বুধবার, ৬ এপ্রিল, ২০১৬

উসমানী খিলাফাতের ইতিহাস (২)


সুলতান মুহাম্মদ আলপারসলান

সুলতান মুহাম্মদ আল পারসলান তার চাচা সুলতান তুউরুলের মৃত্যুর পর সমগ্র এলাকায় তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন।কিছু কাল পরে কিছু কিছু সমস্যার সৃষ্টি হলেও আলপারসলান সমস্যাকে সামলে নিয়ে সকল কিছুকে তিনি তার নিয়ন্ত্রনে নিতে সক্ষম হন। আলপারসলান তার চাচার মত অত্যন্ত বিচক্ষণ এবং যোগ্য একজন নেতা ছিলেন। যে সকল অঞ্চল সেলজুকদের আধিপত্যকে মেনে নিতে অস্বীকার করছিল, সে সকল এলাকায় সেলজুকদের প্রভাবকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য তিনি বিশেষ একটি রাজনৈতিক পদ্ধতি অবলম্বন করেন।যার ফলে তিনি সফলতা লাভ করেন।আল্লাহ তায়ালার দ্বীনকে প্রতিষ্ঠার জন্য এবং ইসলামের বানীকে আর্মেনিয়া, রুমের মত খ্রিস্টিয়ান দেশ সমুহেও পোঁছে দেওয়ার জন্য তিনি আপ্রান প্রচেষ্টা চালান।ইসলামের জিহাদী রুহু, আলপারসলানকে দেশ বিজয়ে পাগল পারা করে তুলে। এই রূহ তাকে দিয়েছিল এক অপরিসীম ইসলামী চেতনা। এবং তাকে বানিয়েছিল এক দ্বিকবিজয়ী বীর।সেলজুক সাম্রাজ্যের সেনাপতি গণ ছিলেন এই সকল জিহাদের অগ্রসেনানী। ইসলামের সেবায়,ইসলামকে এই সকল ভূমিতে পৌঁছানোর জন্য এবং ইসলামের পতাকাকে বাইজান্টাইনে সাম্রাজ্যের প্রসাদের উপরে উড়ানোর জন্য এবং এই মহান দ্বীনের প্রচার প্রসারের জন্য তারা ছিলেন পাগলপারা। 
কিন্তু শেষের ৭ বছর এই রাষ্ট্রটি তার এই বিশেষ বিশিষ্টকে হারাতে শুরু করে। সুলতান আল পারসলান পুনরায় তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হন, এবং তার সাথে সম্পৃক্ত সেলজুক রাষ্ট্রের সকল এলাকায় তিনি তার কতৃত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করার পর কিছু অদুর ভবিষ্যতে কিছু পরিকল্পনাকে বাস্তবায়ন করার জন্য তিনি দীর্ঘস্থায়ী কিছু পরিকল্পনা গ্রহন করেন।এসকল পরিকল্পনার মধ্যে ছিল, তার প্রতিবেশী খ্রিস্টান দেশগুলোকে বিজয় করা,ফাতেমী খিলাফাতকে জয় করে সমগ্র মুসলিম বিশ্বকে আব্বাসী খিলাফাতের পতাকাতলে সমবেত করা এবং সেলজুক রাষ্ট্রের প্রভাব বৃদ্ধি করা। এই জন্য আর্মেনিয়া এবং জর্জিয়াকে বিজয় করে ইসলামের পতাকা তলে আনার লক্ষ্যে তিনি এক বিশাল সৈন্যবাহিনী প্রস্তুত করেন এবং এই সকল দেশকে বিজয় করে তিনি তার খিলাফাতের অন্তর্ভুক্ত করেন। বিজয়ের পর এই সকল দেশে ইসলামের প্রচার এবং প্রসারের জন্য তিনি বিরামহীনভাবে প্রচেষ্টা চালান। আলপারসলান, শামের উত্তর দিকে সৈন্য সমাবেশ করে আলেপ্পর মুরদাসিয়া রাষ্ট্রকে অবরোধ করেন। যে রাষ্ট্রটি ৪১৪ হিজরীতে (১০২৩ খ্রিষ্টাব্দ)শিয়া মাজহাবের উপর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সালিহ ইবনে মুরাদিস। 
দক্ষিণের রামাল্লা এবং বাইতুল মুকাদ্দাসকে ফাতিমীদের কাছ থেকে উদ্ধার করতে সক্ষম হলেই মিশরের প্রবেশদ্বার বলে পরিচিত আস্কালানকে দখল করা সম্ভব হয়নি। 

৪৬২ হিজরী (১০৬৯ খ্রিস্টাব্দ)সালে মক্কার শাসক মুহাম্মাদ বিন আবু হাশিমের দূত সুলতানের কাছে এসে বলেন যে, সুলতান কাইম বি আমরিলাহর সাথে সুলতানের নামেও খুতবা পাঠ করবেন এবং মিসরের শাসক উবাইদার নাম খুতবা থেকে বাদ দিবেন।পাশাপাশি আযানের বাক্য থেকেও (হায়্যা আলাল আমাল) এই অংশটিকেও বাদ দিবেন।
এই কথা বলার পর সুলতান তাকে ৩০,০০০ দিনার দেন এবং তাকে বলেন যে “মদিনার গভর্নর ও যদি একই কাজ করেন তাহলে তাকেও তিনি ২০,০০০ দিনার দিবেন”।
আলপারসলানের এই বিজয়ে রোম সম্রাট রমেন দিয়জেন খুবই খিপ্ত হয়ে উঠে। রোমান সম্রাট আলপারসলানের এই বিজয়কে তার জন্য হুমকি মনে করেন এবং এই অভিযানকে তিনি মোকাবেলা করার সিধান্ত নেন। মুসলিম সেলজুক বাহিনী, রোমক বাহিনীর মোকাবেলা করার জন্য হিজরী ৪৬৩ (১০৭১ খ্রিষ্টাব্দ)সালের আগস্ট মাসে মালাজগিরত নামক সমভূমিতে অবস্থান নেন। 
ইবনে কাসীর বলেনঃ সেখানে রোমক সম্রাট, রোম এবং ফ্রেঙ্কদের কাছ থেকে পাহাড়ের মত বিশাল এক সৈন্যবাহিনী নিয়ে আলপারসলানকে মোকাবিলা করার জন্য আসেন। সৈন্যর সংখ্যা ছিল অগণিত। সেখানে প্রায় ৩৫,০০০ গোত্রপতি (patriarch) ছিলেন।প্রতি গোত্রপতির অধীনে ছিল ২০০ জন সৈন্য। তাদের সাথে গাজীদের মধ্যে ছিল ইস্তাবুলে বসবাসকারীদের মধ্য থেকে আগত ১৫,০০০ সৈন্য, ১০০,০০০ অপেশাদার সৈন্য।এক হাজার ঐতিহাসিক যারা দৈনঃদৈনিন সব লিখে রাখত।৪০০ অস্রবহনকারী খন্দক খনন কারী ছিল।অপর দিকে তাদের কাছে ছিল ১০০০ ক্ষেপনাস্ত্র এবং ২ শত অভিজ্ঞ ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপকারী সৈন্য। 

সুলতান তাদের এই সৈন্য বাহিনী থেকে ভীত না হয়ে আল্লাহর উপর ভরসা করে ইসলামের বিজয়ের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। সুলতান খলিফার কাছে দূত পাঠিয়ে এই অভিযানে সফল হওয়ার জন্য দোয়া কামনা করেন। পরবর্তীতে ইরাক এবং শাম থেকে সমর্থন নেওয়ার পর তাদেরকে তিনি শামের দায়িত্বে নিয়োজিত করেন এবং অন্যান্য মুসলিম এলাকা থেকে সাহায্য গ্রহন করেন।অতঃপর তিনি এই আয়াত পাঠ করেন 
﴿لَعَمْرُكَ إِنَّهُمْ لَفِي سَكْرَتِهِمْ يَعْمَهُونَ)
তোমার জীবনের কসম হে নবী ! সে সময় তারা যেন একটি নেশায় বিভোর হয়ে মাতালের মতো আচরণ করে চলছিল৷ (সূরা হিজর ৭২)

এর পর সুলতান আল পারসলান তার সেনাবাহিনী নিয়ে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েন। সেই সময় তার সাথে ছিল মাত্র ২০,০০০ সৈন্য। আবু নাসর মুহাম্মাদ বিন আব্দুল মালিক এই অবস্তাকে বিশ্লেষণ করেন বলেনঃ “ খতিবগণ মুজাহিদদের জন্য দোয়া করার পরে, জুমা নামাজের পর সূর্য দলে পড়ার পরে যুদ্ধ শুরু হয়। সেই সময়ে, উভয় পক্ষের সৈন্য বাহিনী মুখোমুখী হলে, সুলতান আল পারসলান তার ঘোড়া থেকে নেমে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে সেজদায় পড়ে যান।মুখে মাটি মেখে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে দোয়া করেন এবং তার কাছ থেকে বিজয় প্রত্যাশা করেন।ফলে মুসলমানদের উপর আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে সাহায্য আসে এবং তারা বহু সংখ্যক রোমক সৈন্য কে হত্যা করে। এক ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর রোমান সম্রাট রমেন দিয়জেনকে গ্রেফতার করে। তাকে রোমের এক গোলাম গ্রেফতার করে নিয়ে আসে।তাকে যখন গাজী আল পারসলানের সামনে আনা হয় তখন সুলতান তাকে ৩ বার হাত দিয়ে স্পর্শ করে বলেন 
-আমাকে যদি তোমার সামনে এই ভাবে গ্রেফতার করে নিয়ে আসা হত, তাহলে তুমি আমাকে কি করতে?

- রোমক সম্রাট জবাবে বলেন, আমি তোমাকে সকল প্রকার নির্যাতন করতাম।

- মুসলিম সেনাপতি আলপারসলান তাকে বলেন, “ আচ্ছা তাহলে আমি তোমাকে কি করব বলে তুমি চিন্তা করছ?”

- রোমক সম্রাট জবাবে বলেন “ হয়ত আমাকে হত্যা করে সমগ্র শহরে প্রদর্শন করবে,অথবা ক্ষমা করে দিয়ে মুক্তিপন নিয়ে আমাকে আমার দেশে পাঠিয়ে দিবে। 

- ইসলামের মহান সেনাপতি সুলতান আলপারসলান তাকে জবাবে বলেন “ আমি ত তোমাকে ক্ষমা করে দিয়ে মুক্তি পন ছাড়া অন্য কিছু চিন্তাই করি নাই”। 

এর পর তার কাছ থেকে ১,৫০০,০০০ দিনার মুক্তিপনের বিনিময়ে মুক্ত করে দেন। এবং সুলতান দাঁড়িয়ে তাকে পানি পান করার জন্য নিজ হাতে পানি দেন। রোমান সম্রাটও খলিফার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে তার সামনে এসে মাটিতে চুমা দেন।পরে নিজেকে ফিরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত করার লক্ষ্যে সুলতান তাকে ১০,০০০ দিনার দেন। সেনাপতিদের মধ্য থেকে একজনকে দিয়ে তাকে সসম্নানে এগিয়ে দেন এবং গার্ড দিয়ে নিরাপদে তাকে তার স্বদেশে রেখে আসেন। তাকে যেসকল সৈন্য গণ এগিয়ে দেওয়ার জন্য যান তারা তাকে নিয়ে যাওয়ার সময় “লা ইলাহা ইল্লাহু” লেখা খচিত একটি পতাকা বহন করেন। 
মূলঃ ডঃ আলী মুহাম্মেদ সাল্লাবী
অনুবাদঃ বুরহান উদ্দিন
(চলবে )


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন