আল্লামা আহমদ ইবনে মুহাম্মদ কাসতালানী (আলাইহির রাহমাহ) নূরে মুহাম্মদী নামের জাল হাদিসটি কি তিনি নিজেই গড়েছিলেন? (নাউযুবিল্লাহ)
জনৈক রেজভী আকিদা-ওয়ালা ভাই প্রশ্ন করেছেন:
আল্লামা কাস্তালানী (রহ:) তিনি ভুল করে মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক নামক কিতাবের দিকে হাদিসে জাবের নেসবত করেছেন-ঠিক আছে। কিন্তু সে সংগে এটাও তো ঠিক যে, তিনি হাদীসটি নিজ কিতাবে উল্লেখ করেছেন। এবার যখন উল্লেখ করেছেন তখন তো মানতে হয় যে, নিশ্চয়ই হাদীসটি আছে। না হলে তিনি উল্লেখ করলেন কিভাবে? আর যদি হাদীসটি না থেকে থাকে, আর প্রথমত তিনিই উল্লেখ করে থাকেন; তাহলে মানতে হবে তিনি হাদীস গড়েছেন! আর হাদীস গড়নেওয়ালা হল বেদ্বীন। সেহেতু উনাকে মুহাদ্দিস মানা যায় কিভাবে? তাহলে বলুন…!
আপনার কমেন্টের জবাব-
আপনি খুব সুন্দর একটি প্রশ্ন করেছেন। শতভাগ নিশ্চিত করে বলতে পারি যে, আপনার উপরিউক্ত সন্দেহ জনক জিজ্ঞাসার যতই তথ্য ভিত্তিক আর প্রামাণ্য জবাব দেয়া হবেনা কেন, মানতে অস্বীকৃতি জানাবেনই। আর ইহাই বাতিলপন্থীদের মজ্জাগত স্বভাব। তথাপি আপনার প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত একটি জবাব দিয়ে আমি আমার দায়িত্ব পালন করব, ইনশাআল্লাহ।
আপনাকে প্রথমে বুঝতে হবে, কোনো হাদিস যদি কারো কিতাবে স্থান পায় তদ্দারা সেই হাদিসটি উক্ত কিতাব রচয়িতার মতে সহীহ হওয়ার দলিল হয়ে যায় না। মাওয়াহেব গ্রন্থকারই এটি প্রথমে উল্লেখ করেছেন-এরকমটি কেউ বলেছেন কি? যদি কেউ অনুরূপ নাই বলে থাকেন, তাহলে তাঁকে হাদীস গড়নেওয়ালা বা বেদ্বীন -মানতে হবে কেন? নাউযুবিল্লাহ। আজ দেখা যাচ্ছে, হাদিসের মুহাদ্দিসগ্ণও আপনাদের (রেজভিদের )অযাচিত বাক্যবাণ হতে নিরাপদ নন!!
আমি আমার এ লেখাটিতে আহলে হক্বের অনুসারী জনৈক ভদ্রলোকটির সে প্রশ্ন গুলোও সংযুক্ত করব, যা তিনি আপনার প্রশ্নের পাল্টা জবাবে করে ছিলেন। তার আগে আমি বিদাতি লোকটির ছোট্ট (?) প্রশ্নটির জবাব দিচ্ছি। ওয়ামা তাওফিকি ইল্লাবিল্লাহ।
আমরা যখন একথা প্রমাণ করলাম যে, কথিত নূরে মুহাম্মদী সৃষ্টি সম্পর্কিত হাদিসটি জাল এবং সেটি মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক কিতাবের দিকে থাকার নেসবত পুরোপুরি ভুল ও ভিত্তিহীন, তখন অবশ্য কেউ কেউ দাবী করে থাকেন যে, হাদীসটি ইমাম বায়হাকী (রহ) তিনিও নাকি সংকলন করেছেন!
আসলে উনাদের উক্ত দাবি পুরোপুরি ভিত্তিহীন। আব্দুর রাযযাক সান‘আনীর কোনো গ্রন্থে এটি যেমন উল্লেখ ছিলনা, তেমনি ইমাম বায়হাকী (রহ)-এরও কোনো গ্রন্থে এটি উল্লেখ নেই। যারা ইমাম বায়হাকী (রহ)-এর কিতাবে উল্লেখ থাকার দাবি করেন তারা একটু কষ্ট করে কিতাবটিতে দেখে নিবেন! বাজারে কিতাবটি আজো পাওয়া যায়, আলহামদুলিল্লাহ। সেহেতু কিতাবের স্কীনসট দিয়ে প্রমাণ করতে পারলে তা অবশ্য মেনে নিতে আমাদের আপত্তি থাকবে না।
এটা খুবই সত্যকথা,
সনদবিহীন কতেক সিরাতুন্নবী, ইতিহাস বা তথ্যহীন কিছু ওয়াজের কিতাব ব্যতীত প্রসিদ্ধ কোনো হাদীসগ্রন্থে নূরে মুহাম্মদী সৃষ্টিকরা শীর্ষক কথাটির অস্তিত্ব নেই। সহীহ, যয়ীফ এমনকি মাঊযূ বা মিথ্যা সনদেও এ হাদীসটি কোনো একটি হাদীসগ্রন্থেও সংকলিত হয়নি।
সাহাবীগণের যুগ হতে আজ পর্য্ন্ত শত শত হাদীসের গ্রন্থ লিপিবদ্ধ ও সংকলিত হয়েছে। সে সকল গ্রন্থে সনদসহ অসংখ্য হাদীস সংকলিত হয়েছে। আমাদের সমাজে প্রচলিত যে কোনো হাদীস (সহীহ/ হাসান/যয়ীফ/মাঊযূ) ঐ সকল হাদিসগ্রন্থের অধিকাংশে পাওয়া যাবে। আপনি যে কোনো হাদীসগ্রন্থে খুঁজে দেখুন, অন্তত ১০ বা ১৫টি গ্রন্থে তা খুঁজে পাবেন, ইনশাআল্লাহ। অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ বা প্রসিদ্ধ হাদীস আপনি প্রায় সকল গ্রন্থেই দেখতে পাবেন। অর্থাৎ, এ ধরনের যে কোনো হাদীস আপনি ৩০/৩৫টি হাদীসগ্রন্থে এক বা একাধিক সনদে সংকলিত দেখতে পাবেন। কিন্তু হাদীস নামের “আল্লাহ সর্বপ্রথম আমার নূর সৃষ্টি করেছেন”- বাক্যটি ঐ সব হাদীসগ্রন্থে খুঁজে দেখুন, একটি হাদীসগ্রন্থেও তা পাবেন না।
রাসুলুল্লাহ (সা)-এর যুগ হতে পরবর্তী শত শত বৎসর পর্য্ন্ত কেউ এ হাদীসটি জানতেন না, কোনো হাদিসগ্রন্থে কেউ লিখেনও নি।
মূলকথায় চলে এলাম-
যতটুকু জানা যায়, ৭ম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ আলিম মহিউদ্দীন ইবনু আরাবী আবূ বকর মুহাম্মাদ ইবনু আলী তায়ী হাতিমী (৫৬০-৬৩৮হিজরী) তিনিই সর্বপ্রথম এ কথাগুলোকে একদম সনদ ছাড়াই স্বীয় লেখিত “ফতূহাতে মাক্কীয়া” জাতীয় গ্রন্থে হাদীস হিসেবে উল্লেখ করেছেন। পরবর্তী প্রায় হিজরী দশম শতাব্দীর পরেই আহলে বিদয়াত সম্প্রদায় এই মিথ্যা কথাটির একটি সুন্দর সনদও বানিয়ে নিয়েছে। যা পরে বিভিন্ন ভাবে ধরা পড়ার কারণে বর্তমানকালের নূরে মুহাম্মদী আকিদার প্রাণশক্তি সমূলে নিস্তেজ হয়ে গেছে।
এখানে প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ইবনুল আরাবী’র পুস্তকাদিতে অগণিত জাল হাদীস ও বাহ্যত ইসলামী বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক অনেক কথাই স্থান পেয়েছে। কিন্তু পরবর্তী যুগে বুযুর্গগণ তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাবশত এ সকল কথার বিভিন্ন ওজর ও ব্যাখ্যা পেশ করেছেন। আবার অনেকে কঠিনভাবে আপত্তিও তুলেছেন।
বিশেষত, মুজাদ্দেদী আলফে সানী হযরত আহমদ ইবনু আব্দুল আহাদ সারহিন্দী (রহ:) [১০৩৪ হিজরী] তিনি ইবনু আরাবী’র এ সকল জাল ও ভিত্তিহীন কথার বারংবার প্রতিবাদ করেছেন। কখনো কখনো নরম ভাষায়, আবার কখনো কঠিন ভাষায়।
[উদাহরণ- মাকতুবাত শরীফ ১/১, মাকতুব ৩১, (পৃষ্ঠা ৬৭, ৬৮) মাকতুব ৪৩]।
এক চিঠিতে তিনি লিখেছেন, “আমাদের নস বা কুরআন ও হাদীসের পরিষ্কার অকাট্য বাণীর সহিত আকিদা রাখতে হবে, ইবনু আরাবী’র কাশফ ভিত্তিক ফসস বা ফুসূসূল হিকামের সহিত নহে। ফুতূহাতে মাদানীয়া বা হাদীস শরীফ বর্জন করে আমাদেরকে ইবনে আরাবীর ফতূহাতে মাক্কীয়া জাতীয় গ্রন্থাদি হতে বেপরওয়া করেনা যেন।
( ১/১, মাকতুব ১০০, পৃষ্ঠা ১৭৮)।
এবার, যে সব প্রশ্নগুলো জনৈক ভাই পাল্টা জবাবে আহলে বিদয়াত লোকটির উদ্দেশ্যে করেছেন, তা নিম্নরূপ –
১-
কোনো হাদিস যদি কারো কিতাবে স্থান পায় তদ্দারা সেই হাদিসটি উক্ত কিতাব রচয়িতার মতে সহীহ হওয়ার দলিল হবে কি?
আমি জনৈক আহলে হক্বের ভদ্রলোকটির পাল্টা জবাবি প্রশ্নের সাথে আরেকটু সংযোজন করছি। ইমাম যাহাবী (রহ), ইবনে হাজার আসকালানী (রহ) এবং আল্লামা ইমাম সুয়ূতী (রহ) আর ইবনু ইরাক (রহ) উনারাও নিজ নিজ কিতাবে উল্লেখ করেছেন-
“আল্লাহ আমাকে তাঁর নূর হতে সৃষ্টি করেছেন, আবূ বকরকে আমার নূর হতে সৃষ্টি করেছেন, উমারকে আবূ বকর এর নূর হতে সৃষ্টি করেছেন এবং আমার উম্মাতকে উমরের নূর হতে সৃষ্টি করেছেন……।”
তো এবার আপনি বা আপনারা হযরত আবূ বকর (রা) এবং উমার (রা) সহ সবাইকে নূর হতে সৃষ্টি বলবেন কিনা? নতুবা এ রকম কথা উনাদের কিতাবগুলোতে উল্লেখ হওয়ার পরেও মুহাদ্দিসগণ উক্ত কথাটিকে হাদিসের নামে জালিয়াতি, মিথ্যা ও বানোয়াট বললেন কেন? এমতাবস্থায় আপনারই সেই প্রশ্নটি ফের আপনার দিকেই তাক হল কিনা? তাই বলছি, আকিদা শুদ্ধ করে নিন, এখনো সময় আছে।
মজার ব্যাপার হল, মুহাদ্দিসগণ একমত যে উক্ত কথাটিও হাদিসের নামে জালিয়াতি, মিথ্যা ও বানোয়াট। মুহাদ্দিসগণ বলেছেন যে, আহমদ ইবনু ইউসূফ আল মানবিযী নামক এক ব্যক্তি এ মিথ্যা কথাটির প্রচারক। সে এই মিথ্যা কথাটির একটি সুন্দর সনদও বানিয়েছে।
[দ্রষ্টব্য : মীযানুল ইতিদাল (১/৩১৪); লিসানুল মীযান (১/৩২৮); যাইলুল লাআলী (পৃষ্ঠা ৫০); তানযীহ (১/৩৩৭)]
২-
আল্লামা কুস্তালানী রহ হতে হাদিসে জাবের সহীহ কিবা জাল-এরকম কোনো উক্তি প্রমাণিত আছে কি?
৩-
‘মাওয়াহেবে লাদূনিয়া’ কিতাবের মুহাক্কিক হাদিসে জাবের এটি “মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক” কিতাবে নেই বলে যে কথা প্রমাণ করে লিখেছেন তাও কি মিথ্যা?
(দ্রষ্টব্য, মাওয়াহেবে লাদূনিয়া-১/৭৩)
আপনারা আর কতকাল মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে সত্য গোপন করবেন!
আশাকরি বুঝতে পেরেছেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন