বৃহস্পতিবার, ১৯ নভেম্বর, ২০১৫

সূরা কাহফের গূঢ় বাণী : মাওলানা ইয়াছিন

হযরত আবু দারদা রা. থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি সূরা কাহফের প্রথম দশ আয়াত মুখস্থ করে সে দাজ্জালের ফেৎনা থেকে নিরাপদ থাকবে।’ [সহি মুসলিম] হাদীসে আরো বর্ণিত আছে, ‘যে ব্যক্তি শুক্রবার দিন সূরা কাহফ পাঠ করবে, তার জন্য কেয়ামতের দিন আলো দিবে এবং বিগত জুমআ থেকে এ জুমআ পর্যন্ত তার সব গুনাহ মাফ হয়ে যাবে।’
রাসূলুল্লাহ সা. কেন তাঁর উম্মতকে প্রতি শুক্রবার সূরা কাহফ পড়তে বলেছেন, সেটা কি কখনো ভেবে দেখেছেন?
এক: গুহাবাসীদের ঘটনা
এটি কিছু ঈমানদার যুবকের গল্প। যারা এমন এক জনপদে বসবাস করতো যেখানে তারা ব্যতীত সবাই ছিল জালিম ও অবিশ্বাসী, এমনকি তাদের স্বজাতিরাও। পরিস্থিতি তাঁদের জন্য এতটাই প্রতিকুল ছিল যে ঈমানের সাথে সেই শহরে বসবাস করা তাঁদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। উপায়ন্তর না দেখে তাঁরা শুধুমাত্র আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভের আশায় নিজ দেশ ত্যাগ করে পার্শ্ববর্তী এক পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নেয়। যুবকরা পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় গ্রহণ করে আল্লাহ্র কাছে প্রার্থনা জানায়, ‘হে আমাদের পালনকর্তা, আমাদেরকে নিজের কাছ থেকে রহমত দান করুন এবং আমাদের জন্যে আমাদের কাজ সঠিকভাবে পূর্ণ করুন।’ [সূরা কাহফ ১৮:১০]   আল্লাহ্  তাঁদের প্রার্থনা কবুল করে নেন, শত্রুদের কবল থেকে তিনি তাঁদেরকে রক্ষা করেন এবং তাঁদের প্রতি রহমত স্বরূপ তিনি তাঁদেরকে ঘুম পাড়িয়ে দেন। যখন তাঁরা ঘুম থেকে জেগে ওঠে তখন তাঁরা আবিস্কার করে যে, কয়েক প্রজন্ম পর আল্লাহর রহমতে তাঁদের ছেড়ে আসা সেই জালিম জনপদের সব অধিবাসী ঈমানদার ও বিশ্বাসীতে পরিণত হয়েছে।
দুই : বাগানের মালিকদ্বয়ের ঘটনা
দুই ব্যক্তির ঘটনা। তাদের একজনকে আল্লাহ্  দুইটি বাগানসহ অগাধ ধন সম্পদের মালিক করেছিলেন। এতো সম্পদ পেয়েও সে আল্লাহ্র কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো না, এমনকি শেষ বিচারের দিন সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করলো। অপরজন গরীব হওয়া সত্ত্বেও ঈমানদার মুসলিম। সে ধনী ব্যক্তিটিকে আল্লাহ্র প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়ার ও বিনয়ী আচরণের পরামর্শ দেয়। অবশেষে ধনী ব্যক্তির বাগান দুটি ধ্বংস হয়ে যায় ও সে সর্বস্বান্ত হয়। সে তার কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয় কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গেছে।
তিন : মুসা আ. এবং খিজির আ. এর ঘটনা
মুসা আ. কে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘পৃথিবীর সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তি কে?’ জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি’। তখন আল্লাহ্  উনাকে ওহী মারফতে জানিয়ে দিলেন যে উনার চাইতেও জ্ঞানী ব্যক্তি আছে। অতঃপর মুসা আ. সেই জ্ঞানী ব্যক্তির সাথে দেখা করার জন্য যাত্রা করলেন এবং এমন একজনের সাক্ষাত পেলেন, যাকে আল্লাহ্ তালার পক্ষ থেকে রহমত ও বিশেষ ঐশ্বরিক জ্ঞান দান করা হয়েছিলো।  সেই ব্যক্তির সাথে থেকে মুসা আ. তিনটি ঘটনা প্রত্যক্ষ করেন এবং বুঝতে সমর্থ হন যে আপাত দৃষ্টিতে খারাপ মনে হলেও কিছু কিছু ঘটনার সুদূরপ্রসারী ফলাফল ভালো হয়।
চার : জুলকারনাইন এর ঘটনা
জুলকারনাইন নামের  মহৎ ও ক্ষমতাশীল একজন রাজা ছিলেন যাকে আল্লাহ্ দিয়েছিলেন অগাধ জ্ঞান এবং ক্ষমতা। তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করে বিপদগ্রস্ত জনগোষ্ঠীকে সাহায্য করতেন এবং  সবাইকে সত্যের পথে আহ্বান করতেন। তিনি তাঁর ভ্রমণের এক পর্যায়ে এমন এক দেশে উপস্থিত হন, যে জনগোষ্ঠীর ভাষা বুঝতে তিনি ছিলেন অপারগ। তারপরেও তিনি সেই দেশে ইয়াজুজ-মাজুজ দ্বারা সংঘটিত অনাচারের অবসানের লক্ষ্যে একটি সুদৃঢ় ও অভেদ্য প্রাচীর নির্মাণ করে দেন।
এই সূরার প্রায় মধ্যবর্তী অংশে আল্লাহ তাআলা উল্লেখ করেন শয়তানের অবাধ্যতার ঘটনা। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই ইবলিস বেহেশত থেকে চিরজীবনের জন্য বিতাড়িত হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন- ‘যখন আমি ফেরেশতাদেরকে বললাম- আদমকে সেজদা কর, তখন সবাই সেজদা করল ইবলীস ব্যতীত। সে ছিল জিনদের একজন। সে তার পালনকর্তার আদেশ অমান্য করল। অতএব তোমরা কি আমার পরিবর্তে তাকে এবং তার বংশধরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করছো? অথচ তারা তোমাদের শত্রু। এটা জালেমদের জন্যে খুবই নিকৃষ্ট বদলা।’ [সূরা কাহফ ১৮:৫০]
এখন দেখা যাক দাজ্জালএর আগমনের সাথে সূরা কাহফের কি সম্পর্ক?
কেয়ামত সংঘঠিত হওয়ার আগে দাজ্জালের আগমন হবে এবং সে সেই সময়ে উপস্থিত মানুষদের জন্য চারটি পরীক্ষা নিয়ে আসবে।
সে নিজেকে আল্লাহ্র সমকক্ষ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করবে এবং মানুষকে আল্লাহ্র পরিবর্তে তাকে উপাসনা করতে আদেশ করবে।
আল্লাহ্র ইচ্ছায় তাকে বৃষ্টি হওয়া ও বৃষ্টি বন্ধ করার ক্ষমতা দেয়া হবে এবং সে মানুষের মনে সম্পদের প্রলোভন জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হবে।
সে পৃথিবীর সব তথ্যসমুহকে নিয়ন্ত্রণ করবে, বিভ্রান্তিমুলক তথ্য উপস্থাপন করে  মানুষের স্বাভাবিক বিচার-বুদ্ধিকে তার পক্ষে প্রবাহিত করতে সচেষ্ট হবে। পৃথিবীর সব প্রান্তে সে তার ক্ষমতা বিস্তার করবে এবং তার সহযোগী ও অনুসারীরা বিপুল ক্ষমতার অধিকারী হবে।
মানুষ কিভাবে এই ভয়ংকর সময়ে দাজ্জালের ফিতনা থেকে নিজেকে রক্ষা করবে? সূরা কাহফের ভেতরেই রয়েছে সমাধান বা উত্তর।
সৎ সঙ্গ ও ঈমানদার বন্ধু
‘আপনি নিজেকে তাদের সংসর্গে আবদ্ধ রাখুন যারা সকাল ও সন্ধ্যায় তাদের পালনকর্তাকে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে আহ্বান করে এবং আপনি পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য কামনা করে তাদের থেকে নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নেবেন না। যার মনকে আমার স্মরণ থেকে গাফেল করে দিয়েছি। যে, নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে এবং যার কার্য কলাপ হচ্ছে সীমা অতিক্রম করা, আপনি তার অনুগত্য করবেন না”। [সূরা কাহফ ১৮:২৮]
ক্ষণস্থায়ী এই জীবন সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান  রাখা
আল্লাহ তাআলা বলেন, তাদের কাছে পার্থিব জীবনের উপমা বর্ণনা করুন। তা পানির ন্যায়, যা আমি আকাশ থেকে নাযিল করি। অতঃপর এর সংমিশ্রণে শ্যামল সবুজ ভূমিজ লতা-পাতা নির্গত হয়; অতঃপর তা এমন শুস্ক চুর্ণ-বিচূর্ণ হয় যে, বাতাসে উড়ে যায়। আল্লাহ এ সবকিছুর ওপর শক্তিমান। [সূরা কাহফ ১৮:৪৫]
বিনয়ী ব্যবহার
মূসা বললেন- আল্লাহ চাহেন তো আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন এবং আমি আপনার কোন আদেশ অমান্য করব না। [সূরা কাহফ ১৮:৬৯]
আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে ইসলাম পালন
(হে রাসূল) বলুন- আমিও তোমাদের মতই একজন মানুষ, আমার প্রতি প্রত্যাদেশ হয় যে, তোমাদের ইলাহই একমাত্র ইলাহ। অতএব, যে ব্যক্তি তার পালনকর্তার সাক্ষাত কামনা করে, সে যেন, সৎকর্ম সম্পাদন করে এবং তার পালনকর্তার এবাদতে কাউকে শরিক না করে। [সূরা কাহফ ১৮:১১০]
কুরআন পাঠ ও সর্বদা আল্লাহকে স্মরণ
আপনার প্রতি আপনার পালনকর্তার যে কিতাব প্রত্যাদিষ্ট করা হয়েছে, তা পাঠ করুন। তাঁর বাক্য পরিবর্তন করার কেউ নাই। তাঁকে ব্যতীত আপনি কখনই কোন আশ্রয় স্থল পাবেন না। [সূরা কাহফ ১৮:২৭]
পরকালকে স্মরণ করা
যেদিন আমি পর্বতসমূহকে পরিচালনা করব এবং আপনি পৃথিবীকে দেখবেন একটি উম্মুক্ত প্রান্তর এবং আমি মানুষকে একত্রিত করব অতঃপর তাদের কাউকে ছাড়ব না। তারা আপনার পালনকর্তার সামনে পেশ হবে সারিবদ্ধ ভাবে এবং বলা হবে তোমরা আমার কাছে এসে গেছ; যেমন তোমাদেরকে প্রথম বার সৃষ্টি করেছিলাম। না, তোমরা তো বলতে যে, আমি তোমাদের জন্যে কোন প্রতিশ্রুত সময় নির্দিষ্ট করব না। আর আমলনামা সামনে রাখা হবে। তাতে যা আছে; তার কারণে আপনি অপরাধীদেরকে ভীত-সন্ত্রস্ত দেখবেন। তারা বলবে হায় আফসোস, এ কেমন আমলনামা। এ যে ছোট বড় কোন কিছুই বাদ দেয়নি-সবই এতে রয়েছে। তারা তাদের কৃতকর্মকে সামনে উপস্থিত পাবে। আপনার পালনকর্তা কারও প্রতি জুলুম করবেন না। [সূরা কাহফ ১৮:৪৭-৪৯]
লেখক: তরুণ আলেম, খতীব।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন