বৃহস্পতিবার, ২১ জুলাই, ২০১৬

আল্লাহ কি সর্বত্র বিরাজমান?

Mohiuddin Kasemi

রাসুলে কারিম সা. এর ওপর দু প্রকার অহী নাযিল হয়েছে। অহীয়ে মাতলু ও গায়রে মাতলু। মাতলু হচ্ছে কুরআন। আর গায়রে মাতলু হচ্ছে হাদিস। কুরআনের কোনো আয়াত কিংবা কোনো হাদিস ব্যাখ্যা করতে হলে এমন ব্যাখ্যা করতে হবে, যা অন্য কোনো আয়াত বা হাদিসের পরিপন্থী না হয়। কারণ, তখন একটিকে গ্রহণ করা হলেও অন্যটি পরিত্যাজ্য হয়ে যাবে। পৃথিবীর যে কোনো সংবিধান ব্যাখ্যারও নীতি এটি। সংবিধানের কোনো ধারার ব্যাখ্যা অন্য ধারার বিপরীত হলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না; বরং অতি অবশ্যই ব্যাখ্যাটি অন্য সকল ধারার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে। 
.
কুরআন ও হাদিসের কিছু বিষয় সত্যিই দুর্বোধ্য ও জটিল। মানুষের বিবেক ও জ্ঞান দিয়ে সেগুলোর স্বরূপ উদঘাটন করতে পারে না। এ জটিল বিষয়গুলোর সমাধান বের করা মানুষের দায়িত্ব ও কর্তব্য না। মানুষের প্রতি আল্লাহর বিধি-নিষেধ মেনে চলাই প্রধান কর্তব্য। এবং আল্লাহ মানুষকে যতটুকু অহীর মাধ্যমে জানিয়েছেন, ততটুকুই জানতে পারে; এর বাইরে তারা কিছুই জানে না। সেসব জটিল বিষয়গুলোর একটি হল আল্লাহর সত্তার পরিচয় ও তাঁর অবস্থান। 
কুরআনে কারিমে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন : 
يَعْلَمُ مَا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ وَلَا يُحِيطُونَ بِهِ عِلْمًا
অর্থ : আল্লাহ জানেন যা কিছু তাদের সামনে ও পশ্চাতে রয়েছে এবং তারা আল্লাহকে জ্ঞান দ্বারা আয়ত্ব করতে পারে না। (সূরা তোয়া হা : ১১০) 
অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে : 
يَعْلَمُ مَا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ وَلَا يُحِيطُونَ بِشَيْءٍ مِنْ عِلْمِهِ إِلَّا بِمَا شَاءَ
অর্থ : তাদের সামনে ও পেছনে যাকিছু রয়েছে সবই আল্লাহ জানেন। আল্লাহর জ্ঞানসীমা থেকে তারা কোনোকিছুই পরিবেষ্টন করতে পারে না; কিন্তু যতটুকু তিনি ইচ্ছা করেন। (সূরা বাকারা : ২৫৫) 
অন্যত্র পরিষ্কার বলা হয়েছে : 
وَمَا أُوتِيتُمْ مِنَ الْعِلْمِ إِلَّا قَلِيلًا
অর্থ : তোমাদেরকে অতি সামান্য জ্ঞান দেওয়া হয়েছে। (সূরা বনি ইসরাইল : ৮৫) 
.
কুরআনে কারিম ও হাদিসে দু ধরনের বক্তব্য পাওয়া যায়। কিছু বক্তব্য দ্বারা বোঝা যায় আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান। আবার কিছু বক্তব্য প্রমাণ করে তিনি আরশে সমাসীন। বাহ্যত দু বক্তব্যের মাঝে বিরোধ পরিলক্ষিত হলেও বাস্তবে কোনো বিরোধ নেই। দুনো বক্তব্যই সঠিক ও যথার্থ। উভয় বক্তব্যের প্রতি ঈমান আনা আবশ্যক। 
আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমানের মানে হল, তিনি সবকিছুই দেখছেন, শুনছেন। কুল মাখলুকাত তাঁর কতৃত্বে ও করায়ত্বে। কোনোকিছুই তাঁর ক্ষমতা ও রাজত্বের বাইরে নয়। আর আরশে তিনি আছেন সত্তাগতভাবে। যেভাবে তিনি আরশে আছেন সেভাবে তিনি আমাদের কাছে নেই। তাহলে আরশে অধিষ্ঠিত ও সমাসীন হওয়ার আয়াতগুলোর কোনো যথার্থতা থাকে না। তবে আরশে তাঁর অধিষ্ঠিত ও সমাসীন হওয়ার প্রকৃতি, ধরন ও পদ্ধতি আমাদের জানা নেই। 
এ বিষয়টিই নিকট অতীতের বিখ্যাত ফকিহ আল্লামা আবদুল হাইল লখনোবি রহ. এভাবে বলেন : 
نعتقد بانه علي العرش مستو عليه استواء منزها عن التمكن والاستقرار وانه فوق العرش و مع ذلك هو قريب من كل موجود وهو اقرب من حبل الوريد ولا يماثل قربه قرب الاجسام. 
অর্থ : আমরা বিশ্বাস করি, আল্লাহ তাআলা আরশে অধিষ্ঠিত আছেন; তবে স্থান গ্রহণ করা ও স্থায়িত্ব হতে পবিত্র তিনি। তিনি আরশে থাকা সত্ত্বে প্রত্যেক সৃষ্টির নিকটবর্তী। তিনি গ্রীবাস্থিত ধমনী থেকেও অধিত নিকটবর্তী। তবে এ নিকটবর্তী হওয়া কোনো বস্তুর সাথে সাদৃশ্য রাখে না। 
তিরমিযি শরিফের একটি হাদিস এসেছে : 
لَوْ أَنَّكُمْ دَلَّيْتُمْ بِحَبْلٍ إِلَى الْأَرْض السُّفْلَى لَهَبَطَ عَلَى اللَّه , ثُمَّ قَرَأَ { هُوَ الْأَوَّل وَالْآخِر وَالظَّاهِر وَالْبَاطِن وَهُوَ بِكُلِّ شَيْء عَلِيم } .
অর্থ : তোমরা যদি রশিতে বেঁধে কাউকে সপ্তম জমিনে ফেলে দাও, তাহলে সে আল্লাহর ওপর গিয়ে পড়বে। এরপর রাসুল সা. এ আয়াত পড়লেন : ‘তিনিই সর্বপ্রথম, তিনিই সর্বশেষ; তিনিই প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য। সববিষয়ে তিনি সম্যক অবগত। (তিরমিযি, হাদিস নং- ৩২৯৮) 
এ হাদিস বর্ণনার পর ইমাম তিরমিযি রহ. বলেন : 
إنما هبط على علم الله وقدرته وسلطانه. علم الله وقدرته وسلطانه في كل مكان وهو على العرش كما وصف في كتابه. 
অর্থ : ওলামায়ে কেরাম এর ব্যাখ্যায় বলেন, ওই ব্যক্তি আল্লাহর ইলম, কুদরত ও রাজত্বে গিয়ে পড়বে। কারণ, আল্লাহর ইলম, কুদরত ও রাজত্ব প্রত্যেক স্থানে রয়েছে। যদিও তিনি আরশে সমাসীন; যেমনটি কুরআনে আল্লাহ নিজেই বর্ণনা দিয়েছেন। (মাজমুআয়ে ফাতাওয়া মাওলানা আবদুল হাই : পৃ. ৫২-৫৩, মাকতাবা থানবী দেওবন্দ)

আল্লাহ মানুষের সঙ্গে আছেন, মানে এই না যে, তিনি যেভাবে আরশে সমাসীন সেভাবে সর্বত্র আছেন। মানুষের সঙ্গে থাকার মতলব হল, সবকিছুই তিনি দেখছেন, সাহায্য করছেন। একটি আয়াতে বলা হয়েছে :
قَالَ لَا تَخَافَا إِنَّنِي مَعَكُمَا أَسْمَعُ وَأَرَى
অর্থ : আল্লাহ বললেন, তোমরা ভয় করো না; অবশ্যই আমি তোমাদের সঙ্গে রয়েছি, আমি শুনছি ও দেখছি। (সূরা তোয়া হা : ৪৬)

বিষয়টি নিয়ে আল্লাম লখনোবি রহ. নীতিদীর্ঘ আলোচনা করেছেন। অনেক আলেম এ বিষয়ে স্বতন্ত্র কিতাবও লিখেছেন। যাই হোক, সারসংক্ষেপ হিসেবে উপরের কথাগুলো মনে রাখলেই কোনোরূপ ঝামেলায় পড়তে হবে না।
والله اعلم

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন