কাদিয়ানীরা অমুসলিম কেন?
কোনো কোনো সাধারণ মানুষ মনে করে যে, কাদিয়ানীদের সাথে মুসলিম সমাজের বিরোধটা হানাফী-শাফেয়ী বা হানাফী-আহলে হাদীস অথবা কেয়ামী-বেকেয়া মীদের মতবিরোধের মত।
আসলে বিষয়টি তা নয়, বরং কাদিয়ানীদের সাথে মুসলিম সমাজের বিরোধ এমন একটি মৌলিক আকীদা নিয়ে, যার বিশ্বাস করা-না করার উপর মানুষের ঈমান থাকা-না থাকা নির্ভর করে।
কুরআনপাকের অনেক আয়াত ও অগণিত হাদীস দ্বারা প্রমাণিত মুসলিম সমাজের অন্যতম মৌলিক আকীদা হল, হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বশেষ নবী এবং তাঁর পরে কোনো নবী নেই।
মুসলমানদের এমন একটি অকাট্য আকীদার বিপরীতে অবস্থান নিয়ে মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী নিজেকে নবী বলে দাবি করে।
সুতরাং সে মুসলমানদের সর্বসম্মত আকীদা মুতাবিক কাফের তথা অমুসলিম। আর যে বা যারা তাকে নবী বলে বিশ্বাস করে, সে বা তারা ইসলামের সর্বজন স্বীকৃত আকীদা মুতাবিক মুসলমান থাকতে পারে না। তারা কাফের অর্থাৎ অমুসলিম।
যে ব্যক্তি ইসলামের অন্যতম মৌলিক আকীদায় বিশ্বাসী নয়; বরং তার বিপরীত অবস্থানে দাঁড়িয়ে নিজেকে ‘নবী’ বলে দাবি করে, আর যারা তার এ দাবিকে সমর্থন করে তারাও মুসলমান নামের পরিচয় বহন করতে পারবেনা।
তাদেরকে হয়ত নিজেদের অপরাধ স্বীকার করে এবং তওবা করে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সর্বশেষ নবী মেনে নিয়ে এবং ইসলামের অন্য সকল মৌলিক আকীদাকে মেনে নিয়ে মুসলমান হতে হবে, নতুবা মুসলমানের পরিচয় বাদ দিয়ে নিজেদের ভিন্ন ধর্মের নামে পরিচিত হতে হবে।
এ কথাটি আমাদের দেশের সাধারণ লোকজন থেকে শুরু করে শাসকগোষ্ঠী পর্যন্ত সর্বস্তরের মানুষ যত তাড়াতাড়ি বুঝে নিতে সক্ষম হবে, ততই তাদের দুনিয়ার জীবনে হেদায়াত ও পরকালে শান্তি ও মুক্তির পথ বেছে নিতে সহজ হবে।
এদেশীয় মুসলমান, ব্রাহ্ম, সনাতন, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের লোকেরা যেমন বাংলাদেশের নাগরিক, তেমনি কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের লোকেরাও এ দেশের নাগরিক। দেশের প্রচলিত আইন অনুসারে সকল ধর্মের অনুসারী লোকেরা যতটুকু নাগরিক অধিকার ও সুবিধা ভোগ করে, কাদিয়ানীরাও ততটুকু পাক, এতে কারও দ্বিমত থাকার কথা নয়। তবে সেটা হতে হবে তাদের নিজের স্বতন্ত্র ধর্মীয় পরিচয়ে, মুসলমান পরিচয়ে নয়।
তারা নিজেদের ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে ভিন্ন নামে সমাজে বেঁচে থাকুক, আর্থ-সামাজিক কার্যক্রমে তারা তাদের স্বতন্ত্র পরিচয় নিয়ে অংশগ্রহণ করুক, তাতেও মুসলমানদের আপত্তি নেই। তবে মুসলমানদের মৌলিক আকীদায় বিশ্বাসী না হয়ে, মুসলমান পরিচয় ধারণ করার অধিকার তাদের নেই।
সুতরাং কাদিয়ানীদের অমুসলিম ঘোষণার দাবি মুসলিম সম্প্রদায়ের আকীদা রক্ষার আন্দোলন তো বটে, ধর্মীয় অধিকারের বিষয়ও।
এখন দেখা যাক, কাদিয়ানীরা অমুসলিম রূপে ঘোষিত ও চিহ্নিত না হলে তাতে মুসলমানদের ধর্মীয় ও সামাজিক ক্ষেত্রে কি কি সমস্যার সৃষ্টি হয়। এ বিষয়টি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য যে, এমন একটি সম্প্রদায় যারা ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণরূপে অমুসলিম, তারা যদি সরকারীভাবে অমুসলিম ঘোষিত হয়ে পৃথক একটি ধর্মাবলম্বী দল হিসাবে চিহ্নিত না হয় তাতে মুসলমানদের ধর্মীয় ও সামাজিক ক্ষেত্রে বহুবিধ সমস্যা সৃষ্টি হয় এবং হতে থাকবে। যেমন :
১.
তাদের রচিত ও প্রকাশিত বইপত্রকে মুসলমানদের লেখা বই- পুস্তকের মত মনে করে পাঠ করে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হয় এবং ঈমান হারিয়ে বসে।
২.
তাদের উপাসনালয়কে মসজিদ মনে করে সেখানে গিয়ে নামায পড়ে। এতে মুসলমানদের কাছে ঈমানের পরে সর্বোচ্চ যে ইবাদত নামায, তা নষ্ট হয়।
৩.
কাদিয়ানী ধর্মমতের অনুসারী কোনো ব্যক্তি মুসলমানের ইমাম সেজে তাদের ঈমান-আমল নষ্ট করতে পারে।
৪.
তারা মুসলমান পরিচয়ে নিজেদের মতবাদ-মতাদর্শ প্রচার করলে তাতে সাধারণ মুসলমান তাদেরকে মুসলমানেরই একটি দল মনে করে তাদের মতবাদ গ্রহণ করে নিজেদের সবচেয়ে বড় সম্পদ ঈমান হারিয়ে ফেলে।
৫.
তারা মুসলমান নামে পরিচিত হওয়ার কারণে তাদের সাথে মুসলনামানের মত আচার-আচরণ ও চলাফেরা করে। অথচ তাদের সাথে মুসলমানের সম্পর্ক হওয়া উচিত এমনই, যেমন কোনো অমুসলিমের সাথে হয়ে থাকে।
৬.
অনেক সাধারণ মুসলমান তাদেরকে মুসলমান মনে করে নিজেদের বিবাহের উপযুক্তা মেয়েদের তাদের সঙ্গে বিবাহ দিয়ে অমুসলিমদের হাতে নিজেদের কন্যা তুলে দেয় এবং মুসলিম পাত্রের জন্য কাদিয়ানী ধর্মাবলম্বী লোকের মেয়েকে মুসলমান না করে বধু হিসেবে বরণ করে। ফলে এরূপ দম্পতি আজীবন ব্যভিচারের গুনাহে লিপ্ত থাকে।
৭.
কোনো সম্পদশালী মুসলমান কোনো কাদিয়ানী ধর্মাবলম্বী গরীবকে যাকাত দিলে তার ফরয যাকাত আদায় হবে না।
৮.
যে কোনো কাফের তথা অমুসলিমের জন্য হারাম শরীফে ঢোকা নিষেধ। অথচ কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের লোকেরা মুসলিম পরিচয় দিয়ে হজ্ব ও চাকরি- বাকরির নামে সৌদি আরবে গিয়ে হারাম শরীফে প্রবেশ করে তার পবিত্রতা নষ্ট করার সুযোগ পায়।
সুতরাং কাদিয়ানী সম্প্রদায়কে মুসলমান থেকে পৃথক একটি ধর্মের অনুসারী দল ঘোষণা করে ভিন্ন নামে চিহ্নিত না করা হলে এরূপ বহু সমস্যা সৃষ্টি হয়, হতে পারে এবং ভবিষ্যতে হতে থাকবে। এতে মুসলমান সমাজের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগার কারণে তারা যদি উত্তেজিত হয়ে উঠে তবে এতে দেশের আইন-শৃঙ্খলার অবনতি হতে পারে এবং মানুষের জানমালের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে, যা কারও কাম্য নয়।
কাজেই তাদেরকে অবিলম্বে পৃথক একটি ধর্মাবলম্বী দল ঘোষণা করে পৃথক নামে তাদেরকে একটি সংখ্যালঘু দল হিসাবে মর্যাদা দিলে এবং তাদের জন্য ইসলামী পরিভাষাসমূহ যেমন : নামায, রোযা, মসজিদ, হজ্ব ইত্যাদির ব্যবহার নিষিদ্ধ করলে তা দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার পক্ষে সহায়ক হবে বলে আমরা মনে করি। এটাই সচেতন মুসলিম সমাজের প্রাণের দাবি।
লেখক ও গবেষক, প্রিন্সিপাল নূরুন্নবী।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন