কুরআন হাসিদ পড়া ও মানার ব্যাপারে প্রায় সব মুসলমানেরই আন্তরিকতার অভাব নেই। কিন্তু সঠিক মূলনীতি না জানার কারণে বিভ্রান্তির শিকার হন। আমার জানা মতে একটি বড় মূলনীতি হল, একই বিষয়ের সবরকম দলিল-প্রমাণ সামনে নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। নয়তো বিভ্রান্তি অবশ্যম্ভাবী। যেমন আমি ক্লাসে বললাম, আগামীকাল থেকে প্রতিদিন ক্লাসে পড়াবো। তখন এক ছাত্র বলল, স্যার! শুক্রবারেও?
আরে ভাই, শুক্রবারে যে বন্ধ এটা তো সবাই জানে। তাই আমার এ কথার সাথে বন্ধের দিনগুলোর বিষয়টিও মনে রাখতে হবে। যদিও আমি বন্ধের দিনে ক্লাস না করার কথা স্পষ্ট করে বলিনি। না বললেও বন্ধের দিন ক্লাস হবে না, এটা সকলকেই বুঝতে হবে।
.
ইসলাম থেকে কিংবা ইসলামের নামে যতগুলো বাতিল ফিরকা, দল-উপদল সৃষ্টি হয়েছে; আকিদাগত, ফিকহী মাসায়েলগত বা অন্যান্য বিষয়ে-- সবগুলোর কাছে কোনো-না-কোনো দলিল থাকে। কুরআন ও হাদিস থেকেই দলিল-প্রমাণ দিয়ে থাকে। যদিও দলিলগুলো খোড়া ও বাস্তবতা-বিবর্জিত। কিন্তু দলিল তো আছে। কারণ, আল্লাহর সমস্ত নিদর্শন, উদাহরণ-উপমা এবং তাঁর অহি দ্বারা হেদায়াত পাওয়া যেমন সহজ; তদ্রƒপ গোমরাহ-পথভ্রষ্ট হওয়াও তেমন কঠিন না। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে : يُضِلُّ بِهِ كَثِيرًا وَيَهْدِي بِهِ كَثِيرًا (সূরা বাকারা : ২৬)
দলিল থাকা সত্ত্বেও সত্যপথে না থাকার একটি মৌলিক কারণ হল, একমুখী অধ্যয়ন। কেউ কোথায় একটি দলিল পেল; ব্যস সে এটি নিয়েই ব্যস্ত ও মগ্ন। অথচ ভিন্ন দলিল ছিল। দুটোর মাঝে সামঞ্জস্য করে একটি সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যেত। দুয়েকটি উদাহরণ নেওয়া যাক।
ক. বাদশা আবরাহা রাসুল সা. এর জন্মের পূর্বে পবিত্র কাবা ধ্বংস করার জন্যে হস্তিবাহিনী নিয়ে আসে। তখন আল্লাহ তাআলা ছোট্ট পাখির দ্বারা তাদের ধ্বংস করে দেন। ওই ঘটনার দিকে ইঙ্গিত করে রাসুল সা. -কে বলা হয়েছে : أَلَمْ تَرَ كَيْفَ فَعَلَ رَبُّكَ بِأَصْحَابِ الْففِيلِ অর্থ : “হস্তিবাহিনীর সাথে আপনার রব কী করেছিল তা আপনি দেখেননি?”
শুধু এ আয়াত নয় আরও অনেক আয়াত এবং হাদিস দ্বারা পরিষ্কার বুঝা যায়, অদৃশ্যের অনেক বিষয় আমাদের নবী সা. জানতেন। তাই তিনি আলিমুল গায়েব।
এর বিপরীতে আরও অনেক আয়াত, হাদিস ও নবী সা. এর ঘটনা দ্বারা স্পষ্ট বুঝা যায়, রাসুল সা. গায়েব জানতেন না। আয়েশা রা. এর ওপর অপবাদ আরোপ করার পর রাসুল সা. পর্যন্ত আয়েশাকে বলেছিলেন, কোনো গোনাহ হয়ে থাকলে ক্ষমা চাও, আল্লাহ তাআলা ক্ষমা করবেন। এরকম হাদিস অসংখ্য।
এবার চিন্তা করুন, যারা সূরা ফীল দ্বারা দলিল গ্রহণ করে রাসুলকে আলিমুল গায়েব বলে তারা এসব দলিল দেখলে এ বিভ্রান্তিকর আকিদা তারা পোষণ করত না।
খ. অনেকে খুতবা চলাকালীন তাহিয়্যাতুল মসজিদ/দুখুলুল মসজিদ পড়ার কথা বলেন। আসলে তাদের কথা কতটুকু দলিলসম্মত?
একটি হাদিসে রাসুল সা. ইরশাদ করেন : إِذَا دَخَلَ أَحَدُكُمُ الْمَسْجِدَ فَلْيَرْكَعْ رَكْعَتَيْنِ قَبْلَ أَنْ يَجْلِسَ
অর্থ : তোমাদের কেউ মসজিদে প্রবেশ করলে বসার আগে দুই রাকাত নামায পড়ে নাও। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৪৩৩)
দুখুলুল মসজিদ মুস্তাহাব হওয়ার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নাই। ফরজ বা ওয়াজিব এমনকি সুন্নতও না। বিখ্যাত আহলে হাদিস আলেম আল্লামা মুবারকপুরি রহ. তোহফাতুল আহওয়াজিতে উল্লেখ করেন : قال الحافظ في الفتح واتفق أئمة الفتوى على أن الأمر في ذلك للندب (খ.২, পৃ. ২১৬; অধ্যায় : باب ما جاء إذا دخل أحدكم المسجد فليركع ركعتين)
সহিহ বুখারিতে হযরত জাবের রা. হতে একটি হাদিসে এসেছে : دَخَلَ رَجُلٌ يَوْمَ الْجُمُعَةِ وَالنَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَخْطُبُ فَقَالَ أَصَلَّيْتَ قَالَ لَا قَالَ قُمْ فَصَلِّ رَكْعَتَيْنِ অর্থ : রাসুল সা. জুমুআর খুতবা দেওয়ার সময় এক ব্যক্তি (সুলায়েক গাতফানি রা.) মসজিদে প্রবেশ করলেন। তখন রাসুল সা. তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি নামায পড়েছ? তিনি বললেন, না। রাসুল তাকে দুই রাকাত নামায পড়ার নির্দেশ দিলেন। (হাদিস : ৮৮৯; অধ্যায় : باب من جاء والإمام يخطب صلى ركعتين خفيفتين )
আরেকটি হাদিসে এসেছে, আবু জর গিফারি রা. জুমুআর খুতবার সময় মসজিদে আসলেন। রাসুল সা. তাকে জিজ্ঞেস করলেন : هل ركعت قال لا قال قم فاركع فقام فركع ركعتين অর্থ : নামায পড়েছ?
-জি না।
-তাহলে নামায পড়ো। তখন তিনি দু রাকাত নামায পড়লেন। (মুজামুল আওসাত, হাদিস : ৪৭২১)
---
এই দলিল দ্বারা বুঝা যাচ্ছে, খুতবা চলার সময়ও কেউ মসজিদে হাজির হলে দুখুলুল মসজিদ পড়তে হবে। এবার আসুন অন্য দলিল দেখি :
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنْ تَكَلَّمَ يَوْمَ الْجُمُعَةِ وَالْإِمَامُ يَخْطُبُ فَهُوَ كَمَثَلِ الْحِمَارِ يَحْمِلُ أَسْفَارًا وَالَّذِي يَقُولُ لَهُ أَنْصِتْ لَيْسَ لَهُ جُمُعَةٌ.
অর্থ : হযরত ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত, রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : জুমুআর দিন ইমামের খুতবার সময় যে ব্যক্তি কথা বলবে, সে গাধার অনুরূপ; কেবল সে বোঝা বহন করছে। আর যে ব্যক্তি তাকে ‘চুপ করো’ বলছে, তার জুমুআর নামাযই শুদ্ধ হবে না। [মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং- ২০৩৩; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদিস নং- ৫৩০৫; কানযুল উম্মাল, হাদিস নং- ২১২০৬]
এই হাদিস তেমন শক্তিশালী ও সহিহ না। কিন্তু বিষয়টি অন্যান্য সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। যেমন :
عَن أَبِي هُرَيْرَةَ أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ مَنْ قَالَ يَوْمَ الْجُمُعَةِ وَالْإِمَامُ يَخْطُبُ أَنْصِتْ فَقَدْ لَغَا.
অর্থ : হযরত আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন : ইমামের খতুবার সময় কেউ কাউকে বলল, ‘চুপ করো’ তাহলে সেও অতিরঞ্জন ও ভুল করল। [তিরমিযি, হাদিস নং- ৫১২, অধ্যায় : با ما جاء في كراهية الكلام والإمام يخطب]
ইমাম তিরমিযি রহ. হাদিসটি বর্ণনার পর বলেন : حَدِيثٌ حَسَنٌ صَحِيحٌ
ইমাম তিরমিযি সাধারণত হাদিস বর্ণনা করার পর হাদিসের ওপর আমল আছে কি-না তাও বলে দেন। এ হাদিস বর্ণনার পর তিনি বলেন :
وَالْعَمَلُ عَلَيْهِ عِنْدَ أَهْلِ الْعِلْمِ كَرِهُوا لِلرَّجُلِ أَنْ يَتَكَلَّمَ وَالْإِمَامُ يَخْطُبُ وَقَالُوا إِنْ تَكَلَّمَ غَيْرُهُ فَلَا يُنْكِرْ عَلَيْهِ إِلَّا بِالْإِشَارَةِ.
অর্থ : আহলে ইলম এ হাদিস অনুযায়ী আমল করে থাকেন। খুতবার সময় কথা বলাকে তারা মাকরুহ (তাহরিমি) মনে করেন। কেউ কথা বললে, তাকে ইশারায় চুপ থাকতে বলা হবে। ‘তুমি চুপ থাক’ এ কথাও বলা যাবে না।
শায়েখ নাসিরউদ্দিন আলবানিও সহিহ বলেছেন।
এ বিষয়ে আরেকটি হাদিস পেশ করছি :
عَنِ ابْنِ شِهَابٍ أَخْبَرَنِى سَعِيدُ بْنُ الْمُسَيَّبِ أَنَّ أَبَا هُرَيْرَةَ أَخْبَرَهُ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- قَالَ : إِذَا قُلْتَ لِصَاحِبِكَ أَنْصِتْ يَوْمَ الْجُمُعَةِ وَالإِمَامُ يَخْطُبُ فَقَدْ لَغَوْتَ.
অর্থ : হযরত আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : ইমামের খতুবার সময় তুমি যদি তোমার পাশের ব্যক্তিকে বলো ‘তুমি চুপ থাকো’ তাহলে তুমিও ভুল করলে। [সহিহ মুসলিম, হাদিস নং- ২০০২, অধ্যায় : باب فِى الإِنْصَاتِ يَوْمَ الْجُمُعَةِ فِى الْخُطْبَةِ]
হযরত আবু হুরায়রা রা. বলেন : ইমামের খুতবা দেওয়ার সময় তোমরা সুবহানাল্লাহও বলবে না। [বিদআতের উদ্ধৃতিতে মাহফুজ প্রণীত ইবাদ, পৃ. ২৭৩]
আমরা জানলাম, খুতবা শোনা ওয়াজিব। দুখুলুল মসজিদ পড়া মুস্তাহাব। এখন আমরা ওয়াজিব ছেড়ে দিয়ে মুস্তাহাব পড়ব? এখন প্রশ্ন হবে, রাসুল সা. তো এক বা দুইজন সাহাবিকে খুতবার সময় দুখুলুল মসজিদ পড়তে বলেছেন। মুহাদ্দিসে কেরাম এর অনেক উত্তর দিয়েছেন।
সেসব উত্তর না দিয়ে আমি ইনসাফের একটি কথা বলতে চাই, রাসুল সা. এর যুগে খুতবা শুরু হওয়ার অনেক আগেই সবাই মসজিদে হাজির হতেন। ওইদিন বিশেষ কোনো কারণে বিলম্ব হওয়ায় এক/দুইজন সাহাবিকে রাসুল সা. দুখুলুল মসজিদ পড়ার আদেশ করেছেন। কারণ, খুতবার পর নফল/সুন্নত পড়ার সুযোগ পাবে না। কিন্তু আমরা প্রতি সপ্তাহে এ কাজ করছি! ওদিকে ইমাম খুতবা দিচ্ছেন আর অনেক মানুষ দুখুলুল মসজিদ পড়ছেন!!!
এটা কি ইনসাফের কথা???
হা, কারও যদি হঠাৎ কোনোদিন দুখুলুল মসজিদ ছুটে যায়; আর তিনি নিয়মিত এ আমল করেন, তখন সে খুব দ্রুত দুই রাকাত পড়ে নিতে পারে। কিন্তু বারবার এ সুযোগ গ্রহণ করা মোটেও জায়েয হবে না। শরিয়তকে পরিবর্তন করার নামান্তর।
সব দলিল-প্রমাণ সামনে না রাখার কারণেই এ ভুল মাসআলা বুঝেছেন। উভয় প্রকার দলিল না দেখলে বিভ্রান্তির আশঙ্কা থাকে বেশি। এখানেও তাই হয়েছে
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন