ইসলামী শরিয়তে প্রাণীর ছবি আঁকা বা বানানো দুটোই কবিরা গুনাহ । পবিত্র হাদিসে এ সম্পর্কে সুস্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। বিস্তারিত নিম্নরূপ –
বুখারি এবং মুসলিম শরিফ সহ বেশ কিছু হাদিসের কিতাবে প্রাণীর ছবি আঁকা বা বানাতে নিষেধাজ্ঞা সূচক যেসব শব্দ বিধৃত হয়েছে সেসব শব্দের প্রকৃত মর্মার্থ সুস্পষ্ট হওয়ায় কোনো ধরণের বেঁকিয়ে ব্যাখ্যা দেয়ার সুযোগ রয়নি। হাদিসে পাকে “আল-মুছাওয়িরূন” ﺍﻟﻤﺼﻮﺭﻭﻥ তথা ছবি নির্মাতাগণ— এরকম শব্দ উল্লেখপূর্বক ঘোষণা দেয়া হয়েছে এ বলে যে, “কেয়ামতে ছবি নির্মাতাগণ কঠিন শাস্তি ভোগ করবে।” (মা’আজাল্লাহ)।
হাদিস শরিফ : ১
.
হাদিসে এসেছে, যারা প্রাণীর ছবি অাঁকে, নির্মাণ করে ও রাখে; কেয়ামতের দিন তাদের কঠিন শাস্তি হবে :
ﻗﺎﻝ ﺣﺪﺛﻨﺎ ﺍﻻﻋﻤﺶ ﻋﻦ ﻣﺴﻢ ﻗﺎ ﻛﻨﺎ ﻣﻊ ﻣﺴﺮﻭﻕ ﻓﻰ ﺩﺍﺭ ﻳﺴﺎﺭﺑﻦ ﻧﻤﻴﺮ ﻓﺮﺍﻯ ﻓﻰ ﺻﻔﺘﻪ ﺗﻤﺎﺛﻴﻞ ﻓﻘﺎﻝ ﺳﻤﻌﺖ ﻋﺒﺪ ﺍﻟﻠﻪ ﻗﺎﻝ ﺳﻤﻌﺖ ﺍﻟﻨﺒﻰ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ ﻳﻘﻮﻝ ﺍﻥ ﺍﺷﺪ ﺍﻟﻨﺎﺱ ﻋﺬﺍﺑﺎ ﻋﻨﺪ ﺍﻟﻠﻪ ﺍﻟﻤﺼﻮﺭﻭﻥ.
অর্থাৎ হযরত আ’মাশ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হযরত মুসলিম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি মাসরুক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এর সঙ্গে ইয়াসার ইবনে নুমাইরের ঘরে ছিলাম, তিনি তাঁর ঘরের মধ্যে প্রাণীর ছবি দেখতে পেলেন। অতঃপর বললেন, আমি হযরত আব্দুল্লাহর নিকট শুনেছি, হুযূরপাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “নিশ্চয় মানুষের মধ্যে ঐ ব্যক্তিকে আল্লাহপাক কঠিন শাস্তি দেবেন, যে ব্যক্তি প্রাণীর ছবি নির্মাণ করে বা আঁকে।” (বুখারী শরীফ ২/৮৮০)
হাদিস শরিফ : ২
ছবি নির্মাতাগণ কেয়ামতের দিন ছবিতে প্রাণ দান করতে হবে :
ﻋﻦ ﻋﺒﺪ ﺍﻟﻠﻪ ﺑﻦ ﻋﻤﺮ ﺍﺧﺒﺮﻩ ﺍﻥ ﺭﺳﻮﻝ ﺍﻟﻠﻪ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ ﻗﺎﻝ ﺍﻥ ﺍﻟﺬﻳﻦ ﻳﺼﻨﻌﻮﻥ ﻫﺬﻩ ﺻﻮﺭﺍ ﻳﻌﺬﺑﻮﻥ ﻳﻮﻡ ﺍﻟﻘﻴﻤﺔ ﻳﻘﺎﻝ ﻟﻬﻢ ﺍﺣﻴﻮﺍ ﻣﺎ ﺧﻠﻘﺘﻢ.
অর্থাৎ হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত আছে, হুযূরপাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, “যারা প্রাণীর ছবি তৈরী করবে, ক্বিয়ামতের দিন তাদের কঠিন শাস্তি দেওয়া হবে এবং তাদেরকে বলা হবে, যে ছবিগুলো তোমরা তৈরী করেছ, সেগুলোর মধ্যে প্রাণ দান কর।” (বুখারী শরীফ ২/৮৮০, মুসলিম শরীফ ২/২০১)
হাদিস শরিফ : ৩
আল্লাহপাকের নিকট সবচেয়ে বড় জালিম প্রাণীর ছবি নির্মাতা :
ﻋﻦ ﺍﺑﻰ ﺯﺭﻋﺔ ﻗﺎﻝ ﺩﺧﻠﺖ ﻣﻊ ﺍﺑﻰ ﻫﺮﻳﺮﺓ ﺩﺍﺭ ﺑﺎﻟﻤﺪﻳﻨﺔ ﻓﺮﺃ ﻫﺎ ﺍﻋﻼﻫﺎ ﻣﺼﻮﺭﺍ ﻳﺼﻮﺭ ﻗﺎﻝ ﺳﻤﻌﺖ ﺭﺳﻮﻝ ﺍﻟﻠﻪ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ ﻳﻘﻮﻝ ﻭﻣﻦ ﺍﻇﻠﻢ ﻣﻤﻦ ﺫﻫﺐ ﻳﺨﻠﻖ ﻛﺨﻠﻘﻰ ﻓﻴﺨﻠﻘﻮﺍ ﺣﺒﺔ ﻭﻟﻴﺨﻠﻘﻮﺍ ﺫﺭﺓ .
অর্থাৎ হযরত আবু যুরয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, আমি হযরত আবু হুরাইরা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এর সঙ্গে মদীনার এক ঘরে প্রবেশ করলাম, অতঃপর তিনি ঘরের উপরে এক ছবি অংকনকারীকে ছবি অঙ্কন করতে দেখতে পেলেন, এবং বললেন আমি হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি তিনি বলেছেন, মানুষের মধ্যে ঐ ব্যক্তি সবচেয়ে বড় জালিম, যে ব্যক্তি আল্লাহ পাক-এর সাদৃশ্য কোন প্রাণীর ছুরত সৃষ্টি করে। তাকে বলা হবে একটি শস্যদানা সৃষ্টি কর অথবা একটি অণু সৃষ্টি কর। (বুখারী শরীফ ২/৮৮০)
হাদিস শরিফ : ৪
হাদিস শরিফে ছবি নির্মাতার ভয়ানক পরিণতি সম্পর্কে আরো উল্লেখ রয়েছে :
ﻋﻦ ﺳﻌﻴﺪ رضي الله عنه ﻗﺎﻝ جاﺀ ﺭﺟﻞ ﺍﻟﻰ ﺍﺑﻦ ﻋﺒﺎﺱ ﻓﻘﺎﻝ ﺍﻧﻰ ﺭﺟﻞ ﺍﺻﻮﺭ ﻫﺬﻩ ﺍﻟﺼﻮﺭ فافتني ﻓﻴﻬﺎ ﻓﻘﺎﻝ ﻟﻪ ﺍﺩﻥ ﻣﻨﻰ ﻓﺪﻧﺎ ﻣﻨﻪ ﺛﻢ ﻗﺎﻝ ﺍﺩﻥ ﻣﻨﻰ ﻓﺪﻧﺎ ﺣﺘﻰ ﻭﺿﻊ ﻳﺪﻩ ﻋﻠﻰ ﺭﺍﺳﻪ ﻭﻗﺎﻝ ﺍﻧﺒﺌﻚ ﺑﻤﺎ ﺳﻤﻌﺖ ﻣﻦ ﺭﺳﻮﻝ ﺍﻟﻠﻪ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ ﻭﺳﻤﻌﺖ ﺭﺳﻮﻝ ﺍﻟﻪ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ ﻳﻘﻮﻝ ﻛﻞ ﻣﺼﻮﺭ ﻓﻰ ﺍﻟﻨﺎﺭ ﻳﺠﻌﻞ ﻟﻪ ﺑﻚ ﺻﻮﺭﺓ ﺻﻮﺭﻫﺎ ﻧﻔﺴﺎ ﻓﻴﻌﺬﺑﻪ ﻓﻰ ﺟﻬﻨﻢ ﻭﻗﺎﻝ ﺍﻥ ﻛﻨﺖ ﻻﺑﺪ ﻓﺎﻋﻼ ﻓﺎﺻﻨﻊ ﺍﻟﺸﺠﺮ ﻭﻣﺎ ﻻ ﻧﻔﺲ ﻟﻪ .
অর্থাৎ হযরত সাঈদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, এক ব্যক্তি হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর নিকট এসে বলল, আমি এমন এক ব্যক্তি যে প্রাণীর ছবি অংকন করি। সুতরাং এ ব্যাপারে আমাকে ফতওয়া দিন। হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তাকে বললেন, তুমি আমার নিকটবর্তী হও। সে ব্যক্তি তাঁর নিকটবর্তী হল। পুণরায় বললেন, তুমি আরো নিকটবর্তী হও। সে আরো নিকটবর্তী হলে হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তার মাথায় হাত রেখে বললেন, আমি হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এ ব্যাপারে যা বলতে শুনেছি তোমাকে তা বলব। হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “প্রত্যেক প্রাণীর ছবি তৈরীকারীই জাহান্নামে যাবে এবং আল্লাহপাক প্রত্যেকটি ছবিকে প্রাণ দিবেন এবং সেই ছবিগুলো তাদেরকে জাহান্নামে শাস্তি দিতে থাকবে।” ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বললেন, তোমার যদি ছবি আঁকতেই হয় তবে, গাছ-পালা বা প্রাণহীন বস্তুর ছবি আঁক।” (মুসলিম শরীফ ২/ ২০২)।
.
Π প্রয়োজনের তাগিদে ছবি তোলা বা নির্মাণ করতে দেয়া :
গ্রহনযোগ্য ওজর ও প্রয়োজনের তাগিদে ইসলাম আমাদের জন্য নানা ক্ষেত্রে ছাড়ও দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে এসেছে, ﻓَﺎﺗَّﻘُﻮﺍ ﺍﻟﻠﻪَ ﻣَﺎ ﺍﺳْﺘَﻄَﻌْﺘُﻢْ অর্থাৎ, তোমরা আল্লাহ পাক উনাকে ভয় কর তোমাদের সাধ্য ও সামর্থ্য অনুযায়ী। (সূরা তাগাবুন : ১৬) অর্থাৎ সাধ্যের বাইরে শরীয়ত কাউকে কোনো আদেশ করেনি।
.
মহান আল্লাহপাক আরো ইরশাদ করেন, ﻻَ ﻳُﻜَﻠِّﻒُ ﺍﻟﻠﻪُ ﻧَﻔْﺴًﺎ ﺍِﻻَّ ﻭُﺳْﻌَﻬَﺎ অর্থাৎ, আল্লাহ পাক কাউকে তার সাধ্যের বাইরে কিছু চাপিয়ে দেন না। (সূরা বাক্বারা : ২৮৬)।
.
তাছাড়া উসূলে ফিকহের কিতাবে উল্লেখ রয়েছে, ﺍﻟﻀﺮﻭﺭﺓ ﺗﺒﻴﺢ ﺍﻟـﻤﺤﺬﻭﺭﺍﺕ অর্থাৎ, জরুরত হারামকে ‘মুবাহ’ করে দেয়। (উসূলে বাযদূবী, উসূলে কারখী দ্রষ্টব্য)। শরীয়তের পরিভাষায় এরূপ অবস্থাকে ‘মা’জুর বা অপরাগতা’ বলা হয়। ফিকহের কিতাব সমূহে এরূপ অসংখ্য মা’জুরের মাসয়ালা বর্ণিত রয়েছে।
মন্তব্য :
উপরুল্লিখিত হাদিস শরিফ গুলোর আলোকে ছবি নির্মাতাদের ভয়ানক শাস্তি সম্পর্কে জানতে পারলাম। তবে বর্তমানে ক্যামেরা দিয়ে যেভাবে প্রাণীর ছবি তোলা হয় তার হুকুম সম্পর্কে ইসলামী বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। এখন প্রশ্ন হল, ক্যামেরা দ্বারা ছবি তোলা ব্যক্তিটি প্রকৃতপক্ষে ছবি নির্মাতা হিসেবে আখ্যায়িত হয়ে কবিরা গুনাহগার হবে কিনা? তার জবাব, না; এরকম ব্যক্তিটি প্রকৃতপক্ষে ছবি নির্মাতা হিসেবে আখ্যায়িত হবেনা ঠিক, কিন্তু বিনা প্রয়োজনে ও শরয়ি ওজর ব্যতীত এরকম কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকাই সব চে উত্তম। এতেই রয়েছে অতিব সাবধানতা এবং তাক্বওয়াহ। দ্বীনদার মুসলিমগণ এবং উলামায়ে কেরাম ও মাদরাসার তালেবুল ইলমদের জন্য সন্দেহযুক্ত ও অনুত্তম যে কোনো কাজ থেকে বিরত থাকাই উচিত। আল্লাহ তায়ালা সহিহ কথাগুলো বুঝে এবং আমল করার তাওফিক দিন, আমীন।
লেখক, প্রিন্সিপাল।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন