মঙ্গলবার, ১৭ জানুয়ারী, ২০১৭

জীবনসায়া‎হ্নের উপলব্ধি!

Atik Ullah


দ্বিতীয় আব্বাসী খলীফা। তাকেই মনে করা হয় আব্বাসী খিলাফতের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা। প্রথম খলীফা তারই হওয়ার কথা ছিল। প্রথম খলীফা ছিলেন আবুল আব্বাস ছিলের বয়েসে ছয় বছরের ছোট। 
.
আব্বাসী আন্দোলনের নেতা ছিলেন বড় ভাই ইবরাহীম বিন মুহাম্মাদ। ইবরাহীমকে শেষ উমাইয়া খলীফা মারওয়ান বিন মুহাম্মাদ গ্রেফতার করেছিলেন। বন্দী থাকাবস্থায় তিনি ইন্তেকাল করেন। ইবরাহীম আব্বাসী আন্দোলনের দায়িত্ব দিয়ে যান ছোট ভাই আবুল আব্বাসকে। 
বড় ভাই আবু জা‘ফরকে ডিঙিয়ে ছোট ভাই আবুল আব্বাসকে দায়িত্ব দেয়ার কারন হলো: 
= আবু জা‘ফর ছিলেন দাসীর ছেলে আর আবুল আব্বাস ছিলেন স্বাধীন আরব নারীর সন্তান। 
.
বর্তমান বাগদাদের প্রতিষ্ঠাতা হলেন আবু জা‘ফর মানসুর। তিনি অত্যন্ত ধার্মিক ছিলেন। তার দরবারে কোনও কোনও কবি-সাহিত্যিক সমাদৃত ছিলো না। কল্পনাবিলাসনির্ভর শিল্প-সাহিত্যের জন্যে আবু জা‘ফর এক কানাকড়িও খরচ করতেন না। এসবকে তিনি অপচয় মনে করতেন। যুগের অলস কবিরা এজন্য আড়ালে-আবডালে খলীফা মনসুরকে ‘কিপটে’ বলতো। 
.
অত্যন্ত কর্মমুখর আর পরিশ্রমী ছিলেন। অনাড়ম্বর জীবন-যাপন করতেন। এমনকি তালিদেয়া জামা গায়ে দেয়ার নজীরও তার আছে। একজন খলীফা তালিযুক্ত জামা পরার ঘটনা বিরল! পাশাপাশি তার কঠোর স্বভাবের কারনে ইমামে আযমের মতো মানুষকেও তিনি নির্যাতন করতে ছাড়েননি। এ-এক দ্বৈত মানসিকতা! তিনি অনেকটা চরম একনায়কতান্ত্রিক স্বভাবের ছিলেন। তিনি হজ্জের সফরে থাকাবস্থায় ইন্তেকাল করেছেন। ইন্তেকালের আগে তিনি একটা অমর উক্তি করে যান:
= প্রকৃত বাদশাহ তো তিনি, যার মৃত্যু নেই। যিনি অমর!
স্বগতোক্তিটাতে আক্ষেপ আছে আবার আত্মসমর্পণও আছে। 
.
(দুই) মু‘আবিয়া বিন ইয়াযিদ রহ.। ৬৬৪-৬৮৪ খ্রিস্টাব্দ। 
উমাইয়া বংশের তৃতীয় খলীফা। তার শাসনকাল অতি স্বল্প: কারো মতে তিন মাস। কারো মতে চল্লিশ দিন। তারপর তিনি স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ছেড়ে দেন। 
.
ক্ষমতা ছাড়া নিয়েও অবশ্য ভিন্নমত আছে। কারো কারো মতে তিনি ক্ষমতার প্রতি বিতস্পৃহ হয়ে সব ত্যাগ করেছিলেন। মতান্তরে অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তাকে প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল:
-আপনি একজন উত্তরসূরী নির্ধারন দিন!
-আমি জীবদ্দশাতেই তোমাদের খিলাফত উপভোগ করতে পারিনি, কাউকে দায়িত্ব দিয়ে আমি মৃত্যুর পর সেটার সাজা ভোগ করতে রাজি নই! তোমরা ক্ষমতাকে মিষ্টি মনে করো, আমি ক্ষমতাকে তিক্ত মনে করি! আমার মৃত্যুর বনু উমাাইয়া ক্ষমতার চিনি উপভোগ করবে আর আমি কবরে বসে বসে সেটার সাজা ভোগ করতে থাকবো, এটা হতে পারে না!
ছেলের এহেন জবাব শুনে মা ক্ষেপে গিয়ে বললেন:
-তোর মুখে এমন কথা শোনার চেয়ে তোকে জন্ম না দেয়াই আমার জন্যে ভালো ছিল!
.
উমাইয়া বংশে এমন নির্লোভ মানুষ সত্যি সত্যি বিস্ময়কর! মাত্র বাইশ বছর বয়েসে তিনি ইহজগত ত্যাগ করেন। 
.
(তিন) আবদুল্লাহ আলমামুন (৭৮৬-৮৩৩)। 
সপ্তম আব্বাসী খলীফা। সবচেয়ে বিতর্কিত খলীফাও বটেন। ইন্তেকাল করেছিলেন জিহাদের ময়দানে। জ্বরাক্রান্ত হয়ে। ইমাম আহমাদ রহ.-কে নির্যাতন করা তার জীবনের এক চরমতম কালো অধ্যায়। 
তিনি ক্ষমতায় ছিলেন বিশ বছর (৮১৩-৮৩৩)। দীর্ঘদিনের শাসন শেষে মৃত্যুর সময় তার মুখ দিয়ে হাহাকার বের হলো:
-হে অবিনশ্বর ক্ষমতার মালিক! এই অসহায় নশ্বর ক্ষমতার নগন্য মালিকের প্রতি দয়া করুন! হে চিরন্তন অমর সত্ত্বা! এই মর সত্ত্বার প্রতি রহম করুন!
কী দোর্দন্ড প্রতাপশালী! আর মৃত্যুর কাছে কী অসহায় আত্মসমর্পন!
.
(চার) হারুন ওয়াসেক বিল্লাহ। তাকে দ্বিতীয় হারূনও বলা হয়। তিনি নবম আব্বাসী খলীফা ৮১৬-৮৪৭। তার শাসনকাল ছিলো: ছয় বছরের কিছু কম ৮৪২-৮৪৭। তিনিই ছিলেন শক্তিমান আব্বাসী খলীফাদের শেষ প্রতিনিধি। তারপর থেকেই শুরু হয়েছে দুর্বল খলীফাদের শাসনকাল। 
.
মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এলে, তিনি বললেন:
-বিছানাটা উঠিয়ে নাও!
বিছানা ওঠানো হলো। তিনি নিজের গন্ডদেশ মাটিতে ঠেকিয়ে বললেন:
-হে অন্তহীন ক্ষমতার মালিক! আমার প্রতি রহম করুন! আমার ক্ষমতা সসীম আপনার ক্ষমতা অসীম!
(পাঁচ) আহমাদ মু‘তাদিদ বিল্লাহ (৮৫৬-৯০৩)। তার শাসনকাল ছিলো দশ বছর। ৮৯২-৯০৩। তিনিই প্রথম আব্বাসী খলীফা, যার পিতা খলীফা ছিলো না। অবশ্য প্রথম দুই খলীফা আবুল আব্বাস ও আবু জা‘ফরের পিতাও খলীফা ছিলেন না। 
মু‘তাদিদকে দ্বিতীয় সাফফাহ বলা হয়। আগের খলীফা ছিলেন তার আপন চাচা। দুর্বল যুগের খলীফা হলে কী হবে, তিনি অত্যন্ত দাপুটে খলীফা ছিলেন। কোথাও সামান্যতম বিশৃঙ্খলা দেখা দিলেই সেটা কঠোর হস্তে দমন করেছেন। এতদিন খলীফারা ছিলেন ‘তুর্কিদের’ হাতের ক্রীড়নক! তুর্কিদের কথাতেই খলীফারা উঠতো-বসতো! এছাড়া উপায় ছিলো। 
.
চাচা মু‘তামিদের আমল থেকেই তুর্কিদের প্রভাব খর্ব হতে শুরু করে। মু‘তামিদ আলাল্লাহ খলীফা হলেও, শাসনকার্য মূলত পরিচালনা করতেন তার আপন ভাই: তালহা মুআফাক! তলহা ছিলেন অত্যন্ত যোগ্য ও প্রজ্ঞাবান সেনাপতি ও রাজনীতিবিদ! তিনিই ভাইয়ের পাশে থেকে তুর্কিদেরকে হটিয়ে দেন!
.
ভাইয়ের সহযোগিতার প্রতিদান দিলেন ভাতিজা মু‘তাদিদকেকে নিজের স্থলাভিষিক্ত করে। তখন থেকে আব্বাসী খিলাফা নবজীবন লাভ করেছিল। মু‘তাদিদ ছিলেন অত্যন্ত বীরপুরুষ! একবার শুধু তরবারী দিয়ে একা একাই একটা সিংহকে কুপোকাত করেছিলেন। আরো অদ্ভুত ব্যাপার হলো, এতবড় দুঃসাহসিক কাজ করেও, দরবারে ফিরে এ-নিয়ে টু-শব্দও করেন নি। যেন কিছুই হয় নি। 
.
পুরো খিলাফাহ জুড়ে আদল-ইনসাফ কায়েম করেছেন। বাগদাদে রাজধানী ফিরিয়ে এনেছেন। অন্যায় কর-ট্যাক্স রহিত করেছেন। শী‘আদের যাবতীয় রসম-রেওয়াজ বন্ধ করেছেন। জাদু-ভাগ্যগণনা-মিথ্যাগল্পবলা নিষিদ্ধ করেছেন। ছয় তাকরীর দিয়ে নিজে ইমামতি করে ঈদুল আজহার নামায আদায় করেছেন। দর্শন বিষয়ক কিতাবাদি বিক্রি নিষিদ্ধ করেছেন!
মাত্র ৪৮ বছর বয়েসে রোগেভুগে মারা গেছেন। তিনি ইন্তেকালের সময় কিছু কবিতা পড়েছিলেন:
= আমি বড় বড় বাহাদুরকে হত্যা করেছি, আমি কোনও দুশমনকে ছেড়ে কথা বলিনি! আমি কারো ফাসাদকে আশকারা দিইনি। আমি খিলাফাহকে সব ধরনের বিরোধী থেকে মুক্ত করেছি। শত্রুদেরকে পূর্ব-পশ্চিমে হটিয়ে দিয়েছি। এসব করতে করতে যখন আমি সবাইকে আমার অনুগত করেছি, উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করেছি, তখনই মৃত্যু আমার দিকে এক অব্যর্থ তীয় ছুঁড়ল! আমার এখন অন্ধকার গর্তে গিয়ে পড়তে হবে!
.
(ছয়) হাজ্জাজ বিন ইউসুফ (৬৬১-৭১৪)। ইসলামী ইতিহাসের অন্যতম বিতর্কিত ব্যক্তি। উরওয়া বিন মাসউদ রা. ছিলেন তার মায়ের দাদা। একজন সাহাবীর নাতি হিশেবে হাজ্জাজের শুরুটা বেশ ভালই ছিল। শিশুদেরকে কুরআন হাদীস শিক্ষা দিতো। নিজের জন্মভূমি তায়েফে। 
.
আজীবন জুলুম-অত্যাচার করেই নিজের শাসনকার্য পরিচালনা করে গেছে। তবে মানুষটার মধ্যে কিছু ভাল গুণও ছিলো। সবচেয়ে সেরা গুণ বোধ হয়:
-কুরআন কারীমের প্রতি মানুষটার অসম্ভব মমতা! 
নিজ উদ্যোগে কুরআন কারীমের অনেক খেদমত আঞ্জাম দিয়েছে লোকটা। হাজার-হাজার মানুষকে যবেহ করার কলংক না থাকলে, মানুষটা ইসলামী ইতিহাসে, সাল্লাহুদ্দীন আইয়ুবী রহ.-এর চেয়ে কম বরিত হতো না! 
.
কুরআন কারীমের এই খিদমতের কারনে তার প্রতি কিঞ্চিত দুর্বলতা বোধ করা অন্যায় কিছু নয়। আর শেষবিচারের মালিক তো আল্লাহ তা‘আলা! 
যাক, এই জাঁদরেল উমাইয়া সামরিক প্রশাসকও মৃত্যুর সময় বড়ই অসহায় হয়ে পড়েছিলো। সেই যুগে হাজ্জাজকে কেউ কেউ ‘যমানার ফেরআওন’ বলে আখ্যায়িত করতেও কসুর করতো না। কিন্তু এটা ঠিক নয়। যত যা-ই হোক, একজন মুমিন আর একজন কাফির কিছুতেই এক হতে পারে না। 
.
হাজ্জাজের মৃত্যুযন্ত্রণা উপস্থিত হলো। চরম আকার ধারন করলো তার শেষ মুহূর্তের কষ্ট! তার এই কষ্টের কথা শুনে একজন বললো:
-আজ তোমার মুক্তিও নেই, মুক্তির ফরিয়াদও নেই!
কথাটা হাজ্জাজের কানে গেলে, হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। আকাশের দিকে মুখ তুলে বললো:
-ইয়া আল্লাহ! আমাকে মাফ করে দিন! লোকজন বলছে, আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন না! আপনি আমাকে ক্ষমা না করলে, আমার ধ্বংস অনিবার্য!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন