ইসলামে
একজন পুরুষ কর্তৃক একসাথে চার স্ত্রী রাখার যে বিধান রয়েছে (সূরা ৪: আয়াত ৩) সে
বিষয়ে শুধু ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মাঝেই নয় বরং অনেক মুসলমানদের মধ্যেও বিশেষ
উদ্বেগ,
বিস্ময়
ও বিভ্রান্তি লক্ষ্য করা যায়। সাম্প্রতিক কালে এ সংক্রান্ত আলোচনা-সমালোচনা ছাড়িয়ে
যেতে বসেছে সঠিক তত্ত্ব, তথ্য ও যুক্তির সমস্ত সীমা-পরিসীমা। অথচ মজার ব্যাপার হচ্ছে
পুরুষদের চার বিয়ের স্বীকৃতি দেয়ার পাশাপাশি আল্লাহ তা’য়ালা যে এক বিয়ের প্রতি
কিভাবে জোর দিয়েছেন তা অধিকাংশ আলোচনাতেই থেকে যাচ্ছে উহ্য। আল্লাহ পাক খুব
পরিষ্কার করেই বলেছেন, অবস্থার প্রেক্ষিতে চারটা পর্যন্ত বিয়ে করা যেতে পারে তবে
তা স্ত্রীদের মধ্যে সমতা বজায়ে রাখার শর্তে, যা কিনা মানুষের জন্য দুরূহ, তাই এক বিয়েই উত্তম ও
যথেষ্ট (৪:৩, ১২৯)। এটা সহজেই বোধগম্য যে সমাজে যোগ্য কোন নারী যাতে
বিবাহহীন না থাকে এটাই এক জন পুরুষকে চারটি পর্যন্ত স্ত্রী রাখার অনুমতি দেয়ার
মূল লক্ষ্য।
উল্লেখ্য বিগত সব কালের মত আমাদের এই যুগেও বিশ্বব্যাপী
প্রতিদিনের সংঘর্ষ-সংঘাত, যুদ্ধ-বিগ্রহ, দুর্ঘটনা-দুর্বিপাকে নারীর চাইতে পুরুষ মারা যাচ্ছে অধিক
হারে। মানব প্রজনন বিজ্ঞানও বলে পুরুষের চাইতে নারী ভ্রূণের জন্মহার, স্থায়িত্ব
সবই বেশী। এমনকি মানুষের লিঙ্গ নির্ধারক এক্স ও ওয়াই ক্রোমোজোমের বিবর্তন
বিজ্ঞানও বলে যে বিশ্বে এক সময় নারীর জন্মহার বেড়ে যাবে অনেক। বিষয়টার
গুরুত্ববহ উল্লেখ দেখা যায় রসুলুল্লাহ (সা:)-এর হাদিসেও। কেয়ামত পূর্ব বিশ্ব
পরিস্থিতির বর্ণনা দিতে গিয়ে আল্লাহর রসুল (সা:) বলেছেন, তখন
বিশ্বে নারীর সংখ্যা এত বেড়ে যাবে যে কোন কোন বাড়ীতে একজন পুরুষের তত্ত্বাবধানে
দেখা যাবে চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ জন পর্যন্ত নারীকে (বোখারী, মুসলিম)।
আপদকালীন ভবিষ্যতের স্পষ্ট ইঙ্গিতবহ এই হাদিস এবং আল্লাহ কর্তৃক এক বিয়ের উপর
গুরুত্ব আরোপ দ্বারা এটাই প্রমাণ হয় যে একজন যোগ্য পুরুষের চারটি পর্যন্ত বিয়ের
অনুমতিটা শুধুমাত্র সংকটকালীন পরিস্থিতির জন্য। কোন অবস্থাতেই যেনতেন প্রকারে
নিজের খায়েস পূরণের জন্য নয়।
ঐ ধরনের আপদকালীন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল মদিনায়
রসুলুল্লাহ (সা:)-এর সময়। তখন মাত্র দশ বছরের মধ্যে মুসলমানদেরকে লড়তে হয়েছিল
২৭টি যুদ্ধ। তাতে পুরুষেরা শহীদ হয়েছিলেন কাতারে কাতারে। তাদের পরিবার-পরিজনদের
সহায়তায় সমাজের সক্ষম পুরুষদের একের অধিক বিয়ে ছিল আবশ্যক। শুধু শহীদ হওয়ার
কারণেই নয় বরং যুদ্ধে জয়ী হওয়া বাবদও মুসলমানদের হস্তগত হচ্ছিল পরাজিত পক্ষের
নারী ও শিশুরা। এ ধরনের যুদ্ধলব্ধ নারী ও শিশুরা সাধারণত: হয়ে থাকে বিজয়ী
বাহিনীর গণভোগের শিকার। কিন্তু মানব সভ্যতার ইতিহাসে মুসলিম বাহিনী ছিল এক্ষেত্রে
একমাত্র ব্যতিক্রম। শত্রু পক্ষের অসহায় পরিবারগুলোকে সে সময় জুড়ে দেয়া হতো
বিভিন্ন মুসলিম পরিবারে সাথে যাতে নিশ্চিত হতো তাদের নিরাপদ জীবন এবং অবারিত হতো
নতুন আলোয় তাদের পথ চলা। এমনকি রসুলুল্লাহ (সা:) নিজেও বিয়ে করে যোগ্য সম্মান
প্রদান পূর্বক দায়িত্ব নিয়েছিলেন নিহত শত্রু দলপতিদের স্ত্রী জাওয়ারিয়া বিনতে
হারিছ বিন আবি জারার ও সাফিয়া বিনতে হাইয়ে বিন আখতাব-এর (সহি হাদিস গ্রন্থসমূহ
এবং উইকিপিডিয়া)।
সন্তানের পরিচয় নির্ধারণের প্রয়োজনে নারীদের একত্রে বহু
স্বামী গ্রহণ নিষিদ্ধ
ইদানীং মেয়ে ভ্রূণ মেরে ফেলার ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ
ভাবে ধারনা করা হচ্ছে যে অদূর ভবিষ্যতে ছেলেরাই হয়তো মেয়ে পাবে না বিয়ে করার
জন্য। সেক্ষেত্রে কি একজন নারী একাধিক পুরুষকে বিয়ে করতে পারবে? উল্লেখ্য
বর্তমান এই বিশ্বে এমন জনগোষ্ঠী মোটেই বিরল নয় যেখানে নারীর বহুবিবাহ এখনও
আইনসিদ্ধ। কিন্তু ইসলামী আইনে অতীতের মত এখন যেমন, ভবিষ্যতেও তেমন, নারী
কর্তৃক এক সংগে একাধিক পুরুষকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করা সম্ভব নয়। আল্লাহ পাকের
প্রতিটি আইনের মত মানুষের বিবাহ আইনেও লক্ষ্য রাখা হয়েছে দৃশ্যমান এবং অদৃশ্য
অগণিত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নারীর তুলনায় পুরুষের সংখ্যা কমে যাওয়ার ক্ষেত্রে
করণীয় যেমন এখানে আলোচিত হয়েছে তেমনি সেখানে অতীব গুরুত্বের সাথে লক্ষ্য রাখা
হয়েছে মানুষের আত্ম পরিচয়ের (self identity) দিক। এই বিশ্বে জন্ম নেয়া প্রতিটি মানব
শিশুর নিজস্ব পরিচয় নিশ্চিত করতে বিশেষ সতর্কতা লক্ষ্য করা যার ইসলামের বিবাহ
আইনে। শুধু বাবা অথবা মা নয় বরং উভয়ের পরিচয়ই যে কোন সন্তানের প্রকৃত পরিচয়।
এই সত্যটা অতি কার্যকর ভাবে নিশ্চিত করা হয়েছে ইসলামে। সেজন্যেই এখানে তালাকের পর
স্ত্রীদের জন্যে নির্ধারিত রাখা হয়েছে নির্দিষ্ট ‘ইদ্দতকালীন’ সময় যাতে সম্ভাব্য
গর্ভজাত সন্তানের পিতৃ পরিচয় নিয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ না থাকে (২:২২৮)।
বিষয়টা পরিষ্কার ভাবে বুঝতে একটা বাস্তব উদাহরণ বিবেচনা
করা যেতে পারে। একজন সামর্থ্যবান কৃষকের পক্ষে একাধিক জমি চাষাবাদ করা সম্ভব।
কিন্তু নিজের শান্তি ও স্বস্তিময় জীবনাচার এবং সব জমির সব ফসলের প্রতি সমান
যত্নের স্বার্থে সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও পরিমিত জমিতেই পরিকল্পনা করে বছরব্যাপী
চাষাবাদের আয়োজন করে থাকে বিশ্বের কৃষক সমাজ। একটা মাত্র জমিতে একাধিক কৃষক মিলে
বিভিন্ন ধরণের বীজ কখনই বপন করে না। যদি সেটা করা হয় তাহলে সব ফসলই যেমন বাতিল
হতে বাধ্য তেমনি একই নারীতে একই সাথে একাধিক পুরুষের বীজ থেকেও উৎপন্ন হতে বাধ্য
বরবাদ প্রজন্ম। আজকের দুনিয়ার অগণিত আত্মপরিচয়হীন বখে যাওয়া তারুণ্যের কথা একটু
চিন্তা করলে খুব সহজেই বোঝা যায় ইসলামের এই অতি সতর্ক বিবাহ নীতির সুদূরপ্রসারী
লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।
জমি চাষ এবং ফসল উৎপাদনের এই যে ধারা ও পদ্ধতি, যেখানে
কর্ষিত মাটিতে বপন করতে হয় বীজ, তা এতটাই সার্বজনীন যে এই বিশ্বজগতের প্রতিটি জীবনকেই তা
মেনে চলতে হয়, চাই সেটা তার ভাল লাগুক বা না-ই লাগুক। তাই বিশ্ব জুড়ে আজ
এই যে ছয়-সাত শত কোটি আদম সন্তানের ব্যাপক বিস্তার তাকে ব্যাখ্যা করতেও চাষাবাদের
এই উপমার চাইতে যথার্থ কোন উপমা আর হতে পারে না। আর ঠিক সেই কাজটাই করা হয়েছে পবিত্র
আল-কোরআনে যেখানে নারীদেরকে তুলনা করা হয়েছে ফসলী জমির সাথে যাতে চাষাবাদের মত
একই পদ্ধতিতে বপন করতে হয় মানব বীজ (২:২২৩)। অতঃপর তা অন্যসব প্রাণের মতই ধীরে
ধীরে সৃষ্টির নির্ধারিত ও সুনির্দিষ্ট স্তরসমূহ একে একে পার করে তবেই হয়ে ওঠে
পূর্ণাঙ্গ এক সৃষ্টি, একেকটা মানব শিশু।
এহেন সহজ, সরল ও অবধারিত সত্য বর্ণনাও আজকের নারীবাদীদের কাছে
অপমানজনক হিসেবে বিবেচিত। অথচ ‘জমি চাষাবাদ’-এর সুপ্রতিষ্ঠিত এই পদ্ধতি ছাড়া
তাদের নিজেদের জন্মই যে হয়ে পড়ে অসম্ভব সেই চরম সত্যটা কেন যে এদের একবারে
জন্যেও মনে পড়ে না তা বোঝা দুষ্কর। আল্লাহ পাক স্বয়ং মানুষকে উপর্যুপরি পরামর্শ
দিয়েছেন তর্ক করার আগে নিজের জন্মের বিষয়ে চিন্তা করতে (৩৬:৭৭~৭৮)।
বস্তুত: এই একটা বিষয়ে চিন্তার দ্বারাই মানুষ পেতে পারে তার মনের অসংখ্য প্রশ্ন ও
অনুসন্ধিৎসার
উত্তর। এ প্রসঙ্গে আমাদের আরও মনে রাখা দরকার যে, সব ধরণের চাবি দিয়ে যেসব
তালা খোলা যায় সেগুলোকে কেউ তালা বলে না। সেসব কেউ কখনও তালা হিসেবে ব্যবহারও করে
না। তাই সন্তান ধারণ ও জন্ম দানের ক্ষেত্রে সব ধরনের ভাবাবেগ বর্জিত বাস্তবমুখী
অতিমাত্রিক সতর্কতাই নিজে ভাল থাকার এবং মানুষের আগামী প্রজন্মকে ভাল রাখার
একমাত্র উপায়।
তালাকের অপব্যবহার আল্লাহর প্রতি অকৃতজ্ঞতা স্বরূপ
ইসলামের আদর্শ পথে বহাল থাকতে হলে আল্লাহ ও তাঁর রসুল
(সা:)-কে পরিপূর্ণ ভাবে মেনে চলাই একমাত্র উপায়। কথাটা পবিত্র আল-কোরআনে বলা
হয়েছে বারবার। সেই আল্লাহ পাকের কাছে ‘সবচেয়ে অপ্রিয় কিন্তু অনুমোদিত’ কাজ হল
তালাকের মাধ্যমে একটা সংসার ভেঙ্গে দেয়া। কাজটা আল্লাহর কাছে অপ্রিয় তাই
রসুলুল্লাহ (সা:) নিজের জীবনে কখনই তা ব্যবহার করেন নি। তিনি কখনই তাঁর কোন
স্ত্রীকে তালাক দেন নি। যেহেতু তাঁর প্রিয় হাবিব (সা:) কখনও তালাক দেননি তাই
আল্লাহ তা’য়ালা চাইলেই উম্মতের জন্য এই কাজটা হারাম ঘোষণা করতে পারতেন। আর যদি
তাই করা হতো তা হলে সমাজের অবস্থা যে কি হতো তা সহজেই অনুমেয়। বস্তুতপক্ষে
মানুষের জটিল এই সমাজবদ্ধ জীবনে বিবিধ কারণে ও প্রয়োজনে বিয়ে করার মত বিয়ের
বাঁধন থেকে মুক্ত হওয়ারও দরকার হবে বিধায় কোরআন ও হাদিসে খুব সহজ ভাবে বাতলে দেয়া হয়েছে বিবাহ বিচ্ছেদের বিবিধ পদ্ধতি। এটা যে কোন বিচারে মানব জাতির জন্যে আল্লাহ পকের খুব বড়সড় একটা অনুগ্রহ বৈ কিছু নয়।
কিন্তু মানুষ খুব কমই মনে রাখে তাদের প্রতি আল্লাহ ও তাঁর
রসূল (সা:)-এর অপার স্নেহ, ভালবাসা আর অনুগ্রহের কথা। তাই নিজের সীমাহীন অজ্ঞতার কারণে
সে অহরহ অপব্যবহার করে থাকে আল্লাহর দেয়া নেয়ামত ও অনুগ্রহ সমূহ।
দায়িত্বজ্ঞানহীন ভাবে যুক্তিযুক্ত প্রকৃত কোন কারণ ছাড়াই যখন তখন, অযথা
এবং যেনতেন কারণে ‘তালাক’-এর ক্ষমতা ব্যবহার করে একটা ঘর ভেঙ্গে ফেলা তেমনই একটা
নিদারুণ অকৃতজ্ঞতা। এটা খুব বেশী সত্য ‘তিন তালাকের’ ক্ষেত্রে। যেহেতু ‘তিন
তালাকের’ তাৎক্ষনিক বিবাহ বিচ্ছেদ ক্ষমতাটা শুধুমাত্র স্বামীদের হাতে দেয়া হয়েছে
তাই অন্য যে কোন তালাকের চাইতে এই ‘তালাকের’ অপব্যবহারই হয়ে থাকে সবচেয়ে বেশী।
অথচ আল্লাহ পাক প্রবর্তিত মানুষের বিয়ে এবং বিচ্ছেদের আইনগুলো একটু গভীর ভাবে
পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে ‘তিন তালাকে’র যে কোন ধরণের অপপ্রয়োগ আসলে আল্লাহ
প্রদত্ত ক্ষমতার চরম অপব্যবহারের শামিল। আর তাই সেটা আল্লাহর সাথে এক প্রকারের বেঈমানি
এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূল (সা:)-এর সাথে এক ধরণের বেয়াদবিও বটে।
উল্লেখ্য, যে কোন বিবেচনাতেই নারী-পুরুষের বিয়ে কোন ছেলেখেলার বিষয়
নয়। পবিত্র এই বন্ধনে শুধুমাত্র দুটি সত্ত্বাই জড়িত হয় না, সেখানে
প্রতিষ্ঠিত হয় অনেকগুলো পরিবারের মাঝে বন্ধন। ফলে বৃদ্ধি পায় সুস্থ সামাজিক
পরিসর। তাই জগত ও জীবনের যাবতীয় অভাব-অনটন, টানাপোড়ন, খুনসুটি উপেক্ষা করে আমৃত্যু টেকসই হবে এই সম্পর্ক সেটাই
কাম্য ও প্রার্থিত। আর বস্তুত: সেজন্যেই ‘তিন তালাকের’ তাৎক্ষনিক
বিচ্ছেদ ক্ষমতাটা শুধুমাত্র স্বামীদের হাতে দিয়ে আল্লাহ পাক এর অপব্যবহারের
সম্ভাবনা প্রথমেই কমিয়ে দিয়েছেন পঞ্চাশ ভাগ (২:২২৯, এই
আয়াতের ব্যাখ্যা এবং সহি বোখারী শরীফের এ সংক্রান্ত হাদিস সমূহ দ্রষ্টব্য)।
শুধুমাত্র পুরুষদেরকে দেয়া এই ক্ষমতাটা এই জগতকে সুষ্ঠু ভাবে পরিচালনার প্রয়োজনে
একের দ্বারা অন্যকে নিয়ন্ত্রণে রাখার আল্লাহ পাক অনুসৃত সার্বজনীন কর্মপন্থারই
অংশ বিশেষ (২:২৫১)।
আবার যেহেতু সংসারে স্ত্রীর উপরে স্বামী দায়িত্বশীল
(২:২২৮)। তাই তালাকের মত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বামীরা চরম ধৈর্য ও
দায়িত্ববোধের পরিচয় দেবে সেটা স্বাভাবিক ভাবেই কাম্য। আর তাই ‘তিন তালাকের’
ক্ষমতা শুধুমাত্র স্বামীদের হাতে দেয়াটা যে কোন সৃষ্টিকে চূড়ান্ত ক্ষণ পর্যন্ত
সময় দেয়া বিষয়ে আল্লাহ পাকের নির্ধারিত সুনির্দিষ্ট নীতিমালার সাথেও অতি
সংগতিপূর্ণ (৬:৬৭; ২৯:৫৩)।
এই ক্ষমতা যদি সমান ভাবে স্বামী-স্ত্রী দুই পক্ষেরই থাকতো
তাহলে ঘর ভাঙ্গা-গড়া ছাড়া মানুষের পক্ষে বোধহয় অন্য আর কিছুই করা সম্ভব হতো না।
যা এখন হচ্ছে পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে। অতিমাত্রায় শিক্ষিত ও পরিশীলিত জাতি হওয়ার
পরও এই সব দেশে আস্ত একটা ঘর খুঁজে পাওয়া রীতিমত দুরূহ কাজ। এসব দেশে এখনও যে সব
সংসার টিকে আছে সেগুলোর দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে সেসব টিকে আছে মূলত: সহায়, সম্পদ
আর অর্থকড়ির হাতিয়ে নেয়ার সবচেয়ে লাভজনক সময় সুযোগের অন্বেষণে। সেখানে
সাংসারিক সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের অপার্থিব বোধ, অনুভূতি ও বন্ধন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অনুপস্থিত। আর এই কারণেই
এসব দেশের ছেলে-মেয়েরা লিখিত বিয়ের চাইতে দলিল বিহীন গার্লফ্রেণ্ড-বয়ফ্রেণ্ড
কালচারেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে বেশী।
আল্লাহর আইন দ্বারা কঠিন ভাবে নিয়ন্ত্রিত হওয়ার পরও
তালাকের এই ক্ষমতা যে কোন সমাজে জন্য হতে পারে অস্বস্তি ও অস্থিরতার উপসর্গ। এই
ক্ষমতার অহেতুক ভাবাবেগ সর্বস্ব ব্যবহার সৃষ্টি করতে পারে অযথা সামাজিক বিশৃঙ্খলা।
কারণ একটা তালাকের পরিণতি কোন ব্যক্তি একা ভোগ করে না। এর সাথে জড়িত থাকে অন্তত
আরও একটা জীবন। আরও একটা পরিবার। কখনও কখনও কয়েকটা পরিবার। এটা আবার অতিমাত্রায়
এবং অতি নিষ্ঠুর ভাবে সত্য ‘তিন তালাকে’র তাৎক্ষণিক বিবাহ বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে। তাই
বস্তুতপক্ষে কারো মধ্যে আল্লাহ পাকের প্রতি অকৃতজ্ঞতা বোধ প্রবল হলেই শুধুমাত্র এই
ক্ষমতার অপব্যবহার করা সম্ভব।
এই ধরণের দায়িত্বজ্ঞানহীন অকৃতজ্ঞতার কাজ থেকে মানুষকে
যতদূর সম্ভব দূরে থাকতে বাধ্য করার অতি বাস্তবসম্মত উপায় হল ‘হিল্লা বিয়ের’
ব্যতিক্রমধর্মী টনিক। এটা যেমন অধৈর্য হয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করার শাস্তি তেমনি
অসুখ যাতে আদতেই না হতে পারে তারও অসুখ-পূর্ব যথার্থ প্রতিরোধ ব্যবস্থা। প্রকৃত
প্রস্তাবে ধৈর্য, সহ্য ও ক্ষমার নির্দেশিত পথে সংসার টিকিয়ে রাখার আপ্রাণ
চেষ্টা-তদবির না করেই যারা কাণ্ডজ্ঞানহীন ভাবে প্রয়োগ করবে আল্লাহ পাকের অপ্রিয়
তালাকের আইন তাদের পুনর্মিলনের পথে ‘হিল্লা বিয়ে’ হল কুইনাইন স্বরূপ। এসব
অধৈর্য-অকৃতজ্ঞ দম্পতির দুরবস্থা থেকে শিক্ষা নিয়ে সমাজের অন্য দম্পতিরা সংসার
জীবনে ধৈর্যশীল হবে এবং ব্যক্তিগত ছোটখাটো স্বার্থগুলোকে উপেক্ষা করে পবিত্র
বৈবাহিক সম্পর্ক টিকিয়ে রাখাতে সদা সচেষ্ট থাকবে এটাই বোধকরি সুকঠিন এই ‘হিল্লা
বিয়ে’ প্রথা প্রবর্তনের পেছনে আল্লাহ পাকের প্রধান উদ্দেশ্য।
নির্যাতিত নারীর মুক্তি উপায় ও সংসারে ধৈর্য হারানোর
শাস্তি হিল্লা বিয়ে
ঘর-সংসার বেঁধে সমাজে বসবাস করার পরও নিভৃত গৃহ কোণে কূল
বধূ আসলে কেমন আছে তা বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই রয়ে যায় অজ্ঞাত। স্বামী যদি হয়
নিতান্তই অর্বাচীন। স্বামী হিসেবে নিজের দায়-দায়িত্ব সম্বন্ধে তার যদি কোন বোধই
না থাকে। স্ত্রীকে যদি অহর্নিশি থাকতে হয় সংসার ভাঙ্গার হুমকির মুখে। আর সেসব
তথ্য যদি থেকে যায় অগোচরে তা হলে কি হবে সেই গৃহবধূর মুক্তির উপায়? মূলত:
এহেন স্বামীদের দ্বারাই ঘটে থাকে ‘তিন তালাকের’ যত কুকীর্তি। আর সেটাই হল ঐ
নির্যাতিতার মুক্তি লাভের মোক্ষম উপায় ও মাহেন্দ্রক্ষণ। অর্থাৎ দায়িত্বজ্ঞানহীন
স্বামীর স্বেচ্ছাচারিতা এবং জুলুমের কবল থেকে নির্যাতিতা স্ত্রীকে অত্যন্ত কার্যকর
ভাবে মুক্ত করতে পারে ‘হিল্লা বিয়ের’ এই অভাবনীয় আইন (২:২৩০)। এটা ‘তিন তালাকের’
ক্ষেত্রে বেশী দৃশ্যমান হলেও একই রকম সত্য অন্যান্য তালাকের ক্ষেত্রেও।
এখানে হঠাৎ এবং অযথা তালাকপ্রাপ্ত নারীকে পূর্ণ অধিকার ও
স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে পূর্বতন স্বামীর ঘরে আর ফিরে না যাওয়ার। সে তার সুবিধা মত
বিরতিতে ইচ্ছা মত বিয়ে করে নতুন করে ঘর বাঁধতে পারবে যে কোন সময়। এটা তার
স্বাধীনতা। তবে যদি একান্তই আগের ঘরে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তবে তাকে ফেরত
যেতে হবে ‘নতুন স্বামী’র হাত ঘুরে। এখানে ‘অন্য পুরুষ’কে বিয়ের বিধান বস্তুত:
নারীর সামনে আগের ঘরে ফেরার পথে এক রকম দুর্লঙ্ঘ বাঁধা স্বরূপ। তবে বিস্ময়ের
ব্যাপার হচ্ছে নিজেদের ভাঙ্গা ঘর জোড়া লাগানোর পথে স্বামী-স্ত্রীর সামনে ‘হিল্লা
বিয়ে’র পর্বতসম প্রতিবন্ধক থাকলেও নতুন বিয়ে করে নতুন ঘর বাঁধতে গেলে এদেরকে
শুধুমাত্র ‘বিধবা বা পত্নীহীন ব্যক্তিদেরকেই বিয়ে করতে হবে’ এমন কোন শর্ত কিন্তু
নেই। অর্থাৎ ঘর ভাঙ্গা স্বামী-স্ত্রীর জন্যে নতুন করে সংসার গড়তে চির কুমারী বা
চির কুমার বিয়েতেও কোন বাঁধা নেই। আর এতে এটাই প্রতীয়মান হয় যে অন্যায় ভাবে
তালাক পেয়ে মুক্তি পাওয়া নারী আবার ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন স্বামীর’ ঘরে ফিরে যাক তথা
একবার ভেঙ্গে যাওয়া ঘর আবার জোড়া লাগুক এটা আল্লাহ পাকের ইচ্ছা নয়।
উল্লেখ্য তালাকের মাধ্যমে ভেঙ্গে যাওয়া ঘর যদি
স্বামী-স্ত্রীর সম্মতিতে আবার জোড়া লাগানোই সম্ভব হয় তাহলে বুঝতে হবে যে সমস্যা
ছিল সমাধান যোগ্য আর তাই ঘর ভাঙ্গার সিদ্ধান্তটা ছিল অপরিণত এবং ভাবাবেগ সর্বস্ব।
উপায় ছিল ধৈর্যের সাথে আলাপ-আলোচনার মধ্যমে অথবা কিছু দিন আলাদা থেকে পরিস্থিতি
মোকাবেলা করা এবং সমস্যার সম্মানজনক সমাধান করা। সে পথে না গিয়ে আবেগ তাড়িত ভাবে
দ্রুততার সাথে আল্লাহ পাকের ‘অপ্রিয়’ তালাকের সিদ্ধান্ত নেয়ার দায় তখন তাই সমান
ভাবে বহন করতে হবে স্বামী-স্ত্রী দু’জনকেই। তাই স্ত্রীকে আগের ঘরে ফিরতে হবে ‘অন্য
স্বামী’র হাত ঘুরে। এটা সংসার পালনে স্বামী-স্ত্রীর অপরিপক্বতা ও দায়িত্বহীনতার
তাৎক্ষনিক পার্থিব শাস্তি স্বরূপ। ভোগান্তিটা পৃথিবীতেই হয়ে যাওয়ার কারণে আশা
করা যায় যে স্বামী-স্ত্রী কেউই হয়তো পরকালের জীবনে এই ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন সামাজিক
শৃঙ্খলা পরিপন্থী কর্মকাণ্ডের’ জন্যে আর কোন জিজ্ঞাসাবাদের সম্মুখীন হবে না।
সংসারে যেহেতু স্বামীর অধিকার ও আধিপত্য অধিক তাই যে কোন
দাম্পত্য সমস্যায় স্বামীকেই হতে হবে ধৈর্য, সহ্য ও সম্প্রীতি রক্ষায় অগ্রণী। যে পুরুষ তালাকের ক্ষমতা
ব্যবহারে দায়িত্বশীল নয় সে মূলত: নারীকে সম্মান দিতে এবং সংসারে নারীর গুরুত্ব
বুঝতে অক্ষম। এমন বিবেকহীন পুরুষের অধিকার নাই কোন স্ত্রী গ্রহণ করার। তাই নারীর
স্বভাবগত চিত্ত চাঞ্চল্য ও অস্থিরতার সুযোগে তাকে হঠাৎ ত্যাগ করে আবার নিজের ইচ্ছা
মত যখন-তখন ফিরিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে আল্লাহ পাক তুলেছেন ‘অন্য স্বামীর হাত ঘুরে’
যাওয়ার এই দেয়াল যাতে এমন খামখেয়ালী পূর্ণ চেষ্টা ও বাসনা পূরণ করা যেন করো
জন্যেই কোন ভাবেই সহজ সাধ্য না হয়। এমনকি অন্য পুরুষের সাথে বিয়ের পরও নারীর
হাতে সময় থাকে আগের ঘরে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার। ইচ্ছা করলেই সে
নতুন স্বামীর কাছেও থেকে যেতে পারে। এটা পুরোপুরি ঐ নির্যাতিতার ইচ্ছা ও
স্বাধীনতা।
এখানে নির্যাতিত নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করার কোন সুযোগ
কারোই নেই। এমনকি তাকে কোন বৃদ্ধ বা অক্ষম পুরুষের সাথে ফন্দি করে বিয়ে দিয়ে কোন
রকমে আবার ফিরিয়ে নেয়ারও কোন উপায় নেই কারণ কনের মত নেই এমন কোন পুরুষের সাথে
তাকে বিয়ে দেয়া সরাসরি ইসলামী পরিপন্থী। আল্লাহ পাক খুব পরিষ্কার ভাবে বর ও কনের
পরস্পরের পছন্দের ভিত্তিতে বিয়ের পক্ষে মতামত দিয়েছেন (৪:৩, ১৯)।
এমনকি কনের অমতের জবরদস্তির বিয়ে রসুলুল্লাহ (সা:) সরাসরি বাতিলও করেছেন বলে
স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে সহি হাদিস সমূহে। তাই কেউ যদি এমন ফন্দি-ফিকিরের চেষ্টা করে
তাহলে দেশের আইন ও প্রশাসনকে অবশ্যই তৎপর হতে হবে এবং নিশ্চিত করতে হবে ঐ নারীর
সিদ্ধান্ত নেয়ার স্বাধীনতাকে। কোন গ্রাম্য সালিস বা মহল্লার কোন সর্দার নয় বরং
তালাকের মত এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আইনের যে কোন অপপ্রয়োগ নিরসনে
সাক্ষী-প্রমাণের ভিত্তিতে চূড়ান্ত ফয়সালা দিতে পারে শুধুমাত্র যথাযথ কর্তৃপক্ষ
বা আইনের আদালত। দেশের আইন যেমন নিজের হাতে তুলে নেয়া অন্যায় তেমনি ভাবে আল্লাহর আইনও
নিজের হাতে তুলে নিয়ে নিজের মন মত প্রয়োগ করার কোন সুযোগ কারোই নেই। নারীর
অসহায়ত্ব বা সমাজের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে এই বিষয়ে কোন কারসাজি করতে গেলে
এক্ষেত্রে জড়িত প্রত্যেককে সুনিশ্চিত ভাবেই পরতে হবে আল্লাহ পাকের কোপানলে তাঁর
সুমহান বিধান নিয়ে ছেলেখেলা এবং তা বিকৃত ভাবে প্রয়োগ করার জন্য।
‘তিন তালাকে’র ক্ষমতাপ্রাপ্ত পুরুষ জাতিকে ধৈর্যের সাথে
সংসার জীবনে সুস্থির রাখতে এবং নিভৃত গৃহ কোণের অব্যক্ত নির্যাতন ও অত্যাচার থেকে
নারীকে এক পলকে মুক্ত করতে ‘হিল্লা বিয়ে’র মত এমন সুসমন্বিত ও সুনিপুণ বহুমাত্রিক আইন শুধুমাত্র সর্বজ্ঞ মহান আল্লাহ পাকের পক্ষেই প্রণয়ন করা সম্ভব।
লস এঞ্জেলস, ইউএসএ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন