বৃহস্পতিবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৬

আসহাবে উখদুদ!

Atik Ullah


জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রকে কুরআন কারীমের আওতায় আনা মুমিনের দায়িত্ব। নিজের চিন্তার লাগামের নিয়ন্ত্রণ কুরআন কারীমের হাতে ছেড়ে দেয়া, একজন শিক্ষিত মানুষের কর্তব্য। চিন্তা ও কর্ম জুড়ে কুরআন কারীম থাকা, মানবজীবনের শ্রেষ্ঠতম প্রাপ্তি! কিন্তু এই দুর্লভ অর্জন অধরাই থেকে গেলো! কুরআন কারীমকে ধারন করতে না পারার একটা অতৃপ্তি সারাক্ষণ ভেতরটাকে কুরে কুরে খায়। 
.
হালাব ও ইরাক-সিরিয়ার বিভিন্ন শহরের অবস্থা দেখে, সূরা বুরূজের কথা মনে পড়লো। হাদীস শরীফে এ-বিষয়ে একটা ঘটনার কথা বলা হয়েছে! সেটা একটু পড়ে দেখা যাক! উখদূদ অর্থ গর্ত। শিরোনামের অর্থ দাঁড়ায়: গর্তজীবিরা। 
.
যু-নাওয়াস। নাজরানের বাদশা। নাজরান প্রাচীন আরবের বিখ্যাত শহর। এখানে জাদুবিদ্যার বেশ প্রচলন। এখনকার সরকারী আলেমদের মতো, তখনো রাজদরাবারে থাকতো জাদুকর। রাজার পক্ষে জাদুকরী ফলাতো। এখন যেমন ফতোয়াগিরি করে। জাদুকরের বয়েস হয়ে গেছে। এখনো যোগ্য কোনও উত্তরসূরী তৈরী হলো না। এ-নিয়ে তার আক্ষেপের শেষ নেই। কী হবে তার মৃত্যুর পর? সারা জীবনের সঞ্চিত ‘জাদুবিদ্যা’ কি তবে বৃথা যাবে? নাহ একটা বিহিত করতেই হবে:
-জাহাঁপনা! আমি বৃদ্ধ হয়ে গেছি। কখন মনে যাই তার ঠিক-ঠিকানা নেই! আমাকে একজন নবীসের ব্যবস্থা করে দিন না! তাকে গড়েপিটে নিতাম!
কথাটা রাজার মনে বেশ ধরলো। পুরো শহর চষে উপযুক্ত এক বালককে নিয়ে আসা হলো। শুরু হলো জাদুবিদ্যা শিক্ষা। বালক প্রতিদিন গুরুর কাছে আসে। জাদুর তালীম নিয়ে ঘরে ফিরে যায়। 
বালকের আসা-যাওয়ার পথেই এক রাহেব (সংসারত্যাগী আল্লাহভীরু) আবাস ছিল। ঘটনাক্রমে রাহেবকে ভালো লেগে গেলো বালকের। রাহেবের কথা শুনে মুগ্ধ হলো বালক। জাদুগুরুর কাছে যাওয়ার পথে, রাহেবের কাছেও ধর্না দিতে শুরু করলো। এজন্য মাঝেমধ্যে গুরুর আখড়ায় পৌঁছতে বিলম্ব হয়ে যেতো। বুড়ো গুরু ছিলেন রগচটা স্বভাবের। শাগরেদের দেরী দেখলে নিজেকে সামলাতে পারতেন না। ধমাধম কিলঘুষি বসিয়ে দিতেন। 
বালক পড়লো বিপদে! বুযুর্গ রাহেবের কাছে না গেলে তার ভাল লাগবে না। আবার গুরুর কাছেও যেতে হবে। রাজ-ফরমান বলে কথা! এখন উপায়? শেষমেষ বুযুর্গের কাছেই কথাটা পাড়ল:
-ও আচ্ছা, এই ব্যাপার! একদম চিন্তা করবে না। জাদুগুরুকে বললে: ঘরের লোকেরা আসতে দেয়নি! আর ঘরের লোকদের বলবে: গুরু আসতে দেননি, তাই দেরী হয়েছে!
.
আপাতত একটা সমাধান হলেও, বালকের মনে প্রশ্ন উদয় হলো: কে ভালো? জাদুগুরু না ধর্মগুরু? আল্লাহ তা‘আলা খটকা দূর করার ব্যবস্থা করলেন। শহরে এক চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটলো। লোকজন চলাচলের বড় রাস্তায় কোত্থেকে এক বিরাট অজগর এসে ঠাঁই নিল। প্রাণভয়ে লোকজন পথচলা বন্ধ করে দিল। জনজীবনে দেখা দিল অবলাবস্থা। রাস্তার দুই পাড়েই মানুষজন আটকা পড়ে রইল। 
বালকের মাথায় একটা চিন্তার উদয় হলো: এবার জানা যাবে দু’জনের কে ভালো। একটা পাথর কুড়িয়ে নিল। মনে মনে বললো: হে আল্লাহ! রাহেব যদি আপনার কাছে সাহের (জাদুকর)-এর চেয়ে বেশি প্রিয় হয়, তাহলে অজগরটাকে মেরে দেখান! 
পাথরটা ছুঁড়ে মারলো সাথে সাথে সাপটা মারা গেলো। রাহেবের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস বহুগুণ বেড়ে গেলো। পরিষ্কার হয়ে গেলো,জাদুগুরুর অসারতা। রাহেবের কাছে গিয়ে ঘটনা খুলে বললো বালক। রাহেব সবকথা শুনে বললেন:
-বাছা, তুমি আজ আমার চেয়েও আগে বেড়ে গেছো। তোমার বিষয়টা আজ বড় আকার ধারন করেছে। তুমি যদি পরীক্ষার সম্মুখীন হও, তাহলে আমার কথা কাউকে বলে দিও না!
.
পাথর ছুঁড়ে সাপ মারার কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো। সবাই ভাবলো নিশ্চয় বালক অপার্থিব শক্তির অধিকারী। দলে দলে অসুস্থ মানুষেরা বালকের কাছে আসতে শুরু করলো। জন্মান্ধ, কুষ্ঠরোগীরা ধর্না দিতে শুরু করলো। রাজার এক সভাসদও বালকের কাছে এলো। তার সভাসদের দৃষ্টিশক্তি লোপ পেয়েছিল। সাথে নিয়ে অগাধ ধনরত্ন:
-আমাকে ভালো করে দিতে পারলে, এসব হীরে-জহরত তোমার হয়ে যাবে!
-আমি সুস্থ্য করার ক্ষমতা রাখি না। সুস্থ্য করার মালিক একমাত্র আল্লাহ। আপনি যদি আল্লাহর প্রতি ঈমান আনেন, তাহলে আমি আরোগ্যের জন্যে দু‘আ করতে পারি!
-ঠিক আছে ঈমান আনলাম!
আল্লাহ সভাসদের দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিলেন। পরদিন খুশিমনে দরবারে হাজির হলেন সভাসদ। রাজা অবাক! 
-তোমার চোখ ভাল হলো কী করে?
-আমার রব ভালো করে দিয়েছেন!
-আমি ছাড়াও তোমার আর রব কে?
-তিনি আমার ও আপনার রব, আল্লাহ!
সভাসদকে গ্রেফতার করা হলো। চরম নির্যাতন চালানো হলো। সভাসদ সইতে না পেরে, শেষে বাধ্য হয়ে বালকের কথা বলে দিলেন। রাজা এবার বালকের দিকে মনোনিবেশ করলেন:
-কী ব্যাপার, খবর পেলাম তুমি নাকি সর্বরোগের আরোগ্য দানকারী?
-আমি কাউকে আরোগ্য দান করার ক্ষমতা রাখি না। আল্লাহই সবাইকে আরোগ্য দান করেন। 
রাজার হুকুমে বালককে গ্রেফতার করা হলো। কোথায় পেয়েছে এই নতুন ধর্মবিশ্বাস, সেটা বের করার জন্যে দিনরাত নির্যাতন চালানো হলো। বালক বাধ্য হয়ে রাহেবের নাম বলে দিল। গ্রেফতার করা হলো রাহেবকে। তাকে বলা হলো:
-তোমার দ্বীন থেকে ফিরে এসো!
-আমি কিছুতেই আমার দ্বীন ত্যাগ করবো না!
করাত দিয়ে রাহেবের মাথা থেকে পা পর্যন্ত দু’টুকরা করে ফেলা হলো। রাজার সভাসদও একই পরিণতির শিকার হলেন। এবার বালকের পালা:
-তুমি আগের দ্বীনে ফিরে এসো!
-আমি কিছুতেই আমার দ্বীন ত্যাগ করবো না!
রাজা হুকুম দিলেন:
-এই বালককে নিয়ে অমুক পাহাড়ে যাও। চূড়ায় ওঠার পর, তাকে আরেকবার তার ধর্মত্যাগ করতে বলবে। ফিরে এলে ভাল, নইলে পর্বতশিখর ছেড়ে ছুঁড়ে নিচে ফেলে দিবে। 
.
রাজার লোকেরা বালককে নিয়ে গন্তব্যে পৌঁছে গেলো। চূড়ায় চড়ার পর, বালক তার রবের কাছে দু‘আ করলো:
-আল্লাহুম্মাকফিনীহিম বিমা শি‘তা। ইয়া আল্লাহ! আপনার ইচ্ছা মতো, তাদের বিরুদ্ধে আমার জন্যে আপনি যথেষ্ট হয়ে যান। 
দু‘আ শেষ হতে না হতেই পাহাড়টা প্রবলভাবে কেঁপে উঠলো। রাজার লোক-লস্কর ছিটকে পড়ে বেঘোরে মারা পড়লো। মুমিন বালক বহাল তবিয়তে ফিরে এলো। রাজা সীমাহীন অবাক হয়ে জানতে চাইলেন:
-অন্যদের কী হলো?
-আল্লাহ তা‘আলাই আমার পক্ষ হয়ে তাদের ব্যবস্থা করেছেন!
.
রাজা গেলেন আরো ক্ষেপে। এবার আরো বেশি লোক দিয়ে বালককে বন্দী করে পাঠালেন। বলে দিলেন:
-তাকে নিয়ে গভীর সমূদ্রে চলে যাও! ধর্মত্যাগ করলে ভাল, অন্যথায় বন্দী অবস্থাতেই ফেলে দিবে। 
বালক আগের দু‘আটাই আবার পড়লো। সাথে সাথে নৌকা উল্টে গেলো। সবার সলিল সমাধি হলেও, বালক কুদরতি বলে বেঁচে গেলো। রাজা যারপরনাই অবাক:
-বাকীরা কোথায়?
-তাদের ব্যবস্থা আল্লাহ করেছেন! শুনুন রাজামশায়! আপনি আমাকে শত চেষ্টা করলেও হত্যা করতে পারবেন না। তবে আমাকে মারার একটা উপায় বাতলাতে পারি!
-কী উপায়?
-নগরবাসীকে এক জায়গায় জড়ো করতে হবে। তারপর আমাকে শূলে চড়িয়ে তীর ছুঁড়ে হত্যা করতে হবে। তীর ছোঁড়ার আগে একটা দু‘আ পড়তে হবে। 
-কোন দু‘আ?
-বিসমিল্লাহি রাব্বিল গুলাম!
.
নগরবাসী আগে থেকেই সাহসী বালকের প্রতি গুণমুগ্ধ ছিল। তার প্রতি রাজার এই নির্মম জুলূম দেখে, তারা বালকের প্রতি আরো বেশি অনুরক্ত হয়ে পড়লো। বালকের ধর্ম সম্পর্কে শহরবাসী কমবেশি জানতে পেরেছিল। তাকে হত্যার বিভিন্ন প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার সংবাদও জানতে পেরেছিল। এসব কারনে তাদের মনে বালকের ধর্মের প্রতি প্রবল অনুরাগ তৈরী হলো। বালক শহীদ হওয়ার সাথে সাথেই সবাই কালিমা পড়ে মুসলমান হয়ে গেলো। 
.
রাজার দরবারে সংবাদ পৌঁছতে দেরী হলো না। হিতাহিত জ্ঞানশুন হয়ে রাজা হুকুম দিলেন:
-বিরাট বড় করে লম্মালম্বি একটা গর্ত খোঁড়! গর্তের মধ্যে আগুন জ্বালাও। 
যারা বালকের ধর্ম ত্যাগ করতে অস্বীকার করলো, তাদের সবাইকে ধরে ধরে অগ্নিগর্তে ছুঁড়ে ফেলা হলো। শিশুসন্তান সহ এক মাকে ধরে আনা হলো। মা আগুনে ফেলার ভয়ে কাঁপছিলেন। তখন শিশুসন্তান মাকে সান্তনা দিয়ে বললো: আম্মু ভয় পেয়ো না, তুমি হকের ওপর আছো!
.
গল্পের মূল বক্তব্য হাদীস শরীফ থেকে নেয়া। কুরআন কারীম ও হাদীস শরীফ উভয় নসেই ঘটনাটার উল্লেখ আছে। এজন্য ঘটনাটা গুরুত্ব অনেকগুণ বেড়ে যায়। কিছু ঘটনা শুধু কুরআনে আছে, হাদীসে নেই, আবার কিছু ঘটনা হাদীসে আছে কুরআনে নেই। ঘটনাটা পড়লে কিছু ভাবনা মাথায় আসে। সেগুলো সেঁচে আনা যাক।
-
প্রথম ভাবনা
গল্পের মূল চরিত্র হলো একজন গোলাম মানে বালক। উপযুক্ত শিক্ষা পেলে, একজন কিশোরও বিরাট পরিবর্তন আনতে পারে। শিশু-কিশোরদের মধ্যে ছোটকাল থেকেই ‘দাওয়াত ও জিহাদের’ মেজাযে গড়ে তুলতে পারলে, ভবিষ্যতে তারা উম্মাহর অমূল্য রতনে পরিণত হবে। মুস্তাফা সাদেক রাফেয়ী রহ. বলেছেন:
-আজকের কাঁচারাই আগামী দিনের ‘পাকা’!
আজকের শিশুরাই আগামী কালের পুরুষ। প্রতিটি শিশুই বিপুল সম্ভাবনা নিয়ে জন্ম গ্রহণ করে। বাবা-মায়ের হাতেই তার ভবিষ্যত নির্মিত হয়। 
সন্তানের সাথে সম্পর্কটা হওয়া চাই ঘনিষ্ঠ ও নিবিড়। ভয় ও ভালবাসার মিশেলে। স্নেহ ও শ্রদ্ধার যৌথ আয়োজনে। পিতার দায়িত্ব আল্লাহ তা‘আলা একটা বাক্যেই বলে দিয়েছেন:
= তোমরা নিজেকে ও পরিবারকে আগুন থেকে রক্ষা করো (তাহরীম: ৬)। 
নবীজি সা.-ও বলে গেছেন:
= প্রতিটি শিশুই ‘ফিতরাতের’ উপর জন্মগ্রহণ করে। তার বাবা-মা তাকে ইহুদী বানায়। খ্রিস্টান বানায়। মজুসী বানায় (মুসলিম)। 
.
দ্বিতীয় ভাবনা:
শিষ্যের কথা শুনে রাহেব বললেন:
-তুমি আজ আমার চেয়ে এগিয়ে গেছো!
চমৎকার একটা দিক ফুটে উঠেছে। উস্তাদ অম্লানবদনে স্বীকার করে নিলেন: শাগরেদের শ্রেষ্ঠত্ব। তাও সরাসরি শাগরেদের সামনে। এ-দিকটাতে আমাদের সমাজ আজো পিছিয়ে আছে। শিষ্যকে স্বীকৃতি দিতে বেজায় অনীহ আমরা। অথচ হাজারো বছর আগেই এই মূল্যবোধ চর্চিত ও অর্জিত হয়েছিল। একজন বিনয়ী উস্তাদের চিত্র ফুটে উঠেছে। ছাত্ররা যদি শিক্ষকদের চেয়ে বেশি যোগ্য হয়ে না ওঠে, তাহলে সমাজ আগে বাড়বে কী করে? স্থবিরতা দেখা দেবে না সমাজে ও রাষ্ট্রে? একজন যোগ্য শিষ্যকে হতে ওস্তাদের চেয়েও যোগ্য। ওস্তাদের সমান হওয়াও চলবে না। তাহলে বড় হয়ে কী করবে? ওস্তাদের বইয়ের নোট লিখবে। অথবা ওস্তাদের লিখিত বইয়ের সারসংক্ষেপ লেখায় নিরত হবে। শিষ্যকে আগা বাড়াতে হলে ওস্তাদের প্রেরণার বিকল্প নেই। আলি তানতাবী রহ. বলেছেন:
-গত শতাব্দীতে সিরিয়ায় জ্ঞানের ক্ষেত্রে স্থবিরতা সৃষ্টি হওয়ার অন্যতম কারণ ছিল: উৎসাহদানের অনুপস্থিতি। 
শুধু শুকনো প্রশংসা নয়, পিঠ চাপড়ে উৎসাহ ও প্রেরণা যোগাতে হবে শিষ্যকে। এটা সুন্নাতও বটে। নবীজি সা. সব সময় এমনটাই করতেন। তিনি একবার বলেছিলেন:
-তোমাদের সেরা কারী হলেঅ উবাই, সেরা ফরায়েয বিশেষজ্ঞ হলো যায়েদ (তিরমিযী)।
 এছাড়া বড় বড় প্রায় সব সাহাবী সম্পর্কেই এক বা একার্ধিক প্রশংসাবাক্য-উৎসাহবাক্য উচ্চারণ করেছেন নবীজি। এটা যে সুন্নাত, সেটাই তো মাথায় থাকে না! শুধু ওস্তাদ-শাগরেদই নয়, যে কোনও গুণীর কদর ও সমাদর করা, তার গুণের স্বীকৃতি দেয়া সুন্নাত। 
.
তৃতীয় ভাবনা
বিপদের সময় একমাত্র আল্লাহর দিকে রুজু হওয়া। আল্লাহ তা‘আলার প্রতি পুর্ণ আস্থা রাখা। তাও ওপর তাওয়াক্কুল করা। বালক বয়েসে ছোট্ট হলেও, রাহেবের কাছে এই অমূল্য শিক্ষাটা পেয়ে গিয়েছিল। তাই নিঃশঙ্কচিত্তে বলতে পেরেছিল:
اللهم اكفنيهم بما شئت
আমাদের শিশুদের মধ্যেও এই বোধটা গভীরভাবে চারিয়ে দিতে হবে। 
.
চতুর্থ ভাবনা
একজন দায়ী কেমন হবে? বাধা পেয়ে থেমে যাবে? না তা হবে না। শত বাধা পেলেও দাওয়াত চালিয়ে যেতে হবে। ঘটনা পড়ে জানা যায়, বারবার হত্যাপ্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পরও, বালক রাজার কাছে ফিরে এসেছে। জান নিয়ে পালিয়ে যায় নি। ভয়ে পিছুৃও হটে নি। রাজার দরবারে ফিরে এসেছে। দমে যায় নি। হটে যায় নি। 
.
পঞ্চম ভাবনা
দায়ীর কাজ হলো দাওয়াত দানের সুযোগ তৈরী করা। দাওয়াতের সুযোগ পেলেই কাজ শুরু করা। এমনকি নিজের জীবন দিয়ে হলেও। এটা নবীওলা সুন্নাত। নবীজি সা. কী করেছেন? সাফা পাহাড়ে দাঁড়িয়ে কুরাইশদেরকে আহ্বান করেছেন। মুসা আ. কী করেছেন? সুযোগ পেয়ে বলেছেন:
-তোমাদের নির্ধারিত সময় হলো: উৎসবের দিন। পূর্বা‎েহ্ন লোকজনকে জমায়েত করা হবে (ত্বহা ৫৯)। 
.
বালক কী করলো, তার মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও, দাওয়াতের সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইল না। শুধু সম্ভান্ত শ্রেনী নয়, সাধারন জনগনের মাঝেও দাওয়াতের ফিকির করেছে সে। 
.
ষষ্ঠ ভাবনা
বিজয় বা নসর মানে কী? ব্যক্তির মুক্তি? না, প্রকৃত নসর-বিজয় মানে, চিন্তা-মতবাদ ও মূল্যবোধের বিজয়। নির্দিষ্ট কোনও ব্যক্তি বা দলের নসরকে প্রকৃত নসর বলা যায় না। বালকটি চাইলে নিজের মুক্তি ও বিজয় নিশ্চিত করতে পারতো। কিন্তু তা না করে, সবার বিজয়ের কথা ভেবেছে। 
.
এগার নাম্বার আয়াতে প্রকৃত বিজয় বা বড় সফলতা বলা হয়েছে: ঈমান আনা ও সৎকর্ম করাকে। বালকটি সবার জন্যে প্রকৃত সাফল্য নিশ্চিত করতে চেয়েছিল। 
.
সপ্তম ভাবনা
ঘটনার এক জায়গায় ছোট্ট শিশু মাকে অবিচল থাকার পরামর্শ দিয়েছে। ঈমানের ক্ষেত্রে অবিচলতা বড় বেশি জরুরী। এ-ব্যাপারে একটু শিথিলতা দেখা দিলেই সর্বনাশ। দাওয়াতের কাজ করতে গেলে, বিপদ আসবেই। তখন সবর জরুরী। নবীজি তাই বলে গেছেন:
-মানুষ সকালে মুমিন থাকবে, বিকেলে কাফের হয়ে যাবে। বিকেলে মুমিন থাকবে, সকালে কাফের হয়ে যাবে। দুনিয়ার সামান্য প্রাপ্তির বিনিময়ে সে তার দ্বীনকে বিকিয়ে দেবে (মুসলিম)। 
বিপদের মুহূর্তে অন্তরের ঈমান ঠিক রেখে, মৌখিকভাবে কুফুরিবাক্য উচ্চারণ করা জায়েয আছে। নির্যাতন থেকে বাঁচার জন্যে। তবুও হিম্মত থাকলে, নির্যাতনের মুখোমুখি হওয়া ভাল। 
.
অষ্টম ভাবনা
সূরা বুরুজ মক্কী সূরা। মক্কার মুসলমানরা চরম নির্যাতনের শিকার হচ্ছিলেন। এই সূরা নাযিল করে, আল্লাহ তা‘আলা মুমিনগনের হিম্মত বাড়াতে চাইলেন। সাহসী বালকের ঘটনার দিকে ইঙ্গিত করে, সবরের তালকীন দিলেন। বিপদে টলে না যাওয়ার সবক দিলেন। 
আমরাও বর্তমানে এই সূরা থেকে শিক্ষা নিতে পারি। রোহিঙ্গা ভাইরা পারেন। হালাবী ভাইয়েরা পারেন। কাশ্মীরি ভাইয়েরা পারেন। আল্লাহ তা‘আলার শিক্ষাদান পদ্ধতির দাবিও এটা। তিনি এভাবেই নবীজি সা. ও সাহাবায়ে কেরামকে গড়ে তুলেছেন। মক্কায় অবতীর্ণ হওয়া আয়াত ও সূরাগুলো নাযিল হওয়ার ধারাবাহিকতা খেয়াল করলে, বড় আজীব চিত্র ফুটে ওঠে! আল্লাহ তা‘আলা কিভাবে ধীরে ধীরে শিক্ষিত করে তুলেছেন। ঈমানে। আকীদায়। হিম্মতে। সবরে। সাহসিকতায়!
.
নবম ভাবনা
সতের নাম্বার আয়াতে, ফিরআওন ও সামূদ জাতির দিকে ইশারা করে বোঝানো হয়েছে, এত শক্তিশালী জাতি হয়েও তারা আজ কোথায়? হে রাশা! হে বাশার! হে আমেরিকা! সূরা বুরূজে তোমাদের কথাই বলা হয়েছে। সাবধান হয়ে যাও!
.
দশম ভাবনা
তবে হাঁ, যত কঠিন পরিস্থিতিই হোক, আত্মহত্যা করা যাবে না। নিজের সাধ্য অনুযায়ী শত্রুর মোকাবেলা করে যাবে। আল্লাহর কাছে সাহায্য কামনা করবে। হিম্মত করে শত্রু থেকে অস্ত্র ছিনিয়ে নেবে। বালকটিও আগাম মৃত্যু কামনা করেনি। 
.
এগারতম ভাবনা;
সবকিছুই ওস্তাদের কাছে শিখতে হয়। একা একা শেখা ‘ফিতরাতবিরোধী’ ব্যাপার। এমনকি মন্দ কাজ বা মন্দজ্ঞান হলেও, ওস্তাদ লাগে। বালকের জাদুবিদ্যা শেখা থেকে সেটাই পরিষ্কার হয়ে। ব্যবিলনের দুই ফিরিশতাও জাদুবিদ্যা শিখিয়েছিলেন। 
.
বারোতম ভাবনা:
ভালোমন্দ শিক্ষা একসাথে চলতে পারে। সেটা হতে পারে মন্দ সম্পর্কে জ্ঞান না থাকা অবস্থায়। জানা হয়ে যাওয়ার পর, মন্দশিক্ষা আর গ্রহণ করা যাবে না। বালকও একসাথে জাদু শিখেছিল। পাশাপাশি ঈমানও শিখেছিল। আল্লাহর কাছে কে বেশি প্রিয়,সেটা পরিষ্কার হয়ে যাওয়ার পর, বালক আস্তে আস্তে ঈমানি দাওয়াতের দিকেই ঝুঁকে পড়েছিল। নির্যাতনের মুখে দোয়া-দুরূদই পড়েছিল। মন্ত্রতন্ত্র নয়। 
.
তেরোতম ভাবনা
দাওয়াত দিতে গেলে, অনেক সময় অলৌকিক ঘটনা ঘটতে পারে। কারামাত প্রকাশ পেতে পারে। যেমনটা বালকের ক্ষেত্রে হয়েছে। তবে দায়ী এসবকে গুরুত্ব না দিয়ে আপন কাজ চালিয়ে যাবে। 
.
ষোলতম ভাবনা
যাচাই-বাছাই করেই ওস্তাদ গ্রহণ করা উচিত। বালক দুই ওস্তাদের মাঝে তুলনা করে আল্লাহর কাছে সাহায্য চেয়েছিল। কে বেশি ভাল, সেটা নিশ্চিত হতে চেয়েছিল।
.
সতেরতম ভাবনা 
একজন দায়ী একা একা কাজ করবে না। একজন অভিজ্ঞ মুরুব্বীর অধীনেক কাজ করাই ভাল। বালক তাই করেছে। নিয়মিত ওস্তাদের সাথে পরামর্শ করেছে। 
আঠারতম ভাবনা
সবকিছু আল্লাহই করেন। বান্দা কিছুই করতে পারে না। এই বিশ্বাস রাখা। অন্যদের মাঝেও এই বিশ্বাসের প্রসার ঘটানো। বালক রাজা ও জনগনকে এটাই বোঝাতে তৎপর ছিলো। 
.
উনিশতম ভাবনা
একজন দায়ী আল্লাহর রাস্তায় দাওয়াত দানের বিনিময়ে কোনও প্রতিদানের আশা করবে না। নির্লোভ থেকে কাজ করে যাবে। 
.
বিশতম ভাবনা
দায়ীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হবে: আল্লাহর প্রতি ঈমান। তারপর আল্লাহর কাছে দু‘আ। এই দুই গুণ না থাকলে, পূর্ণতা আসবে না। 
.
একুশতম ভাবনা
যালেম শাসকরা সাধারণত বেকুবই হয়ে থাকে। পাশাপাশি তারা নির্দয়ও হয়ে থাকে। রাজ ভেবেছিল, সেই রোগীকে আরোগ্য দান করে। অন্য কেউ নয়।
.
বাইশতম ভাবনা
নিজের মতে না চললে, যালেমের শেষ অস্ত্র হলো যুলুম-নির্যাতন করা। ভয় দেখানো। ত্রাসের সঞ্চার করা। চাপ প্রয়োগ করে মানুষের টুটি চেপে ধরা। গণহারে হত্যা করা। হকের আওয়াজ বুলন্দকারীর আওয়াজকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়া। 
.
তেইশতম ভাবনা
দায়ী যখন দু‘আ করেন, আল্লাহ সেটা কবুল করেই নেন। বালকের দু‘আও আল্লাহ কবুল করেছেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন