হযরত ওলামায়ে কেরাম, তালিবে ইলম সাথীগণ ও উপস্থিত সুধিবৃন্দ!
‘ইসলাহে নফস’ বা আত্মশুদ্ধির বিষয়ে কিছু কথা আপনাদের খিদমতে পেশ করতে আমাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রথমত আমি নিজেই ইসলাহের মুহতাজ। যার নিজেরই ইসলাহের প্রয়োজন, সে অন্যকে এ বিষয়ে কী বলতে পারে!
দ্বিতীয়ত এ মজলিসে বুযুর্গ ব্যক্তিগণ উপস্থিত আছেন। তাঁদের উপস্থিতিতে এ বিষয়ে কিছু বলতে যাওয়া দুঃসাহসিকতাও বটে। কিন্তু বুযুর্গগণ বলেছেন, ‘আলআমরু ফাওকাল আদব’ অর্থাৎ মুরববীগণ কোনো কাজের নির্দেশ দিলে তা মান্য করাই আদব। তাই নিদের্শ পালনার্থে আপনাদের সামনে উপস্থিত হয়েছি। আমি কুরআন মজীদের একটি আয়াত তেলাওয়াত করেছি। তার সামান্য ব্যাখ্যা আরজ করব ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তাআলা ইখলাসের সাথে বলার তাওফীক দান করুন।
আয়াতের তরজমা হল, ‘হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে ভয় কর। তাঁর নৈকট্য অর্জনের জন্য রাস্তা তালাশ কর এবং তাঁর রাস্তায় মেহনত কর। যাতে এসব কিছুর ফলে তোমাদের সফলতা অর্জিত হয় দুনিয়াতেও, আখিরাতেও।’ (সূরা : মায়িদা : ৩৫)
তাকওয়া এক অতন্দ্র প্রহরী
এ হল আয়াতের অনুবাদ। আল্লাহ তাআলা এ আয়াতে প্রথমে তাকওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। পুরা কুরআন মজীদ তাকওয়ার নির্দেশে পরিপূর্ণ। স্থানে স্থানে একটু পরপরই তাকওয়ার নির্দেশ এসেছে। কুরআন মজীদের রীতি হল, কোনো নির্দেশ বা বিধান জারি করার পূর্বে বা পরে সাধারণত তাকওয়ার আদেশ করা হয়। কারণ তাকওয়াই হচ্ছে ওই বস্ত্ত, যা মানুষকে আল্লাহ তাআলার যে কোনো হুকুম পাবন্দীর সাথে মেনে চলতে বাধ্য করে। দুনিয়ার ক্ষেত্রে দেখুন, কোনো সরকার জনগণের জন্য আইন-কানুন জারি করলে অনেক সময় তা কয়েক পয়সার বিনিময়ে বেচাকেনা হয়ে যায়। ঘুষের বাজার গরম হয়ে ওঠে, আর সে বিধানের কোনো মূল্যই থাকে না। প্রকাশ্যে তা লঙ্ঘিত হতে থাকে।
আর কোনো এলাকায় আইন-কানুনের পাবন্দি থাকলেও দেখা যায়, তা কেবল পুলিশের ডান্ডা ও আদালতী ঝামেলার ভয় থাকা পর্যন্তই। এরপর আর কেউ নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা করে না। কিন্তু একান্ত নির্জনতায় এবং নিশুতি রাতের অন্ধকারেও যে জিনিস মানুষের অন্তরে অতন্দ্র প্রহরীর কাজ করে তা হল আল্লাহ তাআলার ভয়।
খোদাভীতির একটি দৃষ্টান্ত
হযরত ওমর রা. তাঁর খেলাফতকালে লোকজনের খোঁজখবর নেওয়ার জন্য রাতের বেলা মদীনা মুনাওয়ারায় টহল দিতেন। এক রাতে তাহাজ্জুদের পর টহল দিচ্ছিলেন। হঠাৎ লক্ষ করলেন, একটি ঘর থেকে কথাবার্তার শব্দ শোনা যাচ্ছে। সাধারণ অবস্থায় কারো ব্যক্তিগত কথা আড়ি পেতে শোনা জায়েয নয়। কিন্তু দায়িত্বশীল ব্যক্তির জন্য প্রয়োজনের ক্ষেত্রে অনুমতি আছে। তো কথাবার্তার ধরন শুনে তাঁর কৌতূহল হল। তিনি ঘরের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ালেন এবং শুনতে পেলেন, এক বৃদ্ধা তার মেয়েকে বলছে, ‘বেটি! আজ তো উটের দুধ কম হয়েছে। এত অল্প দুধ বিক্রি করে দিন গুজরান করা কষ্ট হবে। তাই দুধের সাথে একটু পানি মিশিয়ে দাও।’
মেয়ে উত্তরে বলল, ‘মা! আমীরুল মুমিনীন তো দুধের সাথে পানি মেশাতে নিষেধ করেছেন?’ বৃদ্ধা বললেন, ‘আমীরুল মুমিনীন কি আমাদের দেখছেন? তিনি হয়তো নিজ ঘরে ঘুমিয়ে আছেন। তুমি নিশ্চিন্তে পানি মেশাতে পার।’
এবার মেয়ে বলল, ‘মা, আমীরুল মুমিনীন এখানে নেই এবং তার কোনো লোকও নেই। কিন্তু আল্লাহ তাআলা তো আছেন! তিনি তো দেখছেন! তাঁর কাছে আমরা কী জবাব দেব?’
ওমর রা. দেয়ালের ওপাশ থেকে সব কথা শুনতে পাচ্ছিলেন। এতটুকু শুনেই তিনি চলে এলেন এবং পরদিন লোক পাঠিয়ে সে ঘরের খোঁজখবর নিলেন। তারপর বৃদ্ধার কাছে পয়গাম পাঠালেন যে,‘আপনি সম্মত হলে আপনার মেয়ের সাথে আমার ছেলের বিয়ে দিতে চাই।’
এভাবে তাকওয়ার বদৌলতে মেয়েটি আমীরুল মুমিনীনের পুত্রবধু হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করল। এই বরকতময় ঘরের তৃতীয় পুরুষে জন্মগ্রহণ করলেন খলীফা ওমর বিন আবদুল আযীয রাহ., যাকে পঞ্চম খলীফায়ে রাশেদ বলা হয়।
তো মানুষের অন্তরে সর্বক্ষণ এই ধ্যান জাগরুক থাকা যে, ‘আল্লাহ তাআলা আমাকে দেখছেন’-এর নামই তাকওয়া।
কয়েক বছর আগে এক সফরে আমেরিকার টেক্সাস প্রদেশের প্রসিদ্ধ শহর হিউস্টনে (houston) গিয়েছিলাম। ‘নাসা’র (NASA) সবচেয়ে বড় কেন্দ্র সেখানেই অবস্থিত। আমার মেজবান আমাকে তা পরিদর্শন করানোর জন্য নিয়ে গেলেন। এটা ‘নাইন-ইলেভেন’-এর আগের কথা। এখন কী অবস্থা জানি না। একপর্যায়ে আমরা সবচেয়ে ‘গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর’অংশে প্রবেশ করলাম, যেখান থেকে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা হয়। সবার জন্য সেখানে প্রবেশের অনুমতি নেই। প্রবেশ করেই দেখতে পেলাম, দেয়ালে একটি বোর্ড লাগানো রয়েছে। তাতে স্পষ্ট অক্ষরে`You are being watched’ ‘আপনার প্রতি লক্ষ রাখা হচ্ছে’ বা সর্বক্ষণ আপনি আমাদের নজরে রয়েছেন। ব্যাস, এটুকুই! কোনো সিকিউরিটি গার্ড নেই, পুলিশ নেই। শুধু এটুকু লেখা যে, আপনাকে নজরদারি করা হচ্ছে। প্রবেশকারী বোর্ডের লেখা পড়েই বুঝতে পারে যে, গোপন ক্যামেরার সাহায্যে তার প্রতিটি কার্যকলাপ লক্ষ রাখা হচ্ছে, ফলে সে তৎক্ষণাৎ সতর্ক হয়ে যায়। এমন কোনো কাজ করে না, যার ফলে তাকে জবাবদিহি বা গ্রেফতারের সম্মুখীন হতে হবে।
লেখাটি পড়ে আমি ভাবলাম, ‘এ বোর্ডের কারণে এখানে প্রবেশকারী সবাই সতর্ক হয়ে চলে। আহা! এ অনুভূতিই তো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন যে, You are being watched by Allah taaala ‘আল্লাহ তাআলা সব সময় তোমাকে দেখছেন।’
ان الله ان الله يعلم ما تفعلون
يعلم ما تفعلون
‘তোমরা যা করছ, সব তিনি জানেন।’
আমাদের সবার মনে যদি এই চেতনা সদাজাগ্রত থাকে যে, প্রতি মুহূর্তে আল্লাহ তাআলা আমাকে দেখছেন তাহলে আমাদের সকল সমস্যা দূর হয়ে যাবে। কেউ কারো ওপর জুলুম করবে না, একে অপরের হক নষ্ট করবে না। আল্লাহ তাআলার কোনো বিধান লঙ্ঘন করবে না। কেবল এই একটি জিনিসই মানুষকে অন্যায়-অপরাধ এবং পাপাচার ও সীমালঙ্ঘন থেকে বিরত রাখতে পারে। এরই নাম তাকওয়া। নবীগণের মেহনত এবং নবী প্রেরিত হওয়া ও কিতাব নাযিল হওয়ার মূল উদ্দেশ্য হল মানুষের অন্তরে তাকওয়া সৃষ্টি করা।
তাকওয়া অর্জনের উপায়
কুরআন মজীদের এ আয়াতে এবং অন্যান্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা তাকওয়া অর্জনের নির্দেশ দিয়েছেন।
এখন প্রশ্ন হল, তাকওয়া অর্জিত হবে কীভাবে? আল্লাহ তাআলা এই আয়াতে তাকওয়ার নির্দেশ দানের পাশাপাশি তা অর্জনের দু’টি পদ্ধতি বর্ণনা করেছেন।
প্রথমটি হল,
وابةغوا اليه الوسيلة وابتغوا اليه الوسيلة
আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জনের জন্য ‘ওসীলা’ তালাশ কর। ‘ওসীলা’ কী? মুফাসসিরগণ এর বিভিন্ন ব্যাখ্যা করেছেন। কেউ বলেছেন, ‘ওসীলা’ হল নেক আমল। যত বেশি নেক আমল করবে, ততই তাকওয়া হাসিল হবে এবং আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জিত হবে। কেউ অন্য ব্যাখ্যাও করেছেন। একটি ব্যাখ্যা হল-যার সমর্থন অন্য আয়াতেও পাওয়া যায়-‘ওসীলা’ তালাশ করার অর্থ এমন ব্যক্তিদের সাহচর্য গ্রহণ করা, যাঁরা তাকওয়ার গুণে গুণান্বিত। এটি তাকওয়া অর্জনের সবচেয়ে সহজ ও সবচেয়ে ফলপ্রসূ পন্থা।
সোহবতের প্রভাব
সোহবত বা সাহচর্যের গভীর প্রভাব রয়েছে। সোহবতের গুণে মানুষের কর্ম ও চিন্তায় এবং চরিত্র ও নৈতিকতায় পরিবর্তন আসে।
দ্বীন মূলত সোহবতের মাধ্যমেই চলে আসছে। সাহাবায়ে কেরাম রা. প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সোহবত অবলম্বন করেছিলেন। সাহাবীদের সোহবত লাভ করেছেন তাবেঈগণ। এভাবে তাবেঈগণের সোহবত লাভ করেছেন তাবে তাবেঈগণ। তাঁদের যুগকেও গণ্য করা হয়েছে সর্বোত্তম যুগের মাঝে।
তাই প্রকৃতপক্ষে বুযুর্গানে দ্বীনের সোহবতের দ্বারাই মানুষের মাঝে দ্বীন পয়দা হয়।
হযরত শাহ ইসমাঈল শহীদ রাহ. বলেছেন,-‘সাহাবায়ে কেরাম রা. হলেন নবীগণের পর পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ। নবীগণের পরই তাঁদের মর্যাদা। যত বড় ওলী-বুযুর্গ, পীর-মাশায়েখই হোন না কেন, সাহাবায়ে কেরামের মর্যাদার ধারেকাছেও কেউ পৌঁছতে পারবেন না।
পরবর্তী ব্যক্তিদের নামের শুরুতে সম্মানসূচক বিভিন্ন উপাধি ব্যবহার করা হয়। কুতুবুল আকতাব, শায়খুল ইসলাম, ফখরুল মুহাদ্দিসীন, ফকীহুল আসর ইত্যাদি বলা হয়। ‘ইমাম’ উপাধিতে স্মরণ করা হয়। অথচ সাহাবায়ে কেরামের নামের সাথে এ জাতীয় কোনো খেতাব ব্যবহার করা হয় না। কেউ বলে না যে, ইমাম আবু বকর রা. বা মুফতী আবু বকর রা.। কোনো সাহাবীর নামের সাথেই এমন গুরুগম্ভীর বা আড়ম্বরপূর্ণ উপাধি নেই।
শাহ ছাহেব রাহ. বলেন, এর কারণ হল, সাহাবীগণের সম্মান ও শ্রেষ্ঠত্ব বোঝানোর জন্য কোনো উপাধির প্রয়োজন নেই। সাহাবী বলার পর আর কিছুই বলার প্রয়োজন হয় না। সাহাবী বলা মানে সবকিছু বলা।
শেখ সাদী রাহ. সুন্দর বলেছেন-
‘যার চেহারাই চাঁদের মতো, তার সাজগোজের কী প্রয়োজন!
নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সোহবতের কারণে সাহাবাগণ যে মর্যাদার অধিকারী হয়েছেন ‘সাহাবী’ শব্দ ছাড়া অন্য কোনো বিশেষণ ব্যবহার করে তা বর্ণনা করা কঠিন।
সারকথা এই যে, দ্বীন অর্জনের মূল পদ্ধতি সোহবত। যারা মনে করে যে, শুধু বই পড়েই দ্বীনদার হয়ে যাব, তাদের ধারণা সঠিক নয়।
অনেক সময় আল্লাহওয়ালাদের সামান্য সাহচর্য মানুষের জীবনের গতিধারা পাল্টে দেয়। কবি বলেছেন-
يك زمانه صحبت با اولياء بهتر از صد يك زمانه صحبت با اولياء بهتر از صد ساله طاعت بى رياء
ساله طاعت بى رياء
আল্লাহ ওয়ালাদের সামান্য সময়ের সোহবত একশত বছরের রিয়ামুক্ত ইবাদতের চেয়েও উত্তম!’
হাকীমুল উম্মত হযরত আশরাফ আলী থানভী রাহ.কে কেউ বলল, হযরত! এ তো অতিরঞ্জন বলে মনে হচ্ছে। একশত বছর ইখলাসের সাথে ইবাদত করে একজন যা অর্জন করল, সামান্য সময় আল্লাহওয়ালার সোহবতে থেকেই আরেকজন তেমনি লাভবান হয়ে গেল! তা কীভাবে হয়?
হযরত রাহ. বললেন, ‘ভাই! অতিরঞ্জন নয়, শত বছর না বলে যদি শত লক্ষ বছর বলা হত তাহলেও অতিশয়োক্তি হত না। কারণ ইবাদতের জন্য শুধু রিয়ামুক্ত হওয়াই যথেষ্ট নয়, তা সহীহ তরীকায় হওয়াও জরুরি। আল্লাহ ওয়ালাদের সোহবতের দ্বারা ইবাদতের তরীকা সহীহ হয়। তেমনি ফিকির ও মেজাযের উন্নতি হয়। আল্লাহ তাআলার মুহাববত নিয়ে ইবাদত করতে শেখে, ফলে ইবাদত আল্লাহর দরবারে মকবুল হয় এবং তার মান বহু গুণে বেড়ে যায়।
পীর-মুরিদীর স্বরূপ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগ থেকেই সোহবতের সিলসিলা চলে আসছে। দ্বীন শেখার জন্য মানুষ বুযুর্গানে দ্বীনের সোহবতে যায়, ইসলাহী তাআল্লুক কায়েম করে।
কিন্তু এখন তো পীর-মুরিদীকে এক ধাঁধাঁর বিষয় বানিয়ে ফেলা হয়েছে। এ বিষয়ে আসল কথা এই যে, মানুষ তার নিজের রোগ নিজে চিহ্নিত করতে পারে না। তাকে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হয়। যেমন অহংকার একটি রোগ। শরীয়তে তা হারাম। এতে কারো দ্বিমত নেই। কিন্তু কোনো অহংকারী ব্যক্তি কখনোই স্বীকার করে না যে, আমি অহংকারী। আরবী সাহিত্যে এর চমৎকার একটি উদাহরণ রয়েছে। উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় কেউ দাঁড়ালে তার কাছে নিচের সবকিছুই ছোট ছোট মনে হবে। মানুষ, ঘরবাড়ি, গাছপালা সবকিছুই দেখা যাবে অনেক ছোট। এখন তার কাছে মনে হবে দুনিয়ার সবকিছুই ছোট, শুধু আমি অনেক বড়। পক্ষান্তরে নিচের লোকজনও পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়ানো লোকটিকে আকারে ছোট দেখতে পাবে।
তেমনিভাবে অহংকারী ব্যক্তি মনে করে, দুনিয়ার সবাই ছোট, শুধু আমি বড়। অথচ অন্যদের দৃষ্টিতে সে তুচ্ছ হয়ে ধরা পড়ে। যদিও মানুষ তার প্রভাব-প্রতিপত্তির ভয়ে তার সামনে হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকে, মুখে কিছুই বলে না। কিন্তু মনে মনে তার প্রতি বিরক্ত থাকে। অহংকারী নিজে বুঝতেই পারে না যে, আমি ভয়ানক এক রোগে আক্রান্ত।
অহংকার এক ভয়াবহ রোগ
অহংকার বড় ভয়ানক ব্যাধি। এই ব্যাধি থেকে আরো অনেক রোগ সৃষ্টি হয়। ক্রোধ, হিংসা-বিদ্বেষ, অত্যাচার ইত্যাদি সবকিছুর মূলে অহংকার। অথচ অহংকারী নিজে তা অনুভব করে না।
এখন এই রোগ চিহ্নিত করে এর চিকিৎসা কে করবে? এজন্যই শায়খের দরকার। এটাই পীর-মুরিদির আসল প্রয়োজন এজন্যই।
টাখনুর নিচে পোশাক পরা
হাদীস শরীফে এসেছে, টাখনুর নিচে পোশাক পরিধানকারী জাহান্নামী হবে। অনেকেই বলে থাকেন যে, অন্য হাদীসে এর কারণ হিসেবে অহংকারের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ অহংকারবশত টাখনুর নিচে পোশাক পরলে জাহান্নামে যেতে হবে, কিন্তু আমরা তো অহংকার করে পরি না। ফ্যাশন হিসেবে পরি। এতে তো কোনো দোষ নেই!
আমি তাদেরকে প্রশ্ন করি, ভাই! বলুন তো পৃথিবীতে এমন কে আছে, যে দৃঢ়তার সাথে বলতে পারে যে, আমার অন্তরে সামান্য অহংকারও নেই? নিশ্চয়ই নেই। তেমনিভাবে অন্যের ব্যাপারেও নিশ্চিতভাবে কেউ এ দাবি করতে পারে না যে, তার মনে বিন্দুমাত্র অহংকার নেই। শুধু দোজাহানের সর্দার প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে বলা যাবে যে, তিনি সম্পূর্ণ অহংকারমুক্ত ছিলেন। অন্য কারো সম্পর্কেই একথা বলা যায় না। অথচ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো কখনো টাখনুর নিচে কাপড় পরেননি। তো আমাদের উচিত তাঁর অনুসরণ ও অনুকরণ করা।
দ্বিতীয় কথা হল, এমন একজন অহংকারী খুঁজে বের করুন, যে তার অহংকারের কথা স্বীকার করে! তাহলে এ দাবি কীভাবে করা যায় যে, আমার মাঝে অহংকার নেই, তাই আমি টাখনুর নিচে পোশাক পরতে পারি?
অবশ্য কারো যদি ওযর বা অপারগতা থাকে তাহলে ভিন্ন কথা। যেমন আবু বকর রা. সম্পর্কে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাঁর কাপড় আপনা আপনি নিচে ঝুলে পড়ত। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে আরজ করলে তিনি তাঁর অপারগতা দেখে বললেন, অসুবিধা নেই, তুমি তো আর স্বেচ্ছায় অহংকারবশত করছ না।
যাহোক, যেভাবে রোগী নিজে তার দৈহিক রোগ-ব্যাধি নির্ণয় করতে পারে না, তাকে অভিজ্ঞ ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হয় তেমনিভাবে অন্তরেরও অনেক রোগ-ব্যাধি আছে, যা রোগী নিজে নির্ণয় করতে পারে না। যেমন হিংসা, বিদ্বেষ, অহংকার, রিয়া, যশ-খ্যাতির লোভ, সম্পদের মোহ ইত্যাদি।
এই রোগ-ব্যাধি নির্ণয় ও নিরাময়ের জন্য বুযুর্গানে দ্বীনের শরণাপন্ন হতে হয়। তিনি এর চিকিৎসা করেন। কুরআন মজীদের ভাষায় একেই বলে তাযকিয়া। আর এটিই তাসাওউফের মূল কথা।
আগের যুগে মানুষ ইসলাহে নফসের জন্য কোনো বুযুর্গের শরণাপন্ন হলে মাসের পর মাস তার সাহচর্যে থেকে রিয়াযত-মোজাহাদা করতে হত। এ ধরনের বিভিন্ন ঘটনা আপনারাও হয়তো কিতাবপত্রে পড়েছেন। এখন এই যুগে যদি আমাকে-আপনাকে বলা হয়, অন্তরের ইসলাহের জন্য ঘরবাড়ি ছেড়ে খানকায় গিয়ে এত মাস পড়ে থাকতে হবে, কঠিন রিয়াযত-মুজাহাদা করতে হবে তাহলে আমাদের জন্য তা সম্ভব হবে না। তাই আমাদের দুর্বলতার কারণে বুযুর্গানে দ্বীন ইসলাহে নফসের এমন তরীকা বাতলে দিয়েছেন, যা আমরা সহজেই অনুসরণ করতে পারি। খুব বেশি মেহনতও করতে হয় না। আবার উদ্দেশ্যও অর্জিত হয়ে যায়।
আল্লাহওয়ালাদের সোহবতে যাওয়ার মূল উদ্দেশ্য হল, আল্লাহ তাআলার সাথে আমাদের তাআল্লুক যেন কায়েম হয়ে যায় এবং মজবুত হয়ে যায়। তাই হযরত হাকীমুল উম্মত রাহ. এমন কিছু সহজ‘নুসখা’ বলে দিয়েছেন, যা ঠিকমতো মেনে চললে আগের যুগের দীর্ঘ মেহনত দ্বারা যা হাসিল হত এখন অল্প মেহনতেই তা হাসিল হবে এবং আল্লাহ তাআলার সাথে তাআল্লুক মজবুত হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।
প্রথম আমল : দুআ
অর্থাৎ আল্লাহর কাছে চাওয়া এবং চাইতেই থাকা। এর একটি উপায় হল, জীবনের সকল কাজে মাসনূন দুআর ইহতিমাম করা। যেমন ঘুম থেকে উঠে দুআ পড়া, ইস্তিঞ্জাখানায় যেতে ও বের হতে দুআ পড়া, ফজরের সময় মসজিদে যেতে দুআ পড়া, ঘরে ঢুকতে ও বের হতে দুআ পড়া, খাবারের শুরুতে ও শেষে দুআ পড়া। মোটকথা, জীবনের প্রতিটি কাজে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে দুআ শিখিয়েছেন তা পাঠ করা। মানুষ একে সামান্য আমল মনে করে। আসলে তা অসামান্য আমল।
কারণ এ সকল দুআর মাঝে একটি দুআও যদি কবুল হয়ে যায় তাহলেও মানুষের জীবন সার্থক। যেমন মসজিদে প্রবেশ করার সময় পড়তে হয়-
اللهم اللهم افتح لي أبواب رحمتك
افتح لي أبواب رحمتك
অর্থাৎ হে আল্লাহ! আমার জন্য আপনার রহমতের সকল দরজা খুলে দিন।
এই একটি দুআই যদি কবুল হয়ে যায় তাহলে আমার দুনিয়া-আখেরাতের কোন প্রয়োজনটি অপূর্ণ থাকবে?
ফজরের নামাযে মসজিদে যাওয়ার সময় পড়তে হয়,
اللهم اجعل في قلبي نورا، وفي لساني نورا، واجعل في سمعي نورا، واجعل في بصري نورا، واجعل منخلفي نورا، ومن أمامي نورا، واجعل من فوقي نورا، ومن تحتي نورا، اللهم أعطني نورا اللهم اجعل في قلبي نورا، وفي لساني نورا، واجعل في سمعي نورا، واجعل في بصري نورا، واجعل من خلفي نورا، ومن أمامي نورا، واجعل من فوقي نورا، ومن تحتي نورا، اللهم أعطني نورا.
অর্থাৎ হে আল্লাহ! আমার অন্তরে নূর দান করুন। আমার দৃষ্টিতে নূর দান করুন। আমার ডানে-বায়ে, সামনে-পিছনে, উপরে-নিচে সবদিকে নূর দান করুন এবং আমাকে নূরে নূরান্বিত করুন।’
ভেবে দেখুন, এই দুআটি যদি কবুল হয়ে যায় তাহলে কল্যাণের আর কী বাকি থাকে?
মোটকথা, প্রতিটি মাসনূন দুআই এত গভীর অর্থবহ যে, একটি দুআও যদি কবুল হয়ে যায় তাহলে জীবনের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
মাসনূন দুআর দ্বিতীয় ফায়েদা হচ্ছে, এর দ্বারা আল্লাহ তাআলার সাথে সার্বক্ষণিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। সকল কাজে মাসনূন দুআর ইহতিমামের ফলে সর্বাবস্থায় আল্লাহ তাআলাকে স্মরণ করার সৌভাগ্য অর্জিত হয়। আমি উদাহরণ দিয়ে থাকি যে, আগে মানুষ সফরে গেলে পরিবারের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ থাকত না। এখন মোবাইল ফোন আবিষ্কৃত হয়েছে। ফলে মানুষ যেখানেই থাকুক, সর্বদা ঘরের সাথে, ছেলেমেয়ের সাথে তার যোগাযোগ থাকে। বিচ্ছিন্নতার মধ্যে সময় কাটাতে হয় না। তেমনিভাবে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতকে যেসব দুআ শিক্ষা দিয়েছেন তার দ্বারা আল্লাহ তাআলার সাথে বান্দার সার্বক্ষণিক যোগাযোগ স্থাপিত হয়।
এজন্য ভাই! মাসনূন দুআ কোনো মামুলি বিষয় নয়। এ এক অমূল্য সম্পদ। অজ্ঞতা ও উদাসীনতার কারণে মানুষ এই দুআগুলি মুখস্থও করে না। সময়মতো পড়ারও ইহতিমাম করে না। আরো আফসোসের কথা হচ্ছে, আমরা যারা তালিবে ইলম, হাদীসের কিতাবে এ দুআগুলো পড়ে থাকি, আমরাও খেয়াল করে এগুলো পড়ি না।
আমাদের হযরত আরেফী রাহ. বলতেন-(মাসনূন দুআ তো আছেই) সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত যত কাজ করতে হয় প্রত্যেক কাজের শুরুতে আল্লাহ তাআলার কাছে দুআ কর। ঘর থেকে বের হচ্ছ, মনে মনে দুআ কর-‘আয় আল্লাহ! সহজে যানবাহনের ব্যবস্থা করে দাও।’ বাহন পাওয়া গেল তো বল-‘আল্লাহ! নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছে দাও।’ রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম লেগে আছে, দুআ কর, ‘হে আল্লাহ! রাস্তা পরিষ্কার করে দাও।’ মোটকথা সকল কাজে সকল অবস্থায় আল্লাহ তাআলার কাছে দুআ কর। সারাদিনই কোনো না কোনো কাজ থাকে। সকল কাজে আল্লাহ তাআলার কাছে চাইতে থাক। আল্লাহর দুয়ারের ভিখারী হয়ে যাও, তাঁর রহমতের কাঙাল বনে যাও এবং বারবার চাইতে থাক। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, জুতার ফিতা ছিঁড়ে গেলেও আল্লাহ তাআলার কাছে চাও।
এ নির্দেশনার মধ্য দিয়ে পেয়ারা নবী যেন উম্মতকে বললেন, ওহে মানুষ! তোমার তো অভাবের শেষ নেই, সব সময় কোনো না কোনো প্রয়োজন লেগেই থাকে। অতএব সব সময় আল্লাহর কাছে চাইতে থাক। মাখলুকের সহায়তা নেওয়ার আগে খালিকের কাছে চাও। তিনিই তো প্রকৃত প্রয়োজন পূরণকারী।
হযরত আরেফী রাহ. আরো বলতেন, মুখে উচ্চারণ করে বলতে না পার, মনে মনে বল। আল্লাহ তো তোমার মনের খবরও জানেন। এভাবে সব সময় কিছু না কিছু চাইতে থাক। তারপর দেখ, জীবনে কেমন বরকত হয়।
দুআ করতে তো পয়সাকড়ি খরচ করতে হয় না। বাড়তি সময় লাগে না। কোনো পরিশ্রমও করতে হয় না। কত সহজ আমল!
অনেকে বলে, কত দুআ করব, দুআ তো কবুল হয় না। মনে রাখবেন, বান্দার প্রতিটি দুআই কবুল হয়। কোনো দুআই ব্যর্থ হয় না। প্রতিটি দুআর কমপক্ষে তিনটি ফায়েদা সম্পূর্ণ নিশ্চিত। এর মধ্যে দুটি তো সাথে সাথে পাওয়া যায়।
প্রথম ফায়েদা হল, দুআ একটি ইবাদত। প্রার্থিত বস্ত্ত পাওয়া যাক বা না যাক দুআর কারণে সাথে সাথে নেকি লেখা হয়। দুআর দ্বারা বান্দার আমলনামা ভারি হতে থাকে।
দ্বিতীয় ফায়েদা হচ্ছে, দুআর দ্বারা বান্দা আল্লাহ তাআলার নিকটবর্তী হয়।
তৃতীয় ফায়েদা হল, বান্দার জন্য প্রার্থিত বিষয় যদি কল্যাণকর হয় তাহলে প্রার্থিত বস্ত্তই তাকে দান করা হয়। অন্যথায় এর বিনিময় আল্লাহ তাআলা তাকে অন্যভাবে দান করেন।
দেখুন, অবুঝ শিশু যদি ধারালো ছুরি নিয়ে খেলতে চায় তাহলে পিতামাতা তার ইচ্ছা পূরণ করেন না। সে যতই কান্নাকাটি করুক, বাবা-মা কখনোই তা দেন না। অন্য কিছু দিয়ে তাকে সন্তুষ্ট করেন। তেমনিভাবে বান্দা অনেক সময় না বুঝে অকল্যাণকর জিনিস চেয়ে বসে। কিন্তু মেহেরবান মালিক তা না দিয়ে অন্যভাবে তার প্রার্থনা মঞ্জুর করেন।
অতএব কোনো দুআই নিষ্ফল হয় না। এত বড় নেআমতকে মানুষ মামুলি মনে করে। ফলে এর বরকত থেকে বঞ্চিত থেকে যায়। তাই মশক করে করে এর অভ্যাস গড়তে হবে।
হাকীমুল উম্মত হযরত থানভী রাহ. বলেন, যখনই কেউ আমার কাছে কোনো বিষয়ে প্রশ্ন করে, সাথে সাথে আমি আল্লাহ তাআলার দিকে রুজু করি এবং মনে মনে দুআ করি, আল্লাহ! এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর আমার অন্তরে দান কর। আল্লাহ তাআলার শোকর, কখনো এর অন্যথা হয় না।
দ্বিতীয় আমল : শোকর
দ্বিতীয় আমল হল, বেশি বেশি শোকরগোযারি করা। চিন্তা করে দেখুন, প্রতি মুহূর্তে আল্লাহ তাআলার কত অসংখ্য নেআমত আমাদের উপর বর্ষিত হচ্ছে। শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আল্লাহ তাআলার নেয়ামত। এগুলো সবল ও কর্মক্ষম থাকা কত বড় নেয়ামত! স্বাভাবিক অবস্থায় এই সব নেয়ামতের মূল্য না বুঝলেও যখন কোনো একটি অঙ্গ অসুস্থ বা অকেজো হয়ে পড়ে তখন তার মূল্য বুঝে আসে।
ইমাম বায়হাকী রাহ. শুআবুল ঈমান কিতাবে এক বুযুর্গের ঘটনা লিখেছেন। বুযুর্গ মারাত্মক অসুস্থ ছিলেন এবং চলাফেরাতেও অক্ষম ছিলেন। হাত-পা অবশ হয়ে গিয়েছিল। সেই করুণ অবস্থাতেও শুয়ে শুয়ে বলছিলেন যে, ‘হে আল্লাহ! তোমার শোকর, তোমার শোকর।’ এক ব্যক্তি বলল, হযরত! এত অসুখের মাঝেও শুকরিয়া আদায় করছেন? তিনি বললেন, ভাই! আল্লাহ তাআলা তো আমার চোখ দুটো এখনও সুস্থ রেখেছেন। যদি এ দুটোও নষ্ট হয়ে যেত তাহলে আরো কত পেরেশানি হত!
খলীফা হারুনুর রশীদের একটি ঘটনা আছে। তিনি পিপাসার্ত হয়ে খাদেমের কাছে পানি চাইলেন। বিখ্যাত বুযুর্গ বুহলূল রাহ. খলীফার কাছেই ছিলেন। খলীফা পানি পান করতে যাবেন, এমন সময় বুহলূল বললেন, জনাব, একটু থামুন। আমার একটি প্রশ্ন আছে। খলীফা কিছুটা অবাক হয়ে পাত্র নামিয়ে নিলেন। বুহলূল বললেন, ‘প্রচন্ড পিপাসার সময় এই এক পাত্র পানির জন্য আপনি কী পরিমাণ সম্পদ খরচ করতে রাজি হবেন?’
একটু ভেবে খলীফা বললেন, ‘পিপাসা যদি তীব্র হয়, প্রাণনাশের আশঙ্কা দেখা দেয় তাহলে প্রয়োজনে আমার গোটা রাজত্ব দিয়ে হলেও এ পানিটুকু পেতে চাইব।
বুহলূল বললেন, ঠিক আছে। পান করুন।’ খলীফা পানি পান করার পর বুহলূল আবার জিজ্ঞাসা করলেন, হুজুর, আরেকটি ছোট্ট প্রশ্ন আছে।’ খলীফা বললেন, ‘বলুন।’ বুহলূল বললেন, ‘আপনি যে পানিটুকু পান করলেন তা যদি আপনার শরীরে আটকে থাকে (অর্থাৎ প্রস্রাব বন্ধ হয়ে যায়) তাহলে তা বের করার জন্য কী পরিমাণ ব্যয় করবেন?’
খলীফা বললেন, ‘এমন যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে প্রয়োজনে আমার গোটা রাজত্ব দিয়ে দেব।’
এবার বুহলূল বললেন, ‘হুজুর! এই রাজত্বের কী মূল্য, যা এক পাত্র পানির পান করার জন্য এবং এক পাত্র পানি শরীর থেকে বের করার জন্য চলে যায়?!’ অর্থাৎ এটি আল্লাহ তাআলার এত বড় নেয়ামত, এর মোকাবিলায় আপনার এই বিশাল রাজত্বও অতি তুচ্ছ।
বান্দা যদি তা চিন্তা করে তাহলে সে শোকরগোযারি করবে। তাই ইস্তিঞ্জা করার পরই এই দুআ পড়ার কথা আছে-
الحمد لله الذي أذهب عني الحمد لله الذي أذهب عني الأذى وعافني
الأذى وعافني
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর, যিনি আমার ভিতর থেকে কষ্টদায়ক বস্ত্ত বের করে দিয়েছেন এবং আমাকে আফিয়ত ও সুস্থতা দান করেছেন।
সুনানে দারাকুতনীর এক রেওয়ায়েতে দুআটি এভাবে আছে-
الحمد لله الذي أذاقني لذته وأبقى علي قوته الحمد لله الذي أذاقني لذته وأبقى علي قوته ودفع عني أذاه
ودفع عني أذاه
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তাআলার, যিনি আমাকে খাবারের স্বাদ আস্বাদন করিয়েছেন, আমার দেহে এর শক্তি ও উপকারিতা বাকি রেখেছেন এবং এর ক্ষতিকর অংশটুকু আমার ভিতর থেকে বের করে দিয়েছেন।
কত সুন্দর অর্থবহ দুআ!
এভাবে প্রতি মুহূর্তে মানুষ আল্লাহ তাআলার কত নেয়ামত ভোগ করছে! কিন্তু আল্লাহ তাআলা বলেন-
وقليل من عبادي الشكور وقليل من عبادي الشكور.
আমার বান্দাদের মাঝে শোকরগোযার খুবই কম।
মোটকথা প্রয়োজনের শুরুতে দুআ আর প্রয়োজন পূরণ হলে শুকরিয়া, ইনশাআল্লাহ, খুব সহজ এ আমল দুটি পাবন্দির সাথে আদায় করলে দ্রুত আল্লাহ পাকের নৈকট্য অর্জিত হবে।
আবার খুব সহজ হওয়ার কারণে দেখবেন, এখান থেকে উঠেই ভুলে যাচ্ছেন। গাফলত এসে যাচ্ছে। এই গাফলত দূর করার উপায় হল আল্লাহ ওয়ালাদের সোহবত। সোহবতের বরকতে আমলের তাওফীক হয়।
আর শোকর এমন এক দামি আমল, যে বান্দা যত বেশি শোকর আদায় করবে তত বেশি শয়তানের হামলা থেকে বেঁচে যাবে। শয়তান জান্নাত থেকে বহিষ্কার হওয়ার সময় পণ করেছিল, আদমসন্তানকে সবদিক থেকে গোমরাহ করার চেষ্টা চালাবে। তখন একথাও বলেছিল-
ولا تجد اكثرهم شاكرين ولا تجد اكثرهم شاكرين
তাদের অধিকাংশকেই শোকরগোযার পাবেন না।
বুঝা গেল, শয়তানের অনেক বড় একটি হামলা হল, বান্দাকে শোকরগোযারি থেকে বিরত রেখে নাশোকরিতে লিপ্ত করে দেওয়া।
আর বান্দার অন্তরে যখন আল্লাহ তাআলার নেয়ামতের কদর সৃষ্টি হয় তখন গুনাহ থেকে বেঁচে থাকাও সহজ হয়ে যায়। এভাবে ধীরে ধীরে আল্লাহ তাআলার সাথে তাআল্লুক বাড়তে থাকে।
তাকওয়া অর্জনের দ্বিতীয় উপায় হল, মুজাহাদা। মুজাহাদা ও জিহাদের শাব্দিক অর্থ সর্বাত্মক চেষ্টায় আত্মনিয়োগ করা।
আর সশস্ত্র জিহাদ শরীয়তের হুকুম-আহকাম মোতাবেক হলে তা অনেক বড় ইবাদত। আরেক ধরনের জিহাদ হল, যার ব্যাপারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
المجاهد المجاهد من جاهد نفسه
من جاهد نفسه
আপন নফসের সাথে যে জিহাদ করে, সে-ই মুজাহিদ। অর্থাৎ প্রবৃত্তির কামনার বিরুদ্ধে কাজ করা। একে বড় জিহাদ বলেও অভিহিত করা হয়েছে। হাদীসের সনদে যদিও কিছুটা কালাম আছে, কিন্তু বুযুর্গ ও ফকীহগণ একে জিহাদে আকবর বলেছেন। মনে চাচ্ছে না মসজিদে যেতে, মনের বিরুদ্ধাচরণ করে মসজিদে চলে যেতে হবে। গুনাহ ছাড়তে মনে চাচ্ছে না, তারপরও জোর করে ছাড়তে হবে।
হযরত থানভী রাহ. বলেন, অল্প কথায় তাসাওউফের সারমর্ম হল, কোনো ইবাদত পালনে অলসতা লাগ লে জোর করে তা আদায় করা। আর গুনাহ থেকে বাঁচতে অনীহা বোধ করলে নিজের ওপর জোর খাটিয়ে তা থেকে বাঁচা।
কে বলেছেন এই কথা? হাকীমুল উম্মত। যিনি তাসাওউফের মুজাদ্দিদ, যাঁর সারা জীবন এই পথেই কেটেছে। তিনি আরো বলেন, এই গুণ যার অর্জিত হয়েছে, তার অন্য কিছুর প্রয়োজন নেই। এর মাধ্যমেই আল্লাহ তাআলার সাথে সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। এর কারণেই সম্পর্কে উন্নতি ঘটে এবং এর মাধ্যমেই তা স্থায়ী থাকে।
আর সবকাজে মনমতো চলা মানুষের প্রকৃতি নয়। বলুন দেখি, এমন কেউ আছে, যার সবকাজ মনমতো হয়? কখনোই অনাকাঙ্খিত কিছুর সম্মুখীন হতে হয় না? যত বড় সম্পদশালী, পুঁজিপতি বা ক্ষমতাশালী হোক না কেন, এ দাবি করতে পারবে না যে, আমি যা চাই, তাই হয়। কামনা-বাসনা কখনো কখনো বিসর্জন দিতেই হয়। এই বিসর্জন যদি আল্লাহ তাআলার পছন্দ মোতাবেক হয়, তাহলেই তা বান্দার জন্য আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের কারণ হয়। তাই নিজের ওপর জোর খাটিয়ে মনের বিরুদ্ধে আল্লাহ তাআলার হুকুম মেনে চলতে হবে। এই চিকিৎসা ছাড়া অলসতার আর কোনা চিকিৎসা নেই। আল্লাহ তাআলা নিজ মেহেরবানিতে আমাদের সবাইকে এ আয়াতের শিক্ষা অনুযায়ী আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন। ষ
[ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার বসুন্ধরায় কৃত হযরত মাওলানার একটি বয়ানের অনুবাদ। অনুবাদ : মুহাম্মাদ জাবির]
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন