মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
ব্যাপক দাওয়াতের প্রয়োজনীয়তা
দ্বীনের অনুসারীদের কাছে দ্বীনের অন্যতম প্রধান দাবি এই যে, তারা যেন সর্বস্তরের মানুষের মাঝে দ্বীনের অনুসরণ ব্যাপক করার চেষ্টা করেন এবং দ্বীনের দাওয়াতকে সমাজের কোনো বিশেষ শ্রেণী বা শুধু আগ্রহী ব্যক্তিদের মাঝে সীমাবদ্ধ না রাখেন। মুসলমানদের মনে মুসলমানিত্বের অনুভূতি জাগ্রত করার এবং দ্বীনের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টির প্রচেষ্টা দ্বীনের গুরুত্বপূর্ণ দাবি। মুসলমানদেরকে এ বিষয়ে সচেতন করতে হবে যে, দ্বীন ও ঈমান হচ্ছে শিক্ষা করার বিষয়। শেখা ছাড়া এমনি এমনি তা অর্জিত হয় না আর তা জাগতিক বিভিন্ন বিদ্যা ও পেশা শিক্ষার চেয়ে অনেক বেশি জরুরি।
বর্তমানে মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ব্যাধি দ্বীনের বিষয়ে অনাগ্রহ ও উদাসীনতা। এটি কীভাবে দূর হয় এবং তাদের মাঝে দ্বীনকে জানার এবং দ্বীন ও ঈমান শেখার প্রেরণা জাগ্রত হয়-এই প্রচেষ্টাই হচ্ছে দাওয়াতের ব্যাপক বিস্তারের সর্বাধিক প্রয়োজনীয় ও ফলপ্রসূ পদ্ধতি।
বিগত শতাব্দীর অন্যতম মুজাদ্দিদ হযরত মাওলানা ইলিয়াস রাহ.-এর প্রচেষ্টায় দিল্লীর নিযামুদ্দীন থেকে দাওয়াত ও তাবলীগের যে কর্মপন্থা প্রচলিত হয়েছে তা এ পদ্ধতির একটি উত্তম দৃষ্টান্ত। আল্হাম্দুলিল্লাহ এর মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহ কল্পনাতীত উপকার পেয়েছে এবং এখনও পাচ্ছে। ইনশাআল্লাহ কেয়ামত পর্যন্ত মানুষ এর মাধ্যমে উপকৃত হবে।
দ্বীনী ইলমের ব্যাপক বিস্তারের গুরুত্ব
যদিও দাওয়াত ও তাবলীগের এই পদ্ধতি লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের দিক থেকে মানুষের ঈমানী জাগরণ ও দ্বীনী শিক্ষার ব্যাপক বিস্তারের একিট ফলপ্রসূ মেহনত এবং এর মূল কর্মপন্থাও সর্বসাধারণের দ্বীনী ইলম অর্জনের একটি উত্তম উপায়। কিন্তু সে সময়ই হযরত মাওলানা ইলিয়াস রহ. বলে গেছেন যে, “আলেমগণের নিকট আরজ, তাবলীগ-জামাআতের চলাফেরা এবং মেহনত ও কোশেশ দ্বারা সর্বসাধারণের মাঝে শুধু দ্বীনের আগ্রহ ও দ্বীনের মূল্য বোঝার যোগ্যতা সৃষ্টি করা যাবে এবং তাদেরকে দ্বীন শেখার জন্য প্রস্তুত করা যাবে। এরপর তাদেরকে দ্বীন শেখানো এবং দ্বীনী তরবিয়তের কাজ উলামায়ে কেরাম ও হক্কানী বুযুর্গানে দ্বীনের মনোযোগ ও প্রচেষ্টার মাধ্যমেই সম্পন্ন হতে পারে। তাই এদিকে আপনাদের সদয় দৃষ্টির বড় প্রয়োজন।” -মালফূযাত, হযরত মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াস রহ., সংকলনে মাওলানা মুহাম্মদ মনযূর নুমানী রহ. ১৪২, মালফূয নং ২১২
তিনি আরো বলেছেন, “তাবলীগ-জামাআতের শিক্ষা-সিলেবাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ‘তাজবীদ’। কেননা কুরআন কারীম সহীহ-শুদ্ধভাবে তেলাওয়াত করতে শেখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তাজবীদ শিক্ষা দেওয়ার জন্য যে পরিমাণ সময় প্রয়োজন জামাআতে তা পাওয়া যায় না। এজন্য এই সময় শুধু চেষ্টা করতে হবে, যেন মানুষের মনে এর প্রয়োজনীয়তার অনুভূতি সৃষ্টি হয় এবং এর সাথে প্রাথমিক পর্যায়ের কিছু সম্পর্ক তৈরি হয়। এরপর বিষয়টি শেখার জন্য যেন আলাদা সময় বের করতে প্রস্তুত হয়ে যায়।” -মালফূযাত ১৩৮, মালফূয নং ২০২
বাস্তব কথা এই যে, ফরযে কেফায়া তো অনেক উপরের বিষয়, ফরযে আইন ইলমের পরিমাণও কম নয়। কুরআন, হাদীস, সীরাতে রাসূল, আকায়েদ, ইবাদত, লেনদেন, ব্যক্তি-জীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন, আত্মার জগৎ ইত্যাদি সকল বিষয়ের মৌলিক ও প্রাত্যহিক জীবনে প্রয়োজনীয় ইলম অর্জন করা প্রত্যেক মুসলিম নারী-পুরুষের উপর ফরয, তা তিনি যে শ্রেণীরই হোন না কেন।
তদ্রূপ বাস্তবতা এই যে, বর্তমান ফেতনার যুগে বৈষয়িক শিক্ষায় শিক্ষিত এবং সমাজ ও জগতের ব্যাপারে সচেতন ব্যক্তিদের জন্য দ্বীনিয়াতের প্রাথমিক কিছু জ্ঞান মোটেও যথেষ্ট নয়। হযরত থানভী রহ.এর ভাষায়, “তাদেরকে আকায়েদ ও আহ্কামের ইলম মোটামুটি বুঝে-শুনে অর্জন করতে হবে এবং ইসলামের সৌন্দর্য, নিগুঢ় তত্ত্ব ও রহস্য এবং ইসলামী শিক্ষা ও নির্দেশনার সর্বজনীনতা ও চিরন্তনতার মজবুত ইলম অর্জন করতে হবে। যাতে শরীয়তের মাহাত্ম্য অন্তরে বদ্ধমূল হয়ে যায় এবং ইসলামী আকীদা-বিশ্বাস মনমস্তিষ্কে এমনভাবে দৃঢ়মূল হয় যে, শত্রুদের নানামুখী অপপ্রচারের মুখেও তা বিপর্যস্ত হওয়ার আশংকা না থাকে।
এখন প্রশ্ন দাঁড়ায় যে, সাধারণ মানুষ ও সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত ভাইয়েরা দ্বীনিয়াতের উপরোক্ত জ্ঞান কীভাবে এবং কোথায় অর্জন করবেন এবং দ্বীনী দাওয়াতের মত দ্বীনী শিক্ষাকে ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর করার উপায় কী? অনেকের ধারণা, দ্বীনী ইলম শুধু বিশেষ সিলেবাস ও বিশেষ শিক্ষকদের অধীনে আরবী মাদ্রাসার গণ্ডির ভেতরে অবস্থান করে সুদীর্ঘ সময়ের অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমেই হাসিল করা যায়। আর যেহেতু সকলের পক্ষে মাদ্রাসার তালিবে ইলম হওয়া বা মাদ্রাসার চারদেয়ালের ভিতর আট দশ বছর সময় দেওয়া সম্ভব নয়, তাই তারা স্থির সিদ্ধানে- উপনীত হয়েছেন যে, ইলমে দ্বীন তাদের কিসমতে নেই। আর বাকি জীবনটুকু জাহালতের মধ্যে কাটানোর ব্যাপারেও তারা সন্তুষ্ট হয়ে গেছেন।
এই ধারণা ও সিদ্ধান্ত দু’টোই ভুল। দ্বীনের প্রয়োজনীয় ইলম (যার প্রতি উপরে ইঙ্গিত করা হয়েছে) প্রত্যেক মুসলমান চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং দুনিয়াবী অন্যান্য ব্যস্ততার মধ্যেও অর্জন করতে পারে। ইসলামের প্রথম যুগের মুসলমানদের ইতিহাস এর জ্বলন্ত প্রমাণ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন