༺ بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ ༻
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওবারাকাতুহু
আল্লাহ তাআলা মানব জাতির হিদায়াতের জন্য মহাগ্রন্থ আল কুরআন নাযিল করেছেন এবং কুরআন থেকে উপদেশ গ্রহণ সকলের জন্য সহজ করে দিয়েছেন। ইরশাদ হচ্ছে: وَلَقَدْ يَسَّرْنَا الْقُرْآنَ لِلذِّكْرِ فَهَلْ مِنْ مُدَّكِرٍ “আমি কুরআন সহজ করে দিয়েছি; আছ কেউ উপদেশ গ্রহণকারী?” (সূরা কমার: ১৭) এই আয়াত থেকে বুঝা যাচ্ছে কুরআনে কারীম সহজ, যা সকলেই বুঝতে সক্ষম।
এর উত্তর হল, কুরআন সহজ হওয়ার অর্থ হচ্ছে, এর তিলাওয়াত ও বাহ্যিক অর্থ সহজ। কিন্তু এর আভ্যমত্মরীণ নিগুঢ় অর্থ সকলেই বুঝতে পারে না; বরং এক শ্রেণীর গভীর জ্ঞানীরাই কেবল বুঝতে পারে। তাফসীরে ইবনে কাসীরে এব্যাপারে স্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে।
قال السدى بسرنا تلاوته على الالسن ، وقال الضحاك عن إبن عباس: لولا أن الله يسره على لسان آميين ماإستطاع أحد من الخلق ان يتكلم بكلام الله عز وجل ، قلت من تيسره تعالى على الناس تلاوته ـ 4/336
সুদ্দী বলেন, আমি মুখে এর পাঠ সহজ করেছি। হযরত যাহ্হাক হযরত ইবনে আববাস রা. থেকে বর্ণনা করেন, যদি আল্লাহ তা’আলা মানুষের মুখে সহজ না করতেন, তাহলে কোন সৃষ্টজীব আল্লাহ কালাম উচ্চারণ করতে পারত না। আমি বললাম, আল্লাহ তা’আলা সহজ করণের অর্থ হল, তা তিলাওয়াত করা মানুষের উপর সহজ করা। ৪/৩৩৬
উদ্ধৃত সূরা ক্বামারে আল্লাহ তা‘আলা সকলের জন্য কুরআন বুঝা ও তা থেকে উপদেশ গ্রহণ করাকে সহজ বলেছেন কথাটির অর্থ হল কুরআনের উপদেশমূলক সহজবোধ্য অংশটুকু। আর যে অংশটুকু ইজতিহাদ ও ব্যাপক গবেষণার দাবিদার সে অংশের বিধান হল-
فَاسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ
‘তোমরা যদি না জান তাহলে এব্যাপারে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞেস করে জেনে নাও’। (সূরা নাহল-৪৩ সূরা আম্বিয়া-৭)
কুরআনের গভীর অর্থ বুঝা যদি সহজ হত, তাহলে কোন সাহাবীর তা বুঝতে ভুল হওয়ার কথা ছিল না। কারণ তারা ছিলেন আরবী এবং কুরআন তাদের মাতৃভাষায় অবতীর্ণ হয়েছে। অথচ বাসত্মবতা হল সাহাবায়ে কিরামেরও কখনো কখনো কুরআনের কিছু বিষয় বুঝার ক্ষেত্রে অসুবিধা হয়েছে।
হাকীমুল উম্মত হযরত মাও. আশরাফ আলী থানবী রহ. এ আয়াত প্রসঙ্গে বলেন “এ বিষয়ে সার কথা এই যে, কুরআন ও হাদীসের কিছু বিষয় জাহের তথা সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন। আর কিছু বিষয় খফি তথা প্রচ্ছন্ন ও অস্পষ্ট। কুরআন ও হাদীসকে সহজ বলা হয়েছে প্রথমোক্ত বিষয়ের প্রতি লক্ষ করে। ইজতিহাদ করতে হলে কুরআন ও হাদীসের প্রচ্ছন্ন ও অস্পষ্ট বিষয়গুলোর মর্ম উদঘাটন করতে হবে। এর এ কাজ সবার জন্য সম্ভব নয়”।
অর্থাৎ কুরআনের কিছু কিছু বিষয় এমন যা আরবী ভাষায় পূর্ণ জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও সাধারণের জন্য বুঝা মোটেও সহজ নয়। তিনি এর দুটি উজ্জ্বল দৃষ্টামত্ম মূলক উদাহরণ পেশ করেন-
১. হযরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রা. বর্ণনা করেন আমরা এক সফরে ছিলাম। তখন একসাথীর মাথায় একটি পাথর পড়ল এবং তাতে ক্ষত হয়ে গেল। এমতাবস্থায় তার গোসল ফরজ হয়। তিনি সাথীদের জিজ্ঞেস করলেন আমার কি গোসলের পরিবর্তে তায়াম্মুম করার সুযোগ আছে? তাঁরা বললেন, না। অপারগ হয়ে তিনি গোসল করেন এবং মাথার ক্ষতে পানি লাগার কারণে তিনি মারা যান। সফর থেকে ফেরার পর নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বিষয়টি জানানো হয়। তিনি রেগে বললেন ‘না জেনে কথা বলে তারা তাকে মেরে ফেলেছে। আল্লাহ তাদের নাশ করুন। তারা যেহেতু এ বিষয়ের বিধান জানে না তবে কেন জিজ্ঞেস করে জেনে নেয়নি ?! অজ্ঞতার সমাধান তো জিজ্ঞেস করার মধ্যেই। তার জন্য তো তায়াম্মুম করে নেয়াটাই যথেষ্ট ছিল। (সুনানে আবুদাউদ হা. ৩৩৬ সুনানে ইবনে মাযা হা. ৫৭২ মুসতাদরাকে হাকিম হা. ৫৮৭)
পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে “” ‘তোমরা অপবিত্র হলে গোসল করে পবিত্র হও’। মূলত সফরসঙ্গী সাহাবীগণ বুঝে ছিলেন যে, এ আয়াতটি সর্বাবস্থার জন্য। উজর থাক বা না থাক, গোসল করতেই হবে। আর কুরআনের অপর আয়াতটি যেখানে বলা হয়েছে “আর তোমরা যদি অসুস্থ হও ... তবে পাক মাটি দ্বারা তায়াম্মুম করে নাও”(সূরামায়েদা-৬) শুধু অজুর বিকল্প, গোসলের বিকল্প নয়। এই ভিত্তিতে ইজতিহাদ করে তাঁরা তাকে গোসল করার ফতুয়া দিয়েছিলেন। তাঁদের এ ফতুয়ার উপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ জন্য নিন্দা করেননি যে, ইজতিহাদ করা দোষণীয় কাজ। বরং রাসূলের এ নিন্দাবাদের কারণ হল তাঁরা ইজতিহাদের যোগ্যতা রাখতেন না। কাজেই যে কাজের প্রতিভা তাদের নেই সে কাজ করতে গেলেন কেন? এতে প্রমাণিত হয় যে মুজতাহিদ নয় তার ইজতিহাদ বৈধ নয়। বরং সে ইজতিহাদ করলেও তা গ্রহণ করা হবে না।
২. হযরত আদী ইবনে হাতিম রা. বর্ণনা করেন যখন এ আয়াত অবতির্ণ হল وَكُلُوا وَاشْرَبُوا حَتَّى يَتَبَيَّنَ لَكُمُ الْخَيْطُ الْأَبْيَضُ مِنَ الْخَيْطِ الْأَسْوَدِ ‘তোমরা পানাহার কর যতক্ষণ না কাল রেখা থেকে শুভ্র রেখা পরিস্কার দেখা যায়’ (সূরাবাকারা-১৮৭) তখন তিনি একটি সাদা সুতা ও একটি কাল সুতা তার বালিশের নিচে রেখে দেন। রাতে উঠে দেখেন সুতাদুটি একটি অপরটি থেকে পৃথক দেখা যায় না। অর্থাৎ সদা কালো রঙের কোন পার্থক্য ধরা পরে না। ভোর হলে নবীজীকে এসে ঘটনার বিবরণ শুনালেন। তিনি শুনে রসিকতা করে বলেনÑ তোমার বালিশ তো দেখছি তাহলে অনেক বড়! এর নিচে দিগন্তজোড়ে বিস্তৃত বিশাল আকাশ সংকুলান হয়ে যায়। আয়াতে সাদা কালো রেখা দ্বারা রাত দিনের কথা বুঝানো হয়েছে। দিনকে সাদা আর রাতকে কালো বলা হয়েছে। (সহী বুখারী হা. ৪৫০৯ সহী মুসলিম হা. ১০৯২) সহী বুখারীর অপর বর্ণনা (হা. ১৯১৭)
لكم الخيط الأبيض من الخيط الأسود ، قال أخذت عقالا أبيض وعقالا أسود فوضعتهما تحت وسادتى فنظرت فلم أتبين فذكرت ذلك لرسول الله صلى الله عليه وسلم فضحك فقال: إن وسادتك إذا لطويل عريض إنما هو الليل والنهار، وقال عثمان إنما هو سواد الليل وبياض النهار ـ روه ابو داؤد : ১/৩২১
হযরত আদী ইবনে হাতিম রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, যখন -حتى يتبين لكم الخيط الأبيض من الخيط الأسود – এ আয়াতটি অবতীর্ণ হল, তখন আমি একটি সাদা সূতা নিলাম এবং একটি কাল সূতা নিলাম। অতঃপর তা আমার বালিশের নিচে রাখলাম। কিন্তু তা দেখে পার্থক্য করতে পারলাম না। ফলে বিষয়টি রাসূল সা. এর নিকট বললে তিনি হেসে উঠলেন এবং বললেন, তাহলে তো তোমার বালিশটি অনেক লম্বা চওড়া। এটাতো কেবল রাতদিন। আবু দাউদ: ১/৩২১
দেখুন, কুরআনের সব অর্থ সকলের জন্য যদি বোধগম্য হতো, তা হলে এখানে সাহাবী কেন বুঝতে পারলেন না? এ থেকে জানা যায় এরূপ ঘটনা আরো অনেকের বেলায়ই ঘটেছিল।
দেখুন! এ সাহাবী আরবী ভাষাভাষী হওয়া সত্ত্বেও ইজতিহাদী প্রতিভা না থাকার কারণে কুরআনের এ আয়াতের সঠিক মর্ম বুঝতে অক্ষম হয়েছেন। আরও লক্ষ করুন! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর ইজতিহাদকে রসিকতার মাধ্যমে প্রত্যাখ্যান করেছেন।
উপরোক্ত দুটি ঘটনার সাথে যুক্ত সাহাবীরা সকলেই ছিলেন আরবীভাষী। তথাপি কুরআনের উপরোক্ত দুটি আয়াতের উদ্দিষ্ট মর্ম উদ্ধার করতে পারেননি।
কুরআনের উপদেশগুলো যেহেতু আল্লাহ তাআলা বিভিন্ন কওমের ঘটনা এবং উদাহরণের মাধ্যমে বর্ণনা করেছেন সেহেতু তা বুঝা সহজ। পক্ষান্তরে আহকাম বর্ণনার ক্ষেত্রে ঘটনা এবং উদাহরণের মাধ্যম না থাকায় তা বুঝা কষ্টসাধ্য। তাই কঠিন বিষয় বোধগম্য করতে সর্বপ্রথম আল্লাহ তাআলা স্বয়ং তাঁর রসূলকে কুরআনের ব্যাখ্যা শিক্ষা দিয়েছেন। ইরশাদ হচ্ছে: فَإِذَا قَرَأْنَاهُ فَاتَّبِعْ قُرْآنَه ثُمَّ إِنَّ عَلَيْنَا بَيَانَه “যখন আমি কুরআন পাঠ করি তখন আপনি তার অনুকরণ করুন। আর এর বিশদ বর্ণনা আমারই দায়িত্বে”। (সূরা কিয়ামাহ: ১৮-১৯)
আবার তাঁর প্রতি দায়িত্ব দিয়েছেন কুরআনের বাণী উম্মাতকে ব্যাখ্যা করে শুনাতে। ইরশাদ হচ্ছে: وَأَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الذِّكْرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَيْهِمْ “আমি আপনার প্রতি কুরআন অবতীর্ণ করেছি যেন মানুষের জন্যে যা অবতীর্ণ হয়েছে আপনি তাদেরকে তা বুঝিয়ে দেন।” (সূরা নাহল: ৪৪) এ নির্দেশটি বিশেষভাবে আহকামের সাথে সম্পর্কিত। আল্লাহ তাআলার এ নির্দেশ পালনে রসূলুল্লাহ স. ছিলেন সদা তৎপর। তিনি সাহাবায়ে কিরামকে অত্যন্ত সুন্দরভাবে কুরআন বুঝিয়েছেন এবং তাঁদের পক্ষ থেকে দায়িত্ব আদায়ের স্বীকৃতিও পেয়েছেন। (বুখারী: ৬৩২৮)
অতঃপর সাহাবায়ে কিরাম তাবিঈদেরকে কুরআন বুঝিয়েছেন, তাঁরা তাঁদের পরবর্তীদেরকে। আর এটাই কুরআন থেকে ব্যাখ্যা গ্রহণের সঠিক পদ্ধতি। এ নিয়মের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে সাহাবায়ে কিরাম কুরআনের ওই ব্যাখ্যাই তুলে ধরেছেন যা রসূলুল্লাহ স. থেকে শুনেছেন ও বুঝেছেন। যদিও বর্ণনার ক্ষেত্রে কখনও কখনও রসূলুল্লাহ স.-এর নাম উহ্য রেখেছেন।
এ ধারাবাহিকতায় তাবিঈন, তাবে তাবিঈন ও তাঁদের পরবর্তী মুফাসসিরগণ কুরআনের কোন ব্যাখ্যা তুলে ধরার পূর্বেই বর্ণনা করে থাকেন যে, “আমি আমার উসতাদ অমুকের নিকট থেকে এ ব্যাখ্যা শুনেছি; তিনি তাঁর উসতাদ থেকে এ ব্যাখ্যা শুনেছেন”। এ নিয়ম অগ্রাহ্য করে শুধু নিজের বুদ্ধি-বিবেক খাটিয়ে কুরআনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ বা কুরআন সম্পর্কে কোন মন্তব্য করার বিরুদ্ধে রসূলুল্লাহ স. কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেন:
حَدَّثَنَا سُفْيَانُ بْنُ وَكِيعٍ، حَدَّثَنَا سُوَيْدُ بْنُ عَمْرٍو الْكَلْبِيُّ، حَدَّثَنَا أَبُو عَوَانَةَ، عَنْ عَبْدِ الأَعْلَى، عَنْ سَعِيدِ بْنِ جُبَيْرٍ، عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ، عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ " اتَّقُوا الْحَدِيثَ عَنِّي إِلاَّ مَا عَلِمْتُمْ فَمَنْ كَذَبَ عَلَىَّ مُتَعَمِّدًا فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ وَمَنْ قَالَ فِي الْقُرْآنِ بِرَأْيِهِ فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ. قَالَ أَبُو عِيسَى هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ .( رَوَاه التِرْمِذِىُّ فِىْ بَابِ مَا جَاءَ فِي الَّذِي يُفَسِّرُ القُرْآنَ بِرَأْيِهِ)
হাদীস নং- ১ : হযরত ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ স. ইরশাদ করেন: তোমরা আমার থেকে নিশ্চিতভাবে না জেনে হাদীস বর্ণনা করার ব্যাপারে সাবধান থাকবে। যে ব্যক্তি জেনে-শুনে আমার প্রতি মিথ্যা আরোপ করে সে যেন জাহান্নামে তার আবাস বানিয়ে নেয়। আর যে ব্যক্তি কুরআনে নিজের মতানুসারে কথা বলে সেও যেন তার আবাস জাহান্নামে বানিয়ে নেয়। (তিরমিজী: ২৯৫১)
হাদীসটির স্তর : হাসান। ইমাম তিরমিজী রহ. বলেন: এ হাদীসটি হাসান।
সারসংক্ষেপ : এ হাদীস থেকে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, কুরআনুল কারীমে নিজের মতানুসারে কিছু বলার অর্থ হলো জাহান্নামের পথ অবলম্বন করা। তবে জটিল বিষয়ের ব্যাখ্যা গ্রহণের ক্ষেত্রে কুরআন-হাদীসে পারদর্শী গবেষক আলিমগণ বিভিন্ন আয়াত ও হাদীসের ইঙ্গিত থেকে এমন ব্যাখ্যা গ্রহণ করতে পারেন যা অন্য কোন আয়াত বা হাদীসের সাথে সাংঘর্ষিক না হয়।
ইমাম তিরমিজী রহ. ২৯৫২ নম্বর হাদীসের আলোচনায় বলেন:
رُوِيَ عَنْ بَعْضِ أَهْلِ العِلْمِ مِنْ أَصْحَابِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَغَيْرِهِمْ، أَنَّهُمْ شَدَّدُوا فِي هَذَا فِي أَنْ يُفَسَّرَ القُرْآنُ بِغَيْرِ عِلْمٍ وَأَمَّا الَّذِي رُوِيَ عَنْ مُجَاهِدٍ وَقَتَادَةَ وَغَيْرِهِمَا مِنْ أَهْلِ العِلْمِ أَنَّهُمْ فَسَّرُوا القُرْآنَ فَلَيْسَ الظَّنُّ بِهِمْ أَنَّهُمْ قَالُوا فِي القُرْآنِ أَوْ فَسَّرُوهُ بِغَيْرِ عِلْمٍ أَوْ مِنْ قِبَلِ أَنْفُسِهِمْ وَقَدْ رُوِيَ عَنْهُمْ مَا يَدُلُّ عَلَى مَا قُلْنَا أَنَّهُمْ لَمْ يَقُولُوا مِنْ قِبَلِ أَنْفُسِهِمْ بِغَيْرِ عِلْمٍ
অনুবাদ : সাহাবায়ে কিরাম এবং অন্যান্যদের মধ্যে যারা পারদর্শী আলিম তাদের থেকে বর্ণিত আছে যে, গভীর জ্ঞান ব্যতীত কুরআনের তাফসীর করার বিষয়ে তারা খুব কঠোরতা অবলম্বন করতেন। আর হযরত মুজাহিদ, হযরত কতাদা এবং অন্যান্যদের থেকে তাফসীর করার যে বিষয় বর্ণিত রয়েছে সে সম্পর্কে এ ধারণা করা যায় না যে, তাঁরা কুরআন-হাদীসের গভীর জ্ঞান ব্যতীত কুরআনের তাফসীর করেছেন বা কুরআন সম্পর্কে কিছু বলেছেন। বরং তাদের থেকে যা বর্ণিত আছে তা এটাই প্রমাণ করে যে, কুরআন-হাদীসের গভীর জ্ঞান ব্যতীত তারা নিজেদের পক্ষ থেকে কিছুই বলেননি।
হযরত আমর বিন শুআইব সূত্রে তাঁর দাদা থেকে একটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, إِنَّ الْقُرْآنَ لَمْ يَنْزِلْ يُكَذِّبُ بَعْضُهُ بَعْضًا، بَلْ يُصَدِّقُ بَعْضُهُ بَعْضًا، فَمَا عَرَفْتُمْ مِنْهُ، فَاعْمَلُوا بِهِ ، وَمَا جَهِلْتُمْ مِنْهُ، فَرُدُّوهُ إِلَى عَالِمِهِ (রসূলুল্লাহ স. ইরশাদ করেছেন:) “কুরআন এ জন্য অবতীর্ণ হয়নি যে, তার কিয়দাংশ দ্বারা অন্য অংশকে মিথ্যা প্রমাণ করা হবে। বরং কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে কিয়দাংশ দ্বারা অন্য অংশকে সত্যায়ন করার জন্য। সুতরাং যা পরিপূর্ণ অনুধাবন করতে পারো তার ওপর আমল কর। আর যে বিষয়ে তোমার অজ্ঞতা রয়েছে তা আলিমের নিকট সোপর্দ কর”। (মুসাদে আহমাদ: ৬৭০২)
এ হাদীসের তাহকীকে শায়খ শুআইব আরনাউত বলেন: صحيح “হাদীসটি সহীহ”। এ হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, পূর্ণ অবগতি ছাড়া আমল করা বৈধ নয়। আর কুরআনের উপর আমল করা যেহেতু জরুরী তাই রসূলুল্লাহ স. আমলের জন্য আলিমের শরণাপন্ন হওয়ার তাকীদ দিয়েছেন।
কুরআন অবতরণের মূল উদ্দেশ্য মানুষের হিদায়াত। (সূরা বাকারা: ১৮৫) আর কুরআন থেকে হিদায়াত পাওয়ার নিরাপদ পদ্ধতিও এটাই যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে পুরস্কারপ্রাপ্ত নেক মানুষের অনুকরণে কুরআন থেকে হিদায়াত আহরণ করা। নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া নিজের বুদ্ধি খাটানোর চেষ্টা না করা। কুরআনী ইলম শিক্ষার এ পদ্ধতির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে সূরা ‘ফাতিহা’র মধ্যে।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন: اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ صِرَاطَ الَّذِينَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلَا الضَّالِّينَ “হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করুন। তাদের পথে যাদেরকে আপনি পুরস্কার দিয়েছেন; অভিশপ্ত ও পথভ্রষ্টদের পথে নয়”। এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা সীরাতে মুস্তাকীম পাওয়ার সংক্ষিপ্ত বিবরণ পেশ করে বলেন: এদের অনুসৃত পথই সীরাতে মুস্তাকীম। যার অর্থ হলো: সীরাতে মুস্তাকীম পেতে হলে পুরস্কারপ্রাপ্ত পথিকদের শরণাপন্ন হও; তাদের চলার পথই সীরাতে মুস্তাকীম। এদের পথ অনুসরণ না করে কুরআন বুঝার চেষ্টা করা ভ্রষ্টতা থেকে নিরাপদ নয়। কুরআন বুঝার ক্ষেত্রে উপরোক্ত পদ্ধতি অনুকরণ না করে অনেকেই পথভ্রষ্ট হয়েছে।
অন্য আয়াতে পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণের পচিয় এভাবে দেয়া হয়েছে যে, নবী, সিদ্দীক, শহীদ ও সালেহগণ হলেন পুরস্কারপ্রাপ্ত পথিক। (সূরা নিসা: ৬৯)
সারকথা হলো: সীরাতে মুস্তাকীমের ওপর চলার জন্য আল্লাহ তাআলা কুরআন নাযিল করেছেন; আর কুরআন অনুযায়ী চলার জন্য নিজের বুদ্ধির উপর নির্ভরশীল না হয়ে পুরস্কারপ্রাপ্ত কোন পথিকের অনুসরণ করা চাই; যিনি কুরআন অনুযায়ী চলার পদ্ধতি শিখিয়ে দিবেন এবং দেখিয়ে দিবেন।
কোরআনের তাফসীর করতে কি জানতে হয় -
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন