ইসলামি শরীয়তে ব্যবহৃত ওজন পদ্ধতি ও বর্তমান তার বাজার দর সহ যাকাতের নিসাব এবং জুরুরী গাণিতিক হিসেব !!
যাকাতের নিসাব ও কত হারে জাকাত দিতে হয়?
আমাদের জবাব, প্রথমে মনে রাখতে হবে যে, ”পাঁচ উকিয়ার কম পরিমাণ সম্পদের যাকাত নেই। পাঁচটি উটের কমের উপর যাকাত নেই। পাঁচ ওয়াসাক এর কম উৎপন্ন দ্রব্যের যাকাত নেই।” (বুখারীর হাদিস)
জ্ঞাতব্য :
বর্তমানে অনেকে প্রাচীনকালের মাপযন্ত্রের পরিভাষা ও ওজন সম্পর্কে পুরোপুরিভাবে অবিজ্ঞ না হওয়ায় শরীয়তের নানা মাসয়ালা-মাসায়িল এবং ওজন সংশ্লিষ্ট বেশ কতেক হাদিসের তাৎপর্য বুঝতে পারেননা।
তাই সেদিককার বিবেচনায় অধমের এ ক্ষুদ্র প্রয়াস।
Π আলোচ্য হাদিসে কয়েকটি শব্দ-বিশ্লেষণ নিম্নরূপ –
১ উকিয়া = (১১৯ গ্রাম রূপা) ৪০ দিরহাম অতএব ৫ উকিয়া = ২০০ দিরহাম অর্থাৎ ৫৯৫ গ্রাম রূপা।
১ ওয়াসাক = ৬০ ছা। রাসুল (সা)’র ছা’র পরিমাণ ছিল ১ ছা = ২ কেজি ৪০ গ্রাম পাকা পুষ্ট গম।
আরবি অভিধানে বর্তমানে প্রচলিত হিসাব অনুযায়ী ১৩০ কেজি ও ৩২০ গ্রাম ফসল।
(সূত্রঃ মু’জামু লুগাতুল ফুকাহা পৃষ্ঠা ৪৪৯-৪৫০।)
এ ছাড়া আরো অনেক পরিভাষা রয়েছে। যা সহজে এভাবে বুঝে নিন যে,
১ দিয়াত = ১০০০ দিনার।
১ দিনার = ১২ দিরহাম।
১ দিরহাম = সাড়ে ৪ আনা।
১ উকিয়া = ৪০ দিরহাম বা ১১৯ গ্রাম রূপা।
সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা = ১৪০ দিরহাম বা ৫৯৫গ্রাম রূপা।
সাড়ে সাত তোলা সোনা = ২০ দিনার বা ৮৫ গ্রাম সোনা।
১ তোলা = ১ভরি বা ১২ গ্রাম প্রায়।
১ দিনার (কুয়েত) = ২৭৪.৯০ টাকা।
১ দিরহাম (দুবাই) = ২১.১৭ টাকা।
১ রিয়াল (সৌদিআরব) = ২০.৭৪ টাকা।
১ ছা = ১০৪০ দিরহাম।
১ ছা = সাড়ে তিন সের।
১ ওয়াক্ত নামাযের কাফফারা = আধা ছা صاع ।
১ ফিতরা = আধা ছা গম।
১ যব = ৩ চাউল।
১ ক্বিরাত = ৫ যব।
১ দিরহাম = ৭০ যব।
১ মিসকাল = ১০০ যব।
১ রতল = ২০ আস্তার।
১ ছা = ১৪০ দিরহাম।
১ রতল = ১৩০ দিরহাম।
১ রতল = ৯১ মিসকাল।
১ রতল = আধা মুদ।
১ আস্তার = সাড়ে ছয় দিরহাম।
১ আস্তার = সাড়ে চার মিসকাল।
২ ওয়াসাক্ব = ৬০ ছা।
১ ছা = ৭২৮ মিসকাল।
১ ছা = ৪ মুদ।
১ ছা = ১৬০ আস্তার।
১ ছা = ৮ রতল।
Π এবার স্বর্ণ ও রূপা সহ নানা জিনিষ’র যাকাতের নিসাবঃ
স্বর্ণের নিসাব হচ্ছে ২০ মিসকাল (দিনার) তথা ৮৫ গ্রাম।
যদি কারো কাছে ৮৫ গ্রাম পরিমাণ বা অধিক স্বর্ণ ১ বছর (অর্থাৎ ১২ মাস) পর্যন্ত স্থিতিশীল অবস্থায় থাকে তাহলে বছর শেষ হলে যাকাত দিতে হবে।
রূপার নিসাব হচ্ছে ১৪০ মিসকাল (দিরহাম) তথা সৌদি আরবের রূপার দিরহাম অনুযায়ী ৫৬ রিয়াল অর্থাৎ ৫৯৫ গ্রাম।
অর্থাৎ কারো কাছে ৫৯৫ গ্রাম বা এর অধিক রূপা ১ বছর কাল সময় পূর্ণ করলে এর যাকাত আদায় করতে হবে।
Π জমানো টাকার ক্ষেত্রেঃ
জমানো টাকার পরিমাণ যদি বাজারে স্বর্ণ বা রূপার নেসাব এর বাজার মূল্যের পরিমাণ বা অধিক থাকে তাহলে তার যাকাত দিতে হবে!
এখানে আমাদের একটু বুঝতে হবে। যদি কারো কাছে স্বর্ণ অথবা রূপার নেসাব পরিমাণ বাজার মূল্য ”টাকা” হিসেবে পুর্ণ ১ বছর জমা থাকে তাহলে তার যাকাত দিতে হবে। এখানে নেসাব হিসেবে স্বর্ণকেও গ্রহণ করা যেতে পারে আবার রূপাকেও গ্রহণ করা যেতে পারে, এই সুযোগ দেয়া হয়েছে।
Π জমিনে উৎপন্ন ফসলের যাকাত বা উশড়ঃ
আল্লাহ্ বলেন, ”আর তোমরা ফসলের হক সমূহ আদায় কর যেদিন ফসল কর্তন কর সেদিনই। (সুরা আল আন’আম ১৪১)।
অর্থাৎ যে দিন ফসল জমি থেকে কেটে ঘরে তোলা হয় সে দিনই ফসলের যাকাত দিতে হয়, যাকে উশর বলা হয়। শরীয়তে তা আদায় করা ফরয।
Π গবাদি পশুর নিসাব পরিমাণঃ
এগুলোর মধ্যে সামিল হবে গরু, ছাগল, ভেড়া, উট ইত্যাদি গৃহপালিত পশু। এগুলোর ক্ষেত্রে শর্ত হল এই গবাদি পশুগুলো মাঠে চরা পশু হতে হবে এবং দুধ কিংবা আর্থিক লাভের জন্য পালন করা হতে হবে।
মাঠে চড়ার ক্ষেত্রে শর্ত হল সমস্ত বছর কিংবা বছরের অধিকাংশ সময় চরতে হবে। এদের নিসাব ও পুর্ণ এক বছর পুর্তি হলেই কেবল যাকাত দিতে হবে, নতুবা নয়।
Π গবাদি পশুর নিসাব:
উটের ক্ষেত্রেঃ সর্ব নিম্ন ৫টি আর গরুর ক্ষেত্রেঃ সর্ব নিম্ন ৩০ টি এবং ছাগল বা ভেড়া বা দুম্বার ক্ষেত্রেঃ সর্ব নিম্ন ৪০ টি।
অর্থাৎ এই পরিমাণ পশু ১ বছর সময় পর্যন্ত থাকলে এদের যাকাত দিতে হবে। কিন্তু ব্যবসার জন্য যদি তাদের পালন করা হয় তাহলে মাঠে চড়ানো হোক বা খোঁয়াড়ে রেখে পালন করা হোক, তার যাকাত দিতে হবে ”মূল্য” তথা অর্থ নির্ধারণ করে।
Π নেসাব পরিমাণ সম্পদের যাকাতের পরিমাণঃ
অর্থ, স্বর্ণ ও রূপার শতকরা আড়াই ভাগ যাকাত দিতে হবে । (বুখারী, মুসলিম)।
স্বর্ণঃ ২০ দিনার বা ৮৫ গ্রাম ওজনের তথা সাড়ে সাত তোলা সোনা হলে ৪০ ভাগের ১ ভাগ যাকাত দিতে হবে। অর্থাৎ শতকরা আড়াই ভাগ স্বর্ণ বা স্বর্ণ মূল্য যাকাত হিসেবে দিতে হবে। (বুখারী, মুসলিম)।
রূপাঃ ১৪০ দিরহাম বা ৫৯৫ গ্রাম অর্থাৎ সাড়ে ৫২ তোলা রূপা হলে তখন শতকরা আড়াই ভাগ রূপা অথবা রৌপ মূল্য যাকাত হিসেবে দিতে হবে। (বুখারী, মুসলিম)।
টাকাঃ বাজারে স্বর্ণ মূল্য অনুযায়ী কারো কাছে যদি ৮৫ গ্রাম স্বর্ণ এর বাজারমূল্য পরিমাণ অর্থ জমা থাকে তাহলে এর শতকরা আড়াই ভাগ যাকাত দিতে হবে। অথবা বাজারে রূপার মূল্য অনুযায়ী কারো কাছে যদি ৫৯৫ গ্রাম রূপার এর বাজারমূল্য পরিমাণ অর্থ জমা থাকে তাহলে এর শতকরা আড়াই ভাগ যাকাত দিতে হবে। এক্ষেত্রে নিসাব পরিমাণ হিসেবে ব্যক্তি ইচ্ছামত স্বর্ণ বা রূপা যে কোনটিকে গ্রহণ করতে পারে।
আজকের বর্তমান বাজার দর অনুযায়ী স্বর্ণকে নিসাব ধরলে, স্বর্ণের নুন্যতম মূল্য হিসেবে কারো কাছে কমপক্ষে প্রায় ১,১৭,০০০ টাকা ১ বছর পর্যন্ত সঞ্চয়ে থাকলে এর আড়াই শতাংশ জাকাত হিসেবে দিতে হবে। অর্থাৎ প্রতি ১,১৭,০০০ টাকায় যাকাত আসবে প্রায় ৪২৫০ টাকা।
অপরদিকে রুপাকে নিসাব ধরলে, রুপার নুন্যতম মূল্য হিসেবে কারো কাছে কমপক্ষে প্রায় ১৭,০০০ টাকা ১ বছর পর্যন্ত সঞ্চয়ে থাকলে এর আড়াই শতাংশ জাকাত হিসেবে দিতে হবে। অর্থাৎ প্রতি ১৭,০০০ টাকায় যাকাত আসবে প্রায় ৪২৫ টাকা। যেহেতু স্বর্ণের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গিয়েছে সেহেতু রুপাকে নেসাব ধরে যাকাত আদায় করাটাই উত্তম। এতে গরিব মানুষের অশেষ উপকার হয়। জাকাত দিলে সম্পদ বাহ্যিক দৃষ্টিতে কমে যাচ্ছে মনে হলেও মূলত বাড়ছে!
প্রশ্ন হল, বাড়ছে কিভাবে?
জবাব, তার এক অর্থে বাড়ছে মতলব, যাকাত আদায় করলে সম্পদে বরকত বাড়ে। বরকতহীন লক্ষ টাকা ১০,০০০ টাকারও সমান নয়।
অপরদিকে বরকতযুক্ত ১০,০০০ টাকা লক্ষ টাকার প্রয়োজন পূরণ করে দেয় ।
যদি কেউ রূপা কে নিসাব গ্রহণ করে তাহলে সেটা গরিবদের জন্য খুবই উত্তম হয়। তাই ওলামাগণ রূপাকে নিসাব গ্রহণে পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তবে কেউ চাইলে স্বর্ণকেও নিসাব হিসেবে গ্রহণ করতে পারে।
লেখক, নূরুন্নবী। তাকমীল : দারুলউলুম আল- হোসাইনিয়া ওলামা বাজার, ফেনী। হ্যালো : 01812561424
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন