বুধবার, ৬ জানুয়ারী, ২০১৬

নূরে মুহাম্মদী বিশ্লেষণে মোল্লা আলী ক্বারী (রহ)-এর তাহকীক

কথিত নূরে মুহাম্মদী হাদিসে উল্লিখিত নূর শব্দের প্রকৃত মর্মার্থ বিশ্লেষণে প্রখ্যাত মুহাদ্দিস শারেহে মেশকাত আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (আলাইহির রাহমাহ)-এর
তাহকীক :
বন্ধুরা, খুব বেশী লেখব না। বেশী লিখে আপনাদের ধৈর্যহারা করতে চাই না। দলিল আর কতেক যুক্তিভিত্তিক দুটো প্রশ্ন করব। হ্যাঁ, শুধু দুটো প্রশ্ন করব। উত্তরদানে বাধিত করবেন! নতুবা ভীষণ কষ্ট পাব কিন্তু! যারা বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর শরীর মুবারক নূরের সৃষ্ট বলিয়া প্রকারান্তরে উনার শরীর মুবারকের সৃষ্টিমূল-উপাদান মাটি হওয়াকে অস্বীকার করেন, সেসব হতভাগা ভাইদের খেদমতে আরজ করছি –
১-
হযরত মুহাম্মদ (সা)-কে কোথাও নূর বলে সম্ভোধন করার দলিল থাকলেও, নূরের তৈরি বলে কোথাও সম্ভোধন করার কোনো দলিল আছে কি? তবে কি মনে করেন যে, নূর নূরের তৈরি?

২-
কথিত আছে, আল্লাহ আমার নূর সৃষ্টি করেছেন।

এবার আমি জানতে চাই, আমার নূর আর আমি কি একই জিনিষ? উদাহরণ—আমার কলম, আমার কিতাব, আমার মাদরাসা, আমার উস্তাদ।
তো এবার আপনিই বলুন,
আমি আর আমার কলম/কিতাব /মাদরাসা/উস্তাদ
একই জিনিষ, নাকি ভিন্ন ভিন্ন?
তাহলে خلق الله نوري অর্থাৎ আল্লাহ আমার নূর সৃষ্টি করেছেন শীর্ষক বাক্যটিতে
“আমার নূর”
বলতে-আমি আর নূর উভয়টি আলাদা দুটি জিনিষ নয় কি?
এমতাবস্থায় তাহলে কি প্রশ্ন উঠেনা যে, আমি বলতে যদি আমার আপাদমস্তক বুঝাই, তাহলে নূর বলে কী বুঝাতে পারি? নিশ্চয় রূহ মুবারককে বুঝাতে পারি, তাই নয় কি? যেমনটি ব্যাখ্যা দিলেন শারেহে মেশকাত আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (আলাইহির রাহমাহ)।
[ দ্রষ্টব্য, মেরকাত শরহে মেশকাত-১/১৬৮-৬৯, ঈমান অধ্যায়, দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ। হাদিস নাম্বার : ৯৪; লেখক : প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ইমাম মোল্লা আলী ক্বারী আলাইহির রাহমাহ। ]
মেরকাত কিতাব থেকে নিম্নোক্ত ইবারতখানা কপি করে বাংলায় অনুবাদ করা শেষে আপনাদের সামনে সেটির লিংক সহকারে আপডেট দিলাম। আশাকরি, আমাদের ভিন্ন মতের বন্ধুরাও (রেজভী আকিদা-ওয়ালা) এ রকম সুস্পষ্ট রেফারেন্স পাওয়ার পর নফসের গোলামি হতে বেরিয়ে না এসে পারবেন না, ইনশাআল্লাহ । আর এতদিনের ভুল আকিদা হতে তাওবা করতেও দ্বিধা করবেন না!!
আমাদের আকিদা,
নবীজি (সা)’র শান ও মান মহান আল্লাহ তায়ালার পরেই। তিনি হায়াতুন্নবী। সম্মান আর মর্যাদার দিক থেকে তিনি অতুলনীয়। উনাকে আমাদের মত স্বাধারণ মানুষ বলা গোমরাহী। উনি মানুষ হিসেবে নিশ্চয়ই মাটির সৃষ্ট, নূরের সৃষ্ট নন। যেহেতু একমাত্র ফেরেশতা জাতিই নূরের সৃষ্ট, তাই নয় কি? আর আশরাফুল মাখলূকাত হলেন মানুষ জাতি, তাই না!
বন্ধুরা, আমরা মেশকাত’র ব্যাখ্যাগ্রন্থ মেরকাত কিতাবে মোল্লা আলী ক্বারী (রহ) হতে সেই ব্যাখ্যাটি কিভাবে আছে তা এক্ষুণি দেখে নেব। সেহেতু তিনি মেরকাত কিতাবের ১ম খন্ডের ১৬৮-৬৯ নং পৃষ্ঠায় নূরে মুহাম্মদীকে রূহে মুহাম্মদী দ্বারা ব্যাখ্যা দিয়ে যা লিখেছেন, আমি তা হুবহু তাঁরই ভাষায় তুলে দিলাম-
ﻭﺭﻭﻱ : ﺃﻥ ﺃﻭﻝ ﻣﺎ ﺧﻠﻖ ﺍﻟﻠﻪ ﺍﻟﻌﻘﻞ ، ﻭﺇﻥ ﺃﻭﻝ ﻣﺎ ﺧﻠﻖ ﺍﻟﻠﻪ ﻧﻮﺭﻱ ، ﻭﺇﻥ ﺃﻭﻝ ﻣﺎ ﺧﻠﻖ ﺍﻟﻠﻪ ﺭﻭﺣﻲ ، ﻭﺇﻥ ﺃﻭﻝ ﻣﺎ ﺧﻠﻖ الله ﺍﻟﻌﺮﺵ ، ﻭﺍﻷﻭﻟﻴﺔ ﻣﻦ ﺍﻷﻣﻮﺭ ﺍﻹﺿﺎﻓﻴﺔ ﻓﻴﺆﻭﻝ ﺃﻥ ﻛﻞ ﻭﺍﺣﺪ ﻣﻤﺎ ﺫﻛﺮ ﺧﻠﻖ ﻗﺒﻞ ﻣﺎ ﻫﻮ ﻣﻦ ﺟﻨﺴﻪ ، ﻓﺎﻟﻘﻠﻢ ﺧﻠﻖ قبل ﺟﻨﺲ ﺍﻷﻗﻼﻡ ، ﻭﻧﻮﺭﻩ ﻗﺒﻞ ﺍﻷﻧﻮﺍﺭ ، ﻭﺇﻻ ﻓﻘﺪ ﺛﺒﺖ ﺃﻥ ﺍﻟﻌﺮﺵ ﻗﺒﻞ ﺧﻠﻖ ﺍﻟﺴﻤﺎﻭﺍﺕ ، ﻭﺍﻷﺭﺽ ، ﻓﺘﻄﻠﻖ الأولية ﻋﻠﻰ ﻛﻞ ﻭﺍﺣﺪ ﺑﺸﺮﻁ ﺍﻟﺘﻘﻴﻴﺪ ﻓﻴﻘﺎﻝ : ﺃﻭﻝ ﺍﻟﻤﻌﺎﻧﻲ ﻛﺬﺍ ، ﻭﺃﻭﻝ ﺍﻷﻧﻮﺍﺭ ﻛﺬﺍ ، ﻭﻣﻨﻪ ﻗﻮﻟﻪ ( ﺃﻭﻝ ﻣﺎ ﺧﻠﻖ ﺍﻟﻠﻪ ﻧﻮﺭﻱ ) ، ﻭﻓﻲ ﺭﻭﺍﻳﺔ : ﺭﻭﺣﻲ ، ﻭﻣﻌﻨﺎﻫﻤﺎ ﻭﺍﺣﺪ ، ﻓﺈﻥ ﺍﻷﺭﻭﺍﺡ ﻧﻮﺭﺍﻧﻴﺔ ﺃﻱ : ﺃﻭﻝ ﻣﺎ ﺧﻠﻖ ﺍﻟﻠﻪ ﻣﻦ ﺍﻷﺭﻭﺍﺡ ﺭﻭﺣﻲ (
অনুবাদ, “একটি বর্ণনায় রয়েছে যে, আল্লাহ তায়ালা সর্বপ্রথম বিবেক সৃষ্টি করেছেন। আরো বর্ণিত আছে, আল্লাহ তায়ালা সর্বপ্রথম আমার নূর সৃষ্টি করেছেন। আরো বর্ণিত আছে, আল্লাহ তায়ালা সর্বপ্রথম আমার রূহ সৃষ্টি করেছেন। আরো বর্ণিত আছে, আল্লাহ তায়ালা সর্বপ্রথম আরশ সৃষ্টি করেছেন।
সর্বপ্রথম হওয়ার দিক থেকে সম্ভোধনী বিষয়গুলো তা’বীল তথা বিশ্লেষণের দাবি রাখে। কাজেই সর্বপ্রথম হওয়ার দিক থেকে তাদের প্রত্যেককে স্বীয় সমজাতীয় জিনিষ অপেক্ষা সর্বপ্রথম হওয়া উদ্দেশ্য নেয়া হবে। সে হিসেবে (হাদিসে বর্ণিত) কলম তার সমজাতীয় কলম সমূহ অপেক্ষা পূর্বে হওয়া উদ্দেশ্য হবে, তেমনি ভাবে তাঁর নূরও তার সমজাতীয় নূর সমূহ অপেক্ষা পূর্বে হওয়াই উদ্দেশ্য। অধিকন্তু আরশ (ভিন্ন একটি হাদিস দ্বারা) আসমান ও জমিনের পূর্বে হওয়াই প্রমাণিত হয়ে আছে । অতএব এসবের কোনো একটি ক্ষেত্রেও সর্বপ্রথম হওয়ার মর্মার্থ শর্তহীন ভাবে বুঝাবেনা।
তাই সর্বপ্রথম হওয়ার মর্মার্থ ওখানে যেমন বুঝাল, তেমনি নূর সমূহের ক্ষেত্রেও বুঝাবে। কাজেই যেহেতু বর্ণনায় রয়েছে যে, আল্লাহপাক সর্বপ্রথম আমার নূর সৃষ্টি করেছেন। এভাবে অন্য আরেকটি বর্ণনায় রয়েছে যে, আল্লাহপাক সর্বপ্রথম আমার রূহ সৃষ্টি করেছেন। অতএব উভয় বর্ণনার মর্মার্থ একই। যেহেতু রূহই নূর। অর্থাৎ আল্লাহপাক সর্বপ্রথম আমার নূর তথা রূহ সৃষ্টি করেছেন।”
[অনুবাদ এখানে শেষ হল]
এবার ভালভাবে যাচাই করার জন্য কিতাবটির ১ম খন্ডের ১৬৮-৬৯ নং পৃষ্ঠার সরাসরি লিংকটিতে ক্লিক করুন।


জগৎ বিখ্যাত শাইখুল ইসলাম আল্লামা ইবনে কাইয়্যুম আলজাওযিয়াহ (রহঃ) [মৃত৭৫১হিজরী] তাঁর সুবিখ্যাত কিতাব “রূহ” গ্রন্থের ২০৬ নং পৃষ্ঠায় রূহ মুবারককে আল্লাহ তায়ালার নূর বলে অভিহিত করার কথা ব্যক্ত করেছেন। তিনি লিখেছেন—
ﻭﻗﺎﻝ ﺑﻌﻀﻬﻢ ﺍﻻﺭﻭﺍﺡ ﻧﻮﺭ ﻣﻦ ﺍﻧﻮﺍﺭ ﺍﻟﻠﻪﺗﻌﺎﻟﻲ . ﻛﺘﺎﺏ ﺍﻟﺮﻭﺡ
অনুবাদ, মুহাদ্দিসগণের অনেকে রূহ সমূহকে আল্লাহ তায়ালার নূর বলে আখ্যায়িত করেছেন।
শারেহে বুখারী আল্লামা ইমাম কাসতালানী (রহ) রচিত “আল-মাওয়াহিবুল লাদূনিয়া’ কিতাবের অষ্টম পৃষ্ঠায়ও রূহকে সম্মানসুচক ভাবে নূর নামে সম্ভোধন করার দলিল রয়েছে। তিনি লিখেছেন—
ان الله لما خلق نور نبي محمد صلي الله عليه وسلم امره ان ينظر الي انوار الانبياء

অনুবাদ আল্লাহ তায়ালা যখন নবী মুহাম্মদ (সা)-এর নূর সৃষ্টি করেছেন, তখন তাঁকে [ঐ নূরকে] অন্যান্য নবীদের (আলাইহিমুস সালাম) নূরের দিকে তাকে বলেন।”
[তথ্য সূত্র— আল-মাওয়াহিবুল লাদূনিয়া ১/৮]
কাজেই দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে পারি যে, নূরে মুহাম্মদী অর্থ রূহে মুহাম্মদী তথা মুহাম্মদ (সাঃ)-এর রূহ মোবারক। নূরের উপরোক্ত বর্ণনাটিকে এভাবে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করার মাধ্যমে সকল প্রকারের মতানৈক্য আর শিরিকি আকিদা বিশ্বাসের মূলোৎপাটন করা সম্ভব হবে। আর এটাই আহলে হক্ব উলামায়ে দেওবন্দ, উলামায়ে মাক্কী ওয়া মাদানীর। আল্লাহ পাক আমাদের গোঁড়ামি হতে রক্ষা করুন এবং প্রকৃত আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাতের দলভুক্ত করুন। আমীন।
লিখেছেন- প্রিন্সিপাল।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন