বৃহস্পতিবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

যুগে যুগে মুসলিম উম্মাহর চিহ্নিত দুশমন

মতিউর রহমান আকন্দ
মহানবী (সা.) মক্কা ছেড়ে মদীনার পথে এগিয়ে চলেছেন, বাতাসের কাঁধে ভর করে এ খবর মদীনায় ছড়িয়ে পড়লো। এ খবর শুনে স্বভাবতই মদীনায় ঔৎসুক্য চরম আকার ধারণ করলো এবং অপেক্ষার মুহূর্তগুলো অসহনীয় হয়ে উঠলো।
ছোট ছোট শিশুদের মুখে পর্যন্ত এ কথাই লেগে ছিল যে, রাসূল (সা.) আসছেন, রাসূল (সা.) আসছেন। লোকরা প্রতিদিন সকালে ঘর থেকে বের হয়ে শহরের বাইরে জমায়েত হয়ে অপেক্ষা করতো। গ্রীষ্মের সূর্য মাথার ওপর এলে এবং রৌদ্র অসহনীয় হয়ে উঠলে আক্ষেপ করতে করতে ঘরে ফিরে যেতো। যে দিন রাসূল (সা.) সত্যি সত্যি এসে পৌঁছলেন, সেদিন যথারীতি তারা জমায়েত হওয়ার পর ঘরে ফিরে যাচ্ছে। সহসা এক ইহুদী এক দুর্গের ওপর থেকে দেখেই সুসংবাদ শোনালো ‘ওহে ইয়াসরিববাসী, ঐ দেখ, তোমরা যে মহামানবের অপেক্ষা করছ, তিনি এসে গেছেন।” সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র শহর আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে ফেটে পড়লো। তারা হন্তদন্ত হয়ে ছুটলো।
মদীনা থেকে তিন মাইল দূরবর্তী শহরতলীর জনপদ কোবাতে তিনি সর্বপ্রথম আবাসস্থল করলেন। আমর বিন আওফের বাড়িতে ১৪ দিন অবস্থান করেন রাসূল (সা.)। এখানে লোকরা দলে দলে সাক্ষাৎ করতে আসতে থাকে। চৌদ্দ দিন পর তিনি কোবা থেকে মদীনায় রওনা হলেন। কোবা থেকে মদীনা পর্যন্ত আনসারগণ দু’ধারে লাইন করে দাঁড়িয়েছিলেন মোবারকবাদ জানানোর জন্য। মহিলারা ছাদের উপর জমায়েত হয়ে স্বাগত সঙ্গীত গাইতে থাকে :
ছোট ছোট শিশুরা দলে দলে ঘুরছিল এবং ঢোল বাজিয়ে বাজিয়ে গাইছিল।
এই শিশুদের ভালোবাসার জবাবে রাসূল (সা.) তাদের প্রতি বিশেষ স্নেহ প্রদর্শন করলেন। তাদের সাথে কথা বললেন। জিজ্ঞাসা করলেন “তোমরা কি আমাকে চাও?” তারা বললো, “জ্বী হ্যাঁ।” রাসূল (সা.) বললেন, “আমিও তোমাদের চাই।”
মদীনার অনুকূল পরিবেশে ইসলামের অংকুরোদগত ুদ্র চারটি মহীরুহরূপে আত্মপ্রকাশের আশায় মাথা তুলে দাঁড়ায়। ইসলাম প্রতিকূল ও প্রতিপক্ষ শক্তির মোকাবিলায় ক্রমান্বয়ে প্রবল শক্তিরূপে আবির্ভূত হয়।
এখানেও ইসলামী আন্দোলনকে দুটো শক্তির বিরোধিতার মুখে আত্মরক্ষা করে চলতে হয়। মক্কার বুকে ইসলামের ভিত্তি দুর্বল থাকায় প্রবল কুরাইশ কাফির শক্তি দৈহিক শক্তির জোরেই ইসলামের অস্তিত্ব মিটিয়ে দিতে চেয়েছে। তাদের শত্রুতা ও বিরোধিতার পিছনে লুকোচুরির কিছু ছিল না। তারা যা চেয়েছে একান্তেই চেয়েছে। প্রকাশ্য ময়দানেই তারা ইসলামের অস্তিত্বকে চ্যালেঞ্জ করেছে। সে চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় ইসলামকে ভিনদেশে গিয়ে অনুকূল পরিবেশের মাঝে আশ্রয় খুঁজতে হয়েছে, শক্তি সঞ্চয় করতে হয়েছে। মুসলমানদের শক্তি সঞ্চয়কে মদীনার স্থানীয় প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীও সহজে মেনে নিতে পারেনি। কিন্তু মক্কার তুলনায় এখানে মুসলমানদের শক্তি সংহত হওয়ায় ও বৃদ্ধি ঘটায় তারা সরাসরি চ্যালেঞ্জ ঘোষণায় সাহসী হয়নি। অতএব তারা ভিন্ন পথে অগ্রসর হয়। গোপন ষড়যন্ত্রই ছিল মদীনা ও পার্শ্ববর্তী এলাকার ইসলাম-দুশমনদের একমাত্র হাতিয়ার। মুনাফিকী আর গাদ্দারীই ছিল তাদের অবলম্বন।
প্রতিক্রিয়াশীল শাসকগোষ্ঠী অবশেষে এককালের খাসরাজ বংশের নেতা “আব্দুল্লাহ বিন উবায় ইবন মলুলের মাঝে ভর করেছিল। হযরতের মদীনা গমনের পূর্বে সেই হবে গোটা মদীনার একচ্ছত্র শাসক-সেটাই স্থিরীকৃত সিদ্ধান্ত। কিন্তু মদীনার বুকে মহানবী (সা.)-এর শুভাগমন আব্দুল্লাহকে দারুণভাবে হতাশ কর্ েতার নিজস্ব গুটি কতক লোক ব্যতীত মদীনার সকল গোত্রের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতাই ইসলাম গ্রহণ করে। এমনকি ‘আব্দুল্লাহ বিন উবায়-এর পুত্র আব্দুল্লাহ পর্যন্ত মুসলমান হয়ে যান। অবস্থার এই দ্রুত পরিবর্তন ইবনে উবায় মলুলের মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ ও ঈর্ষার জন্ম দেয় এবং এই ঈর্ষা ও বিদ্বেষই তাকে ভিন্ন পথে চালিত করে। সে প্রকাশ্যে ইসলাম গ্রহণের মাঝে নিজের বাহ্যিক নিরাপত্তা অনুভব করলেও হযরতের মদীনা উপস্থিতিই তার এত বড় পার্থিব স্বার্থ হাতছাড়া হবার প্রধান কারণ বলে মনে করে। সে জন্য সে রাসূলকে (সা.) কোনদিনই সহজভাবে নিতে পারেনি। কিন্তু স্বয়ং তার গোত্রের লোকরা এমনকি আপন পুত্র মুহাম্মদ (সা.)-এর ভক্ত অনুসারিতে পরিণত হওয়ায়ই প্রকাশ্য শত্রুতার পরিবর্তে গোপন ষড়যন্ত্রকে সে তার উদ্দেশ্য সাধনের জন্য একমাত্র হাতিয়ার হিসেবে বেছে নেয়।
মদীনা ও পার্শ্ববর্তী এলাকার অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় নেতৃত্বে ছিল কুসীদজীবী ইহুদী সম্প্রদায়। আর্থিক এবং কখনও কখনও ধর্মীয় ব্যাপারে মদীনার লোকরা ইহুদীদের শরণাপন্ন হতো। অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় নেতৃত্ব তাদের হাতে থাকায় অনেক সময় তাদের মদীনার আদি অধিবাসীদের উপর শাসন বিভাগীয় খবরদারি করবার সুযোগও মিলে যেতো। ইসলাম ও নবীর আগমনে এই ইহুদীরাও চরম ক্ষতিগ্রস্ত ও নিরাস হয়। তারা তাদের নীরব আত্মহুতিকে মেনে নিতে পারেন। তারা তাদের উদ্দেশ্য পূরণ একদিকে মদীনার মুনাফিক নেতা আব্দুল্লাহ বিন উবায়-এর সঙ্গে হাত মিলায় এবং অপরদিকে তারা ইসলাম ও মুসলমানদের প্রকাশ্য দুশমন মক্কার কুরাইশ কাফেরদের সঙ্গে হাত মিলায় এবং মদীনা আক্রমণ করে মুসলমানদের সমূলে উৎখাত করতে তাদের প্ররোচিত করে। সঙ্গে তাদের প্রয়োজনীয় সাহায্য সহযোগিতা প্রদানেরও আশ্বাস প্রদান করে। ইহুদীদের সঙ্গে আবদুল্লাহ বিন উবায় তার প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। এর পর থেকে ইহুদী ও মুনাফিকরা ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে শত্রুতা সাধনে পাশাপাশি ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।
রাসূল (সা.) মদীনা আগমনের পরপরই স্থানীয় অস্থানীয় সকল গোত্রের সঙ্গে পারস্পরিক সন্ধি সূত্রে আবদ্ধ হয়ে একটি কমন উম্মাহ গঠন করেন। মদীনার ইহুদীরাও ছিল এ সন্ধি চুক্তির অন্যতম শরীক। সন্ধি চুক্তি অনুসারে ইসলাম ও মুসলিম শক্তির বিরুদ্ধে কোন অন্তর্ঘাত ও নাশকতামূলক কাজে লিপ্ত হওয়া কিংবা ইসলাম বৈরি কোন শক্তির সঙ্গে কোনরূপ যোগাযোগ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ছিল এবং তা ছিল শাস্তিযোগ্য অপরাধ। প্রথমদিকে বেশ কিছুদিন তারা শান্ত ও নিরপেক্ষ জীবন যাপন করলেও অল্পদিনের ভেতর তাদের মুখোশ খসে পড়ে এবং তাদের চিরাচরিত অন্তর্ঘাত ও বিশ্বাসঘাতকতামূলক রূপ ফুটে ওঠে। তারা একদিকে মদীনার মুনাফেকদের সঙ্গে হাত মেলায়, অপরদিকে মক্কার কাফের কুরাইশদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে। অথচ এমনটি হবার কথা ছিল না। আর রাসূল (সা.) এমন ধরনের আশংকা করেননি। কারণ, আকিদাগত দিক দিয়ে অর্থাৎ তাওহীদ, রিসালাত ও আখেরাত নির্ভর বিশ্বাসের দিক দিয়ে মুসলমানরা ছিল ইহুদীদের নিকটতর। কিন্তু ইহুদীরা যদি তাদের বিশ্বাস ও আকিদার ভিত্তিতে ভূমিকা রাখত অন্তত কিছুটা সম্মান জানিয়েও তারা নিরপেক্ষ থাকতো তাহলে পৃথিবীর ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতো এবং ইসলামের প্রচার ও প্রসার ইতিহাসে সে সব সমস্যা ও সংকটের উদ্ভব ঘটতো না।
এর পেছনে ইহুদীদের জাতিগত ঈষা বিদ্বেষ, সংকীর্ণচিত্ততা, স্থবিরতা, জাতিবিদ্বেষ ও পরশ্রীকাতরতা যেমন দায়ী, তেমনি দায়ী তাদের বাতিল ও ভ্রান্ত আকিদা বিশ্বাস, জঘন্য চরিত্র ও নিষ্কৃষ্টতম স্বভাব-কুরআনুল করীমের বিভিন্ন স্থানে যা পুনঃ পুনঃ উল্লেখ করা হয়েছে। নবীদের সঙ্গে সংঘর্ষে প্রবৃত্ত হওয়া, তাঁদের দাওয়াত ও পয়গামের মোকাবিলা করা-এমনকি নবীদের হত্যা করার মতো দুঃসাহসিক ধৃষ্টতা প্রদর্শন, হিংসা ও বিদ্রোহাত্মক আচরণ, আল্লাহর প্রতি অপবাদ আরোপ, সীমাহীন অর্থলোলুপ মনোবৃত্তি, শোষণের হাতিয়ার নিষিদ্ধ সুদের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত আকর্ষণ ও প্রীতি, অবৈধ সম্পত্তি অর্জন, জাগতিক স্বার্থে আসমানী গ্রন্থের বিকৃত সাধন এবং জীবনের প্রতি অসীম মায়া ও মমত্ববোধ তাদের বংশগত ও জাতীয় বৈশিষ্ট্য। রাসূল (সা.) তাঁর দাওয়াত ও তাবলীগের বিভিন্ন পর্যায়ে ইহুদীদের এ জাতীয় চরিত্রের স্বরূপ উদঘাটন করলে তারা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং সন্ধি শর্ত লংঘনপূর্বক প্রকাশ্য ও গোপন শত্রুতা সাধনে আত্মনিয়োগ করে।
একবার নবী করিম (সা.) কোন এক কার্যোপলক্ষে বনী নাযীর পল্লিতে গেলে সেখানে বিশ্রামরত অবস্থায় তারা উপর থেকে প্রস্তর নিক্ষেপ করে নবী (সা.) কে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। রাসূল (সা.) তাদের কুমতলবের কথা অবগত হয়ে তাদেরকে মদীনা থেকে বহিষ্কার করেন। এরপর খন্দক যুদ্ধের অন্যতম উস্কানিদাতা ইহুদী কাব বিন আশরাফকে তার অপকর্মের কঠোর শাস্তি প্রদান করেন। এ শাস্তি প্রদানের দৃশ্যে অতঃপর ইহুদী ও মুনাফেক নেতা আব্দুল্লাহ বিন উবায় মলুলের মৃত্যুতে অন্যান্যের ষড়যন্ত্রে আপাতত কিছুটা ভাটা পরিলক্ষিত হয়। বনী মুস্তালিফ এ সময় তাদের বিশ্বাস ভঙ্গের শাস্তি লাভ করে।
বহিষ্কৃত অপরাপর ইহুদীরা খায়বরে মিলিত হয়ে তাদের ষড়যন্ত্র অব্যাহত রাখলে মহানবী (সা.) তাদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেন। এখানে তারা সম্মুখযুদ্ধে পরাজিত হয়ে ভক্তের ছদ্মবেশে মহানবী (সা.)কে দাওয়াত দিয়ে বিষ পান করিয়ে হত্যা করার চেষ্টা করে। রাসূল (সা.) একমাত্র বিষ প্রয়োগকারিণীকেই শাস্তিদান করে গোত্রের অন্যদের ক্ষমা করে দেন।
পরাজিত ইহুদীগোত্রগুলো হযরতের সঙ্গে উৎপাদিত ফসলের অর্ধেক প্রদানের শর্তে সন্ধি চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। মহানবী (সা.) তাদেরকে সাময়িকভাবে আরব ভূখণ্ডে বসবাস করার অনুমতি দেন। কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, সংহতি, স্থিতি ও শান্তি সংরক্ষণের স্বার্থে তাদের হাত থেকে জবীরাতুল আরবকে মুক্ত করার জন্য সাহাবীদের সতর্ক করেন।
ইসলামের অব্যাহত বিস্তৃতির প্রেক্ষাপটে রোম সম্রাট হিরাকিয়াসের নেতৃত্বে খ্রিস্টান শক্তি মুসলিম শক্তির অগ্রযাত্রা প্রতিহত করতে এগিয়ে আসে। রাসূল (সা.) তাদের মোকাবিলায় তাবুক পর্যন্ত অগ্রসর হন। রাসূল (সা.)-এর অমিতবিক্রম ও দৃঢ়তা প্রদর্শনের ফলে হিরাকিয়াস সংঘর্ষে যেতে সাহসী হয়নি। খ্রিস্টান রাজ্য আবিসিনিয়া ও মিসর মৈত্রীসূত্রে আবদ্ধ হয়।
রাসূল (সা.)-এর ইন্তেকালের পর খলিফা হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.) মুসলিম জাহানের সার্বিক দায়িত্ব লাভ করেন। এ সময় অনেকগুলো অমুসলিম গোত্র রাসূল (সা.)-এর ইন্তেকালের সুযোগে ইসলামকে তার বিকাশের প্রথম স্তরেই গলাটিপে হত্যার চেষ্টা চালায়। একদল মোনাফেক নবুয়তকে জাগতিক উন্নতির সোপান ভেবে নিজেদের নবী হিসেবে ঘোষণা দেয়। এ ক্ষেত্রে পুরুষদের কাতারে নারীও শামিল হয়। জাহেলিয়াতের বিভ্রম সম্পূর্ণ না কাটতেই নবতর এই ফেৎনা অনেক অজ্ঞ আরববাসীকেই বিভ্রান্ত করতে সক্ষম হয়। মুনাফেকদের একদল ইসলামের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ যাকাত প্রদানকেই অস্বীকার করে। কেউ আবার মদীনার কেন্দ্রীয় ভূমিকাকে অস্বীকার করতে চেষ্টা করে এবং মদীনা আক্রমণের স্বপ্ন দেখে। এমতাবস্থায় হযরত আবু বকর (রা.) শক্ত হাতে হাল ধরে সকল প্রতিকূল পরিস্থিতি সামলে নেন। খলিফার বাস্তবোচিত দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে অতি অল্পকালের মধ্যে মুনাফেকদের সকল তৎপরতা মিইয়ে যায়
হযরত আবু বকর (রা.)-এর পর খলিফা হন হযরত উমর (রা.)। তাঁর অপ্রতিহত ব্যক্তিত্ব ও প্রভাব অনুপম চরিত্র মাহাত্ম্য এবং অতিমাত্রায় সচেতনতা সাময়িকভাবে হলেও শত্রুদের সব ধরনের শয়তানি অপচেষ্টায় বিরত থাকতে বাধ্য করে। হযরত উমর (রা.)-এর দশ বছরের খেলাফত আমল ছিল ইসলামের অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রা ও অবিরাম বিস্তৃতির যুগ। এ সময় মুসলিম বাহিনী সিরিয়া, ইরাক, ফিলিস্তিন, মিসর, ইরান ও ইয়েমেন পুরোপুরিভাবে বিজয় করে।
এরপর খলিফা হন হযরত উসমান (রা.)। তার খেলাফতের প্রথম কয়েক বছর পরিপূর্ণ শান্তি নিরাপত্তার আবহাওয়া বিরাজ করে। সে সাথে ইসলামী সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষামূলক অগ্রাভিযানও অব্যাহত থাকে। ইসলামের এ অব্যাহত অগ্রযাত্রা ও অগ্রাভিযান মুনাফেক ও ইহুদীদের অন্তর্জ্বালা বাড়িয়ে দেয়। সহস্র বছরের প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী ইরানী সাম্রাজ্য, সুদীর্ঘকালের অজেয় বিশাল রোমক সাম্রাজ্যকে নবোত্থিত এ মুসলিম শক্তির সামনে ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতে দেখে দুশমনরা বুঝতে পারে, সম্মুখ সমরে এ অজেয় বাহিনীকে কিছুতেই মোকাবিলা করা যাবে না। এদের ভেতরে অনুপ্রবেশ ঘটিয়েই কেবল অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছা সম্ভব।
হযরত উসমান (রা.)-এর বাধ্যক্য ও সরলতা তাদের জন্য অপূর্ব সুযোগ এনে দেয়। রোমক সাম্রাজ্যের খ্রিস্টান অধিবাসীবৃন্দ, পারস্য সাম্রাজ্যের অগ্নিউপাস্যকবৃন্দ তাদের স্ব স্ব গৌরবমণ্ডিত সুবিশাল সাম্রাজ্যের পতনের জন্য মুসলমানদের দায়ী মনে করে এবং যে কোনভাবে মুসলমানদের উপর প্রতিশোধ গ্রহণে সংকল্পবদ্ধ হয়। এরাও পূর্ব হতে তৎপর ইহুদী ও মুনাফেকদের ঘৃণ্য অশুভ প্রয়াসের সঙ্গে হাত মেলায়।
এ সময়ে আব্দুল্লাহ বিন সাবা নামক ইয়েমেনের অন্তর্গত সান’আর একজন ইহুদী মুসলমান হয় এবং পূর্ব থেকে মুসলিম সমাজে অবস্থানরত মুনাফেকদের গোপন তৎপরতায় যোগ দেয়। অল্পদিনের মধ্যেই সে তার অসাধারণ সাংগঠনিক প্রতিভা, নেতৃত্বগুণ, উদ্ভাবনী শক্তি ও নিরলস প্রচেষ্টার মাধ্যমে সকল মুনাফেকদের ছাড়িয়ে যায়।
ইসলামের অব্যাহত অগ্রযাত্রা ও বিস্তৃতির পেছনে কার্যকারণ শক্তি হিসেবে ছিল মুসলমানদের অটুট ঐক্য ও সংহতি। তাওহিদ, রিসালাত ও আখেরাতে বিশ্বাস ছিল তাদের ঐক্য ও সংহতির মূল সূত্র। রাসূল (সা.) উপরোক্ত তিনটি মৌল বিশ্বাসের ভিত্তিতে এমন একটি সমাজের বুনিয়াদ কায়েম করেছিলেন যার শ্রেষ্ঠত্ব ও আভিজাত্যের প্রতীক ছিল ঈমান ও তাকওয়া। সকল বংশগত কৌলিণ্য, গোত্রীয় আভিজাত্য, রক্ত ও বর্ণের অহমিকাবোধের দাফন ঘটিয়ে শতধাবিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠীকে কালেমা-ই-তায়্যিবার পতাকাতলে সমবেত করতে তিনি সক্ষম হয়েছিলেন। তাদের ঐক্য ও সংহতি ছিল সীসাঢালা প্রাচীরের মতো। ফলে যারাই এ সীমাবৎ প্রাচীরের সঙ্গে টক্কর দিতে চেষ্টা করেছে তারা নিজেরাই টুকরো টুকরো হয়ে গেছে-আহত ও রক্তাক্ত হয়েছে। কাফের, মুশরেক, মুনাফিক, ইহুদী ও খ্রিস্টান শক্তি তাই মুসলমানদের শক্তির উৎস এই পারস্পরিক ঐক্য ও সংহতি ভিত্তিমূলেই আঘাত হানতে প্রয়াস পায়।
মুনাফিক নেতা আব্দুল্লাহ বিন উবায় রাসূল (সা.)-এর জীবিতকালেই একবার সামান্য ছুঁতা উপলক্ষ করে মুহাজির ও আনসারদের পরস্পরকে সংঘর্ষে লিপ্ত করতে চেষ্টা চালায়। রাসূল (সা.) সংবাদ পাওয়ামাত্র উভয়ের মাঝে গিয়ে হাজির হন এবং বলেন, আমি তোমাদের মাঝে উপস্থিত থাকতেই তোমরা জাহিলী যুগের আচরণে লিপ্ত হয়েছ? রাসূল (সা.)-এর এ সংক্ষিপ্ত তিরস্কারই তাদের জন্য যথেষ্ট প্রমাণিত হয়। তারা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে লজ্জিত ও অনুতপ্ত হয় এবং কোলাকুলির মাধ্যমে পুনরায় ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ হয়। আব্দুল্লাহ বিন সাবা তার পূর্বসূরির দৃষ্টান্তই হুবহু অনুসরণ করে এবং তা করে আরও একটু সতর্ক পন্থায়। ফলে ইবনে উবায় ব্যর্থ হলেও উবনে সাবা ঠিকই তার লক্ষ্য পূরণে সফল হয়।
বনু উমাইয়্যা ও বনু হাশিম কুরাইশ বংশের দু’টি প্রধান শাখা। ইসলাম পূর্বকাল থেকেই তাদের মধ্যে বিরোধ চলে আসছিল। বনু হাশিমের সদস্য আব্দুল্লাহ পুত্র মুহাম্মদ (সা.)-এর দ্বারা ইসলামের প্রচার ও প্রসারকে বনু উমাইয়্যা প্রতিদ্বন্দ্বী বনু হাশিমের উত্থান ও প্রাধান্য লাভের মাধ্যম হিসেবে ধরে নেয় এবং এর প্রতিরোধে সর্বশক্তি নিয়োগ করে। বদর যুদ্ধের পরবর্তী কাফেরদের প্রতিটি আক্রমণে নেতৃত্ব দিয়েছে বনু উমাইয়া প্রধান আবুসুফিয়ান। মক্কা বিজয়ের সময় আবু সুফিয়ানের সঙ্গে বনু উমাইয়ার সকলেই ইসলাম গ্রহণ করে। রাসূল (সা.)-এর অনুপম চরিত্র, মাধুর্য, অসাধারণ ঔদার্য ও সহনশীলতা উভয় গোত্রের ভেতরকার বিরোধ ও বিদ্বেষকে ভুলিয়ে দিতে সাহায্য করে এবং সময়ের ব্যবধানে এক সময় তা চাপাও পড়ে যায়। (চলবে)
-

খলিফা হযরত উসমান (রা.)-এর বার্ধক্যজনিত অসতর্কতা ও সরলতার সুযোগে বনু উমাইয়ার কিছু সংখ্যক লোক অবৈধ সুবিধা হাসিলের চেষ্টা চালায়। বিশেষ করে মারওয়ান বিন আল হাকামের কতিপয় অপকীর্তি ইবনে সাবার অপচেষ্টার পেছনে মদদ যোগায়। ইবনে সাবা এগুলোকেই পুঁজি করে বনু হাশিম ও বনু উমাইয়ার পুরাতন বিদ্বেষ উস্কে দিতে চেষ্টা চালায় এবং এ সবের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে উমাইয়া বংশের খলিফা উসমান (রা.)কে চিত্রিত করে তার বিরুদ্ধে অসন্তোষ ও বিদ্রোহ ছড়াতে চেষ্টা করে। বসরা, কুফা, দামেস্ক, মিসর প্রভৃতি দূরবর্তী শহর ও অঞ্চলগুলোতে খলিফার বিরুদ্ধে সৃষ্ট তার অপপ্রচার হয় এবং বিরাট একদল লোক যাদের অধিকাংশই ছিল নওমুসলিম এবং ইসলামের শিক্ষা যাদের মনমগজে তখনো দৃঢ় আসন লাভ করেনি, তার সমর্থকে পরিণত হয়। ধীরে ধীরে তারা সংঘবদ্ধভাবে বিদ্রোহী হয়ে উঠে এবং মদীনায় খলিফার বাসভবন ঘেরাও করে। তারা খলিফাকে হত্যার হুমকি দিয়ে পদত্যাগ দাবি করে। খলিফার বাসগৃহের খাদ্য ও পানি সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। মসজিদে নামায আদায়ে বাধা সৃষ্টি করে। এক পর্যায়ে তারা খলিফার বাড়িতে ঢুকে পড়ে এবং রোযা অবস্থায় কুরআন তেলাওয়াতরত বয়োবৃদ্ধ খলিফাকে হত্যা করে। কাবুল থেকে মরক্কো পর্যন্ত বিশাল খেলাফতের কর্ণধারের জানাযায় মাত্র সতরজন লোক অংশ গ্রহণ করেছিল। খলিফা উসমান (রা.) বিদ্রোহীদের দ্বারা ঘেরাও হওয়ার পর ইচ্ছা করলে তাদের নির্মূল করতে পারতেন। অন্য সাহাবীরা সে জন্য প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু হযরত উসমান (রা.) নিজের জন্য কোন মুসলমানের রক্ত ঝরাতে চাননি। তিনি চাননি মুসলমানদের মধ্যে রক্তপাতের সূচনাকারী হতে।
ইসলামের সংকটকালে বিশেষ করে মদীনায় যখন পানি সংকট অত্যন্ত তীব্র তখন তিনি বিস্তর অর্থের বিনিময়ে ইহুদী মালিকানাধীন ‘বীরেরুমা’-রুমা কূপটি খরিদ করে মদীনার মুসলমানদের জন্য ওয়াকফ করে দেন। বিনিময়ে রাসূল (সা.) তাঁকে জান্নাতের অঙ্গীকার করেন। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস যিনি একদিন ‘বীরেরুমা’ ওয়াকফ করে মদীনাবাসীদের পানি কষ্ট দূর করেছিলেন, তার বাড়িতেই সেই কূপের পানি বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। সেই ঘেরাও অবস্থায় একদিন তিনি জানালা দিয়ে মাথা বের করে মদীনাবাসীদের স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নির্দেশে আমিই বীরেরুমা খরিদ করে সর্বসাধারণের জন্য ওয়াকফ করে দিয়েছি-আজ সেই কুপের পানি থেকেই তোমরা আমাকে বঞ্চিত করেছো। আমি আজ পানির অভাবে ময়লা পানি দিয়ে ইফতার করেছি।
হযরত উসমানের (রা.) নির্মম শাহাদাতের পর ইবনে সাবার অনুচর এসব মুনাফেকদের অধিকাংশই হযরত আলী (রা.)-এর সমর্থক ও সৈন্যদলের সাথে মিশে যায় এবং খলিফার পক্ষে হযরত উসমান (রা.) হত্যার বিচার অনুষ্ঠানকে অসম্ভব করে তোলে।
অপরদিকে এদের অবশিষ্ট অংশ হযরত আয়েশা (রা.)সহ অনেক প্রবীণ সাহাবার সঙ্গে যোগ দিয়ে তাদের বুঝাতে সক্ষম হয় যে, ‘উসমান (রা.) হত্যার সঙ্গে নতুন খলিফা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত না হলেও তিনি হত্যাকারীদের প্রশ্রয় দিচ্ছেন এবং হত্যাকারীদের খুঁজে বের করে শাস্তি প্রদানে গড়িমসি করছেন। পরোক্ষ জড়িত বিধায় তাদের বিচার হোক তা তিনি চান না। এ প্রচারণা এত ব্যাপকতা লাভ করে যে, কেউ তা বিশ্বাস করতে না চাইলে তাকেও খলিফা উসমান (রা.) হত্যার সঙ্গে জড়িত বলে সন্দেহ করা হতো। প্রচারণার প্রাবল্যে হযরত আয়েশা (রা.) পর্যন্ত বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন এবং অবশেষে তা জঙ্গে জামাল বা উষ্ট্র যুদ্ধ পর্যন্ত গিয়ে গড়ায়। হযরত আলী (রা.) ও হযরত আয়েশা (রা.)-এর মধ্যকার আলোচনাকে ব্যর্থ করে দিয়ে এরাই রাতের অন্ধকারে যুদ্ধ বাধাবার প্রয়াসে বিপরীত শিবিরকে তীরের লক্ষ্যে পরিণত করে। দশ হাজার তরতাজা প্রাণ মুসলিম সিপাহীর লাশের বিনিময়ে যুদ্ধের অবসান ঘটলেও ইসলামের প্রসার ও অগ্রাযাত্রার পথে তা একটি কলঙ্কিত অধ্যায় ও বাধা হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে রইল।
পরবর্তীকালে বনু উমাইয়া ও বনুহাশিমের দ্বন্দ্ব ‘আলী ও মুয়াবিয়া (রা.) বিরোধের মধ্যে রূপ লাভ করে এবং উভয়কেই সিফফিন প্রান্তরে টেনে নিয়ে আসে। হযরত আলী (রা.)-এর জয়লাভের চূড়ান্ত মুহূর্তে ইবনে যাবার লোকরাই আবার বেঁকে বসে এবং হযরত আলীকে (রা.) সন্ধি আলোচনায় টেনে নামায়। এরাই আবার যুদ্ধ মুলতবি করার অভিযোগে আলীকে (রা.) অভিযুক্ত করে এবং পরবর্তীতে তাকে শহীদ করে।
৩০ হিজরী থেকে ৪০ হিজরী পর্যন্ত ছিল মুসলমানদের মর্মান্তিক এক অধ্যায়। এ সময়ে মুসলমানদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, মতবিরোধে বিপুল সংখ্যক মুসলমানকে জীবন দিতে হয়। ৪১ হিজরীতে হযরত ইমাম হাসান (রা.) ইবনে সাবা ও তার অনুচরদের সৃষ্ট এই গোত্র ও বংশবিদ্বেষী ফেৎনাকে অত্যন্ত বীরত্ব ও সাহসিকতার সাথে মোকাবিলা করেন। ফলে পুনরায় মুসলিম জাহানে শান্তি ও স্বস্তির আবহাওয়া দেখা দেয়। মুসলিমদের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি ফিরে আসে। কিন্তু মু’আবিয়া (রা.) পরবর্তী ইয়াজিদ কর্তৃক খিলাফত লাভ এবং কারবালার লোমহর্ষক ও দুঃখজনক ঘটনা মুশরেক ও মুনাফেকদের কর্মতৎপরতার মধ্যে জোয়ার সৃষ্টি করে। মুশরিক কাফেররা সফল হতে না পারলেও মুনাফেকদের সৃষ্ট অশান্তি ও নাশকতামূলক কাজের জের প্রায় এক যুগ অব্যাহত থাকে। এদেরই হাতে পবিত্র কাবার অসম্মান পর্যন্ত ঘটে।
কারবালার মর্মান্তিক ঘটনাকে সম্মুখে রেখে এ সময় অপর একজন ইসলাম দুশমন মোনাফেক ময়দানে অবতরণ করে। তার নাম মুখতার বিন ‘উবায়দা ছাকাফী’ কারবালার শহীদি রক্তের বদলা নেবার শপথ নেয় সে এবং অল্পদিনের মধ্যেই একটি বিরাট জামাত গঠনে সফল হয়। অত্যন্ত সুকৌশলে সে কতিপয় সরল বিশ্বাসী সাহাবীর সমর্থন আদায়ের মাধ্যমে হুসায়েন (রা.) হত্যার প্রতিশোধ দাবিকে গণ দাবিতে পরিণত করে। ইবনে সাবার গুপ্ত প্রচারক দলের সমর্থন তাকে আরেক ধাপ এগিয়ে দেয়। সে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে কুফার শাসন কর্তৃত্ব ছিনিয়ে নেয়। এরপরই সে স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করে। হযরত আলী (রা.)-এর নামে কৃত্রিম কুরসী তৈরি করে সে তার অনুসারীদের উক্ত কুরসী চুমু ও তার সামনে সিজদা দিতে নির্দেশ দেয়। কিছুদিন পর আরও একধাপ অগ্রসর হয়ে সে ইলহাম-এমনকি ওহী লাভের দাবি পেশ করে এবং লোকদের বয়আ’ত করতে শুরু করে। হিজরী ৬৭ সালে মুসআব বিন যুবায়ের (রা.) কর্তৃক নিহত হবার মাধ্যমে এ ইসলাম দুশমনের সৃষ্ট ফেৎনার অবসান ঘটে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন