বৃহস্পতিবার, ৪ আগস্ট, ২০১৬

চারটি মহান গুণ


মূল : বিচারপতি আল্লামা তাকি উসমানি দা.বা.
অনুবাদ : মুহিউদ্দীন কাসেমী

عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ أَرْبَعٌ إِذَا كُنَّ فِيكَ فَلَا عَلَيْكَ مَا فَاتَكَ مِنْ الدُّنْيَا حِفْظُ أَمَانَةٍ وَصِدْقُ حَدِيثٍ وَحُسْنُ خَلِيقَةٍ وَعِفَّةٌ فِي طعمة
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলে কারিম সা. ইরশাদ করেছেন : চারটি গুণ এমন রয়েছে, যদি তা তোমার মধ্যে এসে যায়, তাহলে যদি দুনিয়ার কোনো নেয়ামত তুমি নাও পাও, তা সত্ত্বেও তোমার কোনো দুঃখ না হওয়া চাই। কারণ, এ চারিটি গুণ এতই মহা মূল্যবান সম্পদ যে, তার উপস্থিতিতে আর কোনো সম্পদ মূল্যবান ও উত্তম নয়। এ চারটি গুণ কী? তিনি বলেন : সেই চারটি গুণ, যা দুনিয়ার সমস্ত সম্পদ থেকে উত্তম, তার মধ্যে সর্ব প্রথম গুণটি হল আমানত সংরক্ষণ করা। দ্বিতীয় গুণটি হল, সত্য কথা বলা। তৃতীয় গুণটি হল সচ্চরিত্রতা আর চতুর্থটি হল খাবার পবিত্র হওয়া। এতে হারামের সংমিশ্রণ না থাকা। এ চারটি গুণ খুবই সংক্ষিপ্ত। কিন্তু এতটা ব্যাপক যে, পূর্ণ দীন তার মাঝে ঢুকে আছে। [মুসনাদে আহমাদ, হাদিস নং- ৬৩৬৫]

প্রথম গুণ : আমানাতের সংরক্ষণ
প্রথম গুণটি হল আমানতের সংরক্ষণ করা। কুরআন ও হাদিসের বহু স্থানে তার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। যেমন ইরশাদ হচ্ছে :
إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تُؤَدُّوا الْأَمَانَاتِ إِلَى أَهْلِهَا
‘নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদেরকে আমানাতগুলোকে তার প্রাপকের কাছে দিয়ে দিতে নির্দেশ করছেন।’ (সূরা নিসা ৫৮)
হাদিসে পাকে রাসুলে কারিম সা. আমানতে খেয়ানত বা আত্মসাৎ করাকে মুনাফেক লোকদের চরিত্র বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, তিনটি বিষয় যার মাঝে পাওয়া যাবে, সে পাকা মুনাফেক। তার মধ্যে একটি হল, ওয়াদা খেলাফি, অঙ্গীকর ও প্রতিশ্র“তি ভঙ্গ করা। দ্বিতীয়টি হল আমানতের খেয়ানদ করা। তৃতীয়টি হল মিথ্যা কথা বলা। এ তিনটি বিষয়কে তিনি মুনাফিকের আলামত হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। এ তিন কাজ কোনো মুসলমান করতে পারে না।
মোটকথা আমানত হল এমন একটি গুণ, যার প্রতি গুরুত্বারোপ করলে মুসলমান হতে পারে।

নবুওয়াতপ্রাপ্তির পূর্বে নবীজির প্রসিদ্ধ গুণগুলো
রাসুলে কারিম সা.-এর গুরুত্বপূর্ণ গুণ, যা নবুওয়াতপ্রাপ্তির পূর্ব থেকে মানুষের মধ্যে প্রসিদ্ধ ছিল, তা হল অর্থাৎ সত্যবাদিতা ও আমানতদারি। ঘোর শক্রও তার কাছে আমানত রাখতে প্রস্তুত ছিল। এমনকি যখন তিনি মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করছিলেন, তখনও মানুষের আমানত তার কাছে রাখা ছিল। সেই আমানতগুলো মালিকের কাছে পৌঁছিয়ে দেয়ার লক্ষ্যে হযরত আলি রা. -কে রেখে এসেছিলেন। এটা তার একটি বিশেষ গুণ ও বৈশিষ্ট্য ছিল। এটা অবিশ্বাসী কাফেরদের কাছেও সুবিদিত ছিল। সুতরাং কাজ হল, সে আমানতের প্রতি সবিশেষ লক্ষ্য রাখা।

আমানতের ব্যাপক অর্থ
সাধারণভাবে মানুষ মনে করে,আমানতের অর্থ হল, কোনো লোক আমার কাছে টাকা-পয়সা বা কোনো জিনিস গচ্ছিত রাখল আর আমি তা সিন্দুকে আটকে রাখলাম আর যখন সে তা চাইবে, তখন তা ফিরিয়ে দিবে। আর খেয়ানত হল, আত্মসাৎ আমাদের দ্বারা হয় না, তাই এ ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত যে, আমরা আমানদার এবং আমরা আমানতের সংরক্ষণ করে যাচ্ছি। কিন্তু আমানতের অর্থ অনেক ব্যাপক। অসংখ্য বিষয় এতে শামিল রয়েছে, যার পূর্ণ বিবরণ এবং বয়ানে আলোচনা করেছিলাম।

দ্বিতীয় গুণ : সত্য বলা
দ্বিতীয় গুণ, যার কথা এই হাদিসে বলা হয়েছে, তা হল, সত্য কথা বলা। অর্থাৎ কোনো লোক মিথ্যা বলবে না। বিভ্রান্তিমূলক কোনো কথা বলবে না। দেখুন, একটা হল স্পষ্ট মিথ্যা, যা প্রত্যেকেই বুঝতে পারে যে, কথাটি সত্য নয়। আরেক হল, অস্পষ্ট মিথ্যা। আল্লাহর মেহেরবানিতে যাদের মাঝে ধর্মীয় মূল্যবোধ আছে এবং মিথ্যা থেকে বেঁচে থাকার নূন্যতম চিন্তা আছে, তারা সাধারণত স্পষ্ট মিথ্যা থেকে বিরত থাকে। কিন্তু মিথ্যার আরো কিছু ছুরত এমন আছে, যা আমাদের সমাজে প্রচলিত; যেগুলোকে মিথ্যা ও গোনাহের কাজ মনে করা হয় না। যেমন একজনের কথা অন্যের কাছে বর্ণনা করার মাঝে অসতর্কতা ও ভয়হীনতা। ফলে মূল কথার গতি-প্রকৃতি পরিবর্তন হতে হতে। এমন হয় যে, মূল কথার সাথে বর্ণিত কথার কোনো সম্পর্কই থাকে না। একটি ভিত্তিহীন ও বানোয়াট বিষয় প্রচারিত হয়। এমনটি কেন হল? কারণ কথাটি বর্ণনার সময় সতর্কতা অবলম্বন করা হয়নি। উচিত ছিল, যে কথাটি যেভাবে বলা হয়েছে, ঠিক সেভাবে সংরক্ষণ করে অন্যের কাছে বর্ণনা করা। কিন্তু যা হচ্ছে, তাহল শুনেছে এক রকম, বুঝেছে অন্য রকম, তারপর নিজের পক্ষ থেকে সামন্য লবণ-মরিচ লাগিয়ে সমাজে পরিবেশন করেছে। একে মিথ্যা মনেই করা হয় না।

কথা কোথা থেকে কোথায় গড়ায়
আমার কাছে আট-দশ জায়গা থেকে পত্র এসেছে যে, একজন বক্তা তার বক্তৃতায় আপনার বরাত দিয়ে এ মাসআলা বর্ণনা করেছেন যে, আপনি বলেছেন, টেপ রেকর্ডে কুরআন শরিফ শ্রবণ করা গান শোনার চেয়েও মারাত্মক গোনাহ। আমার ফেরেশতাদেরও জানা নেই যে, আমি কখন এ মাসআলা বলেছিলাম। যখন আমি এতে চিন্তা-ভাবনা করলাম যে, একথা কোথা থেকে উৎসারিত হল, তখন স্মরণ হল যে, একবার এক মজলিসে ওয়াজ করেছিলাম। মজলিসে এক ব্যক্তি প্রশ্ন করেছিল, যদি টেপ রেকর্ডে কুরআন তেলাওয়াত শুনি আর সিজদায়ে তেলাওয়াত পড়া হয়, তখন সিজদা দেওয়া ওয়াজিব হবে কিনা? উত্তরে আমি বলেছিলাম, টেপ রেকর্ডে যে তেলাওয়াত শ্রবণ করা হয়, তা বাস্তব তেলাওয়াতের হুকুমে নয়। সুতরাং তা শ্রবণের কারণে সিজদায়ে তেলাওয়াত ওয়াজিব হবে না। এখন যেহেতু আমি বলছি, টেপরেকর্ডের তেলাওয়াত বাস্তব তেলাওয়াতের মতো নয়; সেখান থেকে বুঝে নিয়েছে যে, সেই তেলাওয়াত হারাম ও নাজায়েয। আবার এটাকে নিজের পক্ষ থেকে আরো একটু অগ্রসর করে সে বছেছে, তা গান শোনার চেয়েও মারাত্মক। অথচ সে জেনে-বুঝে মিথ্যা বলেনি, বরং অসতর্কতাবশত নিজের চিন্তা-ভাবনা এতে মিলিয়েছে।

আমার সাথে সংযুক্ত করে বলা একটি স্বপ্ন
কিছু দিন পূর্বে জনাব কালিম ভাই সাহেব আমাকে বলছিলেন, যে অঞ্চলে ভূমিকম্প হয়েছে, সেখানে আমার নামে একথা প্রসিদ্ধ হয়ে গেছে যে, তিনি একটা স্বপ্ন দেখেছেন। এতে বলা হয়েছে, রমজানুল মুবারকের কারণে আল্লাহ তাআলা ভূমিকম্পকে হালকা করে দিয়েছেন আর ঈদের পর তার চেয়েও অনেক ভয়াবহ ভূমিকম্প হবে। তারপর আমার কাছে টেলিফোন আসতে থাকে যে, আপনি কি এ ধরনের কোনো স্বপ্ন দেখেছেন? আল্লাহ মালুম এমন আজগুবি স্বপ্ন কোথা থেকে উৎসারিত হল এবং কিভাবে প্রচার পেয়েছে। প্রথম কথার তো একটি উৎস ছিল। এর তো কোনো উৎসও খুঁজে পাচ্ছি না যে, কোথা থেকে সম্প্রচারিত হল।

বর্ণনায় সতর্কতা অবলম্বন করুন
মোটকথা সংবাদ প্রচার ও বর্ণনায় সতর্কতা অবলম্বনের দিন শেষ হয়ে গেছে। ইসলাম এ ব্যাপারে যতই গুরুত্বারোপ করেছে যে, মানুষের মুখ থেকে যেন কোনোরূপ ভুল ও মিথ্যা বের না হয়, বর্তমানে ততই অসতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে। ফলে সমাজে ফেতনা বিস্তৃত হচ্ছে। গুজব ও প্রোপাগাণ্ডা বিস্তার লাভ করছে। হয় কথার প্রচার ও বর্ণনা করা বন্ধ রাখ, অন্যথায় যদি প্রচার করতেই হয়, তাহলে আল্লাহর ওয়াস্তে নিজের ওপর দয়া কর। মিথ্যা ও ভুল প্রচার থেকে বিরত থাক আর যে কথা অন্যের কাছে পৌঁছানো দরকার, তা সঠিকভাবে জেনে নাও যে, কী হয়েছে; তারপর বলো। কোনো রদবদল করো না।
একজন মুহাদ্দিসের সতর্কতা
আল্লামা খতিবে বাগদাদি রহ. আল-কিফায়াহ নামক গ্রন্থে একজন মুহাদ্দিসের একটি হাদিস বর্ণনার ঘটনা লিপিবদ্ধ করেছেন। আপনারা হয়ত শুনেছেন, একজন হাদিস বর্ণনাকারী যখন হাদিস বর্ণনা করেন, তখন এভাবে বলেন যে, حدثنا فلان قال : حدثنا فلان قال : حدثنا فلان
অর্থাৎ আমাকে অমুক এই হাদিসটি শুনিয়েছেন। حدثنا শব্দের অর্থ হল অমুক আমাকে এই হাদিসটি শুনিয়েছেন। উক্ত মুহাদ্দিস একটি হাদিসকে তার উস্তাদের প্রতি সম্পৃক্ত করে বর্ণনা করলে বলতেন : حدثنا فلان قال : ثنا فلان: 
পূর্ণ শব্দ ‘হাদ্দাসানা’র স্থলে শুধুু ‘সানা’ বলতেন।
লোকেরা তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, এ হাদিস বর্ণনাকালে পূর্ণ শব্দ হাদ্দাসানা কেন পড়েন না। উত্তরে তিনি বলেনম, যখন আমি উস্তাদের কাছে গেলাম, তখন তিনি পাঠ শুরু করে দিয়েছিলেন। আমি আসার পূর্বেই ‘হাদ’ শব্দটি তার যবানে শুনতে পাইনি বরং শুধুু ‘সানা’ শুনেছি। এখন যদি আমি পূর্ণ শব্দ হাদ্দাসানা বলে বর্ণনা করি, তাহলে এটা মিথ্যা হবে। তাই আমি শুধুু সানা বলি। এতটা সতর্কতার সাথে হাদিসের ভাণ্ডার আমাদের পর্যন্ত পৌঁছেছে। হাদিস বিশারদগণ রাসুলে আকরাম সা.-এর বাণীগুলোকে সংরক্ষণের ক্ষেত্রে এতটা সতর্কতা অবলম্বন করেছেন।

হযরত থানবি রহ.-এর সতর্কতা
আমার শ্রদ্ধাভাজন পিতা বলতেন, আমি হাকিমুল উম্মত হযরত মাওলানা থানবি রহ. -কে বলতে শুনেছি। তিনি ইচ্ছামত সিদ্ধান্ত গ্রহণের নিন্দা করে বলেন, যখন নীতিগত দিক থেকে তোমার চেয়ে বড় বিদ্যমান থাকে, তাহলে তার সাথে পরামর্শ কর। বড় কেউ না থাকলে সমমানের লোকের সাথে পরামর্শ কর। আর যদি এমনও কেউ না থাকে, তাহলে ছোটদের সাথে পরামর্শ কর। পরামর্শ ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করো না এবং কোনো কাজে হাত দিয়ো না। অতঃপর তিনি নিজেই ব্যাখ্যা করে বলেন, নীতিগত দিক থেকে বড় এজন্য বলেছি, মূলত কে বড় আর কে ছোট তা তো আল্লাহ তাআলাই ভালো জানেন। কারণ ছোট-বড়র ভিত্তি হল তাকওয়া ও আল্লাহর আনুত্যের ওপর। কিন্তু নীতিগত দিক থেকে আমরা মনে করি, পিতা সন্তানের চেয়ে বড়। উস্তাদ ছাত্রের চেয়ে বড়, পীর মুরিদ থেকে বড়। এসবই নীতিগত বড়। কিন্তু বাস্তবে কে বড়, তা আল্লাহ ভালো জানেন।
আব্বাজান রহ. বলেন, হযরত থানবি রহ. একথাও বলতে পারতেন, যখন বড় বিদ্যমান থাকে, তখন বড় থেকে পরামর্শ গ্রহণ কর যেহেতু মস্তিষ্কে সেই নিক্তি লাগানো আছে যে, কোনো কথা যেন বাস্তবতা বিরোধী না হয়, সেই নিক্তি শুধুু বড় শব্দটি বলতে দেয়নি। বরং এ কথা বলিয়েছে যে, নীতিগত বড় বা নৈতিকভাবে বড় যেন কথাটি বাস্তবতার খেলাফ না হয়।

উদাসীনতা ও নির্ভীকতা কঠিন এক বিপদ
যখন অন্তরে ভাবনা আসে, তখন আল্লাহ তাআলা অন্তরে সঠিক ও বিশুদ্ধ শব্দ ঢেলে দেন যে, মানুষ এ মুহূর্তে এ শব্দটি ব্যবহার করবে। সবচেয়ে বড় বিপদ হল, উদাসীনতা ও বেপরোয়া হওয়া। এ ব্যাপারে উদাসীনতা যে, আমার মুখ দিয়ে যা-ই বের হয়, তার কোনো পরোয়া নেই। যা ইচ্ছা তা-ই বকে গেলাম। এ কঠিন মুসিবত আমাদেরকে সত্য কথা থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। কথা-বার্তায় সত্যতার অর্থ হল, যে কথাটি মুখে উচ্চারিত হবে, তা যেন শতভাগে সঠিক হয়। তাতে মিথ্যার কোনো লেশ যেন না থাকে। তবে হ্যাঁ, একটু –আধটু অতিরঞ্জন তো মানুষ বাক্পদ্ধতিতে করেই থাকে। কিন্তু এমন অতিরঞ্জন, যা মিথ্যার সীমায় নিয়ে যায়, তা কথাবার্তায় সততার পরিপন্থী। মোটকথা হল, যখন মুখ থেকে কোনো কথা উচ্চারণ করবে, তখন সামান্য চিন্তা-ভাবনা করে কথা বলবে।

যদি তোমার কথাবার্তা রেকর্ড করা হয়, তাহলে?
তার উত্তম মাপকাঠি আমার আব্বাজান রহ. বর্ণনা করেছিলেন আর আলহামদুলিল্লাহ তা আমার অন্তরে গেঁথে আছে তা হল, এই যে যখন কোনো কথা মুখে উচ্চারণ করুন বা কলম দিয়ে লিখে রাখুন ,তখন মনে করুন যে, তা আমাকে কোনো আদালতে প্রমাণ করতে হবে মনে করুন , যদি আপনাকে বলা হয় যে , আপনি দুই ঘণ্টার মাঝে যা কিছু বলবেন, তা রেকর্ড করে থানায় পেশ করা হবে এবং তারই ভিত্তিতে আপনাকে গ্রেফতার ও মুক্তির রায় শোনানো হবে এখন বলুন, এ দু ঘণ্টা আপনি কী ধরনের কথা বলবেন? তখনও কি আপনি চিন্তা-ভাবনাহীন কথাবার্তা বলবেন, না-কি হিসাব করে বলবেন? তখন যদি আপনার সাথে কেউ কথা বলতে চায়, আপনি বলবেন, আরে ভাই ! এখন তো আমার প্রতিটি কথা রেকর্ড হচ্ছে এবং তার ওপর নির্ভর করে মুক্তি ও গ্রেফতারি পরোয়ারা জারি হবে সুতরাং এই নাজুক পরিস্হিতিতে তুমি আমার সাথে অর্থহীন কথা বলো না এবং আমাকে দিয়েও বলাইয়ো না এই পরিস্থিতিতে আপনার জবান থেকে মাপা কথা বের হয়!

প্রতিটি শব্দ রেকর্ড হচ্ছে 
আমার মরহুম আব্বাজী বলতেন ,আরে ভাই ! এই টেপরেকর্ড তো আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে প্রতিটি লোকের জন্য লাগিয়ে রাখা হয়েছে; কুরআনুল কারিমে ইরশাদ হচ্ছে :
مَا يَلْفِظُ مِنْ قَوْلٍ إِلَّا لَدَيْهِ مَا يَلْفِظُ مِنْ قَوْلٍ إِلَّا لَدَيْهِ رَقِيبٌ عَتِيدٌ
মানুষ যে-কথাই উচ্চারণ করে, তাই গ্রহণ করার জন্য তার কাছে সদা প্রস্তুত প্রহরী রয়েছে।’ (সূরা কফ-১৮) 
আর সেই টেপরেকর্ডারের ভিত্তিতে বিচারকার্য সম্পাদিত হবে। তুমি মিথ্যা বলেছিলে, নাকি সত্য বলেছিলে। সুতরাং কথাবার্তায় এমন সতর্কতা অবলম্বন করো যে, একেকটি শব্দ যা মুখে উচ্চারিত হচ্ছে, আখেরাতে তার জবাব দিতে হবে। তাই চিন্তা-ভাবনা করে আল্লাহর ভয় মনে রেখে মুখ থেকে কথা বের কর। যাদের অন্তরে আল্লাহর ভয় আছে, তারা শুধুু প্রয়োজনীয় কথাই জবানে উচ্চারণ করে। নচেৎ তারা চুপ থাকে। আল্লাহ তাআলা তার দয়া অনুগ্রহে আমাদেরকে আমানতদারিও দান করুন এবং কথার্বাতায়ও সততা দান করুন। পাশাপাশি যে কথা মুখে আসে, তা যেন শতভাগ সঠিক হয়।

তৃতীয় গুণ : সচ্চরিত্র
তৃতীয় গুণ, যা হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে, তা হল :
حُسْنُ خَلِيقَةٍ
মানে উত্তম চরিত্র মাধুরী।
এক হাদিসে রাসুলে কারিম সা. থেকে বর্ণিত আছে, তিনি ইরশাদ করেন, “মুমিন উত্তম চরিত্রের অধিকারী হয়ে থাকে। মুমিন চরিত্রহীনও না আবার বিদ্বেষপরায়ণ ও মানুষের সাথে কঠোর আচরণকারীও হয় না। এগুলো কোনো মুসলমানের চরিত্র নয়। মুসলমান তো অন্যের সাথে উত্তম চরিত্রের পরিচয় দিয়ে থাকে। সে কারো সাথে কঠোরতা করে না।

উত্তম চরিত্র বলতে কী বুঝায়?
আমাদের বুঝতে হবে উত্তম চরিত্র কী এবং তা মানুষের মাঝে কিভাবে সৃষ্টি হয়। এটি সুদীর্ঘ আলোচনার বিষয়। এ সংক্ষিপ্ত সময়ে তা বর্ণনা করা কঠিন। সংক্ষিপ্ত কথা হল, উত্তম চরিত্র মানে, আপনি বাহ্যত কারো সাথে হাসি মুখে কথা বললেন। নিঃসন্দেহে এটাও উত্তম চরিত্রের একটি অংশ। কিন্তু যদি আপনি বাহ্যত হাসি মুখে কথা বলছেন আর অন্তর বিদ্বেষে পরিপূর্ণ, তাহলে তা উত্তম চরিত্রের কৃত্রিম বহিঃপ্রকাশ হবে। আপনার ইখলাস ও নিষ্ঠা নেই বরং কপট আচরণ হল, যা একজন মুমিনের বৈশিষ্ট্য নয়।

পশ্চিমা বিশ্ব ও সচ্চরিত্র
অধুনা পশ্চিমা বিশ্বে এ ব্যাপারে অনেক বইপুস্তক লিপিবদ্ধ করা হচ্ছে যে, মানুষের সাথে কিভাবে আচরণ করতে হবে এবং মানুষকে কিভাবে নিজের দিকে আকৃষ্ট করবে। মানুষ এ ধরনের বইপুস্তক অনেক আগ্রহ সহকারে পড়ে। সেসব পুস্তকে একথা লেখা হয় যে, যখন মানুষের সাথে মিলিত হবে, তখন এভাবে হবে, যখন কথা বলবে, তখন এভাবে বলবে, এ ধরনের আচরণ করবে। এ হল উত্তম চরিত্রের পন্থা। কিন্তু এই উত্তম চরিত্র অবলম্বনের উদ্দেশ্য হল অন্যকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করা ও অন্যের অন্তরকে নিজের প্রতি বিমুগদ্ধ করা, অন্যের অন্তরে নিজের মর্যাদা সৃষ্টি করা। এ উদ্দেশ্যেই উত্তম চরিত্রের সকল পথ অবলম্বন করা হচ্ছ। কিন্তু সেই উত্তম চরিত্র মাধুরি, যা ইসলাম ধর্মে কাম্য এবং যার ব্যাপারে রাসুলে কারিম সা.-এর নির্দেশণা রয়েছে, সেই উত্তম চরিত্রের উদ্দেশ্য অন্যকে বিমুগ্ধ করা নয়। বরং তার উদ্দেশ্য হল, একজন মুসলমান হিসাবে আমার জন্য অবশ্য কর্তব্য হল অন্যের সাথে সদাচরণ করা। সুতরাং উভয়ের উদ্দেশ্যের মাঝে আসমান-জমিন পার্থক্য। কারণ পশ্চিমাদের দ্বারা যে উত্তম চরিত্রের চর্চা হচ্ছে, তার উদ্দেশ্য হল মানুষকে আপন করা ও ভক্ত বানানো। আর তা হচ্ছে ¯্রফে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য। কিন্তু আল্লাহ ও তার রাসুলে কারিম সা.ইরশাদ করেছেন, এটিও একটি সদকা যে, তুমি তোমার ভাইয়ের সাথে হাসিমুখে মিলিত হবে, যেন আমার আল্লাহ আমার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যান।

বাণিজ্যিক সদাচরণ
বর্তমানে মানুষ পশ্চিমা সম্প্রদায়ের অনেক প্রশংসা করে থাকে। তারা বড় সদাচারী ও নীতিবান। মানুষ তাদের সাদাচরণের প্রশংসা করে। অনেক সময় ইসলাম ও মুসলমানদের মুকাবেলায় তারা উন্নত ও উৎকৃষ্ট হওয়ার কথা মনে আসতে থাকে। কথা হল, হয়ত বাস্তবে সদাচারী ও নীতিবান হতে পারে। কিন্তু সাধারণভাবে তাদের এ সাদাচরণ ও নৈতিকতা ব্যবসা ও মার্কেটিং এর কৌশল হয়। একজন সেলসম্যান যদি দোকানে দাঁড়িয়ে থেকে গ্রাহক ও ক্রেতাদের সাথে হাসিমুখে কথা না বলে, সুন্দর আচরণ না করে,তাহলে কে তার পণ্য ক্রয় করতে আসবে? সে তা তার ব্যবসার খাতিরে এবং লাভের উদ্দেশ্যে মানুষের সাথে সদাচরণ করতে বাধ্য। কিন্তু আপনি যদি তাকে এ কথা বলেন যে, আপনি তো আমার সাথে উত্তম নৈতিকতা প্রদর্শন করেছেন, তাই আমাদেরকে দশ টাকা কমে পণ্যটি দিয়ে দিন, তাহলে দেখবেন, সকল সদাচরণ ও উত্তম স্বভাব বিদায় নিয়েছে। কারণ এ সকল সদাচরণ ও নৈতিকতা শুধুু এজন্য প্রদর্শন করা হচ্ছে যে, আমি তার থেকে কিভাবে অধিক অর্থ লাভ করতে পারি এবং পণ্য বিক্রি করতে পারি। আপনি কি ভেবেছেন যে, এটাই উত্তম নৈতিকতা ও উন্নত চরিত্রমাধুরী? মূলত উত্তম চরিত্র ও সদাচরণ হল, যা মানুষের মন থেকে উৎসারিত হয় এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হয়, যার উদ্দেশ্য হল পরকালের সফলতা। পার্থিবজীবনে তার বিনিময় কাম্য নয়। এটাই আসল সদাচরণ ও উন্নত চরিত্রমাধুরী।

মানুষের মাঝে কিভাবে সৎস্বভাব জন্মাবে?
এই সৎস্বভাব মানুষের মাঝে কিভাবে জন্মাবে? এই তাসাওউফ মূলত নৈতিক উৎকর্ষ সাধনেরই বিজ্ঞান। মানুষ পীর-বুযুর্গদের সংস্পর্শে মূলত এই নৈতিক ও উৎকর্ষ অর্জনের জন্যেই গিয়ে থাকে। তাসাওফও মূলত নৈতিক চরিত্র গঠন ও আত্মশুদ্ধির একটি ব্যবস্থা, যা এ মুহূর্তে আলোচনা করা সম্ভব নয়। কিন্তু নীতিশাস্ত্রের যে চাবি আমার কাছে রয়েছে, তা-ই এ মুহূর্তে আপনাদের সামনে পেশ করছি। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তার ওপর আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
নীতিশাস্ত্রের বুনিয়াদি চাবি যদি লাভ হয়ে যায়, তাহলে মনে করুন সদাচরণ নীতিও অর্জিত হয়েছে। তা হল বিনয় ও নম্রতা। এটা সমস্ত সৎস্বভাব ও সদাচরণের বুনিয়াদি স্তম্ভ। যদি কারো মাঝে বিনয় ও নম্রতা লাভ হয়ে যায়, তাহলে বিনয়ী কোনো লোক অসৎচরিত্র ও অসদাচরণের অধিকারী হয় না। কারণ অসদাচরণকারী তখনই হবে, যখন কোনো লোকের মাঝে বড়ত্ব ও অহংকার আসবে। বিনয়ের অর্থ হল, নিজেকে ছোট মনে করা এবং অন্যকে নিজের থেকে বড় মনে করা। যদি কোনো লোকের অন্তরে একথা এসে যায় যে, আমি ছোট, বাকি সবাই আমার চেয়ে বড়, তা হলেই সে ভালো মানুষের পরিণত হয়ে যায়। অন্যকে বড় মনে করার অর্থ বয়সে ও জ্ঞানে বড় হওয়া নয়। বরং আল্লাহ তাআলার কাছে মকবুল হিসেবে, খোদাভীরুতা ও নেক আমলে সবাই আমার চেয়ে বড়। বর্তমানে বড় বা শেষ পরিণতিতে তার আমার চেয়ে বড় হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

বিনয় ও ন¤্রতার গুণ সৃষ্টি করুন
অন্তরে নিজের ব্যাপারে কোনো ধরনের বড়ত্ব রাখবে না। বরং একথা ভাববে যে, আমার যা কিছু রয়েছে, তা খোদাপ্রদত্ত। যখন ইচ্ছা তিনি তা ছিনিয়ে নিবেন। আমি আমার মাঝে সত্তাগত কোনো ধরনের যোগ্যতা রাখি না। না আমার সত্তাগত কোনো রকম সৌন্দর্য আছে। অপরাপর মাখলুককে আল্লাহ তাআলা মর্যাদা ও বড়ত্ব দান করেছেন। এভাবে নিজেকে ছোট মনে করার নাম বিনয়। যখন কোনো মানুষের মনে এ বিষয়টি পয়দা হবে এবং সে একথা বলবে যে, আমি সবার চেয়ে ছোট আর সবাই আমার চেয়ে বড়। তাহলে কি কোনো ছোট মানুষ বড়দের সাথে অসদাচরণ করতে পারে? ছোট কখনই বড়র সাথে অসদাচরণ করবে না। কারণ, অসদাচরণ তো তখনই হয়, যখন অন্তরে নিজের বড়ত্ব থাকে। আর অন্যকে তুচ্ছ মনে করে। আমি বড় মানুষ, আমার অনেক অধিকার রয়েছে মানুষের ওপর। আর মানুষের ওপর কর্তব্য আমার অমুক অধিকার আদায় করা। যদি সে আমার অধিকার আদায় না করে, তাহলে সে অন্যায় করেছে। সুতরাং আমি তার সাথে সদাচরণ করব না। এটাই হল সকল অসদাচরণের মূল কারণ।

বিনয় ও নম্রতা দ্বারা উচ্চ মর্যাদা লাভ হয়
যদি বিনয় ও ন¤্রতা লাভ হয়, তাহলে কোনো অন্যায়-অপরাধ প্রকাশ পাবে না। তাই আমি বলি, নৈতিক চরিত্রের মূল চাবি হল বিনয় ও ন¤্রতা। আর অন্যায়-অপরাধের ভিত্তি হল আমিত্ব ও অহংকার। যদি কোনো লোক এ আমিত্ব ও অহংকারের চিকিৎসা করায় এবং বিনয় ও নম্রতা লাভ হয়ে যায়, তাহলে কোনো ধরনের অন্যায়-অপরাধ তার কাছেও আসবে না। হাদিস শরিফে রাসুলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন : 
مَنْ تَوَاضَعَ لِلَّهِ رَفَعَهُ اللَّهُ
‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টিকল্পে বিনয় প্রদর্শন করে,আল্লাহ তাআলার তার মর্যাদা বৃদ্ধি করেন।’ [মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং- ১১২৯৯]

তুমি তোমার প্রকৃতি নিয়ে ভাবো
বিনয় ও নম্রতা লাভের জন্য মানুষকে প্রথমে নিজের প্রকৃতি নিয়ে চিন্তা করতে হবে যে, আমি কী? কুরআনুল কারিম দুই শব্দে মানুষের মূল প্রকৃতি বর্ণনা করেছে। ইরশাদ হচ্ছে :
مِنْ أَيِّ شَيْءٍ خَلَقَهُ (১৮) مِنْ نُطْفَةٍ
‘তিনি তাকে কোনো উপাদান থেকে সৃষ্টি করেছেন? শুক্র থেকে তাকে সৃষ্টি করেছেন।’ (সূরা আবাসা :১৮-১৯)
যদি মানুষ এ আয়াতে চিন্তা করে, তাহলে সকল অহমিকা ও আত্মম্ভরিতা দূর হয়ে যাবে। কোনো জিনিস থেকে আল্লাহ তাআলা তোমাকে সৃষ্টি করেছেন? তোমার মৌলিক উপাদান কী? এ তো নাপাক বীর্যমাত্র।
অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে :
أَلَمْ نَخْلُقْكُمْ مِنْ مَاءٍ مَهِينٍ
‘আমি কি তোমাদেরকে তুচ্ছ ও নাপাক পানি থেকে সৃষ্টি করিনি?’ [সূরা মুরসালাত- ২০]
এটাই তোমার মূল উপাদান। যদি মানুষ তার সেই মূল উপাদানে চিন্তা-ভাবনা করে, তাহলে কখনো মন-মস্তিষ্কে অহংকার আসবে না। আবার যখন মারা যাবে,তখন তার প্রিয়জন ও আত্মীয়স্বজন কেউ তাকে ঘরে রাখার অনুমতি দিবে না। কারণ দুর্গন্ধ সৃষ্টি হবে এবং গন্ধ ছড়াবে। অতএব এটাই তোমার শুরু এবং এটাই তোমার শেষ।

বাথরুম মারেফাতের দোকান
হাকিমুল উম্মত হযরত থানবি রহ. বলতেন, কখনো তোমার মনে আন্তরিকতা ও অহংকারবোধ এলে তখন মনে মনে এই কল্পনা করে নিয়ো যে, বাথরুমে আমার পজিশন কেমন হয়ে থাকে। আমার অবস্থা কেউ দেখে ফেললে, সে আমাকে ঘৃণা করবে অথবা একথা চিন্তা করুন যে, আল্লাহ তাআলা দেহের ওপর চামড়ার পর্দা দ্বারা আবৃত করে রেছেছেন। অন্যথায় সামান্য চামড়া কোথাও থেকে সরিয়ে ফেললে দেখবেন, ভেতরে শুধুু নাপাক আর নাপাক। কোথাও রক্ত, কোথাও পুঁজ, কোথাও পেশাব, কোথাওবা পায়খানা। এই চামড়ার আবরণ সেই সকল নাপাক বস্তুগুলো ঢেকে রেখেছে। এ-ই হল তোমার বাস্তব অবস্থা। মানুষ গর্ব করে যে, আমি এমন, আমি তেমন। আমি এটা করে দিব, ওটা করে দেব। মস্তিষ্ক সামান্য ঢিলা হয়ে গেলেই সব খতম হয়ে যাবে। তারপরও তুমি নিজেকে বড় বলে দাবি কর। তাহলে বুঝতে হবে, শয়তান তোমাকে ধোঁকায় ফেলে রেখেছে। সুতরাং তুমি তোমার মূল উপাদানের চিন্তা কর।

নিজেকে সেবক মনে কর
আমাদের হযরত ডা. আবদুল হাই সাহেব বড় কাজের কথা বলতেন। এ সমস্ত ফেতনার ওপর ভিত্তি করেই এমনটি হয়ে থাকে যে, তুমি তোমাকে মাখদূম সেবা পাওয়ায় উপযুক্ত মনে করে রেখেছ।
নিজেকে খাদেম বা সেবক মনে কর। আমি খাদেম। ছোট-বড় সবার খাদেম। হ্যাঁ, খেদমতের প্রকার বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে। যদি শিক্ষক ছাত্রকে পড়ান, এটাও এক ধরনের খেদমত। তাই শিক্ষকের উচিত, নিজেকে ছাত্রদের খাদেম মনে করা। কখনো বা তিনি শিক্ষা-দীক্ষা প্রদানের খেদমত আঞ্জাম দেন। আত্মীয়স্বজন ও প্রিয়জনের খাদেম মনে কর। সেবকের ভূমিকা পালন কর। অতঃপর যখনই কারো সাথে সম্পর্ক হবে, তখন মনে কর যে, যার সাথে কথা বলছি, আমি তার খাদেম বা সেবক।

পদের চাহিদা অনুপাতে কর্তব্য পালন করা ভিন্ন ব্যাপার
যদি কেউ বড় হয়, প্রশাননিক ক্ষমতাধর হয়, তার সামনে তো সবারই মাথা নোয়াতে হয়। তার আদেশ মানতে হয়। তার সামনে সবাই বিনয় প্রদর্শন করে। তার সামনে কথাও মুখ থেকে বড় হয় না। কিন্তু সেই বিনয় প্রদর্শন যোগ্য ও মানবতার অলংকার, যা নিজের সমবয়সী ও ছোটদের সাথে প্রদর্শন করা হয়। অবশ্য কখনো কখনো কর্তব্যের খাতিরে বা দায়িত্ববোধ উজ্জীবিত হয়ে অন্যের ওপর রাগ করতে হয়। যেমন কর্মচারী ঠিকমত কাজ করছে না। এখন তার সংশোধনের লক্ষ্যে কখনো তার ওপর রাগও করতে হয়। কখনো বা শাস্তিও দিতে হয়। কখনোবা শিক্ষক ছাত্রকে সাজা দেয়। পিতা পুত্রকে সাজা দেয়। এই শাস্তি দেওয়া খেদমত। কিন্তু এ সময় মনে করতে হবে যে, আমি আমার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনার্থে এ কাজ করছি। এজন্য নয় যে, আমি আর সে আমার চেয়ে ছোট। কারণ জানা নেই যে, আল্লাহর দরবারে তার মর্যাদা কতটুকু। হতে পারে,আমার চেয়ে তার মর্যাদা বেশি।

একটি সুন্দর উদাহরণ
এ ব্যাপারে হযরত থানবি রহ. একটি সুন্দর উদাহরণ দিতেন। যদি কোনো বাদশা তার গোলামকে দারোয়ান বানিয়ে দরজায় দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলেন যে, শুধুু সেসব লোককে ভেতরে আসতে দিবে, যাদেরকে অনুমতি দেওয়া হবে। অন্যরা যেন ভেতরে না আসতে পারে। এখন যদি কোনো শাহজাদাও আসে তাহলে গোলামের এই অধিকার আছে যে, সে শাহাজাদাকে বলবে, আগে আপনার পরিচয় দিন। অতঃপর ভেতরে যাওয়ার অনুমতি হবে। যদি সে জোরপূর্বক ভেতরে প্রবেশ করতে চায়, তাহলে দারোয়ানের এই অধিকার আছে যে, সে তাকে বাধা প্রদান করবে।
এখানে লক্ষ্য করুন। একজন সাধারণ দারোয়ান শাহজাদাকে বাধা প্রদান করছে। বাহ্যত সে তার ক্ষমতা প্রয়োগ করছে। কিন্তু বলুন, দুয়ের মাঝে উত্তম কে? যে সময় দারোয়ান শাহজাদাকে বাধা প্রদান করছে, সে সময়ও তার মনে একথা নেই যে, আমি শাহজাদা থেকে উত্তম বা আমি তার চেয়ে বড়। বরং সে সময়ও তার মনে একথাই বদ্ধমূল থাকে যে, বড় তো শাহাজাদাই। কিন্তু কর্তব্যের খাতিরে আমি তাকে বাধা দিতে বাধ্য।

উস্তাদ, পীর ও পিতার শাসন
এমনিভাবে যদি কোনো উস্তাদ তার শাগরিদকে শাসন করে বা কোনো পীর সাহেব মুরিদকে শাসায় বা কোনো পিতা তার সন্তানকে ধমকায় বা কোনো ব্যাপারে বিধিনিষেধ আরোপ করে,তাহলে তার ভাবা উচিত যে, আমি আমার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করছি। বাস্তবে হয়ত আল্লাহর এই বান্দা গ্রহণযোগ্যতা ও মর্যাদার দিক থেকে আমার চেয়ে এগিয়ে আছে।

হযরত থানবি রহ. -এর কর্মনীতি
হযরত থানবি রহ.তার খানকাতে আগতদের জন্য কতিপয় নীতিমালা প্রণয়ন করে রেখেছিলেন। যখন কেউ সেই নীতিমালার কোনো কাজ করত, তখন তাকে ধমক ও শাস্তি দিতেন। এসব কিছুর পরও হযরত রহ.বলতেন, আলহামদুলিল্লাহ আমি কাউকে শাসন করলে, মনে মনে এ কল্পনা করি যে, আমি একজন দারোয়ান মাত্র। আর সে হল শাহজাদা। যেহেতু শাসন করা আমার দায়িত্ব ও কর্তব্য, তাই শাসন করি। নচেৎ সে-ই আমার থেকে উত্তম। শাসনের সময় এ কথাও মনে মনে বলি যে, হে আল্লাহ! যেভাবে আমি তাকে জবাবদিহি করছি, আমাকে আখেরাতে সেভাবে পাকড়াও করো না। বলুন দেখি! যে ব্যক্তি নিজের চেয়ে ছোটদের ব্যাপারে মনে এ কল্পনা বদ্ধমূল করেছে যে, আমি দারোয়ান আর তারা শাহজাদা, তার অন্তরে অহমিক ও দাম্ভিকতা আসবে কোথা থেকে? আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে বুঝ দান করুন।

বিনয় বুযুর্গদের সাহচর্যে অর্জিত হয়
এ বিনয় ও নম্রতা বুযুর্গদের সাহচর্যে অর্জিত হয়। বিনয়ীদের সঙ্গী হবেন; তাহলে বিনয় লাভ করে। আর অহংকারীদের সঙ্গ লাভ করলে মনে অহংকার আসবে। যাদেরকে আল্লাহ তাআলা বিনয়ের গুণে ভূষিত করেছেন, তাদের সুহবত লাভ করুন। নিজের সৃষ্টিগত উপাদান নিয়ে বেশি বেশি চিন্তা করুন। আর একথা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করুন যে, আখেরাতে যা কিছু মিলবে, দাম্ভিক প্রকৃতির লোকেরা তার কিছু পাবে না। বরং তা বিনয়ী স্বভাবের লোকেরা পাবে। নিজের দীনতা, হীনতা ও অক্ষমতা প্রকাশকারীরা পাবে।

জান্নাত দরিদ্রদের বাড়ি
হাদিস শরিফে এসেছে, একদা জান্নাত ও জাহান্নামের মাঝে বির্তক হল যে, কে শ্রেষ্ঠ? জাহান্নাম বলল, আমি অহংকারী ও দাম্ভিকদের ঘর। অর্থাৎ আমার অভ্যন্তরে যারা রয়েছে, তারা সবাই বড় বড় দাম্ভিক ও অহংকারী। কেউ রাষ্ট্রপ্রধান, কেউ মন্ত্রী, কেউবা যুগের ফেরাউন। আমি তাদের আবাসন। আর জান্নাত বলল, আমি অসহায় ও মিনকিনদের ঘর। মিসকিন তাকে বলে, যার স্বভাবে দীনতা ও রয়েছে। তাই তো রাসুলে আকরাম সা. দোয়ায় বলেছেন :
اللَّهُمَّ أَحْيِنِى مِسْكِينًا وَأَمِتْنِى مِسْكِينًا وَاحْشُرْنِى فِى زُمْرَةِ الْمَسَاكِينِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ
‘হে আল্ল্াহ! আমাকে দরিদ্র অবস্থায় জীবন দান কর দরিদ্র অবস্থায় মৃত্যু দান কর আর দরিদ্রদের সাথে আমার হাশর কর।’ [সুনানে তিরমিযি, হাদিস নং- ২২৭৫]
অনন্তর জান্নাত বলছে, আমি দরিদ্রদের ঘর। দীনতা, হীনতা অসহায়ত্ব ও দরিদ্রতা মানুষকে জান্নাতের দিকে নিয়ে যায়। অহংকার, দাম্ভিকতা ও গর্ব মানুষকে জাহান্নামের নিয়ে যায়। সুতরাং নিজের মাঝে বিনয় সৃষ্টির কথা ভাবতে থাক। এটা এলে পরে সচ্চরিত্র ও সদাচরণ আপনা-আপনিই চলে আসবে।
চতুর্থ গুণ : মুখের গ্রাস পবিত্র হওয়া
চতুর্থ গুণ, যা হুজুর সা.বর্ণনা করেছেন, তা হল : 
عفة في طعمة
‘আহার-খাদ্য পবিত্র ও হালাল হওয়া।’
ইফফাত শব্দটি দ্বারা এদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, যে বিষয় স্পষ্ট গোনাহ ও হারাম তা থেকে বেঁচে থাকা চাই। কিন্তু যে বিষয় হারাম হওয়ার ক্ষেত্রে সন্দেহ রয়েছে, এ জাতীয় সন্দেহজনক বিষয় থেকেও বেঁচে থাকা জরুরি। সন্দেহপূর্ণ ও দ্ব্যর্থবাঁচক বস্তুও পেটে না ঢোকানোর যথাসাধ্য চেষ্টা কর। কখনো কোনো বস্তু ফাতওয়ার দৃষ্টিতে তো হালাল হয়; কিন্তু সন্দেহপূর্ণ হয়। সন্দেহজনক হওয়ার সূরতে যদি সেই বস্তুটি বাস্তবেও হারাম হয়, তাহলেও তা আহার করা দ্বারা আপনার গোনাহ না হলেও স্বভাবে তার খারাপ প্রতিক্রিয়া অবশ্যই পড়বে। কারণ হা যদিও ফতোয়ার দৃষ্টিতে হালাল ছিল; কিন্তু যেহেতু বাস্তবে তা হারাম, তাই এর মন্দ প্রভাব চরিত্রে প্রতিফলিত হবে।

হারামের তামাশা ও কুফল
আমাদের অনুভূতি নষ্ট হয়ে গেছে। তাই আমরা হারামও খেয়ে ফেলি, সন্দেহজনক বস্তুও খেয়ে ফেলি। কোনোটারই প্রভাব প্রতিক্রিয়া বুঝতে পারি না। সবই সুস্বাদু মনে হয়। কিন্তু আল্লাহ তাআলা যাকে সুরুচিবোধ ও অনুভূতি দান করেছেন, সে মুখে দিয়েই বুঝতে পারে, হালাল ও হারামের স্বাদের মাঝে পার্থক্য কী। হযরত মাওলানা মুহাম্মদ ইয়াকুব সাহেব রহ. বলেন, আমি একবার কোনো একটি নিমন্ত্রেণে গিয়েছিলাম। প্রথমে বুঝতে পারিনি যে, লোকটির আয়-আমদানি হারাম। অজ্ঞতাবশত চলে গেলাম। ভাবলাম, মেজবান যেহেতু মুসলমান; তাই রুজি-রোজগারও হালাল হবে। তাই কিছু গলাধঃকরণও করলাম। কিন্তু যখন বুঝতে পারলাম, সাথে সাথে খানা ছেড়ে ওঠে দাঁড়িয়ে গেলাম। কিন্তু যে এক-দুই লুকমা অজ্ঞতাবশত খেয়ে ফেলেছিলাম, তার কুফল অন্তরে একমাস পর্যন্ত অনুভব করেছি। তার ফলে বারবার অন্তরে গোনাহের তাড়না সৃষ্টি হতো যে, এই পাপ কাজটি করে ফেলি, সেটা করে ফেলি। অথচ শরিয়তের দৃষ্টিতে তা হালাল ছিল। কারণ তার হারাম হওয়ার বিষয়টি আমার জানা ছিল না।
হালাল খাদ্যের মূল
একটু চিন্তা করুন, আমরা কোনো সারিতে আছি। আমরা তো বুঝতেই পারি না যে, কিসে নুর রয়েছে আর কিসে অন্ধকার রয়েছে। হযরত নানুতবি রহ. একটি ঘটনা শোনাতেন যে, দেওবন্দে একজন ঘাসবিক্রেতা ছিল। লোকটি ঘাস বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করত। তা থেকে সারা বছরে তিনি এক-দু পয়সা করে সঞ্চয় করে দারুল উলুম দেওবন্দের বড় বড় আসাতেযায়ে কেরামকে দাওয়াত করত। এই দাওয়াতে শুধুু শুকনো রুটি ও ডাল পাকাতো। হযরত নানুতবি রহ. বলতেন, আমি ঘাস ব্যবসায়ী এই আল্লাহর বান্দার দাওয়াতের প্রতীক্ষায় থাকতাম. কখন তিনি দাওয়াত করবেন। কারণ, যে দিন তার বাড়িতে দাওয়াত খেতাম, সেদিন থেকে মাসব্যাপী এর নূর অন্তরে অনুভব করতাম।
অতএব যদি খানা-খাদ্যে পবিত্রতা অর্জন করতে চাও, তাহলে সন্দেহজনক খাদ্য থেকেও যথাসম্ভব বিরত থাকা চাই। আল্লাহ তাআলা আমাকে ও আপনাদেরকে উক্ত চারটি গুণকে নিজের মাঝে সৃষ্টি করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

وآخر دعوانا أن الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ.

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন