বুধবার, ৩০ আগস্ট, ২০১৭

মাজার পূজা এবং মিলাদের বিরুদ্ধে আকাবিরে দেওবন্দের শত শত ঐতিহাসিক ফতোয়া


আমাদের উপমহাদেশে ১৭৫৭ সালের পর থেকেই মুসলমানদের তেমন কোন রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক প্রভাব ছিল না। আর ১৭৯৯ সালের মহীশুরের সিংহ টিপু সুলতানের পরাজয়ের মাধ্যমে চুড়ান্ত ভাবে হাত ছাড়া হয়ে যায় শাসন ক্ষমতা। 

এরপর মুসলমানদের ইতিহাস শুধু অপমান, লাঞ্ছনা, অত্যাচার আর গনহত্যার ইতিহাস। এর আগে মুসলমানদের প্রতি জনপদে মাদ্রাসা ছিল। এসব মাদ্রাসা সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় চলত। আর বড় বড় জায়গীর ছিল এসব মাদ্রাসার নামে। এ দিয়েই এর খরচ চলত। কারও কাছে হাত পাততে হত না এসব মাদ্রাসার। কাউকে পাত্তা দেয়ার দরকার পড়ত না। কাউকে বেতন দিয়েও পড়তে হত না। 

ইংরেজরা একে একে সব মাদ্রাসা ধ্বংস করে। একের পর এক উলামায়ে কেরাম বলা চলে যাকে যেখানে যেভাবে পেয়েছে কোন ধরণের অভিযোগ বা বিচার ছাড়াই নিত্য নতুন প্রক্রিয়ার প্রাণদন্ড দিতে ছিল। লোমহর্ষক সব উপায়ে শাস্তি দিতে থাকে। এসব অত্যাচারের মাত্রা এত বেশী ছিল যে, এর বিবরণ মানুষের কাছে অতিরঞ্জন বলে মনে হতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা এটাই ছিল।

মুসলমানদের জমিজমা কেড়ে নিয়ে ভূমিদাস বানানো হয়। মুসলমানদের দৈনন্দিন আমাল ও অভ্যাসেও বাঁধা দেয়া হয়। দাঁড়িও উপর উচ্চ হারে কর বসানো হয়। মুসলমানদের ঈমান ও আকীদাহ ধ্বংস করার জন্য সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় বিভিন্ন ফেরকার জন্ম দেয়া হয়। একই সাথে বিভিন্ন ভাবে ভুল বুঝিয়ে অনেক সরলমনা মুসলমানদের খৃষ্ট ধর্মে দীক্ষিত করে। এর সাথে পর্তুগিজ ও ফরাসী দস্যুদের অত্যচার তো ছিলই। এদেশীয় হিন্দুদেরও মুসলমানদের সম্পর্কে খারাপ ধারণা ও ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি করে বিবাদ বাঁধিয়ে দেয়া হয়।

এরই প্রেক্ষাপটে কিছু উলামায়ে কেরাম অন্তরালে চলে যান। আর প্রত্যন্ত এক গ্রামে এক মাদ্রাসা গঠন করেন। যে গ্রামের নাম দেওবন্দ। দেওবন্দ মাদ্রাসা তাই নতুন কিছু নয়। নতুন কোন সম্প্রদায় বা নতুন কোন আকীদাও নয়। নতুন কোন ধারাও নয়। ফেরকাও নয়। বরং উপমাহাদেশের ইসলামের ধারাবাহিকতাই দেওবন্দ মাদ্রাসা।

অবশ্য এরপর থেকে উপমহাদেশের ইসলামের ইতিহাস আর দেওবন্দের ইতিহাস সমার্থক। কেননা উলামায়ে দেওবন্দ অনেক কষ্ট কুরবানী, ত্যাগ তিতিক্ষা, কৌশল প্রয়োগ করে এখানে ইসলামের ধারাবাহিকতা টিকিয়ে রেখেছেন। বলতে পারেন মহানবী (সঃ) এর মক্কার জীবনের এক প্রতিচ্ছাবি ছিল দেওবন্দের শুরু দিকের সময় গুলো। পরবর্তীতে দেওবন্দী উলামাদের উপরও চলে ইংরেজদের লোমহর্ষক সব অত্যাচার।

দেওবন্দের প্রথম ছাত্র মাওলানা মাহমুদুল হাসানকে মাল্টায় নির্বাসনে পাঠানো হয়। ইতিহাস বলে খাব্বাব (রাঃ) এর মত অত্যাচার চলে তার উপর সেখানে। আজকের গুয়েনতামো বে এর জেলখানার কথা শুনেই আমরা অবাক হই। সারা দুনিয়ার কাফেররা পর্যন্ত সোচ্চার। কিন্তু মাল্টার জেলখানার তুলনায় গুয়েন্তামো বে অনেক আরামের জায়গা। 

এভাবে দুশো বছর অত্যাচার চলে। আসল ব্যাপার হল ইংরেজরা চেয়েছিল ইসলাম মিটে যাক। ইসলাম মেটানোর জন্য সম্ভাব্য যত পদ্ধতি তাদের জানা ছিল সবই তারা প্রয়োগ করেছিল। কিন্তু এই সব মহান আলেমদের কুরবানী এ অঞ্চলে মুসলমানদের সংখ্যা তো বাড়িয়েছেই, আজও এখানে নবীজি সুন্নত ১০০% পালন করার জন্য আগ্রহী মানুষে অভাব হয় না। নবীজির শানে বেয়াদবী প্রতিবাদে জীবন দেয়ার জন্যও মানুষের অভাব নেই এখানে।
.
ইংরেজদের শাসনআমলে ইংরেজদের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে, তৎকালীন উপ-মহাদেশের সবচেয়ে বড় আলেম, আল্লামা শাহ্ ওয়ালিউল্লাহ্ মুহাদ্দিসে দেহলবী (রহঃ) এর বড় সাহেবজাদা আল্লামা শাহ্ আব্দুল আযীয মুহাদ্দিসে দেহলবী (রহঃ) ১৮০৩ সালে ইংরেজদের বিরুদ্ধে জালিম বলে ফতোয়া দিলেন।

এই দেওবন্দি আলেমদের একটি ফতোয়া "ভারত বর্ষ দারুল হারব হয়ে গেছে ইংরেজদের বিরুদ্ধে জেহাদ করা ফরজ" একইসাথে ইংরেজদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাও দেন। এই ঘোষণা বা ফতোয়ার ভিত্তিতে, ভারত বর্ষের সকল মুসলমান, স্বাধীনতা আন্দোলনে প্রাণ-পণে ঝাঁপিয়ে পড়ে। যার ফলে শেষ পর্যন্ত হাজার হাজার মুসলমান তথা-আলেমদের রক্তের বিনিময়ে ইংরেজদের হাত থেকে ভারত স্বাধীনতা লাভ করে। যার কারনে ইংরেজ বিতাড়িত হয় এবং ভারতবর্ষ স্বাধীন হয়। ভারতবর্ষ ইংরেজ মুক্ত হতে পেরেছে বলেই পাকিস্তান এবং তার পর বাংলাদেশ স্বাধীন হতে পেরেছে।
.
বিগত শতাব্দীতে বিশ্ববাসীর উপর উলামায়ে দেওবন্দের অবদান এতো বেশি যে, দ্বীনী খিদমাতে তাঁদের অবদানকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। মুফতী তাক্বী উসমানী (হাফিজাহুল্লাহ), মাওলানা তারেক জামীল (হাফিজাহুল্লাহ) –এর ন্যায় গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিগণ পুরো পৃথিবী ভ্রমণ করে বলেছেন, উলামায়ে দেওবন্দের মতো দ্বিতীয় আরেকটি জামাত বিশ্বের বুকে নেই।

কাদিয়ানী গোষ্ঠী যখন রাসূল (সাঃ)-এর নামে মিথ্যাচার করেছে, উলামায়ে দেওবন্দ তাঁদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। সাহাবায়ে কেরামের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়েছে, উলামায়ে দেওবন্দ রুখে দাঁড়িয়েছেন।

যখন দ্বীনের বিরুদ্ধে কেউ অস্ত্র ধারণ করেছে, উলামায়ে দেওবন্দ অস্ত্র হাতে নিয়েছেন। দ্বীনের মোকাবেলায় কলম ব্যবহার করেছে, উলামায়ে দেওবন্দ কলম দিয়ে জবাব দিয়েছেন। বিতর্কের আহ্বান করেছে, উলামায়ে দেওবন্দ বিতর্কে অংশ নিয়ে পরাভূত করেছেন। বাতিল সম্প্রদায়ের ভয়ে উলামায়ে দেওবন্দ কখনো পালিয়ে যাননি।

শায়খুল হিন্দ মাহমুদ হাসান (রহঃ), সায়্যিদ হুসাইন আহমদ মাদানী (রহঃ), আশরাফ আলী থানভী (রহঃ), ইলিয়াস (রহঃ), আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী (রহঃ), ইউসুফ বানূরী (রহঃ), আমীন সফদর (রহঃ) প্রমুখ উলামায়ে কেরামের জীবন পর্যালোচনা করলে উলামায়ে দেওবন্দের অবদান অনুভব করা যায়।

এক শায়খুল হিন্দের মোকাবেলায় ব্রিটিশ গোষ্ঠী অসহায় হয়ে পড়েছিলো। অর্জিত হয়েছিলো স্বাধীনতা। মাদানী (রহঃ)-এর দূরদর্শী সিদ্ধান্ত উপহার দিয়েছিলো পাকিস্তান। হাকীমুল উম্মত (রহঃ)-এর সহস্রাধিক কিতাব জাতিকে দেখিয়েছিল নতুন দিগন্ত। ইলিয়াস (রহঃ) পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন রাসূলের সুন্নাত। ইউসুফ বানূরী (রহঃ) “আক্বিদায়ে খতমে নবুওয়াত” কনফারেন্সে এশা থেকে নিয়ে ফজর পর্যন্ত বক্তব্য রেখেছিলেন। কোর্টের ভেতরে বিচারপতির সামনে কাদিয়ানীদের অমুসলিম প্রমাণ করেছিলেন। আমীন সফদর (রহঃ) বিতার্কিকের ভূমিকায় বাতিল গোষ্ঠীকে চুপসে দিয়েছিলেন।

দেওবন্দিয়াত কাপুরুষতার নাম নয়। মিথ্যাচারের নাম দেওবন্দিয়াত নয়। যারা দেওবন্দের নামে মিথ্যাচার করছে, তারা কূপে অবস্থানকারী সেই ব্যাঙের মতো, যে কূপের বাইরে পৃথিবীর অস্তিত্বে বিশ্বাসীই নয়।

মাজার পূজা এবং মিলাদের বিরুদ্ধে আকাবিরে দেওবন্দের শত শত ঐতিহাসিক ফতোয়া রয়েছে।

কয়েকটির হাওয়ালা দিয়ে দিলাম। যাদের গায়ে চুলকানি বেশি, তারা দেখে নিতে পারেন।

👉“ইমদাদুল ফতোয়া” (৬/৩২৭.মাকতাবা যাকারিয়া)
👉“ইমদাদুল আহকাম” (১/১৮৭.মাকতাবা যাকারিয়া)
👉“কিফায়াতুল মুফতী” (২/২১৯.মাকতাবা ইদারাতুল ফারুক)
👉“আযীযুল ফতোয়া” ((১/১২২.মাকতাবাতু দারিল ইশায়া)
👉“জাওয়াহিরুল ফিকহ” (১/৪৫৯.মাকতাবাতু দারুল উলূম করাচী)
👉“ফতোয়া মাহমুদিয়া” (১/১৭৮.যাকারিয়া বুক ডিপো।)
👉“ফতোয়া রহিমিয়া” (২/৭৩.দারুল ইশায়া’)
👉“ফতোয়া উসমানী” (১/১১০-১১৫.)

এরপরও যদি কেউ আকাবিরে দেওবন্দের নামে বলে যে,তারা মিলাদ এবং মাজার পুজায় বিশ্বাসী, তারা আর যাই হোক কোন একজন আলেম হতে পারে না।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন