মঙ্গলবার, ১৭ জানুয়ারী, ২০১৭

লা-ইয়াকূনু আমসা-লাকুম!



আমরা বুঝি আর না বুঝি, আল্লাহ তা‘আলা বিশ্বকে পরিচালনা করেন কিছু সুন্নাহ (নিয়ম)-এর আওতায়। কুরআন কারীম খেয়াল করে তিলাওয়াত করলে, সুন্নাহগুলো চোখে পড়ে। সুন্নাহগুলো স্থির, অকম্প! অনমনীয়! অপরিবর্তনীয়! রাব্বে হাকীম নিজেই বলে দিয়েছেন: 
-আপনি কিছুতেই আল্লাহর স্থিরীকৃত নিয়মে কোনও পরিবর্তন পাবেন না! এবং আপনি আল্লাহর স্থিরীকৃত নিয়মকে কখনও টলতেও দেখবেন না (ফাতির: ৪৩)। 
.
তেমনি একটি সুন্নাহ হলো:
তোমরা যদি মুখ ফিরিয়ে নাও তবে তোমাদের স্থানে অন্য কোনও সম্প্রদায়কে সৃষ্টি করবেন অতঃপর তারা তোমাদের মতো হবে না (মুহাম্মাদ: ৩৮)!
.
এর সমর্থনে আরেকটু পড়তে পারি:
-হে মুমিনগণ! তোমাদের কী হলো, যখন তোমাদেরকে বলা হয় আল্লাহর রাস্তায় অভিযানে বের হও, তখন তোমরা ভারাক্রান্ত হয়ে মাটির সাথে মিশে যাও? তোমরা কি আখেরাতের পরিবর্তে পার্থিব জীবন নিয়েই সন্তুষ্ট হয়ে গেছ? (তাই যদি হয়) তবে (স্মরণ রেখ), আখিরাতের বিপরীতে পার্থিব জীবনের আনন্দ অতি সামান্য
তোমরা যদি অভিযানে বের না হও, তবে আল্লাহ তোমাদেরকে যন্ত্রণাময় শাস্তি দেবেন এবং তোমাদের স্থানে অন্য কোনও জাতিকে আনয়ন করবেন এবং তোমরা তার কিছুমাত্র ক্ষতি করতে পারবে না। আল্লাহ সর্ব বিষয়ে পরিপূর্ণ ক্ষমতা রাখেন (তাওবা: ৩৮-৩৯)। 
.
আরও ব্যাপক পরিসরেও আল্লাহ তা‘আলা ধমকির সুরে বলেছেন:
-হে মানুষ! তিনি চাইলে তোমাদের সকলকে (পৃথিবী হতে) নিয়ে যেতে পারেন এবং অন্যদেরকে (তোমাদের স্থানে) নিয়ে আসতে পারেন। আল্লাহ এ বিষয়ে পূর্ণ সক্ষম (নিসা: ১৩৩)। 
.
আল্লাহ তা‘আলা অলসদেরকে বেশিদিন ক্ষমতায় রাখেন না। কর্মঠ যদি কাফেরও হয়, তাকেও সুযোগ দিয়ে দেন। নবীজি সা.-এর সময় থেকে বর্তমান পর্যন্ত ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখলেও উপরের আয়াতের সুষ্পষ্ট বাস্তবায়ন চোখে পড়ে। মুসলমানরা যখনই অভিযানে বের হতে শৈথিল্য প্রদর্শন করেছে, আল্লাহ তা‘আলা কঠিন আযাব চাপিয়ে দিয়েছেন। সম্বিত ফিরে পেয়ে তৎপর হওয়ার আগ পর্যন্ত আযাব অব্যাহত থাকতো। 
.
হিজরী ষষ্ঠ শতকে বিষয়টা বেশ প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে। তখন বলতে গেলে পুরো উম্মাহই ভোগ-বিলাসে বুঁদ হয়ে পড়েছিল। তারা ভুলে গিয়েছিল দায়িত্বের কথা। ফি-সাবীলিল্লাহের মেহনতের কথা! শরয়ী বিধান বাস্তবায়নের কথা! আল্লাহ তা‘আলা তখন ‘ফিরিঙ্গিদেরকে চাপিয়ে দিলেন। খ্রিস্টান ফিরিঙ্গি (ইউরোপিয়ান)-রা শামের পশ্চিম উপকূল দিয়ে প্রবেশ করে, মুসলিম ভূখন্ডে লঠতরাজের রাজত্ব কায়েম করেছিল। হত্যা-বন্দীর সয়লাব বইয়ে দিয়েছিল! শক্ত ধাক্কা খেয়েও মুসলিমদের হুঁশ ফিরে নি। তারা তখন দলাদলি-হানাহানিতে ব্যস্ত! চারপাশের ভয়াবহতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন!
.
মুসলিমদের অবস্থার কোনও পরিবর্তন হলো না। আল্লাহ তা‘আলা এবার চাপালেন আরো কঠিন আযাব! মোঙ্গলরা হামলে পড়লো মুসলিমদের উপর! সংঘটিত হলো মানবেতিহাসের বর্বরতম হত্যাযজ্ঞ। 
.
এহেন শোচনীয় পরিস্থিতিতে আল্লাহ তা‘আলা তার পরিবর্তনের ‘সুন্নাহ’ বাস্তবায়িত করলেন। অলস অথর্ব হয়ে পড়া জাতির স্থলে আরেকটি নতুন জাতি প্রতিস্থাপন করলেন। নতুন জাতির বৈশিষ্ট্য কেমন হবে? আল্লাহ ত‘আলা এটাও বলে দিয়েছেন:
-হে মুমিনগণ! তোমাদের মধ্য হতে কেউ যদি নিজ দ্বীন থেকে ফিরে যায়, তবে আল্লাহ এমন লোক সৃষ্টি করবেন, যাদেরকে তিনি ভালোবাসবেন এবং তারাও তাকে ভালোবাসবে। তারা মুমিনদের প্রতি কোমল এবং কাফিরদের প্রতি কঠোর হবে। তারা আল্লাহর পথে জিহাদ করবে এবং কোনও নিন্দুকের নিন্দাকে ভয় করবে না। এটা আল্লাহর অনুগ্রহ, যা তিনি যাকে ইচ্ছা দান করেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ (মায়িদা: ৫৪)। 
.
উপরের আয়াতগুলোতে চোখ বোলালে কিছু বিষয় উঠে আসে:
(১). আল্লাহ তা‘আলা মুমিনগণকে সতর্ক করছেন, জিহাদের ডাকে সাড়া না দিয়ে পিছিয়ে থাকা ও ভীরুতার পরিণতি সম্পর্কে। 
(২). আল্লাহ তা‘আলা সতর্ক করে দিচ্ছেন, দুনিয়ার প্রতি ঝুঁকে না পড়তে, দুনিয়ার মোহে না জড়াতে। পাশাপাশি আখিরাতের গুরুত্বও বুঝিয়ে দিয়েছেন। 
(৩). জিহাদ ছেড়ে দিলে কী পরিণতি হবে, সে সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছেন। ইমাম তাবারী বলেছেন: জিহাদে বের না হলে, আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়াতেই আযাব নাযিল করে দিবেন!
(৪). আল্লাহর কথামতো কাজ না করলে, হাতপা গুটিয়ে বসে থাকলে, আল্লাহ তা‘আলা নতুন জাতিকে ক্ষমতা দিয়ে দিবেন। অভিযানে বের না হলে, বান্দারই ক্ষতি! আল্লাহর কিছুই যায় আসে না। বান্দার নিজের নিরাপত্তার স্বার্থেই জিহাদ ও দ্বীনের জন্যে আত্মত্যাগ করা প্রয়োজন। নইলে আল্লাহর আযাব নেমে আসবে। লাঞ্ছনাময় জীবন যাপন করতে হবে। 
(৫). নতুন যাদেরকে স্থলাভিষিক্ত করা হবে, তাদের কিছু বৈশিষ্ট্যও বলে দিয়েছেন:
(ক). তারা আল্লাহকে ভালোবাসবেন। আল্লাহও তাদেরকে ভালোবাসবেন। 
(খ) মুমিনগণকে তারা ভালোবাসবেন। তাদের বন্ধুত্ব থাকবে শুধু মুমিনগণের সাথে। যাবতীয় শত্রুতা আর কঠোরতা থাকবে কাফিরদের প্রতি। 
(গ) আল্লাহর রাস্তায় জিহাদে বের হবে। 
(ঘ) একমাত্র আল্লাহকেই ভয় করবে। আল্লাহ ছাড়া আর কোনও সৃষ্টিকে তার বিন্দুমাত্র ভয় করবেন না। 
(ঙ) হকের প্রচারে ব্রতী হবেন। হকের জন্যে লড়াই করবেন। হকের জন্যে সব ধরনের ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকবেন। 
(চ) কারো কোনও নিন্দার ভয় করবেন না। 
.
(৬) আয়াতের শেষে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন: তিনিই এই নতুন প্রজন্মকে উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলো দ্বারা বিভূষিত করবেন। তিনি যা ইচ্ছা, করে থাকেন। 
.
.
নতুন প্রজন্মের প্রথমেই নাম আসে: ইমাদুদ্দীন যিনকী রাহ.-এর। ১০৮৭-১১৪৬। আজকের হালাবে তার জন্ম। আর ইন্তেকাল হয়েছিল আজকের দিনের দিমাশকে। জিহাদের ময়দানেই তিনি শাহাদাত লাভ করে ধন্য হয়েছিলেন। 
.
তিনি ছিলেন একাধারে: সুদক্ষ রাজনীতিবিদ। অত্যন্ত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন সেনানায়ক। দৃঢ় সংকল্পের অধিকারী সাহসী পুরুষ। ভাবগম্ভীর। সহীহজাগানিয়া। 
পাশাপাশি তিনি অত্যন্ত বিনয়ী ছিলেন। অনি অনাড়ম্বর জীবন যাপন করতেন। অধীনস্থ সেনাদের প্রতি অত্যন্ত কোমল ছিলেন। সাধারন সৈনিকদের ঘর-বাড়ির প্রতিও নজর রাখতেন। পরিবার পরিজনের প্রতি যেন, সৈনিকরা পর্যাপ্ত সময় দিতে পারে, এ-ব্যাপারে চৌকান্না থাকতেন। তিনি বলতেন:
-আমরা নারীদের যথাযথ দেখবাল না করলে, তারা স্বামীর দীর্ঘ অনুপস্থিতির কারনে ‘বিচ্যুত’ হয়ে যেতে পারে!
.
শত ব্যস্ততা সত্ত্বেও নিজের সন্তানদের লালন-পালনে কসুর করতে না। তাদেরকে ঈমান-আকীদার পাঠ দিতে অবহেলা করতেন না। ছেলেবেলা থেকেই তিনি সন্তানদেরকে তাওয়াক্কুল শিক্ষা দিতেন। ওলা-বারা মানে মুমিনের প্রতি ভালোবাসা আর কুফরের প্রতি ঘৃণা শিক্ষা দিতেন। দ্বীনের পতাকাকে বুলন্দ করার প্রতি উৎসাহ যোগাতেন। 
.
ইমাদুদ্দীন যিনকী রহ.-এর কর্মতৎপরতা ছিলো মুসলিম উম্মাহর জন্যে ‘প্রথম ঘণ্টা’। খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ জিহাদের সূচনা। ঘুমন্ত উম্মাহকে জাগিয়ে তোলার আহ্বান। তিনি চলে গেলেন। উম্মাহকে জাগিয়ে তোলার দায়িত্ব নিতে এগিয়ে এলেন, যোগ্য পিতার সুযোগ্য সন্তান: 
সুলতান নুরুদ্দীন যিনকী রহ. ১১১৮-১১৭৪। জন্মেছিলেন আজকের মসূলে। মারা গিয়েছেন দিমাশকে। ৫৯ বছর হায়াত পেয়েছিলেন। উমাইয়া খলীফা উমার বিন আবদুল আযীয রহ.-এর পর, সুলতানের মতো আর কোনও ন্যায়পরায়ন শাসক মুসলিম উম্মাহ পায়নি। 
.
বাবার দেখিয়ে দেয়া পথেই তিনি পথচলা শুরু করেছেন। পিতার অসমাপ্ত কাজই তিনি আগে বাড়িয়ে নিয়ে চলেছেন। বাগদাদে রাফেযীদের প্রভাবে, আযানে বলা হতো:
-হাইয়া আলা খাইরিল আমাল!
সুলতান সেটা বদলে পুরোপুরি সুন্নাহসম্মত আযান চালু করলেন:
-হাইয়া আলাল ফালাহ!
দেশ থেকে শিরক-বিদআতের মুলোৎপাটন করেছিলেন। শাসিত এলাকায় শরয়ী হুদূদ কায়েম করেছিলেন। উপকূলীয় অঞ্চল থেকে হানাদার ইঙ্গ-ফরাসীদেরকে হটিয়ে দিয়েছেন। হাতছাড়া হয়ে যাওয়া অসংখ্য কেল্লা-দুর্গ উদ্ধার করে, বাগদাদী খিলাফাহর অধীনে নিয়ে এসেছেন। 
.
শত জিহাদী ব্যস্ততা সত্ত্বেও অধ্যয়ন মুতালায়া করতেন। তিনি হানাফী মাযহাবের অনুসারী হলেও, অন্য মাযহাবের ওলামায়ে কেরামকে অত্যন্ত সমাদরের সাথে দরবারে ঠাঁই দিতেন। জামাতের সাথে পাঁচ ওয়াক্ত নামায নিয়মিত আদায় করতেন। নিজের কাছে কিছুই জমিয়ে রাখতেন না। তিনি ছিলেন তার যুগের সবচেয়ে বেশি দান-খয়রাতকারী। পাশাপাশি দেশের সহায়-সম্পহীনদের তালিকায়ও তার নাম থাকতো!
অসংখ্য মসজিদ-মাদরাসা কায়েম করেছেন। দেশ থেকে দারিদ্র্য বিমোচন করেছেন। তার মুখ থেকে কেউ কখনো কটু-অশোভন কথা বের হতে শোনেনি। 
হিমস শহরে কয়েকটা দোকান কিনেছিলেন। গনীমতে পাওয়া অর্থ দিয়ে। এই দোকানগুলোর আয় দিয়েই নিজের খরচ চালাতেন। দোকানের আয়ে খরচ না কুলোলে, ওলামায়ে কেরামের কাছে ফতোয়া চাইলেন:
-বায়তুল মাল থেকে কতো টাকা নেয়া জন্যে হালাল হবে?
ওলামায়ে কেরাম যা নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন, সেটাই আজীবন গ্রহণ করে গেছেন। বিন্দুমাত্র বেশকম করেন ন্ ি
.
তিনি ঘোড়ায় চড়ে ‘ পোলো’ খেলতে পছন্দ করতেন। এক বুযুর্গ তাকে এ নিয়ে ভর্ৎসনা করে বললেন:
-আপনার জন্যে এই খেলা শোভা পায় না!
-খেলাটা খেললে, আমার অশ্বারোহণবিদ্যাটা পোক্ত হয়। শরীরটা তাগড়া থাকে! আমি জিহাদের প্রস্তুতির জন্যেই শুধু খেলি!
-ও আ্চ্ছা! তাহলে ঠিক আছে!
.
তিনি সাধারন মানুষের মতোই জীবন যাপন করতেন। খাওয়া-দাওয়াও আলাদা কিছু ছিল না। একদিন সঙ্গীকে নিয়ে ঘোড়দৌড়ে বের হলেন। সূর্যকে পেছনে রেখে। দু’জনের ছায়া ছিল সামনে! সাথীকে বললেন:
-চলো! আমরা নিজের ছায়াকে ধরি!
অনেক চেষ্টা করেও ছায়াকে পেছনে ফেলতে পারলেন না। এবার ঘোড়াকে উল্টো দিকে ছোটালেন। সূর্যকে সামনে রেখে। ছায়া পড়লো পেছনে। সাথীকে বললেন:
-চলো! ছায়াটাকে হারিয়ে দিই!
তীব্র গতিতে ঘোড়া ছুটিয়েও ছায়াকে আলগা করতে পারলেন না। দৌড় থামিয়ে দৌড়সঙ্গীকে বললেন:
-ছায়াটাই হলো দুনিয়ার প্রকৃত উদাহরণ!
-কিভাবে?
-তুমি যতই দুনিয়াকে ধরতে যাবে, দুনিয়া ততই দূরে সরে যাবে। আবার তুমি যতই দুনিয়া থেকে নিজেকে আলগ করতে চাইবে, দুনিয়া কিছুতেই তোমার পিছু ছাড়বে না। কবর পর্যন্ত যাবে!
.
তার স্ত্রী ছিলেন ইসমতুদ্দীন খাতুন রহ.। বিদূষী মহিলা। রাত জেগে ইবাদত বন্দেগী করতেন। স্বামী-্স্ত্রী দু’জনে প্রতিযোগিতা দিয়ে শববেদারী করতেন। একরাতে স্ত্রী ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, রাতের নির্দিষ্ট ইবাদত করতে পারেন নি। সকালো স্ত্রীকে ভীষণ মনক্ষুন্ন দেখে জানতে চাইলেন:
-মন খারাপ কেন?
-আজ রাত ইবাদত করতে পারিনি। 
সুলতান আলাদা একটা পদ সৃষ্টি করলেন। তার দায়িত্ব হলো: ঢাক বাজিয়ে তাহাজ্জুদের জন্যে সবাইকে জাগিয়ে দেয়া। তাকে স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি সম্মানী দিতেন। 
.
তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হলো। তিনি সশরীরে আদালতে হাজির হয়ে গেলেন। তিনিই সর্বপ্রথম ‘ন্যায়বিচার কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে তিনি স্বয়ং বিচার করতে বসতেন। সাথে থাকতো চার মাযহাবের বড় বড় ফকীহ!
.
বড় দুঃসাহসী ছিলেন। জিহারে ময়দানে নির্ভিকচিত্তে শত্রুর ব্যুহ ভেদ করে ঢুকে পড়তেন। শায়খ কুতবুদ্দীন নীসাপুরী রহ. তাকে বললেন:
-সুলতান! আপনি কেন এত ঝুঁকি নেন? আপনার নিরাপত্তার সাথে পুরো দেশের নিরাপত্তা জড়িত! দ্বীন ও ইসলামের ভবিষ্যত জড়িত!
-ওহে কুতবুদ্দীন! চুপ করো! তোমার কথাটা, আল্লাহর প্রতি মন্দ ধারনার শামিল! মাহমুদ (নুরুদ্দীন) কে? আল্লাহ ছাড়া কে দ্বীন-ঈমান-ইসলাম রক্ষা করার ক্ষমতা রাখে?
.
তিনিই সর্বপ্রথম দারুল হাদীস প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে হাদীস শিক্ষাদান করা হতো। শুধু আলিমদের সম্মানই করতেন তাই নয়, ছাত্রের মতো তাদের কাছ থেকে শিক্ষাও গ্রহণ করতেন। একবার হাদীসের দরসে গিয়ে শুনলেন:
-নবীজি গলায় তরবারী ঝুলিয়ে সাহাবীদের সামনে এসেছিলেন!
তিনিও এরপর থেকে গলায় তরবারী ঝুলিয়ে রাখতেন। সুন্নাত পালনের উদ্দেশ্যে। 
.
সুলতান ইন্তেকাল করলেন। কিন্তু আল্লাহর ‘সুন্নাত’-এ কোনও পরিবর্তন এলো না। রব্বানী ইস্তেবদাল (পরিবর্তন)-এর ধারায় এবার এলেন:
সালাহুদ্দীন আইয়ুবী রহ. (১১৭৩-১১৯৩)। বর্তমানে ইরাকের তিকরীতে জন্ম। দিমাশকে মৃত্যু। বিশাল ভূখন্ডের অধিপতি, কিন্তু রেখে গেছেন মাত্র একটা স্বর্ণমুদ্রা আর ছত্রিশটা রৌপ্যমুদ্রা। এছাড়া আর কোনও স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি রেখে যান নি। 
আজীবন খ্রিস্টান ও শী‘আদের বিরুদ্ধে লড়ে গেছেন। ক্রুশেডারদের হাত থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস ছিনিয়ে এনেছেন। খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে জিহাদ করেই জীবন পার করে দিয়েছেন। 
.
খুবই ইলমপিপাসু ছিলেন। শাফেয়ী মাযহাব মেনে চলতেন। নিয়মিত কুরআন কারীম তিলাওয়াত করতেন। মুহাদ্দিসীনের কেরামের কাছে গিয়ে হাদীস শুনতেন। 
.
সাতান্ন বছরের জীবনে তিনি নিজের জন্যে খুব কমই ভাবার ফুরসত পেয়েছেন। তার ইন্তেকালের পর, খ্রিস্টানবিরোধী জিহাদে আস্তে আস্তে ভাটা পড়তে থাকে! ফিরিঙ্গিরা আবার উপকূলীয় এলাকায় মাথাচাড়া দিতে শুরু করে। 
.
আইয়ুবী বংশের শাসকরা ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়লো। অবস্থাদৃষ্টে মনে হলো, আবার বায়তুল মুকাদ্দাস হাতছাড়া হবে। মুসলিমদের ইন্দিয়বিলাসী জীবনধারার শাস্তি হিশেবে আল্লাহ তা‘আলা বর্বর মোঙ্গলদেরকে চাপিয়ে দিলেন। মুসলিম বিশ্বকে তছনছ করে দিতে শুরু করলো মোঙ্গলরা। এক পর্যায়ে মনে হতো লাগলো, মক্কা-মদীনাও তাদের হাত থেকে রেহাই পাবে না। 
এমন সঙ্গীন মুহূর্তে আল্লাহ তা‘আলা তার নিজস্ব রীতিতে একজনকে দাঁড় করিয়ে দিলেন:
সাইফুদ্দীন কুতুয রহ.। খ্রিস্টিয় তের শতকের শুরুতে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ১২৬০ সালে ইন্তেকাল করেন। তার শাসনকাল ছিলো খুবই স্বল্প: ১২৫৯-১২৬০। কায়রো ছিলো তার রাজধানী। 
.
মুসলিম উম্মাহর জন্যে তিনি রহমতস্বরূপ ছিলেন। তিনি তুর্কি বংশোদ্ভুক্ত ছিলেন। তাতাররা চারদিক থেকে ঘেরাও করে মিসরের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, এমন সন্ধিক্ষণে কুতুয শাসনভার কাঁধে তুলে নেন। তিনি ছিলেন একজন সত্যিকারের বীর। খালি হাতেই অসম শত্রুর মুখোমুখি হতে পিছপা হন না, এমন অমিততেজা অকুতোভয়। 
.
আইনে জালুতের ময়দানে যুদ্ধ তীব্র আকার ধারন করলে, সুলতানের ঘোড়াটা মারা পড়লো। তিনি খালি পায়েই অটল অনঢ় হয়ে ময়দানে স্থির থাকলেন। সামান্যতম বিচলিত হলেন না। একচুলও পিছু হটলেন না। সহযোদ্ধারা নিজের ঘোড়া দিতে চাইলো। তিনি প্রত্যাখ্যান করে বললেন:
-আমি কাউকে বিপদে ফেলে বেশি সুবিধা নিতে চাই না! 
একটু পর তার জন্যে ঘোড়া নিয়ে আসা হলো। সওয়ার হয়ে আগের মতো বিপুলবিক্রমে জিহাদ শুরু করলেন। তাকে বলা হলো:
-আপনি এতক্ষণ অরক্ষিত ছিলেন! শত্রুরা আপনাকে বাগে পেলে কী পরিণতি হতো? আপনার কারনে ইসলাম ঝুঁকির মুখে পড়তো!
সুলতান উত্তর দিলেন:
-কিছুই হতো না! আমি মারা গেলে জান্নাতের দিকে উড়ে যেতাম! আর ইসলামের কথা বলছো তো! সেটা নিয়ে আমার ভাবনার কিছু নেই! ইসলামের রব আছেন! তিনিই ইসলামকে রক্ষা করবেন! 
সুলতান নুরুদ্দীন রহ. ও সুলতান কুতুযের মন-মেজাযে কী অসম্ভব মিল! আল্লাহর রাস্তার মুজাহিদগন বোধ হয় একই ছাঁচে তৈরী! আল্লাহই ভালো জানেন!
.
ছেলেবেলায় কুতুযের একজন খাদেম ছিলো। একদিন কুতুযের শরীর থেকে উকুন বেছে দেয়ার পর, কুতুয খুশি হয়ে বললেন:
-তুমি কী চাও আমার কাছে?
-তুমি ছোট মানুষ আমাকে কী দিতে পারবে?
-আমি যখন মিসরের শাসক হবো, তখন দিবো!
-তুমি কোথায় আর মিসর কোথায়? আর তুমি কিভাবে মিসরের শাসক হবে?
-আমি নবীজি সা.-কে স্বপ্নে দেখেছি! তিনি আমাকে বলেছেন: তুমি মিসরের শাসক হবে। তাতারদের পরাজিত করবে!
-আমি পঞ্চাশজন ঘোড়সওয়ারী দলের নেতা হতে চাই!
অনেক বছর পর, স্বপ্নটা ঠিকই বাস্তব হয়েছিল। এবং ঘটনার কথক তাজুদ্দীন ইবনুল আসীরকে যথসময়ে পুরষ্কারও দেয়া হয়েছিল!
.
আইনে জালুতে মুসলমানরা অবিশ্বাস্য জয়লাভ করলো। তাতাররা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলো। কুতুয মারা গেলেন। কিন্তু কাজ তখনো অনেক বাকী! তাতাররা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থেকে রয়ে গেছে। ওদিকে খ্রিস্টানরাও মাথাচাড়া দিয়েছে। আসমানী বিধান হিশেবে দাঁড়ালেন উম্মাহর আরেক সিংহ:
-রুকনুদ্দীন বায়বার্স রহ.১২২৩-১২৭৭। চুয়ান্ন বছর বয়েসে ইন্তেকাল করেছেন। শাসন করেছেন: ১২৬০-১২৭৭। 
.
প্রচন্ড শারীরিক শক্তির অধিকারী ছিলেন তিনি। জাতে ছিলেন ককেশীয়। দাস হিশেবে বিক্রি হয়েছিলেন। আস্তে আস্তে মিসরের শাসনক্ষমতায় আরোহন করেছেন। জিহাদের ব্যাপারে, খ্রিস্টানদেরকে নাকানিচোবানি খাওয়ানোর ব্যাপারে তার দম ছিলো অফুরন্ত। 
.
তার আমলেই সংঘটিত হয়, সপ্তম ক্রুশেড। হানাদার ক্রশেডাররা সুলতান বায়বার্সের নাম শুনলেই দুঃস্বপ্ন দেখতে শুরু করতো। আল্লাহর এই তরবারী খ্রিস্টানদের কাছে ত্রাস হিশেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। 
সুলতানের হামলাগুলো হতো প্রচন্ড দুর্বার শক্তিসম্পন্ন। কোনও খ্রিস্টান বাহিনী তার মুখোমুখি হওয়ার অর্থ: সবাই যুদ্ধক্ষেত্রেই যবেহ হয়ে যাওয়া। শত্রুদের পুরো বাহিনীকে তিনি দুমড়ে মুচড়ে খানখান করে দিতেন। খ্রিস্টান শক্তিকে তিনি জনমের মতো চরম শিক্ষা দিয়ে ছেড়েছিলেন। 
.
সুলতান তার দায়িত্ব পালন করে জান্নাতে চলে গেলেন। তার অবর্তমানে আবার খ্রিস্টানরা মাথাচাড়া দিতে শুরু করলো। এবার ঝান্ডা উঁচিয়ে ধরতে এলেন:
আলমানসুর কালাউন রহ. ১২২২-১২৯০। তিনি শাসন করেছেন বারো বছর ১২৭৯-১২৯০। তিনি ছিলেন অনতম সেরা মামলুক সুলতান। খ্রিস্টান হানাদারদের তিনি প্রায় সমূলে বিনাশ করে ছেড়েছিলেন। 
.
আল্লাহ তা‘আলা এভাবেই পালাবদল ঘটান। আরবরা নেতৃত্বগুণ হারিয়ে ফেলেছিল। উমাইয়া ও আব্বাসী খিলাফাহ অধীনে থেকে থেকে তাদের তনুমনে জং ধরে গিয়েছিল। আল্লাহ তা‘আলা তাদের বদলে নিয়ে এলেন: একদল আনকোরা চনমনে মুসলিমকে! ককেশীয় তুর্কি কুর্দি মুসলিম। 
.
বর্তমানেও বিশ্বপরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করলে ধরা পড়ে। মধ্যপ্রাচ্যের হাল-হাকীকত খেয়াল করলে আল্লাহর সুন্নাহ অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে ওঠে:
= অলস জিহাদবিমুখ জাতি মানেই ‘পচা জাতি’। আল্লাহর খাতায় ‘বাতিল জাতি’! অকেজো জাতি! অশুদ্ধ জাতি! 
এমন পরিস্থিতিতেই আল্লাহ তা‘আলা নতুন দল সৃষ্টি করেন। যারা পৃথিবীর বুকে খিলাফাহ কায়েম করবে। নবীজি সা.-এর আদর্শে কুরআনী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবে!
 = আল্লাহ এভাবেই সত্য ও মিথ্যার দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেছেন। যা ফেনা, তা তো বাইরে পড়ে নিঃশেষ হয়ে যায় আর যা মানুষের উপকারে আসে তা জমিতে থেকে যায়। এ রকমের দৃষ্টান্ত আল্লাহ বর্ণনা করে থাকেন!
.
আমরা নিজেরা যাচাই করে দেখতে পারি:
-আমি কোন দলে! খবীস (অকেজো) দলে নাকি তাইয়িব (কেজো) উত্তম দলে? 
আমি যদি বাতিল দলভুক্ত হই, তাহলে দল পরিবর্তন করা অতিআবশ্যক! আল্লাহর ডাক নতুন দলের দিকেই! যারা কুফুর-তাগুতের বিরুদ্ধে জানবাজির সাথে লড়বে! আমি সাড়া দিলে কী হবে?
= কল্যাণ তাদেরই জন্যে, যারা তাদের রাবের ডাকে সাড়া দিয়েছে। আর যারা তার ডাকে সাড়া দেয়নি, তাদের কাছে যদি দুনিয়ার সমস্ত জিনিসও থাকে এবং তার সমপরিমাণ আরও, তবে তারা (কিয়ামতের দিন) নিজেদের প্রাণ রক্ষার্থে তা সবই দিতে প্রস্তুত হয়ে যাবে। তাদের জন্যে রয়েছে কঠিন হিশেব এবং তাদের ঠিকানা জাহান্নাম; তা বড় মন্দ ঠিকানা!
.
আমি আমার ঠিকানা কোনটা বেছে নেবো? 
ক: জান্নাত?
খ: জাহান্নাম?
= আমার কাজই প্রমাণ করবে আমি কোনটা নিলাম! তাহলেই অামি হবো: লা-ইয়াকূনু আমসা-লুকুম (তারা তোমাদের মতো হবে না)-এই অায়াতের সম্বোধিত! আমি হবো অনন্য! আমার রবের কাছের! আমার রবের প্রিয়!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন