প্রান্তিতা পরিহার করে মধ্যপন্থা অবলম্বন করার দাওয়াত দেওয়াই মূল উদ্দেশ্য।) ১৯৯৮ সন। স্মরণকালের ভয়াবহ স্থায়ী বন্যার বছর। আমি তাইসির [৫ম শ্রেণী] পড়ি। জামিআ আনওয়ারিয়া বরমী, শ্রীপুর, গাজীপুরে।
তখন সাদা পাঁচকল্লি টুপি পরতাম। যাতে কোনো কাজ থাকত না।হঠাৎ একদিন একবন্ধু কাজকরা একটি পাঁচকল্লি হাদিয়া দিল; কী যে খুশি হয়েছিলাম বলে বুঝাতে পারব না। ১৯৯৯ সনে ঢাকার বনানীতে অবস্থিত একটি মাদরাসায় মিজান জামাতে ভর্তি হলাম। ২০০৫ সনে মেশকাতে বেফাক পরীক্ষা দিয়ে দারুল উলুম দেওবন্দে গিয়ে দাওরা ও আদব পড়লাম; ২০০৬-২০০৭ সনে।
ইফতা পড়তে চেন্নাই এক্সপ্রেসে নয়াদিল্লি থেকে তামিলনাডুর সায়লামে গেলাম। ২০০৮।
মাদরাসা মাজাহিরুল উলুম সায়লামের প্রতিষ্ঠাতা মাও. শফিক খান কাসেমী রহ.। যিনি হযরত শায়খুল হাদিস মাও. যাকারিয়া রহ. এর খলিফা। হযরতের একাধিক পুত্র মুফতি মাহমুদ হাসান গাঙ্গুহি রহ. এর খলিফা। সে মাদরাসায় আাকবিরে উম্মত এবং পীর-মাশায়েখ যাতায়াত করেন। মাও. ইবরাহিম আফ্রিকিও সেখানে যান। সায়লাম শহরটি বেঙ্গালুরু ও চেন্নাইয়ের মাঝে অবস্থিত একটি মনোরম শহর।
সেখানের আদব ও ইফতা বিভাগের উস্তাদ মুফতি মাহমুদ হাসান গাঙ্গুহি রহ. এর খলিফা মাও. আবুল কালাম দা.বা. একদিন ক্লাসে বললেন : হযরত থানবী রহ. এর খলিফা গঞ্জেমুরাদাবাদী রহ. দর্জির দোকানে জামা সেলাই করতে দেন। দর্জি অতিরিক্ত টুকরো কাপড় দিয়ে একটি টুপি সেলাই করে দেয়। ঘটনাচক্রে টুকরো কাপড়ের সংখ্যা ছিল পাঁচটি। তিনি ওই টুপি মাথায় দিয়ে হযরত থানবী রহ. এর মজলিসে যান। তিনি টুপিটি অনেক পছন্দ করেন।
মাও. আবুল কালাম দা.বা. বলেন : হযরত থানবী রহ. পাঁচকল্লি টুপি মাথায় দিয়েছেন বলে কোনো প্রমাণ নেই। মাও. আবুল কালাম উপরের ঘটনার সনদ বয়ান করেছিলেন, এখন আমার মনে নেই।
হুজুরের ওই বক্তব্য শুনেছেন আমার বাংলাদেশী সব ক্লাসমেট। যেমন জামআ মাদানিয়া বারিধারার উস্তাদ মুফতি আকআমীন, জামিআতুস সুন্নাহ শিবচরের মুহাদ্দিস মাও. মনজুরুল হক ময়মনসিংহ, জামিআ সুবহানিয়া উত্তরার উস্তাদ মুফতি তাওহীদুল হক, শামছুল উলুম কাওলা, বিমানবন্দর মাদরাসার উস্তাদ মাও. আবদুর রহীম।
বনানীতে পড়াকালীন পাঁচকল্লি ‘ইউনিরফম’ (?) ছিল। পাঁচকল্লির ফজিলত ও মাহাত্ম্য শুনতে শুনতে এটাকেই সুন্নত মনে করতাম। অন্য টুপি দেখলে মনের মধ্যে খচখচ করত। সমস্যা হলো দেওবন্দে গিয়ে পাঁচকল্লি টুপি আর কিনতে পাওয়া যায় না। দেখলাম, একেকজনে একেক টুপি পরছেন। মনটাই খারাপ হয়ে গেল। এতদিন কী শুনলাম! দেওবন্দেও গায়রে সুন্নতের উপর আমল হয়!! এমনকি দেওবন্দে হারদুই হযরত রহ. এর দুজন খলিফার মাথায়ও পাঁচকল্লি-ভিন্ন অন্য টুপি দেখলাম।
দেওবন্দ থেকে গোমরাহ (?) হয়ে দেশে ফিরে কাঙ্ক্ষিত ও লালিত স্বপ্ন তাদরিসে যোগ দিলাম।
পাঁচকল্লির পাশাপাশি জালি টুপিও সঙ্গে করে নিয়ে আসলাম। ভুলক্রমে জালি টুপি মাথায় দিয়ে আমার এক উস্তাদের সামনে গেলে তিনি বললেন, পাঁচকল্লি কই? পাঁচকল্লিকে মনে স্থান দিতে পার নাই? আরও অনেক কিছু।
তখন আমার মনে পড়ল, উস্তাদগণ পাঁচকল্লিকে ইউনিফরম বলতেন মুখে মুখে, আর মনে মনে পাঁচকল্লিকেই সুন্নত ভাবতেন। তা নাহলে আমি তো এখন ওই প্রতিষ্ঠানের ছাত্র না, আমাকে ইউনিফরম স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন কেন?
উপরন্তু ইউনিফরম কেবল মাথায় হয়, জামা ও পায়জামায় হয় না?
একজনে সাদা, আরেকজনে কালো, কত যে কালারের জামা পরে ছাত্ররা ক্লাস করে। একজনে লুঙ্গি আরেকজনে জুব্বা, আরেকজনে পায়জামা পরে ক্লাস করছে। উস্তাদগণও তাই।
ঢাকার একটি মাদরাসার মিটিং হচ্ছে। আমি সেখানের উস্তাদ। ওই মাদরাসার ইউনিফরম (?) হচ্ছে পাঁচকল্লি। ভর্তির ফরমে পাঁচকল্লি বাধ্যতামূলক হওয়ার কথা আছে। ঘটনাচক্রে আমি জালি টুপি পরে বসেছি। আরো দুইজন মুহাদ্দিস জালি টুপি পরা ছিলেন। মিটিং শুরুর পরপরই একজন উস্তাদ বলল, উস্তাদরা যদি মাদরাসার কানুন না মানে তাহলে ছাত্রদেরকে কীভাবে শাসন করব? মুহতামিম বললেন, পরিষ্কার করে বলুন। সে বলল, অনেক উস্তাদ পাঁচকল্লি পরে না। ছাত্রদেরকে বললে তারা উত্তর দেয় অমুক উস্তাদ তো পাঁচকল্লি পরে না। অথচ ভর্তির ফরমে পাঁচকল্লির কথা আছে।
আমি শুধু বলেছিলাম, ভর্তির ফরম দিয়ে আমি ভর্তি হইনি। সে চিল্লায়ে উঠল, পাঁচকল্লি না পরলে বুযুর্গ বুযুর্গ লাগে না!!!
সঙ্গে সঙ্গে সবটুকু শক্তি সঞ্চয় করে কড়া প্রতিবাদ করে বলেছিলাম, দেওবন্দের আমার উস্তাদগণ কেউ (অধিকাংশ) পাঁচকল্লি পরে না, তাহলে তারা মুত্তাকি না? বিশ্বের কয়জন আলেম পাঁচকল্লি পরে? তাকি উসমানী কী পরেন? তারেক জামিল কী পরেন? পালনপুরী কী পরেন?
এভাবে আমরা পাঁচকল্লিকে সাধারণ জায়েযের স্তর থেকে সুন্নতের স্তরে নিয়ে যাচ্ছি। পাঁচকল্লি পরা সুন্নত না, টুপি পরা সুন্নত।
পাঁচকল্লিতে ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভ রয়েছে।
আমি বলব, আল্লাহ এক, তাঁর কোনো শরিক নেই; তাই এককল্লি টুপি পরা দরকার।
কালেমার দুটি অংশ হচ্ছে আল্লাহ ও রাসুল; তাই টুপি হবে দুই কল্লি।
ঈমানের মৌলিক শাখা তিনটি, তাওহীদ রিসালাত ও আখিরাত; তাই তিনকল্লি টুপি হওয়া বাঞ্ছনীয়।
শরিয়তের দলিল চারটি, কুরআন, হাদিস ইজমা ও কিয়াস; তাই টুপি হবে চারকল্লি।
ঈমানের সাতাত্তরটির অধিক শাখা রয়েছে; তাই সাতাত্তরকল্লি টুপি চাই।
এভাবে আঠার হাজার মাখলুকাতের স্মরণে আঠার হাজারকল্লি টুপির কথা বললেও অযৌক্তিক হবে না।
আমি পাঁচকল্লিকে অবজ্ঞা করার উদ্দেশ্যে এসব বলছি না। যারা বাড়াবাড়ি করে তাদের কাজটি যে অযৌক্তিক সেটাই বুঝাতে চাচ্ছি। পাঁচকল্লির প্রতি আমার শ্রদ্ধা আছে, অতিরিক্ত টান নেই। উম্মতের হক্কানী ওলামায়ে কেরাম ও সুলাহায়ে ইজাম যে টুপি পরেন তা-ই সুন্নত হবে।
আবারও বলি, বারবারই বলব, ইউনিফরম কেবল টুপিতেই! এমন ইউনিফরম পৃথিবীর কোথাও নেই।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন