বৃহস্পতিবার, ৪ আগস্ট, ২০১৬

সালাহুদ্দীন আইয়ুবী রহ. এর বোন ফাতেমা খাতুন : একজন কীর্তিমতী নারী

(এক) একজন নারীর কি কি উপাধি থাকতে পারে? একজন নারীর কী কী গুণ থাকতে পারে? একজন পর্দানশীন নারী কী কী করতে পারে? একজন ধার্মিক নারী কী কী ভাবতে পারে? একজন মুসলিম নারীর কর্মক্ষমতা ও কার্যপরিধি কতটুকু হতে পারে?
-
(দুই) বাবা-মায়ের দেয়া নাম ছিল ফাতেমা খাতুন। কিন্তু তাকে মানুষ চিনতো অনেকগুলো উপাধিতে: রাজকুমারী। গরীবের মা। জ্ঞানানুসন্ধানী। ইলমহিতৈষী। আলিমবান্ধব। রাজাদের বোন। শাসকদের ফুফী। রাজার স্ত্রী। আরো নানা জীবন্ত অভিধায় তাকে অভিহিত করা যায়। ছোট বড় মিলিয়ে তার আপন আত্মীয়দের মধ্যে প্রায় ৩৫জন রাজা ছিলেন। এতশত প্রাপ্তি তাকে অহংকারিণী-গরবীনি করে তোলে নি। উল্টো তিনি ছিলেন বিনয়ী। 
-
(তিন) বাবার নাম নাজমুদ্দীন রহ.। ভাইয়ের নাম সালাহুদ্দীন ইউসুফ রহ.। চাচার নাম আসাদুদ্দীন শেরকূহ রহ.। স্বামীর নাম নাসিরুদ্দীন। সম্পর্কে চাচাত ভাই। মানে শেরকূহের ছেলে। এতক্ষণে নিশ্চয় পরিষ্কার হয়ে গেছে, আমরা কার কথা বলছি!
-
(চার) সালাহুদ্দীন আইয়ুবীর মায়ের নাম সিত্তুল মুলক খাতুন। সন্তান লালন পালনে কতো যত্নশীল, সেটা তার ছেলে সালাহুদ্দীন আইয়ুবীকে দেখলেই আন্দায করা যায়। ঠিক একইভাবে প্রতিপালন করেছেন মেয়েকেও। 
-
(পাঁচ) সালাহুদ্দীন আইয়ুবী আপন বোনকে খুবই ভালোবাসতেন। বোনও প্রতিটি বিষয়ে ভাইয়ের সাথে লেগে থাকতেন। শেখার চেষ্টা করতেন। ক্ষেত্রবিশেষে ভাইকেও ছাড়িয়ে যেতেন। ভাইয়ের সাথেই ইলমুল ফিকহ, ইলমুল হাদীস অধ্যয়ন করেছেন। উভয়শাস্ত্রেই গভীর পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন। মেয়েদের মাদরাসায় তিনিই শিক্ষকতা করতেন। শাফেয়ী মাযহাবের ফিকহশাস্ত্রে তার ব্যুৎপত্তি ছিল বিস্ময়কর। 
-
(ছয়) নিজেই মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন। বারানী মাদরাসা। পরবর্তীতে এটা হুসামী মাদরাসা নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল। ৫৮২ হিজরীতে জুয়ানি মাদরাসাও প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠা করেই ক্ষান্ত হননি, মাদরাসার যাবতীয় ব্যয়নির্বাহের জন্যে ব্যক্তিগত সম্পত্তি থেকে বিপুল একটা অংশ মাদরাসার নামে ওয়াকফ করে দিয়েছেন। 
-
(সাত) ভাইয়ের সাথে তার প্রতিযোগিতা নিয়মিতই চলছিল। দীনি ইলমে ভাইয়ের সাথে পাল্লা দিয়েছেন। এবার শুরু করলে জাগতিক জ্ঞানে। সালাহুদ্দীন চিকিৎসাবিদ্যা অধ্যয়ন করেছিলেন। ওষুধ-পথ্য তৈরীতে পারদর্শী ছিলেন। এবার বোন এসে ভাইয়ের সাথে অবতীর্ণ হলেন। অল্প দিনের মধ্যে চিকিৎসা ও ঔষুধিবিদ্যায় ভাইকে ছাড়িয়ে গেলেন। 
-
(আট) ওষুধ তৈরীর জন্যে একটা ল্যাব তৈরী করলেন। মুসলিম বিশ্বে তিনিই বোধ হয় প্রথম নারী, যিনি ল্যাব তৈরী করেছেন। ওষুধ কারখানায় একশ নারীকর্মী নিয়োগ দিলেন। এই নারীদের সবাই কুরআনে হাফেয ছিল। অশ্বারোহণে দক্ষ ছিল। এ-দুই গুণ ছিল ল্যাবরেটরিতে চাকুরি করার মূল যোগ্যতা। 
-
(নয়) সালাহুদ্দীন আইয়ুবী রহ. বলতেন:
-আমি আমার বোন ছাড়া জীবনে আর কাউকে ঈর্ষা করিনি। সে চিকিৎসাবিদ্যা ও ওষুধিবিদ্যায় আমাকে ছাড়িয়ে গেছে। আমি রাজকার্য নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ার কারণেই এমনটা ঘটেছে। 
-
(দশ) তাকে প্রশ্ন করা হতো:
-আপনার কর্মীদের অশ্বারোহণে দক্ষ হতে হবে কেন?
-আমি তাদেরকে আল্লাহর রাস্তার লড়াকু হিসেবে দেখতে চাই! ঘোড়সওয়ার না হলে যুদ্ধে যাবে কী করে? ময়দানে তাদের কাজ হবে নার্সের। অসুস্থদের সেবা করবে। 
-আর হাফেজ হতে হবে কেন?
-তারা পুরুষদের মধ্যে কাজ করবে, আল্লাহর কিতাব সীনায় থাকলে, ঈমান মজবুত থাকবে। 
-
(এগার) এতকিছুর পরও তিনি ছিলেন একজন আদর্শ স্ত্রী। আদর্শ মাতা। শত ব্যস্ততা তাকে ঘরবিমুখ করেনি। স্বামী ছিলেন আপন চাচাত ভাই। তাদের সন্তানের নাম ছিল হুসামুদ্দীন। সালাহুদ্দীন ভাগ্নেকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। ভাগ্নে সম্পর্কে বলতেন:
-আমি হুসামুদ্দীনের মতো আর কোনও শিশুকে এতটা আদর-যত্নে লালিত-পালিত হতে দেখিনি। আর কোনও মাকেও দেখিনি আমার বোনের মতো সন্তানকে গড়েপিটে বড় করতে!
-
(বারো) যুদ্ধের আগেই ভাইয়ের কাছে প্রয়োজনীয় সাজ-সরঞ্জামের আবেদন করতেন! 
-তোমার কী কী লাগবে?
-আপাতত একপাল উৎকৃষ্ট মানের ঘোড়া হলেই চলবে। আমাদের মেডিকেল টিমের জন্যে। 
-
(তেরো) হিত্তীনের যুদ্ধে ছেলে হুসামুদ্দীন শহীদ হয়েছিলেন। খবরটা শুনে তিনি দামামাবাদকের কাছে খবর পাঠিয়েছিলেন: আরো জোরে বাজাও! এভাবেই কলিজার টুকরা পুত্রের শাহাদতকে উদযাপন করেছিলেন। অন্যদেরকেও শাহাদাতের প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। সাধারণ শহীদদের মতো শহীদ ছেলেকে হিত্তীনের ময়দানেই দাফন করেছিলেন। 
-
(তেরো) তিনি ছিলেন ইবাদতগুজার। অবিশ্রান্ত কর্মযোদ্ধা। সিরিয়া অঞ্চলের বড় আলেমদের একজন। সামরিক কমান্ডার। স্বামীর জীবদ্দশাতেই ইন্তেকাল করেছিলেন। তার পরে স্বামী দ্বিতীয়বার দ্বার পরিগ্রহণ করেন নি। কেউ প্রশ্ন করলে বলতেন:
-সিত্তুশ শাম আমাকে যেভাবে ভালোবেসেছে, আর কোনও নারী সেভাবে ভালোবাসা দিতে পারবে বলে মনে করি না!
-
স্ত্রীকেও ইতোপূর্বে প্রশ্ন করা হয়েছিল:
-আপনি কেন স্বামীকে এতবেশি ভালোবাসেন?
-আমি তার কাছে কোনও আবদার করার সাথে সাথেই সেটা সে পূরণ করতে উঠেপড়ে লেগে যেতো। একবার একটা ঔষুধিলতা পাচ্ছিলাম না, তাকে বলতেই সে বহুদূর থেকে খুঁজে এনেছিলো। 
-
(চৌদ্দ) হাত খুলে দান করতেন। কোনও বাছবিচার করতেন না দানের ক্ষেত্রে। প্রাত্যহিক দান তো ছিলই, ঘটা করে বাৎসরিক দানও করতেন। 
-
(পনের) সুলতান নুরুদ্দীন যিনকী রহ. কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বীমারিস্তানের দেখভালও তিনি কিছু কিছু করতেন। 
-
(ষোল) ছেলে হুসামুদ্দীন ছিলেন প্রথম স্বামীর সন্তান। চাচাত ভাই ছিলেন দ্বিতীয় স্বামী। প্রথম স্বামী মারা যাওয়ার পর তার সাথে বিয়ে হয়ের্ছিল। 
-
(সতের) সালাহুদ্দীন আইয়ুবী রহ. একজন খ্রিস্টান নাইটকে হত্যার করার কসম করেছিলেন। তার নাম ছিল আরনল্ড। কেউ কেউ বলে, আরনল্ড যেসব হজ কাফেলায় আক্রমণ করে সম্পদ করেছিল, তার একটাতে ‘ফাতেমা খাতুনও’ ছিলেন। তিনি ছেলের সাথে হজে যাচ্ছিলেন। 
-
(ষোল) ১৬-ই জিলকদ, ৬১৬ হিজরীতে এই অবিস্মরণীয় নারী ইন্তেকাল করেন। তার প্রতিষ্ঠিত হুসামী মাদরাসাতেই তাকে দাফন করা হয়েছিল। দিমাশকে। বর্তমান সিরিয়ার রাজধানীতে। 
-
সালাহুদ্দীন আইয়ুবীর বোন তো এমনই হবেন, সে আর বিচিত্র কী! কিন্তু এমন একজন মানুষ সম্পর্কে আমি এতদিন কিছুই জানতাম না, এটাই আমাকে অবাক করছে! না না, বেশি জানি বলে নয়, আমাদের সোনালী একটা অধ্যায়ের প্রতি আমার উদাসীনতা দেখেই অবাক হয়েছি!
- 
আমাদের ঘরে ঘরে এমন মহিয়সী কন্যা জন্ম নিক। নাজমুদ্দীরে মতো পিতা হয়ে যাক সমস্ত বাবা। প্রতিটি ভাই হয়ে যাক সালাহুদ্দীন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন