সোমবার, ১৪ নভেম্বর, ২০১৬

পিতা পুত্রকে!

Atik Ullah


ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল রহ। চার ইমামের কনিষ্ঠতম। আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে আজীব ইস্তেকামত দান করেছিলেন। তাকে দ্বিতীয় আবু বাকর বলা হয়। রিদ্দার যুদ্ধে প্রথম খলীফার মতো, খলকে কুরআনের মাসয়ালায়, তিনি একাই লড়ার হিম্মত করেছেন। এজন্য তাকে অমানুষিক নির্যাতন সইতে হয়েছে। খলীফা মুতাওয়াক্কিল (৮৪৭-৮৬১) আসার পর পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলো। ইমাম আহমাদকে সসম্মানে মুক্তি দেয়া হলো। 
.
খলীফার মনে চাচা মামুন, বাবা মুতাসিম ও ভাই ওয়াসেকের কর্মকান্ডের কারনে অনুশোচনা ছিল। এই তিনজন ইমাম আহমদের প্রতি যা করেছে, পুরো আব্বাসী খিলাফতকেই কালিমাযুক্ত করে দিয়েছে। বংশীয় গুনাহের কাফফারা আদায়ের অংশ হিশেবে কিছু কাজ হাতে নিলেন। ইমাম আহমদের সুখ-শান্তির প্রতি নজর দিলেন। ইমাম আহমাদ এক অর্থে তার গুরুভাইও বটে। কারণ মুতাওয়াক্কিলই আব্বাসী খলীফাদের মধ্যে প্রথম শাফেয়ী মাযহাব গ্রহণ করেন। দাদাজান হারুনুর রশীদ রহ. ছিলেন হানাফী। ইমাম আবু ইউসুফ রহ.-এর সঙ্গ লাভের কারণে। মুতাওয়াক্কিলকে নিয়ে অনেক আগে একটা দিনলিপি দেয়া হয়েছিল। আজ আর বেশি কিছু না বলাই ভাল। ইমাম আহমাদ ছিলেন ইমাম শাফেয়ীর প্রিয় ছাত্র।
.
মুতাওয়াক্কিল হাদিয়া পাঠালেন। ইমাম সাহেবের দরবারে। পোশাক, তেল, খাবার-পানীয় ইত্যাদি। ইমাম সাহেব এসব দেখে বললেন:
-কে পাঠিয়েছে এসব?
-আমীরুল মুমিনীন। 
-আমি কি এসব পাঠাতে বলেছিলাম?
-জ্বি না বলেন নি। খলীফা আপনার জন্যে এসব হাদিয়াস্বরূপ পাঠিয়েছেন। 
-সুবহানাল্লাহ!
-জাযাকাল্লাহু খাইরান। আপনি হাদিয়াগুলো রেখে দিন। 
.
সেখানে ইমাম সাহেবের ছেলে আবদুল্লাহও উপস্থিত ছিলেন। তিনি আর থাকতে না পেরে বললেন:
-আব্বু! আপনি আমাদের দুরবস্থা দেখতে পাচ্ছেন না? আমরা কী কষ্টে আছি একটু ভেবে দেখবেন না? এই হাদিয়াগুলো আমাদের যে কী প্রয়োজন, আপনাকে তা কী করে বোঝাই!
-বৎস! একসময় এসবের কিছুই থাকবে না রে! সব ফুরিয়ে যাবে! যা থাকবে না, তা রেখে লাভ কী?
-আপনি কি আমাদের চরম আর্থিক অনটন দেখার পরও একথা বলছেন?
ইমাম সাহেব ছেলের অবুঝপনা দেখে, ভর্ৎসনা করে বললেন:
-এগুলো প্রহরীদেরকে দিয়ে এসো। তাদেরকে জাযাকাল্লাহ বলতে ভুলো না যেন!
ইমামপুত্রের পক্ষে বাবার এই কঠোর আদর্শবাদ মেনে নেয়া কঠিনই ছিল বৈ কি। হাদিয়া গ্রহণ করা তো সুন্নাত। আর এখন প্রয়োজনের সময় গ্রহণ করা আবশ্যকও বটে। পুত্র বাবার আদর্শকে ধরতে না পারার কারণেই চিন্তার পার্থক্যটা প্রকট হয়ে ধরা দিয়েছে। নইলে আবদুল্লাহ রহ.ও অন্য সব দিক দিয়ে যোগ্য পিতার মোটামুটি যোগ্য সন্তানই ছিলেন। লেখাপড়া-তাকওয়া পরহেযগারিতে। বাবার জীবনীও লিখেছিলেন। কিন্তু ইমাম সাহেব শাসকের কাছ থেকে কোনও প্রকারের সাহায্য নিবেন না, এটাই ছিল তার পণ। মনে গেলেও না। পুত্র হয়তো এক্ষেত্রে খানিকটা নমনীয় ঘরানার ছিলেন। এখন যেমন কওমী সনদ নিয়ে দুই দল! 
.
ঘটনার পর এক বছর পার হয়ে গেছে। একদিন পুত্রকে কাছে ডেকে বললেন:
-বাছা, কাছে এসে বসো! তোমার কি খলীফার পাঠানো সেই পোশাক আর খাবারদাবারের কথা মনে পড়ে?
-জ্বি আব্বাহুজুর!
-তোমার কি মনে হয়, আমরা যদি সেদিন হাদিয়াগুলো গ্রহণ করতাম, আজ সেগুলোর কিছু অবশিষ্ট থাকতো?
-জ্বি না। সবই নিঃশেষে ফুরিয়ে যেতো! বাকি থাকতো না কিছুই!
-বাবারে! গত এক বছরে এমন কি কখনো হয়েছে, তুমি ক্ষুধার্ত হওয়ার পরও খাবার পাওনি? 
-জ্বি না আব্বু! সব সময়ই রুটি বা খেজুর যা হোক একটা কিছু পেয়েই যেতাম!
-গত একটা বছর কখনো কি তুমি আদুল গায়ে ছিলে? বস্ত্রহীন থাকার কারনে তোমার কোনও কাজ কি আটকে গিয়েছিল?
-জ্বি না। মোটামুটি ধরনের হলেও পরিধেয় পোশাক সব সময়ই ছিল। 
-বাবা! খাবার, পানীয়, পোশাক এক রকম হলেই দিন চলে যায়! এজন্য খলীফার কাছে হাত পাততে হয় না। খলীফার সাহায্যও নিতে হয় না!
.
বাবার হাতে গড়ে ওঠা আবদুল্লাহ রহ. সময়ের বড় আলিম হতে পেরেছিলেন। কিতাবুস সুন্নাত রচনা করেছিলেন। বাবার নামে প্রসিদ্ধ কিতাব ‘মুসনাদে আহমাদ’ তারই সংকলন করা। 
.
কেউ বিশ টাকা দিয়ে আহার সারে, কেউ বিশ হাজার দিয়ে। কেউ মসজিদের কল থেকে পানি পান করে পেটের ক্ষুধানিবৃত্তি করে, কেউ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত চায়নিজে গিয়ে। কেউ সাতকোর্সের ডিনার সারে, কেউ পাউরুটি-কলা খেয়েই রাত পার করে দেয়। 
কেউ পঞ্চাশ টাকা গজের কাপড় পরে দিন কাটিয়ে দেয়, কেউ পঞ্চাশ হাজার টাকার। দিন কি কারো থেমে থাকে? যত কম তত গম!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন