বুধবার, ৬ জানুয়ারী, ২০১৬

বিশ্বনবী (সা)-এর দেহ মুবারক নূরের তৈরি, নাকি মাটির তৈরি?

হাদিসে জাবিরে বর্ণিত “নূর” শব্দ হতে রূহে মুহাম্মদী উদ্দেশ্য হওয়ার প্রমাণ :
ভুমিকা : সব ধর্মেই তিন ধরণের মানুষ পাওয়া যায়। নিষ্ঠাবান, উদার এবং ভণ্ড। কাজেই প্রথম দু শ্রেণীর অনুসারিদের বাদ দিয়ে ভন্ডদের দিয়ে ধর্মকে চ্যালেঞ্জ করা দুরভিসন্ধি বৈ কিছু না। তদ্রূপ আমাদের মুসলিমদের ভেতরও তৃতীয় শ্রেণীর তথা ভণ্ডদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েই চলছে। মাইজভাণ্ডারী, চন্দ্রপুরী, আটরশী , কালিয়াপুরী, সিরাজগঞ্জী, দেওয়ানবাগী, কুতুববাগী, রাজারবাগী, রেজভী আর ওয়াহাবী-লামাযহাবী প্রভৃতি অন্যতম ভ্রষ্ট ফেরকা। রাসুল (সা) সম্পর্কে এদেশীয় দুটি ফেরকা বাড়াবাড়ি আর ছাড়াছাড়ি দু রকম আকিদা পোষণ করে। প্রথমত, ওয়াহাবী-লামাযহাবীরা বলেন যে, রাসুল (সা) আমাদের মতই স্বাধারণ মানুষ। অপরদিকে আহলে বিদয়াত রেজভী তথা ভান্ডারী সুন্নীরা ওয়াহাবী-লামাযহাবীদের উপরিউক্ত কথার প্রতিউত্তরে সীমানা ডিঙ্গিয়ে বলেন যে, রাসুল (সা) মানুষই নন। তাহলে তিনি কে? হ্যাঁ, তিনি হলেন আল্লাহ’র জাত। (মা’আজাল্লাহ)। আমরা এ দু’শ্রেণীর এহেন বক্তব্যের কড়া নিন্দা জানাই। আমরা তাদের দু পক্ষেরই যথাক্রমে ছাড়াছাড়ি আর বাড়াবাড়ি থেকে সরে এসে বলে থাকি যে, রাসুল (সা) আমাদের মতই মানুষ, তবে স্বাধারণ মানুষ নন, অস্বাধারণ এবং অতুলনীয় মানুষ। আল্লাহ তায়ালার পরই যাঁর শান-মান ও মর্যাদা। তিনি আল্লাহ’র জাত নন। তাঁর শান-মান ও মর্যাদা বৃদ্ধির অযুহাতে তাঁকে যেমন আল্লাহ’র জাত বললে কুফুরী হবে, তেমনি মাটির সৃষ্ট বলে অস্বীকার করলেও কুফুরী হবে। আহলে বিদয়াত ভান্ডারী সুন্নীরা যেসব রেওয়ায়েত আর আয়াত দ্বারা রাসূল (সা)-কে আল্লাহ’র জাত কিংবা আল্লাহ’র জাতের অংশ বলে দাবি করে, নিচে দীর্ঘ আলোচনার মাধ্যমে আমরা তাদের সেই দাবি ভুল ও ভিত্তিহীন বলে সাব্যস্ত করব, ইনশাআল্লাহ।
আলোচনা শুরু:
প্রথমত, যেসব আয়াতে নবী কারীম (সা)- কে নূর বলে সম্বোধন করা হয়েছে সে গুলো প্রকৃত অর্থে নয়, বরং মাজাজী বা রুপক অর্থে। তার অনেক উপমা রয়েছে। যেমন—

√ আমাদের দেশকে বলা হয় সোনার বাংলা। কিন্তু আমাদের দেশ কি প্রকৃত অর্থে সোনার তৈরী? তো কেনো বলা হয় সোনার বাংলা?
√ বায়তুল্লাহ থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে অবস্থিত হেরা পর্বতকে “জাবালে নূর” (নুরের পাহাড়) বলা হয়। তো ওই পাহাড় কি প্রকৃত অর্থে নুরের তৈরী? কী বলবেন? নিশ্চয় বলতে হবে যে, এগুলো মূলত রূপক অর্থে এবং ﺗﺸﺮﻳﻔﺎ বা সম্মান সূচক হিসেবে, কিন্তু প্রকৃত অর্থে নয়। অন্যথায় কোরআনুল কারীমও নূর (দেখুন- সূরা নিসা: ১৭৪)। তো এই নূরের কি ব্যাখ্যা দিবেন? কুরআন কি নূরের তৈরী? কখনো নয়।
√ ইসলাম (দেখুন- সূরা যুমার: ২২), হিদায়াত (দেখুন- সূরা বাক্বারা: ২৫৭), নবুওয়াত, ইলম ইত্যাদি এসবও নূর। তো এই নূরের কী ব্যাখ্যা দিবেন?
√ স্বয়ং আল্লাহপাক নিজেও নূর (দেখুন- সূরা নূর: ৩৫) । তো এই নূরের কী ব্যাখ্যা দিবেন? তাঁকে কি নূরের তৈরী বলবেন? তাহলে ত প্রশ্ন আসে যে, কে তাঁকে তৈরি করলেন? নাউযুবিল্লাহ। অনুরূপ ভাবে নবীকরীম (সা) তিনিও মুফাসসীরদের একটি অংশের ব্যাখ্যা অনুযায়ী পবিত্র কুরআনে (সূরা মায়েদা: ১৫) নূর নামে ভূষিত হয়েছেন বলে মনে করা হয়। কিন্তু তাই বলে কি তিনি নূরের সৃষ্ট হয়ে গেলেন? অবশ্যই না। সুতরাং বুঝা গেল, নূর নামে ভূষিত হওয়ার কারণেই নূরের সৃষ্ট হয়ে যায় না। কাজেই কোনো পীর ফকিরের অন্ধ অনুসারী হয়ে নয়, বরং পবিত্র কুরআন আর সহীহ সুন্নাহর পরিভাষার আলোকে ও সালফে সালেহীনের ব্যাখ্যা মতে নিজের বিবেককেই প্রশ্ন করুন। ইনশাআল্লাহ সঠিক জবাব পেয়ে যাবেন।
→→→
দ্বিতীয়ত , আমাদের আরো আকিদা হল, তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসূল। আল্লাহ তায়ালার পরই তাঁর মর্যাদা। তাঁকে স্বাধারণ মানুষের মত দোষে গুণে মানুষ বলা কিংবা নিষ্পাপ আর হায়াতুন্নবী বিশ্বাস না করা—সবই গোমরাহী ও পথভ্রষ্টতা। তিনি মানুষ, যদিও সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ, তাই আমাদের বিশ্বাস থাকতে হবে যে, উনি আশরাফুল মাখলূকাত হিসেবে নূর দ্বারা নয়, বরং সর্বশ্রেষ্ঠ মাখলূকাত হিসেবে তাঁর শরীর মুবারক সর্বশ্রেষ্ঠ মাটি দ্বারাই সৃজিত হয়েছে।

ইবনে মাসউদ (রা) হতে বর্ণিত হাদিসখানা আল্লামা ইমাম জালালুদ্দিন আসসুয়ূতী (রহ) স্বীয় সংকলিত “জামেউল আহাদীস” (১৯/২৮৭) ও হাদিস নং (২০৭৭৬) কিতাবেও নিয়ে এসেছেন।
হাদিসখানা হল— ﻣﺎ ﻣﻦ ﻣﻮﻟﻮﺩ ﺇﻻ ﻭﻓﻰ ﺳﺮﺗﻪ ﻣﻦ ﺗﺮﺑﺘﻪ ﺍﻟﺘﻰ ﻳﻮﻟﺪ ﻣﻨﻬﺎ ﻓﺈﺫﺍ ﺭﺩ ﺇﻟﻰ ﺃﺭﺫﻝ ﻋﻤﺮﻩ ﺭﺩ ﺇﻟﻰ ﺗﺮﺑﺘﻪ ﺍﻟﺘﻰ ﺧﻠﻖ ﻣﻨﻬﺎ ﺣﺘﻰ ﻳﺪﻓﻦ ﻓﻴﻬﺎ ﻭﺇﻧﻰ ﻭﺃﺑﻮ ﺑﻜﺮ ﻭﻋﻤﺮ ﺧﻠﻘﻨﺎ ﻣﻦ ﺗﺮﺑﺔ ﻭﺍﺣﺪﺓ ﻭﻓﻴﻬﺎ ﻧﺪﻓﻦ ‏( ﺍﻟﺨﻄﻴﺐ ﻋﻦ ﺍﺑﻦ ﻣﺴﻌﻮﺩ . ‏[ ﺍﻟﺪﻳﻠﻤﻰ ﻋﻦ ﺃﻧﺲ
অনুবাদ, “প্রত্যেক নবজাতক শিশুর নাভিতে মাটির কিছু অংশ নিহিত থাকে যেখান থেকে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে। যখন সে তার জীবনের অন্তিমসময়ে এসে পৌছে যাবে, তখন সে ওই মাটিতেই ফিরে আসবে যেখান থেকে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে এমনকি সেখানেই সে দাফন হবে। নিশ্চয়ই আমি [রাসূল] এবং আবু বকর আর উমর (রাদিয়াল্লাহু আনহুমা) একই মাটি হতে সৃষ্ট এমনকি একই মাটিতে (আমরা তিনজন) দাফন হবো।” হাদিসটি ইমাম খতিব আলবাগদাদী তিনি ইবনে মাসউদ (রা) হতে আর আল্লামা দায়লামী (রহ) হযরত আনাস (রা) হতে বর্ণনা করেছেন।”
তথ্য সূত্র—
১- তারিখে বাগদাদ- খন্ড১৫, পৃষ্ঠা ৩২; (হাদিস নাম্বার ৪৩৫৫) লেখক, ঊলূমে হাদিসের প্রখ্যাত কিতাব “মুত্তাফাক ওয়াল মুফতারাক” রচয়িতা খতীব আল-বাগদাদী (রহঃ) [মৃত ৪৬৩ হিঃ]।
২- মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক -৩/৫১৬, হাদিস নং ৬৫৩৩; শায়খ মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক আস-সান’আনী (রহ) উনি হযরত ইবনে আব্বাস এবং আবু হোরায়রা (রা) দুজন হতে মাওকূফ সূত্রে এটি বর্ণনা করেছেন।
৩- বায়হাক্বী ফী শু’আবিল ঈমান, হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা) হতে।
৪- আল্লামা ইবনে যওজী (আলাইহির রাহমাহ) আল- মাওদ্বু’য়াত (২/৭৭)।
৫- আল্লামা জালালুদ্দিন আস- সুয়ূতী (আলাইহির রাহমাহ) রচিত নূরুচ্ছদূর ফী শরহিল কবূর, পরিচ্ছেদ নং ১৪।
৬- আল্লামা সুয়ূতী (আলাইহির রাহমাহ) রচিত, জামেউল আহাদীস-১৯/২৮৭।
৭- তালখীছুল ইলালিল মুতানাহিয়্যাহ-৬৫, ইমাম যাহাবী (রহ)।
৮- মু’আজামু শুয়ূখিত তিবরী- ৬২৮, ইবনে মাসউদ হতে।
৯- আদ-দ্বূ’আফা ওয়াল মাতরূকীন- ১৬৩, ইমাম দার-আলকুতনী।
১০- আল-ইরশাদ- ২/৫০৩, ইমাম আল-খালিলী (রহ)।
১১- আল-মুগনী- ২/৬৮৩, ইমাম যাহাবী (রহ)।
১২- আল-ইলালুল মুতানাহিয়্যাহ ফিল আহাদীসিল ওয়াহিয়্যাহ- ১/১৯৩, ইমাম ইবনে যওজী (রহ) [মৃত ৫৯৭]।
১৩- তানজীহুশ শারীয়াতিল মারফূয়াহ আনিল আখবারিশ শানীয়াতিল মাওদ্বূয়াহ- ১/৩৭৩, ইমাম নূরুদ্দীন ইবনে আররাক (রহ) [মৃত ৯৬৩হিজরী ]।
১৪- আল-হিলইয়াতুল আওলিয়া ওয়া ত্ববক্বাতুল আছফিয়াহ- ২/২৮০, শায়খ আবু নোয়াঈম ইস্ফাহানী (রহ) [ মৃত ৪৩০ হিজরী]।
১৫- মুফতি শফী (রহ) রচিত , মা’আরিফুল কুরআন-৬/১১৮।
১৬- আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী (রহ) রচিত, উমদাদুল ক্বারী ফি শরহে বুখারী – ৫/২২৬, সালাতুল জানাযা অধ্যায়।
১৭- আল্লামা তিবরানী সংকলিত ও ইবনে উমর (রা) হতে বর্ণিত ‘আল- মু’জামুল কাবীর’ দ্রষ্টব্য।
১৮- হাকিম তিরমিযি (রহ) তিনি “আন-নাওয়াদিরুল ঊসুল” কিতাবে ইবনে মাসউদ (রা) হতে মাওকূফ সূত্রে এটি বর্ণনা করেছেন। ইমাম হাকিম (রহ) এ ব্যাপারে লিখেছেন ﺻﺤﻴﺢ ﺍﻻﺳﻨﺎﺩ অর্থাৎ এর সনদ সঠিক। ]
১৯- আবু সাঈদ খুদরী (রা) প্রমুখ হতে ইমাম বাজ্জার এবং হাকিম তিরমিযি (রহ) উনারা বর্ণনা করেছেন।
২০- মুসনাদে দাইলামী- ৪/২৮, হাদিস নং ৬০৮৭ ইবনে মাসউদ হতে; হযরত আনাস (রা) হতে হাদিস নং ৬০৮৮।
২১- তাফসীরে মাজহারী ৬/৭৩, প্রণেতা কাজী ছানাউল্লাহ পানিপথী [১৮৮৩ খ্রীঃ]।
২২- ইমাম ইবনু আ’দী (আলাইহির রাহমাহ) রচিত “আল-কামিল” (৭/১৫০) ।
২৩- হযরত আব্দ ইবনে হুমায়েদ (রহ) তিনি হযরত আ’তা আল-খোরাসানী হতে ।
২৪- শায়খ আদ্দিনাওয়ারী (রহ) তিনি হেলাল ইবনে ইয়াসাফ (রহ) হতে এটি “আল-মাজালিসাহ” কিতাবে বর্ণনা করেছেন।”
২৫- মক্কা বংশোদ্ভূত আল্লামা মুহাম্মদ ইবনে আহমদ (ইবনু দ্বিয়া আল- মাক্কী নামে প্রসিদ্ধ) [জন্ম-মৃত্যু ৭৮৯-৮৫৪ হিজরী] রচিত “তারিখু মাক্কাতিল মুশাররাফাহ ওয়াল মাসজিদিল হারাম ওয়াল মাদীনাতিশ শারীফাহ ওয়াল ক্ববরিশ শারীফ” (পৃষ্ঠা নং ৩২৫)।
~
তৃতীয়ত, আমরা জানি যে, হাদিসে জাবের (রা) দ্বারা বিশ্বনবী (সাঃ)-এর নূর সর্বপ্রথম সৃষ্টি করা হয়েছিল-এরকমই বুঝা যায়, তাই না?

কিন্তু বন্ধু! আপনি নবীজি (সাঃ)-কে সর্বপ্রথম সৃষ্টি করা হয়েছিল, এ বলে আসলে কী বুঝাতে চান? নবীজির (সাঃ) শরীর মোবারক সর্বপ্রথম সৃষ্টি; নাকি নবীজির (সাঃ) রূহ মোবারক সর্বপ্রথম সৃষ্টি? কোনটা বুঝাতে চান একটু পরিস্কার করে বলুন!”
~
হাদিসে জাবের (রা) দ্বারা বিশ্বনবী (সাঃ)-এর নূর সর্বপ্রথম সৃষ্টি করা হয়েছিল—এ হিসেবে জানার বিষয় হল, হাদিসে জাবিরে বর্ণিত “আমার নূর” আর “আমি” দু’নোটি কি একই জিনিষ? উদাহরণ- আমার কলম, আমার কিতাব, আমার মাদরাসা, আমার উস্তাদ। তো এবার আপনিই বলুন, আমি আর আমার কলম/কিতাব /মাদরাসা/উস্তাদ একই জিনিষ, নাকি ভিন্ন ভিন্ন?

তাহলে خلق الله نوري অর্থাৎ আল্লাহ আমার নূর সৃষ্টি করেছেন শীর্ষক বাক্যটিতে “আমার নূর” বলতে-আমি আর নূর উভয়টি আলাদা দুটি জিনিষ নয় কি?
এমতাবস্থায় তাহলে কি প্রশ্ন উঠেনা যে, আমি বলতে যদি আমার আপাদমস্তক বুঝাই, তাহলে নূর বলে কী বুঝাতে পারি? নিশ্চয় রূহ মুবারককে বুঝাতে পারি, তাই নয় কি? যেমনটি ব্যাখ্যা দিলেন শারেহে মেশকাত আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (আলাইহির রাহমাহ)। দলিল প্রমাণ সামনে দেখুন।
~
জাবের (রাঃ) এর সূত্রে বর্ণিত হাদিসটিতে রাসূল (সাঃ) এর নামে যে রেওয়ায়েত প্রচলিত আছে, সেটিতে উল্লিখিত “নূর” শব্দটি রূহে মুহাম্মদী অর্থে বিশ্লেষিত। কারণ সর্বপ্রথম সৃষ্টি হওয়া বিষয়ক অনেক গুলো রেওয়ায়েত পাওয়া যায়।

যে কারণে সর্বপ্রথম হওয়ার দিক থেকে সম্ভোধনী বিষয়গুলো তা’বীল তথা বিশ্লেষণের দাবি রাখে। কাজেই সর্বপ্রথম হওয়ার দিক থেকে তাদের প্রত্যেককে স্বীয় সমজাতীয় জিনিষ অপেক্ষা সর্বপ্রথম হওয়া উদ্দেশ্য নেয়া হবে।
জাবের (রাঃ) এর সূত্রে বর্ণিত হাদিসটিতে রাসূল (সাঃ) এর নামে যে রেওয়ায়েত প্রচলিত আছে, সেটিতে উল্লিখিত “নূর” শব্দ হতে রূহে মুহাম্মদী উদ্দেশ্য। নিচে রূপকার্থে রূহকেও নুর বলার কতেক দলিল দস্তাবেজ দেখানো হল—

আল্লামা কাসতালানী (রহঃ) তিনি স্বীয় কিতাব “মাওয়াহিবে লাদূনিয়া”র ৮ম পৃষ্ঠায় নূরে মুহাম্মদীর বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন—
~
ﺍﻥ ﺍﻟﻠﻪ ﺗﻌﺎﻟﻲ ﻟﻤﺎ ﺧﻠﻖ ﻧﻮﺭ ﻧﺒﻲ ﻣﺤﻤﺪ ﺻﻠﻲ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ ﺍﻣﺮﻩ ﺍﻥ ﻳﻨﻈﺮ ﺍﻟﻲ ﺍﻧﻮﺍﺭ ﺍﻻﻧﺒﻴﺎﺀ. ﻣﻮﺍﻫﺐ ﻟﺪﻭﻧﻴﺔ ٨

অর্থাৎ “আল্লাহ তায়ালা যখন নূরে মুহাম্মদী সৃষ্টি করলেন তখন তাকে আনওয়ারে আম্বিয়া (অন্যান্য সকল নবীর নূর মোবারক) -এর প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে বললেন।” এখানে ﻧﻮﺭ ﻣﺤﻤﺪﻱ (নূরে মুহাম্মদী) থেকে অবশ্যই রূহে মুহাম্মদী উদ্দেশ্য। যদি এ কথা মানতে কাহারো দ্বিধা লাগে তাহলে তার নিকট আমার প্রশ্ন যে, “আনওয়ারে আম্বিয়া” থেকে আপনি কী উদ্দেশ্য নিবেন? অথচ, তিনি বিশ্বনবীর ক্ষেত্রে যেরূপ “নূর” শব্দ ব্যবহার করেছেন, সেরূপ সকল নবীদের ক্ষেত্রেও তিনি বহুবচন শব্দ “আনওয়ার” ব্যবহার করেছেন।
বন্ধুরা, আমরা মেশকাত’র ব্যাখ্যাগ্রন্থ মেরকাত কিতাবে মোল্লা আলী ক্বারী (রহ) [মৃত১০১৪ হিঃ] হতে সেই ব্যাখ্যাটি কিভাবে আছে তা এক্ষুণি দেখে নেব।

তিনি মেরকাত কিতাবের ১ম খন্ডের ১৬৮-৬৯ নং পৃষ্ঠায় নূরে মুহাম্মদীকে রূহে মুহাম্মদী দ্বারা ব্যাখ্যা দিয়ে যা লিখেছেন, তা হুবহু তাঁরই ভাষায় তুলে দিলাম-
~
ﻭﺭﻭﻱ : ﺃﻥ ﺃﻭﻝ ﻣﺎ ﺧﻠﻖ ﺍﻟﻠﻪ ﺍﻟﻌﻘﻞ ، ﻭﺇﻥ ﺃﻭﻝ ﻣﺎ ﺧﻠﻖ ﺍﻟﻠﻪ ﻧﻮﺭﻱ ، ﻭﺇﻥ ﺃﻭﻝ ﻣﺎ ﺧﻠﻖ ﺍﻟﻠﻪ ﺭﻭﺣﻲ ، ﻭﺇﻥ ﺃﻭﻝ ﻣﺎ ﺧﻠﻖ الله ﺍﻟﻌﺮﺵ ، ﻭﺍﻷﻭﻟﻴﺔ ﻣﻦ ﺍﻷﻣﻮﺭ ﺍﻹﺿﺎﻓﻴﺔ ﻓﻴﺆﻭﻝ ﺃﻥ ﻛﻞ ﻭﺍﺣﺪ ﻣﻤﺎ ﺫﻛﺮ ﺧﻠﻖ ﻗﺒﻞ ﻣﺎ ﻫﻮ ﻣﻦ ﺟﻨﺴﻪ ، ﻓﺎﻟﻘﻠﻢ ﺧﻠﻖ قبل ﺟﻨﺲ ﺍﻷﻗﻼﻡ ، ﻭﻧﻮﺭﻩ ﻗﺒﻞ ﺍﻷﻧﻮﺍﺭ ، ﻭﺇﻻ ﻓﻘﺪ ﺛﺒﺖ ﺃﻥ ﺍﻟﻌﺮﺵ ﻗﺒﻞ ﺧﻠﻖ ﺍﻟﺴﻤﺎﻭﺍﺕ ، ﻭﺍﻷﺭﺽ ، ﻓﺘﻄﻠﻖ الأولية ﻋﻠﻰ ﻛﻞ ﻭﺍﺣﺪ ﺑﺸﺮﻁ ﺍﻟﺘﻘﻴﻴﺪ ﻓﻴﻘﺎﻝ : ﺃﻭﻝ ﺍﻟﻤﻌﺎﻧﻲ ﻛﺬﺍ ، ﻭﺃﻭﻝ ﺍﻷﻧﻮﺍﺭ ﻛﺬﺍ ، ﻭﻣﻨﻪ ﻗﻮﻟﻪ ( ﺃﻭﻝ ﻣﺎ ﺧﻠﻖ ﺍﻟﻠﻪ ﻧﻮﺭﻱ ) ، ﻭﻓﻲ ﺭﻭﺍﻳﺔ : ﺭﻭﺣﻲ ، ﻭﻣﻌﻨﺎﻫﻤﺎ ﻭﺍﺣﺪ ، ﻓﺈﻥ ﺍﻷﺭﻭﺍﺡ ﻧﻮﺭﺍﻧﻴﺔ ﺃﻱ : ﺃﻭﻝ ﻣﺎ ﺧﻠﻖ ﺍﻟﻠﻪ ﻣﻦ ﺍﻷﺭﻭﺍﺡ ﺭﻭﺣﻲ (

অনুবাদ, “একটি বর্ণনায় রয়েছে যে, আল্লাহ তায়ালা সর্বপ্রথম বিবেক সৃষ্টি করেছেন। আরো বর্ণিত আছে, আল্লাহ তায়ালা সর্বপ্রথম আমার নূর সৃষ্টি করেছেন। আরো বর্ণিত আছে, আল্লাহ তায়ালা সর্বপ্রথম আমার রূহ সৃষ্টি করেছেন। আরো বর্ণিত আছে, আল্লাহ তায়ালা সর্বপ্রথম আরশ সৃষ্টি করেছেন।
সর্বপ্রথম হওয়ার দিক থেকে সম্ভোধনী বিষয়গুলো তা’বীল তথা বিশ্লেষণের দাবি রাখে। কাজেই সর্বপ্রথম হওয়ার দিক থেকে তাদের প্রত্যেককে স্বীয় সমজাতীয় জিনিষ অপেক্ষা সর্বপ্রথম হওয়া উদ্দেশ্য নেয়া হবে। সে হিসেবে (হাদিসে বর্ণিত) কলম তার সমজাতীয় কলম সমূহ অপেক্ষা পূর্বে হওয়া উদ্দেশ্য হবে, তেমনি ভাবে তাঁর নূরও তার সমজাতীয় নূর সমূহ অপেক্ষা পূর্বে হওয়াই উদ্দেশ্য। অধিকন্তু আরশ (ভিন্ন একটি হাদিস দ্বারা) আসমান ও জমিনের পূর্বে হওয়াই প্রমাণিত হয়ে আছে । অতএব এসবের কোনো একটি ক্ষেত্রেও সর্বপ্রথম হওয়ার মর্মার্থ শর্তহীন ভাবে বুঝাবেনা। তাই সর্বপ্রথম হওয়ার মর্মার্থ ওখানে যেমন বুঝাল, তেমনি নূর সমূহের ক্ষেত্রেও বুঝাবে। কাজেই যেহেতু বর্ণনায় রয়েছে যে, আল্লাহপাক সর্বপ্রথম আমার নূর সৃষ্টি করেছেন। এভাবে অন্য আরেকটি বর্ণনায় রয়েছে যে, আল্লাহপাক সর্বপ্রথম আমার রূহ সৃষ্টি করেছেন। অতএব উভয় বর্ণনার মর্মার্থ একই। যেহেতু রূহই নূর। অর্থাৎ আল্লাহপাক সর্বপ্রথম আমার নূর তথা রূহ সৃষ্টি করেছেন।” [অনুবাদ এখানে শেষ হল] ↓
এবার ভালভাবে যাচাই করার জন্য কিতাবটির ১ম খন্ডের ১৬৮-৬৯ নং পৃষ্ঠার সরাসরি লিংকটিতে ক্লিক করুন।

http://library.islamweb.net/newlibrary/display_book.php?bk_no=79&ID=4&idfrom=10&idto=404&bookid=79&startno=92
~
জগৎ বিখ্যাত শাইখুল ইসলাম আল্লামা ইবনে কাইয়্যুম (রহঃ) [মৃত৭৫১হিজরী] তাঁর সুবিখ্যাত কিতাব “রূহ” গ্রন্থে ( পৃষ্ঠা নং ২০৬) লিখেছেন-

ﻭﻗﺎﻝ ﺑﻌﻀﻬﻢ ﺍﻻﺭﻭﺍﺡ ﻧﻮﺭ ﻣﻦ ﺍﻧﻮﺍﺭ ﺍﻟﻠﻪﺗﻌﺎﻟﻲ.
অনুবাদ, মুহাদ্দিসগণের অনেকে রূহ সমূহকে আল্লাহ তায়ালার নূর বলে আখ্যায়িত করেছেন।’
কাজেই দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে পারি যে, নূরে মুহাম্মদী অর্থ রূহে মুহাম্মদী তথা মুহাম্মদ (সাঃ)-এর রূহ মোবারক। নূরের উপরোক্ত বর্ণনাটিকে এভাবে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করার মাধ্যমে সকল প্রকারের মতানৈক্য আর শিরিকি আকিদা বিশ্বাসের মূলোৎপাটন করা সম্ভব হবে।
~
শায়খ আব্দুল কাদের জিলানী (রহ) রচিত “সিররুল আসরার” কিতাবের ভাষ্য হল, আল্লাহ তায়ালার নূর ও সৌন্দর্য হতে সর্বপ্রথম নবী করীম (সা)-এর রূহ মুবারক সৃষ্টি হয়েছে। এবার এ কথাটি উক্ত কিতাবে কিভাবে রয়েছে আমরা তা দেখে নেব।
~
কিতাবের ভাষ্য —

معني الآن مقطع منه فيما يتعلق بهذه الفقرة يقول : اعلم وفقك الله لما يجب و يرضي ، لقد خلق الله تعالي روح محمد صلي الله عليه و سلم اولا من نوره و جماله. )هكذا في سر الاسرار لامام الشيخ عبد القادر الجيلاني رح (
অনুবাদ, এখন এ অধ্যায়ের সাথে সম্পর্কিত مقطع منه (তার একটি অংশ) -এর অর্থ হল, তিনি বলেন: জেনে রেখো! আল্লাহপাক তোমাকে সেসব ব্যাপারে সৌভাগ্যবান করুন যা তিনি আবশ্যক করেছেন এবং সন্তুষ্ট রয়েছেন, তা হল আল্লাহ তায়ালা তাঁরই নূর ও সৌন্দর্য হতে সর্বপ্রথম নবী করীম (সা)-এর রূহ মুবারক সৃষ্টি করেছেন।”
~
জাবের (রাঃ) -এর সূত্রে বর্ণিত হাদিসটিতে উল্লিখিত “নূর” শব্দের বিশ্লেষণও মাওয়াহেবে লাদূনিয়া কিতাবের ৭১নং পৃষ্ঠার ৫ নং টীকায় রয়েছে । আমি এখানে তা অর্থ সহকারে তুলে ধরছি। যাতে সেখানে উল্লিখিত নূর শব্দটি দেখে কেউ বিভ্রান্তিতে না পড়ে।
~
“নূর” শব্দের বিশ্লেষণ-

ﻋﻦ ﺟﺎﺑﺮ ﺍﻭﻝ ﻣﺎ ﺧﻠﻖ ﺍﻟﻠﻪ ﻧﻮﺭ ﻧﺒﻴﻚ ﻣﻦ ﻧﻮﺭﻩ ﺍﻟﺦ ﻗﻮﻟﻪ ﻣﻦ ﻧﻮﺭﻩ ﺍﻱ ﺍﻻﺿﺎﻓﺔ ﺍﺿﺎﻓﺔ ﺗﺸﺮﻳﻒ، ﻛﺬﺍ ﻓﻲ ﻣﻮﺍﻫﺐ ﻟﺪﻭﻧﻴﻪ ﺍﻟﻤﺠﻠﺪ ﺍﻻﻭﻝ ﺑﺮﻗﻢ ﺍﻟﺼﻔﺤﺔ ٧١ ﺍﺭﻗﺎﻡ ﺍﻟﺤﺎﺷﻴﺔ ٥
অনুবাদ, হযরত জাবের রা: থেকে রেওয়ায়েত “আল্লাহ তায়ালা সর্বপ্রথম তাঁর নূর হতে তোমার নবীর নূর সৃষ্টি করেছেন। (তাঁর নূর হতে-এভাবে) আল্লাহ তায়ালার প্রতি নূরের নেসবত সম্মান আর মর্যাদা প্রকাশের জন্যই।” [এখানে এ অর্থ উদ্দেশ্য নয় যে, তাঁর (রাসূল সাঃ) নূরের সৃষ্টি মূল উপাদান আল্লাহ তায়ালার জাতি নূর অথবা তাঁর সত্তার অংশ বা টুকরা বিশেষ।] ~
‘মাওয়াহেবে লাদূনিয়া’ কিতাবের (১/৭৪) মধ্যে আমরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আরো একটি তথ্য পাই। সেখানে হাদিসে জাবের (রা)-এর উপর শারেহে মাওয়াহেব (আলাইহির রাহমাহ) কয়েকটি প্রশ্নের প্রতিউত্তর স্বরূপ জবাব দিতে গিয়ে লিখেছেন –

و قيل : الاولية في كل بالاضافة الي جنسه اي اول ما خلق الله من الانوار نوري و كذا في باقيها. بحواله مواهب لدونيا
অর্থাৎ, হাদিস বিশারদদের কেউ কেউ বলেছেন, (এ সমস্ত ক্ষেত্রে) সর্বপ্রথম হওয়ার মর্মার্থ সেগুলোরই সমজাতীয় বস্তুর প্রতি সম্বোধনের মাধ্যমেই ধর্তব্য হইবে। অর্থাৎ আল্লাহপাক সমস্ত নূর (রূহ) হতে আমার নূর (রূহ) সর্বপ্রথম সৃষ্টি করেছেন। এরূপ অন্যান্য সমজাতীয় বস্তুর ক্ষেত্রেও (একই নিয়ম বিবেচিত হবে)। ~
শায়খ আহমদ ইবনে মুহাম্মদ কাস্তালানী (রহ) রচিত “‘মাওয়াহেবে লাদূনিয়া’ কিতাবে (১/৩১-৩২) হযরত আবু হুরায়রাহ (রাদি:) থেকে একটি হাদিস (হাদিস নং ৪৮) উল্লেখ রয়েছে । হাদিসের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, নবী করীম (সা) হযরত আদম (আ) এর সৃষ্টি পূর্ণ হওয়ার পূর্বে (রূহের আকারে) তাকদীর বা অদৃষ্টলিপিতে ছিলেন।

কিতাবের ভাষ্য —
كنت نبيا و آدم بين الماء والجسد “ثم قال : و اما قوله عليه السلام : )كنت نبيا( فاشارة الي ما ذكرناه و انه كان نبيا في التقدير قبل تمام خلقه آدم عليه السلام لانه لم ينشأ خلق آدم الا لينتزع من زريته محمدا صلعم و يستصفي تدريجا الي ان يبلغ كمال الصفاة.
অনুবাদ, আমি তখনো নবী ছিলাম, যখন আদম পানি আর শরীরের মাঝামাঝিতে বিদ্যমান ছিলেন। আলোচ্য হাদিসটি সে দিকেই ঈংগিত বহন করে যা আমরা উল্লেখ করেছি।
তা হল, নবী করীম (সা) হযরত আদম (আ)-এর সৃষ্টি পূর্ণ হওয়ার পূর্বে (রূহের আকারে) তাকদীর বা অদৃষ্টলিপিতে ছিলেন। কেননা তিনি নবী করীম (সা) -কে তাঁরই সন্তান সন্ততীর অন্তর্ভুক্ত করা ব্যতীত আদমের আকার আকৃতি সৃষ্টি করেননি। তিনি তাঁর সমুদয় গুণাবলীর পূর্ণতা দিয়েই তাবলীগ করার জন্য মনোনীত করেছেন।”
~
‘মাওয়াহেবে লাদূনিয়া’ কিতাবে (১/৩১-৩২) উক্ত হাদিসের (হাদিস নং ৪৮) ব্যাখ্যায় আরো উল্লেখ রয়েছে “আমি তখনো নবী ছিলাম”—এটি তাঁরই রূহ মোবারকের প্রতি ঈংগিত।

কিতাবের ভাষ্য —
و هو متعقب بقول الشيخ تقي الدين السبكي عليه الرحمة انه قد جاء ان الله خلق الارواح قبل الاجساد. فقد تكون الاشارة بقوله: )كنت نبيا( الي روحه الشريفة او الي حقيقة من الحقائق. والحقائق تقصر عقولنا عن معرفتنا و انما يعلمها خالقها و من امده الله بنور الهي
অনুবাদ, শায়খ ইমাম তকি উদ্দিন আস-সুবকী (রহ) -এর ভাষ্য মতে তিনি (শারিরীক ভাবে) পশ্চাদ্বর্তী। যেহেতু (হযরত উমর ইবনে আবাসাহ রাদি: হতে বর্ণিত) একটি হাদিসে এসেছে যে, আল্লাহ তায়ালা শরীর সৃষ্টি করার পূর্বে রূহগুলো সৃষ্টি করেছেন। তাই নবীজির বাণী আমি তখনো নবী ছিলাম—এটি তাঁরই রূহ মোবারকের প্রতিই ঈংগিত।”
হযরত উমর ইবনে আবাসাহ (রাদি:) হতে বর্ণিত হাদিসটি নিম্নরূপ —
قال النبي صلي الله عليه وسلم: ان الله خلق ارواح العباد قبل العباد بالفئ عام فما تعارف منها ائتلف و ما تناكر منها اختلف. )عن عمر ابن عبسة( الروح ٢٢٩
অনুবাদ, নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা বান্দা সৃষ্টি করার দু’হাজার বছর পূর্বে তাদের রূহগুলো সৃষ্টি করেছেন।
[সূত্র— রূহ : ২২৯] ~
“মাওয়াহেব” কিতাবে (হাদিস নং ৪৮) উপরিউক্ত হাদিসের ব্যাখ্যায় আরো উল্লেখ রয়েছে যে,
~
قوله عليه السلام )كنت نبيا( … ولو صح الحديث لكان معناه ان روحه صلي الله عليه وسلم اول ارواح البشر و فرق بين ان يقال اول ارواح البشر و بين ان يقال اول خلق الله الأن بين كتابة القلم علي اللوح المحفوظ و بين خلق السموات والارض خمسين الف سنة. كما مر

অনুবাদ, যদি হাদিসটি সহীহ হয়ে থাকে, তাহলে তার অর্থ হবে, মানুষের রূহগুলোর মধ্য হতে সর্বপ্রথম সৃষ্ট রূহ হল নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামেরই রূহ মুবারক ।
~
শারেহে বুখারী আল্লামা বদরুদ্দিন আইনী ওয়াল হানাফী (আলাইহির রাহমাহ) রচিত “উমদাদুল ক্বারী” কিতাবে (১৫/১০৯) উল্লেখ করেছেন যে, সর্বপ্রথম সৃষ্টি হওয়া সম্পর্কিত রেওয়ায়েত গুলোর ভেতর সমন্বয় সাধন করতে হবে। সেখানে প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে তাদেরই সমজাতীয় জিনিসের দিকে সর্বপ্রথম হওয়ার নেসবত করা হবে।

কিতাবের ভাষ্য –
وحكي ابن جرير عن محمد ابن اسحاق انه قال قال اول ما خلق الله تعالي النور والظلمة ثم ميز بينهما فجعل الظلمة ليلا اسود مظلما و جعل النور نهارا ابيض مبصرا . و قيل اول ما خلق الله تعالي نور محمد قلت التوفيق بين هذه الروايات بان الاولية نسبي و كل شيئ قيل فيه انه اول فهو بالنسبة الي ما بعدها. )عمداد القاري شرح بخاري للعيني رح ١٥/١٠٩ (
অনুবাদ, ইবনে জারীর (রহ) মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক (রহ) হতে বর্ণনা করেছেন, নবী করীম (সা) ইরশাদ করেছেন—
“আল্লাহ তায়ালা সর্বপ্রথম নূর (আলো) এবং যূলুমাত (অন্ধকার) সৃষ্টি করেছেন। অতপর দু’নোটির মাঝে পার্থক্য নিরূপণ করেছেন। তিনি যূলুমাতকে কালো অন্ধকারাচ্ছন্ন রাত্রিতে পরিণত করেছেন আর নূর বা আলোকে করেছেন শুভ্র দিবসে।”
কথিত আছে,
ﺍﻭﻝ ﻣﺎ ﺧﻠﻖ ﺍﻟﻠﻪ ﺗﻌﺎﻟﻲ ﻧﻮﺭ ﻣﺤﻤﺪ
অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা সর্বপ্রথম মুহাম্মদ (সা:) -এর নূর সৃষ্টি করেছেন । আমার (আল্লামা আইনী) বক্তব্য হল, বর্ণনাগুলোর মাঝে সমন্বয় সাধন করতে হবে। যেহেতু সর্বপ্রথম হওয়ার বিষয়টি প্রত্যেকটি বস্তুর দিকেই সম্বন্ধীয়, সেহেতু (সমন্বয় সাধন করে) বলতে হবে যে, সেখানে অবশ্যই প্রত্যেকটি বস্তু স্ব স্ব সমজাতীয় বস্তুগুলোর নেসবতে সর্বপ্রথম সৃষ্ট।”
~
এবার আল্লামা জুরকানী (রহ)-এর ভাষায় হাদিসে জাবের (রা) দ্বারা বিশ্বনবী (সাঃ)-এর নূর সর্বপ্রথম সৃষ্টি করা হয়েছিল মর্মে রেওয়ায়েতটির ব্যাখ্যা আরো সুস্পষ্টভাবে জেনে নিন!

আল্লামা জুরকানী (রহঃ)-এর কিতাব থেকে সম্পূর্ণ মূল ইবারত অর্থসহ তুলে দেব, ইনশাআল্লাহ ।
আপনারা তাঁর সম্পূর্ণ লেখাটি পড়ার পর অবাক হবেন যে, একটি বিদয়াতি গোষ্ঠী জুরকানী (রহঃ)-এর ইবারতকে কাটছাট করে কিভাবে নিজেদের মতলব সিদ্ধ ব্যাখ্যা তুলে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দিয়েছে এবং বিশ্বনবী (সাঃ)-কে খ্রিস্টান জাতির ন্যায় আল্লাহ তায়ালার জাতের অংশ বলে সাব্যস্ত করেছে।
~
আল্লামা জুরকানীর মূল ইবারত—

] ﻗﻮﻟﻪ ﻣﻦ ﻧﻮﺭﻩ [ : ﺍﺿﺎﻓﺔ ﺗﺸﺮﻳﻒ ﻭ ﺍﺷﻌﺎﺭ ﺍﻧﻪ ﺧﻠﻖ ﻋﺠﻴﺐ، ﻭ ﺍﻥ ﻟﻪ ﺷﺄﻧﺎ ﻟﻪ ﻣﻨﺎﺳﺒﺔ ﻣﺎ ﺍﻟﻲ ﺍﻟﺤﻀﺮﺓ ﺍﻟﺮﺑﻮﺑﻴﺔ ﻋﻠﻲ ﺣﺪ ﻗﻮﻟﻪ ﺗﻌﺎﻟﻲ :]ﻭ ﻧﻔﺦ ﻓﻴﻪ ﻣﻦ ﺭﻭﺣﻪ ،ﺍﻟﺴﺠﺪﺓ ٩؛ [ ﻭ ﻫﻲ ﺑﻴﺎﻧﻴﺔ، ﺍﻱ ﻣﻦ ﻧﻮﺭ ﻫﻮ ﺫﺍﺗﻪ، ﻻ ﺑﻤﻌﻨﻲ ﺍﻧﻬﺎ ﻣﺎﺩﺓ ﺧﻠﻖ ﻧﻮﺭ ﻣﻨﻬﺎ، ﺑﻞ ﺑﻤﻌﻨﻲ ﺗﻌﻠﻖ ﺍﻻﺭﺍﺩﺓ ﺑﻪ ﺑﻼ ﻭﺍﺳﻄﺔ ﺷﻴﺊ ﻓﻲ ﻭﺟﻮﺩﻩ، ﻭ ﻫﺬﺍ
ﺍﻭﻟﻲ ﻣﻦ ﺍﺣﺘﻤﺎﻝ ﺃﻥ ﺍﻟﻤﺮﺍﺩ ﻣﻦ ﻧﻮﺭ ﻣﺨﻠﻮﻕ ﻟﻪ ﺗﻌﺎﻟﻲ ﻗﺒﻞ ﺧﻠﻖ ﻧﻮﺭ ﺍﻟﻤﺼﻄﻔﻲ ﻭ ﺍﺻﺎﻓﻪ ﺍﻟﻴﻪ ﻟﺘﻮﻟﻴﻪ ﺧﻠﻘﻪ ﻭ ﺍﻳﺠﺎﺩﻩ ﻟﻤﺎ ﻳﻠﺰﻡ ﻋﻠﻴﻪ ﻣﻦ ﺳﺒﻖ ﻣﺨﻠﻮﻕ ﻋﻠﻲ ﻧﻮﺭ ﺍﻟﻤﺼﻄﻔﻲ، ﻭ ﻫﻮ ﺧﻼﻑ ﺍﻟﻤﻨﺼﻮﺹ .

অনুবাদ, (হাদিসটিতে আল্লাহর প্রতি নূরের ইজাফত বা সম্ভোধন মূলত) সম্মান সূচক। কারণ ইহা (আল্লাহ তায়ালার) একখানা বিস্ময়কর সৃষ্টি। এটি নিশ্চিতভাবে তাঁরই শান ও মর্যাদা (‘র বহিঃপ্রকাশ) যিনি খোদাপ্রদত্ত মহান মর্দাযার সহিত সম্পর্কিত। (উদাহরণ স্বরূপ) আল্লাহ তায়ালার বাণী “তিনি তথায় (আদমের অভ্যন্তরে) তাঁর রূহ ফুঁকে দিয়েছেন।” [সূরা সিজদা-৯]। তার মর্মার্থ (বিভিন্ন বর্ণনা দ্বারা) সুস্পষ্ট। অর্থাৎ (অনুরূপভাবে) اي من نوره هو ذاته অর্থাৎ তাঁর নূর হতে তথা জাত হতে (একথার মর্মার্থও সুস্পষ্ট)। {এখানে اي হল حرف تفسير (হরফে তাফসির) । এটি নূর শব্দকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার “জাত ও সত্তা” অর্থে ব্যাখ্যা দিতে উল্লেখ হয়েছে। এখন অর্থ দাঁড়ায়, তাঁর নূর হতে তথা তাঁর জাতের পক্ষ হতে । এককথায়, ‘তাঁর জাত হতে’ মানে আল্লামা তায়ালা স্বীয় সত্তার পক্ষ হতে সরাসরি কোনো মাধ্যম ছাড়াই নবীজী (সা:)-কে বিশেষ প্রক্রিয়ায় সৃষ্টি করেছেন।} (এখানে) এ অর্থ উদ্দেশ্য নয় যে, তাঁর (রাসূল সাঃ) নূরের সৃষ্টি মূল উপাদান তাঁরই (আল্লাহ তায়ালা) জাত ও সত্তার অংশ বা টুকরা বিশেষ।
বরং [তিনি তাঁর নূর হতে] এ কথার (প্রকৃত) অর্থ হল, কোনো রকম মাধ্যম ছাড়া তাঁর অস্তিত্ত লাভে মহান আল্লাহ তায়ালার (পবিত্র) ইচ্ছার প্রতিপলন। মুহাম্মদ মুস্তফা (সাঃ)-এর নূরের [রূহের] পূর্বে অন্যান্য সকল সৃষ্ট নূর (‘র অস্তিত্ত) বিদ্যমান থাকার সম্ভাবনার ক্ষেত্রে এ বিশ্লেষণটুকু অধিকতর যুৎসই। {সূত্র, জুরকানী শরহে মাওয়াহিব ৯০}
লক্ষণীয়, আল্লামা জুরকানী (রহঃ) তিনি নিজের লেখাতেই বিষয়টি এ ভাবে স্পষ্ট করে দিলেন যে, اضافة تشريف و اشعار নূর শব্দটিকে আল্লাহ তায়ালার প্রতি নিসবত করা হয়েছে শুধু কেবল সম্মান ও মর্যাদা প্রকাশার্থে। এ রকম নেসবত করার অনেক উদাহরণ রয়েছে। যেমন, বাইতুল্লাহ (আল্লাহর ঘর), ছাইফুল্লাহ (আল্লাহর তরবারী), রূহুল্লাহ (আল্লাহর রূহ)।
এখানে যথাক্রমে ঘর, তরবারী আর রূহের নেসবত আল্লাহ তায়ালার দিকে শুধু মাত্র সম্মান আর মর্যাদা প্রকাশের উদ্দেশ্যে। অন্যথা হযরত ঈসা (আঃ) এর উপাধি হল রূহুল্লাহ (আল্লাহর রূহ)।
তো কী ব্যাখ্যা দেবেন? উনাকে আল্লাহর রূহের তৈরি বলবেন? খ্রিষ্টান জাতির মত রেজভিরাও কি হযরত ঈসা (আঃ)-কে আল্লাহর পরমাত্মা বা জাতের অংশ বলা শুরু করে দেবেন?? নাউযুবিল্লাহ।
কাজেই ওখানে যে ব্যাখ্যা রয়েছে ঠিক “তিনি তাঁর নূর হতে” এ কথাটিরও ব্যাখ্যা রয়েছে।
আর ব্যাখ্যা রয়েছে বলেই তাঁকে আল্লাহ তালার নুরের সৃষ্ট বলা যাবেনা।

পরিশেষে বলা যায়, উপরে উদ্ধৃতাংশে “নূর” শব্দটিকে সুস্পষ্টভাবে রূহে মুহাম্মদী অর্থে ব্যাখ্যা দেয়ার কথা প্রমাণিত হল। কাজেই এ ধরণের রেওয়ায়েত আর যাই হোক, নবী করীম (রহ)-এর শরীর মুবারক নূরের সৃষ্ট বলে কস্মিনকালেও দলিল যোগ্য হবেনা। আশাকরি এবার আপনারা বুঝতে পেরেছেন।
~
লেখক, প্রিন্সিপাল নূরুন্নবী। মোবাইল : 01812561424

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন