বৃহস্পতিবার, ৪ আগস্ট, ২০১৬

তাবিজ-কবজ ব্যবহার করা শিরক?

 মুহিউদ্দীন কাসেমী (হাফি:)

তাবিজ-কবজ ব্যবহার করাকে অনেকে শিরক বলতেছে।
আসলে কি তাই? 
বিষয়টি আমি খতিয়ে দেখার চেষ্টা করেছি। তাহকীক করে যা পেয়েছি, উপস্থাপন করেছি। দালিলিক ও যৌক্তিক সমালোচনা সম্মান ও সমীহের উপযুক্ত। কেবল আকাবির ও শায়েখদের নাম দিয়ে দোহাই দিলে চলবে না। অমুক শায়েখ এটা বলেছেন, তমুক ইউটিউব আলোচক এটা বলেছেন- এসব চলবে না। দলিল ও যুক্তি দিন, মেনে নেব ইনশাল্লাহ। 
.
সমস্ত ক্ষমতার মালিক আল্লাহ। রোগ দেওয়ারও মালিক তিনি, রোগের আরোগ্যও দেন তিনি। পৃথিবীর কোনো বস্তুই আল্লাহর হুকুম ছাড়া কিছু করতে পারে না। 
হযরত উসামা ইবনে শরিক রা. বলেন, কিছু গ্রাম্যলোক রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে জিজ্ঞেস করেন, হুজুর! আমরা কি চিকিৎসা করাব? তখন রাসুল সা. বলেন : 
تَدَاوَوْا فَإِنَّ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ لَمْ يَضَعْ دَاءً إِلاَّ وَضَعَ لَهُ دَوَاءً غَيْرَ دَاءٍ وَاحِدٍ الْهَرَمُ.
অর্থ : চিকিৎসা করাও। কারণ, আল্লাহ তাআলা এমন কোনো রোগ সৃষ্টি করেননি যার কোনো ওষুধ দেননি। তবে বার্ধক্য (মৃত্যু) রোগের কোনো ওষুধ নেই। (সুনানে আবী দাউদ, হাদিস নং- ৩৮৫৭) 
ওষুধের মাঝে নিজস্ব কোনো ক্ষমতা নেই। ওষুধের সবটুকুন ক্ষমতাই আল্লাহপ্রদত্ত। আল্লাহর হুকুমে ওষুধ কাজ করে। প্রত্যেক বস্তুর বেলায়ই একই কথা প্রযোজ্য। 
রোগের চিকিৎসা করানো সকলের মতেই বৈধ। শুধু জায়েয নয়, সুন্নতও বটে। রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামও চিকিৎসা গ্রহণ করেছেন। সুতরাং তাবিজ-কবজকেও চিকিৎসার একটি মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করা যাবে। তাতে শিরকের কোনো গন্ধ নেই। ওষুধকে যদি কেউ মুসাব্বিব বা মূল প্রভাবক মনে করে তাহলেও শিরক হবে। তদ্রƒপ কেউ যদি তাবিজকে মূল প্রভাবক মনে করে, আল্লাহর ওপর ভরসা না করে তখন তো তাবিজ ব্যবহার করাও শিরক হবে।
তাবিজ-কবজ ব্যবহারের ক্ষেত্রে আরেকটি মৌলিক বিষয় হল, কোনো কুফুরি কালাম বা নাজায়েয কোনোকিছু দ্বারা তাবিজ দেওয়া যাবে না; দিলে নাজায়েয হয়ে যাবে। যেমন কেউ কুরআনের আয়াত বা কোনো দোয়া দ্বারা তাবিজ দিল, এটা নিঃসন্দেহে জায়েয হবে। এক্ষেত্রে সে আল্লাহর কালামের আশ্রয় গ্রহণ করেছে। আল্লাহর কালামও আল্লাহর একটি সিফত। সে তো কোনো শিরক করেনি। অতএব এ ধরনের তাবিজ শিরকের অন্তর্ভুক্ত হবে না। 
মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বার মধ্যে একটি স্বতন্ত্র অধ্যায় হল : مَنْ رخَّصَ فِي تعلِيقِ التَّعَاوِيذِ : তাবিজ ঝুলানোর ক্ষেত্রে অবকাশ। 
এ অধ্যায়ের অধীনে তিনি সাহাবি-তাবেয়িদের কর্ম ও বক্তব্য দ্বারা তাবিজ ব্যবহারের ওপর দলিল দিয়েছেন। যেমন : 
كَانَ مُجَاهِدٌ يَكْتُبُ للنَّاسَ التَّعْوِيذَ فَيُعَلِّقُهُ عَلَيْهِمْ.
অর্থ : বিখ্যাত তাবেয়ি মুজাহিদ রহ. মানুষকে তাবিজ লিখে ঝুলিয়ে দিতেন। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদিস নং- ২৪০১১) 
عَنْ عَطَاءٍ ، قَالَ : لاَ بَأْسَ أَنْ يُعَلَّقَ الْقُرْآنُ.
অর্থ : প্রখ্যাত তাবেয়ি আতা রহ. কুরআন দ্বারা তাবিজ ঝুলানো জায়েয মনে করতেন। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদিস নং- ২৪০১১)

عَنْ عَمْرِو بْنِ شُعَيْبٍ ، عَنْ أَبِيهِ ، عَنْ جَدِّهِ ، قَالَ : قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم : إِذَا فَزِعَ أَحَدُكُمْ فِي نَوْمِهِ فَلْيَقُلْ : أَعُوذُ بِكَلِمَاتِ اللهِ التَّامَّاتِ مِنْ غَضَبِهِ وَسُوءِ عِقَابِهِ ، وَمِنْ شَرِّ عِبَادِهِ ، وَمِنْ شَرِّ الشَّيَاطِينِ وَمَا يَحْضُرُونِ ، فَكَانَ عَبْدُ اللهِ يُعَلِّمُهَا وَلَدَهُ مَنْ أَدْرَكَ مِنْهُمْ ، وَمَنْ لَمْ يُدْرِكْ ، كَتَبَهَا وَعَلَّقَهَا عَلَيْهِ.
অর্থ : হযরত আমর ইবনে শোআইব স্বীয় পিতার সূত্রে তার দাদা থেকে বর্ণনা করেন, রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : তোমাদের কেউ ঘুমে ভয় পেলে এ দোয়া পড়বে : 
أَعُوذُ بِكَلِمَاتِ اللهِ التَّامَّاتِ مِنْ غَضَبِهِ وَسُوءِ عِقَابِهِ ، وَمِنْ شَرِّ عِبَادِهِ ، وَمِنْ شَرِّ الشَّيَاطِينِ وَمَا يَحْضُرُونِ
আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা. প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানদের এ দোয়া শিখাতেন আর অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানদের গলায় দোয়াটি তাবিজ বানিয়ে ঝুলিয়ে দিতেন। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদিস নং- ২৪০১১; সুনানে আবী দাউদ, হাদিস নং- ৩৮৯৫, কিতাবুত তিব, অধ্যায় : باب كَيْفَ الرُّقَى) 
.
তবে দুয়েকটি হাদিসে তাবিজ ব্যবহার নিষিদ্ধের কথা পাওয়া যায়। এগুলোকে সামনে রেখেই অনেকে তাবিজ ব্যবহারকে শিরক বলেন। যেমন : مَنْ عَلَّقَ تَمِيمَةً فَقَدْ أَشْرَكَ ‘যে তাবিজ ঝুলাল, সে শিরক করল’। 
তারা আসলে পুরো হাদিস উল্লেখ করেন না। পুরো হাদিস দেখলেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায় যে, কার জন্যে তাবিজ ব্যবহার করা নিষেধ করা হয়েছে। পুরো হাদিসটি দেখুন : 
عَنْ عُقْبَةَ بْنِ عَامِرٍ الْجُهَنِيِّ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَقْبَلَ إِلَيْهِ رَهْطٌ فَبَايَعَ تِسْعَةً وَأَمْسَكَ عَنْ وَاحِدٍ فَقَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ بَايَعْتَ تِسْعَةً وَتَرَكْتَ هَذَا قَالَ إِنَّ عَلَيْهِ تَمِيمَةً فَأَدْخَلَ يَدَهُ فَقَطَعَهَا فَبَايَعَهُ وَقَالَ مَنْ عَلَّقَ تَمِيمَةً فَقَدْ أَشْرَكَ
অর্থ : হযরত উকবা ইবনে আমের আল-জুহানি রা. বলেন : একবার রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লামের ইসলাম গ্রহণের জন্যে কাছে একটি দল আসল। তাদের নয়জনকে বায়আত করলেন; একজনকে করলেন না। তারা বলল, হুজুর! সবার বায়আত গ্রহণ করলেও তারটি কেন করেননি? রাসুল সা. বললেন, তার কাছে তাবিজ থাকায় তাকে বায়আত করিনি। কারণ, যে তাবিজ ঝুলাল সে শিরক করল। (মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং- ১৭৪২২) 
এবার বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে গেল। কারণ, যারা ইসলাম গ্রহণ করতে এসেছিল তারা তো মুশরিক ছিল। আর মুশরিকের গলায় কুরআনের তাবিজ থাকবে? ছিল কুফুরি কালামের তাবিজ। যে কারণে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতিনিধিদলের সবাইকে বায়আত করলেও তাবিজওয়ালাকে করেননি। তাবিজ খোলার পর বায়আত করেছেন। কুরআন-হাদিস দ্বারা তাবিজ গ্রহণ করলে শিরক হওয়ার প্রমাণ কি এ হাদিস দ্বারা দেওয়া যায়? মোটেও দেওয়া যাবে না। 
এসব হাদিসের ব্যাখ্যায় মুহাদ্দিসিন ও ফুকাহায়ে কেরামের অভিমতও লক্ষণীয় : 
মাও. সিন্দি রহ. বলেন : 
قال السندي المراد تمائم الجاهلية مثل الخرزات وأظفار السباع وعظامها وأما ما يكون بالقرآن والأسماء الإلهية فهو خارج عن هذا الحكم بل هو جائز
(আউনুল মাবুদ : খ. ১০, পৃ. ২৫০)

আল্লামা ইবনে আবিদীন শামী রহ. বলেন : 
( قَوْلُهُ التَّمِيمَةُ الْمَكْرُوهَةُ ) أَقُولُ : الَّذِي رَأَيْته فِي الْمُجْتَبَى التَّمِيمَةُ الْمَكْرُوهَةُ مَا كَانَ بِغَيْرِ الْقُرْآنِ.
(ফাতাওয়া শামী : খ. ৬, পৃ. ৩৬৪) 
.
মোটকথা, চিকিৎসা গ্রহণ করা জায়েয। যে কোনো বৈধ জিনিস দ্বারাই চিকিৎসা গ্রহণ করা যায়। এক্ষেত্রে শরিয়তের কোনো বাধানিষেধ নেই। অকাট্য হারাম বস্তু দ্বারা চিকিৎসা গ্রহণ করা মতানৈক্যপূর্ণ একটি বিষয়। তদ্রƒপ তাবিজ-কবজও চিকিৎসার একটি মাধ্যম ও উপকরণ মাত্র। ওষুধের যেমন নিজস্ব কোনো ক্ষমতা নেই, তাবিজেরও নেই। তাই অবৈধ ও নাজায়েয উপকরণ ব্যতীত যে কোনো জিনিস দ্বারা তাবিজ গ্রহণ করা নাজায়েয হবে না। 
এ ওষুধ খেলে এ কাজ হবেÑ এটা কি হাদিসে থাকা লাগবে? এটা অভিজ্ঞতার বিষয়। তদ্রƒপ কুরআন-সুন্নাহর কোনো বিষয় দ্বারা তাবিজ গ্রহণ করার বিষয়টি নসে (কুরআন-হাদিসে) থাকা লাগবে কেন? অভিজ্ঞতাই যথেষ্ট। 
হা, বিধিবিধান ও ফজিলতের জন্য নস দরকার।
.
কয়েকটি বিষয় মনে রাখা দরকার :
* তাবিজ-কবজের নামে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু হয়েছে। এগুলো শরিয়তে নিন্দনীয়। কুরআনকে উপার্জনের মাধ্যম বানানো মোটেও ঠিক নিয়। 
* সব জায়েয কাজ করতে হয় না। কেবলার দিকে মুখ ও পিঠ দিয়ে ইস্তেঞ্জা করার বৈধতা হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয়, অনেক ইমামও মত দিয়েছেন; তাই বলে কি কোনো মুসলিম এ কাজ করে? স্বয়ং ওই ইমামগণ করেছেন? 
* নিরাপদ ও সংশয়মুক্ত থাকাই দরকার। তাবিজের বিষয়টি নাজায়েয না হলেও মাজারপূজারী ও ভ-দের কারণে কেবল নাজায়েয না, শিরকের পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। প্রসিদ্ধ মাজারগুলোতে গেলে বিষয়টির সত্যতা উপলব্ধি হয়। 
* লোহার তাবিজ ব্যবহার করা যাবে না। রূপার তাবিজ ব্যবহার করতে হবে। 
* তাবিজের ভেতর কুরআনের আয়াত ও হাদিস থাকলে বাথরুমে গমন করা অনুচিত।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন