বুধবার, ৬ জানুয়ারী, ২০১৬

সূরা মায়েদায় (আয়াত নং ১৫) উদ্ধৃত নূর শব্দের তাহকীক!

প্রশ্ন,
জনাব! পবিত্র কুরআনের সুরা মায়েদার ১৫ নং আয়াতে মহানবি হযরত মুহাম্মদ সাইল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে “নূর” বলা হল কিনা? তাহলে উনাকে (আলাইহিস সালাম) নুরের সৃষ্ট মানতে আপত্তি কোথায়?? একটু বলবেন কি?
জবাব –
আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনি খুবই সময়োপযোগী প্রশ্ন করেছেন। আর আমরাও প্রায় দেখি যে, বিভিন্ন সময় অনেক ভাই এ আয়াত তথা ﻗَﺪْ ﺟَﺎﺀﻛُﻢ ﻣِّﻦَ ﺍﻟﻠّﻪِ ﻧُﻮﺭٌ ﻭَﻛِﺘَﺎﺏٌ ﻣُّﺒِﻴﻦٌ (তোমাদের কাছে একটি উজ্জল জ্যোতি তথা একটি সমুজ্জল গ্রন্থ এসেছে। সুরা মায়েদা-১৫) দ্বারা নবীপাক (সা)-কে নূরের তৈরি বলেন এমনকি দলিলও দিয়ে থাকেন । তাদের জন্য আমার এ তথ্যবহুল লেখাটি পড়ার পর একটু ভাবতে অনুরোধ করছি!
মূলকথায় আসি-
আপনার দলিলের ভার্সনটি গভীর ভাবে উপলব্ধি করলেই দাবীর অনুকূলে দলিলের হাকিকত অনুধাবন করতে সক্ষম হবেন।
বন্ধুরা! প্রথমে আয়াতটি দেখুন। আল্লাহপাক ইরশাদ করেন- ﻗَﺪْ ﺟَﺎﺀﻛُﻢ ﻣِّﻦَ ﺍﻟﻠّﻪِ ﻧُﻮﺭٌ ﻭَﻛِﺘَﺎﺏٌ ﻣُّﺒِﻴﻦٌ “(তোমাদের কাছে একটি উজ্জল জ্যোতি তথা একটি সমুজ্জল গ্রন্থ এসেছে। সুরা মায়েদা-১৫)।”
লক্ষ্য করুন এবং বুঝে নিন যে, কুরআন কী বলছে।
আয়াতটিতে ক্রিয়াপদ হল ﻗﺪ ﺟﺎﺀ “এসেছে”, কর্ম হল ﻛﻢ “তোমাদের নিকট” আর কর্তা হল ﻧﻮﺭ ﻭ ﻛﺘﺎﺏ “নূর ও সুস্পষ্ট কিতাব”।
পরবর্তী আয়াতটি দেখুন-
ﻳَﻬْﺪِﻱ ﺑِﻪِ ﺍﻟﻠّﻪُ ﻣَﻦِ ﺍﺗَّﺒَﻊَ ﺭِﺿْﻮَﺍﻧَﻪُ ﺳُﺒُﻞَ ﺍﻟﺴَّﻼَﻡِ ﻭَﻳُﺨْﺮِﺟُﻬُﻢ ﻣِّﻦِ ﺍﻟﻈُّﻠُﻤَﺎﺕِ ﺇِﻟَﻰ ﺍﻟﻨُّﻮﺭِ ﺑِﺈِﺫْﻧِﻪِ ﻭَﻳَﻬْﺪِﻳﻬِﻢْ ﺇِﻟَﻰ ﺻِﺮَﺍﻁٍ ﻣُّﺴْﺘَﻘِﻴﻢٍ
অর্থ, এর দ্বারা আল্লাহ যারা তাঁর সন্তুষ্টি কামনা করে, তাদেরকে নিরাপত্তার পথ প্রদর্শন করেন এবং তাদেরকে স্বীয় নির্দেশ দ্বারা অন্ধকার থেকে বের করে আলোর দিকে আনয়ন করেন এবং সরল পথে পরিচালনা করেন।”
মনে রাখবেন, কুরআনের একটি আয়াত যদি আরেকটি আয়াতকে তাফসীর বা ব্যাখ্যা করে দেয়, তো সেটি সর্বাপেক্ষা উত্তম। তাই বুঝে নিন যে, এ আয়াত কী বুঝাচ্ছে। এখানে ক্রিয়াপদ হল ﻳﻬﺪﻱ ” পথ প্রদর্শন করেন/ তিনি রাস্তা দেখান” আর ক্রিয়াপদের সহিত সম্পর্কযুক্ত পদান্বয়ী অব্যয় (Preposition) হল ﺑﻪ “এর দ্বারা”।
খেয়াল করুন, “এর দ্বারা” শব্দটির আরবী হল ﺑﻪ ‘বিহী’। বচনের দিক থেকে একবচন। আর তাই তাফসীরে ইবনে কাসির, বয়ানুল কুরআন ও মাআরিফুল কুরআন সহকারে অসংখ্য তাফসীরের কিতাবে সূরা মায়েদার ১৫ নং আয়াতে উল্লিখিত নূর এবং কিতাব উভয়টি মিলে অভিন্ন একটি বস্তু তথা কুরআনকেই উদ্দেশ্য নিয়েছেন। (সূরা নিসার ১৭৪ নং আয়াতটিতে সুস্পষ্ট ভাবে পবিত্র কুরআনকে নূর আখ্যায়িত করেছেন)।
উনারা ‘নূর ও কিতাব’ দুটির মাঝখানে বিদ্যমান ‘ওয়াও’ অব্যয়কে বিশ্লেষণাত্বক অব্যয় বা Explanatory apposition বলে অভিহিত করেছেন। এমতাবস্থায় অর্থ দাঁড়ায়, “তোমাদের নিকট আমার পক্ষ হতে একটি নূর তথা সুস্পষ্ট কিতাব এসেছে।”
এ কারণে ১৫ নং আয়াতে উল্লিখিত “নূর” শব্দ হতে যারা ব্যাখ্যা স্বরূপ মহানবী (সা) -কে উদ্দেশ্য নিয়েছেন তা পরবর্তী ১৬ নং আয়াতের সুস্পষ্ট ইংগিতের বিরুদ্ধে যাওয়ায় অত্যন্ত দূর্বল। ফলে তাদের সেই ব্যাখ্যা অগ্রাহ্য হয়ে যায়।
~
পরবর্তী ১৬ নং আয়াতের সুস্পষ্ট ইংগিত হল-

ﻳَﻬْﺪِﻱ ﺑِﻪِ ﺍﻟﻠّﻪُ ﻣَﻦِ ﺍﺗَّﺒَﻊَ ﺭِﺿْﻮَﺍﻧَﻪُ ﺳُﺒُﻞَ ﺍﻟﺴَّﻼَﻡِ ﻭَﻳُﺨْﺮِﺟُﻬُﻢ ﻣِّﻦِ ﺍﻟﻈُّﻠُﻤَﺎﺕِ ﺇِﻟَﻰ ﺍﻟﻨُّﻮﺭِ ﺑِﺈِﺫْﻧِﻪِ ﻭَﻳَﻬْﺪِﻳﻬِﻢْ ﺇِﻟَﻰ ﺻِﺮَﺍﻁٍ ﻣُّﺴْﺘَﻘِﻴﻢٍ
অর্থ, এর দ্বারা আল্লাহ যারা তাঁর সন্তুষ্টি কামনা করে, তাদেরকে নিরাপত্তার পথ প্রদর্শন করেন এবং তাদেরকে স্বীয় নির্দেশ দ্বারা অন্ধকার থেকে বের করে আলোর দিকে আনয়ন করেন এবং সরল পথে পরিচালনা করেন।”
লক্ষ্য করুন-
এ আয়াতে একবচনের যমীর বা Pronoun উল্লেখ করে পূর্ববতী আয়াতে উদ্ধৃত “নূর ও কিতাব” উভয়টি মিলে অভিন্ন বস্তু উদ্দেশ্য হওয়ার দিকে ইংগিত করা হয়েছে।
যাইহোক, আমরা আবার আগের বক্তব্যে ফিরে যাই। তো বন্ধুরা! আপনারা আয়াতটির কোথাও কি পেয়েছেন যে, ‘নবীজি (সা) নূরের সৃষ্টি” ।’
হ্যাঁ, যদি তাফসীরে জালালাইনের ভাষায় ধরে নিই যে, ঐ “নূর” দ্বারা উদ্দেশ্য নবীজি সাঃ। তবুও কি আয়াতটিতে নবীজি (সাঃ) -কে নূরের “সৃষ্টি” বুঝাবে? আপনি কী বলেন!
আচ্ছা ধরুন! কোনো মাথামোটা ব্যক্তি এসে বলল যে, আয়াতটিতে নবীজি (সা)-কে নূরের “তৈরি” বুঝাবে।
কিন্তু তারপর যদি আপনি তাকে জিজ্ঞেস করেন যে, বাবাজি! আয়াতটিতে “তৈরি” শব্দের আরবীটা কি এলো তা—একটু বলবে কি?
দেখবেন, সে পালিয়ে যাওয়া ব্যতীত আর কিছুই বলতে পারবেনা। তাহলে আয়াতটি তাদের (বিদয়াতিদের) দাবীর অনুকূলে দলিলযোগ্য হল কিভাবে? ভেবে দেখবেন কি??
লেখক, প্রিন্সিপাল নূরুন্নবী। তাকমীল : দারুলউলুম আল-হোসাইনিয়া ওলামা বাজার, ফেনী।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন