বৃহস্পতিবার, ৪ আগস্ট, ২০১৬

খুতবার সময় কথা বলা, দুরুদ পড়া, ঠিক বলা, আমীন বলা বিদআত?

মুহিউদ্দীন কাসেমী সাহেব

বিষয়টি নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি। দ্বিতীয় খুতবার সময় খতিব সাহেব দোয়া বা বদদোয়া করার সময় আমীন আমীন বলা হয়। মনে মনে বলা হবে, নাকি সশব্দে? তদ্রূপ যেসব মসজিদে বাংলা খুতবা চালু রয়েছে, সেখানে বিশেষ মুহূর্তে জোরে ঠিক বলা হয়। এটা কতটুকু সুন্নাহসম্মত? 
আমার তাহকীক আমি পেশ করেছি। দলিলসমৃদ্ধ তাহকীক দ্বারা উপকৃত হতে চাই। আমি ফিকহে হানাফির অনুসারী হওয়া সত্ত্বেও আল্লামা ইবনে তাইমিয়া রহ. এবং আল্লামা মুবারকপুরি রহ. এর কিতাবপত্র অনেক বেশি পড়ি। তাদের কিতাবেও বিষয়টির বৈধতা পাইনি।
.
খুতবা শোনা ওয়াজিব। আর ভালোভাবে শুনতে হলে চুপ থাকতে হয়। সুতরাং খুতবার সময় কথা বলা হারাম। অকাট্য হাদিস দ্বারা বিষয়টি প্রমাণিত। তবুও অনেক মসজিদে খতুবার সময় কথা বলতে দেখা যায়; যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। 
এমনকি খুতবার সময় রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাম শুনলে দুরুদ পড়া, সাহাবিদের নাম শুনলে রাজিয়াল্লাহু বলা এবং খুতবায় দোয়া করার সময়ও আমিন আমিন বলা মাকরুহ ও বিদআত। একটি হাদিসে এসেছে : 
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنْ تَكَلَّمَ يَوْمَ الْجُمُعَةِ وَالْإِمَامُ يَخْطُبُ فَهُوَ كَمَثَلِ الْحِمَارِ يَحْمِلُ أَسْفَارًا وَالَّذِي يَقُولُ لَهُ أَنْصِتْ لَيْسَ لَهُ جُمُعَةٌ.
অর্থ : হযরত ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত, রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : জুমুআর দিন ইমামের খুতবার সময় যে ব্যক্তি কথা বলবে, সে গাধার অনুরূপ; কেবল সে বোঝা বহন করছে। আর যে ব্যক্তি তাকে ‘চুপ করো’ বলছে, তার জুমুআর নামাযই শুদ্ধ হবে না। [মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং- ২০৩৩; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদিস নং- ৫৩০৫; কানযুল উম্মাল, হাদিস নং- ২১২০৬]
এই হাদিস তেমন শক্তিশালী ও সহিহ না। কিন্তু বিষয়টি অন্যান্য সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। যেমন : 
عَن أَبِي هُرَيْرَةَ أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ مَنْ قَالَ يَوْمَ الْجُمُعَةِ وَالْإِمَامُ يَخْطُبُ أَنْصِتْ فَقَدْ لَغَا.
অর্থ : হযরত আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন : ইমামের খতুবার সময় কেউ কাউকে বলল, ‘চুপ করো’ তাহলে সেও অতিরঞ্জন ও ভুল করল। [তিরমিযি, হাদিস নং- ৫১২, অধ্যায় : با ما جاء في كراهية الكلام والإمام يخطب] 
ইমাম তিরমিযি রহ. হাদিসটি বর্ণনার পর বলেন : حَدِيثٌ حَسَنٌ صَحِيحٌ
ইমাম তিরমিযি সাধারণত হাদিস বর্ণনা করার পর হাদিসের ওপর আমল আছে কি-না তাও বলে দেন। এ হাদিস বর্ণনার পর তিনি বলেন : 
وَالْعَمَلُ عَلَيْهِ عِنْدَ أَهْلِ الْعِلْمِ كَرِهُوا لِلرَّجُلِ أَنْ يَتَكَلَّمَ وَالْإِمَامُ يَخْطُبُ وَقَالُوا إِنْ تَكَلَّمَ غَيْرُهُ فَلَا يُنْكِرْ عَلَيْهِ إِلَّا بِالْإِشَارَةِ.
অর্থ : আহলে ইলম এ হাদিস অনুযায়ী আমল করে থাকেন। খুতবার সময় কথা বলাকে তারা মাকরুহ (তাহরিমি) মনে করেন। কেউ কথা বললে, তাকে ইশারায় চুপ থাকতে বলা হবে। ‘তুমি চুপ থাক’ এ কথাও বলা যাবে না। 
শায়েখ নাসিরউদ্দিন আলবানিও সহিহ বলেছেন।

এ বিষয়ে আরেকটি হাদিস পেশ করছি :
عَنِ ابْنِ شِهَابٍ أَخْبَرَنِى سَعِيدُ بْنُ الْمُسَيَّبِ أَنَّ أَبَا هُرَيْرَةَ أَخْبَرَهُ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- قَالَ : إِذَا قُلْتَ لِصَاحِبِكَ أَنْصِتْ يَوْمَ الْجُمُعَةِ وَالإِمَامُ يَخْطُبُ فَقَدْ لَغَوْتَ.
অর্থ : হযরত আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : ইমামের খতুবার সময় তুমি যদি তোমার পাশের ব্যক্তিকে বলো ‘তুমি চুপ থাকো’ তাহলে তুমিও ভুল করলে। [সহিহ মুসলিম, হাদিস নং- ২০০২, অধ্যায় : باب فِى الإِنْصَاتِ يَوْمَ الْجُمُعَةِ فِى الْخُطْبَةِ] 
হযরত আবু হুরায়রা রা. বলেন : ইমামের খুতবা দেওয়ার সময় তোমরা সুবহানাল্লাহও বলবে না। [বিদআতের উদ্ধৃতিতে মাহফুজ প্রণীত ইবাদ, পৃ. ২৭৩]

এসব হাদিস থাকার কারণে ফুকাহায়ে কেরাম বলেছেন, খুতবার সময়টুকু নামাযের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ; নামাযে যেসব কাজ নিষিদ্ধ প্রায় সবগুলোই খুতবার সময়ও নিষিদ্ধ। অর্থাৎ খুতবার সময় যে-কোনো কথা বলা, সালামের উত্তর দেওয়া, হাঁচির উত্তর দেওয়া; এমনকি রাসুল সা. এর নাম শুনলে দুরুদ পড়া, সাহাবিদের নাম শুনলে রাজিয়াল্লাহু আনহু বলা এবং দোয়ার সময় আমিন আমিন বলাও মাকরুহ। 
যদিও অপর একদল ফকীহ মনে করেন, রাসুল সা. এর নাম শুনলে মনে মনে দুরুদ পড়া যাবে। হাদিসের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ও ফিকহের কিতাবগুলোতে বিষয়টি নিয়ে সুদীর্ঘ আলোচনা করা হয়েছে। 
আল্লামা ইবনে আবিদীন রহ. বলেন : 
وَأَمَّا مَا يَفْعَلُهُ الْمُؤَذِّنُونَ حَالَ الْخُطْبَةِ مِنْ التَّرَضِّي وَنَحْوِهِ فَمَكْرُوهٌ اتِّفَاقًا
অর্থ : খুতবার সময় মুয়াজ্জিনরা যে রাজিয়াল্লাহু আনহু ইত্যাদি বলে, সর্বসম্মতক্রমে তা মাকরুহ। [রদ্দুল মুহতার : খ. ৬, পৃ. ১১৫] 
রদ্দুল মুহতারের উপরের পৃষ্ঠায় আরও রয়েছে :
( وَكُلُّ مَا حَرُمَ فِي الصَّلَاةِ حَرُمَ فِيهَا ) أَيْ فِي الْخُطْبَةِ خُلَاصَةٌ وَغَيْرُهَا فَيَحْرُمُ أَكْلٌ وَشُرْبٌ وَكَلَامٌ وَلَوْ تَسْبِيحًا أَوْ رَدَّ سَلَامٍ أَوْ أَمْرًا بِمَعْرُوفٍ بَلْ يَجِبُ عَلَيْهِ أَنْ يَسْتَمِعَ وَيَسْكُتَ ( بِلَا فَرْقٍ بَيْنَ قَرِيبٍ وَبَعِيدٍ ) فِي الْأَصَحِّ مُحِيطٌ وَلَا يُرَدُّ تَحْذِيرَ مِنْ خِيفَ هَلَاكُهُ لِأَنَّهُ يَجِبُ لِحَقِّ آدَمِيٍّ ، وَهُوَ مُحْتَاجٌ إلَيْهِ وَالْإِنْصَاتُ لِحَقِّ اللَّهِ - تَعَالَى ، وَمَبْنَاهُ عَلَى الْمُسَامَحَةِ وَكَانَ أَبُو يُوسُفَ يَنْظُرُ فِي كِتَابِهِ وَيُصَحِّحُهُ وَالْأَصَحُّ أَنَّهُ لَا بَأْسَ بِأَنْ يُشِيرَ بِرَأْسِهِ أَوْ يَدِهِ عِنْدَ رُؤْيَةِ مُنْكَرٍ وَالصَّوَابُ أَنَّهُ يُصَلِّي عَلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عِنْدَ سَمَاعِ اسْمِهِ فِي نَفْسِهِ ، وَلَا يَجِبُ تَشْمِيتٌ وَلَا رَدُّ سَلَامٍ بِهِ يُفْتَى وَكَذَا يَجِبُ الِاسْتِمَاعُ لِسَائِرِ الْخُطَبِ كَخُطْبَةِ نِكَاحٍ وَخُطْبَةِ عِيدٍ وَخَتْمٍ عَلَى الْمُعْتَمَدِ .

বিষয়টি আরও দেখা যেতে পারে : 
তুহফাতুল আহওয়াযি : খ. ৩, প. ৩১, অধ্যায় : باب ما جاء في كراهية الكلام والإمام يخطب
আল্লামা ইবনে তাইমিয়া রহ. রচিত আল-ইখতিয়ারাত, পৃ. ৮০; ইমাম সারাখসী রচিত আল-মাবসুত : খ. ২, পৃ. ২৯; ইমাম কাসানী রচিত বাদায়েউস সানায়ে : খ. ১, পৃ. ২৬৪; ফাতাওয়া আলমগিরি : খ. ১, পৃ. ১৪৭।

তাছাড়া যে কোনো ফিকহের কিতাবের জুমুআ অধ্যায়ে বিষয়টি পাওয়া যাবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন