শুক্রবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

কুরবানীঃ ত্যাগের মহিমায় প্রেরণা যোগায়

মুনির আহমদ

আদিকাল হতেই কুরবানীর রীতি চলে আসছে। হযরত আদম (আ.)এর পুত্রদ্বয় হাবিল ও কাবিল এক বিশেষ ব্যাপারে ফলাফল নির্ণয়ের জন্য যথাক্রমে হাবিল একটি হৃষ্টপুষ্ট দুম্বা এবং কাবিল কিছু শস্য কুরবানী স্বরূপ পেশ করেছিলেন। হাবিলের কুরবানী কবুল হল। আসমান থেকে একটি অগ্নি শিখা এসে হাবিলের দুম্বা ভস্ম করে দিল। আর কাবিলেরটা কবুল হল না, তার শস্য আসমানী আগুন জ্বালালো না। সে সময় কুরবানী কবুল হওয়া না হওয়ার এরূপ নিশানাই সাব্যস্ত ছিল।হযরত ইব্রাহীম (আ.)কে আল্লাহ্ তাআলার পক্ষ থেকে বহু রকমের পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয় এবং তিনিও প্রতিটি পরীক্ষায় চরম কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়েছেন। ফলে তিনি মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে ‘খলিলুল্লাহ্ (আল্লাহর অন্তরঙ্গ বন্ধু)’ উপাধীতে ভূষিত হন। মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে হযরত ইব্রাহীম (আ.) তাঁর প্রাণাধিক প্রিয় ছেলে হযরত ইসমাঈল (আ.)কে কুরবানী করতে আদিষ্ট হয়ে সকল স্বার্থ দ্বন্দ্বের ঊর্ধ্বে উঠে, সকল মায়া-মুহাব্বত বিসর্জন দিয়ে হুকুমের যথার্থ তা’মীল করেছিলেন। ফলে ইরশাদে ইলাহী নাযিল হয়, “ক্বাদ সাদ্দাকতার রুইয়া…” অর্থাৎ- ‘হে নবী! আপনি স্বপ্নের আদেশকে যথানুরূপ বাস্তবায়ন করেছেন। তাঁর কর্তব্য পরায়ণতা, খোদাভক্তি ও নিষ্ঠার চরম পরাকাষ্ঠা প্রত্যক্ষ করে মহান আল্লাহ্ খুশী হয়ে বেহেশতি দুম্বা পাঠিয়ে দেন। ইসমাঈল (আ.)এর পরিবর্তে দুম্বা কুরবানী হয়। তাই আজ কুরবানীর নামে হযরত ইব্রাহীম (আ.)এর ত্যাগ-তিতিক্ষা, সংগ্রাম-সাধনা ও প্রেম-নৈকট্যের দৃষ্টান্ত ও আত্মত্যাগ নিয়ে প্রতি বছর বিশ্ব মুসলিম আল্লাহর দুয়ারে সমাগত হয়। সুতরাং আমাদের মাঝে হযরত ইব্রাহীম (আ.)এর চরম আত্মত্যাগ অবিস্মৃত স্মৃতিরূপে ভাস্কর হয়ে আছে। সাথে সাথে আল্লাহ্ তাআলা পরবর্তীদের জন্য সেই কুরবানীকে একটি পালনীয় রীতি হিসেবে সাব্যস্ত করেন। ইরশাদ হচ্ছে- “ফাত্তাবিউ মিল্লাতা ইব্রাহীমা হানীফা” অর্থাৎ- ‘একনিষ্ঠভাবে তোমরা ইব্রাহীমী মিল্লাতের অনুসরণ কর।’ (সূরা আলে ইমরান- ৯৫)। মোটকথা, ‘কুরবানী’ হচ্ছে ত্যাগ-তিতিক্ষা প্রদর্শনের মাধ্যমে মাহান আল্লাহর অধিক নৈকট্য ও সান্নিধ্য অর্জনের অনন্য সোপান। কুরবানীর মাধ্যমে বান্দা স্বীয় খাহেশাতকে বিসর্জন দিয়ে মহান আল্লাহর সমীপে আত্মনিবেদন পূর্বক তাঁর আদেশ সম্পর্কিত হুকুম পালন করতঃ তাঁর নৈকট্য লাভে অগ্রসর হয় বিধায় এটিকে ‘কুরবান’ নামে নামকরণ করা হয়েছে। লক্ষণীয় যে, হযরত ইসমাঈল (আ.) যবেহ না হলেও হযরত ইব্রাহীম (আ.)এর আন্তরিকতা ও পূর্বাপর সকল প্রস্তুতিকেই আল্লাহ্ তাআলা ‘বাস্তবায়ন’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে তা কবুল করেছেন। বস্তুতঃ আল্লাহ্ তাআলা তো দেখেন মানুষের আন্তরিকতাময় ইচ্ছাকে।প্রতি বছর আমরা যে পশু কুরবানী করছি, তার গোশত তো আমরাই খাচ্ছি। তার চামড়া-হাড় দ্বারা তো আমারাই উপকৃত হচ্ছি। কুরবানীর পশুর কোন কিছুই আল্লাহর কাছে পৌঁছে না। তাহলে এই কুরবানীর উদ্দেশ্য কি? কালামে পাকে ইরশাদ হচ্ছে, “লাঁই ইয়ানালাল্লাহা লুহুমুহা ওলা দিমাউহা ওলা কিন ইয়ানালাল্লাহুত্ তাক্বওয়া মিনকুম”। অর্থাৎ-‘ কুরবানীর পশুর গোস্ত আল্লাহ্ তাআলার কাছে পৌঁছে না, পৌঁছে  না তার রক্ত। তবে তোমাদের তাক্বওয়াই তাঁর কাছে যায়। (সূরা হজ্ব- ৩৭)। আল্লাহ্ তাআলা পরীক্ষা নেন কেবল আমাদের মনোবৃত্তিরই। কিন্তু আজ আমাদের সামাজের দিকে তাকালে কি দেখতে পাই? আমারা দেখতে পাই, কুরবানীকে যেন গোশত ভক্ষণের এক মহোৎসব মনে করা হয়। সমাজের যারা সম্পদশালী, তারা যেন কুরবানীর পশু ক্রয় করতে এক রকম প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হন। কে কত চড়া দামে পশু ক্রয় করবেন, এটাই হয়ে উঠে মূখ্য বিষয়। আর যারা অপেক্ষাকৃত অসচ্ছল, দরিদ্র, তারা ঈদুল আযহা আসলেই এক মহাচিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। তারা কুরবানী না দিতে পারায় মনো বেদনায় ব্যথিত হন। নিজেদের সমর্থহীনতার কথা বিবেচনা করা হয় না; বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে শুধু সামাজিকতা মেইনটেন করার জন্য কুরবানী করা হয়। এমন কি তারা কুরবানী করার জন্য ঋণ পর্যন্ত করতেও বাধ্য হয়। জিজ্ঞেস করলে বলে- সবাই দিচ্ছে, আমি দিব না; এটা কেমন হয়। তাছাড়া বাড়ীতে স্ত্রী-পরিজন নিয়ে গোশত খাওয়ার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হতে হয়। সাত ভাগে কুরবানী দেওয়া যায়। সাতভাগে কুরবানী দেয়ার ক্ষেত্রে আমাদের নিয়্যাতের কতটা নিষ্ঠতা থাকে, তা ভাবার বিষয়। যে সমাজে দুই জন লোক এক হতে পারে না, ভাই ভাই দ্বন্দ্ব-কলহ্ লেগেই থাকে। ফলে সাত ভাগের কুরবানীর ক্ষেত্রে গোশত ভাগ বণ্টনের সময় দেখা যায় তুমুল বাক বিতন্ডা। এতে গোশ্ত ভক্ষণের উদ্দেশ্যটাই যেন ফুটিয়ে তোলা হয়। অথচ একমাত্র মহান আল্লাহর হুকুম তা’মিল ও তাঁকে রাজি-খুশী করার জন্যই কুরবানী দেয়ার ব্যাপারে সবার নিয়্যাত এক থাকা অপরিহার্য। না হলে কুরবানী হবে না। অথচ আমরা ক’জনই বা সেদিকে লক্ষ্য রাখি! কিন্তু যদি হযরত ইসমাঈল (আ.)এর যবেহই মঞ্জুরে ইলাহী হত এবং হযরত ইব্রাহীম (আ.)এর হাতে তাঁর কুরবানী হত, আর সেই আমলের পরম্পরায় আমাদের প্রাণাধিক প্রিয় সন্তানদেরকে যবেহ করার হুকুম হত, তা কত কঠিন ব্যাপারই না ছিল! তথাপি মুসলমান হিসেবে জীবন যাপন করলে আমাদের তা পালন করতেই হত। এ ক্ষেত্রে পরম করুণাময় আল্লাহ্ আমাদের উপর বড় মেহেরবানী করেছেন যে, তিনি পশু কুরবানীকে তার স্থলাভিষিক্ত করেছেন। তাই ইব্রাহীমী কুরবানীর স্মৃতি গাঁথা ইতিহাস থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। খলীলী ইশকের দীক্ষায় উজ্জিবিত হয়ে আহকামে ইলাহীর সামনে নিজের খাহেশাত বা কামনা বাসনাকে কুরবান করতে হবে। সর্বান্তকরণে নিজেকে সঁপে দিতে হবে ইসলামের তরে। প্রকৃতপক্ষে কুরবানী হচ্ছে ত্যাগের এক সমুজ্জল দৃষ্টান্ত। বলাবাহুল্য, পশু কুরবানী তো একটি প্রতিকী আমল। এর অন্তর্নিহিত কৃতজ্ঞতা-ই একে অর্থবহ করে তুলেছে। কারণ, আল্লাহর জন্য সবচেয়ে প্রিয় বস্তু বিসর্জন দেয়ার মধ্য দিয়েই কুরবানীর সূচনা হয়। তাই কুরবানীর প্রক্কালে সর্বাগ্রে নফ্সানী খাহেশাত, প্রবৃত্তি, লোভ-লালসা ও দুনিয়ামুখিতার গলায় ছুরি চালাতে হবে। নিজের মনের খেয়াল খুশিতে নয়, বরং আল্লাহ্ ও রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশ মোতাবেক সাহাবায়ে কেরামের অনুসৃত পথে চলার সংকল্প করতে হবে। যে কোন পরিস্থিতিতে আল্লাহর ভয় ও আখেরাতের জবাবদিহিতার আশঙ্কায় সর্বপ্রকার অনৈসলামিক বা মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। মানুষ যেখানে সারাক্ষণ নিজের সামান্য কামনা-বাসনা চরিতার্থ করার জন্য, নিজের চাহিদা পূরণের জন্য যে কোন রকম ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত থাকে, সেখানে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর নির্দেশ পালন কল্পে, তাঁর রহ্মতের দারে কড়া নাড়ার জন্য, তাঁর দয়া দৃষ্টি নিজের দিকে আকর্ষণ করার জন্য ত্যাগ স্বীকার করে সর্বোচ্চ কুরবানী করতে হবে। এ ত্যাগ এ কুরবানী পশু কুরবানী থেকে শুরু করে আত্মোৎসর্গ পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত। খোদাভীতির সামনে পরিবেশ পরিস্থিতি, সমাজ সংস্কার আর পার্থিব ভয়-ভীতিকে এবং আল্লাহ্ ও রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভালবাসার সামনে মানুষের সহায় সম্পদ পরিবার পরিজন এবং নিজের জীবনের ভালবাসাসহ অন্যান্য যাবতীয় প্রেম-ভালবাসাকে উৎসর্গ করতে সর্বদা প্রস্তুত থাকতে হবে। আল্লাহর হুকুম পালনে হযরত ইব্রাহীম (আ.) যেরূপ প্রবল মনোবল নিয়ে অগ্রসর হয়েছিলেন, ইবলীস শয়তানও তত কঠোর প্রতিরোধ নিয়ে বাঁধা দিয়েছিল। কিন্তু শয়তান তাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করতে ব্যর্থ হয়েছিল। তিনি রমিয়ে জিমার (পাথর নিক্ষেপ) করে শয়তানকে বিতাড়িত করেছিলেন। যার স্মৃতি আজ হজ্বের আমল হিসেবে গন্য। আর মরদুদ শয়তান পরাস্ত হয়ে চির লাঞ্ছনা কুড়িয়েছে। আজ মীনা প্রান্তরের সেই ‘জমরাত’ জগৎকে বুঝিয়ে দিচ্ছে যে, প্রকৃত মু’মিনের নিকট শয়তানী চক্রান্ত অতি তুচ্ছ এবং প্রস্তরাঘাতে দূরে নিক্ষিপ্ত হওয়ার যোগ্য। ঐ স্তম্ভ জগদ্বাসীকে বলছে যে, যে কোন প্রকার সৎকাজে অগ্রসর হওয়ার সময় যদি শয়তান কোন প্রকার বাঁধার সৃষ্টি করে, তাহলে আল্লাহর এ ক’জন সেরা নবীর নিদর্শন স্মরণ করে তওবা স্বরূপ ভীষণ প্রস্তরাঘাতে তাকে ক্ষত-বিক্ষত করে অনেক দূরে নিক্ষেপ কর। আল্লাহর আদেশ পেয়ে হযরত ইব্রাহীম (আ.) পার্থিব মায়া পরিত্যাগ করে প্রাণপ্রিয় পুত্রের গলায় ছুরি চালিয়ে ছিলেন। অনুরূপভাবে আমাদেরকেও প্রকৃত মুসলমান হতে হলে কিভাবে শত প্রেম ভালবাসা, মায়া-মুহাব্বাত ছিন্ন করে, শত বাধাবিঘ্ন, শয়তানী কুচক্র পদদলিত করে কঠোর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়, আর কিভাবেই বা পরম দয়ালু আল্লাহ্ তাআলা তাঁর সন্তুষ্টির জন্য লালায়িত বান্দাকে শত সহস্র বিপদ হতে অচিন্তনীয় ভাবে সম্পূর্ণ রূপে রক্ষা করেন, কুরবানী তাই শিক্ষা দেয়। আজও কুরবানীর ব্যাপারে শয়তান ওয়াসওয়াসা দিয়ে প্রতিরোধে তৎপর হয়। কিন্তু মিল্লাতে ইব্রাহীমির ধারক আল্লাহর খাঁটি মুসলমান বান্দাগণ শয়তানকে পরাজিত করে আল্লাহর হুকুম বাস্তবায়ন করেন। তথাপি শয়তান কতক লোককে তার দলে ভিড়াতে সক্ষম হয়। তাদের কেউ শয়তানী প্ররোচণায় কুরবানী দ্বারা কেবল নাম কামনার ধান্ধায় থাকে। আবার কেউ ওয়াজীব দায়িত্ব আদায়ে অনীহা দেখায়। উপরন্তু অনেকে কুরবানীকে নির্মম পশু হত্যা ও অপচয় বলে ধৃষ্টতাপূর্ণ উক্তি পর্যন্তও করে বসে। ইসলাম তো হচ্ছে সবান্তকরণে আল্লাহর সমীপে আত্মনিবেদন করার নাম। আল্লাহর বান্দারা আল্লাহর সৃষ্টি পশু কুরবানী করবে, এতে সংকীর্ণমনা হওয়ার আবকাশ নেই। এ ব্যাপারে যারা বিরূপ উক্তি করে, তাদের অনেকে ইসলামী নামের অধিকারী হলেও মূলতঃ তারা ধর্মদ্রোহী নাস্তিক মুরতাদদের কাতারেই তাদের অবস্থান আবিষ্কার করা উচিত। ঈদুল আযহার পশু কুরবানী যেহেতু আল্লাহর আদেশ পালন ও ইবাদত; তাই এক্ষেত্রে মনে কোন সংকীর্ণতার স্থান দেয়া জায়েয নেই। বরং স্বতঃস্ফূর্তভাবে আল্লাহর এ হুকুম পালন করতে হবে। তাই তো এ দিনের নাম ‘ঈদ’ রাখা হয়েছে। অর্থাৎ, এটি কুরবানী তথা আল্লাহর হুকুম পালন করতে পারার খুশির দিন। মূলতঃ হযরত ইব্রাহীম (আ.) যেমন কঠিন পরীক্ষার মুহূর্তে প্রমাণ করেছিলেন, “ইন্নাসালাতি ওয়া নুসুকি ওয়ামাহ্ ইয়াইয়া ওয়া মামাতী লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন” অর্থাৎ- “আমার নামায, আমার কুরবানী, আমার জীবন, আমার মরণ সবই বিশ্ব পালনকর্তা মহান আল্লাহর জন্যই নিবেদিত।” (সূরা আন্আম- ১৬২)। আমাদেরকেও কুরবানীতে ঐ আদর্শই অনুসরণ করতে হবে। ‘কুরবানী’ প্রতি বছর আসে যায়, আমাদের বারবার ত্যাগের মহিমায় উজ্জীবিত করে। সারা বছরের কর্মতৎপরতায় কুরবানীর শিক্ষাকে ধারণ করে রাখাই সচেতন ধার্মিকের কাজ। সুতরাং, আসুন! আমরা কুরবানীর  শিক্ষায় উজ্জীবিত হয়ে ত্যাগের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করি। আল্লাহর অধিক নৈকট্য ও সান্নিধ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে নিজেকে সর্বান্তকরণে সঁপে দেই ইসলামের তরে। আল্লাহ্ আমাদের তাওফীক দান করুন। আমীন॥

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন