বৃহস্পতিবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০১৬

মাও. মুহিউদ্দীন খান রহ. এর অপ্রকাশিত একটি সাক্ষাৎকার

Mohiuddin Kasemi

সমকালীন অজানা অনেক বিষয় আলোচিত হয়েছে; যেগুলোর প্রতি আমাদের আকর্ষণ আছে। তাই পড়ে দেখতে পারেন। অনেক জিজ্ঞাসার জবাব পাওয়া যাবে।
কওমিয়ত-গাইরে কওমিয়ত চিন্তা থেকে বেরুতে হবে ঐক্যের অপেক্ষায় নিজের দায়িত্বে অবহেলা নয়
-মাওলানা মুহিউদ্দীন খান রহ.

[এতো বড় একজন লেখকের কাছে যাবো- কোনোরকম ব্যাকগ্রাউন্ড ছাড়া কী করে হাজির হই? জিজ্ঞেস করলে কী বলবো- শুধু পড়াশোনা? এলাকার ছেলে?... অপেক্ষার প্রহর গড়াতে গড়াতে কখন সন্ধ্যা নেমে এলো, টেরই পেলাম না। কিছু একটা বলার মতো অবস্থান তৈরি করে যখন সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম- তিনি অসুস্থতায় জর্জরিত। এই ভালো তো এই খারাপ। কথা বলতেও কষ্ট। তবু এটা-সেটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করি- তিনি বলে যান। মিশুক প্রকৃতির ছিলেন, তরুণদের এমনিতেই খুব প্রশ্রয় দিতেন। গফরগাঁয়ের হওয়ায় আমি হয়তো প্রশ্রয়টা একটু বেশিই পেতাম। অপ্রিয় এবং স্পর্শকাতর বিষয়েও তাই হাসিমুখেই আমার প্রশ্নগুলোর জবাব দিয়ে যেতেন। পড়াশোনা-ক্যারিয়ার বিষয়ে পরামর্শ, লেখালেখি, সময় ও তারুণ্য, সমাজ বা রাজনীতি- কতো কথাই তো হয়েছে। একসময় মনে হলো কিছু কথা রেকর্ড করে রাখি। বেশ কিছু আলোচনার রেকর্ড জমা হলো। সেগুলো শুনে আরো কিছু প্রশ্ন সাজিয়ে রাখলাম- বড় একটা সাক্ষাৎকার নেবো বলে কিংবা একটা সিরিজ আলোচনা। তিনি কথাও দিলেন। হায় কপাল, পারলাম কই! কিছুই না বলে রমজানের পবিত্র মাসে তিনি তার মাহবুবের ডাকে সাড়া দিয়ে ফেললেন। আমরা বঞ্চিত হলাম। রয়েই গেলাম। সেদিন হেরার জ্যোতি পরিবারের ফোন পেয়ে আবার রেকর্ডগুলো শুনলাম। মোবাইলের দুর্বল রেকর্ডিংয়ে তার আরও ক্ষীণতম কণ্ঠ- বেশ বেগ পেতে হলো। তবু কীভাবে যে ঘন্টা তিনেক সময় পেরিয়ে গেলো। কতোসব গুরুত্বপূর্ণ তথ্যই তো জমা হয়ে আছে!... 
 তাকে নিয়ে অনেক কিছুই লেখা যায়। বরং প্রশ্ন- কী লেখা যায় না?...কথার রেকর্ডগুলো নামালেও তো বিশাল আকার দাঁড়াবে। নিজের ব্যস্ততা আর হেরার জ্যোতি পরিবারের তাড়াহুড়োয় এ মুহূর্তে কোনোটিই দেখলাম সম্ভব নয়। আলোচনার যে কোনো একটা পার্ট উদ্ধারের ভাবনাকেই আপাতত শ্রেয় মনে হলো। আমার সাথে করা ব্যক্তিগত আলোচনার রেকর্ডে বেশ অনেকগুলো স্পর্শকাতর ইস্যু, হুট করে সেগুলো তুলে ধরা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। তবে শেষ সাক্ষাৎটা চমৎকার একটা ইস্যু উপলক্ষে হয়েছিলো। লেখক ও সাংবাদিক নোমান বিন আরমানের আগ্রহে হযরতের প্রিয় বিষয় নবীজীর সীরাতকে কেন্দ্র করে একটি গ্রুপ আলোচনা। বেশ কিছু সাম্প্রতিক ইস্যুও যুক্ত হয়ে আলোচনাটি দীর্ঘতর এবং দারুণ প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিলো। নোমান বিন আরমান, মনযূরুল হক এবং আমার সঞ্চালনায় সে সাক্ষাতে পরে আরো ক’জন মেহমানও যুক্ত হয়েছিলেন। মৌসুমের আগেই বাজারে আসা বিশেষ প্রজাতির বরই খেতে খেতে সেদিন সন্ধ্যায় বেশ সপ্রতিভ ভঙ্গিতেই কথা বলছিলেন পরম প্রিয় ও শ্রদ্ধেয় মাওলানা মুহিউদ্দীন খান। রাহমাতুল্লাহি আলাইহি। সে আলোচনার ছোট্ট একটা অংশ এখানে তুলে ধরলাম, প্রায় হুবহু। সংশ্লিষ্ট সবাই আশা করি দারুণ কিছু তথ্য এবং চিন্তার খোরাক পাবেন। ধন্যবাদান্তে- শাকিল আদনান ]

শাকিল আদনান: হুজুর, সীরাত বিষয়ে সিলেট থেকে একটা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে..
নোমান বিন আরমান: আমার ক’জন বন্ধু যারা মূলত বাইরে থাকে, আমরা মিলে একটা সীরাত মিডিয়া ফাউন্ডেশন করতে চাচ্ছি। এর অধীনে সীরাত টিভি এবং অনলাইনে সীরাত- এমন কিছু কাজ আমরা করতে চাই। উদ্যোগের প্রাথমিক পুঁজি হিসেবে কোরআনে বর্ণিত ২৫ জন নবীকে নিয়ে একটা গ্রন্থ করতে চাচ্ছি। সবার পক্ষে তো বিস্তৃত সীরাত পড়া সম্ভব না, তাই সংক্ষিপ্ত একটা গ্রন্থ তৈরি করা। অন্তত নবীদের মৌলিক বিষয়গুলো যেনো চলে আসে। যেমন যদি কাউকে প্রশ্ন করা হয়- হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের স্ত্রী কে ছিলেন, সবাই ভাবা শুরু করবে কে যেনো ছিলেন! কিন্তু তিনি তো বিয়েই করেন নি। এসব মাথায় রেখেই একটা কাজ করতে চাই, যাতে বড় নবীদের নিয়ে মৌলিক তথ্যগুলো সামনে চলে আসে। এ ব্যাপারে আপনার কাছে আসছি কারণ এ দেশে সীরাত নিয়ে এককভাবে আপনিই সবচে’ বেশি কাজ করেছেন। আমরা এক্ষেত্রে কী কী করতে পারি বা এ মুহূর্তে আপনার ভাবনাই বা কী?
মুহিউদ্দীন খান রহ.: নাম কি দিচ্ছেন? (প্রস্তাবনার খসড়াটা হাতে নিয়ে)- নবীকোষ?... কেমন শোনায় না!...
নোমান: জ্বি, এটা নিয়েও যদি কিছু বলার থাকে, আমরা প্রাথমিকভাবে এটা রেখেছি।
শাকিল: কোষ বলতে তো ব্যাপক কিছু বোঝায়, এটা তেমন নয়। শুধু সংক্ষিপ্ত একটা আদল তৈরি করার চেষ্টা। পরে ধীরে ধীরে আরও বড় এঙ্গেলে কাজ করা। সীরাত যেনো বাৎসরিক বা সাময়িক ভাবনায় আটকে না থেকে সবসময়ের চর্চায় পরিণত হয় বা হতে পারে এমন একটা চিন্তা থেকেই উদ্যোগ...
[লিফলেটটা পড়ছিলেন খুব মনোযোগ দিয়ে...কিছু প্রশ্নও করলেন পড়তে পড়তে। যেমন- হযরত ঈসার পর কোনো নবী এসেছেন কি? এটা একটা প্রশ্ন ছিলো, বললেন- কোনো নবী ছিলেন কিনা এটা একটা প্রশ্ন, থাকলে কে বা কারা সেটাও একটা প্রশ্ন। কিতাবে পাওয়া যায় দুজন নবী এসেছিলেন। মশহুর বর্ণনায় পাওয়া যায় না। তবে এসেছিলেন। নাম তো এ মুহূর্তে মনে নেই। তবে তাদের কোনো কিতাব বা নতুন শরীয়ত ছিলো না।]
শাকিল: এসব ক্ষেত্রে সীরাতের কোন কিতাবকে আমরা মূলে রাখতে পারি?
মুহিউদ্দীন খান: সীরাতুননবী। 
শাকিল: লেখক?
মুহিউদ্দীন খান: আল্লামা শিবলী নোমানী। সীরাতুননবীর সম্ভবত তৃতীয় খ-ে এই তথ্য আছে।
শাকিল: আমাদের নবীসহ সকল নবীদের নিয়ে সীরাতের এই চিন্তাটা কেমন?
মুহিউদ্দীন খান: ভালো।
শাকিল: আমরা তো সীরাত বলতে কেবল আমাদের নবীকে নিয়েই বুঝি বা বুঝতে চাই...
নোমান: মানে সীরাতের ধারণাটা কি শুধু হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেন্দ্রিক, না সামগ্রিক?
মুহিউদ্দীন খান: সামগ্রিক...
নোমান: প্রশংসা তো সবারই করা উচিত, ঈমানও তো সবার ওপরই আনতে হবে।
শাকিল: এই চর্চার মডেলটা কেমন হওয়া উচিত? 
মুহিউদ্দীন খান: কোনটা?
শাকিল: রবিউল আউয়াল থেকে বেরিয়ে সামগ্রিক করা বা এই যে অনলাইন কার্যক্রম শুরুর চিন্তা এসব কেমন? নিউজের মতো প্রতিমুহূর্তে আলোচনা ও তথ্য বিনিময় হতে থাকলো। মানে স্বতন্ত্র এই চিন্তার ধারাটা...
মুহিউদ্দীন খান: আমি তো কতো চিন্তাই করে রাখছি। সব তো মনে থাকে না। এই যে দুজন নবীর নাম ভুলে গেলাম। এইটুকু মনে আছে যে কোথাও পড়েছি- দুজনের নাম।
শাকিল: বেসিকটাও তো দরকার। আপনার যেমন কাজ করে অভিজ্ঞতা বা ব্যাপক জানাশোনা হয়েছে- সে হিসেবে তো আমরা কোনো ধারণাই রাখি না। আমরা এখন কোন পথে আগাতে পারি বা কোন বিষয়গুলোকে বড় করে সামনে আনতে পারি।
মুহিউদ্দীন খান: খুব জটিল কিছু তো না। বড় বড় কিছু কিতাব আছে। এগুলো পাঠে রাখলেই হয়। সীরাতুননবী। এটা ৬ খ- ছিলো। আরেক খ- পাকিস্তানে পরে পাওয়া গেছে। আল্লামা সৈয়দ সুলায়মান নদভী সাহেবের কিছু লেখায় এবং ডায়রিতে এ তথ্য ছিলো যে, সীরাতুননবীর আরো কিছু পার্ট আছে। পরে পাকিস্তানের তাকি উসমানী সাব, ইনারা দায়িত্ব নিয়ে সেটা খুঁজে বের করলেন। এটা এখন সাত খ-ের।
শাকিল: আর কোন কিতাব নিতে পারি? ..ইবনে হিশাম, সীরাতে ইবনে হিশাম?
মুহিউদ্দীন খান: এগুলো তো থাকবেই। মৌলিক কিতাব।
নোমান: উপমহাদেশের আর কাকে আমরা পাঠে রাখতে পারি। আপনি শিবলী নোমানীর কথা বললেন- এর বাইরে আর কেউ?
মুহিউদ্দীন খান: তার ওজনের আর কেউ নেই।
শাকিল: কিছু ব্যাপার তো এমনও যে, অতীতে বড় যতো সব কাজ হয়েছে এগুলোকে সামনে রেখে বা সেগুলোর নির্যাস নিয়েই তারা মানে দেওবন্দী আলেমরা গত শতাব্দীতে কাজগুলো করেছেন- সুতরাং তাদেরকে পড়লেও তো ইতিহাসের পুরো নির্যাসটা পাওয়ার কথা...
মুহিউদ্দীন খান:...(ভাবলে বা স্বাস্থ্যে কোনো অস্বস্তি অনুভব করলে নীরব হয়ে যেতেন)
মনযূরুল হক: ভালো একটা বই করা নিয়ে আমরা অনেক সময় সংকটে ভুগি। কী করা উচিত, কী করা উচিত না। আর একটা বিষয় যে, একজন ছেলের ২৫-৩০ বছর বয়সের মধ্যে কোন কোন বইগুলো পড়ে ফেলা উচিত?
মুহিউদ্দীন খান: (বেশ অনেক্ষণের নীরবতা ভেঙে)...সীরাতুননবী পুরোটার অনুবাদ আমি করেছিলাম। আর তখন তো আমাদেরও দুর্দিন, ইসলামী সাহিত্যেরও দুর্দিন। তো আমার এক বন্ধু সেটা প্রকাশ করবেন বলে নিয়ে গেলেন। আল্লাহ পাকের কি ইচ্ছা হঠাৎ তিনি হার্ট এ্যাটাকে মারা গেলেন। সেই পা-ুলিপিটা তার স্ত্রী রেখে দিয়েছিলেন। পরে তার এক পরিচিত জন সেটা নিয়ে যায়। টুকরো টুকরো করে কিছু সে প্রকাশও করেছিলো।
শাকিল: সামগ্রিকটা আর পাওয়া যায় না?
মুহিউদ্দীন খান: সব মিলালে হতেও পারে।
নোমান: পরে তো আপনার মদীনা পাবলিকেশন্স প্রতিষ্ঠিত প্রকাশনীতে পরিণত হলো- তখন কোনো উদ্যোগ নেন নি?
মুহিউদ্দীন খান: পা-লিপিটা আর পাওয়া যায় নি।
শাকিল: সীরাতের বিশেষ কোন কোন ক্ষেত্র- আপনার মতে যেগুলো নিয়ে কাজ এখনো বাকি বা আরো বেশি করে করা উচিত?
মুহিউদ্দীন খান: আমার ধারণায়, বিশেষ একটা ব্যাপার হতে পারে- পুরো কুরআনে রাসূলে কারীম সা. যেভাবে উপস্থাপিত হয়েছেন তা তুলে আনা। কোথায় কীভাবে রাসূলের আলোচনা এসেছে এগুলো।
নোমান: আমাদের এই গ্রন্থণাতেও অবশ্য কুরআনে নবীর একটা পার্ট আমরা রেখেছি। ২৫ নবী কীভাবে কুরআনে এসেছেন তাও থাকবে। এগুলোর সাথে আর কী কী এড করা যায়?
মুহিউদ্দীন খান: এগুলোই করে দেখেন না আগে।
শাকিল: এই যে ভাবনাটা বললেন- কুরআনে নবী- এ নিয়ে কি আরবি-উর্দুতে কোনো কাজ আছে, না মৌলিক কাজ করবো আমরা?
মুহিউদ্দীন খান: আমার চোখে এখনো পড়ে না। মৌলিকই হতে হবে।
শাকিল: আর একটা বিষয়। ব্যক্তি নবী, তার সংসার বা দিনযাপন- নবুওয়ত থেকে আলাদা করে- এই চিন্তা থেকে কি কাজ হয়েছে বা করা যায়? নবুওয়তের আগে-পরের বিবরণ তো পাওয়া যায়- কিন্তু মৃত্যু পর্যন্ত জীবন বা মানুষ নবীর হালাতটা?
মুহিউদ্দীন খান: আমরা যেটুকু জানি বা কুরআন যেভাবে জানায় সে অনুপাতে নবীদের ব্যক্তি জীবন বলতে কিছু ছিলো না। আল্লাহ পাক কতৃক তারা নিয়ন্ত্রিত ছিলেন এবং পরিচালিত হতেন। যখন যা-ই তারা করেছেন, আল্লাহর হুকুমেই করেছেন। সুতরাং ব্যক্তি জীবন বলে আলাদা কিছু করার সুযোগ নেই।
নোমান: আপনর তো সীরাত বিষয়ক পাঠ সবচে বেশি। নবীরা যে দাওয়াতি কাজ করেছেন, তাদেরকে যে সমস্যা ফেস করতে হয়েছে সেগুলো কি একইরকম ছিলো না ভিন্ন ভিন্ন?
মুহিউদ্দীন খান: সমস্যা ছিলো তা ঠিক তবে ধরন-ধারণ ছিলো সে সময়ের আর্থ সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষিতে। আরেকটা বিষয়কে আপনারা গুরুত্ব দেন- নবীরা যখন যে সমাজে এসেছেন সে সমাজের উন্নয়ন এবং আদর্শীকরণে তাদের অবদান এবং ভূমিকা কেমন ছিলো বা কতোটুকু ছিলো এগুলো লেখেন।
নোমান: জ্বি, আমরা সেটাও আনতে চাচ্ছি। একই সাথে নবী নিজে কেমন অবস্থানের ছিলেন, কেমন পরিবারের বা কেমন আর্থিক অবস্থানের- ইত্যাদি। এই ব্যাপারগুলো কোথায় পাওয়া যেতে পারে?
মুহিউদ্দীন খান: একসাথে এগুলো কোথাও পবেন না। সীরাতুননবীই পড়েন না।
মনযূর: পরে কি এটা কেউ আর অনুবাদ করছেন বা বাংলা কি পাওয়া যায়?
মুহিউদ্দীন খান: নাহ...
মনযূর: অনেক দেশে তো সফর করছেন। সফরনামা কি লিখেছেন?
মুহিউদ্দীন খান: নোট আছে। প্রকাশিত হয় নি।
মনযূর: ফিলিস্তিনে গিয়েছিলেন? কোনো স্মৃতি কি মনে পড়ে?
মুহিউদ্দীন খান: গিয়েছি। তারপর জর্ডান হয়ে আসহাবে কাহাফের গুহাও দেখে এসেছি।
নোমান: একটা বিষয় জানতে চাওয়া। আপনি তো কাছ থেকে দেখেছেন। আমরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধকালীন মানুষের ছবি দেখলে দেখি অসহায় আর ভগ্ন স্বাস্থের সব মানুষ। প্রায় হাড্ডিসার। আর ফিলিস্তিনের দিকে তাকালে, যারা দশকের পর দশক ধরে যুদ্ধাবস্থায় আছে- তারা তো বেশ ভালো স্বাস্থের অধিকারী। সুস্বাস্থ্য ও লাবণ্য দুটোই সমানভাবে তারা ঠিক রাখছে- কীভাবে?
মুহিউদ্দীন খান: এটা একটা ভালো প্রশ্ন। তবে কথা কি- যারা মূলত যুদ্ধ করে তাদেরকে তো আমরা দেখি না । দেখি যারা যুদ্ধের বাইরে আছে বা বিভিন্ন দেশে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে তাদের। তারা তো মোটামুটি ঠিকই থাকবে। ফলে বাস্তব অবস্থা বলা মুশকিল।
মনযূর: ওখানে কখনো দুর্ভিক্ষ হয়েছে বলেও তো শুনি নি।
মুহিউদ্দীন খান: না, সেরকম নয়।
শাকিল: উল্টোচিত্রটা বারবার সামনে আসার কারণ তো রাজনৈতিকই।
মুহিউদ্দীন খান: হুম। আরেকটা ব্যাপার হলো তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থান আমাদের চেয়ে ভালো ছিলো সবসময়। জীবনমানও।
শাকিল: আপনি তো সীরাত নিয়ে প্রচুর কাজ করেছেন। অনুবাদ। মৌলিকও। একটু যদি মনে করতে বলি তালিকায়নের প্রয়োজনে, তাছাড়া আর কী কী করার ইচ্ছে বা করতে চাইতেন সেগুলোও যদি বলতেন।
মুহিউদ্দীন খান: সীরাতুননবী করেছি। ৭ খ-ের। তারপর সীরাতে খাতামুল আম্বিয়া। তারপর... মনেই তো করতে পারছি না... 
নোমান: সীরাত নিয়ে আর কি কাজের স্বপ্ন ছিলো আপনার?
মুহিউদ্দীন খান: সীরাতে হালাবিয়ার অনুবাদসহ আরো অনেক কিছুই...
শাকিল: আপনার বইগুলো তো মদীনা থেকেই বেরিয়েছিলো, বাইরেও আছে কি?
মুহিউদ্দীন খান: কিছু কিছু। বাংলা একাডেমি, এমদাদিয়া লাইব্রেরি। তারপর আরেকটা কী লাইব্রেরি যেনো...
শাকিল: এগুলোর তালিকা কি কোথাও সংরক্ষিত আছে?
মুহিউদ্দীন খান: এগুলো মনে করতে হবে। একদিন সকালে বসলে রাত্রে গিয়ে হয়তো মোটামুটি মনে করে শেষ করা যাবে।
শাকিল: আপনি অনুমতি দিলে আমরা একদিন আসলাম। তালিকাটা হলো। তাহলে তো এগুলো সংরক্ষণের পাশাপাশি পরে যারা কাজ করবে তাদেরও সুবিধে হবে। পুনরাবৃত্তিও এড়ানো যাবে। আপনার সাথে সীরাত নিয়ে সমসাময়িক আর কেউ ভালো কাজ করেছেন বলে মনে পড়ে?
মুহিউদ্দীন খান: একজন ছিলেন ওয়েস্ট বেঙ্গলের। নাম যেনো কী মনে পড়ছে না। দু বছর আগে মারা গেছেন।
শাকিল: বই কি বাংলাদেশ থেকেই প্রকাশিত হয়েছে না ওখান থেকে?
মুহিউদ্দীন খান: বাংলাদেশ থেকে। মাঝে-মধ্যে আসতেন আমার কাছে।
শাকিল: পুরনো কোনো লাইব্রেরিতে খুঁজলে কি পাওয়া যেতে পারে?
মুহিউদ্দীন খান: পারে। আরেকজন ছিলো, মোটামুটি ভালোই করতো। সংগ্রামের সম্পাদক ছিলো। মারা গেছেন।
শাকিল: আবুল আসাদের আগে?
মুহিউদ্দীন খান: হ্যাঁ...
শাকিল: আব্দুল মান্নান তালিব?
মুহিউদ্দীন খান: তালিব, হ্যাঁ, আব্দুল মান্নান তালিব।
শাকিল: আপনি তো রাবেতার সদস্য ছিলেন। সেখানে ভারত-পাকিস্তানসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের আলেমরাও ছিলেন- তারে মধ্যে কে কে ভালো কাজ করেছেন?
মুহিউদ্দীন খান: আমার মতে, এই ভাবনা বা সীরাত নিয়ে মাথা ঘামাইছে এমন লোক আমি দেখি নাই। ভারত-পাকিস্তানের আলেমরাই যা একটু ভালো কাজ করেছেন।
নোমান: অন্য এ্যাঙ্গেল থেকে একটা প্রশ্ন। আমরা বলি হযরত ঈসা আ., খ্রিস্টানরা বলে যিশু, আবার অনেকে বলে হিন্দুরা যাকে শ্রীকৃ- বলে তিনিই মুসা আ.- এগুলোকে আপনি কীভাবে দেখেন?
মুহিউদ্দীন খান: আমার কাছে একটা বই ছিলো তাতে লেখা যে, পৃথিবীর প্রথম নবী হিন্দুদের মধ্যেই ছিলেন।
নোমান: জ্বি, আমিও ভারতীয় এক আলেমের এমন একটা আলোচনা শুনেছি। ভিডিও লিংকও আছে আমার কাছে..
মুহিউদ্দীন খান: এগুলো তারা লেখছে ঠিক আছে কিন্তু তারা তো নির্ভরযোগ্য নয়। তবে প্রথম দিকের নবী-রাসূলগণ এই দক্ষিণ এশিয়াতেই এসেছিলেন। হযরত আদমের আ. চুলাও তো এখানেই পাওয়া গেছে।
আমরা: চুলা না পায়ের ছাপ?
মুহিউদ্দীন খান: না, চুলা। তাছাড়া এখন যেটা আরব সাগর সেটা একসময় ছিলো না। 
শাকিল: সেখানে কি মানব বসতি ছিলো?
মুহিউদ্দীন খান: হ্যাঁ, মানব বসতি ছিলো। লেখক সে বইয়ে প্রমাণ করেছেন যে হযরত নূহ আ. এর কিশতিতে ৬ কোটি মানুষ ছিলো।
মনযূর: ছয় কোটি!
শাকিল: এবং তারা আরব সাগরের জায়গাটিতে বসবাস করতেন?
মুহিউদ্দীন খান: আরব সাগর আর ...মনেই আসছে না। বইটা খুব দামি ছিলো। করাচি থেকে বেরিয়েছিলো।
শাকিল: আপনার সতীর্থ কেউ ছিলেন এসব কাজে, এই চিন্তার বা এগুলো জানতেন- আমরা যার সাথে কথা বলতে পারি? বা মাঝে-মধ্যে এলে আপনি একটু কষ্ট করে সময় দিলেন...
মুহিউদ্দীন খান: আমি যেটুকু পারি সহযোতিা করতে রাজি আছি।
শাকিল: সীরাত বিষয়ক এই প্রেরণাটা আপনি কীভাবে পেলেন? আপনার সমসাময়িক কেউ কাজ করছে না- না দেশের, না বাইরের...আর আপনি সারাজীবন কাজ করে গেলেন...
নোমান: আপনি নতুন একটা ধারা তৈরি করলেন বাংলা সাহিত্যে- এই প্রেরণা কীভাবে এলো, সূচনাটা কীভাবে?
মুহিউদ্দীন খান: এটা আমি সৈয়দ সুলায়মান নদভীর সীরাতুননবী থেকেই পাইছি।
শাকিল: বই পড়ে?
মুহিউদ্দীন খান: হ্যাঁ...
শাকিল: বিশেষ কোনো প্যাসন না থাকলে একটা বই পড়ে পাওয়া প্রেরণার বলে কি সারাজীবন কাজ করা যায়?
মুহিউদ্দীন খান: ব্যাপার তো রাসূলের ইলমি দায়িত্বের...
শাকিল: কেন একটা বই পড়ে এমন প্রেরণা আপনি পেলেন বা এতোটা প্রভাবিত হলেন যে সারাজীবন এই কাজটা ধরে রাখলেন- যা আরো হাজারজন পড়ছে তাদের কারো মধ্যে এই বোধ আসছে না।
মুহিউদ্দীন খান: বইটা পড়ার সময় মনে এলো যে সীরাত নিয়ে তেমন কাজ হয়নি। যথাযথ কাজ হয়নি। তো আমি এতে আত্মনিয়োগ করি। 
নোমান: আরকটা বিষয়। একটা সময় মদীনার সীরাত সংখ্যাটা খুবই সমৃদ্ধ কলেবরে বেশ আয়োজন নিয়ে প্রকাশ পেতো। এরপর এই চর্চার ধারা থেকে আমরা কেন সরে এলাম বা মদীনার অবস্থানটাই বা কী?
মুহিউদ্দীন খান: মানে আমার গায়ে যতোদিন বল ছিলো আমি করেছি। এখন যারা করছে এদের তো এ ধৈর্য্য নাই।
শাকিল: এমন কোনো বিষয়ও কি যে, পাঠকেরা চাইলে পত্রিকাগুলো এমন আয়োজন করতে বাধ্য কিন্তু পাঠকের আগ্রহের ঘাটতির কারণে এখন হচ্ছে না- এমন কানো ব্যাপারও কি থাকতে পারে?
মুহিউদ্দীন খান: না, যে পরিমাণ আশা করেছিলাম সে পরিমাণ আগ্রহ পাঠকেরও নাই।
নোমান: আপনি যেমন ধারণা করতেন সেরকম নাই?
মুহিউদ্দীন খান: না...
মনযূর: মানুষ কি এগুলোকে অনেক আগের কথা বা সেকেলে কথা মনে করে- এরকম?
মুহিউদ্দীন খান:...
নোমান: সীরাতের সংখ্যগুলো আপনাদের সংগ্রহে আছে কি-না?
মুহিউদ্দীন খান: বাংলাবাজার গিয়ে একদিন খোঁজ করেন। গুদামে আছে। সব হয়তো নেই।
শাকিল: আপনার অনুমতি পেলে তো যাওয়া যায়- একটা কাজ হলো।
মুহিউদ্দীন খান: যান না...
শাকিল: আমাদের পাঠবিমুখতার যে একটা ব্যাপার- বিশেষত বাঙালি মুসলমানের। আমরা পড়তে চাই না। দেখা যায় মাহফিল ওয়াজে খুব যাচ্ছি। মসজিদের বয়ানও শুনি। নিজে পড়ে জ্ঞান অহরণের চর্চাটা নেই। শিক্ষিত যারা তারাও পড়ছে নিজেদের মতো করে, মৌলিক জায়গায় আসতে চায় না। এই সংকট কী করে কাটানো যায় কিংবা এই দূরত্ব কী করে ঘুচানো যায়?
মুহিউদ্দীন খান: হাসি...
শাকিল: মানে কোনো সম্ভাবনা আছে?
মুহিউদ্দীন খান: কী বলা যায়? এটা তো ঐতিহাসিক ব্যাপারের মতো। বাংলার মুসলমানদের এই মানসিকতাটা ভালো না...
মনযূর: যেটা বলছিলেন যে, গোড়ায় সমস্যা...
শাকিল: আপনার মদীনার যে পাঠকগোষ্ঠী, একটু শিক্ষিত- একটু সাধারণ সমাজ। এটা কীভাবে হলো বা মদীনা একটু তাদের ঘরানার হলো কী 
করে?
নোমান: আমরা যাদেরকে একটু প্রগতিশীল মনে করি, যারা সমাজের মূল স্্েরাত- ধর্মীয় পত্রিকা হওয়া সত্ত্বেও মদীনা তাদের কাছে কী করে পৌঁছলো? আমাদের যারা করে তারা তো বিশেষ শ্রেণীর পত্রিকা করে। কেউ মুরিদদের জন্য, কেউ তালেবুল ইলমদের জন্য, কেউ তাবলিগের জন্য, আপনার পত্রিকা গণমানুষের হলো কী করে?
মুহিউদ্দীন খান: সাধারণ মানুষের যে চাহিদা সেদিকে খেয়াল রেখেছি। এদেশের মানুষেরা নাস্তিক হলেও সীরাত নিয়ে, ইসলামের বিষয় নিয়ে জানতে বুঝতে চায়...
নোমান: জ্বি, এই ব্যাপারটা খুব আছে। কালকে রাতে আমাকে হোটেলে থাকতে হয়েছে। রাত দুটোয় বাস থেকে নেমে হোটেলে গেলাম। একটু পর দেখি ম্যানেজার তার কাউন্টার থেকে বেরিয়ে তাহাজ্জুদ পড়ছে। মহিলারা আজান হলে সাথে সাথে মাথায় কাপড় দেয়। পুরো সমাজে এই ব্যাপারটা আছে। তাদের ফিতরতেই ব্যাপারটা রয়ে গেছে...
শাকিল: আপনি তখন মানুষের এই মানসিকতাটা কীভাবে ধরতে পারলেন, তাদের মনের ভাষাটা কী করে পড়লেন?
মুহিউদ্দীন খান: আমি আমার কর্মজীবন শুরু করি একটা উর্দু পত্রিকায়। তো উর্দু পত্রিকার পাঠকেরা খুব পড়–য়া হয়। দেখা যায় সারাজীবন নামাজ পড়েনি, কিন্তু নবীজীর বিষয়ে জানতে উদগ্রীব। নবীপ্রেম নিয়ে কিছু বাড়াবাড়ি আছে তাদের, প্রেমও তো আছে...
শাকিল: আপনি যে লেভেলটা নিয়ে কাজ করলেন। তাদের ভাবনা ও অবস্থন তো এতোদিনে নিশ্চয় উন্নীত হয়েছে। আমরা এখন সে স্তর থেকে কাজ করবো না নতুন যারা আসছে, তরুণ প্রজন্ম- তাদের কথা ভেবে কাজ করবো? প্লাটফর্ম তো আলাদা আলাদা হয়ে যাচ্ছে...
মুহিউদ্দীন খান: আমার মনে হয় একটা সার্ভে করতে পারেন। যে পর্যন্ত কাজ হয়েছে সেটা বের করতে পারলে সেটাকে ভূমিকা হিসেবে রেখে বাকি কাজ সামনে নিতে পারেন।
নোমান: একটা ব্যাপার। মদীনাকে যে শেকড়ে আপনি নিয়ে গিয়েছিলেন বা যে প্রত্যাশায় উন্নীত করেছিলেন- আপনার কি মনে হয় মদীনা এখন সে শিকড়ে আছে? এই না থাকা বা মদীনা আরো বৃহত্তর প্রতিষ্ঠান না হওয়ার কারণ কি? আপনার নিশ্চয় স্বপ্ন ছিলো এটি একটি মিডিয়া হাউজ হবে, এই মিডিয়া হাউজ না হওয়ার কারণ কি?
মুহিউদ্দীন খান: এটা আমার অযোগ্যতা...
নোমান: আপনার অযোগ্যতা নয়। আপনি যে গতিতে যে পর্যন্ত নিয়ে আসছেন সেটা তো অবশ্যই আপনার যোগ্যতার বলেই। একটা সময় তো লাখের ওপর সার্কুলেশন ছিলো। কিন্তু এখন যে হাল- মানে আমি শেষ কবে মদীনা পড়েছি বলতে পারি না। অথচ একটা সময় মদীনা পড়ে আমাদের সকাল হয়েছে। মুসলিম জাহান পড়ে আমরা বাংলা শিখেছি- এখন সে মদীনা কেন চোখে পড়ে না? এখন সার্কুলেশন-প্রভাব কোনোটাই তো নেই।
মুহিউদ্দীন খান: (ফোনে রিং। দেখলেন, রিসিভ হলো না...।) আমি এক সময় চিন্তা করেছি যে কখন কী হয়ে গেলো? এবং কেন হলো? আমি তো স্বেচ্ছায় এমন করি নাই। কিন্তু আস্তে আস্তে কমে গেলো কেন। এখন ৫০-৫৫ হাজার ছাপা হয়। এখনও ৫০ এর উপরে। একসময় দেড় লাখ কপি ছাপতে হতো। কখনো কখনো একাধিক এডিশনও ছাপতে হয়েছে। বিশেষ করে সীরাত সংখ্যা।
নোমান: জ্বি, সীরাত সংখ্যা তো অবশ্যই। একটা সময় তো এমন ছিলো যে বামপন্থীদের ঈদসংখ্যা আর ইসলামী সাহত্যের সীরাত সংখ্যা।
শাকিল: এমন কি হতে পারে- এর মধ্যে পাঠকদের মধ্যেই ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে গেছে। মিডিয়া বিপ্লবের কারণে হোক- অনলাইন , টেলিভিশন বা অন্য কোনো কারণে- আমরা যা টের পাই নি।
মুহিউদ্দীন খান: এটাই হব, পরিবর্তন হয়ে গেছে আমরা টের পাই নি।
নোমান: মানে পাঠকের চিন্তা অগ্রসর হয়েছে, আমরা সে অনুযায়ী অগ্রসর হতে পারি নি বা সমন্বয় করতে পারি নি।
মুহিউদ্দীন খান: হুম, হয় নাই।
মনযূর: খেয়াল করেছেন কিনা- এখন কিন্তু ইসলামী পত্রিকা আগে যে কয়টা ছিলো এখন সে কয়টাও নাই। 
আমরা: না-ই বলতে গেলে। আপনি কি পান কোনোটা?
মুহিউদ্দীন খান: নেয়ামত, নতুন করে ছাপছে। আরো কয়েকটা কী যেনো দেখলাম...এক দুই মাস পরপর একটা বের হয়, তৃতীয় মাসে গিয়ে বন্ধ হয়ে যায়।
[-একটু চুপচাপ। নিরবতা।]
শাকিল: খারাপ লাগছে না তো কথা বলতে? আমরা না হয় অন্য কোনো দিন আসি?
মুহিউদ্দীন খান: নাহ, বসেন...
শাকিল: আপনি যাদের নিয়ে কাজ করেছেন তাদের মধ্যে কারো নাম বিশেষভাবে মনে পড়ে- মদীনা বা মুসলিম জাহানে?
মুহিউদ্দীন খান: মদীনায় প্রথম যাদের নিয়ে কাজ করেছি তারা কেউ তো বেচে নেই। দুয়েকজন থাকলেও খুব জবুথবু অবস্থা। নতুন যারা আছে, মান তেমন নেই। ঐ আগ্রহ, চেতনাটা নাই।
শাকিল: মুসলিম জাহানে যারা কাজ করেছেন তাদের লাইন তো অনেক বড় হওয়ার কথা। তাদের মধ্যে দুয়েকজনের কথা মনে পড়ে যারা বেরিয়ে আসতে পরেন কাজের প্রশ্নে? ধরে রাখবেন বা সামনে আগাবেন?
মুহিউদ্দীন খান: পাই নাই তো...
শাকিল: এই ব্যাপারটা কেন, লোক কেন তৈরি হচ্ছে না? তিন চার দশক যাচ্ছে একটা দেশে কয়েকটা লোক তৈরি হচ্ছে না। এই সংকট কেন?
মুহিউদ্দীন খান: যারা তৈরি হয়েছিলো বা তৈরি ছিলো মদীনায় এসে আরেকটু অগ্রগামী হলো- তারা তো প্রায় সবাই মারাই গেছেন। এখনও যে ক’জন আছেন তাদের অবস্থা জবুথবু।
শাকিল: যেমন দুয়েকজনের নাম যদি বলতেন...
মুহিউদ্দীন খান: যেমন আবুল কাসেম ভূঁইয়া একজন। খুব কাহিল। তারপর সিলেটে ছিলো চার-পাঁচ জন।
নোমান: আচ্ছা, কে কে...
মুহিউদ্দীন খান: কবি...
নোমান: মুস্তফা কামাল না আব্দুল জাব্বার...
মুহিউদ্দীন খান: আব্দুল জাব্বার। তিনি যে গদ্য লেখতো অনেকে জানে না। তারপর...নামই তো ভুলে গেছি। দেওয়ান আজরফ সাহেবের চাচাতো ভাই একজন ছিলেন। নাম তো ভুলে গেলাম...
শাকিল: আরেকটা ব্যাপার যে, মদীনায় যারা লিখতেন বা লেখেন তারা জেনারেল শিক্ষিত বা সে ধারা থেকেই উঠে আসা। আলেম সমাজের প্রতিনিধিত্ব তেমন নেই। আলেম সমাজের অনেকেই ফাউন্ডেশনে কাজ করলেন। একটা মদীনা, একটা ফাউন্ডেশন- দুটো ধারা হয়ে গেলো। এখন যদিও দুটোই দুর্বল, তো এই ধারাটা কীভাবে তৈরি হলো- একদিকে মদীনার সাধারণ শিক্ষিত সমাজ আরেক দিকে মাদরাসা শিক্ষিত আলেম সমাজ?
মুহিউদ্দীন খান: মাদরাসা শিক্ষিত যারা, খুব কম বেরিয়ে এসেছে আমাদের সময়। এর চাইতে বরং সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত যাদের মধ্যে ইসলামী চেতনাবোধ ছিলো আমি তাদেরকে একটু বাতাস দেওয়ার চেষ্টা করছি।
শাকিল: তাদের শিক্ষার ভিত্তি কেমন ছিলো? দুর্বল শিক্ষার ভিত্তি নিয়ে ইলমি কাজ করা কতোটা নির্ভরযোগ্য?
মুহিউদ্দীন খান: আমার ধারণা- যাদের মধ্যে ইসলামের চেতনা আছে, তাদেরকে পরিচর্যা করতে পারলে ভালো লেখক বেরিয়ে আসবে। এবং আমি প্রমাণও পেয়েছি।
শাকিল: আপনারা যখন গড়ে ওঠেন, তখন তো বড় বড় আলেমরা ছিলেন। তারা আপনাদের সমর্থন করতেন বা একসাথে নিয়ে কাজ করতেন। তো তাদের মতো ব্যক্তিত্বদের সাথে যারা কাজ করেছেন বা ছত্রছায়ায় গড়ে উঠেছেন তাদের মধ্যে আর তেমন লোক কেন গড়ে উঠতে পারলেন না?
মুহিউদ্দীন খান: আমি যখন ঢাকায় আসি তখন তো অনেক বড় বড় লোক ছিলেন, এখন তো কেউ নেই । মাওলানা আকরাম খাঁ। মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী। পীরজি হুজুর। সিদ্দিকুর রহমান খান। মাওলানা আব্দুল্লাহিল বাকী। এই ধরনের কয়েক ডজন লোক ছিলেন ঢাকায়। মাওলানা মুস্তাফিজুর রহমান খান। এখন তো তেমন লোকই নাই।
শাকিল: এখন ইলম থাকলে কলম নেই আর কলম থাকলে ইলম নেই- এমন একটা ব্যাপার দাঁড়িয়েছে। এটা ভবিষ্যতে কোন দিকে মোড় নিতে পারে?
মুহিউদ্দীন খান: আমি তো আর ভবিষ্যৎ বলতে পরবো না। তবে আমার ধারণা মতে এই সমস্যা দূর হয়ে যাবে।
শাকিল: কীভাবে হতে পারে?
মুহিউদ্দীন খান: কিছু চেতনাবোধ সম্পন্ন লোক এগিয়ে আসবে।
মনযূর: হেফাজত নিয়ে আপনার ব্যক্তিগত মতামত কি? তখন যেমন ছিলো, এখন সরকার যা চায়...তাদের প্রতি ভরসা রাখা যায় কি-না, সার্বিকভাবে?
নোমান: কদিন আগে বাবুনগরী সাহেব আপনার কাছে আসছিলেন- বিশেষ কোনো কথা হলো আপনাদের মধ্যে?
শাকিল: বা বিশেষ কোনো পরামর্শ?
মুহিউদ্দীন খান: বাবুনগরী আসে মাঝে-মধ্যে। খুব মুখলিস লোক। খুব মুখলিস। তার ভিতরে কোনো খাদ নাই। কিন্তু মাওলানা আহমদ শফী সাব তার মতো আর কোনো লোক পান নাই। সব দু নম্বর, দেড় নম্বর...
নোমান: ৫-৬ মে’র সময় যা ঘটলো। কেউ কেউ বাইরেও চলে গেলেন। কখন টিকিট কাটলেন আর কখন ভিসা নিলেন- বাতাসে নানা কথা ভেসে বেড়ায়- আপনার কি মনে হয়?
মুহিউদ্দীন খান: কিছু মানুষ, এরা বহু আগে থেকেই এমনই...হাওয়া কাজে লাগায়।
শাকিল: তারা এখন বড় নাম নিয়ে উচ্চ লেভেলে কাজ করছেন তাদের অবস্থা এমন হলে তাহলে বাকিদের কী হাল...
নোমান: আপনি যে বাবুনগরী সাহেবকে মুখলিস বললেন- তিনিও তো এদের সাথে নিয়েই কাজ করছেন বা যাদের নিয়ে প্রশ্ন তাদেরকে বাইরে রাখছেন না। 
মুহিউদ্দীন খান: ব্যাপার হলো কি, সংগঠন করতে যে মেধা বা যোগ্যতা সম্পন্ন লোক দরকার সেটার বরাবরই অভাব আমাদের। এখন কাউকে না কাউকে নিয়ে তো কাজ করতে হবে। 
শাকিল: এই আপস কি ঠিক হচ্ছে। ভুল মানুষদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে সাধারণ মানুষদের মধ্যে ব্যাপক কুধারণার জন্ম নিচ্ছে। এর ক্ষতিটা মারাত্মক না?
মুহিউদ্দীন খান: বলেই তো দিলেন...
শাকিল: মিডিয়ায় খোলাখুলি এসব সমালোচনা এসেছে তারপরও তারা গুরুত্ব দিচ্ছেন না, তখন তো মানুষ বিশ্বাস করবেই...
মুহিউদ্দীন খান: আমার তো মনে হয় তারা পত্রিকা পড়েই না...হে হে হে। মিডিয়া যে এগুলো লেখে তারা হয়তো জানেই না।
[কিছুক্ষণ নীরবতা...]
নোমান: আপনার কি কষ্ট হচ্ছে, আমরা উঠবো?
মুহিউদ্দীন খান: নাহ...থাকেন
নোমান: আপনার কি এখন নি:সঙ্গ বোধ হয়, যখন একা থাকেন?
মুহিউদ্দীন খান: না, তবে স্মৃৃতিবিভ্রমটা খুব কষ্ট দেয়।
মনযূর: এটা কি স্মৃতিবিভ্রম না কষ্ট ভুলতে চাওয়া?
মুহিউদ্দীন খান: আমার তেমন কোনো কষ্ট বা আক্ষেপ নেই।
শাকিল: আলহামদুলিল্লাহ, এটা তো অনেক বড় প্রশান্তির জায়গা...
আমরা: আপনি সামগ্রিকভাবে সবাইকে সাথে নিয়েই কাজ করেছেন- আলিয়ায় পড়েও আপনি কওমিরই প্রতিনিধি সবক্ষেত্রে- তারপরও আপনার কিছু সমালোচনা বাজারে ছড়ানো। জামাতঘেষা বা এই টাইপের...এগুলো কি আপনাকে কষ্ট দেয়?
মুহিউদ্দীন খান: আমি এগুলোকে পাত্তা দেই না। 
আমরা: এগুলোর কোনো ভিত্তি তো নেই, তবুও...
মুহিউদ্দীন খান: তা বটেই, তবে আমি এসবকে কখনো পরোয়া করি না।
নোমান: লীগ এখন যেভাবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, সর্বত্র- বিরোধী জোটের নেতা বা আলেম হিসেবে ইসলামপন্থীদের ভবিষ্যৎ কেমন দেখেন- বিশেষত কওমিদের?
মুহিউদ্দীন খান: কওমিদের হালত হবে না ঘরকা না ঘাটকা। ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই। বৃহত্তর ঐক্যের। তবে সবাই একত্রিত হয়ে প্লাটফর্ম তৈরি করে দিবে বা সুদিন আসবে- এসবের অপেক্ষা না করে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করে যেতে হবে। যেটুকু সমঝ আছে তা নিয়েই কাজ করে যেতে হবে।... 
(অসমাপ্ত)

সংরক্ষণ ও অনুলিখন
শাকিল আদনান

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন