বৃহস্পতিবার, ১৯ নভেম্বর, ২০১৫

সাহাবিদের জীবন কাহিনী : হা. মোহাম্মদ রুহুল আমিন

৯৩২ সাল। ঐতিহ্যবাহী নগরী মাদায়েন। যার বর্তমান নাম সালমান পার্ক। সালমান পার্ক একটি প্রাচীন জনপদ, যার অবস্থান ইরাকের রাজধানী বাগদাদ থেকে ৪০ মাইল দূরে। এক সময় এটি ছিল পারস্য সম্রাজ্যের রাজধানী। কিন্তু কালক্রমে ছোট হতে হতে এটি আজ ছোট জনবসতির আকারে এসে ঠেকেছে।
সালমান পার্কে সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে সর্বপ্রথম কবরস্থ হন বিখ্যাত সাহাবি হযরত সালমান ফার্সী রা.। এরপর প্রায় তেরশত বছর পর সেখানে সমাহিত হন আরো দুজন সাহাবি! তন্মধ্যে একজন হলেন হযরত হুজাইফা রা. এবং অপরজন হলেন হযরত জাবের বিন আবদুল্লাহ আনসারী রা.।
ওনাদের কবর প্রথমে সালমান পার্কে ছিল না। তাদের কবর ছিল সেখান থেকে দু ফার্লং দূরে একটা অনাবাদী জায়গায়, যার নিকট দিয়ে বয়ে চলছে ঐতিহাসিক দজলা নদী। হঠাৎ করে একটি বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে ,যার কারণে তাদেরকে সেখান থেকে সরিয়ে এখানে আনা হয়।
ঘটনাটি হলো-
তখন ইরাকের বাদশাহ ছিলেন বাদশাহ ফয়সাল। তিনি একদিন ঘুমিয়ে ছিলেন। হঠাৎ তিনি স্বপ্নে দেখেন, হযরত হুজাইফা রা. তাকে বলছেন- ” আমাদের বর্তমান অবস্থান থেকে সরিয়ে অন্যত্র দাফন করা হোক। কারণ আমার কবরে পানি জমতে শুরু করেছে আর হযরত জাবের রা. এর কবরে পানি প্রবেশ করার উপক্রম হয়েছে।
বাদশাহ ফয়সাল ব্যস্ত মানুষ। বিভিন্ন ব্যস্ততার কারণে তিনি স্বপ্নের কথা ভুলে যান। পরের রাতেও তিনি একই স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু এবারও নানাবিধ ঝামেলার কারণে স্বপ্নের সে নির্দেশ পালন করতে পারেননি।
তৃতীয় রাতে হযরত হুজাইফা রা. ইরাকের প্রধান মুফতি সাহেবকে স্বপ্ন যোগে একই নির্দেশ দেন। সেই সাথে এও বলেন, আমি পরপর দু রাত বাদশাকে এ ব্যাপারে অবহিত করেছি। কিন্তু তিনি এ ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কোন পদক্ষেপ নেয়নি। এখন আপনার দায়িত্ব হচ্ছে, আমার এ নির্দেশটি তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়া এবং যথাশীঘ্র আমাদেরকে স্থানান্তরিত করার ব্যবস্থা করা।
পরদিন সকালে হওয়া মাত্রই মুফতী সাহেব প্রধানমন্ত্রী নূরী আস সাঈদকে টেলিফোন করলেন। বললেন, আমি বিশেষ প্রয়োজনে আপনার কাছে এক্ষুণি আসছি। আপনার কোন কাজ থাকলে পরে বের হবেন। প্রধানমন্ত্রী বললেন, ঠিক আছে আপনি আসুন। আমি আপনার অপেক্ষায় রইলাম। নূরীর সাথে সাক্ষাৎ হলে মুফতি সাহেব স্বপ্নের বিস্তারিত বিবরণ পেশ করলেন। সবশুনে প্রধানমন্ত্রী তৎক্ষণাৎ বাদশাহর সাথে মুফতি সাহেবের সাক্ষাতের সুযোগ করে দেন, সাথে নিজেও তার সাথে উপস্থিত হন। মুফতি সাহেবের মুখ থেকে সব কিছু শোনে বাদশাহ বলেন, হ্যাঁ আমি পর পর দু রাত এ স্বপ্ন দেখেছি এবং সে নির্দেশ পেয়েছি। আমি তো ভেবেই পাচ্ছিলাম না এ আমি কী দেখলাম? আপনি এসে ভালই করেছেন। এখন আপনিই বলেন এমতাবস্থায় কী করণীয়?
মুফতি সাহেব বললেন, তিনি তো স্পষ্ট করেই লাশ সরানোর নির্দেশ দিয়েছেন। তাই, আমার মনে হয় অতিসত্বর তাঁর আদেশ পালন করা উচিৎ। বাদশাহ বললেন, ঠিক আছে, তাহলে আপনি আগে স্থানান্তর করার ফতোয়াটা দিন। তখন মুফতি সাহেব সাহাবায়ে কেরামের কবর স্থানান্তর করার ফতোয়া লিখে দেন। এরপর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, সামনের কুরবানীর ঈদের দিন জোহরের নামাজের পর সম্মানিত দুই সাহাবির কবর খুঁড়ে লাশ মুবারক তুলে কোন নিরাপদ স্থানে দাফন করা হবে।
ইরাকের পত্রপত্রিকায় খবরটি প্রচারিত হওয়ার সাথে সাথে সমগ্র ইরাকে আনন্দের ঢেউ খেলে যায়। তাছাড়া রয়টারসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থাগুলো মুহূর্তের মাঝে খবরটি সারাবিশ্বে ছড়িয়ে দেয়।
তখন ছিল হজের মৌসুম। তাই লক্ষ লক্ষ মুসলমান মক্কা নগরীতে সমবেত ছিল। এ সংবাদ শোনার পর হাজী সাহেবরা বাদশার কাছে আবেদন জানালেন, তারাও মহান সাহাবিদের চেহারা দর্শনে আগ্রহী, তাই অনুগ্রহ পূর্বক তারিখটা আরো ক’দিন পিছিয়ে দিলে ভালো হত। এদিকে ইরান, তুরস্ক, লেবানন, ফিলিস্তিন, হেজাজ, বুলগেরিয়া, উত্তর আফ্রিকা, রাশিয়া, ভারত প্রভৃতি রাষ্ট্র থেকে বাদশার কাছে একই আবেদন সম্বলিত অসংখ্য তারবার্তা আসতে থাকে।
বাদশাহ ফয়সাল পড়লেন মহা বিপাকে। একদিকে গোটা মুসলিম বিশ্বের তারিখ পেছানোর আবেদন আর অন্যদিকে দ্রুত লাশ স্থানান্তরের স্বাপ্নিক নির্দেশ। এমতাবস্থায় কী করবেন তিনি? তার চিন্তা হলো, যদি সত্যি সত্যি কবরে পানি এসে থাকে, তবে তো বিলম্ব করার কারণে কবরদ্বয়ের ক্ষতি হবে।
অবশেষে এ ব্যপারে পরামর্শ হলো। বহু আলোচনা পর্যালোচনার পর সিদ্ধান্ত হলো, আপাততঃ কিছুদিন যাতে কবরের ভিতরে পানি প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য নদীর দিক থেকে দশ ফুট দূরে একটা গভীরগর্ত করে সেখানে কাঁকড় ফেলা হবে। আর সারা বিশ্বের মুসলমানদের আগ্রহের প্রতিসম্মান প্রদর্শনপূর্বক পূর্বের তারিখটি আরো দশদিন পিছিয়ে দেয়া হলো। অর্থাৎ লাশ স্থানান্তর করা হবে ঈদের দশদিন পর সোমবার দুপুর বারটায়, ইনশাআল্লাহ।
এ ঘোষণার পর কদিনের মধ্যেই সালমান পার্কের ছোট্ট জনপদটি লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। অনেক জ্ঞানী-গুণী, রাষ্ট্রদূত, উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা ও লক্ষ লক্ষ রাসুলপ্রেমিকের ঢল নামে সালমান পার্কে।
পরে জৌলুসের দিক দিয়ে সেটা আরেক বাগদাদে পরিণত হয়। তাঁবুয় তাঁবুয় ভরে যায় মাদায়েনের ঐতিহাসিক মাঠটিও। একটি গ্রহণযোগ্য হিসাব অনুযায়ী আগত দর্শনার্থীদের সংখ্যা ছিল পাঁচ লাখ।
অবশেষে সেই দিনটি এলো। লক্ষ লক্ষ জনতার উপস্থিতিতে কবর খোঁড়া হলো। দেখা গেল সত্যিই হযরত হুযাইফা রা. এর কবরে কিছু পানি জমে গেছে এবং হযরত জাবের রা. এর কবরে কিছুটা আর্দ্রতা দেখা দিয়েছে। এ অবস্থা প্রত্যক্ষ করে সমবেত জনতা আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ে। তাদের কণ্ঠে বারবার উচ্চারিত হয় আল্লাহু আকবার ধ্বনি। চোখে নেমে আসে অশ্রুর প্লাবন। তাদের এ কান্নায় শরীক হতে যেন সালমান পার্কের পবিত্র ভূমিও যেন আবেগপ্লুত হয়ে কাঁদছে।
বাদশাহ ফয়সালের নেতৃত্বে তার মন্ত্রী ও কর্মকর্তাবৃন্দ এবং বিভিন্ন দেশ থেকে আগত রাষ্ট্রদূতগণের সহায়তায় প্রথমে হযরত হুযাইফা রা. এর লাশ মুবারক কবর থেকে ক্রেন দ্বারা তোলা হলো। ক্রেনের সাহায্যে তাঁর পবিত্র লাশটি এমনভাবে তোলা হলো যে, মোবারক লাশটি আপনাতেই ক্রেনের মাথায় ফিট করে রাখা ট্রেচারে এসে পৌঁছায়। অতঃপর ট্রেচারটি ক্রেন থেকে পৃথক করে নেয়া হলে বাদশাহ ফয়সাল, মুফতি সাহেব, সিরিয়া ও তুরস্কের নির্বাচিত মন্ত্রীবর্গ এবং মিশরের যুবরাজ শাহ ফারুক অত্যন্ত যতœ ও তাজীম সহকারে লাশ মোবারককে তুলে এনে একটি কফিনের ভিতর রাখেন। অতঃপর একই ভাবে হযরত জাবের রা. এর পবিত্র লাশটিও তুলে আনা হয়।
আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, শতশত বছর পেরিয়ে গেলেও শুধু লাশ মোবারকই নয়, কাফন বাধার ফিতাগুলোর মধ্যেও কোন প্রকারের পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগেনি। লাশ দুটিকে দেখে কেউ কল্পনাও করতে পারছিল না যে, এগুলো দীর্ঘ তেরশত বছর আগের লাশ। আরো বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, তাদের চোখগুলো খোলা ছিল। সেই খোলা চোখ থেকে এমন রহস্যজনক অপার্থিব জ্যোতি ঠিকরে পড়ছিল যে, অনেকেই তাদের চোখ ভালভাবে দেখার চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু চোখ থেকে আসা অতি উজ্জ্বল আলোর কারণে কেউই দৃষ্টি স্থির রাখতে পারছিল না।
এ অবস্থা প্রত্যক্ষ করে বড় বড় ডাক্তারগণ হতবাক হয়ে যান। এ সময় আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন জনৈক জার্মান চক্ষু বিশেষজ্ঞ অত্যন্ত আগ্রহ সহকারে সবকিছু খুঁটে খুঁটে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখছিলেন। এ দৃশ্য তার উপর এমন প্রভাব বিস্তার করে যে, পবিত্র লাশ দুটি কফিনে রাখার সাথে সাথে তিনি মুফতি সাহেবের হাত ধরে বললেন, ইসলামের সত্যতা আর সাহাবাগণের উচ্চ মর্যাদা স্বপক্ষে এর চেয়ে বড় প্রমাণ আর কী হতে পারে?
এ বলে তিনি কালিমা পড়ে মুসলমান হয়ে যান। (সুবহানাল্লাহ)
যা হোক, পবিত্র লাশ দুটিকে কফিনে রাখার পর উপস্থিত জনতা তাদের নামাজে জানাযা আদায় করেন। এরপর আলেম ও মন্ত্রীবর্গ কফিন দুটো কাঁধে উঠিয়ে নেয়। কিছুদূর যাওয়ার পর বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিগণ এবং সব শেষে বাদশাহ ফয়সাল কাঁধ পেতে ধরেন।
এদিকে বাদশাহর অনুমতি নিয়ে জার্মানের একটি চলচ্চিত্র কোম্পানী বিশাল পর্দার সাহায্যে উপস্থিত সবাইকে কোন প্রকার হুড়াহুড়ি না করে এ দৃশ্য শুরু থকে শেষ পর্যন্ত সরাসরি দেখার ব্যবস্থা করে। এতে সবাই তাদেরকে অন্তর থকে ধন্যবাদ জানায়।
দীর্ঘ চার ঘণ্টা পর পরম ভক্তি ও শ্রদ্ধার সাথে পবিত্র লাশ দুটি সালমান পার্কে এসে পৌঁছে। যে সৌভাগ্যবানরা লাশ দুটিকে প্রথমে কফিনে রেখেছিল তারাই কফিন দুটিকে নবনির্মিত কবরে নামিয়ে রাখেন। আর এভাবেই জনতার নারায়ে তাকবীরের মধ্য দিয়ে ইসলামের এই জিন্দা শহীদেরকে মাটির কোলে শুইয়ে দেওয়া হয়।
অনেক বিদেশী পর্যটক এবং অমুসলিম এ বিস্ময়কর ঘটনা দেখতে আসে। তারা প্রভাব সৃষ্টিকারী সেই দৃশ্যে শুধু প্রভাবান্বিত হননি বরং অনেকে মুসলমান হয়ে যান। সেই সময়ে হিন্দুস্তানের এক সাহিত্যিক দম্পতি ইরাকে গিয়েছিলেন, তারা স্বচক্ষে ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করেন। সম্ভবতঃ মহিলাটি ইরাকের এই ভ্রমণ কাহিনী তার এক সফরনামায় লিপিবদ্ধ করে, যা পরে পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়।
এ ঘটনাটা যেন সুরা বাকায়ায় বর্ণিত আয়াতের বাস্তব উদাহরণ:
“যারা আল্লাহরপথে নিহত হয় তোমরা তাদের মৃত বলো না। প্রকৃতপক্ষে তারা জীবিত। কিন্তু তোমরা তা অনুভব করতে পার না। [আয়াত নং-১৫৪]
আল্লাহ তাআলা স্বীয় নিপুণ শক্তিমত্তা এবং দীনের অম্লান সত্যতার এমন মোজেজা কদাচিৎ দেখিয়ে থাকেন।
বি:দ্রঃ
যদি জাবের রা. ওহুদ যুদ্ধে নিহত আব্দুল্লাহ রা. এর সন্তান হয়ে থাকেন, তাহলে তাঁর পিতার সাথেও একই ঘটনা ঘটেছিল।
ঘটনাটি এই যে, হযরত জাবের রা. এর পিতা আবদুল্লাহ রা. ওহুদ যুদ্ধে সর্বপ্রথম শহিদ হন। তাঁকে হযরত উমর বিন জামুহ রা. এর সঙ্গে একই কবরে সমাহিত করা হয়। সে সময়ে মুসলমানদের এত দরিদ্র অবস্থা ছিল যে, শহিদদের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ কাফনের কাপড় ছিল না। বিধায় হযরত আবদুল্লাহ রা. কে মাত্র একটি চাদরে কাফন দেয়া হয়। যার ফলে তার মুখমণ্ডল ঢেকে দেয়া হলেও পদযুগল খোলা থেকে যায়, ফলে তা ঘাস দ্বারা আবৃত করা হয়। তাদের কবরটি ছিল ভাটি অঞ্চলে। চল্লিশ বছর পর হযরত মুয়াবিয়া রা. এর খেলাফতকালে এক প্লাবন দেখা দেয়। তখন জাবের রা. এর উপস্থিতিতে কবরটি খনন করা হলে বুযর্গদ্বয়ের দেহ সম্পূর্ণ অক্ষত ও সতেজ পাওয়া যায়।
একটি বর্ণনায় এমন আছে যে, তাঁদের পবিত্র মুখমণ্ডলে যে ক্ষত ছিল, সে ক্ষতের উপর হাত রাখা ছিল। লোকেরা ক্ষতস্থান থেকে হাত সরালে তাজা রক্ত বেরিয়ে আসতে থাকে। ক্ষতস্থানে পুনরায় হাত রাখলে রক্তের প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়।

তথ্য সূত্র :
১. জাহানেদিদাহ- শাইখুল ইসলাম আল্লামা তাকী উসমানী (দা বা)
২. উইকিপিডিয়া
লেখক : প্রাবন্ধিক।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন