ইসলামী অর্থনীতির বিপরীতে পৃথিবীতে বিরাজমান অন্যসব অর্থনীতি দর্শন ও নীতিতে বহুধাবিভক্ত ও বাহ্যত সাংঘর্ষিক হলেও সেগুলো একই সূত্রে গাঁথা। বস্তুবাদই হচ্ছে এ সবের উৎস। বস্তুবাদি মানসিকতা থেকেই এ জাতীয় সকল দর্শন ও মতবাদের উদ্ভব। তাই বিভিন্ন দর্শন সৃষ্টিতে বস্তুবাদের প্রভাব এবং বস্তুবাদের বিপরীতে ইসলামের দর্শন সম্পর্কে আলোচনা করা সময়ের অপরিহার্য দাবি। গত সংখ্যায় বস্তুবাদ সম্পর্কে আলোচনা হয়েছিল। এ সংখ্যায় ইসলামের দর্শন সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করা হল।
ইসলামী দর্শনের মূল বিশ^াস হচ্ছে সব কিছুর স্রষ্টা আল্লাহ তায়ালা। বস্তু ও আত্মা তাঁরই সৃষ্টি। তিনি আদি, অনন্ত, চিরঞ্জীব, চিরন্তন। তাঁর সমকক্ষ বা তুল্য কেউ নেই। তিনি সৃষ্ট নন; ¯্রষ্টা। তাঁর পিতামাতা, স্ত্রী-সন্তান তথা পূর্বাপর কিছু নেই।
বস্তুর সঞ্চালন, শক্তি বা অন্যান্য গুনাগুণ আল্লাহ তাআলাই সৃষ্টি করেছেন। বস্তুর গুনাগুণ তাঁর সৃষ্টি ও নিয়ন্ত্রণে। মহাবিশে^র কোনো পরমাণু বা সামান্য কিছুও তাঁর অসীম জ্ঞান বহির্ভুত নয়। তিনি সব দেখেন, শোনেন; কথা বলেন। সকল গুণের পূর্ণ সমাবেশ তাঁরই শোভা। তবে তাঁর গুণগুলো সৃষ্টের অনুরূপ নয়। সব দোষত্রুটির উর্ধ্বে তাঁর অবস্থান। গুনাগুণ ও আলামত দ্বারা তাঁকে চেনা যায়। তবে তাঁর স্বরূপ উদঘাটন সৃষ্টের ক্ষমতা বহির্ভুত। তাঁর হুকুম ও ইচ্ছা ছাড়া কারো সামান্য নড়ারও সাধ্য নেই। সব তাঁর হুকুমাধীন। আর তাঁর কোনো হুকুম হিকমত ও কল্যাণ বিবর্জিত নয়। কারো সাধ্য নেই যে তাঁর উপকার বা ক্ষতি করে। তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন; সকলেই তাঁর মুখাপেক্ষী। জীবন-মরণ, সুস্থতা-অসুস্থতা সব তাঁর হুকুমের অনুগামী। তিনি ক্ষমতার উৎস। সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। কাজেই ইবাদতের যোগ্য কেবল তিনিই।
এ দর্শনানুসারে মহাবিশ^সহ কোনো কিছু ¯্রষ্টার পরিকল্পনা ও ইচ্ছা ছাড়া কেবল প্রকৃতির স্বাভাবিক বিবর্তনের ফসল নয়। আল্লাহ তাআলাই তাঁর অসীম কুদরতের মাধ্যমে, বিশেষ উদ্দেশ্যে পরিকল্পিত ভাবে একে অস্তিত্ত দিয়েছেন। বস্তু ও প্রকৃতির বিবর্তন, মহাবিশে^র বাহ্যিক ব্যবস্থাপনা তাঁর তৈরী। সুদৃঢ় নীতিমালার মাধ্যমে সবকিছু তিনি পরিচালনা করছেন। যদিও যাবতীয় নীতির উর্ধ্বে তাঁর অবস্থান। যখন খুশি এসব নীতিমালা তিনি ভেঙ্গে চুরমার করে দিতে পারেন। নমুনা হিসেবে কখনো কখনো তিনি এমন করেও থাকেন।
প্রতিটি প্রাণীর মাঝে তিনি প্রাণ ও অনুভূতি সঞ্চার করেছেন। একেক প্রাণীকে একেক বৈশিষ্ট্য দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। এর মাঝে কোনোটিকে আবার দৃষ্টির অন্তরাল করেছেন। যেমন নূর দ্বারা ফেরেশতা তৈরী করেছেন। যারা কখনোই তাঁর অবাধ্য হতে পারে না। বিভিন্ন দায়িত্বে তাদেরকে নিয়োজিত করেছেন। আর মানুষকে সৃষ্টির সেরা বানিয়ে তাঁর প্রতিনিধি রূপে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। মানুষের কল্যাণে যাবতীয় বস্তু ও উপকরণ সৃষ্টি করেছেন। যেন মানুষ তার জ্ঞান-বুদ্ধি, চিন্তা ও সাধনা ব্যয় করে এগুলোকে জয় করে এবং তাঁর বেঁধে দেয়া সীমায় থেকে নিজ প্রয়োজনে ব্যবহার করে। তিনি কখনোই মানুষকে সাধ্যাতীত কাজের আদেশ করেন না। অধিকন্তু ভুলের পর তওবা করলে তিনি ক্ষমা করেন। চাইলে তিনি দান করেন। তিনি ন্যায় বিচারক। তাই কেউ শাস্তিযোগ্য অপরাধ করলে তাকে শাস্তিও প্রদান করেন। কারো প্রতি অবিচার করেন না।
এ পৃথিবীতে মানুষ কীরূপে তার জীবন পরিচালনা করবে; সেজন্য আল্লাহ তাআলা নিষ্পাপ নবী-রাসূলগণের মানুষের মাধ্যমে সকলকে জীবন বিধান জানিয়েছেন। সেই জীবন বিধান হচ্ছে ইসলাম। সর্বপ্রথম নবী হযরত আদম আ. আর সর্বশেষ নবী হচ্ছেন হযরত মুহাম্মাদ সা.। মাঝে হযরত নূহ, ইবরাহীম, মুসা, ঈসা আ. সহ বহু নবী এ পৃথিবীতে আগমন করেছেন। কোনো কোনো নবীর প্রতি ফেরেশতাদের মাধ্যমে তিনি ছোট-বড় বহু কিতাব পাঠিয়েছেন। যেন তদনুসারে তাঁরা মানুষকে আল্লাহর বিধান জানাতে পারেন। পবিত্র কুরআন হচ্ছে এ ধারার সর্বশেষ কিতাব; যা শেষনবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা.-এর উপর অবতীর্ণ হয়েছে। এরপর আল্লাহ্র পক্ষ থেকে কোনো নবী বা কিতাব আসবে না। কুরআন হিফাজতের দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহ তাআলা গ্রহণ করেছেন। ফলে অদ্যাবধি তাতে সামান্যতম পরিবর্তনও হয়নি। ভবিষ্যতেও কখনো হবে না।
কুরআন ও (কুরআনের ব্যাখ্যা) রাসূলের হাদীসের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা মানুষের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ সংবিধান দিয়েছেন। যার কার্যকরিতা কিয়ামত অবধি বলবৎ থাকবে। কুরআন ও হাদীস ইসলামী শরীয়তের এমন দুটি উৎস যাতে ভবিষ্যতে সংঘটিতব্য সকল বিষয়ের শরঈ সমাধান উল্লেখ রয়েছে। কোনো বিষয়ে বিস্তারিত আর কোনো কোনো বিষয়ে এমন কিছু নীতিমালা বর্ণনা করা হয়েছে যার আলোকে ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞানসম্পন্ন ফুকাহায়ে কেরাম যাবতীয় সমস্যার সমাধান পেশ করতে পারেন। এভাবে তিনি মানুষের জন্য বৈধ-অবৈধ, ভাল-মন্দ, দায়িত্ব-অধিকার ইত্যাদি সবই জানিয়ে দিয়েছেন। তা বুঝার জন্য জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়েছেন। আবার সেচ্ছায় কোনো একটি গ্রহণ করার স্বাধীনতাও দিয়েছেন। এর মাধ্যমে তিনি পরীক্ষা করতে চান যে কে তার বাধ্য আর কে অবাধ্য। এ পরীক্ষার প্রকৃত ফলাফল তো আখেরাতেই প্রকাশ পাবে। তবে কখনো দুনিয়াতেও এর কিছু নমুনা প্রকাশিত হয়।
ইসলামের দর্শনানুসারে দেহÑআত্মার সমন্বিত মানুষ মৃত্যুর মাধ্যমে শেষ হয়ে যায় না। বরং মৃত্যুর পর আত্মা আমাদের দৃষ্টির অন্তরালে অবস্থিত বরযখ নামক ভিন্ন এক জগতে স্থানান্তরিত হয়। তখন দেহ ও আত্মার পূর্বের সম্পর্ক তো বহাল থাকে না। তবে দেহের ধ্বংসাবশেষের সাথে আত্মার এক ধরণের সুক্ষ সম্পর্ক তখনো বিদ্যমান থাকে। যার বিস্তারিত বিবরণ মানুষকে জানানো হয়নি। বরযখ জগতেও দুনিয়ার ভাল-মন্দ কাজের প্রতিফল সীমিত পরিসরে অব্যাহত থাকে।
এরপর যখন কিয়ামত সংঘটিত হবে, মহাবিশ^ ধ্বংস হবে, আর সকল প্রাণীর মৃত্যু ঘটবে; তখন আখেরাতের জগতে সকলকে পুণরায় জীবিত করা হবে। এবং দুনিয়ায় সম্পাদিত সকল কাজের হিসাব নেয়া হবে। যার রেকর্ড আল্লাহ তাআলার নিকট সংরক্ষিত। আল্লাহর অনুগত মুসলিমদেরকে সেদিন অনন্ত কালের জন্য জান্নাত আর অস্বীকারকারী অবাধ্যদেরকে চিরস্থায়ী জাহান্নাম দেয়া হবে। জান্নাত চির সুখ-শান্তির সমাবেশ। আর জাহান্নাম ভয়ানক সব শাস্তির আবাস। মুসলিম হওয়া সত্বেও যারা দুনিয়াতে অপরাধী ছিল এবং তওবা বিহীন মৃত্যুবরণ করেছিল। তাদের যাকে ইচ্ছা তিনি ক্ষমা করে জান্নাতে স্থান দিবেন। আর যাকে ইচ্ছা জাহান্নামে স্থান দিবেন। প্রত্যেক নির্যাতিত, বঞ্চিতকে সেদিন তার অধিকার ফিরিয়ে দিবেন।
ইসলামের এ দর্শনানুসারে কোনো কিছুই প্রকৃতির নিজস্ব নিয়মানুসারে ঘটছে না। বরং আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা ও হুকুমেই সব পরিচালিত হচ্ছে। ইসলামের কোনো কোনো বিষয় এমন হতে পারে যে এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আমাদের জানা নেই। কিন্তু তাই বলে তা পরিত্যাজ্য হওয়ার যুক্তি হতে পারে না। মহাবিশ^ তো বটেই এ পৃথিবীর কতো এমন বিষয় রয়েছে যার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আজো মানুষ জানে না ; তাই বলে কী তার অস্তিত্ব অস্বীকার করা যায়! অধিকন্তু এসব বিষয় তো কেবল ইসলাম কারো মনগড়া বক্তব্য বা শোনা কথার ওপর ভিত্তি করে গ্রহণ করেনি। বরং নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা.- এর সুস্পষ্ট ও সুনিশ্চিত বাণীর ভিত্তিতেই তা গ্রহণ করেছে। যাঁর পবিত্রতা, সততা, বিশ^স্ততার স্বীকৃতি খোদ তাঁর দুশমন কতৃকও স্বীকৃত। তাঁর জীবনী একটি উন্মুক্তগ্রন্থ। যে কেউ তা পাঠ করে এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারে। মানবেতিহাসে কোনো ব্যক্তির জীবনী এতো বিস্তারিত ও সতর্কতার সাথে এতো অধিক ভাষায় রচিত ও সংরক্ষিত হয়নি; যেমন তাঁর ক্ষেত্রে হয়েছে। এছাড়াও তাঁর সততা ও বিশ^স্ততার বহু অলৌকিক ও চাক্ষুষ অনস্বীকার্য প্রমানও বিদ্যমান। সত্যানুসন্ধাণী যে কারো পক্ষে সামান্য প্রয়াসেই যা জানা সম্ভব।
তাছাড়া পূণ অনুসন্ধাণের পরও ইসলামী আকীদা ও দর্শনে কোনো একটি বিষয়ও এমন পাওয়া যাবে না, যার বিপরীতে আধুনিক বিজ্ঞানের অকাট্য প্রমাণ রয়েছে। বরং ইসলামের শ^াশত দাবী তো হচ্ছে বিজ্ঞানের কোনো অকাট্য বিষয় কখনোই ইসলামী আকীদার সাথে সাংঘর্ষিক হতে পারে না। সাংঘর্ষিক হলে কোনো থিওরী ও মতামতের হতে পারে। ফ্যাক্ট বা অকাট্য বাস্তবতার হতে পারে না। এজন্যই কুরআন ও হাদিসে বারবার জ্ঞান সাধনায় নিমজ্জিত হতে উৎসাহ দেয়া হয়েছে। কারণ বিজ্ঞান মানুষের ঈমান বৃদ্ধিতে সহায়কই হবে। সাংঘর্ষিক হবে না।
ইসলাম কখনোই বৈরাগ্যপনার শিক্ষা দেয় না। বরং কঠোর ভাবে একে প্রত্যাক্ষান করে। উপরন্তু কুরআন তো আরো একধাপ এগিয়ে ঘোষণা করছে “তিনিই সে সত্তা যিনি ভুপৃষ্ঠে যা রয়েছে সব তোমাদের কল্যাণে সৃষ্টি করেছেন।” (বাকারা ঃ ২৯) আল্লাহ তাআলা এ এরশাদের মাধ্যমে বৈরাগ্যপনার বিষবৃক্ষ কেবল সমূলে উপড়ে ফেলেননি। বরং মানুষকে জাগতিক ও বৈজ্ঞানিক চুড়ান্ত উৎকর্ষ সাধনে উৎসাহিতও করেছেন। যেন মানুষ তার জ্ঞান, সাধনা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে কেবল এ পৃথিবীই নয়, মহাবিশে^ ছড়িয়ে থাকা আল্লাহ তাআলার অসংখ্য নেয়ামতরাজি নিজ কল্যাণে বৈধভাবে ব্যবহার করে তাঁর শুকরিয়া আদায় করে।
ইসলামের এ দর্শন মধ্য যুগে খৃষ্টান চার্চের চাপিয়ে দেয়া দর্শনের সম্পূর্ণ বিপরীত। যারা পাশ্চাত্যে বিজ্ঞানের উত্থানপূর্বকালে এক অন্ধকার যুগের সুচনা করেছিল। এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে সীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় দাড়িয়ে গিয়েছিল। কারণ তাদের নিজস্ব তৈরী ধর্মীয় তত্ব ও তথ্যগুলো আধুনিক বিজ্ঞানের সাথে সাংঘর্ষিক ছিল। ফলে তারা জ্ঞান সাধনায় অনুৎসাহ আর বৈরাগ্যপনাকে উৎসাহিত করল। অধিকন্তু দুনিয়া বিমুখতাকে ধর্মীয় লেবাস পরাল। জাগতিক দিক থেকে পিছিয়ে থাকাকে তাকওয়ার মানদ- সাব্যস্ত করল। বিজ্ঞান ছিল তাদের চোখের শূল। বিজ্ঞান চর্চা ছিল ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। বৈজ্ঞানিকদেরকে কঠোর শাস্তি দেয়াকে চার্চের পবিত্র ধর্মীয় দায়িত্ব মনে করা হতো। এভাবে বিজ্ঞান ধর্ম থেকে আলাদা বরং প্রতিপক্ষ সাব্যস্ত হল।
ফল যা হবার তাই হল। বিজ্ঞানের বাস্তবতার বিপরীতে জনতার ধর্মীয় আবেগের বাঁধ এক সময় ভেঙ্গে গেল। যে চার্চের প্রতাপে রাজাধিরাজরা প্রকম্পিত হত। সেই প্রবল প্রতিপত্তিশালি চার্চ ও ধর্মকে তারা নিজেদের সামগ্রিক জীবন থেকে উৎখাত করে কেবল কিছু আচার-অনুষ্ঠান ও দিন বিশেষের মাঝে সীমিত করে ফেলল। ফলে প্রযুক্তির উন্নয়ন ঠিকই হল। কিন্তু মানুষ হল উম্মাদ।
এ সংঘর্ষের দায় কখনোই ইসলামের ওপর ফেলা যাবে না। ইসলাম তো বিজ্ঞানকে স্বাগত জানিয়েছে তার সুচনা থেকেই। ইসলামের মতানুসারে ধর্মের সাথে বিজ্ঞানের সহাবস্থান একটি সুনিশ্চিত বিষয়। একে আলাদা ভাবা বা করার কোনো সুযোগ নেই। এ ক্ষেত্রে অযাচিত বিভাজন সৃষ্টির পায়তারা যে কত ভয়াবহ পরিণতি বয়ে আনতে পারে বিশ^বাসী আজ হাড়ে হাড়ে তা উপলদ্ধি করছে। প্রযুক্তির আগ্রাসী থাবায় পৃৃথিবী আজ আহত-ক্ষতবিক্ষত। ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে মানুষের পরিবার, সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনীতি। নিছক প্রযুক্তির পূজারী পৃথিবীবাসীর হাতে পৃথিবী আর নিরাপদ নয়। তাই বিশ^বাসীর সামনে ইসলাম ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই। ওয়েলকাম টু ইসলাম।
ইসলামী দর্শনের মূল বিশ^াস হচ্ছে সব কিছুর স্রষ্টা আল্লাহ তায়ালা। বস্তু ও আত্মা তাঁরই সৃষ্টি। তিনি আদি, অনন্ত, চিরঞ্জীব, চিরন্তন। তাঁর সমকক্ষ বা তুল্য কেউ নেই। তিনি সৃষ্ট নন; ¯্রষ্টা। তাঁর পিতামাতা, স্ত্রী-সন্তান তথা পূর্বাপর কিছু নেই।
বস্তুর সঞ্চালন, শক্তি বা অন্যান্য গুনাগুণ আল্লাহ তাআলাই সৃষ্টি করেছেন। বস্তুর গুনাগুণ তাঁর সৃষ্টি ও নিয়ন্ত্রণে। মহাবিশে^র কোনো পরমাণু বা সামান্য কিছুও তাঁর অসীম জ্ঞান বহির্ভুত নয়। তিনি সব দেখেন, শোনেন; কথা বলেন। সকল গুণের পূর্ণ সমাবেশ তাঁরই শোভা। তবে তাঁর গুণগুলো সৃষ্টের অনুরূপ নয়। সব দোষত্রুটির উর্ধ্বে তাঁর অবস্থান। গুনাগুণ ও আলামত দ্বারা তাঁকে চেনা যায়। তবে তাঁর স্বরূপ উদঘাটন সৃষ্টের ক্ষমতা বহির্ভুত। তাঁর হুকুম ও ইচ্ছা ছাড়া কারো সামান্য নড়ারও সাধ্য নেই। সব তাঁর হুকুমাধীন। আর তাঁর কোনো হুকুম হিকমত ও কল্যাণ বিবর্জিত নয়। কারো সাধ্য নেই যে তাঁর উপকার বা ক্ষতি করে। তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন; সকলেই তাঁর মুখাপেক্ষী। জীবন-মরণ, সুস্থতা-অসুস্থতা সব তাঁর হুকুমের অনুগামী। তিনি ক্ষমতার উৎস। সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। কাজেই ইবাদতের যোগ্য কেবল তিনিই।
এ দর্শনানুসারে মহাবিশ^সহ কোনো কিছু ¯্রষ্টার পরিকল্পনা ও ইচ্ছা ছাড়া কেবল প্রকৃতির স্বাভাবিক বিবর্তনের ফসল নয়। আল্লাহ তাআলাই তাঁর অসীম কুদরতের মাধ্যমে, বিশেষ উদ্দেশ্যে পরিকল্পিত ভাবে একে অস্তিত্ত দিয়েছেন। বস্তু ও প্রকৃতির বিবর্তন, মহাবিশে^র বাহ্যিক ব্যবস্থাপনা তাঁর তৈরী। সুদৃঢ় নীতিমালার মাধ্যমে সবকিছু তিনি পরিচালনা করছেন। যদিও যাবতীয় নীতির উর্ধ্বে তাঁর অবস্থান। যখন খুশি এসব নীতিমালা তিনি ভেঙ্গে চুরমার করে দিতে পারেন। নমুনা হিসেবে কখনো কখনো তিনি এমন করেও থাকেন।
প্রতিটি প্রাণীর মাঝে তিনি প্রাণ ও অনুভূতি সঞ্চার করেছেন। একেক প্রাণীকে একেক বৈশিষ্ট্য দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। এর মাঝে কোনোটিকে আবার দৃষ্টির অন্তরাল করেছেন। যেমন নূর দ্বারা ফেরেশতা তৈরী করেছেন। যারা কখনোই তাঁর অবাধ্য হতে পারে না। বিভিন্ন দায়িত্বে তাদেরকে নিয়োজিত করেছেন। আর মানুষকে সৃষ্টির সেরা বানিয়ে তাঁর প্রতিনিধি রূপে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। মানুষের কল্যাণে যাবতীয় বস্তু ও উপকরণ সৃষ্টি করেছেন। যেন মানুষ তার জ্ঞান-বুদ্ধি, চিন্তা ও সাধনা ব্যয় করে এগুলোকে জয় করে এবং তাঁর বেঁধে দেয়া সীমায় থেকে নিজ প্রয়োজনে ব্যবহার করে। তিনি কখনোই মানুষকে সাধ্যাতীত কাজের আদেশ করেন না। অধিকন্তু ভুলের পর তওবা করলে তিনি ক্ষমা করেন। চাইলে তিনি দান করেন। তিনি ন্যায় বিচারক। তাই কেউ শাস্তিযোগ্য অপরাধ করলে তাকে শাস্তিও প্রদান করেন। কারো প্রতি অবিচার করেন না।
এ পৃথিবীতে মানুষ কীরূপে তার জীবন পরিচালনা করবে; সেজন্য আল্লাহ তাআলা নিষ্পাপ নবী-রাসূলগণের মানুষের মাধ্যমে সকলকে জীবন বিধান জানিয়েছেন। সেই জীবন বিধান হচ্ছে ইসলাম। সর্বপ্রথম নবী হযরত আদম আ. আর সর্বশেষ নবী হচ্ছেন হযরত মুহাম্মাদ সা.। মাঝে হযরত নূহ, ইবরাহীম, মুসা, ঈসা আ. সহ বহু নবী এ পৃথিবীতে আগমন করেছেন। কোনো কোনো নবীর প্রতি ফেরেশতাদের মাধ্যমে তিনি ছোট-বড় বহু কিতাব পাঠিয়েছেন। যেন তদনুসারে তাঁরা মানুষকে আল্লাহর বিধান জানাতে পারেন। পবিত্র কুরআন হচ্ছে এ ধারার সর্বশেষ কিতাব; যা শেষনবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা.-এর উপর অবতীর্ণ হয়েছে। এরপর আল্লাহ্র পক্ষ থেকে কোনো নবী বা কিতাব আসবে না। কুরআন হিফাজতের দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহ তাআলা গ্রহণ করেছেন। ফলে অদ্যাবধি তাতে সামান্যতম পরিবর্তনও হয়নি। ভবিষ্যতেও কখনো হবে না।
কুরআন ও (কুরআনের ব্যাখ্যা) রাসূলের হাদীসের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা মানুষের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ সংবিধান দিয়েছেন। যার কার্যকরিতা কিয়ামত অবধি বলবৎ থাকবে। কুরআন ও হাদীস ইসলামী শরীয়তের এমন দুটি উৎস যাতে ভবিষ্যতে সংঘটিতব্য সকল বিষয়ের শরঈ সমাধান উল্লেখ রয়েছে। কোনো বিষয়ে বিস্তারিত আর কোনো কোনো বিষয়ে এমন কিছু নীতিমালা বর্ণনা করা হয়েছে যার আলোকে ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞানসম্পন্ন ফুকাহায়ে কেরাম যাবতীয় সমস্যার সমাধান পেশ করতে পারেন। এভাবে তিনি মানুষের জন্য বৈধ-অবৈধ, ভাল-মন্দ, দায়িত্ব-অধিকার ইত্যাদি সবই জানিয়ে দিয়েছেন। তা বুঝার জন্য জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়েছেন। আবার সেচ্ছায় কোনো একটি গ্রহণ করার স্বাধীনতাও দিয়েছেন। এর মাধ্যমে তিনি পরীক্ষা করতে চান যে কে তার বাধ্য আর কে অবাধ্য। এ পরীক্ষার প্রকৃত ফলাফল তো আখেরাতেই প্রকাশ পাবে। তবে কখনো দুনিয়াতেও এর কিছু নমুনা প্রকাশিত হয়।
ইসলামের দর্শনানুসারে দেহÑআত্মার সমন্বিত মানুষ মৃত্যুর মাধ্যমে শেষ হয়ে যায় না। বরং মৃত্যুর পর আত্মা আমাদের দৃষ্টির অন্তরালে অবস্থিত বরযখ নামক ভিন্ন এক জগতে স্থানান্তরিত হয়। তখন দেহ ও আত্মার পূর্বের সম্পর্ক তো বহাল থাকে না। তবে দেহের ধ্বংসাবশেষের সাথে আত্মার এক ধরণের সুক্ষ সম্পর্ক তখনো বিদ্যমান থাকে। যার বিস্তারিত বিবরণ মানুষকে জানানো হয়নি। বরযখ জগতেও দুনিয়ার ভাল-মন্দ কাজের প্রতিফল সীমিত পরিসরে অব্যাহত থাকে।
এরপর যখন কিয়ামত সংঘটিত হবে, মহাবিশ^ ধ্বংস হবে, আর সকল প্রাণীর মৃত্যু ঘটবে; তখন আখেরাতের জগতে সকলকে পুণরায় জীবিত করা হবে। এবং দুনিয়ায় সম্পাদিত সকল কাজের হিসাব নেয়া হবে। যার রেকর্ড আল্লাহ তাআলার নিকট সংরক্ষিত। আল্লাহর অনুগত মুসলিমদেরকে সেদিন অনন্ত কালের জন্য জান্নাত আর অস্বীকারকারী অবাধ্যদেরকে চিরস্থায়ী জাহান্নাম দেয়া হবে। জান্নাত চির সুখ-শান্তির সমাবেশ। আর জাহান্নাম ভয়ানক সব শাস্তির আবাস। মুসলিম হওয়া সত্বেও যারা দুনিয়াতে অপরাধী ছিল এবং তওবা বিহীন মৃত্যুবরণ করেছিল। তাদের যাকে ইচ্ছা তিনি ক্ষমা করে জান্নাতে স্থান দিবেন। আর যাকে ইচ্ছা জাহান্নামে স্থান দিবেন। প্রত্যেক নির্যাতিত, বঞ্চিতকে সেদিন তার অধিকার ফিরিয়ে দিবেন।
ইসলামের এ দর্শনানুসারে কোনো কিছুই প্রকৃতির নিজস্ব নিয়মানুসারে ঘটছে না। বরং আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা ও হুকুমেই সব পরিচালিত হচ্ছে। ইসলামের কোনো কোনো বিষয় এমন হতে পারে যে এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আমাদের জানা নেই। কিন্তু তাই বলে তা পরিত্যাজ্য হওয়ার যুক্তি হতে পারে না। মহাবিশ^ তো বটেই এ পৃথিবীর কতো এমন বিষয় রয়েছে যার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আজো মানুষ জানে না ; তাই বলে কী তার অস্তিত্ব অস্বীকার করা যায়! অধিকন্তু এসব বিষয় তো কেবল ইসলাম কারো মনগড়া বক্তব্য বা শোনা কথার ওপর ভিত্তি করে গ্রহণ করেনি। বরং নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা.- এর সুস্পষ্ট ও সুনিশ্চিত বাণীর ভিত্তিতেই তা গ্রহণ করেছে। যাঁর পবিত্রতা, সততা, বিশ^স্ততার স্বীকৃতি খোদ তাঁর দুশমন কতৃকও স্বীকৃত। তাঁর জীবনী একটি উন্মুক্তগ্রন্থ। যে কেউ তা পাঠ করে এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারে। মানবেতিহাসে কোনো ব্যক্তির জীবনী এতো বিস্তারিত ও সতর্কতার সাথে এতো অধিক ভাষায় রচিত ও সংরক্ষিত হয়নি; যেমন তাঁর ক্ষেত্রে হয়েছে। এছাড়াও তাঁর সততা ও বিশ^স্ততার বহু অলৌকিক ও চাক্ষুষ অনস্বীকার্য প্রমানও বিদ্যমান। সত্যানুসন্ধাণী যে কারো পক্ষে সামান্য প্রয়াসেই যা জানা সম্ভব।
তাছাড়া পূণ অনুসন্ধাণের পরও ইসলামী আকীদা ও দর্শনে কোনো একটি বিষয়ও এমন পাওয়া যাবে না, যার বিপরীতে আধুনিক বিজ্ঞানের অকাট্য প্রমাণ রয়েছে। বরং ইসলামের শ^াশত দাবী তো হচ্ছে বিজ্ঞানের কোনো অকাট্য বিষয় কখনোই ইসলামী আকীদার সাথে সাংঘর্ষিক হতে পারে না। সাংঘর্ষিক হলে কোনো থিওরী ও মতামতের হতে পারে। ফ্যাক্ট বা অকাট্য বাস্তবতার হতে পারে না। এজন্যই কুরআন ও হাদিসে বারবার জ্ঞান সাধনায় নিমজ্জিত হতে উৎসাহ দেয়া হয়েছে। কারণ বিজ্ঞান মানুষের ঈমান বৃদ্ধিতে সহায়কই হবে। সাংঘর্ষিক হবে না।
ইসলাম কখনোই বৈরাগ্যপনার শিক্ষা দেয় না। বরং কঠোর ভাবে একে প্রত্যাক্ষান করে। উপরন্তু কুরআন তো আরো একধাপ এগিয়ে ঘোষণা করছে “তিনিই সে সত্তা যিনি ভুপৃষ্ঠে যা রয়েছে সব তোমাদের কল্যাণে সৃষ্টি করেছেন।” (বাকারা ঃ ২৯) আল্লাহ তাআলা এ এরশাদের মাধ্যমে বৈরাগ্যপনার বিষবৃক্ষ কেবল সমূলে উপড়ে ফেলেননি। বরং মানুষকে জাগতিক ও বৈজ্ঞানিক চুড়ান্ত উৎকর্ষ সাধনে উৎসাহিতও করেছেন। যেন মানুষ তার জ্ঞান, সাধনা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে কেবল এ পৃথিবীই নয়, মহাবিশে^ ছড়িয়ে থাকা আল্লাহ তাআলার অসংখ্য নেয়ামতরাজি নিজ কল্যাণে বৈধভাবে ব্যবহার করে তাঁর শুকরিয়া আদায় করে।
ইসলামের এ দর্শন মধ্য যুগে খৃষ্টান চার্চের চাপিয়ে দেয়া দর্শনের সম্পূর্ণ বিপরীত। যারা পাশ্চাত্যে বিজ্ঞানের উত্থানপূর্বকালে এক অন্ধকার যুগের সুচনা করেছিল। এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে সীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় দাড়িয়ে গিয়েছিল। কারণ তাদের নিজস্ব তৈরী ধর্মীয় তত্ব ও তথ্যগুলো আধুনিক বিজ্ঞানের সাথে সাংঘর্ষিক ছিল। ফলে তারা জ্ঞান সাধনায় অনুৎসাহ আর বৈরাগ্যপনাকে উৎসাহিত করল। অধিকন্তু দুনিয়া বিমুখতাকে ধর্মীয় লেবাস পরাল। জাগতিক দিক থেকে পিছিয়ে থাকাকে তাকওয়ার মানদ- সাব্যস্ত করল। বিজ্ঞান ছিল তাদের চোখের শূল। বিজ্ঞান চর্চা ছিল ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। বৈজ্ঞানিকদেরকে কঠোর শাস্তি দেয়াকে চার্চের পবিত্র ধর্মীয় দায়িত্ব মনে করা হতো। এভাবে বিজ্ঞান ধর্ম থেকে আলাদা বরং প্রতিপক্ষ সাব্যস্ত হল।
ফল যা হবার তাই হল। বিজ্ঞানের বাস্তবতার বিপরীতে জনতার ধর্মীয় আবেগের বাঁধ এক সময় ভেঙ্গে গেল। যে চার্চের প্রতাপে রাজাধিরাজরা প্রকম্পিত হত। সেই প্রবল প্রতিপত্তিশালি চার্চ ও ধর্মকে তারা নিজেদের সামগ্রিক জীবন থেকে উৎখাত করে কেবল কিছু আচার-অনুষ্ঠান ও দিন বিশেষের মাঝে সীমিত করে ফেলল। ফলে প্রযুক্তির উন্নয়ন ঠিকই হল। কিন্তু মানুষ হল উম্মাদ।
এ সংঘর্ষের দায় কখনোই ইসলামের ওপর ফেলা যাবে না। ইসলাম তো বিজ্ঞানকে স্বাগত জানিয়েছে তার সুচনা থেকেই। ইসলামের মতানুসারে ধর্মের সাথে বিজ্ঞানের সহাবস্থান একটি সুনিশ্চিত বিষয়। একে আলাদা ভাবা বা করার কোনো সুযোগ নেই। এ ক্ষেত্রে অযাচিত বিভাজন সৃষ্টির পায়তারা যে কত ভয়াবহ পরিণতি বয়ে আনতে পারে বিশ^বাসী আজ হাড়ে হাড়ে তা উপলদ্ধি করছে। প্রযুক্তির আগ্রাসী থাবায় পৃৃথিবী আজ আহত-ক্ষতবিক্ষত। ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে মানুষের পরিবার, সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনীতি। নিছক প্রযুক্তির পূজারী পৃথিবীবাসীর হাতে পৃথিবী আর নিরাপদ নয়। তাই বিশ^বাসীর সামনে ইসলাম ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই। ওয়েলকাম টু ইসলাম।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন