শুক্রবার, ১ এপ্রিল, ২০১৬

একজন ফিলাস্তিনী শিক্ষিকা Atik Ullah Atik


হানান হারূব। একজন ফিলাস্তিনী শিক্ষিকা। সদ্য বিশ্বের সেরা শিক্ষিকার পুরস্কার পেলেন। লন্ডনভিত্তিক শিক্ষাসংস্থা ভারকে ফাউন্ডেশন এই পুরস্কারের আয়োজন করে। সারা বিশ্ব থেকে তালিকাভুক্ত আট হাজার শিক্ষক থেকে দশজনকে বাছাই করা হয়। আমন্ত্রণ জানানো হয়। সেখান থেকে একজনকে এক মিলিয়ন ডলার দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়। 
-
আমি চেষ্টা করি প্রতিবার পুরস্কারপ্রাপ্ত শিকক্ষকদের শিক্ষাদান-পদ্ধতিগুলোর খোঁজখবর রাখতে। পাশাপাছি বাছাইয়ে টিকে থাকা অন্য নয়জন সম্পর্কেও জানার চেষ্টা করি। বোঝার চেষ্টা করি কিছু সৃজনশীল মানুষের চিন্তাগুলো। কিছু ভালো মানুষের আন্তরিক প্রয়াসগুলোকে। এবার তাহলে ফিলাস্তীনের রামাল্লাহ থেকে ঘুরে আসা যাক! মনে আছে ঐ যে এক মহিলা! যিনি সারা জীবন কুরআনের আয়াত দিয়েই কথাবার্তা চালিয়ে গেছেন! তার শহলে। এবার রামাল্লারই আরেকজন। তার চিন্তাগুলো একটু খতিয়ে দেখা যাক না! 
.
(১) আমি যে পরিবেশে বেড়ে উঠেছি, সেখানে শৈশব বলে কিছু নেই। জন্মের সাথে সাথেই আমরা একলাফে অনেকদূর চলে যেতাম। চারপাশটা ছিল সহিংসতা-সংঘর্ষে ভরপুর। নিরংকুশ স্থিতিশীল পরিস্থিতি কখনোই ছিল না। আমাদের শিশুদের বেড়ে ওঠা, বিশ্বের আর দশটা দেশের চেয়ে ভিন্ন। তাই তাদের শিক্ষব্যবস্থাও ভিন্ন ধাঁচে না হলে কার্যকর হবে না। আমি সে চিন্তা থেকেই একটা ভিন্ন কিছু করা নিয়ে ভাবছিলাম।
.
(২) আমার স্বামী-সন্তান বাড়ি ফেরার পথে গুলিতে আহত হয়েছিল। এই ঘটনায় বাড়ির সবাই মুষড়ে পড়লো। সন্তানদের চিন্তা অন্যখানে বইতে শুরু করলো। তাদের আচরণ, ব্যক্তিত্ব ও দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যাপক পরিবর্তন দেখা দিল। 
আমার উৎকণ্ঠার কথা অন্য শিক্ষকদেরকে বললাম। কেউ তেমন গুরুত্ব দিল না। আমি ভাবতে শুরু করলাম, কিভাবে আমাদের শিশুদেরকে এই পরিস্থিতির নেতিবাচক প্রভাব থেকে বের করে আনা যায়। 
.
(৩) প্রথমেই আমি একটা কাজ করলাম, আমার সন্তানদেরকে প্রতিবেশির সন্তানদের সাথে খেলার সুযোগ করে দিলাম। একসাথে উঠাবসা করতে দিলাম। এতে ফল হলো, তারা ইসরাঈলি হামলার খারাপ প্রভাব কাটিয়ে কিছুটা সামাজিক হতে শুরু করলো। আত্মকেন্দ্রীক অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে শুরু করলো। তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ফিরে আসতে শুরু করলো। ঘরের বাইরে বের হওয়ার ভীতি কেটে গেলো। 
.
(৪) তখন মাথায় এলো, এভাব যদি কাজটা আরও বড় পরিসরে করি, অন্য শিশুদের মধ্যে হয়তো ভাল একটা প্রভাব পড়বে। এই চিন্তা থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকুরি ছেড়ে শিশুদের স্কুলে যোগদান। প্রথম দিন থেকেই আমি একটা একটা কথা ঠিক করে নিয়েছিলাম: আমি শিশুদের সাথে অত্যন্ত সামাজিক ও আপনজনসুলভ হবো। আমি তাদের বাবা-মা-শিক্ষক-দিকনির্দেশক-বন্ধু সবকিছু হবো। তারা শুধু স্কুলের গন্ডীতেই নয়, চারদেয়ালের বাইরেও তারা আমার ছাত্র থাকবে। স্কুলের বাইরের কু-প্রভাব থেকে বাঁচানোর দায়িত্বও আমার। না হলে শিক্ষাটা পরিপূর্ণ হবে না। আধাআর্ধি থেকে যাবে। আমি চার ঘণ্টা শিক্ষা দিয়ে বিশ ঘণ্টার প্রভাবকে ঠেলে দূর করতে পারবো না। 
.
(৫) পরিবেশ-পরিস্থিতিই আমদেরকে সহিংস হওয়ার পথে ঠেলে দেয়। সহিংসতাটা শুধু শারীরিকভাবেই নয়, মানসিকভাবেও হয়। আমাদের ছেলেরা শুধু হাতেই পাথর ছোঁড়ে না, মনেও ছোঁড়ে। এই মানসিকতা তাদেরকে শিক্ষা থেকে ছিটকে ফেলছে। আমি এর প্রতিকার খুঁজছিলাম। মনে হয় কিছুটা পেয়েও গেছি। 
.
(৬) আমাদের ছেলেরা শুধু যে রাজপথের সহিংসতা দেখেই থেমে যাচ্ছে তা নয়, এসবের ভিডিও মোবাইলে, টিভিতে দেখে দেখে চব্বিশ ঘন্টাই একটা লাইভ সহিংসতার ঘোরের মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠে। তাদের স্বাভাবিক চিন্তা-চেতনাই গড়ে ওঠার সুযোগ পায় না। এজন্য আমাদের স্কুলগুলোর র্শিক্ষাদীক্ষাও তাদের উপযোগী করে গড়ে তোলা অতীব প্রয়োজন ছিল। আমি এদিকটা নিয়েই সারাক্ষণ ভেবে যাচ্ছিলাম। 
.
(৭) তবে আমাদের ছেলেদের কিছু গুণ আছে: তারা নির্ভীক। ভয়ডশঙ্কাহীন। কষ্টসহিষ্ণু। কর্মঠ। সংগ্রামী। আমি ভেবে দেখলাম, তাদেরকে যদি সঠিকভাবে কাজে লাগানো যায়, অনেকদূর নিয়ে যাওয়া যাবে। সেটাই করে যাচ্ছি। 
.
(৮) আমি চাই স্কুলে এসে যেন একটা ছেলে বা মেয়ে অস্বস্তি বোধ না করে। সে যেন ভাবতে পারে, স্কুলটাই তার ঘর। বা তার চেয়েও বেশি কিছু। মায়ের আদর, বাবার স্নেহ, বোনের মমতা, ভাইয়ের আশ্রয় স্কুলেও পায়। তার মনের কোনও একটা আকাঙ্খাও যেন অচরিতার্থ না থাকে। চিৎকার-হৈচৈ-চেঁচামেচি সবই যেন করতে পারে। ফাঁকে ফাঁকে চলবে পড়াশুনো। 
.
(৯) আমি চেষ্টা করি, একটা শিশুর সাথে আমার সম্পর্কটা এমন হয়, কোনও কথা সে মায়ের কাছে বলতে না পারলেও আমার কাছে যেন অসংকোচে বলতে পারে। অকপটে মুখ খুলতে পারে। আমি অনেকটাই সফল। 
.
(১০) শিশুরা স্কুলে এসেই প্রথমে দৌড়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে। আমিও সাগ্রহে তাদের দিকে দৌড়ে যাই। গল্প জুড়ে দেয়। মায়ের নামে নালিশ করে আমার কাছে। বড় ভাইয়ের নামে একগাদা অভিযোগ করে। গাল ফোলায়। আমাকে সেটার বিচারও করতে হয়। বাড়ি বাড়ি গিয়ে। আমার এসব করতে ভীষণ ভাল লাগে। 
.
(১১) ক্লাশরূমটা যেন জেলখানা না হয়ে পড়ে। সেটা যেন শিশুর খেলার বাগানের মতো হয়। আমাদের কাছে উন্নতবিশ্বের মতো যান্ত্রিক উপকরণ নেই, কিন্তু মানবিক উপকরণ আছে। তারা যেটা করে মেশিন দিয়ে, আমরা সেটা শরীর দিকে করতে পারি। মেশিনের চেয়ে মন অনেক বেশি মানবিক আর হৃদয়গ্রাহী। মনকাড়া। 
.
(১২) আমি প্রথম হয়েছি, এসব কোনও একজন আদর্শ শিক্ষকের কামনা-বাসনা হতে পারে না। এটা নিছক একটা বস্তগত উপকরণ, হয়তো খ্যাতিলাভটা আমার কর্মক্ষেত্রের জন্যে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। যদি আমি সেটাকে ইতিবাচকভাবে ব্যবহার করতে পারি আরকি। নাহলে সেরা হওয়ার নেশায় ডুবে টিভি-রেডিওতে সাক্ষাতকার দিয়ে বেড়ালাম, সংবর্ধনা গ্রহণ করতে শুরু করলাম, এদিকে আমার সাজানো সংসার তছনছ হয়ে গেলো, তাহলে এত মেহনতের আর কী অর্থ রইল!
.
(১৩) শিক্ষকরাই বিশ্বের প্রকৃত শক্তি। তারাই চাইলে পারে বিশ্বকে বদলে দিতে। অল্পব্যয়েই। স্বল্প মেহনতেই। আমি তাই করার চেষ্টা করছি। 
.
(১৪) নিজদেশেও আমি বা আমরা পরবাসীর মতো জীবন কাটাচ্ছি। অসংখ্য মুখাইয়াম (শিবিরে) ছিলাম। সব জায়গা থেকে আমি একটা না একটা গুণ অর্জন করেছি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে শিক্ষাটা আমি লাভ করেছি, তা হলো: চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করা ও অনঢ়ভাবে লেগে থাকা। 
..
(১৫) আমি শিক্ষকতা করতে গিয়ে খেয়াল রাখি তাকামুল বা পরিপূর্ণতার দিকে। শিক্ষা ও দীক্ষা। চিন্তা ও মূল্যবোধ। আখলাক ও আচরণ। শুধু পুঁথিগত বিদ্যা নয়, জীবনের পাঠও যেন সাথে সাথে দিয়ে দিতে পারি। 
.
(১৬) একদিন কুদস ইউনিভার্সিটি থেকে ঘরে ফিরছি। ইসরাঈলি সৈন্যরা একজন লোককে মেরে ফেলে রেখেছে। ছোট্ট ছেলেটাও বাবার সাথে ছিল। সৈন্যটা এবার রাইফেল তাক করেছে, শিশুটার দিকে। অবাক কান্ড হলো, শিশুটা একটুও ভয় না পেয়ে, হাসি মুখে বুক বুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি যুগবৎ আনন্দ আর কষ্ট পেলাম। একটা শিশু তার বাবার মৃত্যুতে কাঁদবে না? আবার এ ভেবে আনন্দ পেলাম, আমাদের শিশুরা অস্ত্রের মুখেও বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে পারে। 
.
(১৭) শিশুদেরকে শিক্ষা দেয়ার তিনটি পদ্ধতি আমার কাছে বেশ ফলদায়ক মনে হয়েছে: 
ক: খেলতে দেয়া। 
খ: পুরষ্কার দেয়া। 
গ: প্রশংসা করা। 
.
(১৮) আমাদের স্কুলের স্লোগানই হলো: আমরা খেলতে খেলতে শিখি। নালআব নাতাআল্লাম। উই প্লে এন্ড লার্ন। এ বিষয়ে একটা বইও লিখেছি: নালআব নাতাআল্লাম। 
.
(১৯) পুরস্কার বড় কিছু হতে হবে এমন না। আশেপাশে চোখ রাখলেই পুরষ্কার তৈরী করে ফেলা যায়। একটা পানির বোতল কেটে একটা ফুল বানানো যায়। সেটাই হতে পারে পুরষ্কার। শিুশুদেরকে দিয়েও তাদের পুরষ্কার বানিয়ে নেয়া যায়। তাদের বুদ্ধিমত্তার ওপর ছেড়ে দিয়ে। নিজের প্রাপ্ত পুরস্কার অন্যকে বা ফান্ডে দান করে দেয়ার প্রতিও উদ্বুদ্ধ করা যায়। বাড়তি খরচ করতে হয় না। 
.
(২০) একজন শিক্ষকের বড় সঞ্চয় তার ছাত্ররা। ব্যাংক-ব্যালেন্স নয়। ছাত্রদেরকে নিয়েই তার জগত গড়ে উঠবে। সংসার গড়ে উঠবে। 
.
(২১) পুরস্কারে পাওয়া ১মিলিয়ন ডলারের পুরোটাই ব্যয় করার ইচ্ছা আছে, গরীব ছাত্রদের লেখাপড়ার খরচের পেছনে। 
.
(২৩) আমি শিক্ষকদেরকে বলি, প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু আইডিয়া আছে। আমরা সেটাকে মডিফাই করে কাজে লাগাতে পারি। আমার আইডিয়াই কাজে লাগাতে হবে এমন নয়। তবে নিজের আইডিয়াকে অন্যের সাথে শেয়ার করতে হবে। আলোচনা করতে হবে। উন্নত করে তুলতে হবে। প্রচার করতে হবে। নিজের যোগ্যতা ও সামর্থের প্রতি খেয়াল ও আত্মবিশ্বাস রাখতে হবে। 
.
(২৪) পাশাপাশি এটাও মনে রাখতে হবে, পুরষ্কার পেয়েছি বলেই আমি সেরা হয়ে গেছি, এমনটা নয়। আলোচনার পাদপ্রদীপের বাইরে আরও কতো শিক্ষক রয়ে গেছেন। তাদের কাছে হয়তো আমাদের শ্রম কিছুই নয়। 
.
(২৫) এক অভিভাবকের অভিব্যক্তি:
আমার ছেলে কারাম কাউকেই পছন্দ করতো না। সঙ্গী-সাথীদেরকেও না। তার কোনও খেলার সাথী ছিল না। স্কুলে যেতে তার মোটেও ভাল লাগতো না। ছোট্ট বয়েস হলে কী হবে, সে ছিল অত্যন্ত হিংস্র আর হিংসুটে প্রকৃতির। 
তখনই একজনের পরামর্শে নিতান্ত অনাগ্রহের সাথে হানানের স্কুলে ছেলেকে ভর্তি করিয়ে দিলাম। আস্তে আস্তে ছেলে আমার অন্য ছেলেতে রূপান্তরিত হলো। তার এখন অনেক বন্ধু। সে সুর তুলতে পারে। আঁকতে পারে। অক্ষর চেনে। লিখতে পারে। আমার কাছে কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা নেই। হানান আমার ছেলেকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন। নবজীবনের প্রেরণা যুগিয়েছে। নতুন করে হাসতে র্শিখিয়েছে। 
.
(২৬) কোনও পরিবারে হামলা হল্ইে আমি ছুটে যাই। শিশুটাকে কোলে তুলে নেই। চেষ্টা করি তাকে এই নারকীয় পরিবেশে ছোঁয়া থেকে দূরে সরিয়ে আনতে। আমাদের খেলার স্কুলে নিয়ে আসতে। 
.
(২৭) আমি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াই। খেলার মাঠগুলোতে যাই। পাড়ার অন্ধকার গলিগুলোতে টহল দেই। খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করি, কোথায় আমার শিশুরা লেখাপড়া বাদ দিয়ে অন্যকিছুর তালীম নিচ্ছে। ঢিল ছোঁড়া শিখছে। গুলতি নিয়ে অহেতুক ছুটে বেড়াচ্ছে। তাদেরকে ধরে স্কুলে নিয়ে আসার চেষ্টা করি। বোঝাই, এসব বড় হয়ে করো। এখন মন দিয়ে পড়ো। কেউ সাথে সাথে চলে আসে। কেউ ছুটে পালিয়ে যায়। আমি পালাই না। ঠিক চিনে রাখি, আবার যাই। আবার যাই। আবার যাই। আমাকে যেতেই হয়। 
.
(২৮) আমার কাছে ইসরাঈলের মোকাবেলায় অস্ত্র নেই। শক্তি নেই। আছে শিশুরা। তাদেরকে গড়ে তুলতে চাই। ইসরাঈলিদের একে-৪৭এর বিপরীতে আমার ছেলেরাই হবে শিক্ষাদীক্ষায় ভিন্নধর্মী এক একে-৪৭। ইনশাআল্লাহ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন