শুক্রবার, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

অহংকার ছাড়া টাখনোর নিচে কাপড় ঝুলিয়ে রাখলে কি গোনাহ হবে না


টাখনোর নিচে কাপড় ঝুলানো সম্পর্কে আমাদের অনেক ভ্রান্তি রয়েছে। ইতিপূর্বে দু’টি পোস্টে কিছুটা আলোচনা করেছি। এখন যে বিষয়টি আলোচনা করতে চাচ্ছি তা হচ্ছে, অহংকার ছাড়া কেউ যদি কাপড় ঝুলিয়ে রাখে তাহলে সেটা নিষেধাজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত হবে কি না। অনেক ভাই হাদীসের ‘খুইয়ালা’ শব্দ দেখে মনে করেন, অহংকারের কারণে ঝুলিয়ে রাখলেই শুধু নিষেধাজ্ঞাটি প্রয়োগ হবে নতুবা কাপড় ঝুলানো নিন্দনীয় নয়। তাদের এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। কেননা-
১.
প্রথম কথা হলো, যদিও কিছু কিছু হাদীসে নিষেধাজ্ঞাকে অহংকারের সাথে সম্পৃক্ত করা হয়েছে কিন্তু এর বিপরিত অসংখ্য হাদীসে অহংকারের শর্ত ছাড়াই সাধারণভাবে কাপড় ঝুলানো থেকে নিষেধ করা হয়েছে এবং কঠিন শাস্তির ভয় দেখানো হয়েছে। যেমন-
*হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, লুঙ্গির যে অংশ দু’টাখনোর নিচে থাকবে, তা জাহান্নামে যাবে। (সহীহ বুখারী, হা.৫৭৮৭)

*হযরত আবু যর রা. থেকে বর্ণিত নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তিনি ব্যক্তি এমন কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা তাদের সাথে কথা বলবেন না, তাদের দিকে দৃষ্টিও দিবেন না এবং তাদেরকে পবিত্রও করবেন না... 
এরপর এই তিনি ব্যক্তির মধ্যে কাপড় ঝুলন্তকারীকে (অহংকারের শর্ত উল্লেখ ছাড়াই) উল্লেখ করেছেন (দেখুন, সহীহ মুসলিম, হা. ১০৮)

*হযরত ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাপড় ঝুলিয়ে রাখতে নিষেধ করেছেন। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবাহ, হা.)
*হযরত আবু সাঈদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, মুসলিমের লুঙ্গি পায়ের নলার অর্ধভাগ পর্যন্ত। তবে নলা এবং টাখনো পর্যন্ত থাকতে কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু লুঙ্গির যে অংশ দু’টাখনোর নিচে যাবে, তা জাহান্নামে যাবে। (সুনানানে আবু দাউদ, হা.৪০৯৩; ইবনে মাজা, হা. ৩৫৭৩; সহীহ ইবনে হিব্বান, হা.১২/২৬৩)
*হযরত ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তাআলা লুঙ্গি ঝুলন্ত কারীর দিকে দৃষ্টি (রহমতের) দিবেন না। (সুনানে নাসায়ী: হা.৫৩৩২)
*হযরত মুগীরা বিন শু’বা রা. থেকে বর্ণিত নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, হে সুফিয়ান বিন সাহল! কাপড় ঝুলিও না। কেননা আল্লাহ তাআলা কাপড় ঝুলন্তকারীকে পছন্দ করেন না। (সুনানে ইবনে মাজা, হা.৩৫৭৪; সহীহ ইবনে হিব্বান, হা.১২/২৫৯)
উপরে কয়েকটি বর্ণনা উল্লেখ করা হয়েছে, অনুসন্ধান করলে এরকম অনেক বর্ণনা পেশ করা যাবে যেগুলো থেকে একথা সুস্পষ্ট যে, টাখনোর নিচে কাপড় ঝুলানো অহংকারের সাথে হোক কিংবা অহংকার ছাড়াই হোক সর্ববস্থায় তা নিষেধ।
হযরত ইবেন উমর রা. সর্বাবস্থায় কাপড় ঝুলানো অপছন্দ করতেন। হাফেজ ইবনে হাজার রহ. বলেন, ইবনে আবী শাইবাহ এটি বর্ণনা করেছেন। এরপর তিনি বলেন, ইবনে উমরের এই অপছন্দ হচ্ছে যদি ইচ্ছাকৃত ঝুলিয়ে রাখে অহংকার থাক বা না থাক। (ফাতহুল বারী: ১০/২৫৫)

২.
দ্বিতীয় কথা হলো, অহংকার থাকা না থাকার বিবেচনা ছাড়াই অন্য অনেক কারণে নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে। যতটুকু লম্বা কাপড়ের প্রয়োজন এরচেয়ে বেশি লম্বা কাপড় পরিধান করলে নিষেধাজ্ঞার কি কি কারণ হতে পারে এসম্পর্কে হাফেজ ইবন হাজার রহ. বলেন-
ক.ইসরাফ যা হারাম
খ.মহিলার সাথে সামঞ্জস্যতা। এটি প্রথমটির চেয়েও মজবুত। তিনি বলেন হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে-রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঐ পুরুষকে লা’নত করেছেন যে মহিলার মতো কাপড় পরে।
হাকীম রহ. উক্ত হাদীসকে সহীহ বলেছেন।(হাদীসটি মুসনাদে আহমদ; সহীহ ইবনে হিব্বান সহ অন্যান্য হাদীসের গ্রন্থেও বর্ণিত হয়েছে)
গ.পরিধানকারী ব্যক্তি নাজাসত লেগে যাওয়া থেকে নিরাপদ থাকতে পারে না। এদিকে ইঙ্গিত করেই শামায়েলে তিরমিযি (হা.১১১) এবং নাসায়ী (কুবরা, হা.৯৬০৩) তে হযরত উবাইদ বিন খালিদ রা. থেকে বর্ণিত হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে-‘‘তিনি বলেন, আমি টাখনোর নিচে একটি চাদর ঝুলিয়ে হাটছিলাম এক ব্যক্তি আমকে বলল, তোমার কাপড় উঠাও কেননা এটা তোমার কাপড়ের পবিত্রতা এবং দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার বেশি উপযোগী। পিছনে ফিরিয়ে দেখি সেই লোকটি হলেন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।’’
৩.
আমাদের অনেক ভাই টাখনোর নিচে কাপড় পরেন এবং নিজেদের আমলের বৈধতা প্রমাণে হযরত আবু বকর রা. এর আমল পেশ করেন। তারা বলেন, হযরত আবু বকরের অহংকার ছিল না তাই তা নিষেঘজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত হয় নি আমরাও অহংকারের কারণে পরি না সুতরাং আমাদেরটাও বৈধ।

ঐসকল ভাইদের জেনে রাখা দরকার অহংকার ছাড়া কাপড় ঝুলানোর দাবী করার দু’টি সুরত:
ক.অহংকার ছাড়া অনিচ্ছায় কাপড় ঝুলানো। যেমন বেখায়ালে কারো লুঙ্গি কিংবা কাপড় টাখনোর নিচে চলে যায় কিন্তু যখনই খেয়াল হয় উঠিয়ে নেয়।
খ.ইচ্ছাকৃত কাপড় ঝুলিয়ে দাবী করা যে, আমি অহংকার ছাড়া করেছি।

হযরত আবু বকর রা. ছিলেন প্রথম সূরতের অন্তর্ভুক্ত। দেখুন, সহীহ বুখারী শরীফে (হা. ৩৬৬৫; ৫৭৮৪) হযরত ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত হাদীসের শেষে হযরত আবু বকর রা. এর প্রশ্ন এবং নবীজীর জবাব উল্লেখিত হয়েছে এভাবে-হযরত আবু বকর রা. বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার লুঙ্গির এক অংশ খেয়াল না করলে ঢিলা হয়ে যায়। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তুমি তাদের অন্তর্ভুক্ত নয় যারা অহংকারের কারণে ঝুলিয়ে রাখে।’’
তাড়াহুড়ো করে চলার কারণে এরকম তো নবীজীরও হয়েছিল। সহীহ বুখারী শরীফে (হা. ৫৭৮৫) হযরত আবু বাকরা রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, নবীজীর সময়ে একবার সূর্য-গ্রহণ হলো। তিনি দ্রুত কাপড় ঝুলিয়ে মসজিদে আসলেন।
তাছাড়া হযরত আবু বকর রা.অহংকার থেকে মুক্ত একথার সার্টিফিকেট খোদ নবীজী দিয়েছেন কিন্তু অন্য ঝুলন্তকারীদের যে অহংকার নেই একথার সার্টিফিকেট কে দিবে? সুতরাং হযরত আবু বকর রা.কে দলীল বানানোর কোনো সুযোগ নেই।
৪.
ইচ্ছাকৃত কাপড় ঝুলিয়ে যে দাবী করবে, আমি অহংকারমুক্ত তার এই দাবী সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য হবে। ইবনুল আরাবী রহ. বলেন-
‘‘টাখনোর নিচে কাপড় ঝুলিয়ে একথা দাবী করা যে, আমি অহংকারের কারণে করি নি, এটা জায়েয নয়। কেননা নিষেধাজ্ঞার শব্দটি এটাকেও অন্তর্ভুক্ত করে (কোরআন হাদীসের) শব্দ যখন কাউকে বিধানগতভাবে অন্তর্ভুক্ত করে একথা বলার সুযোগ নেই যে, আমি এটা পালন করবো না, কেননা এই ইল্লত (কারণ) আমার মধ্যে নেই। এটি অগ্রহণযোগ্য দাবী। বরং (কাপড়ের) অগ্রভাগ ঝুলানোই একথা প্রমাণ কর যে, তার মধ্যে অহংকার রয়েছে।’’

হাফেজ ইবনে হাজার রহ. ফাতহুল বারীতে (১০/২৬৪) উপরোক্ত বক্তব্য উল্লেখ করে বলেন, সারকথা হলো, কাপড় ঝুলানোর দ্বারা ‘জাররুস সাওব’ অত্যাবশ্যক আর ‘জাররুস সাওব’ এর জন্য অহংকার অত্যাবশ্যক যদিও পরিধানকারী অহংকারের উদ্দেশ্য না করে।
তিনি বলেন, ‘‘এটি (এই বক্তব্যটি) সুদৃঢ় হয় ইবনে উমর রা. থেকে অন্য সূত্রে আহমদ ইবনে মানী’ (আল মাতাবিলবুল আলিয়া: ১০/২৯১) এর বর্ণনা থেকে। নবীজী (এক আ’রাবীকে) বলেছেন, তুমি লুঙ্গি ঝুলানো থেকে বেঁচে থাকো। কেননা লুঙ্গি ঝুলানো অহংকারের অন্তর্ভুক্ত।
এবং তাবারানীতে (হা.৭৯০৯) আবু উমামার বর্ণনা দ্বারাও উক্ত বিষয়টি সুদৃঢ় হয়। তিনি বলেন, আমরা নবীজীর কাছে ছিলাম ইতিমধ্যে আমর ইবনে যুরারা রা. আমাদের কাছে একটি লুঙ্গি এবং চাদর ঝুলিয়ে আসলেন। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার কাপড় ধরতে লাগলেন এবং আল্লাহর জন্য বিনয় প্রকাশ করতে লাগলেন এবং বলতে লাগলেন- اللَّهُمَّ عَبْدُكَ، وَابْنُ عَبْدِكَ، وَابْنُ أَمَتِكَ হযরত আমর ইবনে যুরারা শুনতে পেয়ে নবীজীর দিকে ফিরে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার পায়ের নলা শক্ত। নবীজী বললেন, হে আমর ইবনে যুরারা! আল্লাহ তাআলা তার সকল মাখলূককে সুন্দরভাবে সৃষ্টি করেছেন। হে আমর ইবনে যুরারা! আল্লাহ তাআলা কাপড় ঝুলন্তকারীদেরকে পছন্দ করেন না।’’

দেখুন, এটা তো সুস্পষ্ট সাহাবী আমর ইবনে যুরারা অহংকার ছাড়াই টাখনোর নিচে কাপড় ঝুলিয়ে ছিলেন তথাপি নবীজী কাপড় উঠাতে বলেছেন এবং বলেছেন, আল্লাহ তাআলা কাপড় ঝুলন্তকারীদেরকে পছন্দ করেন না। বুঝা গেল অহংকার না থাকলেও কাপড় ঝুলানো নিষেধ।
শায়খুল ইসলাম আল্লাম তাক্বী উসমানী দা. বা. বিষয়টি আরো সুস্পষ্ট করে দিয়েছেন। তিনি বলেন-
‘‘টাখনোর নিচে কাপড় ঝুলানো হারাম হওয়ার মূল কারণ তো অহংকার যেমন হাদীস শরীফে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুস্পষ্ট করে দিয়েছেন। কিন্তু অহংকার প্রমাণিত হওয়া একটি লুকায়িত বিষয় অনেক সময় অহকারে আক্রান্ত ব্যক্তি অবগত হতে পারে না তাই অহকারের সববকে ইল্লতের স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছে। আর এটা হচ্ছে কাপড় ঝুলন্ত করা। (অর্থাৎ কাপড় ঝুলন্ত করাই তার অহংকার আছে একথার প্রমাণ বহণ করে) এটা সফরের কসর পড়ার মতো। কেননা কসরের ইল্লত হচ্ছে ‘মুশক্কত’ (কষ্ট)। কিন্তু ‘মুশক্কত’ একটি অস্পষ্ট বিষয়, কোনো নিয়ম-নীতি দ্বারা নিয়ন্ত্রন করা যায় না। তাই সববকে (সফর) ইল্লতের (মুশক্কত) স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছে। এহিসেবে যখনই কাপড় ঝুলন্ত করা পাওয়া যাবে নিষেধাজ্ঞা আসবে। তবে অনিচ্ছার অবস্থা ভিন্ন। কেননা তখন অহংকার না থাকা নিশ্চিত। কারণ অহংকার এমন কাজের দ্বারা প্রমাণিত হয় না যাতে বান্দার কোনো এখতিয়ার নেই। এ দিক বিবেচনায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আবু বকর রা. কে অনুমতি দিয়েছিলেন আর বলেছিলেন তুমি তাদের অন্তর্ভুক্ত নয় যারা অহংকারের কারণে ঝুলিয়ে রাখে।’’ (তাকমিলায়ে ফাতুল মুলহিম:৪/১০৭-১০৮)
শায়খুল ইসলামের উপরোক্ত বক্তব্য দ্বারা সব প্রশ্ন এবং সন্দেহ নিরসন হয়ে যয়।
৫.
উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা সুস্পষ্ট হয়ে গেল যে, কাপড় ঝুলিয়ে রাখাই অহংকার আছে একথার প্রমাণ বহণ করে। তাই একথা বলার সুযোগ নেই আমার মধ্যে অহংকার নেই তাই নিষেধাজ্ঞাটি আসবে না। তথাপি যারা ঐসকল আলেমদের বক্ত্বব্যকে ঢাল বানাতে চান যারা অহংকার থাকা না থাকার মধ্যে পার্থক্য করেছেন যেমন ইবনু আব্দুল বার, নভভী, আইনী, ইবনুল মালিক, মুল্লা আলী ক্বারী। ঐসকল ভাইদের জেনে রাখা দরকার যারা পার্থক্য করেছেন তারা একথা বলেননি যে, অহংকার না থাকলে ঝুলিয়ে রাখতে কেনো অসুবিধা নেই। বরং তারা বলেছেন হারাম কিংবা মাকরূহে তাহরীমী হবে না। তবে অহংকার ছাড়াও ঝুলিয়ে রাখা নিন্দনীয় এবং মাকরূহে তানযীহী। (দেখুন, আত তামহীদ: ৩/২৪৪; আল মিনহাজ:১৪/৬২; ফাতহুল বারী:১০/২৬৩-২৬৪; আল হিন্দিয়্যাহ: ৩/৩৩৩; তাকমিলায়ে ফাতহুল মুলহিম:৪/১০৫)

৬.
সারকথা: আমার মধ্যে অহংকার নেই তাই নিষেধজ্ঞাটি আমার ক্ষেত্রে আসবে না, একথা বলে কাপড় ঝুলিয়ে রাখার কোনো সুযোগ নেই।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন