমাদের ওপর নিত্য নতুন হয়রানি শুরু হলো। অবস্থা দিনদিন খারাপ হতে দেখে, আমরা রাতের আঁধারে গ্রামত্যাগ করি! বিভিন্ন স্থান ঘুরে, এই গ্রামে এসে আশ্রয় নিয়েছিলাম। 
আব্বু-আম্মু-দাদু মিলে বহুচেষ্টা করেছিলেন আমার বিয়ে দেয়ার। ভাল ভাল সম্বন্ধও এসেছিল! কিন্তু একেতো আমি সন্তানসম্ভবা অন্যদিকে সবসময় মনে হতো: এই বুঝি ও এলো! কারণ ভিনদেশী হলেও আমাদের তিনমাসের সংক্ষিপ্ত সংসারজীবনে তাকে যেভাবে চিনেছি, আর যাই হোক, তাকে প্রতারক মনে হয়নি! আমার মন বলতো, সে নিশ্চয়ই কোনও বিপদে পড়েছে! ওটা কেটে গেলে ঠিকই ছুটে আসবে! 
-
সন্তানের জন্ম হলো। তাকে নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটলো। ও একটু বড় হওয়ার পর আবার কিছু সময়ের জন্যে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়লাম। তখন দেশ নতুন স্বাধীন হয়েছে! অর্থনৈতিক অবস্থা শোচনীয়! মনের মধ্যে একটা খেয়াল এলো:
-গ্রামের মহিলাদেরকে একসাথ করে, কিছু করা যায় কি না? ভাবতে ভাবতে বের হলো, তারা তো সবাই গালিচা বানাতে পারে! এটাকেই কিভাবে আরও গতিশীল ও লাভজনক করা যায়? একা একা গালিচা বুনতে গেলে অনেক সময় লেগে যায়! কিন্তু কয়েকজন মিলে করলে, অতিদ্রুত কাজ তুলে ফেলা যায়! তাই প্রথম দিকে তিনজনের একটা দল গঠন করে, যৌথভাবে কাজ শুরু করলাম। আস্তে আস্তে দল ভারী হতে হতে, গ্রামের সবাই এখন আমাদের এই ভবনে কাজ করে। সবাইকে তার কাজের ধরন অনুযায়ী মুনাফা দেয়া হয়। 
-
হিশেব রাখা হয়, কে কতটুকু কাজ করেছে! ফাঁকি দেয়ার অবকাশ কম! তাদের মেহনতও কমে এসেছে বহুগুণ, আবার আয়-রোজগারও বেড়েছে !
-আচ্ছা আম্মু! এই যে দীর্ঘ একটা সময় একা একা কাটিয়ে দিলেন, খারাপ লাগেনি? 
-একদম লাগেনি তা নয়, কিন্তু নিজেকে সব সময় কোনও না কোনও কাজে জড়িয়ে রেখেছি! খুব বেশি ভাবার ফুরসৎ মেলেনি! স্কুলে সময় দিয়েছি! মেয়েদেরকে কুরআন শিক্ষা দিয়েছি! হাতের কাজ শিখিয়েছি! এই করেই জীবনটা কিভাবে যেন পার হয়ে গেছে প্রায়!
-আম্মু! আসল প্রশ্নটা করি! আব্বু যদি আপনার সাথে দেখা করতে আসতে চায়, আপনার আপত্তি নেই তো! 
-আমার সাথে তার ছাড়াছাড়ি হয়নি! আমি তার স্ত্রী। ও আমার স্বামী! তাকদীর আমাদেরকে একটা পরীক্ষায় ফেলেছিল! এখন হয়তো জোড়া লাগাতে চাইছে! আমি এমনটাই ভাবি। এতদিন এটা ভেবেই মনকে প্রবোধ দিয়ে এসেছি। আর সত্যি বলতে কি, আমি তার প্রতীক্ষার প্রহর গুণতে গুণতেই এতটা পথ পাড়ি দিয়ে এলাম। তাকে পেয়ে আবার হারাতে চাইবো কেন? আপত্তি করার প্রশ্নই ওঠে না। সে যেমনই হোক! শুধু মুসলমান হলেই হবে। 
-আব্বু চাকুরিতে থাকাবস্থায়, তার ওপর বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা ছিল। এখন সেটা নেই। তবুও কিছু আইনি বাধা ছিল, এতদিনে সেটা কেটে গেছে আশা করি! এখানে টেলিফোন না থাকাতে এতবড় একটা সুসংবাদ তাকে দিতে পারছি না! আগামী কাল তার সাথে কথা বলবো! আপনি কি আমার সাথে যাবেন?
-না মা, তার সাথে আমার দেখা ও কথাটা সরাসরি হোক! আগে কথা বলে এতদিনের জমিয়ে রাখা আবেগ-অনুরাগ হালকা করতে চাই না!


মাওলানা মুহিউদ্দীন খানঃ যেমন দেখেছি


আবুল হুসাইন আলেগাজী
২৬. ০৬. ২০১৬, রোববার



০১. বাংলা ইসলামী সাহিত্য ও সাংবাদিকতার অন্যতম পথিকৃৎ Pioneer رائد, সাহসী লেখক, অনুবাদক ও প্রকাশক মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের সাথে আমার দুইবার দেখা হয়েছে। প্রথমবার ১৪১৮ (১৯৯৮) হিজরীর রমজানের শেষের দিকে আমার নিজের আগ্রহে বাংলা বাজারের মাসিক মদীনার কার্যালয়ে এবং দ্বিতীয়বার ২০০৭ এর শুরুর দিকে শ্রদ্ধেয় মাওলানা আবদুর রহীম ইসলামাবাদী সাহেবের আগ্রহে গেন্ডারিয়াস্থ তাঁর বাড়িতে। 

০২. আজ থেকে ১৯ বছর অগে যখন মাসিক মদীনার কার্যালয়ে মাওলানা খান সাহেবের সাথে অমার দেখা হয়, তখন বর্তমানে স্থগিত সাপ্তাহিক মুসলিম জাহানের (প্রতিষ্ঠাকাল ১৯৯০) স্বর্ণযুগ ছিল। আমি ১৯৯৪ এর প্রথম দিক থেকে এটির পাঠক ছিলাম। এটির প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদনা পরিষদের সভাপতি ছিলেন খান সাহেব নিজে। সম্পাদক ছিলেন তাঁর জ্যেষ্ঠ ছেলে মোস্তফা মইনুদ্দীন খান। নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন মাওলানা উবাইদুর রহমান খান নদভী। প্রধান প্রতিবেদক ছিলেন ময়মনসিংহের মাওলানা শহীদুল ইসলাম। সেরা কলাম লেখক ছিলেন মরহুম সালেহ উদ্দীন আহমদ। তিনি 'আদব আলীর বেয়াদবি মাফ করবেন' শিরোণামে লিখতেন। তাছাড়া ঝিনাইদহের কবিতা সুলতানাও ভালো লিখতেন। 'সরল সত্য' শিরোণামের মাওলানা উবাইদুর রহমান খান নদভী সাহেবের লেখাগুলো ছিল অতুলনীয়।

০৩. তখন জিহাদ-কিতালের চিন্থায় মনটা অস্থির-বিক্ষুব্ধ থাকলেও বয়স ও জীবনচিন্তার ভার ছিল অনেক হাল্কা। হাটাচলা ও সফরে কষ্ট হতো না। মীরপুর থেকে রমজানের শেষের দিকে চট্রগ্রাম যাওয়ার পথে চিন্তা করলাম দাওরায়ে হাদীছে আমার ক্লাস ও রুম মেট মাওলানা বদরুল আলম হামিদীর (হাটহাজারীতে মাদরাসা সংলগ্ন একটি ভাড়া বাসায় আমরা দুইজন এক সাথে থাকতাম ও খেতাম) সাথে দেখা করবো। কারণ, তিনি বলেছিলেন তাঁর দাদা (শায়খে বরুনী) একজন বড় বুজর্গ ব্যক্তিত্ব ছিলেন এবং বরুনায় (শ্রীমঙ্গল) তাদের একটি বড় মাদরাসা রয়েছে। আছরের সময় মীরপুর থেকে বের হওয়ার সময় ঠিক করেছিলাম মৌলভী বাজারের গাড়িতে ওঠার আগে বাংলা বাজারস্থ মাসিক মদীনা, সাপ্তাহিক মুসলিম জাহান ও মদীনা পাবলিকেশন্স কার্যালয় দেখে যাবো। বাংলা বাজারে পৌঁছুতেই ইফতারের সময় হয়ে গেল। একটি ছোট ছোলা-পিয়াজির দোকানে ইফতার করলাম। মাগরিব নামাজ শেষে মদীনার কার্যালয় খুঁজে বের করি। ওই কার্যালয়ে তখন মাসিক মদীনার চেয়ে সাপ্তাহিক মুসলিম জাহানের কাজই বেশি হতো। ওখানে ঢুকে দেখা হল মাওলানা উবাইদুর রহমান খান নদভী, পশ্চিমবঙ্গের জালাল উদ্দীন বিশ্বাস (তখন তিনি মুসলিম জাহানে কর্মরত ছিলেন) মাওলানা শহীদুল ইসলাম ও কবি আবদুল কুদ্দুস ফরিদীর সাথে। দাঁড়িয়ে ওলামায়ে দেওবন্দের কি একটা বিষয় নিয়ে কথা বলতে দেখলাম আহমদ বদরুদ্দীন খানকেও। নদভী সাহেব তখন মাসিক জাগো মুজাহিদের উপদেষ্টা সম্পাদক ছিলেন। জানালেন, তিনি এটির সম্পাদকীয় লিখে দেন। কথা প্রসঙ্গে বললাম, আমি মাওলানা মুহিউদ্দীন খানকে দেখতে চাই। বললেন, ওই কক্ষে যান। গিয়ে সালাম দিলাম। তিনি তখন সম্ভবত মাসিক মদীনার প্রশ্নের উত্তর লেখায় ব্যস্ত ছিলেন। তারপরও আমার সালামের উত্তর দিয়ে বসতে বললেন। পিয়নকে চা আনার নির্দেশ দিলেন। চা খেলাম। পরে তিনি আমাকে কাছে রক্ষিত তাঁরই সঙ্কলিত 'হাদীসে রসূল' নামের একটি বই হাদিয়া দিলেন। এটি খান সাহেবের বড় আর্থিক মুহসিন মরহুম শিল্পপতি জহুরুল ইসলামের ভাই কামাল সাহেব তার ভাইয়ের মাগফিরাতের উদ্দেশ্যে বিনামূল্যে বিতরণ করছিলেন মাওলানা খানের মাধ্যমে। কোনো দোয়া বা নছীহত চাইতে নয়; শুধুমাত্র তাঁকে দেখতেই গিয়েছিলাম। তাই দেরি না করে বিদায় নিয়ে চলে এলাম। তবে প্রথম সাক্ষাতেই তাঁকে আমার একজন কর্মট ও ভালো মনের মানুষ বলে মনে হয়েছিল। হ্যা! আমি তখন জিহাদ-কিতালের চিন্তায় অনেকটক অস্থিরমনা হওয়ায় আমাদের আলেম সমাজসহ কারো রাজনৈতিক তৎপরতা অমার ভালো লাগতো না। এতে রিয়া ও হীনমন্যতার গন্ধ অনুভব করতাম । অবশ্য এখনো নিজে কোনো বিকল্প দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করতে না পারায় বর্তমানে নির্বোধ ও নিষ্ঠুর সালাফী খারেজী ছাড়া অন্য কারো সমালোচনা করতে উৎসাহ পাই না। তবে আমি বিক্ষুব্ধ জিহাদ-কিতাল প্রেমী তরুণদের খারাপ দৃষ্টিতে দেখি না। ওদের যে মাইন্ড ঘড়ে উঠছে, তা এ অস্থির ও জাহেলী সমাজের অনিবার্য প্রতিক্রিয়া। ওরা মসজিদ-মাদরাসাসহ কোনো জায়গায় উপযুক্ত গাইড বা দিকনির্দেশনা না পাওয়ায় এরকম ক্ষুব্ধ ও সমালোচক হয়ে উঠছে।

০৪. মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের সাথে আমার দ্বিতীয়বার দেখা হয়েছে ২০০৭ এর শুরুর দিকে গেন্ডারিয়াস্থ তাঁর মালিকানাধীন বাড়িতে। তখন আমি ফরিদাবাদ মাদরাসার মালিকানাধীন গেন্ডারিয়াস্থ ভবনটির লাইনে একটি বাসায় থাকতাম। পথে দেখা পেয়ে একদিন ওখানে সাদা মনের মানুষ চট্রগ্রামের প্রবীন লেখক ও গবেষক মাওলানা আবদুর রহীম ইসলামাবাদী সাহেবকে নিয়ে গিয়েছিলাম। তিনি আমাকে স্নেহ করতেন। ঢাকায় থাকাকালে তিনি খান সাহেবের বাড়িতে আসা-যাওয়া করতেন। ওই সময় ওখানে আসা-যাওয়ার পথে তিনি মাঝেমধ্যে আমার বাসায়ও যেতেন। একদিন সন্ধ্যায় তিনি আমাকে বললেন, 'চলো তোমাকে মাওলানা মুহিউদ্দীন খান সাহেবের সাথে পরিচয় করিয়ে দিই। তোমার অনুবাদ করা বই তাঁকে হাদিয়া দাও। তোমারই উপকার হবে।' আমি বললাম, আমিতো অন্য চিন্তার মানুষ। তিনি বললেন, 'তারপরও চলো।' মহানুভব মুরুব্বী মানুষের কথা শোনে আমার অনুবাদ করা শহীদ ডঃ আবদুল্লাহ আযযামের 'পাশ্চাত্য ইসলামবিরোধী ষড়যন্ত্র' বইটি নিয়ে গেলাম। খান সাহেবকে হাদিয়া দিলাম। তিনি তখন পড়াতে ব্যস্ত ছিলেন। জিহাদ-কিতাল ও তাগুতবিরোধী চিন্তায় আসক্ত ও অস্থির থাকায় এবারও তার কাছে কোনো ব্যাপারে প্রশ্ন করতে উৎসাহবোধ করিনি। চা খেয়ে বাসায় চলে এলাম।

০৫. পুরানা পল্টনের নোয়াখালী টাওয়ারের দ্বিতীয় তলায় খান সাহেবের একটি অফিস ছিল। সাথে মদীনা পাবলিকেশন্সের বিক্রয় কেন্দ্র ও মদীনা গ্রাফিক্সের অফিসও। এতে তাঁর ছোট ছেলে আহমদ বদরুদ্দীন খানও বসতেন। আমি খুব কম সময়ই ওই টাওয়ারে যেতাম। একদিন আছরের সময় গিয়ে মাওলানা খান সাহেবকে তাঁর কার্যালয়ের সাদা কাপড় বিছানো ফ্লোরে কাঁত হয়ে শোয়া অবস্থায় দেখলাম। দৃশ্যটি আমার খুব ভালো লাগলো। কারণ, মহান ব্যক্তিরা এরকম সহজ-সরলই হয়ে থাকেন। তাদের মাঝে থাকে না কৃত্রিমতা ও গৌরব-অহঙ্কার। ২০০৯ সালে খান সাহেবের ওই কার্যালয়ে তাঁরই নামে আমার দুইটি বই (কম্পিউটার থেকে প্রিন্ট করা) পাঠিয়েছিলাম। খান সাহেবের সাপ্তাহিক মুসলিম জাহানে ১৯৯৯ ও ২০০০ সালে আমার কয়েকটি লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। একই ভাবে মাসিক মদীনার ২০০০ সালের বড় আকারের সীরাত সংখ্যাটিতেও আমার প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। এরপর সেটির ২০০৬ সালের জুলাই সংখ্যায় জিকিরের গুরুত্ব ও ফজিলতের উপর লেখা আরেকটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। 

০৬. মাওলানা মুহিউদ্দীন খান সারাদেশে ব্যাপকভাবে পরিচিত হয়েছিলেন ১৯৯৪ সালের নাস্তিক বিরোধী আন্দোলনের সময়। তখন তিনি সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদের শীর্ষ নেতাদের একজন ছিলেন। এটি তখন ২০১৩ এর হেফাজতে ইসলামের ভূমিকায় ছিল। মাওলানা মুহিউদ্দীন খান মোল্লা ওমরের তালেবানেরও সমর্থক ছিলেন। ১৯৯৬ এর ২৭ সেপ্টেম্বর তালেবান কাবুল দখল করার পর সাপ্তাহিক মুসলিম জাহানে তাদের সমর্থনে সম্পাদকীয়সহ একাধিক লেখা প্রকাশ করা হয়েছিল। ১৯৯৭ সালে মুসলিম জাহানে প্রকাশিত মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের 'ওসামা বিন লাদেনঃ একজন অকুতোভয় মুজাহিদের আলেখ্য' শীর্ষক লেখাটি পড়েই আমি সৌদি জিহাদী মার্চেন্ট শায়খ ওসামা বিন লাদেন সম্পর্কে সর্বপ্রথম ধারণা লাভ করেছিলাম। দেওবন্দী আলেম না হয়েও আকাবিরে দেওবন্দের প্রতি ভক্তি, শ্রদ্ধা এবং দেশের কওমী আলেমদের সাথে উত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে তাদের মন জয় করে নিয়েছিলেন মাওলানা মুহিউদ্দীন খান। তাঁর কর্মদক্ষতা ও সাহস দ্বারা লাখো-কোটি মুসলমান প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে উপকৃত হয়েছে। সীরত সাহিত্যসহ ইসলামের বিভিন্ন দিককে কলমের মাধ্যমে উপস্থাপনের কঠিন কাজে তাঁর কীর্তি অতুলনীয়। মাসিক মদীনা ও সাপ্তাহিক মুসলিম জাহানের পাশাপাশি মদীনা পাবলিকেশন্সের মাধ্যমেও তিনি মানুষের সামনে ইসলামের বাণী তুলে ধরতে বিশাল যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখেছেন। বাংলার ইসলামী ব্যক্তিত্বদের ইতিহাসের পাতায় তাঁর নামটি অনেক উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। ১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত তাঁর অন্যতম সেরা কীর্তি মাসিক মদীনা দীর্ঘজীবি হোক। আল্লাহ তাঁকে স্বীয় রহমত ও মাগফিরাতের চাদরে আবৃত করে রাখুন। 


রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীঃ ইতিহাস ও বর্তমান অবস্থা-০১

আবুল হুসাইন আলেগাজী

এক. ভূমিকা

আমি দক্ষিণ চট্রগ্রামের মানুষ হওয়ায় বর্তমানে বিশ্বব্যাপী আলোচিত রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীটির ব্যাপারে মোটামুটি ধারণা রাখার সুযোগ হয়েছে। ভাষা ও বর্ণের দিক থেকে রোহিঙ্গারা আমাদের চাটগাঁম অঞ্চলেরই মানুষ। রোহিঙ্গাদের আবাসস্থল আরাকান (রাখাইন) একসময় একটি স্বাধীন মুসলিম রাজ্য ছিল। আমি জন্মের পর থেকেই রোহিঙ্গা (গ্রাম্য ভাষায় রোওয়াই) শব্দটি শুনে আসছি। কারণ, আমাদের পাড়ার দক্ষিণে একটি রোওয়াই পাড়া রয়েছে। রোওয়াই লোকজন আমাদেরকে চাটিগাঁনা বলে থাকে। সারা চট্রগ্রামে অনেক রোওয়াই পাড়া রয়েছে। সংখ্যলঘু রোওয়াই জনগোষ্ঠীর সাথে চাটিগাঁনাদের ভাষা ও স্বভাব উভয়টাতে কিছু অমিল/পার্থক্য রয়েছে। রোওয়াইরা চালাক-চতুর ও ধূর্ত প্রকৃতির। এ রোওয়াই তথা রোহিঙ্গা লোকজন ১৭৯৯ সালে আরাকান থেকে চট্রগ্রামে পালিয়ে এসে বিচ্ছিন্ন ভাবে বসবাস শুরু করেছিল। ওই সময় পঁয়ত্রিশ হাজারেরও বেশি রোওয়াই আরাকান দখলকারী বার্মিজদের গ্রেফতার এড়াতে এবং আশ্রয়ের নিমিত্তে আরাকান থেকে নিকটবর্তী চট্টগ্রাম অঞ্চলে চলে এসেছিল। চাটিগাঁনারা তাদেরকে মুসলিম হিসেবে আশ্রয় দিলেও প্রথমদিকে তাদের সাথে দূরত্ব বজায় রেখে চলতো। এমনকি তাদের সাথে আত্মীয়তা করা থেকেও বিরত থাকতো। তবে রোওয়াইদের দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্ম থেকে ধীরে ধীরে এ দূরত্ব মিটে যেতে থাকে। বর্তমানে তা একেবারেই দূর হয়ে গেছে বলা যায়। চাঁটিগানাদের সাথে রোওয়াই লোকেরা এমনভাবে মিশে গেছে যে, রোওয়াইদের বর্তমান প্রজন্ম তারা যে আরাকান থেকে হিজরত করা রোহিঙ্গাদের উত্তরপুরুষ, সেটাই ভুলে গেছে। রোহিঙ্গা মুসলিমদের রাজ্য 'আরাকান' অত্যাচারী বার্মিজ মগদের দখলে চলে যাওয়ার পর তাতে মুসলমানদের উপর দুর্দিন নেমে আসে। পরে তা বৃটিশদের দখলে চলে গেলে আরাকান ও রেঙ্গুনের (ইয়াঙ্গুন) সাথে চট্রগ্রামবাসীর অর্থনৈতিক সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। 

দুই. রোহিঙ্গাদের অধিকতর পরিচয়

বর্তমান মিয়ানমার তথা বার্মার রাখাইন রাজ্য/প্রদেশের প্রাচীন নাম ছিল রোহিং (পরবর্তীতে আরাকান)। ইতিহাস থেকে জানা যায়, রাখাইন প্রদেশের উত্তর অংশে বাঙালি, পার্সিয়ান, তুর্কি, মোগল, আরবীয় ও পাঠানরা বঙ্গোপসাগরের উপকূল বরাবর বসতি স্থাপন করেছে। তাদের কথ্য ভাষায় চট্টগ্রামের স্থানীয় উচ্চারণের প্রভাব রয়েছে। উর্দু, হিন্দি, আরবি শব্দও রয়েছে। রাখাইনে দুটি সম্প্রদায়ের বসবাস। ‘মগ’ ও ‘রোহিঙ্গা’। মগরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। মগের মুল্লুক কথাটি বাংলাদেশে অতি পরিচিত। দস্যুবৃত্তির কারণেই এমন নাম হয়েছে ‘মগ’দের। এক সময় তাদের দৌরাত্ম্য ঢাকা পর্যন্ত পৌঁছেছিল। মোগলরা তাদের তাড়া করে জঙ্গলে ফেরত পাঠায়। রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে একটি প্রচলিত গল্প রয়েছে এভাবে, সপ্তম শতাব্দীতে বঙ্গোপসাগরে ডুবে যাওয়া একটি জাহাজ থেকে বেঁচে যাওয়া লোকজন উপকূলে আশ্রয় নিয়ে বলেন, আল্লাহর রহমে বেঁচে গেছি। এই রহম থেকেই এসেছে রোহিঙ্গা। তবে ওখানকার রাজসভার বাংলা সাহিত্যের লেখকরা ঐ রাজ্যকে রোসাং বা রোসাঙ্গ রাজ্য হিসাবে উল্লেখ করেছেন। কারো মতে, অষ্টম শতাব্দীতে আরবদের আগমনের মধ্য দিয়ে আরাকানে মুসলমানদের বসবাস শুরু হয়। আরব বংশোদ্ভূত এই জনগোষ্ঠী মায়্যু সীমান্তবর্তী অঞ্চলের (বাংলাদেশের চট্টগ্রাম অঞ্চল) চেয়ে মধ্য আরাকানের নিকটবর্তী ম্রক-ইউ এবং কাইয়্যুকতাও শহরতলীতেই বসবাস করতে পছন্দ করতো। এই অঞ্চলের বসবাসরত মুসলিম জনপদই পরবর্তীকালে রোহিঙ্গা নামে পরিচিতি লাভ করে। ইতিহাস থেকে জানায় যে, ১৪৩০ থেকে ১৭৮৪ সাল পর্যন্ত ২২ হাজার বর্গমাইল আয়তনের রোহিঙ্গা স্বাধীন রাজ্য ছিল। মিয়ানমারের রাজা বোদাওফায়া এ রাজ্য দখল করার পর বৌদ্ধ আধিপত্য শুরু হয়।

দ্বিতীয় পর্ব
রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীঃ ইতিহাস ও বর্তমান অবস্থা-০২ 

তিন. প্রাচীন ইতিহাস

ম্রক-ইউ Mrauk-U রাজ্যের সম্রাট নারামেখলার শাসনকালে (১৪৩০-১৪৩৪) বাঙ্গালীদের আরাকানের বসবাসের প্রমাণ পাওয়া যায়। ২৪ বছর বাংলায় নির্বাসিত থাকার পরে সম্রাট বাংলার সুলতানের সামরিক সহায়তায় পুনরায় আরাকানের সিংহাসনে আরোহন করতে সক্ষম হন। যে সব বাঙ্গালী সম্রাটের সাথে এসেছিল তারা আরাকানে বসবাস করতে শুরু করে। সম্রাট নারামেখলা বাংলার সুলতানের দেওয়া কিছু অঞ্চল ও আরাকানের ওপর সার্বভৌমত্ব অর্জন করে। সম্রাট নারামেখলা পরবর্তীতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং বাংলার প্রতি কৃ্তজ্ঞতা স্বরূপ আরাকানে বাংলার ইসলামী স্বর্ণমূদ্রা চালু করেন। পরবর্তীতে নারামেখলা নতুন মূদ্রা চালু করেন যার একপাশে ছিল বার্মিজ বর্ণ এবং অপরপাশে ছিল ফার্সী বর্ণ। বাংলার প্রতি আরাকানের কৃ্তজ্ঞতা ছিল খুবই অল্প সময়ের জন্য। ১৪৩৩ সালে সুলতান জালালুদ্দিন মুহাম্মদ শাহের মৃত্যু হলে সম্রাট নারামেখলার উত্তরাধিকারীরা ১৪৩৭ সালে রামু এবং ১৪৫৯ সালে চট্টগ্রাম দখল করে নেয়। ১৬৬৬ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম আরাকানের দখলে ছিল। বাংলার সুলতানদের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জনের পরেও আরাকানের রাজাগণ মুসলিম রীতিনীতি বজায় রেখে চলে। বৌদ্ধ রাজাগণ নিজেদেরকে বাংলার সুলতানদের সাথে তুলনা করতো এবং মুঘলদের মতোই জীবন যাপন করতো। তারা মুসলিমদেরকেও রাজদরবারের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দিত। ১৭ শতকের দিকে আরাকানে বাঙ্গালী মুসলিমদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। তারা আরাকানের বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে কাজ করতো। যেহেতু রাজাগণ বৌদ্ধ হওয়ার পরেও বাংলার সুলতানদের রীতিনীতি অনুযায়ীই রাজ্য পরিচালনা করতো, তাই আরাকানের রাজদরবারে বাংলা, ফার্সী এবং আরবি ভাষার হস্তলিপিকরদের মধ্যে অনেকেই ছিল বাঙ্গালী। কামেইন বা কামান নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী যারা মায়ানমার সরকারের নৃতাত্ত্বিক জাতিসত্ত্বার মর্যাদা পেয়েছে, তারা আরাকানের মুসলিম জনগোষ্ঠীরই একটা অংশ ছিল। ১৭৮৫ সালে বার্মিজ মগরা আরাকান দখল করে। এর পরে ১৭৯৯ সালে পঁয়ত্রিশ হাজারেরও বেশি মানুষ বার্মিজদের গ্রেফতার এড়াতে এবং আশ্রয়ের নিমিত্তে আরাকান থেকে নিকটবর্তী চট্টগ্রাম অঞ্চলে চলে আসে।ওই সময় বার্মার শাসকেরা আরাকানের হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করে এবং একটা বড় অংশকে আরাকান থেকে বিতাড়িত করে মধ্য বার্মায় পাঠায়। ১৮২৪ সালে যখন ব্রিটিশরা আরাকান দখল করে, তখন যেন এটি ছিল একটি মৃত্যুপূরী।

চার. বৃটিশ শাসনামল

কৃষিকাজের জন্য আরাকানের কম জন অধ্যুষিত এবং উর্বর উপত্যকায় আশপাশের এলাকা থেকে বাঙ্গালী অধিবাসীদের অভিবাসন করার নীতি গ্রহণ করেছিল ব্রিটিশরা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলাকে আরাকান পর্যন্ত বিস্তৃত করেছিল। আরাকান ও বাংলার মাঝে কোন আন্তর্জাতিক সীমারেখা ছিল না এবং এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে যাওয়ার ব্যাপারে কোন বিধি-নিষেধও ছিল না। ১৯ শতকে, হাজার হাজার বাঙ্গালী কাজের সন্ধানে চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে আরাকানে গিয়ে বসতি গড়েছিল। এছাড়াও হাজার হাজার রাখাইন আরাকান থেকে পাহাড়ি বাংলায় চলে এসেছিল।
১৮৯১ সালে ব্রিটিশদের করা এক আদমশুমারীতে দেখা যায়, আরাকানে তখন ৫৮,২৫৫ জন মুসলমান ছিল। ১৯১১ সালে এ সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ১৭৮,৬৪৭ জন হয়। অভিবাসনের মূল উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ বাংলার সস্তা শ্রম যা আরাকানের ধান ক্ষেতের কাজে লাগত। বাংলার এই অধিবাসীরা (বেশিরভাগই ছিল চট্টগ্রাম অঞ্চলের) মূলত আরাকানের দক্ষিণেই অভিবাসিত হয়েছিল। এটা নিশ্চিত যে, ব্রিটিশদের এই অভিবাসন প্রক্রিয়া ছিল পুরো অঞ্চল জুড়ে, শুধু আরাকানেই নয়। ঐতিহাসিক থান্ট মিন্ট-ইউ লিখেছেন: "বিংশ শতাব্দীর শুরুতে, বার্মায় আসা ভারতীয়দের সংখ্যা কোনভাবেই আড়াই লক্ষের কম নয়। এই সংখ্যা ১৯২৭ সাল পর্যন্ত বাড়তেই থাকে এবং অভিবাসীদের সংখ্যা হয় ৪৮০,০০০ জন। রেঙ্গুন নিউ ইয়র্ককেও অতিক্রম করে বিশ্বের বড় অভিবাসন বন্দর হিসেবে। মোট অভিবাসীদের সংখ্যা ছিল প্রায় ১.৩ কোটি (১৩ মিলিয়ন)।" তখন বার্মার রেঙ্গুন, আকিয়াব, বেসিন, প্যাথিন এবং মৌমেইনের মত অধিকাংশ বড় শহরগুলোতে ভারতীয় অভিবাসীরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। ব্রিটিশ শাসনে বার্মিজরা অসহায়ত্ব বোধ করত এবং দাঙ্গা-হাঙ্গামার মাধ্যমে তারা অভিবাসীদের উপর প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করত।
অভিবাসনের ফলে সংঘাত মূলত আরাকানেই ছিল সবচেয়ে প্রকট। ১৯৩৯ সালে রোহিঙ্গা মুসলিম ও রাখাইন বৌদ্ধদের মধ্যকার দীর্ঘ শত্রুতার অবসানের জন্য ব্রিটিশ প্রশাসন জেমস ইস্টার এবং তিন তুতের দ্বারা একটি বিশেষ অনুসন্ধান কমিশন গঠন করে। কমিশন অনুসন্ধান শেষে সীমান্ত বন্ধ করার সুপারিশ করে, এর মধ্যে শুরু হয় ২য় বিশ্ব যুদ্ধ এবং এর পরে ব্রিটিশরা আরাকান ছেড়ে চলে যায়।
১৯৪২ সালের ২৮শে মার্চ, মায়ানমারের মিনবিয়া এবং ম্রক-ইউ শহরে রাখাইন জাতীয়তাবাদী এবং কারেইনপন্থীরা প্রায় ৫,০০০ মুসলমানকে হত্যা করে। ইতোমধ্যে, রাখাইন রাজ্যের উত্তরাঞ্চলে প্রায় ২০,০০০ মুসলমানকে হত্যা করা হয়। এতে উপ-কমিশনার ইউ য়ু কিয়াও খায়াং-ও নিহত হন যিনি দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছিলেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, জাপানীরা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনস্থ বার্মায় আক্রমণ করে। এতে ব্রিটিশ শক্তি পরাজিত হয়ে ক্ষমতা ছেড়ে চলে যায়। এর ফলে ব্যাপক সংঘর্ষ ছড়িয়ে পরে। এর মধ্যে বৌদ্ধ রাখাইন এবং মুসলিম রোহিঙ্গাদের মধ্যকার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছিল উল্লেখযোগ্য। এই সময়ে ব্রিটিশপন্থীদের সাথে বার্মার জাতীয়তাবাদীদেরও সংঘর্ষ হয়। জাপানীদের আক্রমণের সময় উত্তর আরাকানের ব্রিটিশপন্থী অস্ত্রধারী মুসলমানদের দল বাফার জোন منطقة عازلة সৃষ্টি করে। রোহিঙ্গারা যুদ্ধের সময় মিত্রপক্ষকে সমর্থন করেছিল এবং জাপানী শক্তির বিরোধিতা করেছিল। এতে জাপানীরা হাজার হাজার রোহিঙ্গাদের নির্যাতন, ধর্ষণ এবং হত্যা করেছিল। এই সময়ে প্রায় ২২,০০০ রোহিঙ্গা সংঘর্ষ এড়াতে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলায় চলে এসেছিল। জাপানী এবং বার্মিজদের দ্বারা বারংবার গণহত্যার শিকার হয়ে প্রায় ৪০,০০০ রোহিঙ্গা স্থায়ীভাবে চট্টগ্রামে চলে আসে।
(অসমাপ্ত)


কোন নিদর্শন দেখে বুঝবেন যে আজ 'কদর বা মহিমান্বিত রজনী'

১. রাত হবে সাদা-উজ্জ্বল, নাতিশীতোষ্ণঃ
ক. জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«إِنِّي كُنْتُ أُريتُ لَيْلَةَ القَدْرِ ثُم نَسيتُهَا وَهِيَ في العَشْرِ الأَوَاخِرِ، وَهِيَ طَلْقَةٌ بَلْجَةٌ لا حَارَّةٌ ولا بَارِدَةٌ، كَأَنَّ فيهَا قَمَراً يَفْضَحُ كَوَاكِبَهَا لا يَخْرُجُ شَيْطَانُها حَتى يَخْرُجَ فَجْرُهَا».
“আমাকে লাইলাতুল কদর দেখানো হয়েছিল, অতঃপর তা ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে, আর তা হচ্ছে শেষ দশকে। সে রাত হবে সাদা-উজ্জ্বল, নাতিশীতোষ্ণ হবে- না-গরম, না-ঠাণ্ডা, যেন আলোকিত চাঁদ নক্ষত্রগুলোকে আড়াল করে আছে, ফজর উদিত হওয়ার আগ পর্যন্ত সে রাতের শয়তান বের হতে পারে না”। (ইব্‌ন খুযাইমাহ: (২১৯০), ইব্‌ন হিব্বান: (৩৬৮৮) ফাওয়েদ আবু মুহাম্মাল আল ফাকী।)
খ. উবাদা ইব্‌ন সামেত রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«إِنَّ أَمَارَةَ لَيْلَةِ القَدْرِ أَنَّها صَافِيَةٌ بَلْجَةٌ - أَيْ مُسْفِرَةٌ مُشْرِقَةٌ- كَأَنَّ فِيهَا قَمَراً سَاطِعاً، سَاكِنَةٌ سَاجِيَةٌ - أَيْ فيهَا سُكُونٌ- لا بَرْدَ فيهَا وَلا حَرَّ، وَلا يَحِلُّ لِكَوْكَبٍ أَنْ يُرْمَى به فيهَا حَتى يُصْبِحَ، وإِنَّ أَمَارَتَها أَنَّ الشَّمْسَ صَبيحَتَهَا تَخْرُجُ مُسْتَويَةً لَيسَ لها شُعَاعٌ مِثْلَ القَمَرِ لَيْلَةَ الْبَدْرِ، لا يَحِلُّ لِلشَّيْطَانِ أَنْ يَخْرُجَ مَعَهَا يَوْمَئِذٍ» رواه أحمد.
“নিশ্চয় লাইলাতুল কদরের আলামত, তা হবে সাদা ও উজ্জ্বল, যেন তাতে আলোকিত চাঁদ রয়েছে, সে রাত হবে স্থির, তাতে ঠাণ্ডা বা গরম থাকবে না, তাতে সকাল পর্যন্ত কোন তারকা দ্বারা ঢিল ছোঁড়া হবে না। এ রজনীর আরো আলামত হলোঃ সেদিন সকালে সূর্য উদিত হবে সমানভাবে, চৌদ্দ তারিখের চাঁদের ন্যায়, তার কোন কিরণ থাকবে না, সেদিন শয়তানের পক্ষে এর সাথে বের হওয়া সম্ভব নয়”। (আহমদ: (৫/৩২৪), তাবরানি ফি মুসনাদিশ শামিয়্যিন: (১১১৯), দিয়া ফিল মুখতারাহ: (৩৪২), হায়সামি ফিয যাওয়ায়েদ: (৩/১৭৫))

গ. ইব্‌ন আব্বাস রা. নবী করীম সা. থেকে লাইলাতুল কদর সম্পর্কে বলেন:
«لَيْلَةٌ طَلْقَةٌ لا حَارَّةٌ ولا بَارِدَةٌ تُصْبِحَ الشَّمْسُ يَوْمَهَا حَمْرَاءُ ضَعِيفَة»
“লাইলাতুল কদর সাদা-উজ্জ্বল, না গরম না ঠাণ্ডা, সে দিন ভোরে সূর্য উদিত হবে দুর্বল রক্তিম আভা নিয়ে”। (ইব্‌ন খুযাইমাহ, ফাতহুল বারী)
২. সকালে শুভ্রতা নিয়ে সূর্য উদিত হবেঃ
تَطْلُعُ الشَّمْسُ غَدَاةَ إِذْ صَافِيَةً لَيْسِ لها شُعَاعٌ، قَالَ ابنُ مَسْعُودٍ: فَنَظَرْتُ إِلَيها فَوَجَدْتُها كَما قَالَ رَسُولُ الله ﷺ».
সেদিন সকালে শুভ্রতা নিয়ে সূর্য উদিত হবে, তার মধ্যে কোন কিরণ থাকবে না। ইব্‌ন মাসউদ বলেন: আমি সূর্যের দিকে তাকিয়ে সেরূপ দেখেছি, যেরূপ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন” (মুসলিম, তিরমিযি, আহমাদ, সুনানে কোবরা, ইবনে খুজাইমা, মুজামুল আওসাত, আবু দাউদ, মুসান্নাফ)
صُبْحَةَ لَيْلَةِ الْقَدْرِ تَطْلُعُ الشَّمْسُ لَا شُعَاعَ لَهَا كَأَنَّهَا طَسْتٌ حَتَّى تَرْتَفِعَ 
কদরের রজনীর সকাল হবে এমন, সেদিন সূর্য উদিত হবে গামলার ন্যায় উদিত হবে। কিন্তু তার মধ্যে কোন কিরণ থাকবে না। (মুসলিম, তিরমিযি, আহমাদ, সুনানে কোবরা, ইবনে খুজাইমা, মুজামুল আওসাত, আবু দাউদ, মুসান্নাফ)

রবিবার, ২৬ জুন, ২০১৬

মাওঃ মহিউদ্দিন খান রহঃ


মাওঃ মহিউদ্দিন খান রহঃ মাত্র ১৭দিনে অনুবাদ ও সংক্ষেপ করলেন ১১খন্ডের বিশাল তাফসীর মা"আরিফুল কুরআন। কিভাবে সম্ভব হলো শুনুন তার ইতিহাস।
-------------
.
--তারিখটা মনে নেই। সম্ভবত বাদশা ফাহাদের আমলে। সৌদি সরকার ঘোষনা দিল বাংলা ভাষাভাষি হাজীদেরকে এককপি করে প্রবিত্র কুরআনের তাফসীর দিবে। কন্তু সমস্যা হলো কোন তাফসীরটা দিবে??
.
--তখন জামাআতে ইসলাম ও কওমী আলেমদের সাথে দন্ধ ছিল চরমে। তাই জামাআত ইসলামের লোকেরা প্রস্তাব করেছিল মওদূদী সাহেব কতৃক রচিত তাফহিমুল কুরআনের অনুবাদটা সংক্ষিপ্ত করে সকল হাজীদের হাতে পৌছে দিতে। সৌদি সরকার ও তাদের প্রস্তাবটা সাদরে গ্রহন করেন। কাজটাও মোটামোটি শেষের দিকে...
.
--ফকিহুল মিল্লাত মাওলানা আব্দুর রহমান রহঃ তখন সংবাদটি শুনলেন। এবং তিনি আশংকা করলেন মওদূদীর ভুলভাল তাফসীরটা যদি বাংলার প্রতিটা ঘরে ঘরে পৌছে যায় তাহলেতো সর্বনাশ হয়ে যাবে। তাই তড়িঘড়ি করে মুফতি মিযান সাহেব সহ আলেমদের একটা দল পাঠালেন সৌদিআরব। এবং তারা সৌদি সরকারকে একথা বুঝাতে সক্ষম হলেন যে তাফহিমুল কুরআনে অনেক ভুল আছে। (যেমন সূরা আছর এর তাফসীরে বলা হয়েছে নবীগন নিষ্পাপ নয়, এ জাতীয় আরো অনেক)
.
এবার সৌদি সরকার তাফহিমুল কুরআনের বিকল্প চাইলেন। তখন আলেমগন প্রস্তাব করলেন মা"অারিফুল কুরআনের কথা।
.
কিন্তু সমস্য হলো জামাতে ইসলামের লোকেরা তখন অভিযোগ নিয়ে যায় যে মা"আরিফুল কুরআনেও ভুল আছে। তাদের দাবী হলো এ তাফসীরে ওসিলা (কারো ওসিলায় দোয়া করাকে) কে জায়েয বলা হয়েছে, অথচ তা জায়েয নয়। 
.
মুফতি আব্দুর রহমান সাহেব মুফতি মিযান সাহেব সহ তারা পুনরায় ফতোয়া লিখলেন যে "ওসিলা" জায়েয। পবিত্র কুরআনেই আয়াত আছে " وابتغو اليه الوسيلة "
.
এসব জামেলা করতে করতে হাতে সময় থাকে মাত্র ১৮দিন। এই ১৮দিনে উর্দূ ১১খন্ড মা"রিফুল কুরআনকে সংক্ষেপ করে ১খন্ড করা এবং তার নির্ভুল বাংলা অনুবাদ করা সম্ভব কোন কাজ নয়। ভাবতেই শরীর শিউরে উঠে। 
.
আর এই অসম্ভব কাজকেই সম্ভব করে দেখানেল মাওঃ মহিউদ্দিন খান সাহেব রহঃ। আশেপাশে অন্যকোন অনুবাদ নেই। কোন সহায়ক গন্থ নেই, বর্তমান সময়ের মত তখন ইন্টারনেটে ও পাওয়া যেতনা কুরআনের অনুবাদ বা তাফসীর। সম্পূর্ন আল্লাহর উপর ভরসা করে মসজিদে নববী চত্বরে কাজ শুরু করলেন। ১৮দিনও লাগেনি ১৭দিনেই কাজ শেষ করে সৌদি ধর্মমন্ত্রলায়ে পাঠিয়ে দিলেন।
.
তার অনবদ্য পরিশ্রম এবং আল্লাহপদত্ব বিশেষ যোগ্যতাকে কাজে লাগানোর কারনে আজ কুরআন মাজীদের সম্পূর্ন নির্ভুল তাফসীর মা"আরিফুল কোরআন আজ সকলের ঘরে ঘরে...
.
আজ খান সাহেব রহঃ আমাদের মাঝে নেই কোটি কোটি মুসলমানকে এতিম বানিয়ে মহান প্রভুর নিকট পাড়ি জমালেন তিনি। সকলের চোখে অশ্রু বুকে হাহাকার। জানি তার শূন্যতা কখনো পূরণ হওয়ার নয়। আল্লাহর নিকট ফরিয়াদ পবিত্র কালামের এ মহান খেদমতের ওসিলায় আল্লাহ যেন তার কবরকে বেহেশতের টুকরা করে দেন। জান্নাতী সমিরনে তার কবরকে হিমেল করে দেন........

১৯ রমজান উপমহাদেশের দুই বিশিষ্ট আলেমের বিদায়!


১৯ রমজান ২০১২ শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক ইন্তেকাল করেছিলেন।গতকাল ১৯ রমজান ২০১৬ মাওলানা মহিউদ্দীন খান ইন্তেকাল করলেন!শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রাহঃ উপমহাদেশের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস, ইসলামী ঐক্য জোটের প্রতিষ্ঠাতা, খেলাফত মজলিসের অভিভাবক পরিষদের চেয়ারম্যান, ইসলামী চিন্তাবিদ এবং বাংলাদেশের একজন সুপরিচিত রাজনৈতিক ও ইসলামী ব্যক্তিত্ব। বিখ্যাত হাদিসশাস্ত্রে বিশেষ পাণ্ডিত্যের জন্য তাঁকে 'শায়খুল হাদিস' উপাধি দেওয়া হয়।ফখরে মিল্লাত মাওলানা মুহিউদ্দীন খান রহঃ উপমহাদেশের বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন, রাবেতা আলম আল ইসলামীর সদস্য, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সিনিয়র সহ-সভাপতি, তাফসীরে মাআরিফুল কুরআনসহ অসংখ্য গ্রন্থের অনুবাদক, লেখক ও মাসিক মদীনার সম্পাদক ফখরে মিল্লাত মাওলানা মুহিউদ্দীন খান।আল্লাহ তায়ালা যেন উপমহাদেশের এই দুই বিশিষ্ট আলেমে দ্বীনকে জান্নাতের জান্নাতের উচ্চ মাকাম দান করেন। আমিন।




শনিবার, ২৫ জুন, ২০১৬

মাওলানা মুহিউদ্দীন খান ইন্তেকাল করেছেন


Tamim Raihan

মাওলানা মুহিউদ্দীন খান ইন্তেকাল করেছেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। আমার কৈশোরে আমি বারবার তার কাছে গিয়েছি। শিখেছি। সর্বশেষ ২০১৩ সালের রমজান মাসে এক দুপুরে গিয়েছিলাম। তখনই এ ছবিটি তোলা। তিনি তখন বিছানায় শোয়া। অসুস্থ এবং ক্লান্ত। কিন্তু কণ্ঠ ছিল সজীব এবং তাঁর ভেতরের জগত তখনও প্রাণবন্ত। আমার একটি বইয়ের জন্য তথ্যসংগ্রহে আমি গিয়েছিলাম। তিনি আমাকে ঘন্টা দুয়েক সময় দিলেন। আমার খুঁটিনাটি অনেক প্রশ্নের উত্তর দিলেন। অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্নে জানতে চেয়েছিলাম, রাজনীতিতে জড়িয়ে কী পেয়েছেন এই জীবনে? হাসিমুখে আঙুল গোল করে দেখিয়ে বলেছেন, গোলআলু পেয়েছি। জিজ্ঞেস করেছিলাম, সুস্থ হলে প্রথমে কী করতে চান? তিনি বলেছিলেন, জীবনের খেলাঘরের বাকি অংশটুকু লিখে যেতে চাই। আজ থেকে মহীরুহতুল্য এই প্রাজ্ঞজন নাম লেখালেন ইতিহাসের পাতায়। তার পরকাল শান্তিময় হোক মহান দয়াময়ের করুণাছায়ায়। যতদিন কুরআন আছে, কুরআনের তাফসির মাআরিফুল কুরআনের বাংলা অনুবাদ আছে, ততদিন তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন তার এই মহান কর্মের মধ্য দিয়ে। 

শুক্রবার, ২৪ জুন, ২০১৬

রমযানের শেষ ১০ দিনের জন্য সহজ কিন্তু শক্তিশালী আমল!

মাসজিদুল হারামের ইমাম রামাদ্বানের শেষ দশ দিনের আমলের উপর একটি অসাধারণ পরামর্শ দিয়েছেন মুসলিম উম্মাহর জন্য।
.
তিনি বলেন-
.
- প্রতিদিন এক দিরহাম (এক টাকা) দান করুন, যদি দিনটি লাইলাতুল ক্বদরের* মাঝে পড়ে, তবে আপনি ৮৪ বছর (১০০০ মাস) পর্যন্ত প্রতিদিন এক টাকা দান করার সাওয়াব পাবেন।
.
- প্রতিদিন দু' রাকা'আত নফল সালাত আদায় করুন, যদি দিনটি লাইলাতুল ক্বদরের* মাঝে পড়ে তবে আপনি ৮৪ বছর পর্যন্ত প্রতিদিন দু' রাকা'আত সালাতের সাওয়াব পাবেন।
.
- প্রতিদিন তিন বার সূরা ইখলাস পাঠ করুন, যদি দিনটি লাইলাতুল ক্বদরের* মাঝে পড়ে, তবে আপনি ৮৪ বছর পর্যন্ত প্রতিদিন এক খতম ক্বুর'আন পাঠের সাওয়াব পাবেন ।
.
লাইলাতুল কদরের দুআঃ
-----------------------------
মা আয়েশা নবী (সাঃ) কে জিজ্ঞাসা করেনঃ 
হে আল্লাহর রাসূল! যদি আমি লাইলাতুল কদর লাভ করি, তাহলে কি দুআ করবো?
তিনি (সাঃ) বলেনঃ বলবে, (আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন তুহিব্বুল্ আফওয়া ফা’ফু আন্নী”।

অর্থ, হে আল্লাহ! তুমি ক্ষমাশীল। ক্ষমা পছন্দ কর, তাই আমাকে ক্ষমা কর”।
[আহমদ,৬/১৮২]
উপরের কথাগুলো মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিন, যারা আপনার কথা শুনবে ও এগুলো আমলে রুপ দিবে, আপনিও তাদের আমলের সমান সাওয়াব পাবেন। অর্থাৎ সাদাকায়ে জারীয়াহ এর সাওয়াব।
[* লাইলাতুলকদর নির্দিষ্ট নয়, সেটা রামাদানের ২১/২৩/২৫/২৭/২৯ তারিখের যে কোন একদিন হবে, তাই মাঝে কথাটা বলা হয়েছে। ]

কন্যা সন্তান আল্লাহ প্রদত্ত এক শ্রেষ্ঠ নেয়ামত


কন্যা সন্তান মহান আল্লাহ তা'য়ালার পক্ষ থেকে মাতা-পিতার জন্য একটি বিশেষ শ্রেষ্ট নেয়ামত। কন্যা সন্তানকে অশুভ মনে করা কাফিরদের বদস্বভাব। কন্যা সন্তানকে অপছন্দ করা খাটি মুমিনের পরিচায়ক নয়। কন্যা সন্তান অশুভ নয়, অকল্যানকর নয়। বরং কন্যা সন্তান জন্ম নেয়া খোশ কিসমতী ও সৌভাগ্যের নিদর্শন। 

হজরত আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ঐ স্ত্রী স্বামীর জন্য অধিক বরকতময়, যার দেন-মোহরের পরিমান কম হয় এবং যার প্রথম সন্তান হয় মেয়ে।" 

রাসুলুল্লাহ (সা.) আরো ইরশাদ করেন, " যার গৃহে কন্যা সন্তান জন্ম গ্রহন করল, অতঃপর সে তাকে (কন্যাকে) কষ্টও দেয়নি, তার উপর অসন্তুষ্ট ও হয়নি এবং পুত্র সন্তানকে প্রাধান্য দেয়নি, তাহলে ঐ কন্যার কারনে আল্লাহ তা'য়ালা তাকে বেহেশতে প্রবেশ করাবেন।" (মুসনাদে আহমদ, ১:২২৩)

রাসুলুল্লাহ (সা.) আরো বলেছেন," যে ব্যক্তির তিনটি কন্যা সন্তান হবে, এবং সে তাদেরকে এলেম-কালাম, আদব-কায়দা শিক্ষা দিবে, এবং যত্নের সাথে প্রতিপালন করবে ও তাদের উপর অনুগ্রহ করবে, সে ব্যক্তির উপর অবশ্যই জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যাবে। 

উল্লেখিত বর্ণনা দ্বারা প্রমানিত হয় যে, কন্যা সন্তান আল্লাহ তায়ালার এক বিশেষ নেয়ামত। সুতারাং কন্যা সন্তানকে বেশী করে ভালবাসুন। আদর-সোহাগ করুন আর মায়া-মমতা দিয়ে লালন-পালন করুন। সে তো আপনার কলিজার টুকরার টুকরো, দেহের এক বিশেষ অংশ। 
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর অসীম বানীর প্রতি লক্ষ্য রেখে কন্যা সন্তানকে পুত্রের চাইতে ও বেশী আদর যত্ন করুন। এখানে একটি বিষয় আলোচ্য হলো, কন্যা সন্তান আল্লাহ মহান প্রদত্ত নেয়ামত ঠিক কিন্তু পুত্র সন্তানও কিন্তু কোনো অংশে কম নয়। 

-এই আলাচেনার উদ্দেশ্য হচ্ছে, কন্যা সন্তানের প্রতি বিরুপ মানসিকতা পরিহার করা। একমাত্র ছেলে সন্তানের কামনায় কন্যা সন্তানকে অবহেলার পাত্র না বনানো। 

আল্লাহ আমাদের সবাইকে পবিত্র কোরান ও হাদিসের বর্ণনা মেনে কন্যা সন্তানকে আল্লাহ মহানের পক্ষ থেকে প্রদত্ত নেয়ামত করার এবং কন্যা সন্তানের সাথে ব্যবহার করার, নায্য প্রাপ্ত প্রদান করার ব্যাপারে কন্যা সন্তানকে উপযুক্ত মর্যাদা প্রদান করার তাওফিক দান করুন। 
আমিন।


ওহে নাবী. ইমরান হুসাইন আদিব


ওহে নাবী......................................................
তুমিতো আমাদেৱ সর্দাৱ ৱহমাতুল লিল আলামিন৷
তুমিতো আমাদেৱ সুপাৱিশ কারী সাফিয়ুল
মুজনিবীন৷
তুমিতো সব নবীৱ সর্দার সাইয়েদুল মূরসালিন৷
তুমিতো আল্লাহর প্রেরিত দুত আখিরুন্নাবিয়্যিন৷
তুমিতো সকলেৱ বিশ্বস্ত মানব আলআমিন৷
,
ওহে নাবী .........................................................
তুমিঁতো আমার জীবন পথে চলার দিশারী।
তুমিতো আমার জীবন পথে অনুপ্রেরনার বানী
তুমিতো আমার জীবনের ভালবাসার স্পন্দন ।
,
ওহে নাবী.........................................................
তুমিতো উজ্জ্বল নক্ষত্রের চাইতেও অতি সুন্দর। 
তুমিতো সূর্যের আলোর চাইতেও বেশি প্রখর।
তুমিতো চাঁদের আলোর চাইতেও বেশি উজ্জ্বল।
,
ওহে নাবী..................................................................
তোমায় ভাল বেশে পেতে চাই রোজ হাশরের
সেই সাফাআত।
তোমায় ভাল বেশে পেতে চাই সেই নেয়ামত 
সুখময় জান্নাত।
তোমায় ভাল বেশে যেন পাই মেহেরবান খোদার
দর্শন সেই রুয়াত।
হে নাবী
তাই আমি  তোমার আলোয় আলোকিত হয়ে 

সোনার জীবন গড়তে চাই। আমি হতে চাই সে
 পথের পথিক,যে পথের জন্য তুমি তোমার জীবন 
কে বিলিয়েদিয়েছিলে।সত্যিই তুমি মহান 
আল-আলামিন