বুধবার, ৬ এপ্রিল, ২০১৬

ইসলামের স্বর্ণযুগ এবং চিকিৎসাবিজ্ঞান,

পর্বঃ২ লিখেছেনঃউমাইর চৌধুরী


নুরী মেডিকেল কলেজ এন্ড হসপিটাল
Al-Bimaristan al-Nuri (البيمارستان النوري) 
দামেশক, সিরিয়া
প্রতিষ্ঠাতা: নুরুদ্দিন জঙ্গি

১১৫৪ সালের দিকে এই হাসপাতালের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। মূলত দামেশকের একটি মসজিদের বর্ধিত অংশে কিছু ঘর আর উঠোন নিয়ে প্রথমে হাসপাতালের কাজ শুরু হয় পরে অনেকবার এর সংস্কার এবং পরিবর্ধনের কাজ হয়েছে। সালাহউদ্দিন আইয়ুবী এক ইউরোপীয় ক্রুসেডার রাজাকে একবার যুদ্ধে পরাজিত করে বন্দী করেন। পরে তার মুক্তিপণ হিসেবে তিনি ৪ টি দূর্গ এবং ৫ লাখ দিনার আদায় করেন। এই মুক্তিপণের বেশীরভাগটাই তিনি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার কাজে লাগান। আরবের অনেক বড় বড় চিকিৎসক এখানে জ্ঞান অর্জন করেছেন এবং চিকিৎসা দিয়েছেন। এদের মধ্যে আন-নাফিসের নাম না বললেই নয়, মেডিকেল সায়েন্সের ইতিহাসে যিনি সর্বপ্রথম পালমোনারি সার্কুলেশন এর ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। তিনি ইবনে সিনার হার্ট এবং ব্লাড সার্কুলেশন থিউরি সংশোধিত করেন। আন নাফিস এই মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করে এখানকারই হসপিটালে অনেকদিন চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেন। এরপর তিনি চলে যান মিসরে। মিসরে তিনি আল-মানসুরি এবং আল-নাসরি হসপিটালে বহুদিন কাজ করেন, পরে মিশরের সুলতানের ব্যক্তিগিত চিকিৎসক হিসেবেও ছিলেন বেশ কিছুদিন। আন-নাফিস মারা যাবার পর তাঁর অন্তিম ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁর বাড়ি-লাইব্রেরী মানসুরি হাসপাতালের অংশ হিসেবে ব্যবহৃত হয় পর পরবর্তীতে।

তো যা বলছিলাম, নুরী হসপিটালের সার্জারি বিভাগ বেশ বিখ্যাত ছিল। আল-আন্দালুসে চিকিৎসাবিজ্ঞানের যে বিপ্লব তার পুরোপুরি সুফল ভোগ করেছে পুরো আরবসহ মুসলিম বিশ্ব সেসময়। ফাদার অফ সার্জারি মানে আন্দালুসের শ্রেষ্ঠ সার্জন আল জাহরায়ীর লেখা বই এবং বিভিন্ন সার্জিক্যাল ইন্সট্রুমেন্ট ব্যবহার হতো দামেশক-বাগদাদ-কায়রোর হাসপাতালগুলোতে। আর মেডিসিন-ফার্মেসি-কেমিস্ট্রির উপরে ইবনে সিনা, ইবনে যুহর, ইবনে হাইয়ান, ইবনুল হাইসামসহ বিভিন্ন বিজ্ঞানীদের যে গবেষনা এবং অর্জিত জ্ঞান তার ব্যবহার হতো সফলতার সাথে । চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে সরকারীভাবে জনসেবার লক্ষে মুসলমানরাই সর্বপ্রথম হাসপাতাল তৈরী করে। এসব হাসপাতাল পরিচালনা পদ্ধতি পরবর্তীতে গ্রহণ করে ইউরোপ। নুরী হাসপাতালে সবসময় একজন প্রধান চিকিৎসক ডিরেক্টর হিসেবে থাকতেন। প্রতিদিন তিনি রোগীদেরকে একবার ভিজিট করতেন এবং কে কে বাড়ি যেতে পারবে এ ব্যাপারে আদেশ লিখতেন। ভিজিটের সময় তার সাথে কিছু নার্স এবং মেডিকেল ছাত্ররা থাকত। এরপর তিনি পাশের একটি বড় হলরুমে লেকচার দিতেন ছাত্রদের উদ্দেশ্যে। দিনের অন্যান্য সময় তার ছাত্ররা এবং জুনিয়র চিকিৎসকরা রোগীদের দেখতেন।

নুরী হাসপাতালের আরেকটি উল্লেখযোগ্য জিনিশ হচ্ছে এর লাইব্রেরী। ব্যাপক সমৃদ্ধ এবং বিরাট সেই লাইব্রেরী এখনো আছে। পর্যটকরা সেখানে গেলে দেখতে পান চিকিৎসাবিজ্ঞানের উপর সেসময়ে লেখা মূল্যবান সব বই, যদিও এসব বই এর বেশীরভাগেরই মূল ভার্সন নাই বরং এর অনুবাদ দেখতে পাওয়া যায়। এসব বই আঠারো শ শতক পর্যন্ত ইউরোপের বিভিন্ন মেডিকেল ইউনিভার্সিটিতে পড়ানো হতো। সমসাময়িক সকল আরব পর্যটক যারা দামেশকে একবার হলেও গেছেন কিংবা যারা ইতিহাস লিখতেন তাদের প্রায় সবারই গ্রন্থে এই হাসপাতালের কথা এসেছে বেশ গুরুত্বের সাথে।
সেসময় আরবের বিভিন্ন চিকিৎসকের লেখায় নুরী হাসপাতালের বর্ণনা এসেছে। ইবনে উসাইবিয়াহ নামের এক ডাক্তার যিনি এই মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করেছিলেন ১৩ শ শতাব্দীতে তিনি লিখেছেন, 'আমাদের এখানে প্রতিদিন অনেক রুগী আসত, তাদেরকে বাহিরের দিকের একটি বড় ঘরে আমরা পরীক্ষা করে দেখতাম। যারা বেশী অসুস্থ না তাদেরকে তাৎক্ষণিক পরামর্শ এবং ঔষধ দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিতাম এবং কারো অবস্থা খুব খারাপ হলে তাকে আমরা হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে নিতাম। হাসপাতালে চিকিৎসার পর সুস্থ্য হয়ে উঠলে তাকে নতুন জামা-কাপড় এবং অল্প কিছু টাকা দিয়ে বিদায় জানানো হতো।'

সেসময়ের বিখ্যাত আরব পর্যটক ইবনে জুবাইর তার গ্রন্থে লিখেছেন নুরী হাসপাতালের কথা। নিয়মিত ভর্তি হওয়া এবং রিলিজ পাওয়া রোগীদের তালিকা একজন লিপিবদ্ধ করত সমসময়। নুরী হাসপাতালে খাবার বা নিউট্রিশনের উপরে বেশ গুরুত্ব দেয়া হতো বলে লিখেছন তিনি। হাসপাতালের রোগীদেরকে ডাক্তারদের পরামর্শ অনুযায়ী প্রতিদিন স্বাস্থ্যসম্মত খাবার এবং ফল-মাছ-মাংস সরবরাহ করা হতো। এক ইরানী একবার দামেশকে ঘুরতে যেয়ে এই হাসপাতালের কথা শুনে এর খাবারের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে হাসপাতালে যেয়ে ব্যাপক অসুস্থ্য হবার ভান করেন। দায়িত্বরত ডাক্তাররা তাকে ভর্তি নেবার পর তিনদিন গড়িয়ে যায়। এরপর প্রধান চিকিৎসক তৃতীয়দিন তার পালস এবং শারিরীক অবস্থা চেক করে বলেন যে সে সুস্থ্য এবং এখানে থাকার আর কোন সুযোগ তার নাই। পরে ব্যাচারা বাধ্য হয়ে হাসপাতাল ত্যাগ করে।
১৮৯৯ সাল পর্যন্ত দামেশকের অন্যতম বিখ্যাত হাসপাতাল ছিল এটি। পরে তা অন্য এক নতুন বড় বিল্ডিং এ সরিয়ে নেয়া হয়। এরপর কিছুদিন মাদ্রাসা হিসেবে ব্যবহার হয় এবংআরব মুসলমানদের জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার নিদর্শন হিসেবে এখন তা জাদুঘর।সোর্স: উইকি, শাইনিং হিস্টোরি, মুসলিম হেরিটেজ, লস্ট মুসলিম হিস্টোরি, সিরিয়া হিস্টোরি, সিরিয়া ট্যুর গাইড


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন