বুধবার, ৬ জানুয়ারী, ২০১৬

ভারতবর্ষের ইতিহাস সম্পর্কে অনেকেই একটা কথা জানে না যে, এই ইতিহাস কিন্তু মুসলমানদেরই লেখা।

ভারতবর্ষের ইতিহাস সম্পর্কে অনেকেই একটা কথা জানে না যে, এই ইতিহাস কিন্তু মুসলমানদেরই লেখা। মুসলিম শাসনামলে প্রচলিত ফারসী ভাষাতেই ভারতবর্ষের ইতিহাস লেখা হয়েছে, হিন্দুদের সংস্কৃত ভাষায় নয়। রিয়াজ উস সালাতীন, বাহরিস্তান এ গায়বী, চাচানামা, তারিখ এ ফিরোজশাহী, বাবুর নামা, তুজুক ই জাহাঙ্গীরি, মোজাফফরনামা এসবের মতো হাজার হাজার ইতিহাস বই ভারতবর্ষের মুসলমানরা রচনা করেছিলো। ভার্সিটিতে যে ইতিহাস পড়ানো হয়, তা অতীতের ভারতবর্ষের মুসলমানদের রচিত এসব ফারসী গ্রন্থ থেকে অনু্বাদ করেই পড়ানো হয়।
মুসলমানদের রচিত ইতিহাসের কোথাও কিন্তু বলা নেই যে, ভারতবর্ষের মুসলমানরা হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত। তুরস্ক, মিসর, সিরিয়া প্রভৃতি দেশগুলোকে আমরা যতোটা মুসলিম দেশ হিসেবে চিনি, ভারতবর্ষ তার চেয়েও বেশি মুসলিম দেশ ছিলো। ইন ফ্যাক্ট, আরব দেশগুলো থেকে ইসলাম ধর্ম শিক্ষা করতে ছাত্ররা ভারতে আগমন করতো।
বাংলাদেশের একজন প্রধান ইতিহাসবিদ হলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর আবদুল করিম। তার লেখা বই বাংলাদেশের সব ভার্সিটিতে পড়ানো হয়। প্রফেসর আবদুল করিমের লেখা ‘বাংলার ইতিহাস: সুলতানী আমল’ বইতে গণেশ নামক এক বিশ্বাসঘাতক হিন্দুর কথা উল্লেখ রয়েছে। গণেশ ছিলো মুসলিম শাসক গিয়াসউদ্দীন আযম শাহর কর্মচারী। গণেশ তার মনিবকে ষড়যন্ত্র করে হত্যা করে এবং নিজেই বাংলার ক্ষমতা অন্যায়ভাবে দখল করে। ক্ষমতা দখল করে সে বাংলার মুসলমান, বিশেষ করে সূফী দরবেশদের ওপর শুরু করে নির্যাতন। তা দেখে উত্তরপ্রদেশের একজন বিশিষ্ট সূফী মীর সৈয়দ আশরাফ জাহাঙ্গীর সিমনানী অত্যন্ত ব্যথিত হন। তিনি উত্তরপ্রদেশের মুসলমান শাসক ইব্রাহীম শর্কীর নিকট একখানা চিঠি লিখেন। তিনি তার চিঠিতে উল্লেখ করেন-
“ধার্মিক রাজাদের পক্ষে ইসলাম ধর্ম রক্ষার জন্য সৈন্যবাহিনী পরিচালনা করার চেয়ে আনন্দের কাজ আর কিছুই নেই। বাংলাদেশে বড় শহরের তো কথাই নেই, এমনকি ছোট শহর বা গ্রামও মিলবে না, যেখানে সূফী-দরবেশগণ এসে বসবাস করেননি। অনেক দরবেশ ইন্তেকাল করেছেন, কিন্তু যাঁরা বেচে রয়েছেন, তাঁদের সংখ্যাও অল্প হবে না। তাঁদের সন্তান-সন্ততিকে, বিশেষ করে হযরত নূর কুতুবে আলম (বাংলার তৎকালীন সময়কার একজন বিখ্যাত সূফী) এর সন্তান-সন্ততি ও পরিবারকে যদি এই দুরাত্মা গণেশের কবল থেকে উদ্ধার করা যায়, তাহলে খুবই ভালো কাজ হবে।”
চিঠিটি প্রফেসর আবদুল করিম তার ‘বাংলার ইতিহাস: সুলতানী আমল’ বইয়ের ২২৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন। চিঠিটিতে একটি বিষয় স্পষ্ট, বাংলার মুসলমানরা ধর্মান্তরিত নয় বরং তারা এ অঞ্চলে আগত সূফী দরবেশদের সন্তান। মীর সৈয়দ আশরাফ জাহাঙ্গীর সিমনানী হিন্দু রাজাকে উৎখাত করার প্রধান যুক্তিই দিয়েছিলেন যে, সম্ভ্রান্ত মুসলমান সূফী দরবেশগণ কোন হিন্দুর দ্বারা শাসিত ও নির্যাতিত হতে পারে না। উল্লেখ্য বিভিন্ন মুসলিম বংশ পদবী, যেমন ‘সৈয়দ দ্বারা মুসলমানদের নবী’র বংশ, খন্দকার/ভুইয়া/মীর/মিয়া/শেখ’/মোল্লা দ্বারা সূফী বা ধর্মপ্রচারকদের বংশ, ‘কাজী’ দ্বারা কোন কাজীর বংশধর, ‘আখন্দ’ দ্বারা ফারসী শিক্ষকের বংশধর বোঝানো হয়। এভাবে বাংলাদেশের অধিকাংশ বংশের পূর্বপুরুষের পরম্পরা আগত ধর্মপ্রচারকগণের বংশের সাথে গিয়ে যুক্ত হয়।
মুসলমানের বংশধর হিসেবে ভারতবর্ষের মুসলমানদের এই যে বোধ, এই বোধই ভারতবর্ষের মুসলমানদের হিন্দুদের থেকে আলাদা ও বিশেষায়িত করেছে। এই বোধ থেকেই কিন্তু মুসলমানরা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলো। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ হয়েছিলো এই কারণে যে, তারা হাজার বছর ধরে ভারতবর্ষে চলে আসা মুসলমানী সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে বিলীন করার অপচেষ্টা করেছিলো। ১৮৭৩ সালে ব্রিটিশ সিভিল অফিসার উইলিয়াম হান্টার ‘দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস’ বইতে লিখেছিলো, বাংলার মোট ভূ-সম্পত্তির ৪ ভাগের ১ ভাগই ছিলো মুসলমান সূফী দরবেশদের দখলে থাকা লাখেরাজ সম্পত্তি।
লাখেরাজ অর্থ লা-খারাজ, বা করমুক্ত সম্পত্তি। এসব সম্পত্তি মুসলমান শাসকেরা সূফী দরবেশদেরকে দান করতেন, যেন তাঁরা পয়সা টাকার চিন্তা থেকে মুক্ত হয়ে মুসলমানদের শিক্ষাদান করতে পারেন। লাখেরাজ সম্পত্তির আয়কে কেন্দ্র করে মুসলিম শাসনামলে গোটা বাংলায় তখন প্রচুর শিক্ষাকেন্দ্র চালু ছিলো।
ব্রিটিশরা এসব লাখেরাজ সম্পত্তিগুলো কেড়ে নেয়ায় মুসলমানদের শত শত বছরের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যায়। মুসলমানদের থেকে কেড়ে নেয়া ঐসব সম্পত্তিগুলো ব্রিটিশদের দালাল হিন্দুদেরকে দিয়ে তাদেরকে রাতারাতি জমিদার বানানো হয়। এসব কারণেই মুসলমানরা, বিশেষ করে বাঙালি মুসলমানরা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধে লিপ্ত হয়। বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীতেও এর উল্লেখ রয়েছে। বঙ্গবন্ধু উল্লেখ করেছিলেন, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে বাংলা থেকে ২ হাজার মাইল দূরে সেনাছাউনিতে দলে দলে বাঙালী মুসলমানরা গমন করতো।
মুসলমানদের প্রবল যুদ্ধ সত্ত্বেও সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে ১৮৫৭’র সিপাহী বিদ্রোহে ব্রিটিশরা চূড়ান্তভাবে ভারতবর্ষের ক্ষমতা দখল করে নেয়। ক্ষমতা দখলের পর ব্রিটিশরা চিন্তা করে, কী ভাবে মুসলমানদের মধ্যকার এই চেতনাকে নিভিয়ে দেয়া যেতে পারে? কিভাবে তাদের আত্মসম্মানবোধ বিনষ্ট করা যেতে পারে? তখনই ব্রিটিশরা রিসার্চ করে এই এই গুজব রটিয়ে দিলো যে, “ভারতবর্ষের মুসলমানরা সব হলো হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত”।
এই এক থিওরীই ভারতবর্ষের মুসলমানদের ভেড়া ও মুরগীতে পরিণত করেছে। আফসোসের বিষয়, সবচেয়ে বেশি মুরগী হয়েছে বাংলাভাষী মুসলমানরা, যে বাঙালি মুসলমানদের পূর্বপুরুষরাই ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি প্রতিরোধ গড়েছিলো। যদি মুসলমানরা নিজেদের পূর্বপুরুষদের মুসলমান হিসেবেই মেনে না নেয়, তবে তাদের পুরো ইতিহাসই মিথ্যা হয়ে যায়। তারা হয়ে পড়ে ভাসমান শেকড়হীন জনগোষ্ঠী, যারা হিন্দুত্বের স্রোতের বিরুদ্ধে কোনপ্রকার প্রতিরোধ গড়তে সক্ষম হবে না। ব্রিটিশরা এটি বুঝতে পেরেই এই থিওরী প্রণয়ন করেছিলো, যে থিওরী ব্যবহার করে ব্রিটিশদের অনুগত হিন্দুরা আজও উপমহাদেশের মুসলমানদেরকে ভেড়া বানিয়ে রেখেছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন