প্রশ্ন-
নূরে মুহাম্মদী নামক হাদিসটি যদি জালই হত, তাহলে বিভিন্ন গ্রন্থকার নিজেদের কিতাবগুলোতে তা এনেছেন কিজন্য? আর যেহেতু তারা তা এনেছেন, সেহেতু হাদিসটি তাদের নিকট গ্রহণযোগ্য-এরকমই বুঝা যায়, তাই নয় কি?
জবাব –
আসলে আপনার এ রকম ধারণা অাদৌ সঠিক নয়।
যদি আপনার এ রকম ধারণা অাদৌ সঠিক হত তাহলে নিচে উল্লিখিত হাদিস নামক জাল হাদিসগুলোকে কিভাবে দেখবেন?
আপনি কি বিশ্বাস করেন যে, বিভিন্ন গ্রন্থকার নিজেদের কিতাবগুলোতে নিম্নোক্ত জাল হাদিসগুলো এনেছেন বিধায় হাদিসগুলো তাদের নিকটও গ্রহণযোগ্য? এরকমই বুঝাবেন কি? এবার নিম্নোক্ত জাল হাদিসগুলোর প্রতি চোখ রাখুন!
১-
আল্লামা ইবনুল ইরাক (রহ) তিনি “তানযীহ” কিতাবে (১/৩৫১) একটি জাল হাদিস এটিও এনেছেন-
রাসুলুল্লাহ (সা) বলেছেন : “আমাকে ও আলীকে নূর হতে সৃষ্টি করা হয়। আদমের সৃষ্টির ২ হাজার বৎসর পূর্বে আমরা আরশের ডান পার্শ্বে ছিলাম। অতঃপর যখন আল্লাহ আদমকে সৃষ্টি করলেন তখন আমরা মানুষদের ঔরসে ঘুরতে লাগলাম।” (নাউযুবিল্লাহ) ।
কিন্তু মুহাদ্দিসগণ একমত যে, এটি একটি মিথ্যা ও জাল হাদীস।
জা’ফর ইবনু আহমদ ইবনু আলী আল-গাফিকী নামক এক মিথ্যাবাদী জালিয়াত হাদীসটি বানিয়েছে এবং এর জন্য একটি সনদও সে বানিয়েছে।
তথ্য সূত্র:
√ ইবনুল জাউযী, আল মাউদূআত ১/২৫৪।
√ সুয়ূতী, আল লাআলী ১/৩২০।
√ ইবনু ইরাক, তানযীহ ১/৩৫১।
√শাওকানী, আল ফাওয়াইদ, ২/৪৩৪।
২-
আল্লামা ইবনুল ইরাক (রহ) তিনি “তানযীহ” কিতাবে ( ১/৩৩৭ ) একটি জাল হাদিস এটিও এনেছেন-
রাসুলুল্লাহ (সা) বলেছেন : “আল্লাহ তায়ালা আমাকে তাঁর নূর হতে সৃষ্টি করেছেন, আবূ বকরকে আমার নূর হতে সৃষ্টি করেছেন, উমারকে আবূ বকর এর নূর হতে সৃষ্টি করেছেন এবং আমার উম্মাতকে উমরের নূর হতে সৃষ্টি করেছেন……।” (নাউযুবিল্লাহ)
কিন্তু মুহাদ্দিসগণ একমত যে হাদীসটি মিথ্যা ও বানোয়াট।
আহমদ ইবনু ইউসূফ আল মানবিযী নামক এক ব্যক্তি এ মিথ্যা কথাটির প্রচারক। সে এই মিথ্যা কথাটির একটি সুন্দর সনদও বানিয়েছে।
তথ্য সূত্র :
√ ইমাম যাহাবী, মীযানুল ইতিদাল ১/৩১৪।
√ ইবনু হাজার আসকালানী, লিসানুল মীযান ১/৩২৮।
√ আল্লামা জালালুদ্দিন আস সুয়ূতী, যাইলুল লাআলী, পৃ. ৫০।
√ আল্লামা ইবনুন ইরাক, তানযীহ ১/৩৩৭।
৩-
এ অর্থে ইমাম দাইলামী (রহ) তিনি “আল ফিরদাউস” (১/১৭১) কিতাবে আরেকটি বানোয়াট কথা এও উল্লেখ রয়েছে –
“আল্লাহ তায়ালা আমাকে তাঁর নূর হতে সৃষ্টি করেছেন, আবূ বকরকে আমার নূর হতে সৃষ্টি করেছেন, উমারকে আবূ বকর এর নূর হতে সৃষ্টি করেছেন এবং নবী রাসূলগণ ব্যতীত মুমিনগণের সকলকেই উমারের নূর হতে সৃষ্টি করেছেন।”
৪-
এ অর্থে “তাফসীরে কুরতুবী” (১২/২৮৬) কিতাবে আরো একটি ভিত্তিহীন কথা এও উল্লেখ পাওয়া গেছে যে, বর্ণিত আছে –
“আল্লাহ আমাকে তাঁর নূর হতে সৃষ্টি করেছেন, আবূ বকরকে আমার নূর হতে সৃষ্টি করেছেন, উমার ও আয়েশাকে আবূ বকর এর নূর হতে সৃষ্টি করেছেন আর আমার উম্মতের মুমিন পুরুষগণকে উমারের নূর হতে এবং মুমিন নারীগণকে আয়েশার নূর হতে সৃষ্টি করেছেন।” (নাউযুবিল্লাহ)
৫-
আরো একটি ভিত্তিহীন কথা এও উল্লেখ পাওয়া যায় যে, বর্ণিত আছে –
“আল্লাহর মুখমন্ডলের নূরে রাসুলুল্লাহ (সা)- এর সৃষ্টি।”
আব্দুল কাদের জিলানী (রাহ)-এর নামে প্রচলিত ‘সিররুল আসরার’ নামক জাল পুস্তকটির মধ্যে জালিয়াতগণ অনেক জঘন্য কথা হাদীস নামে ঢুকিয়ে দিয়েছে। এ সকল জাল কথার একটিতে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ বলেছেন, “আমি মুহাম্মাদকে আমার মুখমন্ডলের নূর হতে সৃষ্টি করেছি।”
উপরিউক্ত জঘন্য মিথ্যা কথাটি কোনো জাল সনদেও বর্ণিত হয়নি।
তথ্য সূত্র :
√ সিররুল আসরার, পৃ. ১০।
রাসুলুল্লাহ (সা)-এর নূরে ধান চাউলের সৃষ্টি। (নাউযুবিল্লাহ)
৬-
জাল হাদিস তৈরিকারী জালিয়াতদের বানানো এ রকম অগণিত জাল হাদিস গুলোর আরেকটি হচ্ছে, আমি আল্লাহ হতে এবং চাউল আমা হতে। আমার অবশিষ্ট নূর হতে চাউলকে সৃষ্টি করা হয়।”
তথ্য সূত্র :
√ তাহের ফাতানী, তাযকিরা, পৃ. ১৪৭।
√ শাওকানী, আল ফাওয়াদ ১/২১১।
৭-
আরো একটি ভিত্তিহীন কথা এও উল্লেখ পাওয়া যায় যে, বর্ণিত আছে –
“ঈমানদার মুসলমান আল্লাহর নূর দ্বারা সৃষ্ট” (নাউযুবিল্লাহ) ।
আল্লামা দায়লামী (রহ) তার “আল ফিরদাউস” (৪/১৭৮) নামক পুস্তকে ইবনে আব্বাস (রা) এর নামে রাসূলুল্লাহ (সা) হতে বর্ণনা করেছেন “মুমিন আল্লাহর নূরের দ্বারা দৃষ্টিপাত করেন, যে নূর হতে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে।”
কিন্তু এর একমাত্র বর্ণনাকারী মাইসারাহ ইবনু আব্দুরাব্বিহ। সে দ্বিতীয় ও তৃতীয় হিজরী শতকের অন্যতম প্রসিদ্ধ জাল হাদিস তৈরিকারী ও মিথ্যাবাদী রাবী। ইমাম সাখাবী “আল মাখাদিস” (পৃষ্ঠা নং ৪৩৬) কিতাবে এ হাদীসটিকেও জাল বলেছেন । ইমাম বুখারী, আবূ দাউদ, আবূ হাতিম, ইবনু হিব্বান সহ সকল মুহাদ্দিস মাইসারাহ ইবনু আব্দুরাব্বিহ জাল হাদিস তৈরিকারী ও মিথ্যাবাদী রাবী হওয়ার বিষয়ে একমত। তাঁরা তার রচিত অনেক জাল হাদীস উল্লেখ করেছেন।
তথ্য সূত্র :
√ ইমাম যাহাবী, মীযানুল ইতিদাল ৬/৫৭৪-৫৭৫।
√ ইমাম ইবনু হাজার আসকালানী, লিসানুল মীযান ৬/১৩৮-১৩৯।
পরিশেষে আমরা দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি যে, কোনো একটি মিথ্যা অসংখ্য মানুষের মুখ দিয়ে উচ্চারণ হলে সেটি যেমন প্রকৃতার্থে সত্য হয় না, তেমনি কোনো একটি জাল হাদিস অসংখ্য কিতাবে উল্লেখ হওয়ার দ্বারা সেটি কখনো সহীহ হাদিস হবেনা।
সেই সাথে একথাও সবাই জানেন যে, কোন বক্তব্য কোন গ্রন্থে আনা মানেই উক্ত বক্তব্যটি সঠিক ও গ্রহণযোগ্য বলে স্বীকৃতি প্রদান করা নয়। বরং অনেক সময় উক্ত বক্তব্যটির ভুল প্রমাণ করার জন্য, কিংবা সংকলক ভুলক্রমেও তা স্বীয় গ্রন্থে আনতে পারেন। তাই প্রথমে দেখতে হবে লেখক উক্ত বক্তব্যটিকে সঠিক ও গ্রহণযোগ্য বলে স্বীকৃতি প্রদান করেছেন কি না? যদি স্বীকৃতি প্রদান করে থাকেন তাহলে কিতাবটির কোন পৃষ্ঠায়, কোন আলোচনায়, কী শব্দে স্বীকৃতি প্রদান করেছেন তা উল্লেখ করতে হবে। এটি ধোঁকাবাজী ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু নূরের সৃষ্টি দাবিদার ভাইয়েরা ‘মাওয়াহেবে লাদূনিয়া’ কিতাবে হাদিসে জাবের (রা) সম্পর্কে মুসান্নাফ কিতাবের উদ্ধৃতি ভুলক্রমে এসে যাওয়ায়, তারা সেটিকে মুসান্নাফ কিতাবের দিকে চোখ বুজে নেসবত করে থাকে। অথচ তারা ‘মাওয়াহেবে লাদূনিয়া’ কিতাবের সংকলকের পক্ষ থেকে সেটি সম্পর্কে ইতিবাচক কোনো বক্তব্যই দেখাতে পারেননা, পারবেও না।
লেখক, প্রিন্সিপাল।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন