মঙ্গলবার, ২৪ নভেম্বর, ২০১৫

ইসলামের দৃষ্টিতে বিয়ে-শাদী

আদর্শ পরিবার গঠন, মানুষের জৈবিক চাহিদা পূরণ এবং মানসিক প্রশান্তি লাভের প্রধান উপকরণ হচ্ছে বিবাহ। আর বিবাহ-শাদী হচ্ছে প্রত্যেক মানুষের স্বভাব-জাত চাহিদা। এ চাহিদা পূরণার্থেই ইসলামী শরীয়ত বিবাহের হুকুম আরোপ করেছে। মানব জাতিকে অবৈধ-মিলন বিরত রাখা এবং যৌন চাহিদা মেটাবার জন্যই মহান রাব্বুল আলামিন বিবাহের নির্দেশ দিয়েছেন। আমাদের আদিপিতা হযরত আদম (আ.) পৃথিবীতে আগমন করার পর তিনি কি যেন একটি শূন্যতাবোধ করছিলেন। তার এ শূন্যতা পূরণ তথা মানবিক প্রশান্তি লাভের জন্যই মহান রাব্বুল আলামিন হযরত আদম (আ.)-এর পাঁজর থেকে সৃষ্টি করলেন হযরত হাওয়া (আ.)কে। ফলে আদম আ.-এর অশান্ত মন প্রশান্তিতে ভরে ওঠে এবং জান্নাতের হিমেল ছায়ায় তাদের পবিত্র বিবাহ সংঘটিত হয়। উক্ত বিবাহে অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ করেন ফেরেশতারা। আর এ বিবাহই হচ্ছে সর্বপ্রথম বিবাহ। এখান থেকেই বিয়ের প্রচলন শুরু হয়।হানাফী মাযহাব মতে বিবাহ হচ্ছে সুন্নতে মুআক্কাদা। বিশ্বনবী মোহাম্মদ (সা. )-এর গুরুত্বপূর্ণ একটি সুন্নাত। প্রাপ্ত বয়স্ক ও সামর্থ্যবান হলে কালবিলম্ব না করে বিবাহ করে নেয়া ঈমানী দায়িত্ব। বিয়ে শুধু জৈবিক চাহিদাই নয়, বরং মহান একটি ইবাদতও বটে। বিবাহ দ্বারা দ্বীন-দুনিয়ার কল্যাণ সাধিত হয় ।  হাদিস শরীফে রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি বিয়ে করল তার অর্ধেক দ্বীন-ঈমান পূর্ণ হয়ে গেল, সে যেন বাকি অর্ধেকের বিষয়ে আল্লাহকে ভয় করে চলে’। -মিশকাত শরীফ রাসুল (সা.) আরো ইরশাদ করেন, ‘বিবাহ হলো ঈমানের অর্ধেক, যে ব্যক্তি ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও বিয়ে করলো না  সে আমার দলভুক্ত নয়’। মহনবী সা. ইরশাদ করেন, ‘ইসলামে  বৈরাগ্য নেই এবং বৈরাগ্য জীবন-যাপন করাকেও রাসূল (সা.) নিষেধ করেছেন ’। -দারেমী শরীফ হাদিসে বলা হয়েছে, ‘স্বামী-স্ত্রী যখন একান্তে  বসে আলাপ করে, হাসি খুশি করে, তার সওয়াব নফল ইবাদতের  মতো’। বিবাহের দ্বারা পাপ কর্ম থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। জৈবিক চাহিদা পূরণ হয়। নৈতিক চরিত্রের হিফাজত হয়। বংশ পরস্পরা অব্যাহত থাকে। সুখময় সমাজ ও আদর্শ পরিবার গঠন সম্ভব হয়। মানসিকভাবে মানুষ সুস্থ থাকে। মনে প্রশান্তি আসে। স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্ক গভীর হয়। বিবাহের ফযিলত আপরিসীম।ছেলেমেয়েদের বিবাহ দেয়া পিতার দায়িত্ব। যদি পিতা না থাকে তাহলে তার অভিভাকের কতব্য হলো ছেলেমেয়েদের ভালো পাত্র দেখে বিবাহ দিয়ে দেয়া। বিবাহ যেহেতু সকলের জন্য অত্যাবশ্যক তাই মহান রাব্বুল আলামিন অতি সহজে বিবাহ সম্পন্ন করার নির্দেশ দিয়েছেন। বিবাহের মধ্যে ব্যয়বহুল ও অতিরিক্ত আড়ম্বরকে নিষেধ করা হয়েছে। এ জন্যই আমাদের প্রিয় নবী মোহাম্মদ (সা.) তার নিজের কন্যা হযরত ফাতেমা (রা.)-এর বিবাহের অনুষ্ঠান অত্যন্ত সাধাসিধেভাবে সম্পন্ন করেছিলেন। ফাতেমা (রা.)কে বিবাহ করার জন্য প্রথমে হযরত আবুবকর (রা.) হুজুর (সা.)-এর কাছে প্রস্তাব পাঠালেন। তারপর  হযরত উমর (রা.) ফাতেমাকে বিয়ে করার জন্য মহানবী সা. এর কাছে প্রস্তাব পাঠালেন। কিন্তু রাসুল সা. তাদের উভয়কে ফাতেমা রা. বয়স কম বলে ফিরিয়ে দিলেন। পরবর্তীতে হযরত আলী রা. ফাতেমা রা.কে বিয়ে করার জন্য রাসূল সা.-এর কাছে প্রস্তাব পাঠালেন, তৎক্ষণাৎ হযরত জিবরাইল আ. রাসূল সা.-এর নিকট ওহী নিয়ে আসেন, ওহী পেয়ে রাসূল সা. তার প্রস্তাব কবুল করেন এবং ফাতেমা রা.-এর সাথে তার বিবাহের ব্যবস্থা করেন। তখন হযরত আলী রা. এর বয়স ছিল ২১ এবং ফাতেমা রা. এর বয়স ছিল ১৫। হুজুর সা. তাৎক্ষণিক সাহাবাদের ডেকে নিজেই খুৎবা পড়ে  বিবাহ পড়িয়ে দিলেন এবং উপস্থিত মেহমানদের মাঝে খুরমা ও খেজুর বণ্টন করে দিলেন। তার বিয়েতে মোহর ধার্য করলেন মাত্র ৪০০ মিছকাল (দশ দিরহাম)। হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রা. থেকে বর্ণিত রাসূল সা. ইরশাদ করেন, ‘সব  চেয়ে বরকতময় বিয়ে হচ্ছে সুন্নতী বিয়ে অর্থাৎ যে বিয়েতে খরচ কম হয় এবং কোনো জাঁকজমক থাকে না। -মিশকাত শরীফকিন্ত বর্তমান সমাজে কনের পক্ষ থেকে বড় অঙ্কের মোহর এবং বরের পক্ষ থেকে মোটা অঙ্কের যৌতুক এ দুটু বিষয় নিয়ে  বিয়ে-শাদীতে  চলছে দরদাম তথা বাড়াবাড়ি। অথচ উভয়টি ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে নাজায়িজ তথা হারাম। হযরত উমর রা. বলেন, ‘হে মুসলমান সম্প্রদায়! তোমরা বিয়ে-শাদীতে মোটা অঙ্কের মোহর, জাঁকজমক এবং যৌতুক দাবি করো না, কেননা আল্লাহর  কাছে এটার কোন মর্যাদা নেই, যদি থাকত তাহলে রাসূল  সা. তার মেয়ে ফাতেমা রা. এর বিয়েতে করতেন। - তিরমিযি শরীফ। ইসলামী শরীয়তে যৌতুক নেয়া এং দেয়া হারাম। যৌতুকের কারণেই অনেক সোনার সংসার ভেঙে যায়। বিয়েতে যদি আপন পিতা নিজ মেয়ের সাথে স্ব-ইচ্ছায় বরের চাওয়া তথা দাবি ছাড়া  সাংসারিক প্রয়োজনীয় কোনো (জিনিস/মাল) দিয়ে থাকেন তাহলে সেটা যৌতুক হবে না বরং এটা জেহেয (উপঢৌকন/হাদিয়া) হবে।কিন্ত নিজের উপর বোঝা হয় কিংবা বরের চাহিদা/দাবি মেটাতে যা দেয়া হয় এটা হবে যৌতুক। সমাজে প্রচলিত যৌতুকের কোনোরূপ বৈধতা শরীয়তে নেই। তার কোনো অস্তিত্ব মহানবী সা., খোলাফায়ে রাশেদীন, সাহাবায়ে কেরামগণের যুগে ছিল না যার কারণে এটা হচ্ছে নাজায়িজ (হারাম)। যৌতুকের নেশা সমাজে মহামারীর আকারে প্রকাশ পাচ্ছে। সমাজের জন্য এক মহাবিপদ ও সামাজিক ব্যাধি হয়ে দাঁড়িছে যৌতুক। কন্যার পিতা কারো কাছ থেকে টাকা হাওলাত/কর্জ করে, কিংবা সুদের উপর নিয়ে  যৌতুকের (বরের) চাহিদা মেটায়। বর্তমান সমাজে  বিয়েতে যৌতুক না দেয়াকে অপমান মনে করা হয়।      অথচ রাসূল সা. ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি সম্মান অর্জনের জন্য বিয়ে করবে আল্লাহ তাকে অপমানিত করবেন, আর  যে ব্যক্তি বিয়েতে যৌতুক দাবি করবে সে ব্যক্তিকে আল্লাহতা’আলা দরিদ্রতা ও কঠিন আযাব ছাড়া আর কিছুই দিবেন না। আমাদের সমাজ আজ যৌতুকের জন্য পাগল, অথচ রাসূল সা. তার মেয়ে হযরত ফাতেমা রা. এর বিয়েতে  কোনো যৌতুক দেননি বা সাহাবায়ে কেরামগণও  বিয়েতে কোন যৌতুক দাবি করেননি। আসুন আমরা এ সমাজ থেকে যৌতুক প্রথা প্রতিরোধ করি এবং শরীয়ার আলোকে বিবাহ-শাদী সম্পন্ন করি। আল্লাহ আমাদের সকলকে তাওফিক দিন। আমিন। লেখক : প্রবন্ধকার, আলেম  

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন