কোরবানী দাতার জন্য জিলহজ্ব মাস শুরু হওয়ার পর নখ-চুল কাটা থেকে বিরত থাকা এবং কোরবানীর পর তা কাটা উত্তম, এটা তো অনেকেরই জানা কথা। কেননা এটা সুস্পষ্ট সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। উম্মে সালামা রা. থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
"যখন যিলহজ্বের দশক শুরু হবে তখন তোমাদের মধ্যে যে কুরবানী করবে সে যেন তার চুল নখ না কাটে।" (সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯৭৭; জামে তিরমিযী, হাদীস ১৫২৩)
উক্ত হাদীসের উপর ভিত্তি করে ফকীহগণ কুরবানীকারীর জন্য নখ-চুল না কাটাকে মুস্তাহাব বলেছেন। অবশ্য কোন কোন ফক্বীহ উক্ত হাদীসের কারণে কোরবানীর আগে নখ-চুল কাটা হারাম বলেছেন। অনেক কিতাবে হানাফী মাযহাব এর দিকে সম্বন্ধ করা হয়েছে যে, তাদের মতে কোরবানীর আগে নখ-চুল কাটা হারামও নয় মাকরূহও নয়। এসম্পর্কে শায়খুল ইসলাম আল্লাম তাকী উসমানী দামাত বারাকাতুহুম বলেন যে, হানাফীদের কিতাবে আমি এটা পাই নি। (তাকমিলায়ে ফাতহুল মুলহিম: ৩/৪৮৬)
তবে এ হুকুম তাদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে যারা যিলকদের শেষে নখ-চুল কেটেছে। অন্যথায় নখ-চুল বেশি লম্বা হয়ে যাবে যা সুন্নাতের খেলাফ।
এটা তো গেল ঐ ব্যক্তি সম্পর্কে আলোচনা যে ব্যক্তি কুরবানী আদায় করবে। কিন্তু যে কোরবানী আদায় করবে না তার জন্য এ হুকুম প্রযোজ্য হবে কি না এ ব্যাপারে কেউ কেউ বলেছেন যে, এ হুকুম শুধুমাত্র কুরবানী দাতার জন্য প্রযোজ্য। আর কেউ কেউ বলেছেন, কুরবানী যারা করবে না তাদের জন্যও এই বিধান।
তারা দলীল হিসেবে হযরত আমর ইবনুল আস রা. এর হাদীসকে পেশ করেন। তিনি বলেন, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমাকে কুরবানীর দিবসে ঈদ (পালনের) আদেশ করা হয়েছে। যা আল্লাহ এ উম্মতের জন্য নির্ধারণ করেছেন। এক সাহাবী আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! যদি আমার কাছে শুধু একটি মানিহা থাকে (অর্থাৎ অন্যের থেকে নেওয়া দুগ্ধ দানকারী উটনী) আমি কি তা কুরবানী করতে পারি? নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, না। তবে তুমি চুল, নখ ও মোঁচ কাটবে এবং নাভীর নিচের পশম পরিষ্কার করবে। এটাই আল্লাহর দরবারে তোমার পূর্ণ কুরবানী বলে গণ্য হবে। (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৭৮৯; সুনানে নাসায়ী, হাদীস ৪৩৬৫; মুসনাদে আহমদ: ১১/১৩৯; সহীহ ইবনে হিব্বান:১৩/১৬৩; মুসতাদরাকে হাকীম: ৪/২২৪)
হাদীসটির মান:
শায়খ নাসিরুদ্দীন আলবানী রহ. উক্ত হাদীসকে দুর্বল বলেছেন। (দেখুন যয়ীফু আবু দাউদ, হা. ৪৮২; মিশকাতুল মাসাবীহ, হা. ১৪৭৯)
তিনি বলেছেন-
وهذا اسناد ضعيف عندي، رجاله ثقات؛ غير الصدفي؛ فإنه لم يوثقه فيما ذكروا غير ابن حبان.
এই হচ্ছে তাঁর বক্তব্য তিনি দুর্বলতার কারণ হিসেবে ঈসা ইবনে হেলাল আস সাদাফীর এর জাহালতকেই দায়ী করেছেন। তিনি বলেন যে ইবনে হিব্বান রহ. ছাড়া অন্য কেউ তার তাওসীক করেন নি।
এটা শায়খ রহ. এর তাসামুহ ছাড়া আর আর কি বলা যেতে পারে। সম্ভবত তিনি আবু ইয়া’কুব ফাসাওয়ী রহ. এর তাওসীক সম্পর্কে অবগত হতে পারেন নি, নতুবা তিনি এমন বলতেন না। কেননা ফাসাওয়ী রহ. তার আল মা’রেফা ওয়াত তারীখ গ্রন্থে (২/৪৮৭) মিসরের নির্ভরযোগ্য তাবেয়ীনদের আলোচনা শুরু করেন এবং এক পর্যায়ে (২/৫১৫) সেই নির্ভরযোগ্য তাবেয়ীদের মধ্যে এই সাদাফী’র নাম উল্লেখ করেন।
এছাড়া মিশরের প্রসিদ্ধ পাঁচ ব্যক্তিত্ব এই সদফী’র কাছ থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন, তারা হলেন-১.আইয়াশ বিন আব্বাস আল কিতবানী ২.কা’ব বিন আলকামা ৩.ইয়াযীব ইবনে আবী হাবীব ৪.দাররাজ আবুস সামাহ ৫.আব্দুল মালেক বিন আব্দুল্লাহ আত তুজীবী। (দেখুন, আস সিকাত, ইবনে হিব্বান: ৫/২১৩; জখীরুতুল উক্ববা শরহুল মুজতাবা: ৩৩/২৮৩)
সুতরাং তাকে মাজহুল বলা ঠিক নয়।
হাফেজ ইবনে হাজার রহ. তাঁর আত তাকরীব এ সাদাফীকে ‘সাদূক’ বলেছেন। এছাড়া ফাতহুল বারীতে (১০/৮) তিনি অন্য এক আলোচনা প্রসঙ্গে বলেন, এ বিষয়ে আমর ইবনুল আস এর হাদীস দিয়ে দলীল দেয়া যায় অত:পর উপরোক্ত হাদীসকে উল্লেখ করে ইবনে হিব্বানের তাসহীহের কথা উদ্ধৃত করেন।
আর হাকীম রহ. হাদীসের সনদকে সহীহ বলেছেন হাফেয যাহাবী রহ.ও এতে একমত হয়েছেন। (আল মুসতাদরাক: ২/২২৪)
শায়খ আলবানী রহ. এর সমসায়িক আলেম শায়খ শুআইব আল আরনাউত উক্ত হাদীসের সনদকে মুসনাদে আহমদে (১১/১৩৯) হাসান বলেছেন আর সহীহ ইবনে হিব্বানে (১৩/১৬৩) সহীহ বলেছেন।
সারকথা: উপরোক্ত আলোচনা থেকে বুঝা গেল যে, হাদীসটি নির্ভযোগ্য।
উক্ত হাদীসে যেহেতু কুরবানীর দিন চুল-নখ কাটার কথা আছে তাহলে এর আগে না কাটার দিকে ইঙ্গিত বুঝা যায়। কিন্তু কতদিন আগে থেকে কাটবে না? যেহেতু কোরবানী দাতাকে জিলহজ্বের শুরু থেকে কাটা বন্ধ করতে বলেছেন এর উপর কিয়াস করে বলা যায় তার ক্ষেত্রেও এমনই হবে। এটা শুধু ধারণা বা কিয়াস নয় বরং এর সমর্থনে বিভিন্ন আসারও পাওয়া যায়। যেমন-
১.ওলীদ বিন মুসলিম বলেন, আমি মুহাম্মাদ বিন আজলানকে যিলহজ্বের দশকে চুল কাটা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। তখন তিনি বললেন, আমাকে নাফে রাহ বলেছেন যে, আব্দুল্লাহ ইবনে উমর এক নারীর নিকট দিয়ে অতিক্রম করছিলেন। মহিলাটি যিলহজ্বের দশকের ভেতর তার সন্তানের চুল কেটে দিচ্ছিল। তখন তিনি বললেন, যদি ঈদের দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে তবে বড় ভাল হত। (মুস্তাদরাকে হাকেম,হাদীস ২/২২১)
২.মুতামির ইবনে সুলাইমান আততাইমী বলেন, আমি আমার পিতাকে বলতে শুনেছি যে ইবনে সীরীন রাহ. যিলহজ্বের দশকে চুল কাটা অপছন্দ করতেন। এমনকি এই দশকে ছোট বাচ্চাদের মাথা মুণ্ডণ করাও অপছন্দ করতেন। (মুসনাদে মুসাদ্দাদ-ইতহাফুল খিয়ারাহ: ৫/৩১১; আল মাতালিবুল আলিয়া: ১০/৪৪৮)
এসব দলীলের কারণে কারো কারো মতে সকলের জন্যই যিলহজ্বের প্রথম দশকে নখ, গোফ ও চুল না-কাটা উত্তম। তবে এতে কোনো সন্দেহ নেই, এ বিধানটি কুরবানিদাতার জন্য তাকিদপূর্ণ সুন্নত। তার জন্য এই অামল অন্যের তুলনায় বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন