বৃহস্পতিবার, ১৬ মার্চ, ২০১৭

মানুষ কিভাবে মানুষকে রব বা( ইলাহ) বানিয়ে ফেলে

যে শিরোনাম দিয়ে আমি লেখাটি শুরু করেছি, তাশুনে হয়তো আপনি আশ্চর্য হচ্ছেন। আসলেইতো! মানুষ আবার মানুষের ‘রব’ হয় কি করে? আমরাতো জানি ‘রব’ একমাত্র আল্লাহ তা’আয়ালা। অথচ তিনিনিজেই বলেছেন -“তারা তাদের সণ্যাসী ও ধর্মযাজক (পীর বাবা। তাদের নেতা নেত্রী ও নেতৃস্থানীয় লোকদেরকে ) আল্লাহরপরিবর্তে ‘রব’ বানিয়ে নিয়েছে—–।” (সূরা তওবা ৯:৩১)অন্য আয়াতে আল্লাহ তা’আয়ালা তাঁর নবীকে দাওয়াতী পদ্ধতি শিক্ষা দিতে গিয়েও বলেছেন -। যদিওকারো পক্ষে ‘রব’ হওয়া সম্ভব নয়, তাই এখানেবুঝতে হবে যে অজ্ঞতা, জ্ঞানের স্বল্পতা,একগুয়েমী কিংবা বিভিন্ন কারণে অনেক সময় মানুষকোনো কোনো মানুষকে এমন স্থানে বসিয়ে দেয়, এমন ক্ষমতা মানুষের হাতে তুলেদেয়; যার কারণে একান্তভাবে আল্লাহর জন্য সংরক্ষিত ক্ষমতার আসনে মানুষকে বসিয়ে ‘রব’বানিয়ে ফেলে।
আর এভাবে নিজেদেরকর্মকান্ডের দ্বারা তারা নিজেদের জন্য চিরকালীনজাহান্নাম কিনে নেয়। অথচ এই লোকগুলোরভেতরে হয়তো এমন মানুষও আছে যারা নামাযপড়ে, রোযা রাখে, হজ্জ করে, যাকাত দেয়, দাড়িআছে, একান্ত নিষ্ঠার সাথে তাসবীহ জপে, এমনকিতাহাজ্জুদ, এশরাক, আওয়াবীন নামাযও পড়ে। তাই মানুষকিভাবে মানুষের ‘রব’ হয়ে যায়, অর্থাৎ কোনবৈশিষ্ট, গুণাবলী ও ক্ষমতা হাতে তুলে দিলেমানুষকেই রবের আসনে বসিয়ে দেয়া হয়, এসম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা না থাকার কারণে এই জঘন্যতমঅপরাধ যদি আমরা কেউ করে বসি,
তাহলে যত নেকআমলই করি না কেন তা কোনো কাজে আসবে নাএবং কোনো ইবাদতই কবুল হবে না। এ ব্যাপারেকেয়ামতের দিন কোনো ওজর ওজুহাত চলবে না,জানতাম না বলেও পার পাওয়া যাবে না। কেননা, আল্লাহতা’আলা স্পষ্ট করে কোরআনে বলে দিয়েছেনঃ“(হে মানবজাতি) স্মরণ করো সেই সময়ের কথা,যখন তোমাদের ‘রব’ আদম সন্তানের পৃষ্ঠদেশথেকে তাদের পরবর্তী বংশধরদের বের করেএনেছেন এবং তাদেরকেই তাদের নিজেদেরব্যাপারে সাক্ষ্য রেখে বলেছেন, ‘আমি কি তোমাদের একমাত্র ‘রব’ নই?
তারা সবাই বললো,‘হ্যাঁ, আমরা সাক্ষ্য দিলাম (যে আপনিই আমাদেরএকমাত্র ‘রব’)’, এই সাক্ষ্য আমি এ জন্যই নিলাম যে,হয়তো কেয়ামতের দিন তোমরা বলে বসবে যে, আমরা আসলে বিষয়টি জানতামই না।অথবা তোমরা হয়তো বলে বসবে যে, আমরাতো দেখেছি আমাদের বাপ-দাদারা আগেথেকেই এই শিরকি কর্মকান্ড করে আসছে (সুতরাংআমরা তো অপরাধী না, কারণ) আমরা তো তাদেরপরর্বতী বংশধর মাত্র। তারপরও কি তুমি পূর্ববর্তীবাতিলপন্থীদের কর্মকান্ডের কারণেআমাদেরকে ধ্বংস করে দেবে?” (সূরা আরাফ৭:১৭২-১৭৩)
আল্লাহ তায়ালা কোরআনের মাধ্যমে আমাদেরজানিয়ে দিয়েছেন যে, এ ব্যাপারে কোনোঅজুহাত চলবে না, জানতাম না বলেও কোন লাভহবে না। তাই আসুন আমরা কোরআনের উপস্থাপিতবাস্তব ঘটনার আলোকে বুঝতে চেষ্টা করিকিভাবে মানুষ মানুষের ‘রব’ হয়ে যায়।
কেননাকোরআনের আলোকে বুঝতে চেষ্টা করলেআমাদের জন্য বিষয়টি নির্ভূলভাবে বোঝা অনেকসহজ হয়ে যাবে। মূল আলোচনায় যাওয়ার আগেএকটি বিষয় জেনে নিন, কোরআনে যখন কোনব্যক্তি বা জাতির ইতিহাস তুলে ধরা হয় তখন বুঝতেহবে ইতিহাস বা গল্প শোনানোই এখানে উদ্দেশ্যনয়, বরং ব্যক্তি কিংবা জাতি কী কাজ করেছিলো এবংএর ফলে তাদের কী পরিণতি হয়েছে তাপর্যালোচনার মাধ্যমে ঐ কাজের পুনরাবৃত্তিথেকে উম্মতে মুহাম্মদীকে সতর্ক করাই ইতিহাসতুলে ধরার উদ্দেশ্য।আর একটি বিষয় মনে রাখতেহবে
যে, কোরআনে যখনই কোন চরিত্রেরউল্লেখ হবে, বুঝতে হবে এ ধরনের চরিত্রকেয়ামত পর্যন্ত পৃথিবীতে থাকবে।কোরআনের আলোকে মানুষ কিভাবে মানুষের‘রব’ হয়ে যায় তা খতিয়ে দেখতে গিয়ে মানব জাতিরঅতীত ইতিহাসেই শুধু নয় বর্তমান বিশ্বেও অসংখ্য(মিথ্যা) রবের পদচারণা আমরা সচরাচর দেখতে পাই।তবে তারা শুধু মুখ দিয়ে বলে না যে, আমরা তোমাদের ‘রব’।‘রব’ দাবী করা বলতে মূলতঃ কী দাবী করা হয় তাযদি আমরা সত্যিই বুঝতে চাই তাহলে কিছুক্ষণেরজন্যে আমাদেরকে ফিরে যেতে হবেফেরাউনের ইতিহাসের দিকে। কারণ সে যেপ্রকাশ্য নিজেকে ‘রব’ ঘোষণা করেছিলো তাকোরআন সুস্পষ্ট ভাষায় তুলে ধরেছেঃ“দেশবাসীকে জড় করে সে ভাষণ দিলো,অতপর সে বললো, আমিই তোমাদের সবচেয়েবড় ‘রব’।” (সূরা নাযিয়াত ৭৯: ২৩-২৪)
এখন কথা হলো, ফেরাউন নিজেকে ‘রব’ বলতেকী বুঝিয়েছে? সে কি দাবী করেছিলো যে,সে আসমান যমীন সৃষ্টি করেছে, মানব জাতিকেসৃষ্টি করেছে কিংবা পাহাড়-পর্বত যমীনের বুকেগেড়ে যমীনকে সে স্থিতিশীল করেরেখেছে?না, এমন দাবী সে কখনো করেনি। সে যদি এমনদাবী করতো তাহলে তার সংগী-সাথীরাই তাকেপাগল বলে উড়িয়ে দিতো।
বরং সে নিজেও বিভিন্নপূজা-পার্বনে অংশ নিতো। তারও অনেক ধরনেরইলাহ, মাবুদ বা উপাস্য ছিলো। কোরআন থেকেইএর প্রমাণ দেখে নিনঃ“ফেরাউনের জাতির নেতারা (ফেরাউনকে)বললো, আপনি কি মূসা ও তার দলবল কে রাজ্যে বিপর্যয় সৃষ্টির সুযোগ দিবেন আর তারা আপনাকে ওআপনার ইলাহদের এভাবে বর্জন করেচলবে?” (সূরা আরাফ ৭: ১২৭)
দেখুন মক্কার কাফের মুশরেকরা ওএসবের সৃষ্টিকর্তা যে আল্লাহ তা’আলা এটাসর্বান্তঃকরণে মানতো। যেমনঃ“জিজ্ঞাসা কর, ‘এই পৃথিবী এবং এর মধ্যে যারা আছেনতারা কার, যদি তোমরা জান?’ তারা বলবে ‘আল্লাহর’।বল, ‘তবুও কি তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করবে না?’জিজ্ঞাসা কর, ‘কে সপ্ত আকাশ এবং মহা আরশেরঅধিপতি?’ তারা বলবে ‘আল্লাহ’।বল, ‘তবুও কি তোমরাভয় করবে না?’ জিজ্ঞাসা কর, ‘সকল কিছুর কর্তৃত্বকার হাতে, যিনি আশ্রয় দান করেন এবং যার উপরেআশ্রয়দাতা নেই, যদি তোমরা জান?’ তারা বলবে‘আল্লাহর’। বল, ‘তবুও তোমরা কেমন করেমোহগ্রস্থ হয়ে আছ?’”(সূরা মু’মিনুন ২৩ ৮৪-৮৯)
এমন আরো অসংখ্য আয়াত আছে যা প্রমাণ করেযে, তারা সৃষ্টিকর্তা, রক্ষাকর্তা, লালনকর্তা, পালনকর্তাও রিযিকদাতা হিসাবে আল্লাহকে মানতো, সুতরাংসমস্যাটা কোথায় ?
এই বিশ্বাস থাকার পরও কেন তারাকাফের-মোশরেক, কেন তাদের জন্য জাহান্নামঅবধারিত ? ফেরাউন তাহলে কী দাবীকরেছিলো ? এই প্রশ্নগুলো শুনে হয়তোঅনেকে বিভ্রান্তিতে পড়ে যাবেন। কিন্তু বিভ্রান্তহওয়ার কিংবা অন্ধকারে হাতড়ে মরার কোনোপ্রয়োজনই নেই। সরাসরি আল্লাহর কালামকোরআনই আমাদেরকে স্পষ্ট করে জানিয়েদিচ্ছে যে, ফেরাউনের দাবী ছিল সার্বভৌমত্বেরদাবী।
সারা পৃথিবীতে নয় তার দাবী ছিল কেবলমিশরের শাসন ক্ষমতার উপর নিরংকুশ আধিপত্যেরদাবী। তার দাবী ছিলো মিশরের সাধারণ জনগণেরজন্যে তার ইচ্ছানুযায়ী যেমন খুশী তেমন আইন-কানুন ও মূল্যবোধ নির্ধারনের ক্ষমতার দাবী।দেখুন কোরআন কী বলেছেঃ“ফেরাউন তার জাতির উদ্দেশ্যে (এক) ভাষণদিলো। সে বললো, মিশরের সার্বভৌমত্ব কি আমারনয়? তোমরা কি দেখছো না যে, এই নদীগুলোআমার (রাজত্বের ) অধীনেই বয়ে চলছে——–।” (সূরা যুখরুফ ৪৩:৫১)“এসব বলে সে তার জাতিকে ভীতসন্ত্রস্ত করেতুললো, এক পর্যায়ে তারা তার আনুগত্য মেনেওনিলো। এটি প্রমাণ করে যে,নিঃসন্দেহে তারানিজেরাও ছিলো এক পাপীষ্ঠ জাতি।” (সূরা যুখরুফ৪৩:৫৪)
কোরআনের আয়াতগুলো এবং বাস্তব প্রেক্ষাপটযদি আমরা চিন্তা করি তাহলে নিশ্চয়ই বুঝতে পারি যে,আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী,চক্র বা যে কারো সার্বভৌমত্ব মেনে নেয়ামানেই হলো তাকে বা তাদেরকে ‘রব’ বানিয়েনেয়া। কারণ অন্য কারো সার্বভৌমত্ব মেনে নেয়ামানেই হলো আল্লাহর সার্বভৌমত্ব অস্বীকারকরে আইন-কানুন রচনা করার অধিকারসহ নিরংকুশ শাসনকর্তৃত্ব তাদের হাতে তুলে দেয়া।তারা কিভাবে তাদেরকে আল্লাহর পরিবর্তে ‘রব’বানিয়ে নিয়েছিলো তা আমরা সরাসরি আল্লাহর রাসূল(সাঃ)-এর করা এই আয়াতের তাফসীরেরআলোকে একেবারে স্পষ্ট করে বুঝতেপারবো ইনশাআল্লাহ। তিরমিযীতে উদ্ধৃত হাদিসেহযরত আদী ইবনে হাতেম (রাঃ) বলেন, আমিএকবার রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর কাছে এসে দেখলাম তিনিসূরা তওবার এই আয়াতটি তেলাওয়াত করছিলেনঃ“তারা তাদের সন্ন্যাসী ও ধর্মযাজক (পীর,নেতৃস্থানীয় লোকদেরকে) আল্লাহরপরিবর্তে ‘রব’ বানিয়ে নিয়েছে——।” (সূরা তওবা৯:৩১)
অতপর রাসূল (সাঃ) বলেন তোমরা শোনো তারাতাদেরকে (শাব্দিক অর্থে) পূজা/ উপাসনা করতোনা, কিন্তু তারা যখন মনগড়া ভাবে কোনো কিছুকেবৈধ ঘোষনা করতো, জনগণ তা মেনে নিতো,আর যখন কোনো কিছুকে অবৈধ ঘোষণাকরতো তখন তারা তা অবৈধ বলে মেনে নিতো।তাফসীরে ইবনে কাসীরে ইমাম আহমদ তিরমিযীও ইবনে জারীরের সূত্রে আদী ইবনেহাতেম (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে,তার কাছেইসলামের দাওয়াত আসার পরে প্রথমে তিনি সিরিয়ায়পালিয়ে গিয়েছিলেন, পরে যখন রাসূল (সাঃ) এরকাছে তিনি এলেন তখন তার গলায় ক্রুশ ঝুলানোছিলো
। তখন রাসূল (সাঃ) উল্লেখিত আয়াতটিপড়ছিলেন। হযরত আদী (রাঃ) বলেন, আহলে কিতাবরা (ইহুদী ও খৃষ্টানরা) তো আলেম/দরবেশদের (তথা নেতাদের)পূজা উপাসনা করতোনা ! রাসূল (সাঃ) বললেন, তা সত্য। তবে তারা মনমতোকোনো কিছুকে বৈধ কিংবা অবৈধ ঘোষনা করলেজনগণ তা নির্বিচারে মেনে নিতো। এটাই তাদেরপূজা-উপাসনা/ ইবাদত।বর্তমান তাগুতী (সীমালঙ্ঘনকারী) সরকার ব্যবস্থায়এর উদাহরণ দেখুন, ১. মদ, ২. জুয়া, ৩. লটারী, ৪.সুদ, ৫. বেপর্দা, ৬.নারী নেতৃত্ব, ৭. বেশ্যাবৃত্তি(ব্যভিচার) ৮. এমন আরো অসংখ্য বিষয় রয়েছে,যেগুলো আল্লাহ তা’আলা কঠোর ভাবে অবৈধঘোষণা করেছেন, পক্ষান্তরে, তারা এগুলোকেবৈধতার সার্টিফিকেট দিয়েছে।
দন্ডবিধির বিষয়টিদেখুন, চুরি ও ডাকাতির দন্ড, ব্যভিচারের দন্ড, সন্ত্রাসদমন আইন, বিবাহ বিধিসহ আরো অনেক বিষয়েআল্লাহ তা’আলা যে বিধান আল-কোরআনেরমাধ্যমে ঘোষনা করেছেন, তা বাদ দিয়ে তারানিজেদের মনমতো দন্ড বিধি বৈধ করছে। এইঅধিকার তারা পেল কোথায়, তবে কি আপনি তাদের কে রব হিসেবে মেনে নেন নি?
কেননা আপনার ভোটের কারনে ই তারা বিজয়ী হয়েছে
আপনার ভোট পেয়েই তারা আ্ল্লাহর। কোরআনের আইন বাতিল করেছে। তাহলে কি আপনি তাদের রব হিসেবে মেনে নেন নি?? 
 নিশ্চয় মেনে নিয়েছেন

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন