প্রশ্ন –
নূর বলতে কী বুঝায়? নবীজি (সা)-কে কোন অর্থে নূর শব্দে ভূষিত করা হয়েছে?
উত্তর –
নূরের আক্ষরিক অর্থ জ্যোতি বা আলো। পারিভাষিক অর্থে প্রত্যেক ঐ সকল ব্যক্তি বা বস্তুকেও নূর নামে ভূষিত করা যায় যে নিজে সুস্পষ্ট বা আলোকিত এবং অন্যকেও সুস্পষ্ট বা আলোকিত করতে পারে।
কিতাবের ভাষায় –
১-
আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (আলাইহির রাহমাহ) মেশকাত শরীফের ব্যাখ্যামূলক গ্রন্থ “মেরকাত” (৫/৩৫৪) কিতাবে নূর শব্দের পারিভাষিক সংজ্ঞায় লিখেছেন –
النور: هو الظاهر بنفسه و المظهر لغيره . كذا في المركاة شرح مشكاة. ٥/٣٥٤.
অর্থাৎ, (ব্যবহারিক অর্থের দৃষ্টিকোণ হতে) নূর বলতে প্রত্যেক এমন কিছুকে বুঝায়, যেটি নিজে সুস্পষ্ট এবং অপরকেও সুস্পষ্ট করে।”
২-
النور هو ظاهر لذاته و مظهر لغيره . مركاة السعود شرح ابي داود، لامام ملا علي قاري عليه الرحمة
[দেখুন- আবু দাউদ শরীফ ১/১৯২, পার্শ্ব টীকা দ্রষ্টব্য, মেরকাতুছ ছঊদ ফী শরহে আবী দাউদ, মোল্লা আলী ক্বারী (রহ)।]
নূর শব্দের সংজ্ঞার আলোকে আমাদের শিক্ষা ও ইংগিত –
বন্ধুরা, উল্লিখিত নূর শব্দের পরিচিতির আলোকে ইতিমধ্যে আমাদের বুকের মাঝে চেপে থাকা বেশ কিছু বিব্রতকর প্রশ্নের সলিউশন হয়ে গেছে, তাই না! তন্মধ্যে একটি হল, কিছু সংখ্যক বিপথগামী বন্ধুরা সূরা মায়েদার ১৫ নং আয়াতে উদ্ধৃত نور و كتاب مبين (নূর ও সুস্পষ্ট কিতাব) দ্বারা মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নূরের সৃষ্টি বলিয়া আকিদা (বিশ্বাস) পোষণ করে থাকে (নাউযুবিল্লাহ) । অথচ আয়াতটিতে মুফাসসীরদের একাংশ মতে নূর হতে মহানবী (সা) উদ্দেশ্য হয়ে থাকলেও, কোনো মুফাসসীরই উনাকে নূরের সৃষ্ট বলে আখ্যায়িত করেননি। যেহেতু মহানবী (সা) আয়াতটিতে উল্লিখিত নূর শব্দের আক্ষরিক অর্থে উদ্দেশ্যে নন, বরং ব্যবহারিক তথা পারিভাষিক অর্থেই উদ্দেশ্য।
আর এ রকম ভাবে নূর শব্দের ব্যবহারিক তথা পারিভাষিক অর্থে শুধু মহানবী (সা) কেন, বরং পবিত্র কুর’আন, হিদায়াত, এলম, ঈমান, ইসলাম এবং নবুওত প্রভৃতি সবই নূর হতে পারে। কিন্তু তাই বলে কি এগুলো নূরের সৃষ্টি হয়ে গেছে? কস্মিনকালেও না। তাহলে মহানবী (সা) উক্ত নূর শব্দের ব্যবহারিক তথা পারিভাষিক অর্থে উদ্দেশ্য হওয়ায় উনাকে নূরের সৃষ্টি বলে আকিদা রাখা কিংবা প্রচার করা এসব অর্থহীন আর অজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ নয় কি?
হ্যাঁ, মহানবী (সা) উক্ত নূর শব্দের ব্যবহারিক তথা পারিভাষিক অর্থে উদ্দেশ্য হওয়ায় তিনি নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালার অতি সম্মানিত একখানা পবিত্র নূর বা অসংখ্য নূরের অধিকারী এবং তাঁর মাধ্যমে অগণিত পথহারা মানুষ ইসলাম কবুল করেছেন ও হিদায়াতের নূরে নূরান্বিত হয়েছেন। কাজেই তিনি এ সব কারণে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পক্ষ হতে সম্মানসূচক “নূর” নামে ভূষিত হয়েছেন। এটাই আহলে হক্বের স্বচ্ছ আকিদা।
আরো সহজ করে বললে, যে আয়াতে নবী কারীম (সা)-কে নূর বলে সম্বোধন করা হয়েছে সে গুলো প্রকৃত অর্থে নয়, বরং মাজাজী বা রুপক অর্থে।
তার অনেক উপমা রয়েছে। যেমন
১। আমাদের দেশকে বলা হয় সোনার বাংলা। কিন্তু আমাদের দেশ কি প্রকৃত অর্থে সোনার তৈরী? তো কেনো বলা হয় সোনার বাংলা?
২। বায়তুল্লাহ থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে অবস্থিত হেরা পর্বতকে “জাবালে নূর” (নুরের পাহাড়) বলা হয়। তো ওই পাহাড় কি প্রকৃত অর্থে নুরের তৈরী? কী বলবেন? ?
নিশ্চয় বলতে হবে যে, এগুলো মূলত রূপক অর্থে ও تشريفا বা সম্মান সূচক হিসেবে, কিন্তু প্রকৃত অর্থে নয়। অন্যথায় কোরআনুল কারীমকেও তো নূর বলা হয়েছে। তো এই নূরের কি ব্যাখ্যা দিবেন? কুরআন কি নূরের তৈরী?
ইসলাম, হিদায়াত, নবুওয়াত এসবও নূর। তো এ নূরের কী ব্যাখ্যা দিবেন?
স্বয়ং আল্লাহপাক নিজেও নূর। তো এ নূরের কী ব্যাখ্যা দিবেন? তাঁকে কি নূরের তৈরী বলবেন? (নাউযুবিল্লাহ) । তাহলে ত প্রশ্ন আসে যে, কে তাঁকে তৈরি করলেন, তাই না!!
† আরেকটি প্রশ্ন, হযরত আদম (আঃ) ছাড়া সব মানুষকে মাটির তৈরি বলা যায় কিভাবে? কারণ, আমরা তো দেখি যে তিনি ছাড়া অন্যরা সবাই বীর্য বা নোতফা থেকে সৃষ্টি।
‡ জবাব,
মানুষ এর বীর্যের উৎস হল খাবার। আর খাবারের উৎস হল মাটি। অতএব বীর্যের উৎস মাটি। কাজেই আদম আঃ ছাড়া প্রত্যেকটি মানুষ বীর্য থেকে সৃষ্ট হলেও পরোক্ষভাবে মাটি থেকেই সৃষ্টি।
আরেকটি ঊসূলী কথা হল, প্রত্যেকটি বস্তু তার মূলের দিকে প্রত্যাবর্তনকারী। সে জন্য মানুষের মৃত্যু হলে সে তার মূল তথা মাটির দিকেই প্রত্যাবর্তন করে থাকে। আমাদের মহানবী (সাঃ)-এর সৃষ্টিমূল যদি মাটি না হয়ে নূর হত, তাহলে তিনি এখন মাটিতে প্রত্যাবর্তন করেছেন কেন? এতে যুক্তি কী বলে?
‡‡ শেষকথা হল, আমাদের আরো আকিদা হল, তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসূল। আল্লাহ তায়ালার পরই তাঁর মর্যাদা। তাঁকে স্বাধারণ মানুষের মত দোষে গুণে মানুষ বলা কিংবা নিষ্পাপ আর হায়াতুন্নবী বিশ্বাস না করা—সবই গোমরাহী ও পথভ্রষ্টতা। তিনি মানুষ, যদিও সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ, তাই আমাদের বিশ্বাস থাকতে হবে যে, উনি আশরাফুল মাখলূকাত হিসেবে নূর দ্বারা নয়, বরং সর্বশ্রেষ্ঠ মাখলূকাত হিসেবে তাঁর শরীর মুবারক সর্বশ্রেষ্ঠ মাটি দ্বারাই সৃজিত হয়েছে।
বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) হতে বর্ণিত, বিশ্বনবী (সা) ইরশাদ ফরমায়েছেন—
Π হাদিসটির অন্যতম একটি সনদ বা ধারাবাহিক বর্ণনাসূত্র নিম্নরূপ । হাদিস শাস্ত্রের বিদগ্ধ মুহাদ্দিস আবুল ফারায ইবনে যওজী (রহ) [মৃত ৫৯৭হিজরী]।
↓
আবু মানছুর আল-ক্বিরার।
↓
আবু বক্বর ইবনে সাবিত।
↓
আহমদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে গালিব।
↓
আবু বক্বর আল-ইসমাঈলী।
↓
মুহাম্মদ ইবনে ইউসুফ আল-হারুভী।
↓
মুহাম্মদ ইবনে আব্দুর রহমান আল-বাগদাদী।
↓
মূসা ইবনে সাহাল আবু হারূন আল-ফাযারী।
↓
ইসহাক ইবনে ইউসুফ আল-আযরাক্ব।
↓
সুফিয়ান আস-সাওরী।
↓
আবু ইসহাক আশ-শায়বানী।
↓
আবুল আখওয়াছ আলজুশমানী।
↓
বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা)।
↓
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)। [ধারাবাহিক সূত্র এখানে সমাপ্ত হল]
↑
হাদিস ও হাদিসের তরজুমা:
↓
ﻣﺎ ﻣﻦ ﻣﻮﻟﻮﺩ ﺇﻻ ﻭﻓﻰ ﺳﺮﺗﻪ ﻣﻦ ﺗﺮﺑﺘﻪ ﺍﻟﺘﻰ ﻳﻮﻟﺪ ﻣﻨﻬﺎ ﻓﺈﺫﺍ ﺭﺩ ﺇﻟﻰ ﺃﺭﺫﻝ ﻋﻤﺮﻩ ﺭﺩ ﺇﻟﻰ ﺗﺮﺑﺘﻪ ﺍﻟﺘﻰ ﺧﻠﻖ ﻣﻨﻬﺎ ﺣﺘﻰ ﻳﺪﻓﻦ ﻓﻴﻬﺎ ﻭﺇﻧﻰ ﻭﺃﺑﻮ ﺑﻜﺮ ﻭﻋﻤﺮ ﺧﻠﻘﻨﺎ ﻣﻦ ﺗﺮﺑﺔ ﻭﺍﺣﺪﺓ ﻭﻓﻴﻬﺎ ﻧﺪﻓﻦ ( ﺍﻟﺨﻄﻴﺐ ﻋﻦ ﺍﺑﻦ ﻣﺴﻌﻮﺩ . [ ﺍﻟﺪﻳﻠﻤﻰ ﻋﻦ ﺃﻧﺲ
অনুবাদ, প্রত্যেক নবজাতক শিশুর নাভিতে (নাভির সৃষ্টি-মূলে) মাটির কিছু অংশ নিহিত থাকে যেখান থেকে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে। যখন সে তার জীবনের অন্তিম সময়ে এসে পৌছে যাবে, তখন সে ওই মাটিতেই ফিরে যাবে যেখান থেকে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে এমনকি সেখানেই সে দাফন হবে। নিশ্চয়ই আমি [রাসূল] এবং আবু বকর আর উমর (রাদিয়াল্লাহু আনহুমা) একই মাটি হতে সৃষ্ট এমনকি একই মাটিতে (আমরা তিনজন) দাফন হবো।”
[দেখুন- আল-ইলালুল মুতানাহিয়্যাহ ফিল আ- হাদীসিল ওয়াহিয়্যাহ খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ১৯৩; ইমাম ইবনে যওজী (রহ)]
আরো দেখুন, (সামান্য শাব্দিক ব্যবধানে) উল্লিখিত হাদিসটি নিচের কিতাবগুলোতেও উল্লেখ রয়েছে। যেমন :
↓
১- তারিখে বাগদাদ- খন্ড১৫, পৃষ্ঠা ৩২; (হাদিস নাম্বার ৪৩৫৫) লেখক, ঊলূমে হাদিসের প্রখ্যাত কিতাব ‘মুত্তাফাক ওয়াল মুফতারাক’ রচয়িতা খতীব আল- বাগদাদী (রহঃ) [মৃত ৪৬৩ হিঃ]।২- মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক -৩/৫১৬, হাদিস নং ৬৫৩৩; শায়খ মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক আস- সান’আনী (রহ) উনি হযরত ইবনে আব্বাস এবং আবু হোরায়রা (রা) দুজন হতে মাওকূফ সূত্রে এটি বর্ণনা করেছেন।৩- বায়হাক্বী ফী শু’আবিল ঈমান – হাদিস নং ৯২৩৮, হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা) হতে।৪- আল্লামা নূরুদ্দীন আল- হাইছামী (আলাইহির রাহমাহ) [মৃত ৮০৭ হিজরী] রচিত কাশফুল আসতার ৭৮৯।৫- আল্লামা জালালুদ্দিন আস- সুয়ূতী (আলাইহির রাহমাহ) রচিত নূরুচ্ছদূর ফী শরহিল কবূর, পরিচ্ছেদ নং ১৪।৬- নবীজিকে নূরের তৈরি প্রবক্তাদের মাননীয় আ’লা হযরত মওলানা আহমদ রেজাখান উল্টোবাস বেরলবী সাহেব রচিত, আসসানিয়্যাতুল আনীকা ফী ফাত্বওয়ায়ে আফ্রিকা (ঊর্দূ) ৮৪-৮৫, বাংলা সংস্করণ পৃষ্ঠা ৮৯]।
আল্লাহ তায়ালা আমাদের সহীহ কথা বলার ও বুঝার যোগ্যতা দিন। আমীন।
↓
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন