অধ্যাপক আশরাফ জামান
শেখ আহমদ মুজাদ্দিদে আল ফেসানী (র.) ১৫৬৪ ঈসায়ী সালের ২৬ মে শুক্রবার ভারতের পূর্ব পাঞ্জাবের অন্তর্গত সারহিন্দ নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম আবু আল বারাকাত বাদব আল-দীন। তিনি ইসলাম জাহানের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর (রা.) বংশধর। তাঁর পিতার নাম শেখ আব্দুল আহাদ।অল্প বয়সে শেখ আহাদ কুরআনে হাফেজ হন। তারপর বিখ্যাত আলিমের কাছে গিয়ে কুরআনের তাফসীর, হাদীসসহ ইসলামী জ্ঞান অর্জন করেন। মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি অধ্যাপনা শুরু করেন। দীর্ঘ সময় আগ্রা শহরে বসবাস করেন। বাদশাহ আকবরের সভাসদ ফৈজী ও আবু আল ফাদল এর সঙ্গে তার পরিচয় হয়। কিন্তু দরবারে ইসলাম বিরোধী মনোভাবের পরিচয় পেয়ে শেখ আহমদ তাদের সঙ্গে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করেন।আগ্রা থেকে জন্মস্থান সারাহিন্দো ফিরে তিনি পিতার কাছে সূফীবাদে দীক্ষা নেন।বাদশাহ আকবর দীনই ইলাহী নামে দরবারে এক নতুন ধর্মের প্রবর্তন করেন। যা ইসলাম বিরোধী। এছাড়া রাজ্যে ইসলামের আকিদা ও বিশ্বাসকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে নানা জাতীয় আইন-কানুন প্রবর্তন করেন। এমনকি আকবরের দীনই ইলাহীর প্রতি মুসলমান সমাজের কিছু লোকও বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে।শেখ আহমদ (র.) আকবরের ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপ ও প্রবর্তিত নতুন ধর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন। তাঁর সঙ্গে অনেক মুরীদও এসে যোগ দেন। ফলে মুসলিম সমাজে এক নতুন চেতনার উদ্ভব হয়। বাদশাহ আকবর তার নতুন ধর্মপ্রচারে বাধাগ্রস্ত হন।বাদশাহ আকবরের মৃত্যুর পর তার পুত্র জাহাঙ্গীর সিংহাসনে বসেন। পিতার প্রবর্তিত ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপ তার শাসনামলেও অব্যাহত ছিল। তাঁর দরবারে বাদশাহকে সিজদা করার প্রচলন ছিল। শেখ আহমদ এই শেরেকী প্রথা বন্ধ করার জন্য রাজপুরুষ ও সেনাবাহিনীর মধ্যে প্রচার শুরু করলে তাঁর ডাকে অনেক সিপাই ও রাজপুরুষ আকৃষ্ট হলেন।বাদশাহ জাহাঙ্গীর প্রধান উজীর আসাফ খানের প্ররোচণায় শেখ আহমদকে দরবারে ডেকে আনলেন। দরবারে প্রবেশ করে শেখ আহমদ প্রথা অনুসারে বাদশাহকে সিজদা করতে অস্বীকার করলেন। অমাত্যবর্গের কথার উত্তরে তিনি জবাব দিলেন, “এই মস্তক আল্লাহ ছাড়া আর কারও কাছে নত হবে না।”বাদশাহ জাহাঙ্গীর একথা শুনে ক্ষেপে গিয়ে স্বয়ং আদেশ দিলেন সিজদা করার জন্য। কিন্তু তাতেও নির্ভীক কণ্ঠে তিনি উত্তরে একই জবাব দিলেন। বাদশাহ ক্ষীপ্ত হয়ে শেখ আহমদকে গোয়ালিয়া দুর্গে বন্দী করে রাখলেন।শেখ আহমেদের বন্দী হবার খবর পেয়ে কাবুলের শাসনকর্তা মহাব্বত খান সৈন্যসামন্ত নিয়ে রাজধানী আক্রমণ করতে চাইলেন। কিন্তু এ খবর পাবার পর পত্র দ্বারা তাদের নিরস্ত্র করলেন শেখ আহমদ।শেখ আহমদের জনপ্রিয়তা আরো বৃদ্ধি পেতে থাকলো। তাঁর চরিত্রের দৃঢ়তা আল্লাহর প্রতি ঐকান্তিকতা, অকুণ্ঠ আত্মত্যাগ তাঁকে মহান পুরুষ হিসেবে খ্যাতি এনে দিল। তাঁকে মুজাদ্দিদ বা ধর্ম সংস্কারক এর আসনে অধিষ্ঠিত করা হয়। এজন্য তিনি মুজাদ্দিদে আল ফেসানী হিসেবে সর্বত্র পরিচিত হন।কথিত আছে, একদিন আকস্মিকভাবে সম্রাট জাহাঙ্গীর সিংহাসন থেকে মাটিতে পড়ে যান। এতে ভীত ও পীড়িত হয়ে পড়লেন। কবিরাজের ঔষধপথ্য সকল কিছু ব্যর্থ হলো। তখন মনে তার ভয় জাগলো, মুজাদ্দিদের প্রতি অবিচার জুলুম করার জন্য। তখন তিনি মুজাদ্দিদকে মুক্তিদান করেন, তাঁকে সসম্মানে দিল্লিতে আনা হলো। শাহজাদা শাহজাহান ও আজম আসফ খান রাজধানীর তোরনে এসে তাঁকে অভ্যর্থনা করে নিয়ে গেলেন। রাজপ্রাসাদে গিয়ে প্রথম তিনি বাদশাহকে তাওবা করালেন। তারপর আল্লাহতায়ালার দরবারে দোয়া করলেন। অচিরেই বাদশাহ আরোগ্য লাভ করলেন।শেখ আহমদের ইচ্ছানুসারে রাজ দরবারে সিজদাপ্রথা বাতিল করা হলো। মুসলমানদের জন্য মসজিদ, মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা হলো। ধর্মীয় বিধিনিষেধ বাতিল করা হলো যা ছিল ইসলাম বিরোধী। দরবার সংলগ্ন একটি সুন্দর মসজিদ নির্মাণ করা হলো। বাদশাহ ও তার মুসলিম অমাত্যবর্গ মসজিদে নিয়মিত নামাজ পড়া শুরু করলেন। মুজাদ্দিদের সঙ্গে পরামর্শ করে সম্রাট রাজ্যে নানাবিধ ইসলামী রীতিনীতি প্রচলন করলেন। ১৬২৪ ঈসায়ী সালের ৩০ নভেম্বর সারহিন্দে শতাব্দীর অগ্নি পুরুষ ইসলামী চিন্তাবিদ ও দার্শনিক মুজাদ্দিদে আল ফেসানী ইন্তিকাল করেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন