বৃহস্পতিবার, ৪ আগস্ট, ২০১৬

ভয় ও আশা : একটি তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ


বিচারপতি আল্লামা তাকি উসমানি
অনুবাদ : মুহিউদ্দীন কাসেমী
.
যে সব অভ্যন্তরীণ গুণ ও আমল অর্জন করা মানুষের জন্য আবশ্যক ও প্রয়োজনীয়, সেগুলোর মধ্যে ভয় ও আশা অন্যতম। ভয়ের অর্থ “আল্লাহর ভয়”। কেননা মানুষ যদি আল্লাহকে ভয় না করে তাহলে সে অলসতা ও গোনাহে লিপ্ত হয়ে যায়। আর আশার অর্থ হল আকাঙ্ক্ষা অর্থাৎ মানুষের মধ্যে আল্লাহ তাআলার ভয়ও হবে আর আল্লাহ তাআলার জাত এবং তার দয়ার আশাও থাকবে। উভয়টি যখন একসাথে হবে তখন ইমান পরিপূর্ণ হয়। হাদিস শরিফে এসেছে :
الْإِيمَانُ بَيْنَ الْخَوْفِ، وَالرَّجَاءِ
অর্থাৎ ইমান ভয় ও আশার মাঝে। 
যদি এ উভয়টির পরিমাপ সঠিক হয়ে যায় তাহলে ইমান পূর্ণ হয়ে যায়। মানুষের মধ্যে যতটুকু আল্লাহর ভয় থাকা চাই। ততটুকুই থাকবে। তার চেয়ে কমবেশি হবে। এভাবে যতটুকু আশা থাকা কাম্য ততটুকুই আশা হবে। তারচেয়ে কমবেশি হবে না। তবেই মানুষের ইমান পূর্ণ হবে।

ভয় ও আশা উভয়টি থাকা চাই
ইমান গাজালি রহ. বলেন, ভয় ও আশা দু’টি ডানা। যার দ্বারা নেককারগণ এ পৃথিবী থেকে জান্নাতের দিকে উড়ে চলে। যেমন, পাখি পাখা দিয়ে উড়ে চলে। তাই এ উভয়টি অর্জন করা আবশ্যক। কুরআনে কারিমে আল্লাহ তাআলা বিভিন্ন স্থানে এর প্রয়োজনীয়তার প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। সুতরাং ভয়ের ব্যাপারে বলেছেন :
تَتَجَافَى جُنُوبُهُمْ عَنِ الْمَضَاجِعِ يَدْعُونَ رَبَّهُمْ خَوْفًا وَطَمَعًا
তাদের পার্শ্ব শয্যা থেকে আলাদা থাকে। তারা তাদের পালনকর্তাকে ডাকে ভয়ে ও আশায়। [সূরা সেজদা- ১৬]

রহমতের আশা ও জাহান্নামের ভয়
পুরো কুরআন কারিমে আপনি এটা দেখবেন যে, আল্লাহ তাআলা কোথাও জান্নাতের আলোচনা পৃথক ও জাহান্নামের আলোচনা ও করেছেন। আমি কোথাও এর ব্যতিক্রম দেখিনি। এটা এজন্য করেছেন যাতে করে একবার জান্নাতের ঝলক দেখিয়ে মানুষের মনে রহমতের আশা সৃষ্টি করে, আর অপরদিকে জাহান্নামের ঝলক দেখিয়ে মনের মধ্যে নিজের ভয় সৃষ্টি করে। সুতরাং এক স্থানে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন :
نَبِّئْ عِبَادِي أَنِّي أَنَا الْغَفُورُ الرَّحِيمُ (৪৯) وَأَنَّ عَذَابِي هُوَ الْعَذَابُ الْأَلِيمُ
অর্থ : আমার বান্দাদের বলে দাও, আমি বড় ক্ষমাশীল ও দয়ালু। এবং আমার শাস্তিও অত্যন্ত মারাত্মক ও ভয়াবহ। [সূরা হিজর : ৪৯-৫০]
দেখুন উভয় কথা একসাথে বলে দিলেন। এবার রহমতের চাহিদা হল মানুষ আল্লাহর রহমতের আশাবাদী হবে আর তার আযাবের চাহিদা হল মানুষ আল্লাহকে ভয় করবে। যখন উভয়টি সাথে নিয়ে চলবে তো সে নিজের ইমানকে পরিপূর্ণ করবে।

কতটুকু ভয় হওয়া চাই
যদি মানুষের ওপর শুধুু প্রাধান্য বিস্তার করে তাহলে এটাও ভয়ঙ্কর ব্যাপার। যখন শুধুু ভয়ই ভয় হবে। আশা একেবারেই থাকবে না। এর ফলে একদিকে জীবন দুর্বিষহ হয়ে যাযে, অপরদিকে নিরাশ ও হতাশা সৃষ্টি হবে। সে এটা চিন্তা করবে যে, আমার তো কোনো ঠিকানাই নেই। আর এ হতাশা অত্যন্ত ভয়ানক বিষয়। এটা মানুষকে ধ্বংস করে দেয়। এজন্য আল্লাহর আজমত, তার মহত্ব শক্তিমত্তা ও তার আযাবের ভয় যদি সর্বদা বিদ্যমান থাকে এবং এ পরিমাণ যে, তা মন-মস্তিষ্কে ছেয়ে যায় তাহলে মানুষ খানাপিনা ছেড়ে দেবে এবং দুনিয়াবি কাজকর্ম থেকেও বিরত থাকব। তাই হুজুর সা. আল্লাহর নিকট ভয় চেয়েছেন। কিন্তু কতটুকু চেয়েছেন? তিনি বলেন-
اللَّهُمَّ اقْسِمْ لَنَا مِنْ خَشْيَتِكَ مَا تَحُولُ بِهِ بَيْنَنَا وَبَيْنَ مَعَاصِيكَ
শুধুু এটা বলেননি যে, আমাকে আপনার ভয় দান করুন বরং বলেছেন, হে আল্লাহ! এতটুকু ভয় দান করুন, যা আমার আপনার নাফরমানির মাঝে প্রতিবন্ধক হয়। [সুনানে তিরমিযি, হাদিস নং- ৩৪২৪] 
শুধু ভয় চাননি। কারণ, যাদের ওপর আল্লাহর নিকট ভয় প্রভাব বিস্তার করে এবং ভয়েরই আধিক্য হয়। এর দ্বারা জীবন দুর্বিষহ হয়ে যায়। 
অন্য দোয়ায় আল্লাহর কাছে চেয়েছেন :
اللهم اسألك مخافة تحجزني عن معاصيك
হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে এতটুকু ভয় চাই, যা আপনার অবাধ্যতা থেকে ফিরিয়ে দেবে। [মাজমাউয যাওয়াদে : ১/৪০১] 
এর মধ্যে তিনি সীমিত আকারে ভয় চেয়েছেন যে, এর বেশি নয়। কেননা ভয়ের আধিক্যের কারণে যদি হতাশা ও নৈরাশ্য সৃষ্টি হয় তাহলে মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে যাবে।

ভয় ও তাকওয়ার পার্থক্য
এখানে এটাও স্পষ্ট করে দিই, কুরআনে কারিমের কোনো কোনো জায়গায় “তাকওয়ার ” শব্দও এসেছে। আবার কিছু কিছু স্থানে “ভয়” শব্দও এসেছে। তাকওয়ার ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা বলেছেন :
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ حَقَّ تُقَاتِهِ
অর্থ : হে ইমানদারগণ! আল্লাহকে যথাযথভাবে ভয় কর। [সূরা আলে ইমরান-১০২]
অপরদিকে ভয়ের ব্যাপারে একথা বলেননি যে, এতটুকু ভয় কর যতটুকু আল্লাহর হক রয়েছে। কারণ তাকওয়া ও ভয়ের মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান। “ খওফ” এর অর্থ নিরেট “ভয়” যার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যায়। মন ও মস্তিষ্ক তার ভয়ে আচ্ছন্ন হয়ে যায়। এটা হল ভয়। আর তাকওয়া নিরেট ভয়ের নাম নয়। বরং তাকওয়া ওই অবস্থার নাম যা ভয়ের ফলে সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ এমন চিন্তা যার দ্বারা ভয় হয় যে, আমি যেন তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো কাজ না করি। এ অবস্থার নাম তাকওয়া। সুতরাং ভয়ের নাম হল “খওফ” আর ওই ভয়ের কারণে গোনাহ থেকে বাঁচার নাম হল তাকওয়া। সুতরাং এ ভয় যে, আল্লাহ তাআলা মহাপরাক্রমশালী, প্রতিশোধ গ্রহণকারী, তার শাস্তি বড় কঠিন। তিনি এমন জাহান্নাম সৃষ্টি করে রেখেছেন। এ কল্পনার পরে যে ভয় সৃষ্টি হয়, তার নাম ভয়। আর ওই ভয়ের কারণে যদি তুমি মিথ্যা থেকে বেঁচে যাও। তাহলে এরই নাম তাকওয়া। এ ভয়ের কারণে গিবত ও কুদৃষ্টি থেকে বেঁচে যাও তাহলে এটাই হল তাকওয়া।

রহিতকারী ও রহিত
কোনো আলেম বলেন, কুরআনের এ আয়াত :
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ حَقَّ تُقَاتِهِ وَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنْتُمْ مُسْلِمُونَ
এটা রহিত হয়ে গেছে এবং তাকে রহিতকারী আয়াত হল :
فَاتَّقُوا اللَّهَ مَا اسْتَطَعْتُمْ
অর্থাৎ প্রথমে এ হুকুম ছিল যে, যেমন আল্লাহর হক তেমনি তাকওয়া অবলম্বন কর। এ হুকুম শুনে সাহাবায়ে কেরাম অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়লেন, হে আল্লাহ আমরা তাকওয়ার হক কিভাবে আদায় করতে পারি? আমাদের সাধ্যে নাই যে, আমরা আল্লাহর তাকওয়ার হক আদায় করব। সাহাবাদের এ চিন্তার পর এ হুকুম রহিত হয়ে গেল। অতঃপর এ আয়াত অবতীর্ণ হল :
فَاتَّقُوا اللَّهَ مَا اسْتَطَعْتُمْ
অর্থাৎ এতটুকু তাকওয়া অবলম্বন কর যা তোমাদের সামর্থ্যরে ভেতরে। 
কাজেই حَقَّ تُقَاتِهِ এর চাহিদা বাকি থাকল না।

প্রথম আয়াত দ্বিতীয় আয়াতের ব্যাখ্যা
কিন্তু অন্যান্য ওলামায়ে কেরাম বলেন, এ আয়াতদ্বয়কে রহিতকারী ও রহিত বলার প্রয়োজন নেই। বরং মূলত প্রথম আয়াত দ্বিতীয় আয়াতের ব্যাখ্যা অর্থাৎ, যখন একথা বলা হল যেমন আল্লাহর হক রয়েছে তেমনি তাকওয়া অবলম্বন কর, তখন সাহাবায়ে কেরাম ভয় পেয়ে গেলেন তাকওয়ার হক আমরা কিভাবে আদায় করব? তাদের জবাবে আল্লাহ তাআলা এ আয়াত অবতীর্ণ করেছেন যে, তাকওয়ার হক এতটুকুই যতটুকু তোমাদের সাধ্যে রয়েছে। আমি তোমাদের থেকে তাকওয়ার অনেক উঁচু স্তর চাই না। বরং حَقَّ تُقَاتِهِ অর্থ হল مَا اسْتَطَعْتُمْ “তোমাদের সমার্থ্য অনুযায়ী” কারণ আল্লাহ তাআলা কাউকে তার সাধ্যর ও সামর্থের অধিক দায়িত্ব চাপিয়ে দেন না। لاَ يُكَلِّفُ اللَّهُ نَفْسًا إِلاَّ وُسْعَهَا কাজেই এ দ্বিতীয় আয়াত প্রথম আয়াত ব্যাখ্যা।

এহইয়াউল উলুম কিতাবে ভয়ের অধ্যায়
আলোচনার সারাংশ হল, এত ভয় উদ্দেশ্য নয়, যার ফলে মানুষের মধ্যে নিরাশা সৃষ্টি হয়। আর তাকওয়া এতটুকু উদ্দেশ্য যতটুকু সাধ্যে ও সামর্থ্যে আছে। ইমাম গাজালি রহ. এর কিতাব এহইয়াউল উলুম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিতাব। সকল বিষয়ে তার আশ্চর্যজনক অবস্থান। কিন্তু আমার আব্বাজান হযরত মুফতি শফি রহ. থেকে শুনেছি, এ কিতাবের ভয়ের অধ্যায় এক বৈঠকে পড়া উচিত নয়। বরং ভিন্ন ভিন্ন মজলিসে অল্প অল্প করে পড়া চাই। কারণ যদি কেউ পুরোটা এক বৈঠকে পড়ে ফেলে, তাহলে কখনো পাঠকের ওপর ভয় এতটা প্রাধান্য বিস্তার করে বসে, যা কাক্সিক্ষত ভয়ের চেয়ে বেশি হয়ে যায়। এ অধ্যায় পড়ার ফলে অনেক মানুষের অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে। তাদের মাথা বদলে গেছে এবং তারা নিরাশার পথে চলতে শুরু করেছে। এ ব্যাখ্যা তো ভয়ের ব্যাপারে ছিল।

আশার মধ্যে মধ্যমপন্থা কাক্সিক্ষত
দ্বিতীয় বিষয় হল আশা যার অর্থ হল আকাক্সক্ষা। এ আশাও কাম্য। কারণ আল্লাহর রহমতের আশা রাখাও উদ্দেশ্য। কিন্তু আশাও সংযমের মধ্যে থাকা চাই। যদি আশা সীমা অতিক্রম করে তাহলে তার নাম ধোঁকা ও প্রতারণা। আশা কিভাবে সীমা অতিক্রম করেÑ এ সম্পর্কে এক হাদিসে হুজুর সা. ইরশাদ করেছেন :
الْعَاجِزُ مَنْ أَتْبَعَ نَفْسَهُ هَوَاهَا ثُمَّ تَمَنَّى عَلَى اللَّهِ
অর্থাৎ, নির্বোধ ঐ ব্যক্তি, যে নিজের প্রবৃত্তিকে খাহেশাতের পিছনে লাগিয়ে দিয়েছে। তার প্রকৃত্তির চাহিদা তাকে যেখানে নিয়ে যাচ্ছে সে যাচ্ছে, গোনাহ করতে গিয়ে কখনো খটকা লাগে না। গোনাহ থেকে বাঁচার কোনো বন্দোবস্ত নেই। মনে যে খাহেশ সৃষ্টি হচ্ছে সেটাকেই পূরণ করছে। হালাল হারাম গুলিয়ে ফেলছে। আবার এর সাথে আল্লাহ তাআলা ওপর বড় আশাও করে বসে আছে। [সুনানে তিরমিযি, হাদিস নং- ২৩৮৩] 
সুতরাং যখন তাকে এ কথা বলা হয়, এ কাজ নাজায়েয, সে উত্তরে বলে, আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও দয়ালু। ঐ ব্যক্তি ক্ষমাশীল ও দয়ালু হওয়ার ধোঁকায় পড়েছে। এটা আশা নয়। কারণ আশা যখন নিজের সীমা অতিক্রম করে ফেলে তখন তা ধোঁকা ও প্রতারণায় পরিণত হয়। তাই আশাকে তার সীমার মধ্যে রাখা চাই, যেন ধোঁকা না হয়। আর ভয়কেও তার সীমার ভেতরে রাখা চাই, যেন তা হতাশাও নিরাশায় রূপান্তরিত না হয়। উভয়কে নিজ নিজ সীমারেখার মধ্যে রেখে চলতে হবে।

উভয়টির মধ্যপন্থার সীমারেখা কিভাবে জানা যাবে?
এখন প্রশ্ন হল, মানুষ উভয়টিকে নিজ নিজ সীমার মধ্যে রেখে কিভাবে চলবে? কে একথা বলবে যে, এ ভয় তার সীমার মধ্যে আছে আর এ আশা তার সীমার মধ্যে আছে? এবং কে বলবে যে ভয়ের কাক্সিক্ষত স্তর তোমার অর্জন হয়েছে এবং আশার কাক্সিক্ষত অবস্থান অর্জন হয়েছে? এ পরিচয় পাওয়ার জন্যই “ইলমে তাসাওউফ” আর এ পীরমুরিদি একাজের জন্যই। শায়খের কাছে এ উদ্দেশেই যাওয়া হয়। শায়েখ বলে দেন ভয়ের ঐ স্তর যা কাম্য আলহামদুলিল্লাহ সেটা তোমার অর্জন হয়েছে এবং যতটুকু আশার কাম্য ছিল আল্লাহ তাআলা সেটা তোমাকে দিয়ে দিয়েছেন। তুমি এখন মধ্যমপন্থায় আছ। আর যদি কেউ মধ্যমপন্থায় না থাকে, তখন শায়েখ তার সংশোধন করে তাকে মধ্যমপন্থার সীমায় নিয়ে আসেন। তাসাওউফ ও কোনো শায়খের কাছে যাওয়ার আসল উদ্দেশ্য এটাই। আজকাল মানুষ তাসাওউফের উদ্দেশ্য এটা মনে করে নিয়েছে শায়েখ কিছু তাসবি পড়তে বলে দেবেন যে, সকালে এটা পড়বে এবং সন্ধ্যায় এটা পড়বে। মনে রাখবেন তাসবি সংশোধনের জন্য সহায়ক বটে কিন্তু আসল উদ্দেশ্য নয়। তাসবি তো আপনি শায়েখ ব্যতীত ঘরে বসেও পড়তে পারেন। কাজেই তাসাওউফ ও শায়খের নিকট যাওয়ার আসল উদ্দেশ্য হল যে সকল অভ্যন্তরীণ আমল অর্জন করা উদ্দেশ্য সেটা মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয়ে যায়। আর সে সকল আমল থেকে বেঁচে থাকা আবশ্যক সেগুলো থেকে বেঁচে যায়। মোট কথা হযরত থানবি রহ. এ অধ্যায় ভয় ও আশা উভয়টি বর্ণনা করেছেন। যেন আমরা উভয়টির মাঝামাঝি থেকে জীবনযাপন করতে পারি।

হতাশ ও নিরাশ হওয়া জায়েয নেই
সুতরাং এক আলোচনায় হযরত বলেছেন, “নৈরাশ্য যৌক্তিকভাবে তিরষ্কৃত অর্থাৎ যদি এ বিশ্বাস হয়ে যায় যে, আমার ওপর কখনও দয়া করা হবে না এবং আমার বর্তমান অবস্থা এমন নয় যে, এর ওপর রহমত হবে।” [আনফাসে ইসা- ২০৪] 
যদি কারও মনে একথা বসে যায় যে, আমার ওপর কখনও আল্লাহর রহমত হবে না, তাহলে এটাই হল নিরাশা। এরই নাম হতাশা। এটা খারাপ। কোনো মুমিনের জন্য এমন নিরাশা জায়েজ নেই। এটা কখনোই হওয়া উচিত নয়। কুরআন কারিমে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেন :
قُلْ يَا عِبَادِيَ الَّذِينَ أَسْرَفُوا عَلَى أَنْفُسِهِمْ لَا تَقْنَطُوا مِنْ رَحْمَةِ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ جَمِيعًا
অর্থ : হে আমার বান্দারা যারা নিজেদের নফনের ওপর জুলুম করেছ, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ সব গোনাহ ক্ষমা করে দিবেন। [সূরা যুমার : ৫৩]
কাজেই মানুষকে আল্লাহর রহমত হতে নিরাশ না হওয়া চাই। সে যত বড় গোনাহই করে থাকুক এবং খারাপ গোনাহ করে থাকুক, তবুও আল্লাহর রহমত থেকে কোনো অবস্থাতেই নিরাশ হবে না। কারণ আল্লাহর রহমত এমন যে, তুমি চাই যত বড় গোনাহই করে ফেল, একবার যখন খাঁটি মনে তওবা করে নেবে এবং বলবে : استغفر الله ربى من كل ذنب و اتوب اليه
ইনশাআল্লাহ ঐ মুুহূর্তেই আল্লাহ তাআলা তোমাকে সমস্ত গোনাহ থেকে পবিত্র করে দেবেন। এতে কোনো সন্দেহ নেই। সুতরাং এক মুসলমানের নৈরাশ্য কিভাবে স্থান পেতে পারে?

যার আল্লাহ আছে তার পেরেশানি হবে কিভাবে?
নিরাশ তো ঐ ব্যক্তি হবে, যার সাথে এ ওয়াদা করা হয়নি। যাকে আল্লাহ তাআলা এ রাস্তা বাতলে দেননি। আল্লাহ তাআলা দিয়েছেন যে, আমি তোমাদের জন্য তওবার দরজা খুলেছি এবং শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত খোলা থাকবে। তাহলে নিরাশা কেন? আমার হযরত বলতেন :
جس كا الله هو، اس كو پر يشانى كيسى؟
যার আল্লাহ আছে তার পেরেশানি কিভাবে? সুতরাং যখন এ ওয়াদা করে রেখেছেন এবং পদ্ধতিও বলে দিয়েছেন, তারপরে কিসের পেরেশানি? কিভাবে হতাশ হবে? যখন গোনাহ করে পেরেশানি হও, তখন তৎক্ষণাৎ আল্লাহ তাআলার দিকে ফিরে আস তওবা কর। ইস্তেগফার কর এবং ভবিষ্যতে ঐ গোনাহ থেকে বেঁচে থাকার চিন্তা কর। তবে নিজের গোনাহের ধ্যান কখনও করবে না যে, আমি অমুক গোনাহ করেছি। আমি অমুক গোনাহ করেছি। আরে যতটুকু সময় এ ধ্যানে অতিবাহিত করবে, ঐ সময়টুকু আল্লাহর জিকিরে এবং সুবহানাল্লাহ বলে কাটিয়ে দাও। আর তওবা কর, যে সকল গোনাহ করেছি, আমি তার ওপর স্বীকারোক্তিসহ অপরাধী, গোনাহের স্বীকার করছি। কিন্তু হে আল্লাহ আপনার রহমত অত্যন্ত প্রশস্ত। আপনার অনুগ্রহে তওবা করছি। কাজেই আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হবে না। এমন ধারণা যে, আমি তো আল্লাহর দরবার থেকে বিতাড়িত, আমি তার রহমত থেকে দূরে, আল্লাহর রহমত আমার ওপর হতেই পারে না। এগুলো সব শয়তানি ধারণা।

অধিক নৈরাশ্যের ফল
কখনও অবস্থার প্রাধান্যর কারণে মানুষের ওপর ভয় অথবা নিরাশা প্রভাব বিস্তার করে। এ প্রাধান্য বিস্তার করা অত্যন্ত খারাপ জিনিস। কারণ, তার ফলে মানুষের জীবনে আবদ্ধ অবস্থা সৃষ্টি হয়। ইবাদতে মন বসে না, তওবার দিকে মনোযোগ হয় না। মনে সর্বদা এ খেয়াল বদ্ধমূল হয়ে যায় যে, আমি আল্লাহর রহমত থেকে দূরে, এমন অবস্থায় শায়খের প্রয়োজন হয় এবং কৌশলে কাজ নিতে হয়। এক বুযুর্গের একজন মুরিদ ছিল, তার ওপর আবদ্ধতার অবস্থা প্রাধান্য বিস্তার করল। এবং তার মনে এ ধারণা চেপে বসল যে, আমি শয়তান। আর শয়তানের ব্যাপারে একথা সিদ্ধান্তকৃত যে, সে জাহান্নামি। তাই তার জাহান্নামি হওয়ার একিন হয়ে গেল। যার সাথে সাক্ষাৎ হয় তাকেই বলে যে, আমি তো শয়তান হয়ে গিয়েছি। যখন তার শায়েখ এ ব্যাপারে অবগতি হল, তখন তাকে ডাকলেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন। কি অবস্থা? বলল, আমি আল্লাহর রহমত থেকে দূরে চলে গিয়েছি। এখন আমার জাহান্নামে যাওয়া ব্যতীত আর কোনো গন্তব্য নেই। শায়েখ তাকে বললেন, আচ্ছা, বলত : শয়তান কার সৃষ্টি? আরে শয়তানও তার সৃষ্টি। তিনিই শয়তানকে সৃষ্টি করেছেন। তাহলে ভয় পাচ্ছ কেন? অতএব একথা শুনে তার ভুল ভাঙ্গল এবং আল্লাহ তাআলা তার ঐ অবস্থা দূর করে দিলেন। মোটকথা, চিকিৎসার জন্য শায়েখকে দেখতে হয় যে, এ সময় তার জন্য কোনটা উপকারী, এজন্যই হযরত বলছেন এ ধারণা যে, আল্লাহর রহমত কখনো আমার ওপর হবে না, এটা নিরাশা এবং অপছন্দনীয়। এর থেকে বেঁচে থাকা চাই।

নিরাশা কিভাবে সৃষ্টি হয়?
এ নিরাশার অবস্থা এভাবে সৃষ্টি হয়, যে আমল করার তাওফিক আল্লাহ দিচ্ছেন তার অবমূল্যায়নের কারণে ধীরে ধীরে এ অবস্থা সৃষ্টি হয়। অধিকাংশ সময় আমাদের মুখে একথা থাকে যে, আমাদের নামায আর কি? এটা তো ঠৌকর দেয়া মাত্র। এটার দ্বারা সময় কাটানো হচ্ছে। এগুলো সবই অবমূল্যায়নের কথা, এমন অবমূল্যায়ন না করা চাই। আমাদের হযরত ডা. সাহেব রহ. বলতেন, আরে ভাই! এ ইবাদত আদায়ের তৌফিকের ওপর সর্বপ্রথম শোকর আদায় কর। কত মানুষ এমন রয়েছে, যাদের এমন ইবাদত করারও সুযোগ সহজে হয় না। এজন্য আল্লাহ তাআলা তোমাদের মাধ্যমে যখন ঐ ইবাদত আঞ্জাম দেয়ার তাওফিক দিয়েছেন। তাহলে সর্বপ্রথম তার ওপর শোকর আদায় করে নাও এবং এটা বল, যে হে আল্লাহ! আপনার তাওফিক ও দ্বারা, অনুগ্রহের আমার এ তাওফিক হয়েছে। আপনি আমাকে মসজিদে নিয়ে আসেন আমাকে দিয়ে নামায পড়িয়ে দাও। হে আল্লাহ ঐ রহমতের ওপর আপনার শোকর।

নামাযের পর ইস্তেগফার করে নাও
শোকর আদায় করার পর এটা বল, হে আল্লাহ আমি এ নামায সঠিকভাবে পড়তে পারিনি। এ নামাযের মধ্যে অপূর্ণাঙ্গতা রয়ে গেছে। এর ওপর আমি ইস্তেগফার করছি। নামাযের পর আলহামদুলিল্লাহও বল এবং ইস্তেগফারও বল। অতঃপর নিজের নামাযের আসমানী কর না। কারণ এ অসম্মানী ধীরে ধীরে মানুষকে হতাশার দিকে নিয়ে যায়। মনে এ খেয়াল সৃষ্টি হয়। আমি যে কোনো ইবাদতই করি তা গ্রহণযোগ্য হবে না। এ হতাশা থেকে বেঁচে থাক, আর যে ইবাদত করার সুযোগ হয় তার ওপর আল্লাহর শোকর আদায় কর এবং বল :
اللَّهُمَّ لَكَ الْحَمْدُ ، وَلَكَ الشُّكْرُ
তাওফিকের ওপর শোকর এবং অপূর্ণতার জন্য ইস্তেগফার করতে থাক। সারা জীবন করতে থাক। ইনশাআল্লাহ এরপর আর হতাশা সৃষ্টি হবে না। আল্লাহ তাআলা আমাকে এবং আপনাদের সকলকে এর ওপর আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
وآخر دعوانا أن الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ.

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন